১৭
বাড়ির উৎসবমুখর পরিবেশ দেখে এটাকে বিয়েবাড়ি থেকে কোনো অংশে কম বলা যাবে না। গ্রামের বাড়ি থেকে দাদুভাই, বড় চাচা, মেজো চাচা এসেছেন। সঙ্গে এসেছে চাচাতো ভাইয়েরাও। এদিকে আপা দুলাভাইরা তো আছেই। পুরো বাড়িতে হৈ হুল্লোড়, হাসাহাসি আর মায়ের হাতের খাবারের ঘ্রাণ মিলেমিশে একাকার।
আমি আজকে নিজের রুম থেকে খুব একটা বের হবো না ভেবেছি। তবে আমি বের না হলে কী হবে, তারা সবাই একে একে আমার রুমে এসে হাসি তামাশা করে যাচ্ছে। কখনোবা বাবার রুমে মুরুব্বীরা সবাই মিলে আলোচনা সভা বসে, তখন মেয়েরা এসে আমার রুমে ভীড় করে। কি আশ্চর্য, বাসায় কি আর কোনো রুম নেই নাকি?
সন্ধ্যার পরপরই বাবা আমাকে নিচে ডাকলেন। আমি বুঝতে পারছি না এখনই সেই কাঙ্খিত মুহুর্ত কী না!
বড় আপাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি শাড়ি পরে আসবো?
আপা হেসে বললো, না না। এমনিই আয়।
নিচে যেতেই দেখি কীসব কাগজপত্র নিয়ে সবাই বসে আছে। সবার মাঝখানে বাবরি চুলওয়ালাও আছে। তার মাথাটা নিচু করা। আমি গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। কেন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে।
কাগজপত্র দেখে ক্ষণিকের জন্য মনে হলো, আজকেই বিয়ে পড়াবে নাকি! পরক্ষণেই সেখানে কোনো কাজীকে খুঁজে না পেয়ে নিশ্চিত হলাম আজকে বিয়ে নয়।
বাবা ঘোষণা দিলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে তার কোম্পানির চেয়ারম্যান হবে মীরা। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম, আমি কেন!
সবাই আমার দিকে তাকালো। বাবার মুখে ফুটে উঠলো হাসি। মিষ্টি হেসে বললেন, আমি না থাকলে আমার ব্যবসার হাল তোকেই ধরতে হবে মা।
‘আমাকে কেন আব্বু!’
‘আয় এখানে।’
বাবা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বোঝাতে লাগলেন। আমিই সবচেয়ে যোগ্য উত্তরসূরী। আমি চাইলে ভবিষ্যতে এটা আমার স্বামী সন্তানদের নামে করে দিতে পারবো। বাবা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে আমাদের তিন বোনের প্রাপ্যও বুঝিয়ে দিলেন। আমি বারবার বলতে লাগলাম, আজকেই কেন এসব করতে হবে?
বাবা নির্দ্বিধায় উত্তর দিলেন, এটা করার জন্য আজকের মতো সুন্দর দিন আর আসবে না।
সব আয়োজন শেষে নিজের রুমে চলে এলাম। আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমার হাত পা রীতিমতো কাঁপছিলো। সাজগোজ করার সাহসই রইলো না।
আজ থেকে আমি অন্য একজনের বাগদত্তা। আমার জীবনের সমস্ত সমীকরণ পালটে যাবে আজকের পর থেকে। ভাবতেই কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে!
অনেক্ষণ সময় নিয়ে সাজগোজ শেষ করলাম। দুরুদুরু বুক কাঁপছে। মেজো আপার সহায়তায় শাড়ি পরলাম। অথচ ভেবেছিলাম আমার অনেক সাহস। এইটুকুতেই কেমন কোমল লতার মতো নুইয়ে যাচ্ছি।
বসার ঘরে ছোটখাটো আয়োজন। সবাই সেখানে উপস্থিত। সবার সম্মুখে আমাকে আর বাবরি চুল ওয়ালাকে পাশাপাশি বসিয়ে দেয়া হলো। আমি এবার থরথর করে কাঁপতে লাগলাম।
বাবরিচুল ফিসফিস করে বললো, ‘নার্ভাস মনে হচ্ছে?’
‘হুম।’
‘এত ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি তো।’
‘আপনাকেই তো ভয়।’
‘হাহা, কেন?’
‘বিয়ে তো একবারই করবো। এইটুকু নার্ভাস হবো না?’
‘তা ঠিক। আমাকে ভয় কেন?’
‘পাছে যদি আপনার কোনো ভয়ংকর চেহারা বেরিয়ে আসে।’
‘অত টেনশন হচ্ছে! আমার আগের কোনো বউ আছে কিনা এরকম?’
‘ঠিক তা নয়। আগের বউ যে নেই সেটা আমি নিশ্চিত। ভাবছি, আবার একই চেহারার আড়ালে দ্বিতীয় কোনো রূপ থাকতে পারে কী না।’
‘ওমা! এত দ্বিধা নিয়ে বিয়ে করছেন কেন মিস মীরা?’
‘সবাই চাচ্ছে তাই।’
‘সবাই চাচ্ছে বলে বিয়ে করতে হবে?’
‘এখানেই মীরা চুপ।’
‘সবার ওপর এতটুকু আস্থা নেই? আপনার বাবা কি খোঁজ খবর না নিয়েই বিয়ে দিচ্ছে?’
‘উম, তা আছে…’
‘তো?’
আমি চোখ তুলে তার দিকে তাকালাম। সে কাউকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমাদের মাঝখানে পড়ে থাকা আমার একটা হাতের ওপর হাত রেখে বললো, ‘ভরসা রাখুন। বিয়েটা শুধু কাগজে কলমে হয় না, বিয়েটা হয় মনেরও। মন থেকে না চাইলে করার দরকার নেই।’
এমন সময় বাবা বললেন, ‘মীরা, মুনযির তোমরা সামনে চলে এসো।’
আমি হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম। সে ছাড়লো না। সে আমার হাতটা ধরে থাকা অবস্থাতেই উঠে দাঁড়ালো। বাধ্য হয়েই তার সঙ্গে উঠে পড়লাম আমিও। আমাদের এখনো বিয়েও হয়নি। এই ভরা মজলিসে আমরা হাত ধরে সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছি! ভেবেই আমার লজ্জায় মরে যাবার দশা। কোথায় যে মুখ লুকাবো বুঝতে পারছি না আমি। মাথাটা নিচু করতে করতে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ফেললাম।
সে আমার হাত ধরেই সম্মুখে এগিয়ে গেলো। সবার সামনে দাঁড়িয়ে তারপর ছেড়ে দিলো হাত। আমি এতক্ষণে নিজেকে সামলে নেয়ার ফুরসত পেয়ে বড়বড় করে কয়েকটা শ্বাস নিলাম।
বাবা সবার উদ্দেশ্যে বললেন, মাশাল্লাহ। ওদেরকে একসঙ্গে অনেক সুন্দর মানিয়েছে না! সবাই মাশাল্লাহ বলো।
সবার সম্মতি সূচক মন্তব্য কানে আসলো। কেউ কেউ ফোনের ক্যামেরায় আমাদের ছবি তুলতে আরম্ভ করে দিলো। কেউ আবার আমাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ছবি তুলতে লাগলো। আমি লজ্জায় এতটাই মাথা নিচু করে আছি যে, কোনোদিকেই তাকানোর শক্তি পাচ্ছি না।
অবশেষে এলো সেই প্রতিক্ষীত মুহুর্ত। বাবরি চুলওয়ালা আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা ভীষণ সুন্দর একটা বক্তব্য রাখলো। আবেগের ঠেলায় আমি এতটাই আপ্লুত যে, তার কথার কোনোটাই আমার মাথায় ঢুকলো না। শুধু এতটুকু বুঝতে পারলাম, সে আমাদের পরিবারের সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞ।
এরপর সবার কাছে সম্মতি চাইলো আমাকে আংটি পরিয়ে দেয়ার। সবাই সম্মতি প্রদান করলে সে পুনরায় আমার হাতটা তুলে নিলো নিজের হাতে। আমি যন্ত্রের মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফোনের ক্যামেরায় ঘনঘন ক্লিক করার সাউন্ড ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই! পুরো আসর হঠাৎ করেই কেমন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।
সে পরম যত্ন নিয়ে আমার অনামিকা আঙুলে ডায়মন্ডের সেই রিং খানা পরিয়ে দিলো। মুহুর্তেই নিস্তব্ধতা ডিঙিয়ে তুখোড় হাততালিতে ভরে উঠলো চারপাশ। আমি বোধহয় গলে পড়ে যাবো তার গায়ে। নিছক মনের জোরে কোনোমত হেলে পড়া খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে আছি।
সবাই কাছে এসে আমাদের মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ভীড় পেয়ে নিজেকে বাচিয়ে আমি দৌড়ে রুমে চলে এলাম। দরজা বন্ধ করে লাফ দিলাম বিছানায়।
আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাময় মুহুর্ত পার করে আসলাম আমি। উফফ, মনে হচ্ছে হার্টবিট ফেটে বেরিয়ে আসবে। প্রতিটা মেয়েরই কি এমন হয়!
বিয়ের দিকে যতই সময় অগ্রসর হচ্ছে, আমি যেন তার আপন হতে গিয়ে আরও বেশী করে আমার থেকে পর হয়ে যাচ্ছি। নিজেকেই চিনতে পারিনা আজকাল!
এ কেমন দহন!
এ কেমন অন্তর্জ্বালা!
এমন ছটফটানি নিয়ে কি টিকে থাকা যায়!
কতক্ষণ স্থির চোখে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে রইলাম আমি। আবারও নিচতলায় আমার ডাক পড়লো। মেজো আপা আসলো আমাকে নিতে। জানতে চাইলাম, কেন? নিচে গিয়ে হবেটা কি?
‘বোকা মেয়ে, বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হচ্ছে। তোকে যেতে হবে।’
আমি ধীরপায়ে নিচে নেমে আসি। সবার নজর আমার দিকে। মুহুর্তেই যেন আমি সবার ভিআইপি গেস্টে পরিণত হয়েছি! আপাকে বললাম, সবাই এমন ভ্যাবলার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন?
আপা হেসে বললো, কারণ তুই আজকে মেইন ক্যারেক্টর।
‘আর বাবরিচুল?’
‘সে আবার কে!’
আমি এতক্ষণ পর খানিকটা মুচকি হাসলাম। আমি আসার পূর্বেই তারিখ পাকা করার আলোচনা শেষ। এবার সবাই উঠে ডাইনিংয়ে চলে গেলো।
বসার ঘরে তেমন কেউ নেই। ডাইনিং টেবিলে পুরুষরা সবাই একসাথে খেতে বসলো। আপা আমাকে সোফায় বসিয়ে দিলেন।
এমন সময় মা এসে বললেন, ‘আগামী শুক্রবার ডেট ঠিক হয়েছে।’
‘ও..’
‘ও কি? আলহামদুলিল্লাহ বল।’
‘শুক্রবারে বলবো।’
মেজো আপা হেসে উঠলো। মা বললেন, ‘পাগলী মেয়ে আমার। শোন, তুই এখানে থাক। সবাই যদিও বলবে ওদের সঙ্গে খাওয়ার জন্য। দরকার নেই ওখানে বসার। আমরা সবাই পরে একসঙ্গে বসবো। আমি যাই..’
মা প্রায় ছুটে রান্নাঘরে গেলেন। মেজো আপা আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘শুক্রবারে আলহামদুলিল্লাহ বলবি তাই না রে?’
‘তো? বিয়ের ডেট শুনে কোনো মেয়ে কি আলহামদুলিল্লাহ পড়ে?’
‘কি জানি! মা বলতে বলছে যখন, হয়তো মেয়েরাও বলে।’
‘ওটা মুরুব্বীরা বলে। আর বিয়ের পাত্রী বলবে একবারই, বিয়ের দিন। এখন বল আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?’
‘রাজকন্যার মতো লাগতেছে আমার মিষ্টি বোনটাকে।’
‘রাজকন্যা? রাণী নয়?’
‘রাণী কেন লাগবে? রাণীর মতো লাগবে তো বিয়ের পর।’
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘আমার স্বামী তো রাজা না। কিভাবে লাগবে!’
আপু আমার কানের কাছে এসে বললো, ‘প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে তার স্বামী একজন রাজা।’
আমি বাঁকা ঠোঁটে হেসে বললাম, ‘বললেই হলো? রাণীর মতো ট্রিট না করলে আমি রাজা বলবো কেন?’
‘সেটা বিয়ের দিন থেকেই টের পাবেন। শুধু রাণী না, একেবারে মহারাণী করে রাখবে। আর আপনার যে সুপুরুষ জামাই, কপাল ভালো না হলে কেউ এমন জামাই পায়?’
আমি আবারও ঠোঁট বাঁকা করে ভেংচি কেটে বললাম, ‘দেখা যাবে। তোমাদের পছন্দ, আমার কী! কিছু হলে আমি তোমাদের দোষ দিবো।’
‘এহ, খালি আমাদের পছন্দ? নিজের বুঝি পছন্দ না? হাত ধরে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার বলে তোমাদের পছন্দ…’
‘আমি হাত ধরি নাই, ও ধরছে। যা বলার ওকে বল।’
‘সেজন্যই তো বললাম, সুপুরুষ জামাই।’
আপা হাসতে লাগলো। আমি ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। এমন ভাব করছি যেন এই বিয়েতে আমার কোনো মতই ছিলো না। শুধুমাত্র পরিবারের চাপে পড়ে…
কিছুক্ষণ পর বড় আপা মিষ্টি নিয়ে এলো। আমাকে বলল, নে খা। তোকে সবাই এত ভালোবাসে কেন মীরা?
‘তোমরাই জানো।’
‘আব্বা তোকে চেয়ারম্যান বানিয়ে দিলো! আমাদেরকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আমাদেরকে আরেকটু পড়াশোনা করতে দিলে আজকে কি আমরা চেয়ারম্যান হতে পারতাম না?’
আমি বিরক্তির সুরে বললাম, ‘ওটা বাবার অনুপস্থিতিতে। বাবা যখন থাকবে না, তখনকার সময়ের কথা।’
‘যখনকার সময়ই হোক। তোকেই তো ওই পদটা দিলো। আর কাউকে দিলো না।’
‘তোরা এমন হিংসে করছিস কেন? চেয়ারম্যান হলে আমি পুরো কোম্পানি বিক্রি করে খাবো নাকি? সব আগের মতোই থাকবে। বাবার উচিত ছিলো একজন কাউকে দায়িত্ব দেয়া, যে তার পরে হাল ধরবে। তাঁর মনে হয়েছে মীরা এটা পারবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, মীরার সঙ্গে মুনযির আছে। মুনযির এখন থেকেই সবকিছু বুঝেশুনে নিচ্ছে। কাজেই চেয়ারম্যান হলেও মুনযির আর মীরা একসঙ্গে মিলে কোম্পানি চালাতে পারবে। তোদের কি মুনযির আছে?’
দুই বোন আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। বড় আপা বললো, ‘নাহ নাই। দ্যাখ রে মেজো, বিয়ে হওয়ার আগেই আমার মুনযির আমার মুনযির করে পাগল। বিয়ে হলে কি করবে এরা? ভাব একবার।’
আমি খানিকটা মেজাজ দেখিয়ে বললাম, ‘তোর মিষ্টি তুই খা। তোরা এমন কেন? আমার ভালো তোদের সহ্য হয়না।’
গটগট করে ডাইনিং স্পেসে এসে বাবাকে বললাম, ‘আব্বু, তোমার চেয়ারম্যান পদ আমার লাগবে না। তুমি ওটা তোমার বড় মেয়েকে বানাও। আর হ্যাঁ, আমার কোনো জায়গা জমিও লাগবে না। আমার ভাগের সবকিছু তুমি ওদের সবাইকে ভাগ করে দাও। পারলে আমার জামাইকেও বের করে দাও। তোমার গুণধর দুই বড় জামাইকে নিয়ে কোম্পানি চালাও। আমরা দুইজন যেদিকে ইচ্ছে চলে যাবো।’
সবাই আশ্চর্য হয়ে খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বড় চাচা বললেন, মীরার মেজাজ খারাপ করলো কে রে?
আমি আর কোনো কিছু শোনার অপেক্ষায় না থেকে সোজা বাসার বাইরে বেরিয়ে এলাম। অরগাঞ্জা শাড়ি একটা বিশ্রী জিনিস। সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। মাথাটা একদম আগুন হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত রাগ এখন গিয়ে শাড়ির ওপর পড়ছে।
বাড়ির পিছন দিকে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মনে হলো, এভাবে সবার সামনে আবোলতাবোল বলাটা আমার মোটেও উচিৎ হয়নি। মীরা তো বদলে গেছে!
নাহ, মীরা একটুও বদলায় নি। এখনো আগের সেই গাধাই রয়ে গেছে। কী করে পারলাম ওসব বলতে! ভেবেছিলাম এরপর থেকে যা বলবো, ভেবেচিন্তে বলবো। হলো না। ঠিক ঠিক একটা ভুলভাল কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছি। আমার এ জীবনে ভালো মেয়ে হওয়া হবে না…
হঠাৎ বাবরি চুলওয়ালার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। সে বললো, ‘কী গো, মাথা গরম নাকি খুব?’
‘আপনি কেন এখানে এসেছেন? সবাই কি ভাব্বে?’
‘সবাই কি ভাব্বে সেটা মীরা ভাবে?’
‘কি বলতে চাচ্ছেন?’
‘সবার সামনে বললেন, আমরা দুজন যেদিকে ইচ্ছে চলে যাবো। বাবারে বাবাহ, অনেক কষ্টে হাসি আটকেছি আমি।’
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো বাবরি চুলওয়ালা। আমি বললাম, ‘হাসছেন কেন? এটা কি হাসির মতো কথা?’
‘কি করে পারেন আপনি মিস মীরা? আমি অবাক।’
‘কেন? পাগল মনে হচ্ছে আমাকে?’
‘না। অনেকদিন পরে সেই আগের মীরার ফিল পাচ্ছি। ভালো লাগছে।’
‘যান এখান থেকে।’
‘ওমা কেন!’
‘আমাকে একা থাকতে দিন।’
‘সবাই আপনাকে ভেতরে ডাকছে।’
‘যাবো না।’
‘চলুন যেদিকে ইচ্ছে চলে যাই।’
বলেই মুখ টিপে হাসলো। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম। পরক্ষণেই আমারও ভীষণ হাসি পেলো। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেললাম আমি।
সে বললো, ‘মিস মীরা, আপনাকে একদম হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো লাগছে।’
আমি তাকিয়ে রইলাম। সে আবারও বললো, ‘আমার ভাইয়া ভাবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলবেন? তারা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে।’
‘হুম। একটু পরে বলি? মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হোক।’
‘ঠিক আছে। এমন মাথা গরম বউ নিয়ে আমার যে কী হবে..’
‘ভয় পেলে বিয়ে করবেন না।’
‘না, বিয়ে তো করতেই হবে। হাজার হলেও যেই মেয়ে ফ্যামিলির সবার সামনে বলে, আমার জামাইকেও বের করে দাও। আমরা যেদিকে ইচ্ছে চলে যাই। হা হা হা..’
তার হাসি দেখে আমার গা জ্বলে যাওয়ার কথা। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, আমার মোটেও রাগ হচ্ছে না। একদমই না। বরং ভালো লাগছে তার এই হাসিটা দেখতে।
সে হাসি ফুরাতেই বললো, ‘আপনি এমনই থাকুন মিস মীরা। আপনাকে আমার এভাবেই সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে।’
‘ থ্যাংকস।’
‘আমার বাসা থেকে ভাই, ভাবী, ভাতিজা, ভাতিজি সবাই আসতে চাচ্ছে। আপনাকে দেখার জন্য তাদের তর সইছে না।’
‘আসতে বলুন।’
‘আমি নিজেই বানভাসী। তাদেরকে কিভাবে বলি আসতে?’
‘আপনি কি এখনো বুঝতে পারছেন না আপনি আমাদের পরিবারেরই একজন? এখনো এতটা অস্বস্তি বোধ করলে কিভাবে হবে? সবাইকে আসতে বলুন। আমার বিয়েতে আমার শ্বশুরবাড়ির কেউ না থাকলে আমারই তো খারাপ লাগবে।’
সে স্মিত হেসে বললো, ‘ থ্যাঙ্কিউ মীরা। আংকেল সবাইকে দাওয়াত করেছে। তবুও আমার খুব আনইজি লাগছিলো।’
‘চিন্তা করবেন না। কারোই অযত্ন হবেনা। আমরা আছি তো। মীরা থাকতে আপনার টেনশন নেই। আপনি বাড়ির সবাইকে বলুন চলে আসতে। সবাই মিলে একসঙ্গে বিয়ের আয়োজন করবো।’
বাবরি চুল কয়েক পা এগিয়ে এসে বললো, ‘মীরা, আপনি কি মন থেকে খুশি?’
‘হুম।’
‘বিশ্বাস হয় না। কিভাবে আপনার মন জয় করবো জানা নেই। আপনি কিছু টাস্ক দিলে সুবিধা হতো।’
‘মন জয় করার জন্য বাকি জীবন তো পরেই আছে। হয়ে যাবে সমস্যা নেই।’
‘এত সহজে আপনি আমাকে গ্রহণ করছেন!’
‘না করে উপায় আছে? বিয়ে যখন ঠিক হয়েই গেছে। এখন কি আমি আপনার সামনে ছুড়ি ধরে বলবো যে আমাকে টাচ করবেন না? আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে? এসব বললে খুশি হবেন?’
সে হাসতে হাসতে বললো, ‘এটা বলবেন না তাহলে?’
‘না।’
‘তারমানে টাচ করার পারমিশন আছে?’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আশ্চর্য লোক একটা। রেগে আগুন হয়ে বললাম, ‘এবার কিন্তু আমি একাই বের হয়ে যাবো বলে দিলাম। আপনার সঙ্গে যাবোনা আমি। একাই যেদিকে ইচ্ছে চলে যাবো।’
সে হেসে বললো, ‘আচ্ছা বাবা সরি। কোথাও যেতে হবে না। আপনি থাকুন এখানে, আমিই যাচ্ছি।’
সে বাসার ভেতরের দিকে পা বাড়ালো। দূর থেকে বললো, ‘ভাবীর নাম্বারটা হোয়াটসঅ্যাপে দিচ্ছি। সময় করে কল দিয়েন। সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।’
‘আমার চোখের সামনে থেকে যান।’
সে দুই হাতে মাফ চাই ধরনের একটা ভঙ্গী ফুটিয়ে তুললো। আমি মুখ বাঁকা করে ফেললাম। আড়াল হয়ে গেলো সে।
নিজের শাড়ির দিকে চোখ যেতেই ওর বলা সেই কথাটা মনে পড়ে গেলো, আপনাকে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো দেখাচ্ছে। কথাটা মনে পড়তেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো গলে গেলাম আমি।
চলবে..
Share On:
TAGS: বাবরি চুলওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুলওয়ালা গল্পের লিংক
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ১৮
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ২
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৭
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৮
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৪