Golpo romantic golpo সোনাডিঙি নৌকো 

সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৮


সোনাডিঙি_নৌকো (৮)

মৃধা_মৌনি


গল্পটা শুরু হয়েছিল স্বামীর মানিব্যাগে নিজেরই বোনের ছবি দেখে। অবাক বিস্ময়ে সেই নিয়ে প্রশ্ন তুললে বিনিময়ে পেতে হয়েছিল হৃদয় ঝাঁঝরা করা সব জবাব! দীক্ষা ভুলে যায়নি, ভুলতে পারবেও না কোনোদিন- কতটা অচেনা হয়ে গিয়েছিল তার সবচেয়ে চেনা পরিচিত এবং আপন ভাবা মানুষটা…
তাকে ছেড়ে দিয়েছিল একটুখানি সম্মান পাওয়ার জন্য, একজন স্ত্রী পাওয়ার জন্য, আরও ভালো থাকবার জন্য।
কিন্তু প্রকৃতি…সে কি কাউকে কম-বেশি দেয়?
না তো! প্রাপ্যের চেয়ে এক আনা কম ও দেয় না, বেশি না… বরং যার যতটুকু পাওনা থাকে, তাকে ততটুকুই ফিরিয়ে দেয় সে। শিশিরকেও ফিরিয়ে দিতে শুরু করেছে। দীক্ষার আর্তনাদ, হাহাকার, চিৎকার, প্রতিটি চোখের অশ্রু ফোঁটা….গুণে গুণে সব ফিরিয়ে দিতে শুরু করেছে এবার।

শিশির হতবিহ্বল চোখে বেশ অনেকক্ষণ তৃণার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার একটা হাত দিয়ে গাল চেপে ধরে রাখা। তৃণা অনবরত তার গাল ডলছে। তার বিষাক্ত চোখের দৃষ্টিও শিশিরের দিকে বিদ্যমান।

ঘরে নীরবতা ছাড়া আর কিছু নেই।
সেই নীরবতা ভেঙে তৃণাই আগে কথা শুরু করল,

—“আমার গায়ে মোটেও হাত দেবার কথা চিন্তা করবেন না। বলে দিলাম। আমি এইসব পছন্দ করি না। আর আপনার সাথে আমি এমন কিছুই করি নাই যে আমার গায়ে হাত তুলবেন ওকে?”

শিশির জবাব দিলো না।
পূর্বের ন্যায় ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তৃণা উঠে দাঁড়াল,

—“আমার অনেক বড় ভুলই হয়েছে আপনার উপর ভরসা করে। আপনি আসলে কিছুই ম্যানেজ করতে পারেন না। নিজের ফ্যামিলি থেকেও বিতাড়িত হয়েছেন আর সেই ঝাল উঠাচ্ছেন আমার উপর। আমি কোন বাল করছি?”

এবার কথা বলল শিশির।
ক্ষীণ স্বরে বলল,

—“আমার জবটা আর নেই তৃণা। আমাকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।”

তৃণার মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ল। অথবা বন্যায় তার ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। কিংবা তাকে বলা হয়েছে এই মুহূর্তে তার জীবন কে ড়ে নেওয়া হবে- এমন ভাবেই বিস্ফোরিত হলো সে। প্রায় ধপ শব্দে বসে পড়ল শিশিরের সম্মুখে। স্তব্ধ গলায় উচ্চারণ করল,

—“এখন?”

এর জবাব শিশিরের কাছেও নেই। তাই সে চুপ করে রইল। তৃণা অস্থির হয়ে উঠল। এগিয়ে এসে উদ্বেগ ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

—“কি হলো বলেন না! কি হবে এখন? আপনি আরেকটা জব ম্যানেজ করে ফেলেন না। আপনি তো অনেক এডুকেটেড।”

শিশির কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

—“আমি অনেক এডুকেটেড এটা তোমাকে কে বলল?”

—“আপা।”

শিশির থমকে গেল। ওর পড়াশোনা আহামরি কিছু না। ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে পড়াকালীনই এই কোম্পানিতে ঢুকে যায়। দীক্ষার জন্যেই অবশ্য পড়াশোনার মাঝখানে এভাবে একটা কর্মক্ষেত্রে ঢুকে যাওয়া। তাও আহামরি স্যালারি যে ছিল তা না। তবে তার একার জন্য এনাফ ছিল। সংসারের চাপ সেভাবে ঘাড়ে পড়েনি কখনোই। বেশিরভাগ খরচটাই বড় ভাইয়া বহন করতেন। তাছাড়া এই কোম্পানিতে ঢোকার পেছনেও ভাইয়ার একটা অবদান ছিল। তার রেফারেন্সেই শিশিরের চাকরিটা অত সহজে হয়েছিল। সহজে হয়েছিল বলেই বোধহয় সহজে চলেও গেল। ভার্সিটির শেষ দুই বছর খুব খারাপ ভাবে কে টে ছি ল শিশিরের। জব করে, সংসারে মন দিয়ে আর পড়াশোনার প্রতি ইচ্ছে থাকত না। খুব টানাটানিতে পাশ মার্ক তুলেছিল শেষমেশ। এরপর মাস্টার্স আর করেনি। ভাবেইনি পরবর্তীতে আরও ব্যাপক পড়াশোনা বা সার্টিফিকেটের দরকার হতে পারে।

কিন্তু এই কথাগুলো কখনোই কাউকে বুঝতে দেয়নি দীক্ষা। অন্যের সামনে বরাবরই তাকে বড় করে রেখেছে সবসময়। ভালো রেজাল্ট নিয়ে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে এমনটাও জানিয়েছে সবাইকে। তাছাড়া তার চাকরিক্ষেত্রে বেতন স্কেলটাও সবার কাছে সামান্য বাড়িয়ে বলেছে। সে কখনো চায়নি শিশির অন্যদের সামনে ছোট হোক বা ছোট ফিল করুক! হয়তো তৃণাকেও সেই বলেছে, শিশির ওয়েল এডুকেটেড!

—“কি হলো? কি ভাবতে বসে গেলেন? আপনি আবার ইন্টারভিউ দিতে শুরু করলেই একটা না একটা জব তো হয়ে যাবেই তাই না? আপনার রেজাল্ট তো ভালো ছিল।”

শিশির বিরক্তিসূচক গলায় বলল,

—“আমাকে ভাবত দাও তৃণা। বললেই তো হলো না। চাকরি কি পান্তাভাত নাকি? চাইলেই পেয়ে গেলাম! তাছাড়া এই জবটাও আমার রেফার করা ছিল। তাই পেয়েছিলাম। সার্টিফিকেট গুলোও সব বাসায়। কি যে করি…”

তৃণা স্তম্ভিত গলায় বলল,

—“আপনার ফোনে ছবি টবিও তোলা নেই? এগুলো তো একটা কপি ফোনে রাখে মানুষ নাকি!”

—“জ্ঞান দিও না আল্লাহর দোহাই লাগে মুখটা বন্ধ রাখো। হাতে যা টাকা আছে তা দিয়ে খুব বেশিদিন চলতে পারব না। আর শোনো, যতদিন না জব টব গোছাতে পারি, ততদিন এই বাসা থেকে এক পা ও নড়তে পারবে না। এখানেই থাকা লাগবে। তাতে ভালো লাগুক আর না লাগুক।”

—“আর বিয়েটা?”

শিশির সময় নিলো এই উত্তরটা দেবার জন্য।
বিয়ে করতে গেলে তার খরচ আছে। সত্যি কথা বলতে এখন সেইসব দিকে খরচ করতে ইচ্ছে করছে না। পকেটে খুব বেশি এমাউন্ট নেই। তাই দিয়ে নেক্সট জব ঠিক হওয়া পর্যন্ত চলতে হবে। ব্যাংকে যে কয়টা টাকাপয়সা আছে তার দিকে ভুলেও হাত দেওয়া যাবে না। ওটা শিশিরের বিপদের বন্ধু। এরচেয়েও বড় বিপদ আসতে কতক্ষণ?

তৃণা অস্থির কণ্ঠে বলল,

—“কি হলো? আমাদের বিয়েটা কখন হবে?”

শিশির গলার স্বর শীতল করে বলল,

—“জবটা গুছিয়ে নেই।”

—“ততদিন বিয়ে ছাড়াই আপনার সাথে এক বিছানায় থাকব?”

—“তাহলে চলো কোনো মসজিদের হুজুরের কাছে গিয়ে বিয়ে পড়ে আসি।”

—“কেন? এভাবে তো হয় না। কাজীর কাছে যাব। অথবা কোর্ট ম্যারেজ করব।”

—“সেটাতে তো দেনমোহর ধরতে হবে তৃণা।”

—“ওটা না ধরে কি বিয়ে হয় নাকি?”

—“কিন্তু এই মুহূর্তে দেনমোহর পরিশোধ করার মতো অবস্থা আমার নেই।”

—“এখন দিতে হবে না। কিন্তু আমি কোর্ট ম্যারেজ ছাড়া বিয়ে করব না। কি ভরসা, দুদিন পর আপনি আমাকেও না ছেড়ে দেন, যেভাবে বড় আপাকে ছেড়ে দিয়েছেন।”

শিশির হা করে তাকিয়ে রইল। বিষয়টা বুঝতে পেরে থতমত খেল তৃণাও। এই কথাটা বলা ঠিক হয়নি… বুঝতে পেরে সে কথা ঘুরিয়ে নিতে বলল,

—“না মানে আমি আসলে একটা নিশ্চয়তা চাচ্ছিলাম। আর কোর্ট ম্যারেজ তো হালকা পাতলা বিষয় না। আমার মা ও এতদিনে জেনে গেছে যে আপনার সাথে আমি… মানে আপার সংসার ভেঙে দেওয়ার পেছনে আমিই দায়ী। কিন্তু আমাদের ব্যাপারটা তো উনাকে বোঝাতে পারব না। তাই মা যাতে কোনো ঝামেলা না পাকাতে পারে, তাই আমি আমাদের বিয়েটা শক্তভাবে করতে চাচ্ছি।”

শিশির এ ব্যাপারে কিছুই বলল না ভালোমন্দ।
তবে জানতে চাইল,

—“ঠিক আছে। এত করে যখন বলছ তখন নাহয় হবে কোর্ট ম্যারেজ। ৫০ হাজার টাকা কাবিনে বিয়ে করে নিবো। রাজি আছ?”

তৃণা আহত হলো,

—“মাত্র ৫০ হাজার? এটা একটা এমাউন্ট হলো! কাউকে বলতেও বিবেকে বাঁধবে আমার। না বাবা না, আমি এত কম দেনমোহরে বিয়ে করব না।”

—“তাহলে কত চাও তুমি?”

—“মিনিমাম ৫ লাখ।”

—“কত?”

—“৫ লাখ। ৫ এর পরে ৫ টা শূন্য।”

শিশির তৃণার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল এবং আশ্চর্যজনক ভাবে দেখল, যে মুখটা এক সময় তার সমস্ত চিন্তা, পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করত, সেই মুখটাই আজ বড্ড অচেনা, অন্যরকম। কয়টা রাত একসাথে গেল দুজনার? দুটো মাত্র! আর তাতেই কিনা চেনা মানুষটি এত অচেনা হয়ে উঠল?


জানালা সামনে দাড়িয়েই আবার সরে গেল দীক্ষা। ভেতরে বড় মামী রমিলা সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় বসে আছেন। চোখজোড়া জলে ভর্তি, সম্ভবত উনি কাঁদছিলেন। দীক্ষার এত খারাপ লাগল। এই মামী একসময় তাকে বড়ই আদর করতেন। বকুলকেও তিনি ততটা আদর করেননি। কেন এতটা আদর করতেন, তা জানা নেই তার তবে তার প্রিয়জনদের ভেতর রমিলা মামি অন্যতম একজন।

ভেতর থেকে রমিলার ভরাট কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

—“কে রে? দীক্ষায় না?”

দীক্ষা জানালার পাশে দাঁড়িয়েই জবাবে বলল,

—“হ্যাঁ মামী, আমি।”

—“আয় মা, সরে গেলি ক্যান? এদিকে আয়। তুই যে আসছিস, আমি শুনছি কিন্তু তুই আমার সাথে দেখা করতে আইলি সবার পরে। মনে বড় দুঃখ পাইলাম রে মা।”

দীক্ষা কি বলবে, বুঝতে পারল না। তাই চুপ করে রইল।
রমিলা নিজেই এসে জানালার পাশে দাঁড়ালেন। তার পরনে ঘিয়ে রঙা সুতির শাড়ি। দীক্ষা চমকালো। কোন ফাঁকে শাড়ি পরে ফেললেন? পাগল মানুষগুলোর কর্মকান্ড খুবই তাড়াহুড়োতে হয় বুঝি…

রমিলার ঠোঁটে চমৎকার হাসি। উপচে পড়ছে ঢেউয়ের মতোন। দীক্ষা সাহস করে জানালার সামনে যেতেই তিনি হাত বাড়িয়ে দীক্ষার পেটের উপর রাখলেন। যেন কিছু একটা বুঝছেন, এরকম ভঙ্গিমায় ক্ষণকাল একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে হাসিমুখে বললেন,

—“ভালো আছে রে মা। খুব ভালো আছে তোর মাইয়া। আসার প্রস্তুতি নিতেছে। জলদিই আসবে।”

দীক্ষা মুচকি হাসল,

—“তুমি যে কি বলো না মামী! মাত্র ছ মাসে পড়বে। আরও অনেক সময়।”

—“তার আগেই তোর মেয়ে তোর কোলে থাকবে দেখে নিস।”

—“তুমি কিভাবে জানলে ও মেয়ে? ছেলেও তো হতে পারে।”

রমিলা সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন,

—“ওর নাম পরী রাখিস। পরীর মতোই রে। কি সুন্দর চোখ মুখ। চুল গুলি হবে দীঘল কালো।”

—“যদি ছেলে হয়?”

রমিলা জবাব না দিয়ে হাসলেন আবারও।
দীক্ষা বলল,

—“তুমি না বড্ড রহস্য করো মামী।”

রমিলা বললেন,

—“রহস্যই তো জীবন। জীবনে রহস্য না থাকলে বাঁচার উদ্দেশ্য কি?”

দীক্ষা অবাক হলো। সেই সঙ্গে মুগ্ধতাও কাজ করল। কে বলবে পাগল লোকের কথা এইসব! কি সুন্দর স্বাভাবিক মানুষের মতো করেই কথাবার্তা বলছে।

রমিলা ডাকলেন,

—“দীক্ষা মা, শোন।”

—“বলো মামী।”

—“মাথা আউলা মামুষরে মাবুদ বড়ই মায়া করে। তাদের দোয়া বুলেটের গতিতে গিয়ে তার আরশের দরজায় ধাক্কা মারে। সেই দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। আমি তোরে বড়ই পছন্দ করি। তোর জন্য খাস দিলে দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোরে পৃথিবীর সেই সুখে সুখী করেন, যা তোরে কোনোদিন নিসঙ্গ হইতে দিবে না।”

রমিলা জানালার আড়ালে সরে গেলেন। গায়ের কাপড় খুলে বসলেন বিছানায়। পরনে কেবল পেটিকোটটা রয়েছে। ওটাও যেকোনো মুহূর্তে খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে যেতে পারেন। তাই দীক্ষা সরে এলো। তার চোখে পানি টলমল করছে।

রান্নাঘর থেকে দুধ চিতইয়ের থালা হাতে বেরিয়ে এলো বকুল। শান্ত ভাই এসেছে। তাকে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই যাচ্ছিল সে, দীক্ষার ডাকে থমকালো।

দীক্ষা বলল,

—“বড় মামী কাপড় চোপর সব খুলে বসে আছে রে।”

বকুল স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

—“মাথা বেশি খারাপ থাকলে এমন করে মাঝে মাঝে। তুমি তা নিয়ে একদম ভেবো না তো।”

—“ভাবছি না। কিন্তু কোনো পুরুষ যদি জানালা দিয়ে দেখে তবে…”

বকুল বলল,

—“জানালায় পর্দা দিলে উনি চিৎকার চেঁচামেচি করে তামাম দুনিয়া একত্র করেন। আব্বা অনেক চেষ্টা করেও পারেনি। তাই আমরা কেউ আর বিশেষ মাথা ঘামাই না। আর ওদিকে তেমন কেউই যায় না।”

দীক্ষা ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বকুল আবারও বলে উঠল,

—“এসব নিয়ে ভেবো না তো আপা। পুকুর পাড়ে যাবে? চলো, সবাই ওখানে। শান্ত ভাই, কাজল…”

দুবোন হাঁটতে লাগল পুকুরের দিকে।

—“শান্ত আজকেও এসেছে নাকি?”

প্রশ্ন করে দীক্ষা। বকুল বলল,

—“হু।”

—“আজকে আবার কোন কেরামতি দেখায়, কে জানে।”

বকুল সামান্য লজ্জা পেল।

—“উনি আসলে খুব ভালো আপা, একটু হাবাগোবা টাইপ। কিন্তু ভাব করবে বিরাট বুদ্ধিমান!”

—“তুই বুঝি ওকে খুব চিনিস?”

—“না মানে ছোট থেকেই তো দেখছি। আমরা যে মক্তবে আরবি পড়তে যেতাম, উনিও আসতো সেখানে। একদিন ও ঠিক করে ছবক দিতে পারত না। হুজুরে মে রে দুই হাত লাল বানালেও সে কাঁদত না উলটা চিৎকার করে হুজুরকে অভিশাপ দিতো। হুজুরের বাড়িতে রাতের বেলা ঢিল ছুঁড়ত। বাথরুমের পেছনে লুকিয়ে একদিন হু হু করে তাঁকে ভয় ও দেখিয়েছিল। কি ভীষণ ভয়! হুজুর ভাবছে জ্বিন ভূত নাকি… তাছাড়া তার ছোট মেয়েটাকে পেলেই থাপড়ে দিতো। হুজুরের কাছ থেকে পড়া ছেড়ে আসার অনেকদিন পরেও এই যন্ত্রণা করে গেছে।”

দীক্ষা হেসে বলল,

—“ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার।”

—“হুম। সবসময় গুন্ডাদের মতো চলে। কিন্তু ভেতর থেকে একদম তার উলটো। যার তার প্রতি মায়া হয়ে যায় সহজেই। যেই সেই মায়া না, কঠিন মায়া। একদিন এক কুকুর ছানার মৃ ত্যু দেখে আমি তাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেও দেখেছি আপা। জিজ্ঞেস করায়, আমায় সে কি ধমক…”

কথা বলতে বলতে ওরা এসে দাঁড়াল, গতদিনের সেই জায়গায়, যেখানে উলটে পড়ে কাঁদায় মাখামাখি হয়েছিল শান্ত গতদিন।

কাজলের মাথায় চাটি মা র ছিল শান্ত, ওদেরকে দেখে ভদ্র সাহেবের মতো দাঁড়াল। গলার স্বর পরিবর্তন করে সুন্দর ভাবে কথা বলার চেষ্টা করল।

—“কেমন আছেন আপনি?”

শান্ত হকচকিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই মাথা এদিক ওদিক দুলিয়ে বলার চেষ্টা করল, জি ভালো আছি। কিন্তু গলার স্বরের এই পরিবর্তন আনার জন্যই নাকি অতিরিক্ত নার্ভাসনেস থেকেই- গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে ব্যাঙের মতো আওয়াজ বের হলো।

শান্ত গলা ঝেড়ে পুনরায় বলল,

—“জি ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন?”

—“হ্যাঁ আছি। আপনার শরীর কি ভালো হয়েছে? বকুল বলল, আপনার জ্বর গায়ে তাই না খেয়েদেয়ে চলে গেছেন গতকাল। এখন অবস্থা কি?”

শান্তর এত ভালো লাগল।
মানুষটা কত ভালো! তার শরীর ভালো না, সেটা মনে রেখে দিয়েছে! আবার জিজ্ঞেস ও করছে…

সে ঘাড় কাত করে বলল,

—“খুব ভালো আছি। একেবারে চমলক্কো টাইপ ভালো।”

—“এটা আবার কি জিনিস?”

—“ছাতার মাথা আপা, উনি সবসময় এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করে।”

বলল বকুল,

—“এই নেন, এই পিঠা ফুপু আপনার জন্য পাঠাইছে।”

শান্ত বাটিটা তুলে নিলো। তখনো তার চোখজোড়া দীক্ষার দিকেই নিবদ্ধ। বকুলের নজর এড়িয়ে গেল না। সে চুপচাপ এক কোণে গিয়ে দাঁড়াল।

—“আপনার ও ভালো আছে?”

সাহস পেয়ে নিজে থেকেই কথাবার্তা চালাতে লাগল।
দীক্ষা না বুঝতে পেরে বলল,

—“আমার ও মানে?”

—“ও মানে ওই যে ও.. “

শান্ত আঙুল তুলে পেটের দিকে ইশারা করতেই দীক্ষা হেসে উঠল শব্দ করে।

—“মুখে বললেই হয়। এত আনইজি ফিল করার কি আছে? হ্যাঁ ভালো আছে আমার বাবু! থ্যাংকিউ, জিজ্ঞেস করার জন্য।”

—“না আসলে আপনি কি ভাবেন না ভাবেন…”

—“আমি কিছুই ভাবব না। আমি ব্রড মাইন্ডেড পারসন।”

শান্ত মাথা ঝাঁকাল। ওদের চারজনের আড্ডা জমে উঠল মুহূর্তে। তবে বকুল বরাবরই চুপ রইল। কেন যেন তার এই মুহূর্তে কথা বলছে ভালো লাগছে না।

কথায় কথায় দীক্ষা বলল,

—“বাসায় বসে যদি কিছু একটা করা যেতো। ভালোই হতো।”

কাজল বলল,

—“আপা, তুমি ব্যবসা করো না। আজকাল তো ঘরে বসেই অনেক মেয়ে মানুষ ব্যবসা বানিজ্য করতেছে।”

দীক্ষা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল,

—“বুদ্ধিটা যে খারাপ তা না, তবে কি নিয়ে ব্যবসা করব? তাই তো মাথায় ঢোকে না। জামাকাপড় আর কসমেটিকস এসবের ব্যবসা অহরহ।”

—“তুমি মাটির জিনিস নিয়ে ব্যবসা করতে পারো আপা।”

—“নাহ, প্যারা রে অনেক!”

—“উমম তাহলে রেজিন দিয়ে কিসব বানায়, কত সুন্দর শো-পিস, ওসব নিয়ে?”

দীক্ষা এবারেও মাথা দোলালো,

—“না রে, ওগুলো নিয়ে আমি পারব না। নিজে বানাতে হবে। আমার এত ধৈর্য কই! আর সুন্দর যে হবে, তারই বা কি গ্যারান্টি?”

এই ফাঁকে শান্ত বলল,

—“আমি একটা কথা বলি?”

দীক্ষা তার দিকে শরীর ঘুরিয়ে চাইলো,

—“বলুন।”

—“আপনি গামছার ব্যবসা করুন।”

—“গামছা?”

শান্ত মহাউৎসাহে মাথা ঝাঁকালো,

—“হ্যাঁ গামছা। গ্রামের অর্গানিক গামছা নিয়ে শহরে সাপ্লাই দিবেন। আপনি চাইলে আমি আপনার এসিস্ট্যান্ট হতে চাই। মনে করেন যত দৌড়াদৌড়ির কাজ সব আমার…”

দীক্ষা কি বলবে ভেবে পেল না। তার হাসি পাচ্ছে। কিন্তু বেচারা এমন আগ্রহ দেখিয়ে বলছে, হাসলে পরে মনে কষ্ট পেয়ে বসবে। তাই সে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে কোনো মতে কথা কা টা ল,

—“আচ্ছা ভেবে দেখি আগে। প্রস্তাব সুন্দর।”

শান্তর বুক গর্বে দুই গুণ ফুলে উঁচু হয়ে উঠল। তার বুদ্ধিটা দীক্ষার পছন্দ হয়েছে! আহ.. আর কি চাই তার! গল্প করতে করতে অনেকটা সময় গড়ালো। যাওয়ার পথে বকুল শান্তর কাছ থেকে পিঠার বাটিটা নিতে গেলে শান্ত বলল,

—“পিঠা মজাই হইছেরে। আরেক বাটি এনে দিস।”

উত্তরে গম্ভীরমুখে বকুল জানাল,

—“আর খাওয়া লাগবে না। গামছার ম্যানেজার হইছেন না। সেদিকে মনোযোগ দেন।”

প্রায় রাগ দেখিয়েই বাটিটা কে ড়ে নিলো সে। তারপর গটগটিয়ে হাঁটা ধরল। শান্তর ভ্রু কুঁচকে গেল মুহূর্তে। অকারণে এই মেয়ে তাকে রাগ দেখালো কেন!
শান্ত বিড়বিড়িয়ে স্বগতোক্তি করল,

—“আর কিছু থাক বা না থাক, রাগটা একদম ষোলো আনা ভইরা দিছে মাবুদে… মাইয়া মানুষ…হাহ!”


পড়ন্ত বিকেল বেলা। শিশির দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাসার মেইন গেইটের সামনে। কলিংবেল টিপতে চেষ্টা করছে অনেকক্ষণ যাবত কিন্তু পারছে না। কেন যেন একটা জড়তা কাজ করছে মনের মধ্যে। মাত্র দুইদিন হবে, এই বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে সে। কিন্তু এতেই মনে হচ্ছে, কতগুলো বছর হয় আপন মানুষগুলির সাথে দেখা হয় না। তাদের কাছ থেকে সে সরে গিয়েছে দূরে… বহুদূরে…

ভেতর থেকে শর্মিলার কণ্ঠ ভেসে আসছে। সে তার বাচ্চাকে কিছু একটা নিয়ে বকছে ভীষণ। সেই সঙ্গে শোনা গেল সায়েমা বেগমেরও কণ্ঠস্বর। শর্মিলাকে মানা করছেন।

—“ও ছোট মানুষ, কি বোঝে বড় বউমা! থাক আর বইকো না তো।”

শিশিরের হঠাৎ করেই মনটা ভারী হয়ে উঠল। নিজেকে এই পরিবারের দূরের একজন মনে হতে লাগল। অথচ তারি মা, তারই ভাই-ভাবি…হঠাৎ মুখের উপর দরজাটা খুলে যেতেই শিশিরের ভাবনার গতিপথ বন্ধ হয়। সে অবাক হয়ে দেখে রুমেল সামনে। ফিটফাট ড্রেসে, কোথাও একটা বেরোবে মনে হয়।

—“তুই?”

চমকে ওঠে রুমেলও।

শিশির থতমত খাওয়া চেহারা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না।

—“তুই এখানে কেন?”

রুমেলের কণ্ঠস্বর হঠাৎই কঠিন হয়ে ওঠে।

—“আমি…”

—“হ্যাঁ তুই, এখানে কেন? কি চাইতে আসছিস?”

ভেতর থেকে সায়েমা বেগম ও এগিয়ে এলেন এবারে। শর্মিলাও আছে, কোলে বাচ্চা, একটা তফাতে দাঁড়িয়ে…
শিশির মায়ের দিকে তাকাল। স্কুলে মা রা মা রি বা ঝগড়া করে আসার পর যেভাবে আহ্লাদি ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে একটুখানি আদরের আবদার করে বাচ্চারা, ঠিক সেভাবে। বড় ভাইয়া নাহয় তার উপর রাগ করে আছেন। কিন্তু মা.. মাও কি একবার ভেতরে ডাকবে না?দুইটা খেতে সাধবে না? মা কি জানে, তার শিশির এই দুটোদিন ধরে ঠিক করে খাওয়াদাওয়াও করতে পারছে না। অথচ একটা সময় ছিল, একবেলা খাবার মিস দেওয়ার সুযোগ থাকত না মায়ের কারণে। ধরে বেঁধে মে রে পিটে হলেও খাওয়াতেন সায়েমা বেগম।

—“কি হলো? চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কি জন্যে আসছিস এখানে? বল..”

ভেতর থেকে শর্মিলা কটাক্ষ গলায় বলে উঠল,

—“তোমার নতুন বউ ভেগে গেছে নাকি শিশির?”

সেই প্রশ্নের জবাবেও তার দিকে একবার তাকাল না শিশির। তার দৃষ্টি শুধুমাত্র সায়েমা বেগমের উপরই নিবদ্ধ। চোখজোড়ার অসহায়ত্ব যেন বোঝাতে চাইছে, আজ কতটা রিক্ত, শূন্য, ক্লান্ত শিশির.. মায়ের সান্নিধ্য পেতে চাইছে তার ভুবুক্ষ বক্ষস্থল!

সায়েমা বেগম বুঝলেন কি না কে জানে।
তিনি শর্মিলাকে ডেকে বলে উঠলেন,

—“ও বোধহয় ওদের জামাকাপড় নিতে আসছে। ওকে দিয়ে দাও। ছেলেকেই ত্যাগ করে দিছি, ওসব দিয়ে করব কি? দিয়ে দাও বড় বউমা, সব দিয়ে দাও। আর ওই মেয়েটার যা যা আছে তাও বের করে দাও। আর রুমেল, ওকে বলে দে, সব যেন একবারেই নিয়ে যায়। বারবার যেন আমার দুয়ারে এসে এভাবে না দাঁড়ায়। আমি মন থেকে মুছে ফেলেছি, শিশির নামের আমার কোনো সন্তান ছিল। তাই ওর চেহারাটা বারবার দেখে সে কথা মনে করতে চাই না আর।”

প্রায় ক্লান্ত দুর্বল ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলেন সায়েমা বেগম। শর্মিলা দরজায় এসে দাঁড়াল,

—“আসো ভেতরে আসো। কি কি লাগবে নিয়ে যাও ভাই। আর তোমার বউয়ের ও যা যা আছে সব নিয়ে যাও। আমরা এত ছোটলোক না, এসব রেখে কি করব? আর মা কি বলছেন, শুনছ না? যা লাগে একবারে নিয়ে বিদেয় হও। আর আসবে না।”

যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে রুমেল বেরিয়ে পড়ল এরপর। শর্মিলাও এগিয়ে গেল শিশিরদের বেডরুমের দিকে। হয়তো সব বের করে দেবে সত্যি সত্যি। এর জন্যেই তো এসেছিল শিশির। জামাকাপড় না তবে নিজের সার্টিফিকেট গুলো নেওয়ার জন্য। সেখানে বোনাস হিসেবে জামাকাপড়, ব্যবহার্য সবই পাচ্ছে। তার তো খুশিতে আত্মহারা হবার কথা। অথচ শিশির অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, তার বুকের ভেতরটা অস্বাভাবিক ভাবে জ্বলছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা পুড়ে ছাঁই হয়ে যাচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে। পানি জমেছে নাকি? চারপাশ ঝাপসা ঝাপসা কেন? শিশির মায়ের ঘরের দরজার দিকে তাকাল, ভেতর থেকে বন্ধ। সে যাওয়ার সময়েও সেই দরজার দিকে তাকাল। অথচ সায়েমা বেগম একটিবারের জন্যেও দরজা খুলে ছেলের মুখ দেখলেন না আর…

(চলবে)


এক লাখ+ মানুষ গল্পটা পড়ে অথচ রিয়েক্ট করতে গেলে এত কিপটেমি কেন সবার? আমিও কিপটেমি করব, পর্ব দিবো না হুহ 😮‍💨

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply