Golpo romantic golpo হেই সুইটহার্ট

হেই সুইটহার্ট পর্ব ২


হেইসুইটহার্ট__(০২)

নুসরাতসুলতানাসেঁজুতি

আজকের তাপমাত্রা কত হবে? ০°-৫° বোধ হয়। মাথার ওপর সূর্য আছে,কিন্তু তাপ নেই। ধূসর-নীল আকাশে বড্ড ফ্যাকাশে আলো। মুখের চামড়া টানটান হচ্ছে একটু সামান্য বাতাস ছুঁলেই। কুহু খুব তাড়াহুড়ো পায়ে এক্সাম হল থেকে বের হলো। উলের স্কার্ফ দিয়ে ভালো করে ঢাকল মাথাটা। তারপর এক ছুটে চলল মেট্রোর পথে। সেই কোন সকালে বেরিয়েছিল,পেটে এক ফোঁটা দাঁনা-পানি পড়েনি। এখন ডর্মে ফিরে খাবে,একটা হট ওয়াটার শাওয়ার নেবে তারপর সোজা কাজে। মেট্রোতে ভিড় নেই। হতো বাংলাদেশ,পা রাখারও জায়গা পেতো না। কোণের একদম ফাঁকা বেঞ্চ দেখে বসল ও। বাইরের সাই সাই করে ছুটে যাওয়া বরফে ঢাকা গাছগুলো দেখে ফোস করে শ্বাস ফেলল একটু। জীবনটা এখন কেমন যন্ত্রের মতো চলছে। সকালে ওঠা,ক্লাস, এক্সাম,রান্না,একটু নাকেমুখে গুজে খাওয়া,তারপর ডিউটি। তারপর রাত জেগে পড়া, কোনোরকম একটা ঘুম। কোনো আলো নেই,ছন্দ নেই,তাল নেই। আছে শুধু গতি! ঠিক এই মেট্রোটার মতো।
কুহু বাংলাদেশী! ওখানকার পুরান ঢাকায় জন্ম ওর। বাবা খুব নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। তারপর মায়ের সাথে বিয়ে হলো। দূর্ভাগ্যবশত মায়ের সাথে বাবার সংসার বেশিদিনের ছিল না। কুহুর যখন চার বছর বয়স সেপারেশন নিয়ে দুজন দুপ্রান্তে থাকা শুরু করলেন।
কেন,কী জন্য কুহু আজও জানে না ওসব। বাবার সাথে দেখা হতো ছ- মাসে একবার। কালেভদ্রে একবার হয়ত খোঁজ নিতে আসতেন। অথচ কুহু কখনো ওনাদের একটু তর্ক করতেও দেখেনি। ভীষণ কৌতূহলে যদি কোনোদিন আলাদা থাকার কারণ জিজ্ঞেস করতো, মা বলতেন বনিবনা হচ্ছে না। কুহু ভেবে পায় না, এত ভালোবাসার পরেও মানুষ আলাদা হয়ে যেতে পারে? যে মুখ দেখে একদিন কিনা শান্তি মিলতো,সেই মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হতে পারে?
কুহুর চোখ ভিজে উঠল। ভেবে ভেবে একটা চাপা দুঃখে বুকের ভেতরটা টলমল করল খুব। সুইডেনে পড়তে আসায় বাবাই সাপোর্ট করেছিলেন। আদ্যপ্রান্ত খরচাও ছিল তার। তবে এখানে আসার পর ওর সাথে তেমন যোগাযোগ হয়নি। জিমনেসিয়ামে সব ঠিকঠাক কিনা, ডর্মে সব ঠিক আছে কিনা এটুকুর পর রোজকার ফোন করার ঐ আগ্রহ দেখাননি তিনি। এত ছোট মেয়েটা বিদেশে একা পড়ে আছে,এর উর্ধ্বে আর কী জানার চাই? তাই কুহুও আর চাইল না জ্বালাতে। এখানে তো ও নিজের মতোই থাকছে। দেখতে দেখতে কখন যে দুটো বছর ঘনিয়ে গেল টেরই পেলো না! কুহুর ধ্যান ভাঙল রিংটোনের শব্দে।
স্ক্রিনে চেয়ে দেখল একটা চেনা নম্বর ভাসছে। অমনি ঠোঁট টেনে হাসল সে। কানে গুজতেই একটি ধীর,মার্জিত কণ্ঠ ছুটে এলো,
“ হ্যালো কুহু।”
“ আসসালামু আলাইকুম, আলভিন ভাইয়া। কেমন আছেন?”
“ ওপ্স সরি সরি, ওয়ালাইকুমুস সালাম। পরীক্ষা কেমন দিলে?”
“ আমার পরীক্ষার কথা আপনার মনে ছিল?”
“ থাকবে না? তোমার খোঁজ ঠিকঠাক না নিলে তো তোমার বান্ধবী বাংলাদেশ থেকে আমাকে বোমা ছুড়ে মারবে।”
হেসে ফেলল কুহু। আলভিন কুহুর সবথেকে ভালো বন্ধু তিয়াশার বড়ো ভাই। আর ভাগ্যের কী লীলা, দুজনেই এসে একই দেশে পড়েছে। আলভিন বলল,
“ তারপর, বিকেলে ফ্রি আছো?”
“ না। ডিউট আছে তো।”
“ ওহ হ্যাঁ ,তাহলে কোন হলি ডে-তে দেখা করি,এসো। তিয়াশা তোমার জন্য কিছু জিনিস পাঠিয়েছিল,সেগুলো তো দেয়া হলো না।”
“ আমার জন্যে?” বিস্ময়ের সাথে কুহুর মনটাও খারাপ হল অমনি। তিয়াসা ওর সাথে কথা বলে না। একটা ভীষণ রাগের দরুণ যোগাযোগই করে না। কিন্তু ভেতর ভেতর ঠিক নিজের ভাইকে দিয়ে….
ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
আমি আপনাকে জেনে জানাই,ভাইয়া?”
“ ঠিক আছে। অধম তোমার জানানোর অপেক্ষায় রইল। সাবধানে থেকো। সী ইউ সুন।”
কুহু ফোন রাখল, ততক্ষনে রেল এসে স্টেশনে ভিড়েছে। সাথে এসেছে ওর আপাতত গন্তব্যের রাস্তা।

ডর্মে ঠান্ডা একটু কম। রুমে তেমন হুহু ভাব নেই। চারপাশের হালকা শীতেল আবহাওয়া মাড়িয়ে কুহু তাড়াহুড়ো করে কমন কিচেনে ঢুকল। এখানে ওরা ১৫ জনের মতো থাকে। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা রুম,শুধু রান্নাঘর,লাউঞ্জ একটা। কুহু এক পাশে ডিম সেদ্ধ বসাল,সাথে কেতলিতে পানি। শীতে প্রায় হাত পা জমে গেছে, কফি খেয়ে ফটাফট গরম হতে হবে। কিছু সময় পর সেথায় এসে দাঁড়াল এলিন। ও ইটালিয়ান। মাথা ভরতি বাদামি কোকড়া চুল, সাথে টুকটুকে ফরসা গায়ের রং। তবে পড়াশোনার দিক থেকে কুহুর সিনিয়র ও। এলিন আধখাওয়া চাওমিনের প্লেটটা সিংকে রেখে শুধাল,
“ কিয়ু,এক্সাম কেমন দিলে?”
কুহু ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
“ কুহু এলিন!”
“ সরি সরি! খুব কঠিন নাম,মুখেই আসে না।”
“ সমস্যা নেই। আমার এক্সাম ভালো হয়েছে!”
“ পরের এক্সাম কবে?”
“ চারদিন পর।”
এলিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“ তাহলে চলো আজ কনসার্টে যাই।”
ভ্রু কুঁচকে ফিরল কুহু,
“ কনসার্ট!
“ হ্যাঁ কাল বললাম, শোনোনি? সবাই যে প্ল্যান করল।”
কুহু ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
“ কাল তো চিন্তায় আমি নিজের মাঝেই ছিলাম না। একে কিছু পড়িনি,এক্সামে কী লিখব,আবার আমার হাত-মুখ কেটে যাতা অবস্থা। তুমি কি আমাকে ডিমটা ছুলে দেবে?”
“ হ্যাঁ দাও না। ব্যথা কমেনি? পেন-কিলার নিয়েছিলে? কী করে কাটল তাও বললে না।”
কুহু ঠোঁটে ভাঁজ ফেলল। গতকাল রাতের ওই বিভৎস দূর্ঘটনার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেনি সেভাবে। এক পল আঙুলের ব্যাণ্ডেজে তাকাল। ছোট করে জানাল,
“ ছুরিতে কেটেছে।”
এলিন ভ্রু কুঁচকাল,
“ গালটাও?”
কুহু চুপ। এলিন ঘাটল না,
ডিমের খোসাগুলো ছাড়াতে ছাড়াতে নিজের মতো বলল,
“ আজকে তো আমরা সবাই কনসার্ট দেখতে যাব। এইত, উপশালার পাশের শহরেই হচ্ছে। চিফ গেস্ট কে আসবে জানো? মাই হিরো,মাই ড্রিম বয় স্যাম… আমি যদি একবার ওকে একটা হাগ করতে পারি কুহু, আমি আর কোনোদিন গোসল করব না। ওর গায়ের গন্ধ নিয়ে সারাদিন বসে থাকব। শুনেছি ও নাকি ব্লিউ দ্য শ্যানেলের পারফিউম ব্যবহার করে। উফ!
আমার কাজিন একবার দেখেছিল ওকে। কোনোমতে একটা সেল্ফি তুলতে পেরেছিল। বলেছে আমাকে,এত ওয়াইল্ড স্মেল ওর। ইস!”

কুহু হেসে ফেলল। জিমনেসিয়ামে ওর ইয়ার থ্রি চলছে, অথচ কী পাগলাটে কথাবার্তা! নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে দুপাশে মাথা নাড়ল মেয়েটা। পরপর হুট করে কিছু একটা ভেবে কপাল গুছিয়ে গেল তার। মনে পড়ল কালকের গাড়িতে থাকা সেই আহত লোকটার কথা।
ব্লিউ শ্যানেল! কাল ওই লোকটার গা থেকেও তো ও একই ঘ্রাণ পাচ্ছিল। চট করেই যেন রহস্য ধরে ফেলল, লোকটাকে কোথায় দেখেছে কুহু। ও মাই গড! ঐ লোকটা আবার রকস্টার স্যাম নয় তো? এলিনের ক্রাশ! কুহু খপ করে এলিনের হাত ধরে বলল,
“ তোমার রুমে চলো, এলিন।”
“ কেন, কী হলো?”
কুহু জবাব দেয় না। শুধু তড়িঘড়ি করে এলিনকে টেনে রুম অবধি আনল। ভেতরে এসেই সোজা তাকাল স্টাডি টেবিলের সামনের দেওয়ালে। সেখানে সম্রাটের একটা বিশাল পোস্টার টাঙানো। পরনে লেদারের জ্যাকেট, ধূসর বাদামি রঙের চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে কপালে এসে পড়েছে, এক কানে দুল পরা ছেলেটার পিঠে ঝুলন্ত গিটার, ডান হাতে মাইক্রোফোন।
কোনো উত্তাল কনসার্টের স্টেজে গান গাইছে সে। চারপাশ অন্ধকার করে ভক্তদের ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলছে কেবল। সেই জ্বলজ্বলে আলোয় চকচক করছে সম্রাটের সবুজ মনি জোড়া। কুহু ভ্রু টানটান করে ফেলল। মুখের আদল তো সেরকমই লাগছে…
ঘোর ছুটল এলিনের প্রশ্নে,
“ কিয়ু, কী দেখছ বলো না!”
ও হড়বড় করে বলে,
“ এলিন,আমার মনে হয় তোমার রকস্টারের কাল এক্সিডেন্ট হয়েছিল। খুব খারাপ অবস্থা ছিল জানো। সারা মুখ রক্তে…”
এলিন হেসে ফেলল।
“ এক্সিডেন্ট! পাগল হয়েছ?
ওর আজ কনসার্ট আছে। এক্সিডেন্ট করলে কনসার্ট হতো?”
“ কিন্তু আমি যে দেখলাম!”
“ কাইন্ড অফ ইল্যুশন আই থিংক। হয়ত আমার মুখে ওর ব্যাপারে শুনতে শুনতে তুমিও ওকে আমার মত পছন্দ করতে শুরু করেছ। অবশ্য স্যামের ওই গ্রীন আইস, ওর তাকানোর ধরণ, ওর ফিগার,ওর গান,এসবে যে কেউ গলে যাবে। আমি যাই, শাওয়ার নেব। তুমি রাতে গেলে কিন্তু আমাকে জানিও।” এলিন তোয়ালে নিয়ে শাওয়ারে ছুটল৷ কুহু তখনো নিশ্চিত হতে পারল না। কিছুক্ষণ ঠোঁট উল্টে সম্রাটের ছবিতে চেয়ে রইল সে। যদি ওটা স্যাম না হয় তাহলে কে? আচ্ছা যেই হোক, এক্সিডেন্ট যে হয়েছিল সেটাতো সত্যি। এখন কেমন আছে লোকটা ? ইস,পরীক্ষার যন্ত্রণায় কুহু খোঁজ নিতে পারেনি৷ সুযোগ পেলে একবার জানতে হবে ওনাকে কোন হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আর বেঁচে আছে কিনা!


গালের ব্যান্ডেজটা এক টান মেরে তুলে ফেলল সম্রাট। এখনো তাজা ক্ষত, অথচ ব্যথায় এক ফোঁটা মুখও কুচকাল না সে। কপালেরটায় হাত দিতে গেলেই নার্স ছুটে এলেন,
“ আরে এটা খুলবেন না। রক্ত আসবে।”
“ টিপিক্যাল এনোয়িং। এত চেঁচাবেন না। কানে লাগে।”
সম্রাট কপালের ব্যান্ডেজ ছাড়ল,তবে হাতের ক্যানোলাও টেনে খুলল এরপর। গায়ে শার্ট জড়িয়ে চেষ্টা করল এক হাতে বোতাম আটকাতে। পারল না। তাকাল আশেপাশে। নার্স মেয়েটাকে দেখে বলল,
“ দ্য এনোয়িং লেডি,বোতাম আটকে দিন।”
মেয়েটি ভ্রু তুলল কপালে। চোখ ঝাপটাতে দেখেই সম্রাট বিরক্ত হয়। বিড়বিড় করে বলে,
“ গুড ফর নাথিং।”
চিকিৎসক হাসি মুখে মাত্রই ঢুকলেন কেবিনে,সাথে সাথে হাসিটা মুছে চোখ উলটে গেল। যে পেশেন্টের বেডে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকার কথা,সে শরীর টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে?
উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন,
“ মিস্টার স্যাম, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনাকে তো রিলিজ দেয়া হয়নি।”
সম্রাট কথা টথা বলল না। বকবক করতে করতে এগিয়ে আসা ডাক্তারের শরীরটা বুকে এক হাত দিয়ে ঠেলে সামনে থেকে সরাল। বিড়বিড় করে বলল,
“ টিপিক্যাল ইরিটেটিং।”
সম্রাট বাইরে এলো অর্ধ নগ্ন শরীরে। এক হাতের ভেতর শার্টের এক হাতা ভরা, বাকি আরেকটা হাত গলায় ঝুলতে থাকায় জামা পুরোটা পরতে পারেনি। তুহিন উদ্বেগী পায়ে জ্যাকেট নিয়ে এগিয়ে এলো। ভাঙা হাতটা গলিয়ে শার্ট কোনোরকম পরিয়ে জ্যাকেটটাও পরালো ওপরে । তারপর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে গুঁজে দিলো ওর ঠোঁটের কোণে। মিনমিন করে বলল,
“ বস এখনো রিলিজ দেয়নি, আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। এ-এম-এ তে সাইন দিতে হতো না?”
“ নো নিড ফর সাচ টিপিক্যাল ফরমালিটি।
বেশি ঝামেলা করলে হাতে টাকা গুঁজে দাও।
আর এই ঝুলন্ত হাত নিয়ে হাঁটতে ভালো লাগছে না। ডাজেন্ট ম্যাচ উইথ মাই ইমেইজ। আগামী দশদিনের মধ্যে ভালো হবে এমন ডাক্তারের কাছে যাব। খোঁজ নাও।”

“ ওকে বস।”
“ হেডফোন দাও।”
তুহিন ওভার ইয়ার হেডফোনটা চালু করে সম্রাটের মাথায় বসিয়ে দিলো।
সঙ্গে সঙ্গে তারস্বরে বাজল জ্যাকসনের গলায়,
“ The fire’s in their eyes, and their words are really clear!
So beat it, just beat it’’

সম্রাট মাথা দোলাতে দোলাতে, হাত পা চালিয়ে তাল দেয়। এক হাতের আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বিড়বিড় করে গানের সাথে,
“ so beat it,but you wanna be bad,
Just beat it,beat it…”
তুহিন হাঁ করে রইল। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বলল,
“ বসকে দেখে মনেই হচ্ছে না কাল এক্সিডেন্ট করেছেন। নাচছেন,মাই গুডনেস!”
সম্রাট হেসে বলল,
“ আমি কারো দেয়া ব্যথায় কাবু হই না,তুহিন। অন্যকে কাবু বানাই। এতদিন চাকরি করেও এটুকু বোঝোনি।”
“ জি বস!”
“ মেয়েটার কী হলো? বললে বিকেলে পাব,একটা রাত শেষ সেখানে। টিপিক্যাল লায়্যার।”
“ আজকেই নিয়ে আসব বস। আজকেই। আমি আসলে অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে একটু টেন্সড ছিলাম। ওই জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম, আজ রাতে তো আপনার কনসার্ট ছিল। যেজন্যে আমাদের এই এলাকায় আসা। ফুল পেমেন্ট নেয়া সেখানকার। কিন্তু এই অবস্থায় ক্যান্সেল করব কী?”

সম্রাট থেমে দাঁড়াল। ঠোঁট কামড়ে ভাবল,
বলল,
“ না দরকার নেই। এই ভাঙা হাত নিয়ে স্টেজে উঠব,হইচই বাড়বে। একশ-টা ছবি বেশি ক্লিক হবে। লোকজন সিম্প্যাথাইজ
হবে। কারো চোখ ছলছল করবে,মেয়েরা হা হুতাশ করবে। নিউজিপেপারে লেখা হবে। সোস্যাল মিডিয়ায় প্রশংসায় ভাসব। আগামী তিন মাসের জন্যে ট্রেন্ডে থাকব তুহিন। নো নিড ফর এক্সট্রা টিপিক্যাল প্রেসার।”
তুহিন হাসল।
“ স্টারডম কীভাবে ধরে রাখতে হয়, বসের চেয়ে ভালো কে জানে!
“ প্রোগ্রাম রাত বারোটা থেকে বললে না? এক কাজ করো, দেড়টায় স্কেজিয়ুল রাখো। সম্রাটের জন্যে সবাই হাঁ করে বসে থাকবে,তবেই সে পা রাখবে সেখানে। উম,এনি ওয়ে… ড্যাড নাভেদ শেখকে খবর দিয়েছ?”
“ জি, স্যার আসতে চেয়েছিলেন।”
“ দরকার নেই। আমি যাব। আগে মেয়েটাকে দেখা দরকার। তুমি যাও,ওকে আমার অফিসে নিয়ে এসো।”
“ ওকে বস।”
সম্রাট লনে এসে দেখল একটা ঝকঝকে সাদা রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ ওকে দেখতেই নত হয়ে একজন দরজা খুলে দিলেন। সম্রাট কপাল কুঁচকে তুহিনের দিক তাকাল। ছেলেটা স্বদ্যোগে বলল,
“ বস, আপনার গাড়ি টা কাল বাজে ভাবে ভেঙেছে। শুধু একটুর জন্যে ব্লাস্ট করেনি। এখন তো…”
সম্রাট স্থূল স্বরে ডাকল,
“ তুহিন!
আমার এক্ষুনি ওই সেম কালারের,সেম ব্র‍্যান্ডের সেম কার চাই। নাহলে আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়ব না।”
তুহিনের কণ্ঠ শৃঙ্গে,
“ বস এক্ষুনি?”
পরপর মাথা নুইয়ে ঘাড় নাড়ল সে,
“ ওকে বস।”
বিশ মিনিটের মাথায় সেই ডার্ক চকলেট ব্রাউন রঙের আরেকটা নতুন চকচকে মার্সেডিজ-মেবাখ এসে হাসপাতালের সামনে দাঁড়াল। মাত্রই কিনে এনেছে তুহিন। সম্রাট লব্বিতে ছিল, তুহিন ত্রস্ত পায়ে গিয়ে ডেকে আনল তাকে।
“ বস,আপনার গাড়ি।”
ঠোঁট টেনে নিঃশব্দে হাসল সম্রাট। তুষ্ট চিত্তে পিঠটা চাপড়াল তুহিনের। দরজা খুলে দিতেই রাজার মতো উঠে বসল ভেতরে। রোদ নেই,তাও কুচকুচে কালো চশমার আড়ালে নিজের সবুজ চোখ লুকাল। জিজ্ঞেস করল হঠাৎ ,
“ হোয়াট ইজ মাই ফেভ্রেট কালার, তুহিন?”
ছেলেটা গাড়িতে বসতেই যাচ্ছিল,আচমকা প্রশ্নে ভড়কাল একটু। তটস্থ বেগে দাঁড়িয়ে চটপট বললো,
“ ডার্ক চকলেট ব্রাউন, স্যার।”
“ ইয়াহ। ইটস নট যাস্ট আ কালার,ইটস মাই স্টাইল। যেমন আমি ডার্ক ,স্ট্রং, সহজে চোখে পড়ি কিন্তু কারো হাতে ধরা দিই না।”


কুহুর ডিউটি ক্যাফেতে। বিকেল ৫ টা থেকে একেবারে রাত নয়টা অবধি। দুদিন পর ক্রিসমাস,এখন খুব চাপ থাকে এখানে। কুহু ভীষণ ব্যস্ত হয়ে খাবার সার্ভ করছিল,তক্ষুনি
ম্যানেজার ডাকলেন। মাথার ক্যাপ হাতে নিয়ে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল মেয়েটা।
“ ইয়েস স্যার!”
“ ওনারা তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছেন।”
কুহু পাশ ফিরে চাইল। তুহিন সাথে সাথে মাথা হাল্কা ঝুঁকিয়ে বলল,
“ হ্যালো ম্যাম!”
“ হ্যালো স্যার।”
“ ম্যাম, আপনাকে আমাদের সাথে একটু যেতে হবে।”
কুহু অবাক হয়,
“ কোথায়?”
“ আপনি গেলেই বুঝতে পারবেন। চলুন,বস আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
কুহু কপাল কুঁচকে ফেলল,
“ আশ্চর্য, আমি আপনাদের চিনি না জানি না, কে বস না বস তাও জানি না। আপনারা বললেই কেন যাব?”
“ ম্যাম, আমি আপনাকে এখানে ব্যাপারটা বলতে পারব না। বসের নিষেধ আছে। আপনি গাড়িতে বসুন, যেতে যেতে সব বলব।”
কুহু ভীষণ রেগে বলল,
“ এটা কি ইয়ার্কি করার সময়? আপনাদের বস আমাকে ডাকবে কেন? কে সে?
আর, আপনারা বললেই আমি চলে যাব কেন? আপনি দেখতে পাচ্ছেন না আমি এখানে ডিউটি করছি? রাত নটার আগে আমি এখান থেকে বাইরে এক কদমও ফেলি না।”
তুহিন খুব গুছিয়ে বলল,
“ আই ন্যো ম্যাম। কিন্তু , আপনি প্রেসার নেবেন না। আমি ক্যাফের ওনারের সাথে কথা বলেছি। উনি আপনাকে ছুটি দিয়েছেন।”
কুহু চমকে গেল।
তার চেহারা দেখে ফের হাসল তুহিন। বলল,
“ কিছু মনে করবেন না, ম্যাম। আপনাকে নিতে যখন এলাম আসতে তো হবেই। স্বেচ্ছায় না যেতে না চাইলে আপনাকে আমাদের কিডন্যাপ করতে হবে।”
কুহুর মাথায় বোম পড়ল,
“ কীহ?”
“ জি, প্লিজ আসুন! কোনো ক্ষতি হবে না। যাস্ট যাবেন আর আসবেন। আমিই নামিয়ে দিয়ে যাব।”
কুহু ঢোক গিলল। এ কোন মুসিবত এসে দাঁড়াল হঠাৎ। তুহিন বলল,
“ ম্যাম এত ভাববেন না। আমরা কিডন্যাপ করব বলেছি মানে, আজকেই করব না। আপনি যখন ডর্ম থেকে ক্লাস বা ক্লাস থেকে এখানে আসবেন,তখন কোনো একটা সময়ে আপনার মুখে ক্লোরোফর্ম ধরে সেন্সলেস করে গাড়িতে তুলে নেবো। ইটস কোয়াইট ইজি ফর আস।”
কুহু হতবাক,স্তব্ধ। ফ্যালফ্যাল করে দেখল তুহিনের গোলগাল শুভ্র মুখ। পরতে পরতে যেখানে পরিপাটি নির্লিপ্ততা মাখা। পরনে গ্রে স্যুট, গলায় নেভি ব্লু টাই, চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা,চুলগুলো ভদ্র সভ্য ভাবে এক পাশে আঁচড়ানো,চকচক করছে ক্লিন শেভ গাল।
এরকম দেখতে একটা লোক এভাবে কথা বলতে পারে?
পরপর কুহুর বিস্মিত নজর ঘুরে এলো তুহিনের সাথে থাকা কালো শার্ট গায়ে জড়ানো তিনজন পুরুষ থেকে।
ভয়ে ভয়ে শুধাল,
“ আপনারা কি গুণ্ডা?”
“ নো ম্যাম! আমি বসের পি এস,তার ম্যানেজার। আর ওরা বসের বডিগার্ডের কয়েকজন। বাকিরা বসের অফিসে।”
কুহু আশ্চর্য নাহয়ে পারল না। তিনজন বডিগার্ড এখানে,অফিসে আরো আছে? কে রে সেই হরিদাস পাল!
ও দু দণ্ড চুপ থেকে বলল,
“ ঠিক আছে, আমি চেঞ্জ করে আসছি।”
“ সময় নেই, ম্যাম। বস এক্ষুনি ডেকেছেন। আপনি এভাবেই আসুন।”
“ বাইরে এত ঠান্ডা দেখছেন না? ব্লেজা…”
“ ম্যাম গাড়ি এখানেই রাখা,গাড়িতে ঠান্ডা লাগবে না। আসুন, সময় নেই।”


লাউঞ্জ চেয়ারে শরীর রেখে জুতোসহ দুই পা টেবিলের ওপর তুলে বসে আছে সম্রাট। পরনে জ্যাকেট -শার্ট কিচ্ছু নেই। শুধু একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি থাকায়, উন্মুখ হয়ে চেয়ে রইল তার দু-বাহুর ফোলা মাংসপেশী। মাথার পেছন চেয়ারের হাতলে এলিয়ে রাখা, কানে ওভার হিয়্যার হেডফোনটা তখনো আছে। রুম হিটারের তোড়ে বাইরের শীতার্ত তাপমাত্রার আঁচ ছিঁটেফোঁটাও এখানে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্রাটের দু আঙুলে সিগারেট। বাকি অনামিকা আঙুল ভরে পাশে রাখা গিটারের তার টানল,আর টুং টুং করে শব্দ করল সেটা। চোখ বুজে গুনগুন করার সময়ে টোকা পড়ল দরজায়।
“ বস!”
“ কাম ইন।”
তুহিন দরজা ঠেলে উঁকি দিলো একটু।
“ মেয়েটা এসেছে।”
সম্রাট ঘাড় নাড়ল,বোঝাল পাঠাতে। তারপর আস্তেধীরে জ্বলন্ত সিগারেট অ্যাস্ট্রেতে ফেলল। পা দুটো নামাল টেবিল থেকে। এর মাঝেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর ভয়ে চুবিয়ে থাকা মুখ নিয়ে ভেতরে ঢুকল কুহু। সঙ্গে সঙ্গে ব্লিউ শ্যানেলের অন্যরকম কড়া সুগন্ধ এসে বাড়ি খেল নাকে, আর ধক করে কেঁপে উঠল বুকটা। কেন উঠল কে জানে! ততক্ষণে তুহিন ওকে রেখে বাইরে চলে গেছে। গাড়িতে লোকটার থেকে সম্রাটের ব্যাপারে সব শুনেছে কুহু। কাল বাঁচিয়েছে বলে মানুষটা নাকি দেখা করতে চেয়েছেন। হয়ত চাইছেন ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানাতে। কিন্তু কুহুর খুব ভয় লাগছে। এর মানে ও ঠিকই ভেবেছিল,ওই আহত লোক স্যামই ছিলেন। এত নামিদামি একজন রকস্টার, ক্যাফেতে, শপে যার অসংখ্য গান শুনেছে, ম্যাগাজিনে পড়েছে যাকে নিয়ে,পত্রিকার একটা পৃষ্ঠা যার জন্যে সব সময় বরাদ্দ থাকে,বন্ধুদের মুখে মুখে থাকে যার নাম, তার সামনে কী বলবে সে? বাইরে এত ঠান্ডা অথচ মনে হলো অস্বস্তির আগুনে ঘেমে পুড়ে যাচ্ছে ও। মেয়েটার নজর তখন নিচে। কোনোরকম মৃদূ স্বরে বলল,
“ হ্যা-হ্যালো স্যার।”
সম্রাট এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে বসেছে। উত্তর না দিয়ে তীক্ষ্ণ ভ্রু কুঁচকে, চোখ ছোট করে চেয়ে রইল সে। মেয়েটা সত্যিই টিনেজার হবে। গায়ে-পায়ে তো বেশ ছোটো লাগছে। ভ্রু জোড়া পরিমিত বাঁকানো। প্ল্যাগ করা নেই,একদম ন্যাচারাল। সরল-চোখা নাক,লিপবামে ভেজানো লাল দুটো ঠোঁটের রং কিছুটা রোদে শুকনো গোলাপের পাপড়ির মতো। নাকের ডগা ঘেমে গেছে। আশ্চর্য, এই শীতেও কেউ ঘামে? যদিও এখানে রুম হিটার চলছে। ঠোঁটের ঠিক ডান কোণে একটা লাল তিল। চেহারায় জোর করা সৌন্দর্য নেই,তবে এক অদ্ভুতুরে স্বচ্ছতা। চুলগুলো ঢেউয়ের মতো, পিঠ অবধি, পেছনে একটু ঢিল ভাবে পনিটেইল করা। কিছু ছোটো চুল আবার দুপাশ থেকে গালের সাথে ঝুলছে। বা গালে একটা ছোট্ট ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ। ক্যাফের লোগো বসানো ফুল হাতা টিশার্ট, সাথে জর্জেটের কালো স্কার্ট পরনে। আচ্ছা,
মেয়েটা কি বাঙালি?
সম্রাট ওই টুকু সময়েই কুহুকে সূক্ষ্ম ভাবে মেপে ফেলল। একেবারে নজর নামিয়ে এক চোট হাঁটু থেকে মাথা অবধি খুঁটেখুঁটে দেখল ওকে।
ধীর, মৃদূ স্বরে বলল,
“ সীট হিয়্যার।”
কুহু ভেতর ভেতর বেশ ঘাবড়ে যাচ্ছে। সম্রাটের গলার স্বর ভারি। ঠিক মেঘ ডাকা আওয়াজের মতো। মানুষটার মুখোমুখি টেবিলের এপাড়ে রাখা লাউঞ্জ চেয়ারে, মাথা নুইয়ে বসল সে। নত চোখটা গিয়ে সাথে সাথে পড়ল গিটারের তারে রাখা সম্রাটের হাতের ওপর। মাঝের তিনটি আঙুলে প্ল্যাটিনামের তিনটি আংটি পরা। প্রত্যেকটিতে একেকটা ইংরেজি অক্ষর। অনামিকা আঙুলে S, মধ্যমাতে A আর কণিষ্ঠায় পরা M আংটি মিলিয়ে দাঁড়ায় -SAM। এই ব্যাপারটার কথা ও এলিন ছাড়া আরো অনেকের কাছে শুনেছিল অবশ্য। কিছু ছবিতে দেখেছেও। এটা নাকি ওনার নিজস্ব স্টাইল।
মেয়েটা ঐ আনত চিবুকেই জিভে ঠোঁট চুবিয়ে বলল,
“ আমি,আসলে কী বলব বুঝতে পারছি না। আপনি সুস্থ হয়েছেন দেখে ভালো লাগছে। আমার নিজেরই উচিত ছিল আপনার খবর নেয়া, কিন্তু.. কিন্তু আমার এক্সাম আবার জবের প্রেসার মিলিয়ে হয়নি। আপনি এখন ঠিক আছেন,স্যার?”
উত্তর নিতে আস্তেধীরে মুখটা একটু তুলল কুহু। নিভু নজর সোজাসুজি গিয়ে বর্তাল সম্রাটের সবুজ নয়নতারায়। এখনো কেমন নির্বাধ চেয়ে আছে সে। ঐ দৃষ্টি দেখে কুহুর বুক আরেকবার কাঁপল। এই বিরল রঙের চোখ ও ছবি-পোস্টারে হাজার বার দেখেছে। সেখানে যতটা আকর্ষণীয়, অথচ সামনে থেকে কেমন গা হিম করে দেয়ার মতো না!
সম্রাট নিশ্চুপ চোখের মণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেয়েটার গোটা চেহারা দেখল। হঠাৎ বাঁকা নজর পড়ল কুহুর এক পাশের কাঁধের জামার ওপর। দুম করে বলে বসল,
“ ইনারের স্ট্র্যাপ বেরিয়ে আছে।”
কুহু থমকায়,চমকে যায়।
আকাশ থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ে বলে,
“ জি?”
সম্রাটের নিষ্প্রভ চোখ সেদিকেই। পরপর কুহুর স্তম্ভিত চেহারায় চাইল সে। ঘাড়টা এক পাশে একটু কাত করে, খুব শীতেল মেজাজে বলল,
“ ব্ল্যাক,রঙটা ভালো!
but doesn’t suites you tiny lady…”

চলবে…
গত পর্বে যারা একে ক্রাশ ক্রাশ বলছিলা,এই পর্ব পড়েও কি তারা সেই সিদ্ধান্তে অটল? আমি জানতে চাই! 🤣

Share On:

TAGS:



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply