সোনাডিঙি_নৌকো (৪)
মৃধা_মৌনি
হাসপাতালের করিডরটা একেবারে নিস্তব্ধ। শুধু মাঝে মাঝে স্ট্রেচার টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দ আর স্যানিটাইজারের হালকা গন্ধ ভাসছে চারপাশে। দীক্ষা সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় আধশোয়া। বুকের ভেতরটা এখনো কাঁপছে ঝড়ের পরের নৌকোর মতো করে।
মাথার উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল দীক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে একফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল ডান চোখের কার্নিশ ঘেঁষে। সায়মা বেগমের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তিনি ধরে আসা গলায় স্নেহমিশিয়ে জানতে চাইলেন,
—“এখন কি একটু ভালো লাগছেরে মা?”
দীক্ষা সে কথার জবাব দিতে পারল না। আচানক কিছু একটা মনে হতেই তড়িঘড়ি নিজের পেটের উপর হাত রাখল সে। সায়মা বেগম বললেন,
—“ভালো আছে। কিচ্ছু হয়নি।”
দীক্ষা চোখ বুজে নিলো। তার অবচেতন মন হয়তো ভেবেছিল, ও আর নেই। না থাকলেই কি ভালো হতো না একদিক দিয়ে? যেখানে সম্পর্ক্ টারই স্থান নেই, সেখানে ও তো মূল্যহীন। তৃণাও আজ তাই বলল। শিশির নিজে নিজের সন্তানকে মে রে ফেলতে ওর পেটে লাথি দিলো। তবু নাহয় বাবা ছাড়া ওকে বড় করবে দীক্ষা। কিন্তু বড় হয়ে বুঝতে শেখার পর যখন বাবার আদরের অভাব বোধে কুণ্ঠিত হয়ে পড়বে তার সন্তান তারই চোখের সামনে, সেই আফসোস কী করে মেটাবে সে? দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুক চিঁড়ে।
সায়েমা বেগম কিছু একটা বলতে নিবেন, এমনি সময়ে ডাক্তার আর নার্স একত্রে ঢুকল কেবিনে। সায়েমা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। দীক্ষাও চোখ মেললো।
ডাক্তার বললেন,
—“হ্যাল্লো ইয়াং লেডি, আপনার সেন্স ফিরেছে তাহলে, থ্যাংক গড। আপনার বেবি আর আপনি দুজনেই সুস্থ আছেন আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এরকম হলো কি করে? আরও কিছুক্ষণ ব্লিডিং হলে বেবিটাকে রাখা আমাদের জন্য টাফ হয়ে যেতো।”
সায়েমা বেগম বললেন,
—“সিড়ি থেকে পড়ে…”
দীক্ষা অবাক চোখে শ্বাশুড়ির দিকে তাকাল। ডাক্তার বললেন,
—“এই সময়ে সিড়ি বাইতে গেছেন কোন দুঃখে? যাইহোক, নেক্সট থেকে খুব সাবধানে থাকবেন। ভালোই ব্লাড রিলিজ হয়েছে, তবুও যে ও আছে, এটা একটা চমৎকার মিরাকেল বলতে গেলে। মেডিসিন যা দিচ্ছি, নিয়ম মাফিক খাবেন এন্ড কাইন্ডলি ফুল বেড রেস্টে থাকবেন। নো সিড়ি বাওয়া বাওয়ি। আন্ডারস্ট্যান্ড ইয়াং লেডি?”
দীক্ষা কোনোরকমে মাথা কাত করে হ্যাঁ জানাল। সায়েমা বেগম বললেন,
—“ওকে কখন ছাড়বেন ডাক্তার সাহেব?”
সকালেই ছেড়ে দিচ্ছি। সমস্যা নেই। আপনাদের বাসা নাকি কাছেই। সাবধানে নিয়ে যাবেন এবং পুরোপুরি বেড রেস্টে থাকে যেন।
—“জি অবশ্যই।”
প্রেসক্রিপশন প্যাডে আরও কিছু ঘচঘচ করে লেখা শেষে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন। দীক্ষা সাথে সাথে বলে উঠল,
—“আপনি সত্যিটা লুকালেন আম্মা?”
সায়েমা বেগম দীক্ষার শিয়রের কাছে বসলেন আবারও। মাথায় হাত রেখে বললেন,
—“ভুল বুঝিও না মা। এখন আর ঝামেলা বাড়াতে চাইছি না। তুমি আগে সুস্থ হও, তারপর এ ব্যাপারে যা করা যায় করব। শিশিরকে আমি শাস্তি দেবো, সেটা আগেও তোমাকে বলেছি।”
—“শাস্তি দিলেই কি সব অপরাধের ক্ষমা হয়ে যায় আম্মা?”
—“তাহলে তুমি কি করতে চাও রে মা?”
দীক্ষা ক্ষণকাল চুপ থেকে ধীরস্থির কণ্ঠে জানাল,
—“আমি বাসায় যাবো না আর। আমাকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিন।”
সায়েমা বেগম বিস্মিত হয়ে উঠলেন,
—“এটা কি বলছ মা? তুমি কেন বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে?”
—“কারণ এই বাড়িতে আমার সন্তান সেফ নেই। যখন তখন তার উপর… আজ সে বেঁচে গেছে আল্লাহর দয়ায় কিন্তু আগামীতে আবার যদি। তাছাড়া আম্মা, আমি এসব আর নিতে পারছি না। আমার মানসিক ভাবে একটু স্থির হওয়া প্রয়োজন। ঠান্ডা মাথায় ভাবা প্রয়োজন, আমি কি করব, কি করব না। আপনি দয়া করে আমাকে আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন আম্মা।”
সায়েমা বেগমের চোখ ভিজে উঠল। তিনি জবাবে কিছু বলতে পারছেন না। তার মনে পড়ে গেল সেই দিনটির কথা, যেদিন শিশির প্রথম তাকে জানিয়েছিল দীক্ষার ব্যাপারে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। জুম্মাবারের নামাজ। রুমেল আগে ভাগেই তৈরি হয়ে গেছে। সায়েমা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ততা সামলাচ্ছেন। এর ভেতর দেখলেন, রুমেল একাই নামাজের জন্য বেরিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে শিশির নেই। সায়েমা বেগম শিশিরের ঘরে গেলেন। অবেলায় ছেলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ভারী পর্দা টানানো। আধো আলো আধো অন্ধকার হয়ে আছে পুরো ঘরটা।
—“এখনো বিছানা ছাড়িসনি! রুমের এ কি হাল? আমার কি চৌদ্দটা হাত নাকি তোর বাবা দশটা দাসী দিয়ে গেছে হ্যাঁ? এতবড় ছেলে এরকম অগোছালো…”
সায়েমা পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আলোময় হয়ে উঠল ঘর।
—“এই গরমে কাঁথা মোড়ায়ে রাখছিস ক্যান? উঠ…উঠে গোসলে যা। নামাজ পড়তে যা। নামাজ না পড়লে দুপুরের ভাত নাই।”
শিশির উঠল না। জড় বস্তুর ন্যায় পড়ে রইল তবুও।
—“কি হলো? আমি কি বলছি, কথা কানে যায় না। উঠ শিশির উঠ…”
সায়েমা বেগম ছেলের গায়ের উপর থেকে কাঁথা টেনে সরিয়ে নিতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। শিশির কাঁদছে! কারণ কি জিজ্ঞাসা করতেই ছেলেটা হুড়মুড়িয়ে মায়ের পায়ের উপর পড়ে গিয়ে বলেছিল, দীক্ষা নামের মেয়েটিকে সে বড্ড পছন্দ করে। তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু তার ছোট চাকরি, ওর বাবা রাজি হচ্ছে না, ভালো পাত্র দেখছেন। মা যেন একটু কথা বলে দেখে।
সেই শিশির…
কত কষ্ট করে দীক্ষাকে এ বাড়ির বউ করে তুলল!
অথচ আজ? সায়েমা বেগম দু’চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। টপটপ করে তা গড়িয়ে পড়তে লাগল দীক্ষার কপালের উপর। দীক্ষা তরল গলায় বলল,
—“কাঁদবেন না আম্মা। ভাগ্যে যা ছিল তাই হচ্ছে। আপনিই না একসময় আমাকে বলেছিলেন, আমি শিশিরের ভাগ্যে ছিলাম বিধায় শত ঝড়ের পরেও ওর হয়েছি? তাহলে এগুলোও আমার ভাগ্যেই লেখা নিশ্চয়ই। নইলে এমনটা হবার কথা ছিল বলুন? ছিল না।”
সায়েমা দীক্ষার কপালে পড়া অশ্রু ফোঁটা গুলি মুছে দিতে দিতে বললেন,
—“আমি তোমাকে তোমাদের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। তারপর নিজেও এই বাড়ি ছেড়ে যেদিক দুচোখ যায় চলে যাবো। এই শেষ বয়সে এসে এসব অনাচার দেখা ভাগ্যে লিখে রেখেছিল বিধাতা!”
—“আমি কাল সকালেই যেতে চাই আম্মা।”
—“বাসায় যাবা না আর?”
—“না। আপনি আমার জামাকাপড় সব আনানোর ব্যবস্থা করুন। এখান থেকেই আমি বাড়ি যাবো।”
সায়েমা বেগম জবাবে কিচ্ছুটি বললেন না।
বাইরে রাত গভীর হচ্ছে। রাস্তায় দু একটা নেড়ি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে। দেয়াল ঘড়ির কাটাটা টিকটক শব্দে এগিয়ে চলছে। এছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই।
—“মায়ের কাছে চলে যাবে, এটা কেমন কথা আম্মা! আপনার ছেলেরে আমি সব জানাইছি। সে সকালের গাড়িতে উঠতেছে। আসুক, তারপর একটা…”
শর্মিলার কথার মাঝখানেই সায়েমা বেগম বললেন,
—“ও হাসপাতাল থেকেই গাড়িতে উঠবে। ওর কথা আমি ফেলতে পারি নাই। মেয়েটার জন্য আমি কিছুই করতে পারতেছি না। শেষ কথাটা অন্তত রাখি।”
—“আপনার ছেলে অনেক রাগ হবে। সে বলছে শিশিরকে এসে থাপড়ে ঠিক করে ফেলবে।”
সায়েমা মুচকি হাসলেন,
—“শিশির কি ছোট বাচ্চা? থাপড়ালেই যদি সব সমাধান হয়ে যেতো তাহলে এই থাপ্পড় টা আমিই দিতে পারতাম বড় বউ মা। পারতাম না?”
এবারে আর বলার কিছু খুঁজে পেল না শর্মিলা। চুপচাপ বাবুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সায়েমা বেগম বড় লাগেজে যত্ন সহকারে দীক্ষার জামাকাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিস সব গোছাচ্ছেন। ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ার সময় শিশির এসে দাঁড়াল তার সামনে। কাচুমাচু মুখে জানতে চাইল,
—“আম্মু, ও কেমন আছে?”
তিনি কটাক্ষ করে বললেন,
—“কোন খবর জানতে চাও? ভালো না মন্দ? ভালোটাই দেই। তোমাকে ছেড়ে সে চিরতরে চলে যাচ্ছে। এখন তুমি সব ঝামেলা মুক্ত।”
—“আমি সে কথা বলিনি আম্মু।”
—“কিন্তু যেটা শুনতে চেয়েছ আমি সেটাই বলেছি।”
শিশিরকে পাশ কাটিয়ে সায়েমা বেগম, শর্মিলা দু’জনেই বের হয়ে গেল। শিশির একা একা বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। ডাইনিং এর দরজা ধরে পর্দার আড়ালে সরে দাঁড়াল তৃণা। সে কি এই মুহূর্তে শিশিরের কাছে যাবে নাকি যাবে না- ভেবে পাচ্ছে না।
জানালার কাঁচ নামিয়ে রেখেছে দীক্ষা। শোঁ শোঁ করে হাওয়া ঢুকে পড়ছে গাড়ির ভেতর, চোখ-মুখে ছুঁয়ে দিচ্ছে ঠান্ডা ছোঁয়া। কিছুক্ষণ আগেও চোখদু’টো জ্বালা করছিল, এখন খানিকটা আরাম লাগছে। চোখ বুজে নিলো সে। গাড়ি ছুটে চলেছে নির্জন হাইওয়ে ধরে। সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছে যাবে—এই আশা।
মাকে খবর দেওয়া হয়েছে। মা খুব একটা ভালোভাবে নেননি খবরটা। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি ভাইয়ের সংসারে একটা বাড়তি বোঝার মতো করেই পড়ে আছেন। সেই জায়গা থেকেই দীক্ষাকে মানুষ করেছেন, তৃণাকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। বাবার রেখে যাওয়া সামান্য জমানো টাকাগুলো কত হিসেব করে, কত আঁটসাঁট করে খরচ করেন, দীক্ষা জানে খুব ভালো করেই। এখন সেখানে ফিরে গেলে ক’দিন বা টিকবে তাদের জীবনযাপন? ভাবলে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে।
তবু শিশিরের মুখটা আর সহ্য হয় না। ওই মানুষটার সঙ্গে টেনে-হিঁচড়ে সংসার নামক সম্পর্কটা আর চালিয়ে নেওয়া যায় না। সংসার কি জোর করে হয়? ভালোবাসা কি ঠেলেঠুলে টিকিয়ে রাখা যায়?
চোখের কোণে হঠাৎ করেই জমে ওঠে জল। দীক্ষা তা মুছে না। আজ তার পাশে কোনো চেনা মুখ নেই, তাই আড়াল করারও প্রয়োজন নেই। ড্রাইভার নিরবে গাড়ি চালিয়ে চলেছে, একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি।
সঙ্গে আসতে চেয়েছিলেন সায়েমা বেগম। বারবারই বলেছেন, “একলা যেয়ো না মা, আমি যাই তোমার সঙ্গে।” কিন্তু দীক্ষা মানা করে দিয়েছে। এই পথটা একাই হাঁটতে হবে তাকে। যখন সামনে আরও বড়ো, আরও একাকী এক জীবন অপেক্ষা করছে, তখন এইটুকু পথও নাহয় একাই পাড়ি দিক। এখন থেকেই নাহয় অভ্যেস করে নিক নিঃসঙ্গতার, শিখে নিক কি করে কাউকে না ভরসা করেও বেঁচে থাকা যায়।
বিদায়ের সময় সায়েমা বেগম ভীষণ কাঁদছিলেন।
দীক্ষা জানে না, কোনো শাশুড়ি ছেলের বউকে মায়ের বাড়ি পাঠানোর সময় এমন করে কাঁদে কিনা। বারবার তার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন,
—“যতটা কে ড়ে নিয়েছে লোকে, তার চেয়েও বেশি যেন ফিরিয়ে দেয় উপরের মালিক…।”
তারপর কপালে, গালে, এমনকি হাতে ভালোবাসা ভরা একাধিক চুমু রেখে দিলেন।
দীক্ষা সেই মমতায় ভিজে রওনা দিয়েছে।
এই মমতাময়ী মানুষটির সঙ্গে জীবনের যে অল্পটুকু সময় ভাগ করতে পেরেছে, সেটাই যেন বড়ো আশীর্বাদ। রিজিকে হয়তো বেশিদিন লেখা ছিল না, কিন্তু আফসোসও নেই। এই ভালোবাসা, এই ছোঁয়া, এই আশীর্বাদ নিয়েই সে আবার শুরু করবে এক নতুন পথচলা।
ঘরটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আজ। কেবলমাত্র একটা মানুষ যে দীর্ঘ দুটি বছর এ বাড়ির সদস্য হয়ে ছিল, আজ সে নেই। চরম অভিমানে চলে গেছে। কবে ফিরে আসবে, আদৌও আসবে কিনা, জানা নেই সায়েমা বেগমের। মেয়েটির সঙ্গে র ক্তে র কোনো সম্পর্ক ও নেই তার। তবু হৃদয়ে কেন এত র ক্ত ক্ষরণ হচ্ছে?
সায়েমা বেগম সোফায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন। গত রাত থেকে পানি ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি তার। শর্মিলা সে জন্যেই তাড়াহুরো করে এক কাপ চা বানিয়ে এনে দিলো।
—“আম্মা, চা।”
সায়েমা বেগম না তাকিয়েই বললেন,
—“খেতে ইচ্ছে করছে না বড় বউমা। নিয়ে যাও।”
—“রাত থেকে তেমন কিছুই খাননি। তার উপর ছোটাছুটি করছেন। আপনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলে…”
—“সেই তো ভালো হয় বড় বউমা। ম রে গেলেই ভালো। যা হচ্ছে তা আর সহ্য করতে হতো না।”
শিশির আশেপাশেই ছিল।
এগিয়ে এসে নির্লিপ্ত গলায় বলল,
—“হায়াত ফুরোলে এমনিতেই ম র বে আম্মু। অযথা এখন নিজেকে অসুস্থ না বানিয়ে খাওয়া দাওয়া করে নাও। তুমি না খেয়ে থাকলে যে চলে গেছে, সে কি ফিরে আসবে?”
সায়েমা বেগম ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে বলে উঠলেন,
—“ফিরে আসার মতো এমন কোন রাজকার্য টা করেছিস তুই হ্যাঁ? রাস্তার ছেলেরাও তোর চেয়ে ভালো। অশিক্ষিত মূর্খরাও তোর চেয়ে জ্ঞানী। নিজের স্ত্রীকে কতটা সম্মান আর শ্রদ্ধায় রাখতে হয়, তাদের সেটা জানা আছে। নিজে অপরাধ করছিস, অথচ বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বোধ ও নাই। তোর গর্ভবতী বউ একা একা গ্রামে চলে গেছে, তার মায়ের বাড়িতে। বিন্দুমাত্র সেন্স ও কি কাজ করতেছে না শিশির? এই তোকে আমি পেটে ধরছিলাম? এমন অজাত আমার গর্ভে কি করে আসলো!”
—“তুমি বেশি বলতেছো আম্মু। একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে আমার যা পছন্দ-অপছন্দ, আমি সেটা জানাতে পারব না? এখানে আমি অপরাধ করে ফেললাম?”
—“ফেলিস নাই? এখনো তোর মনে হচ্ছে না,কি করছিস তুই? আল্লাহ…”
সায়েমা শিশিরের হাত চেপে ধরলেন। তারপর তাকে টানতে টানতে মেইন গেটে নিয়ে এসে থাপড়ে বাসা থেকে বের করলেন।
—“কোনোদিন এই বাড়ির ত্রিসীমানাতেও আসবি না তুই। আমি মনে করব শিশির নামের আমার কোনো ছেলে নেই। আমার একটাই ছেলে- রুমেল। বের হ, বের হ তুই…”
তৃণা এসে দাঁড়িয়েছিল ভয়ে ভয়ে, ডাইনিং এর দরজা ধরে, শর্মিলা গিয়ে তাকেও টেনে নিয়ে এলো।
—“আম্মা এই শাকচূন্নীরেও বের করেন। গেলে এইটারে নিয়ে যাক। ওরে এইখানে রেখে আমরা করবটা কি?”
—“বের হ, দুই নরকের কীট…”
তৃণাকেও ধাক্কা মে রে বাসা থেকে বের করে দিলেন সায়েমা বেগম। শর্মিলা দাঁত খিঁচে চিবিয়ে চিবিয়ে তৃণাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—“নাও, এবার সংসার করো দু’জন মিলে। ওভার ব্রিজের নিচে বসবে। শিশির সাজবে অন্ধ, প্রতিবন্ধী আর তুমি সাজবে ওর দরদিনী বউ। যে দিনের আলোয় ভিক্ষা করে আর রাতে পর পুরুষের বিছানা গরম করে স্বামীর জন্য টাকা আদায় করে। তোমার তো গলায় অনেক সুর। মনেও অনেক প্রেম। সুর দিয়ে গান ধরবা, আল্লাহর ওয়াস্তে একটা টাকা ভিক্ষা দেন গো আম্মাজি…”
তৃণা হতভম্ব মুখে তাকিয়ে রইল।
সন্ধ্যা হওয়ার কথা ভেবেছিল দীক্ষা। কিন্তু কুসুমকলিপুরে পৌঁছোতে পৌঁছোতে অনেক রাত হয়ে গেল। চারপাশ তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির হেডলাইটের আলো কুয়াশার ভেতর ঢুকে আবার হারিয়ে যাচ্ছে যেন কোথাও। রাস্তার দুই ধারে তালগাছ আর বাঁশঝাড়। হালকা বাতাসে তাদের ছায়া দুলে উঠছে টিমটিমে আলোর মতো। মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের ডাক। চারপাশের এই নৈঃশব্দ্য দীক্ষার বুকের ভেতরটা আরও ভারী করে তুলছে।
গাড়ির দরজা খুলে নামতেই এক রাশ ঠান্ডা হাওয়া এসে তাকে জাপটে ধরল যেন। ঢাকায় শীত এখনো ‘আসি আসি’ করছে, কিন্তু কুসুমকলিপুরে সে দলবল নিয়ে চলে এসেছে। বাতাসে ধানের খড়ের গন্ধ, মাটির কাঁচা সোঁদা গন্ধ, আর তার সঙ্গে এক অচেনা নিস্তব্ধতা। শ্বাস নিতে কেমন হিম লাগে। দীক্ষা দু’হাত বুকে জড়াল, ওড়নাটা ভালো করে গলায় টেনে নিলো।
গাড়ির সামনের দিক থেকে এগিয়ে এলো দু’জন।
—“আপা, চিনলেন?”
হাসিমুখে বলল একজন। বয়স কুড়ির কোঠায়, চোখে মায়া, কণ্ঠে আত্মীয়তার ছোঁয়া। এ হচ্ছে বড় মামার ছোট ছেলে- কাজল।
তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা কিন্তু অন্যরকম। লুঙ্গি পরনে, তার ওপর কালো ফুলহাতা শার্ট। হাতার ভাঁজ পুরো হাতটাকেই ঢেকে রেখেছে। বোতামগুলো কলার অবধি আটকানো। মাথার চুল আবার খাড়া খাড়া। গায়ের রঙ টা এই রাতের আঁধারে ভালো বোঝা গেল না। তবে চোখে টলটলে একরাশ চঞ্চলতা খেলে গেল যা নজর এড়ালো না দীক্ষার।
দীক্ষা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না স্থির হয়ে। একবার হাত নেড়ে, একবার পা নাচিয়ে, একবার গলা খাঁকারি দিয়ে সারাক্ষণ ছটফট করছে। হাবভাবে তাড়াহুড়ো। কপালটা খানিক কুঁচকে রেখেছে। যেন এই শীতের রাতে কম্বলের ওঁম ফেলে এখানে আসতে তার বড্ড কষ্ট হয়ে গেছে।
কাজল পরিচয় করানোর ভঙ্গিমায় বলল,
—“এ হইছে শান্ত ভাই। দুইবার মেট্রিক ফেইল করায় তার বাপে মা র তে মা র তে আমাদের উঠানে আইনা ফেলছিল, মনে আছে? আপনি ভয় খাইছিলেন যে….সেই শান্ত ভাই।”
দীক্ষা হালকা হাসল। তার মনে পড়েছে ঘটনাটা। সে নিজে তখন সেভেনে পড়ে। এক বিকেলে উঠানে বিরাট মা র পি ট, হাঙ্গামা। এমন হাফপ্যান্ট পড়া খালি গায়ের ছেলেকে তার বাবা বেধরক ভাবে পেটাচ্ছেন। সবাই প্রথমে আহা উহু করলেও পরে জানা গেল, ছেলে দুই দুইবারই মেট্রিক দিয়ে ফেইল। এমন ছেলেকে নিশ্চয়ই চুমু খাবে না কেউ!
শান্ত বড্ড বিরক্ত হলো। কটমট করে কাজলের দিকে চাইলো।
—“ইন্ট্রোডাকশন দিবি ভালো কথা। ভালো একটা কথা বলতে পারলি না? সবখানে আজাইরা প্যাচাল…ফাউল।”
কাজল মিনমিনিয়ে বলল,
—“সরি শান্ত ভাই।”
—“ইজ্জত পাংচার যা করার করছোসই। এখন যাইয়া ওই ব্যাগগুলা নামা, যা। আর আপনই এই লাইটটা হাতে রাখেন। দেইখা দেইখা পাও ফেলেন। কাঁদা নাই, সব শুকনা। তাও পইড়া টইরা গেলে পরে…আসেন।”
দীক্ষা নিশ্চুপে টর্চ লাইটটা হাতে নিলো। ছেলেটা এগিয়ে এসে লাইট দেবার সময় কেমন একটা ঝনঝন শব্দ হলো। দীক্ষা বলল,
—“কীসের শব্দ!”
কাজল বলল,
—“আপা, শান্ত ভাইয়ের বুক পকেটে দুনিয়াদারি জিনিস থাকে সবসময়। সেই গুলার শব্দ।”
শান্ত বিরক্তি ঠোঁটে আবারও বলল,
—“আবার একটা আজাইরা কথা! আমি কি মহিলা মানুষ নাকি? সঙ্গে সংসার নিয়া ঘরমু! পকেটে কয়েন আছে। কয়েনে ঠোকাঠুকি খাইছে। তার শব্দ। এই কাজল, তোর কোনো কাজে আমারে আবার ডাক দিস।”
—“সরি শান্ত ভাই। সো সরি। এই যে মুখ বন্ধ। আর একটাও কথা বলব না। আপনে একটু ব্যাগ টা নেন, আমি একলা পারতেছি না।”
—“মুখেই জোর, কামের বেলায় ঠনঠন! হুহ…ছাড়, ব্যাগ ছাড়, আমি একলাই নিতেছি।”
কাজল ব্যাগ ছাড়ল। শান্ত নিচু হয়ে ব্যাগের হাতল ধরতে নিতেই বুক পকেট থেকে হুড়মুড় করে কয়টা কয়েন, একটা চিরুনি, একটা সানগ্লাস, একটা ক্রিমের পাতাও পড়ল। দীক্ষা আবারও শব্দ পেয়ে টর্চের আলো ফেলল সেগুলোর উপর। সঙ্গে সঙ্গে সশব্দে হেসে উঠল সে। সেই সঙ্গে কাজল ও। শান্তর ইচ্ছে করল, কাজলকে এই শীতের রাতে জামাকাপড় ছাড়া খেজুর গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে সারা রাত….
(চলবে)
😉।
Share On:
TAGS: মৃধা মৌনি, সোনাডিঙি নৌকো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
সোনাডিঙি নৌকো গল্পের লিংক
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৭
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৬
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ২
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৫
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১২
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৮
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৯
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১১