Golpo romantic golpo বেলতুলি

বেলতুলি পর্ব ১০


বেলতুলি – [১০]

লাবিবা ওয়াহিদ

[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

–“আমি বুঝি না সোফিয়া, তুমি কেন ওদের নিয়ে এসব বাজে বকো? কয়েক মাস আগেও তো রাজিয়া আপার সাথে তোমার ভালো সখ্যতা ছিল। এখন হুট করে কী সমস্যা হয়েছে বলবে?”

সোফিয়া খানম প্রতিবারের মতোই নীরব রইলেন, কিন্তু তার চোখে-মুখে প্রবল ক্রোধ বোঝা যাচ্ছে। মূলত সোফিয়া খানম আর রাজিয়া শেখের মাঝে অজানা কারণে রেশারেশি চলছে। রেশারেশির কারণটাও মৌনো। সোফিয়া খানম বাকিদের মতো করেই মৌনোকে পছন্দ করেছিলেন তার ছেলের জন্য। তার কেন যেন মনে ধরেছিল মৌনোকে। মৌনো বেশ রূপবতী, নিবিড়ের সাথে খুব মানাবে।

তাই তো তিনি একান্ত ভাবে রাজিয়া শেখকে প্রস্তাব দিলেন। বললেন রিয়াজ সাহেবের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাতে। কিন্তু রাজিয়া শেখ আলোচনা তো দূর, তখনই মুখের ওপর তাকে না করে দিলেন। বদমেজাজী, একরোখা সোফিয়া কখনো কারণও শুনেননি। সেই প্রত্যাখ্যান তার ভরপুর ইগোতে আঘাত করেছে। সেই ইগোর আঘাতে তিনি আর রাজিয়ার মুখোমুখিও হলেন না। সেই থেকে সিদ্ধান্ত নেন, মৌনোর চেয়েও রূপবতী মেয়ে তিনি ঘরে বউ করে আনবেন।

এই প্রশ্ন মশিউর সাহেব আগেও কয়েকবার করেছিলেন, কিন্তু স্ত্রী চুপ থেকেছেন। এবারও তাই। ইগোর আঘাতটা তিনি গিলে চুপ করে রইলেন। স্বামীও কখনো জানতে পারেননি তার ভেতরকার পরিকল্পনা। মশিউর সাহেব এবারও হতাশ হলেন, কিন্তু ছেলের ডাকে ধ্যান ভাঙল। সোফিয়া চোখ তুলেও তাকাল না স্বামীর দিকে, অন্যদিকে ফিরে রইলো। মশিউর সাহেব এক বুক হতাশা নিয়েই বেরিয়ে গেলেন।

রিয়াজ সাহেব বেশ খুশি মনেই অতিথি আপ্যায়ন করছেন। মৌনো এখানে উপস্থিত নেই। জুনায়েদ আর রিয়াজ সাহেবই করছেন, ওই মাঝেমধ্যে রাজিয়া শেখ এক, দু’বার উঁকি দিচ্ছেন। এক সময়ে মশিউর সাহেবের জোরাজুরিতে রিয়াজ সাহেবও বসলেন খেতে। খেতে খেতে বললেন,
–“রিমঝিমের জন্য পাত্র দেখেছি ভাইজান। এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছে। ছেলের বায়োডাটা, পরিবার সবকিছুই আগে খোঁজ করেছি।”

মশিউর সাহেব খাবার গিলে পানির গ্লাসে হাত ছুঁয়ে বললেন,
–“তো কেমন লাগল? আগের মতো নয় তো?”

–“না। ছেলেই নাকি আমার মেয়েকে দেখেছে হাসপাতালে। এরপর সোজা প্রস্তাব নিয়ে এলো। আপনাদেরও জানালাম।”

নিবিড় নীরবে খাচ্ছে। আগেরবার সে এই বিষয়ক কথা বললেও এবার নিশ্চুপ। রিয়াজ সাহেব মেয়ের বাবা, তিনি তার চেয়েও ভালো বুঝেন। পানি খেতে গিয়ে হঠাৎই তার পর্দার দিকে চোখ পড়ে গেল। নিমিষেই মৌনো সরে দাঁড়ায় সে স্থান থেকে। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলো না, নিবিড় তো তাকে দেখেই নিয়েছে। মশিউর সাহেবও মৌনোকে লক্ষ্য করলেন। পরপর ডাকলেন। অগত্যা, মৌনো আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। সালাম দিল তাকে। মশিউর সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
–“আসো আমাদের সাথে খেতে বসো?”

মৌনো নিবিড়ের দিকে তাকাল। আশ্চর্য, মানুষটা তাকাচ্ছেও না। মৌনো নিজেকে সামলে বলল,
–“আপনারা খান আঙ্কেল, আমি মায়ের সাথে খাব।”

–“পড়াশোনা কেমন চলছে? ভালো তো?”

–“জি।”

–“কোনো সমস্যা হলে জানাবে।”

মৌনো বলতে চাইলো সমস্যা তো আপনার সাথে বসা, আঙ্কেল। কিন্তু এভাবে বলাটা অভদ্রতা দেখায়। আন্তরিকতা বজায় রাখতে মৌনো নিজেও তাদের খাবার বেড়ে দিল। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই স্বামীর আদেশে রাজিয়া শেখ টিফিন কেরিয়ারে শেইনা, সোফিয়া খানমের জন্য খাবার তুলে দিলেন। রিমঝিমের বিয়ে বিষয়ক আরও কিছু আলোচনা করেই মশিউর সাহেব বিদায় নিলেন। খুব সম্ভবত শীঘ্রই, আবারও রিমঝিমকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসতে চলেছে।

রিয়াজ সাহেব সুখের ঢেঁকুর তুলে বড়ো মেয়ের রুম পার হতেই দেখলেন রিমঝিম জানালার শিক ধরে নীরবে দাঁড়ানো। বুঝলেন, মেয়ের ঢের মন খারাপ। তিনি চেয়েও মেয়েকে এড়িয়ে যেতে পারলেন না। রিয়াজ এগিয়ে গেলেন।
–“খাওনি?”

রিমঝিম পিছে ফিরে বাবার দিকে তাকাল। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনা রিমঝিম শুনে নিয়েছে।
–“আমি কি তোমার ঘাড়ের বোঝা, বাবা?”

রিয়াজ সাহেব হেসে ফেললেন। তিনি স্বভাবতই বেশ খোশমেজাজের মানুষ।
–“তা কেন হতে যাবে?”

–“তবে কেন বারবার বিয়ের কথা বলো? কেন ছেলে ধরে আনো? বিয়ে করতেই হবে কেন?”

রিয়াজ সাহেব বুঝলেন মেয়ে উত্তেজিত হচ্ছে। তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন,
–“বিছানায় বসো, কথা বলি।”

রিমঝিম বসল। রিয়াজ সময় নিয়ে মেয়েকে পরখ করে বলল,
–“মেয়েরা বোঝা হয় না, মেয়েরা পরের আমানত হয়। যাতে করে সঠিক সময়ে, সঠিক মানুষের কাছে আমানত ফিরিয়ে দেয়া যায়।”

–“আমি চাই না বিয়ে করতে বাবা।”

–“তোমাকে অনেক সময় দিয়েছি মা। তুমি ডাক্তারি পড়েছ, এখন চাকরি করছ। যেই পাত্র আসছে তার তোমার চাকরি নিয়েও সমস্যা নেই। এবার তুমি কিসে অযুহাত দিবে?”

রিমঝিম চুপসে গেল। কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
–“অতীতে..”

রিয়াজ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মেয়ের অস্বস্তি কোথায় তা না বোঝার মতো অবুঝ তিনি নন।
–“অতীত বদলাতে পারব না, কিন্তু ভুল করার মানে এই নয় যে আমাদের নতুন করে বাঁচার অধিকার নেই। আমিও চাই মা, আমার মেয়ের একটা সংসার হোক.. সে খুশি হোক। আমি চাই না আমার মেয়ের ওপর আবারও কুনজর পড়ুক। তোমার পরে তোমার আরও দুটো বোন আছে। এশাকে বাদ দিলাম, কিন্তু মৌনোরও প্রস্তাব আসে রোজ.. তোমাকে রেখে ওকে তো বিয়ে দিতে পারি না।”

–“কিন্তু বাবা, মৌনো ছোটো। এত ছোটো বয়সে..”

–“মৌনো ছোটো নয়, কুড়ি হতে বেশি দেরী নেই। এই ভ্রান্তি ধারণা কাটাও বিয়ে মানে তার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া নয় মা। বিয়ে মানে নতুন এক জীবন, যেই জীবনে আগের জীবনের মতোই সুখ-দুঃখ থাকবে। শুধুমাত্র অভিভাবক বদলাবে। আমাদের শরিয়তকে অবজ্ঞা করার সাধ্যি কারো নেই।”

রিয়াজ সাহেব থেমে আবার বললেন,
–“তাই বলে এটা মোটেও নয় আমার মেয়েদের আমি যার তার হাতে তুলে দিব। যদি সুপাত্রের জন্য আমার অপেক্ষা করতে হয় আমি তাই করব। তোমার ক্ষেত্রেও, মৌনোর ক্ষেত্রেও। সোমবারে পাত্রপক্ষ আসছে, তুমি দেখে বুঝে নিয়ো। এখন সবটাই তোমার হাতে।”

রিমঝিম আর কিছু বলল না। যতটুকু বলার ছিল, বাবার যুক্তিতে তাও মিইয়ে গেছে। রিয়াজ সাহেব বুঝতে পারেন মেয়ের বিয়েতে অনীহা, ভয়, শঙ্কা। কিন্তু আমাদের জীবনে নতুন কারো সাথে জড়ানোর জন্য রিস্ক নিতেই হয়। সেই রিস্ক কতটা ভালো আর কতটা মন্দ, সবটাই ভাগ্যের ওপর। মাবুদের ওপর ভরসা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

তবে রিমঝিমের ব্যাপারটা ভিন্ন। সে অজানা আতঙ্কে থাকে সবসময়। একবার যেই বড়ো ধোকাটা সে পেয়েছে, দ্বিতীয়বার কী করে কাউকে ভরসা করবে? নিজের জীবনের সবটা উজাড় করে দিবে? বাবার কাছেও এসব বলার মুখ তার নেই। বাবা অনেক সহ্য করেছেন তাকে, এবার তো এর ইতি টানতেই হয়।


হাফসার সাথে মৌনোর গুরুতর ঝগড়া হলো। তাও আবার মূর্খ আশিককে কেন্দ্র করে। সে মোটামুটি ভালো রকমই হাফসার ব্রেইনওয়াশ করেছে। মৌনো নাকি তাকে আবোল তাবোল বলে চড় দিয়েছে, অসম্মান করেছে। সেই থেকে হাফসাও চটে গেছে মৌনোর উপর। মৌনো একপ্রকার রাগ করেই ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে এলো। জাবিরকে পথে দেখতেই তার অন্য রাস্তা ধরতে হলো, কোথাও শান্তি নেই। মানুষের জন্য সৌন্দর্য সাধনা, আর মৌনোর জন্য অভিশাপ। সে এই রূপ, প্রীতি নিয়ে আজকাল বড্ড বিরক্ত। যদি তার রূপই না থাকত, খুব সম্ভবত জীবন থেকে আশি শতাংশ ঝামেলা কেটে যেত।

মৌনো বেলতুলির গলিতেই আঁখ পেল। আখের রস তার বড্ড প্রিয়। এই ভর দুপুরে মাথা ঠান্ডা করার জন্য আঁখের বিকল্প নেই। সে দ্রুত আঁখের দিকেই হাঁটা দিল। আঁখ কিনে রাস্তাতেই কামড়ে কামড়ে খেতে লাগল। সে স্পষ্ট দেখেছিল তাকে ওভাবে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আঁখ খেতে কেউ দেখেনি। অথচ বিকালের মধ্যেই নিবিড়ের মাধ্যমে তার বাড়িতে বিচার চলে গেল,
–“আন্টি, মৌনো রাস্তা-ঘাটে আঁখ ছিলে খেয়ে বেড়ায়। দৃশ্যটি বড্ড দৃষ্টিকটু। ওকে বলে দিন ও আর ছোটো নেই এখন। মানুষজন নানান কথা বলে।”

মৌনো সাথেই দাঁড়ানো ছিল। সে গলা উঁচিয়ে বলল,
–“আপনি কীভাবে জানলেন? লুকিয়ে লুকিয়ে নজরে রাখেন?”

নিবিড় চাইল মৌনোর দিকে, বিরক্তি যেন আরও হুড়মুড়িয়ে বাড়ল। সোফিয়া খানম দুপুরে ছাদে কাপড় রোদ দিতে গিয়ে ছাদ থেকে মৌনোকে এই কাণ্ড করতে দেখেছে। সেই থেকে ঘরে কীসব ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে। মায়ের সেসব কথা-বার্তায় একপ্রকার বিরক্ত হয়েই এখানে আসা। সে আর যাই হোক, আরেক বাড়িতে এসে মায়ের বদনাম তো করতে পারবে না। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আমার একার বাদেও অনেকের চোখ ঘুরঘুর করছে তোর আশেপাশে, ব্রেইনলেস!”

ব্রেইনলেস শব্দটা রাজিয়া শুনতে না পেলেও মৌনো কান খাড়া করে ঠিকই শুনে নিল। মৌনো চমকে নিবিড়কে কিছু বলতে নিতেই নিবিড় চোখের নীরব গর্জনে তাকে থামিয়ে দিল। এই তীক্ষ্ণ নজর তার বড্ড চেনা, শুধু পুরান ঢাকার দিনটাই তার জন্য অপরিচিত ছিল। তবে কি সেই দিনটা তার জন্য ভ্রম ছিল? নাকি স্বপ্ন? স্বপ্নতে নিবিড় এত সুপুরুষ হয়েও ধরা দেয় বুঝি? মৌনো নিজেকে ধিক্কার দিল সেদিন এক মুহূর্তের জন্য নিবিড়কে ‘ভালো মানুষ’ ভাবার জন্য।

সেদিন মৌনো অনেক বকা খেল মায়ের হাতে। মৌনো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল,
–“এর মূল্য আপনি পাবেন নেভি সাহেব।”

যা ভাবা তাই, পরেরদিনই মৌনো তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করল। মৌনো শেইনার সাথে দেখা করার অযুহাতে হাতে দেশলাই আর মোম নিয়ে এসেছে। কামরুল গেছে শেইনাকে উপরে ডাকতে। আশেপাশে সোফিয়া খানমও নেই। মৌনো এই সুযোগে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে মোম জ্বালাল। সেই মোমের নরম জল সে পাশেই থাকা নিবিড়ের দামি শু এর ওপর দিল। জুতোর ভেতরটাও নষ্ট করল। অতঃপর শেইনা আসার আগেই সে দ্রুত দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে~~

[যারা এই গল্পটি পড়ছেন তারা সাড়া দিবেন, যেন অন্যান্য পাঠকদের ফিডেও পর্বটি পৌঁছাতে পারে।]

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর নজরে দেখবেন। আগামীকাল গল্প দিব না, সারাদিন বাসায় থাকব না। তাই কষ্ট করে হলেও আজ দিয়ে দিলাম। কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন।

রিচেক একটু পর দিচ্ছি।

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply