বেলতুলি – [১৬]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
ভর দুপুরে এশার প্রাইভেট পড়া শেষ হয়। সে নিজের বোনেদের কাছে পড়তে চায় না। বোনেদের দেখলে নাকি তার ঘুম পায়। এজন্য তাকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই প্রণভের কাছে পড়তে দিতে হয়েছে। প্রণভ আপাতত টিউশনি করাচ্ছে। ব্যাচ, বাড়ি গিয়ে পড়ানো এসবই। অন্তত সে খালি হাতে বসে থাকতে চাইছে না। এশার প্রণভের পড়ানোর স্টাইল পছন্দ হয়েছে। তার ভাষ্যমতে সবারই পড়ানোর নিজস্ব ধারা থাকে। প্রণভেরও তাই। এছাড়া তাকে এশার ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ। প্রায়ই তার সহপাঠী লুবনার কানে ফিসফিস করে বলে,
–“প্রণভ ভাইয়াকে নায়ক নায়ক লাগে কেন? আমি কি বড়ো হলে ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারব? কতদিনে বড়ো হবো?”
লুবনাও তখন গুণতে বসে। কত বছরে বিয়ে করা দরকার, এশার সাথে প্রণভের বয়সের গ্যাপ কত সেটাও বলে। বয়সের গ্যাপ শুনলে এশা হতাশ হয়। ভাবে, সে কেন রিমঝিমের মতো বড়ো হলো না? তবে সেও রত্নার মতো শো-অফ করত, বলে বেড়াত তার বিয়ে হতে চলেছে।
আচ্ছা, বিয়ে কী? এই প্রশ্নটাও এশার মাথায় ঘুরঘুর করে। তবে সে এটা বুঝেছে, আব্বু-আম্মুর একসাথে থাকা, ঝগড়া করাকেই বিয়ে বলে। এর মানে কি প্রণভের সাথেও তার রোজ ঝগড়া করতে হবে? কিন্তু প্রণভ তো ঝগড়া করতে জানে না, উলটো তাকে হাওয়াই মিঠাই, চিপস কিনে দেয়। সে তো এসবেই গলে যায়। রত্নার কাছে গিয়ে কী জিজ্ঞেস করবে কীভাবে ঝগড়া করতে হয়? সে রত্নাকে দেখে এটুকু বুঝেছে রত্না চাইলে যার তার সাথে চুলাচুলিও করতে পারবে। রত্না আপুর মায়ের তো প্রায়ই পাশের বাড়ির আন্টির সাথে ঝগড়া হয়। তা তো এশা আর মৌনো মিলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে। এত টান টান উত্তেজনা।
এশা জুতো পড়ে বের হবে, ওমনি প্রণভ এসে ডাকে।
–“আসো, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিই।”
–“না ভাইয়া, আমি যেতে পারব।”
প্রণভ হাসে। রিমঝিমের এত মিষ্টি বোন। চোখ গুলো প্রায়ই রিমঝিমের সাথে মিলে যায়। প্রণভ ওকে একা ছাড়ল না, কিছুটা এগিয়ে দিবে বলে স্থির করল। এশাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
–“রিমঝিমের কী অবস্থা? রেগুলার যায় তো হসপিটাল?”
এশা মাথা তুলে প্রণভের দিকে তাকায়। প্রণভ প্রায়ই তাকে রিমঝিমের কথা জিজ্ঞেস করে। এবারও সে ভদ্র বাচ্চার মতো জবাব দিল।
–“যায়, তবে আপু একটু অসুস্থ।”
–“অসুস্থ? কী হয়েছে?”
–“জ্বর। আপুর বিয়ে ভাঙার পর থেকে আব্বুরও নাকি সারাদিন মাথা ঘুরে।”
এশার কথাতে প্রণভকে চিন্তিত দেখাল। এমন সময়ই তার মোবাইল বেজে উঠল, স্ক্রিনে তাকাতেই দেখল তার আব্বার কল। এই মুহূর্তে প্রণভ চেয়েও এশাকে বাড়ি অবধি দিয়ে আসতে পারল না। গলিতে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
–“দুঃখিত, আমার একটু বাজারে যেতে হবে। তুমি যেতে পারবে তো?”
এশা ঘাড় কাত করে বলল,
–“পারব, আমি অনেক শক্তিশালী। আমি একা বাড়ি ফিরতে পারি।”
প্রণভ হাসে, এশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সে চলে গেল। এশাও গুণগুণ করতে করতে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। তার গলা শুকিয়ে গেছে, বাসায় গিয়ে আম্মুর কাছে ট্যাঙের শরবতের আবদার করবে। এমন সময়ই তার সামনে জাবির এসে দাঁড়ায়। এশা দাঁড়িয়ে যায়।
–“কি চাই?”
জাবির হাসে এশার কাণ্ডে। এই একটা মেয়ে তাকে ভয় পায় না, কেমন বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখো। অথচ মৌনো তাকে সবসময় এড়িয়ে চলে। জাবির হেসে বলল,
–“খবর কেমন ছুটকি?”
এশা বিরক্ত হয় জাবিরের ডাকে। এই নামটা তার একদমই পছন্দ না।
–“বাড়ি যাব।”
–“শালীটা এক্কেবারে বইনের মতোন হইছে, সারাক্ষণ ছটফটানি।”
–“ব্যাগ ভার ভাইয়া, কাঁধ ব্যথা করছে। আমি কিন্তু তোমাকে এড়িয়ে বাড়ি চলে যাব।”
–“আইচ্ছা, আইচ্ছা হুন!”
বলেই জাবির একটা চিঠি আরেকটা বাক্স এগিয়ে দিল।
–“চিঠিডা তুমার মৌনো বইনরে দিবা। আর এইডা তোমার গিফত! কাজ কইরে দিবা তার অগ্রীম।”
এশা সুন্দর করে দুটোই নিল। জাবিরের আর বুঝিয়ে দেওয়া লাগেনি, এসবে এশা আগে থেকেই পাক খেলোয়াড়! সে ঘাড় কাত করে বলল,
–“আচ্ছা, এবার যাই?”
এশা চলে আসল বাড়ি। দরজা আগে থেকেই খোলা ছিল। বুয়া খালা সাগরের মা আর রাজিয়া শেখ রান্নাঘরে। বাকিরা কেউই বাড়িতে নেই। সে চুপিচুপি মৌনোর ঘরে চলে গেল। চিঠিটা মৌনোর টেবিলে রেখে খাটের নিচ থেকে একটা বস্তা বের করল। সেই বস্তায় জাবিরের দেওয়া ঘুষ সুন্দর করে ঢুকিয়ে আবারও বস্তা আগের জায়গায় রেখে দিল। এটা এশার সিক্রেট ব্যবসা। দুই বোন সুন্দর হওয়ার দরুণ সবাই তার হাত ধরেই চিঠি, চকোলেট পাঠায়। আর এর বদলে এশাও অনেক ঘুষ পায়। সেগুলো কেউ দেখলে বকবে বলে সে এই বস্তার গোপনীয়তা ধরে রেখেছে। ভাগ্যিস আজ অবধি কেউ বস্তাটা খেয়াল করে দেখেনি। এশা দ্রুত খাটের নিচে থেকে বেরিয়ে চলে গেল মায়ের কাছে শরবতের আবদার করতে।
মৌনো রাতে পড়তে বসে ঘোরের মাঝে ঢুকে আছে। সেই রাত পেরিয়েছে প্রায় তিন দিন। এখনো তার কানে বাজছে সেই পুরুষালি কণ্ঠস্বর। রিমঝিমকে নিবিড় কল করেছিল। মৌনোর গলা শুনে সে যখন কণ্ঠে নাম নিল মৌনো থমকে গিয়েছিল। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। বারবার যেন কানে বাজছিল, “মৌনো, আর ইউ অলরাইট?”
মৌনো তখন বহু কষ্টে বলেছিল, “ভা-ভালো।”
এরপর যখন রিমঝিম রুমে আসে তখন সে ঘোরের মধ্যেই রিমঝিমকে ফোন হস্তান্তর করে দেয়। সেই রাত সে আফসোসে ঘুমাতে পারেনি ঠিক মতো! কেন যে মৌনো রিমঝিমকে মোবাইল ফিরিয়ে দিল? কী হত একটু কথা বললে, একটু গলা শুনলে? পরমুহূর্তেই নিজেকে শাসিয়েছিল। নিবিড় তার শত্রু, তাদের সাপে নেউলে সম্পর্ক। আর কিছু নয়।
ভাবনার মাঝেই মৌনো জাবিরের চিঠিটা দেখতে পায়। নামহীন চিঠি দেখে মৌনো চটে যায়। এই টেবিলে চিঠি আসা তার জন্য নতুন নয়, সে যেই দিক। সে তখনই গলা উঁচিয়ে এশাকে ডাকল। এশা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বোনের রুমে যায়।
–“এই চিঠি কে দিয়েছে তোকে?”
–“জাবির ভাই।”
–“না করিনি তোকে এগুলা আনতে? যেই দিবে আর তুই মুখ উঠিয়ে নিয়ে আসবি? এত ছ্যাঁচড়া কবে থেকে হলি? মার খাস না বহুদিন, তাই না?”
এশা ঘাবড়ে যায় বোনের কথায়। প্রতিবারের মতো বলল,
–“আর আনব না আপু। এবারই শেষ।”
মৌনো রাগে হতভম্ভ। প্রতিবার এত কথা শুনিয়েও এশার বুঝ হয় না। প্রতিবার এক কথা বলে কেটে পড়বে, পরেরদিন আবার একই কাহিনী।
–“কান ধরে দাঁড়া!”
–“আর হবে না বললাম তো।”
মৌনো হাল ছেড়ে দেয়। চিঠি ফেলতে গেলে এশা অবাক হয়ে বলল,
–“তুমি প্রতিবার চিঠি কেন ফেলে দাও? কি লিখেছে দেখবে না? যদি তোমাকে চকোলেট দিতে চায়?”
মৌনো গরম চোখে বোনের দিকে তাকাল। কিড়মিড়িয়ে বলল,
–“চটকনা খেতে চাস?”
এশা দ্রুত পালাল। মৌনো না পড়েই সেই চিঠি ময়লাতে ফেলে দিল। বৈঠকঘরে বড়োরা আলোচনা করছে। সামনের সপ্তাহেই রাজিয়া শেখের ছোটো ভাই অর্থাৎ মৌনোর ছোটো মামা ইয়ামিনের বিয়ে। প্রত্যেক বছরেই তাদের বংশে একটা করে হলেও বিয়ে হয়। আপাতত সেখানে যাওয়ারই প্রস্তুতি চলছে। বড়োদের কথাতেই শুনল পরশুদিনই চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হবে তারা। ইয়ামিন নাকি কল করে করে বোন আর দুলাভাইকে পাগলপ্রায় করে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে রিমঝিমের মোবাইলেও কল আসল ছোটো মামার। রিমঝিম কল ধরলে ওপাশ থেকে ইয়ামিন বলে ওঠে,
–“মৌনোকে দে।”
মৌনোকে মোবাইল ধরিয়ে দিতেই সে শুরুতেই সালাম দিল।
–“ওয়া আলাইকুম আসসালাম। ভালো আছিস?”
–“জি মামা।”
–“তোর কি পরীক্ষা আছে?”
–“না।”
–“ক্লাসটেস্ট?”
–“না।”
–“এসাইনমেন্ট? প্রেজেন্টেশন?”
–“না।”
–“কোনো ভার্সিটি প্রোগ্রাম?”
–“এসব জিজ্ঞেস করছ কেন হুট করে?”
–“ওলে আমার খুকি! কিচ্ছু বুঝে না যেন। এবার যাতে কোনো কিছুর বাহানা করে ফিরে যেতে না পারিস তাই শিওর হয়ে নিলাম। বাকিদের তদন্ত করা শেষ, তুই শুধু বাকি ছিলি।”
–“তোমার তদন্ত হলো?”
–“হুঁ, পরশুর মধ্যেই আসবি ব্যাস! জানিস তো আমাকে ধরে-বেঁধে বিয়ে দিচ্ছে। নয়তো কে চায় সুখের জীবন বিয়ে করে নষ্ট করতে? তোরা একটু আনন্দ করবি এই ভেবেই বিয়ে করা।”
–“তোমার আগের ভাই তো এখনো বিয়ে করেনি। তার আগে তুমি করে ফেলছ! তোমাদের চাটগাঁইয়া প্রতিবেশিরা তুচ্ছ করে বলেনি, ‘বড়ো ভাইয়ের আগে ছোট ভাই কেমনে বিয়ে করে?’ নাকি কানে পট্টি বেঁধে আছ?”
ফোনের ওপাশ থেকে হো হো হাসি ভেসে আসল।
–“আপাতত সেঝো ভাই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এজন্য বড়ো মনে বলির পাঠা আমিই হচ্ছি।”
–“তোমাদের গোষ্ঠীতে কী বিয়ে না করতে চাওয়ার কোনো রোগ আছে?”
–“সাবধান মৌনো! তুইও কিন্তু এই বংশেরই। এবার আয়, আমিই ধরে তোকে বিয়ে দিয়ে দিব। শুধু একবার চট্টগ্রামে পা দিয়ে দেখ।”
বিয়ের কথা শুনে মৌনোর নিবিড়ের কথা মাথায় এলো। নিবিড়! সেও তো চট্টগ্রামেই আছে। কে জানে কোথায়।
কামরুল রাতে চুপিচুপি নিবিড়কে কল করল। রত্নার মোবাইল চুরির পর থেকে নিবিড় একদম হারিয়ে গেছে যেন। সে জানে রত্নার মোবাইল চুরির খবর নিবিড় মশিউর সাহেবের মাধ্যমেই পেয়ে গেছে। তবে তারও তো এই মহান কাজের কথা নিবিড়কে নিজ মুখে বলতে ইচ্ছে করে।
নিবিড় কামরুলের কল রিসিভ করল। কামরুল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল,
–“ভাই, কাজ এমন ভাবে করছি যে ছায়াও ধরতে পারে নাই। এলাকার চোরের লগে আমার খাতির আছে জানেনই তো।”
নিবিড় ক্লান্ত ছিল সারাদিনের ট্রেনিং এ। অবশ্য ঘাড় থেকে একটা বোঝা নেমেছে কামরুলের জন্যই। ছেলেটা বেশ সাহায্য করেছে। তাই সে ক্লান্ত ভরা কণ্ঠেই বলল,
–“গুড জব, কামরুল। ইউ ডিড ওয়েল।”
কামরুল ইংরেজি জানে না। আবার নিবিড়ের ইংরেজিকে ফেলনাও করতে পারল না। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
–“বড়ো ভাই ইংরেজি যেহেতু কইছেন, ঠিকই কইছেন। আমি একমত ভাই।”
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে~~~
[যারা যারা গল্পটি পড়ছেন, সবাই রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন যাতে অন্য পাঠকদের ফিডেও পর্বটি পৌঁছায়।]
বিঃদ্রঃ রিচেক পরে দিচ্ছি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন। কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন। আগামী পর্ব আসবে বৃহস্পতিবার।
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ১২
-
বেলতুলি গল্পের লিংক
-
বেলতুলি পর্ব ১১
-
বেলতুলি পর্ব ৬
-
বেলতুলি পর্ব ১৮
-
বেলতুলি পর্ব ৮
-
বেলতুলি পর্ব ১৫
-
বেলতুলি পর্ব ২
-
বেলতুলি পর্ব ১৪
-
বেলতুলি পর্ব ৪