০৫
আমি দুই হাতে মুখ ঢেকে আছি। বাবরিচুল বললো, ‘অন্যের প্রাইভেসি নষ্ট করা মহা অন্যায়। কাজেই, আমি তোমাকে কোনো হেল্প করতে পারছি না। দুঃখিত।’
আমি মুখ থেকে হাত সরিয়ে আশ্চর্য হয়ে তাকালাম। সত্যিই বাবরিচুল ফোন উঁচু করে ধরে রেখেছে। স্কিনের দিকে তাকায় নি! ঝিকিকে কথাগুলো বলে সে আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো, ‘এই নিন আপনার ফোন।’
আমি হতভম্ব অবস্থায় ফোনটা হাতে নিলাম। লোকটার প্রতি সম্মান বেড়ে গেলো আমার। একটু হলেই তার কাছে আমারই সম্মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতো। চলে যেতেই আমি শক্ত করে ফোনটা হাতের মুঠোয় ধরে রেখে ঝিকিকে বললাম, ‘কি বুঝলি? ওনার কাছ থেকে তোদের অনেক কিছু শেখার আছে।’
ঝিকি হতাশ হয়ে বললো, ‘আচ্ছা শিখবো। এখন বলো ওই ছেলেটা কে?’
‘মামাবাড়ির আবদার। ৫০০ টাকা দে, তাহলে বলবো।’
‘দেবো না। আমি এক্ষুনি তোমার আম্মুকে বলে দিচ্ছি।’
‘যা যা, যাকে ইচ্ছে বল।’
ঝিকি রেগে আগুন হয়ে আমার সামনে থেকে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই একজন এসে খবর দিলো বাবা আমাকে ডাকছে! আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। অজান্তেই বাবাকে রাগিয়ে দিলাম না তো?
ভয়ে ভয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। দেখলাম সবাই মিলে আলোচনায় বসেছে! আমার হাত পায়ে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো। এই সামান্য বিষয়ে এত বড় মিটিং ডাকার কোনো মানে হয়!
ভেতরে এসে বুঝলাম পরিস্থিতি যা ভেবেছিলাম তা নয়। আব্বু আমাকে বললেন, ‘মা মীরা, তোর কাছে মেইলে একটা ফাইল আসছিলো না? ওটা কি তোর মোবাইলে ডাউনলোড করা আছে?’
আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারমানে কাহিনি অন্য কিছু নিয়ে। বললাম, ‘না আব্বু। ওটা ল্যাপটপে ডাউনলোড করা আছে।’
আব্বু চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘তাহলে তো সমস্যা। কাল আমার একটা মিটিং আছে। একজন ইনভেস্টর আসবেন দেখা করতে। ওনার সঙ্গে বসার জন্য কাগজগুলো প্রিন্ট করে নিয়ে যেতে হবে।’
আমি আব্বুকে ভরসা দিয়ে বললাম, ‘কোনো সমস্যা নেই। আমি তোমার সঙ্গে কাল বাসায় যাবো।’
‘বিয়ের আনন্দ রেখে তুই আমার সঙ্গে যাবি?’
‘হ্যাঁ। তুমি যেহেতু বিয়েবাড়ি রেখে মিটিংয়ে যাবে, আমিও যেতে পারবো। অনেক আনন্দ করেছি। তোমার মিটিং শেষ হলে আবার তো ব্যাক করবা এখানে। তাইনা?’
‘হ্যাঁ। কাল এই ধর দুপুরের দিকে আবার ব্যাক করবো।’
‘ঠিক আছে। এটা কোনো ব্যাপারই না।’
আব্বুকে খুবই নিশ্চিন্ত দেখালো। আমার ভালো লাগছে বাবাকে এইটুকু স্বস্তি দিতে পেরে। এরপর আব্বু বললেন, ‘এখন ঝামেলা একটা। আমি তো ইংরেজি বুঝি না তেমন। ওনার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে।’
আমার মেজো আপু বলে উঠলো, ‘তোমার জামাই পারবে আব্বা। ওকে নিয়ে যেও।’
আমার মেজো দুলাভাই সঙ্গে সঙ্গে আৎকে উঠলো, ‘আরে পাগল নাকি? আমি তো টুকিটাকি ইংলিশ পারি। ওই লোক আসবে জার্মান থেকে। ওনার সঙ্গে কথা বলার মতো ইংলিশ আমি পারবো নাকি? দেখা যাবে উনি বলবে একটা, আমি বুঝবো আরেকটা। শেষমেশ আমও যাবে, ছালাও যাবে।’
আমি বাবার দিকে তাকালাম। আমি ইংলিশ বুঝি। যদিও কথোপকথন চালানোর চেষ্টা কখনো করিনি। অতটাও আত্মবিশ্বাস নেই। তবুও কি আব্বুকে বলবো, আমি তোমার সঙ্গে মিটিংয়ে থাকবো? আমার দ্রুত হার্টবিট হচ্ছে। বলবো কি না, বলবো কি না… উফফ ভাবতে ভাবতে উত্তেজনা কাজ করছে।
এমন সময় বাবা বললেন, ‘মুনযিরকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখা দরকার। ও পারবে কিনা?’
দুলাভাই বললো, ‘আমি এখনই যাচ্ছি আব্বা।’
মেজো দুলাভাই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি চুপ করে রইলাম। হঠাৎ বেড়ে যাওয়া হার্টবিট আবার স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসলো।
দুলাভাই ফিরে এসে বললো, ‘আরে, ওই ছেলেটা তো একটা ট্যালেন্ট। ওর পুরো শরীরেই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি। ওর কথা শুনলে মনেই হয়না ও বাংলাদেশের। এত সুন্দর করে ইংরেজি বলে। আব্বা আপনি ওকেই নিয়ে যান।’
‘ঠিক আছে। তাহলে তো হলোই। কাজটা যেন হয়ে যায়। দোয়া করিও সবাই।’
আমি এক মিশ্র অনুভূতিতে পড়ে গেলাম। আব্বুর জন্য কাল একটা বিশেষ দিন। আমার বাবার বহুদিনের স্বপ্ন নিজের এলাকায় একটা গার্মেন্টস দেয়ার। যেখানে এলাকার হতদরিদ্র মানুষেরা কাজ করবে। এলাকাতেই উৎপাদিত হবে বিদেশী মানের কাপড়। তারপর সেগুলো দেশের বাইরে বিক্রি হবে। ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে আমার এলাকার সোনার মানুষগুলোর। বাবার এই স্বপ্ন পূরণ হলে বাবার মতো আমরাও ভীষণ আনন্দিত হবো।
ঠিকমতো ঘুমাতে পারছিলাম না আমি। একদিকে বাবার জন্য আমার আনন্দ হচ্ছে, টেনশন হচ্ছে। অন্যদিকে এই ভেবে উত্তেজিত হচ্ছি যে, কাল আমরা তিনজন একসঙ্গে যাবো। আচ্ছা, আমরা কি সিএনজিতে যাবো? বাবার সামনে কাল খুব ভদ্র হয়ে থাকতে হবে আমার। আচ্ছা, কোন ড্রেসটা পরবো আমি?
ঘরভর্তি মানুষজন ঘুমাচ্ছে। বিছানায়, মেঝেতে। সবাইকে ঠেলেঠুলে আমি উঠে এসে লাগেজ খুললাম। আমার জামাকাপড় গুলোর মধ্য থেকে খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে সুন্দর জামা কোনটা সেটা বুঝতে চেষ্টা করছি। হঠাৎ বড় ফুফু বললেন, ‘এত রাতে খচরখচর করে কে রে?’
আমি হুট করে ফোনের টর্চ নিভিয়ে ফেললাম। ফুফু বললেন, ‘ঘুমা মীরা। অনেক রাত হইছে।’
অগত্যা জামাকাপড় ফেলে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু মনের ভেতর উত্তেজনার ঢেউ। বাবার সামনে একবারও বাবরি চুলের দিকে তাকানো যাবেনা। কথাও বলা যাবে না। কাল আমি থাকবো পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তশিষ্ট আর লক্ষী মেয়ে হয়ে।
সকাল নয়টা। রেডি হচ্ছি আমি। মা বারবার তাড়া দিচ্ছেন। আরো এক ঘন্টা আগেই বের হওয়ার কথা ছিলো। আমি রেডি হতে দেরী করছি। বাবা রেগে যাওয়ার আগেই রেডি হতে হবে। এদিকে উত্তেজনায় ঠিকঠাক কিছুই করতে পারছি না।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দেখি আমরা দুইজন যাচ্ছি, আমি আর বাবা। আমি ভাবলাম বাবরিচুল হয়তো সামনে আছে। চুপচাপ রইলাম। কিন্তু বাজারে এসে সিএনজিতে ওঠার পরও বাবরিচুলকে দেখা গেলো না। সে কোথায়? এটা তো বাবাকে জিজ্ঞেসও করার উপায় নেই। কৌতুহল চেপে রেখেই বসে রইলাম।
প্রায় মিনিট দশেক পরে বললাম, ‘তোমার ইংলিশে কথা বলার জন্য কাকে ঠিক করেছো আব্বু?’
‘মুনযির থাকবে।’
‘ওহ আচ্ছা। শুধু আমরা দুইজন যাচ্ছি তো, এজন্য জিজ্ঞেস করলাম। আমি অবশ্য ভেবেছিলাম আমি থাকবো মিটিংয়ে। যদি তুমি চাও আরকি।’
‘মুনযির পারবে। শুনেছি ও অনেক দক্ষ ইংলিশে। ও সকাল ছয়টার দিকে চলে গেছে।’
এতক্ষণে নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে আমি খুশি হবো নাকি দুঃখী- বুঝতে পারলাম না। এত সাজুগুজু করা বৃথা। নিজের জামার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছে, জামাটাও আমাকে করুণা করছে। সত্যি বলতে এই জামাটা এনেছিলাম স্পেশাল কোনো সময় পরার জন্য। যেমন বিয়ের পরে পাত্রীকে আনতে যাওয়ার সময়! বেশী ঢং দেখিয়ে আজকেই পরে ফেললাম। সবাই দেখে ফেললো। অথচ যাকে দেখানোর জন্য পরলাম, সেইই দেখলো না!
বাসায় পৌঁছে দ্রুত ল্যাপটপ খুলে আব্বুকে ফাইলটা ট্রান্সফার করে দিলাম। বাসার পাশের দোকান থেকে সবগুলো কাগজ প্রিন্ট করে আব্বু আমাকে দেখালেন। সুন্দরভাবে কাগজগুলো সাজিয়ে একটা ফাইলে তুলে রেডি করে দিলাম। আলমারি থেকে আব্বুর সবচেয়ে সুন্দর স্যুট বের করে আব্বুকেও সাজগোজ করিয়ে দিলাম। খুশি মনে আব্বু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘তুই গেট বন্ধ করে দিয়ে বাসাতেই থাক। আমি মিটিং শেষ করে আসতেছি।’
‘আচ্ছা আব্বু, বেস্ট অব লাক। খুব ভালো মিটিং হবে দেখো।’
‘ ইনশাআল্লাহ।’
বাবাকে বিদায় দিয়ে গেট বন্ধ করে দিয়ে রুমে এলাম আমি। কোনো কাজ নেই আমার। আলমারি খুলে আরো দুইটা সুন্দর ড্রেস বের করলাম। একগাদা চুড়ি, কানের দুল, ব্রেসলেট নিলাম। এরপর নতুন আরেক জোড়া জুতা বের করে রাখলাম। মায়ের আলমারি থেকে বের করলাম দুইটা শাড়ি। সবকিছু ব্যাগে ভরে রাখলাম।
পুরো বাসার সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করতে লাগলাম আমি। বাসায় এমনিতে বিড়াল বা ইদুর নেই। তারপরও একবার দেখা দরকার। হঠাৎ বাবরিচুলের রুমে এসে থমকে দাঁড়ালাম।
এই রুমটা আগে সবসময় ফাঁকাই থাকতো। ছেলেটা বেশ গোছালো স্বভাবের। রুমের বেডশিট টানটান করে বিছিয়ে রাখা। রুমে একটা ড্রেসিং টেবিল আছে। ড্রয়ার খুলতে গিয়ে বুঝলাম তালাবদ্ধ। মেজাজটা খারাপ হলো। তালা দিয়ে রাখতে হবে কেন? অবশ্য তার ঘর, তার জিনিস। তালা দিয়ে রাখতেই পারে। তাতে আমার কি? অন্যের জিনিস দেখার প্রতি আমার অত লোভ নেই।
বাইরে এসে টবের গাছগুলোতে পানি দিলাম। সময় যেন কাটছেই না। অথচ এটা আমারই বাড়ি। আমারই চিরচেনা থাকার জায়গা! মাত্র দু চারদিনেই কেমন অদ্ভুত লাগছে আমার। মনে হচ্ছে দাদুবাড়িতে তারাতাড়ি ফিরে গেলেই বাঁচি!
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম গেটে খটাখট শব্দ হচ্ছে। বাবা এসেছে হয়তো। আমার ফোন খুঁজে পেলাম না। এক দৌড়ে বাইরে এলাম আমি।
গেট খুলে আমি হতভম্ব! সাইয়ারা মুভির নায়ক এসেছে বাইক নিয়ে! আরেকবার মাথা ঝাড়া দিয়ে তাকাতেই বুঝলাম এটা বাবরি চুলওয়ালা।
বললাম, ‘আপনি? এখানে? এই সময়?’
‘আংকেল বলেছেন আপনাকে নিয়ে যেতে।’
‘কোন আংকেল?’
‘আপনার বাবা।’
‘কোথায় নিতে যেতে?’
‘দাদাবাড়িতে।’
‘আমার বাপ জীবনেও এটা বলবে না।’
‘ফোন দিন ওনাকে।’
‘দিচ্ছি। আপনি কি মিটিং শেষ করে ফিরলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘মিটিং কেমন হয়েছে?’
‘ভালো। খুব ভালো।’
‘আব্বু কোথায়?’
‘ওনার আরো কিছু কাজ বাকি আছে।’
‘আপনি আব্বুকে রেখে চলে যাচ্ছেন যে?’
‘জার্মান ভদ্রলোক চলে গেছে। বাকি কাজ আংকেল একা করতে পারবেন। উনিই বলেছেন আপনাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে।’
আমি গেট থেকে সরে এলাম। আমার চোখে এখনো ঘুমের রেশ। কিন্তু রয়েল এনফিল্ড বাইক উনি কোথায় পেয়েছে! প্রথম দেখে ভেবেছিলাম সাইয়ারা মুভির নায়ক আমার বাসার দরজায়! নিছক স্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিতে যাচ্ছিলাম।
পরক্ষণেই এই ভেবে হাসি পেলো যে, তারমানে আমার হবু বর পাক্কা সিনেমার হিরোদের মতো। কী কপাল আমার!
ফোন খুঁজে পাচ্ছি না। বাবরিওয়ালা নিচতলায় ড্রয়িং রুমে বসে আছে। আমি বললাম, ‘আমার নাম্বারে একটা কল দিতে হবে। ফোন খুঁজে পাচ্ছি না।’
বাবরিওয়ালা নিজের ফোনটা এগিয়ে দিলো আমার দিকে। আমি নাম্বার তুলে কল দিলাম। খুবই মৃদু সাউন্ডে রিংটোন বাজছে। কিন্তু কোথায় বাজছে বুঝতে পারছি না।
বারবার কল দিয়ে আমি ড্রয়িংরুম, রান্নাঘরে খুঁজছি। হঠাৎ বাবরিওয়ালা আমার ফোন নিয়ে এসে সামনে এগিয়ে ধরলো। আমি ওনার ফোনটা ফেরত দিয়ে আমার ফোনটা নিলাম। তারপর মুচকি হেসে বললাম, থ্যাংকস। কোথায় পেলেন?
সে নির্বিকার ভঙ্গীতে বললো, আমার রুমে।
টপ করে আমার মুখের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। ছি ছি, মীরা। করেছিস কি তুই? ফোনটা ফেলে আসার আর জায়গা পেলি না? শিট।
লজ্জা এড়াতে বললাম, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে আপনার রুমে যাইনি। আমি আসলে পুরো বাসাটাই চেক করছিলাম। মানে… আমরা তো সবাই বাসার বাইরে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা এজন্য।’
বাবরিচুল স্বাভাবিক ভাবেই বললো, ‘ইটস ওকে। পুরোটাই আপনার বাসা। আপনি যেতেই পারেন।’
‘আপনি মাইন্ড করেননি তো?’
‘কেন?’
‘ওকে। খুব ভালো।’
আমি বাবার নাম্বারে কল দিলাম। রিসিভ করে বললেন, ‘হ্যাঁ মীরা। আলহামদুলিল্লাহ মিটিং খুবই ভালো হয়েছে মা। মনে হচ্ছে কাজটা হবে।’
‘তুমি দাদুবাড়িতে যাবে না?’
‘যাবো। আমার আরো দেরী হবে মা। আমি মুনযিরকে পাঠিয়েছি। তুই ওর সঙ্গে যা।’
‘কিন্তু.. আমি ওনার সঙ্গে যাবো না।’
‘যা। কোনো অসুবিধা নেই। বাবা বলেছি তো। সে অনেক ভালো ছেলে।’
আব্বু কল কেটে দিলেন। আমি বিব্রত মুখে বাবরিচুলের দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে। আমি তাকানো মাত্রই বললো, ‘আমার সঙ্গে যাবেন না বললেন কেন? আমি কি ভূত?’
‘ভূতের মামা আপনি।’
‘কিহ?’
‘শুনুন, আমি বাইকে যাবো না। আমি বাইক ভয় পাই। তাছাড়া দাদুবাড়ি অনেক দূর। এতদূর বাইকে জার্নি করতে পারবো না।’
বাবরিচুল খানিকক্ষণ ভেবে বললো, ‘তাহলে বাইকটা রেখে যাই। বাসে যাবেন? নাকি সিএনজিতে?’
‘যেকোনো একটাতে গেলেই হবে।’
‘ঠিক আছে।’
বাবরিওয়ালা বাইকটা বাসার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে গেলো। আমি হতভম্ব হয়ে বিছানায় বসে রইলাম। বাইকে আমি মোটেও ভয় পাইনা। তার সঙ্গে বাইক জার্নি করবো ব্যাপারটা ভেবেই আমার পুরো শরীর হিম হয়ে যাচ্ছিলো। ওসব সিনেমায় হয়। নায়কের বাইকের পিছনে নায়িকা। আমি নিজেকে মনেমনে নায়িকা ভাবলেও আপাতত ওনার বাইকে ওঠার দুঃসাহস আমার নেই।
আমি কাপড়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে দরজায় এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাবরিওয়ালা নিজের রুমে। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেলো গতকালের কথা। কালকে বাবা যখন বলেছেন, তোর ওকে পছন্দ না হলে আমাকে বলিস। তখন আমি বলেছিলাম, “ওনাকে পছন্দ অপছন্দ করার সুযোগ দিয়েছো তুমি? আমাকে তো বলেছো যাতে ওনার আশেপাশে না যাই।” এ কারণে কি আব্বু আজকে ইচ্ছেকৃতভাবে ওকে পাঠিয়েছে? যাতে আমি পরিচিত হই? পছন্দ করার সুযোগ পাই?
কথাটা ভেবে নিজের কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লাম। এ কেমন কারবার হলো?
এমন সময় বাবরিচুল সামনে এসে বললো, ‘আবার কি হলো? মাথায় হাত কেন?’
‘কিছু না। কার বাইক এটা?’
‘আমার বন্ধুর।’
‘বন্ধু কিছু বলবে না, এটা যে এখানে রেখে যাচ্ছেন?’
‘না। এই বন্ধু কিছু বলার বন্ধু না।’
‘ওহ আচ্ছা।’
দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। বাসা থেকে বের হয়েই একটা অটোতে উঠলাম আমরা। সে বসেছে আমার মুখোমুখি। মনে হচ্ছে অটোতে গেলেই সবচেয়ে ভালো হবে। বাসে কিংবা সিএনজিতে উঠলে পাশাপাশি বসতে হবে, বিষয়টা অস্বস্তিকর হবে আমার জন্য।
অটো থেকে নেমে সামনেই সিএনজি স্ট্যান্ড। বাবরিওয়ালা সিএনজি ঠিক করতে যাচ্ছে। আমি বাঁধা দিয়ে বললাম, চলুন অটোতে যাই।
সে বললো, ‘সিএনজিতে তারাতাড়ি যাওয়া যাবে।’
‘তারাতাড়ি যাওয়ার মতো তাড়া আমার নেই। সিএনজিতে আমার দমবন্ধ লাগে। অটোতে যাবো। অটো খোলামেলা, বাতাস লাগবে।’
অবশেষে সে অটোতে উঠতে বাধ্য হলো। এবার আমার মুখোমুখিই বসেছে। আহারে বেচারা, নায়কের মতো বাইক নিয়ে এসেছিলো! ভেবেছিলো নায়িকাকে নিয়ে বাইকে করে যাবে। বাতাসে নায়িকার চুল উড়বে। নায়িকা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তাকে ধরে থাকবে। ইশ, বেচারার শখ পূরণ হলোনা। অবশ্য সে এরকম নাও ভাবতে পারে। দেখে তো ভদ্রলোকের বাচ্চা বলেই মনে হয়।
শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ঢুকে পড়তেই পথের দুপাশে বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ। শো শো করে বাতাস এসে গায়ে লাগছে। চুল উড়ছে আমার। বাইরে তাকিয়ে আনমনে কত কী ভাবছি! কিছুদূর আসার পরে আমার পাশে বসা একজন মহিলা যাত্রী নেমে গেলেন। পুরো সিটে আমি একা বসে রইলাম। আরো কিছুদূর যেতেই দুইজন পুরুষ যাত্রী নেয়ার জন্য অটো দাঁড়ালো। আমার পাশে যেহেতু আসন ফাঁকা, সিস্টেম অনুযায়ী ওনারা আমার পাশেই বসার কথা।
আমি লাজলজ্জা ভুলে বাবরিওয়ালাকে বললাম, ‘আপনি এখানে বসুন।’
বাবরিওয়ালা কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার পাশের সিটে বসলো। এটা কিছু হলো! যেই ভয়ে আমি সিএনজি আর বাসে ওঠার সিদ্ধান্ত ছাটাই করেছিলাম, আমাকে সেই ফাঁদেই পড়তে হলো!
অটো ছুটছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। পরিস্থিতি কেমন যেন অস্বস্তিকর। আমি অনেকটা বাধ্য হয়েই বাবরিচুলকে বললাম, ‘আপনার বাসা কোথায়?’
‘রাজশাহী।’
‘তাহলে আপনি এখানে কি করছেন!’
‘সে অনেক কাহিনি। অত বড় গল্প শোনার ধৈর্য আপনার হবে?’
‘না, হবেনা। এক লাইনে বলুন।’
‘একটা কাজে এসেছিলাম। আপাতত কিছুদিন এখানেই থাকবো।’
‘কিছুদিন! তারপর কি চলে যাবেন?’
‘নাও যেতে পারি। আমার ঠিক নেই। যেখানে ক্যারিয়ার দাঁড় করাতে পারবো, সেখানেই থাকবো।’
‘কিসের ক্যারিয়ার?’
‘স্বপ্ন তো অনেক কিছুই ছিলো। এখন দেখা যাক সামনে কী হয়!’
আমি হঠাৎ বলে বসলাম, ‘আব্বু ইনভেস্টমেন্ট পেয়ে গেলে সামনে বিশাল বড় ভবিষ্যৎ। আব্বু একা অত কিছু সামলাতে পারবে? আপনাকে তো অবশ্যই আব্বুর পাশে থাকতে হবে।’
সে মুচকি হেসে বললো, ‘থাকতে হলে থাকবো।’
‘এটা কোনো কথা হলো? আব্বু একা একা একটা গার্মেন্টস কিভাবে সামলাবে?’
‘উনি একাই স্বপ্ন দেখে এসেছেন বহু বছর ধরে। সামলাতে ভয় পেলে কেউ সেই স্বপ্ন দেখেনা মীরা।’
কথাটা সত্যি। বাবরিওয়ালা বাবার জীবনে এসেছে কয়েকদিন হলো। বাবা এই স্বপ্ন বুকে লালন করে আছে বহু বছর ধরে। কোন কোন সেক্টরে কাজ হবে, কতজন শ্রমিক কাজ করবে, প্রোডাক্টসের কোয়ালিটি কেমন হবে, কোথায় কোথায় ডিস্ট্রিবিউট হবে, সবকিছুই বাবার ভেবে রাখা আছে। আমি জানিনা কেন বাবরিওয়ালাকে কথাটা বলেছি আমি! হয়তো তার চলে যাওয়ার কথাটা আমারও পছন্দ হয়নি..
আমি বললাম, ‘আপনার বাসায় কে কে আছে?’
‘সেভাবে কেউ নেই। আমরা তিন ভাই। বাকি দুই ভাই বয়সে বড়। বিবাহিত তারা।’
‘আচ্ছা।’
কিছুদূর যেতেই আমরা দুইজন ছাড়া বাকিরা নেমে যায়। এরপর অটো আবারও দাঁড়িয়ে পড়লো। এবার পাঁচ জন যাত্রী। তারা সবাই একসঙ্গে যাবে অন্য একটা রুটে। অটোচালক আমাদেরকে উদ্দেশ্যে করে বললো, আপনাদের দুজনকে আরেকটা অটোতে তুলে দেই? আমি এই যাত্রীগুলোকে নামিয়ে দিয়ে আসি। আপনারা তো মাত্র দুইজন। ভালো হয় ভাই..
বাবরিওয়ালা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে।
সম্পূর্ণ অচেনা একটা বাজারে অটো আমাদেরকে নামিয়ে দেয়। আশেপাশে তাকিয়ে পুলকিত বোধ করি আমি। মনে হচ্ছে বাজার নয়, মেলায় এসেছি। আশেপাশে এত হরেক রকমের দোকান। কী নেই সেখানে!
আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, ‘আমরা কি একটু এক্সপ্লোর করতে পারি?’
‘কি এক্সপ্লোর করতে চান?’
‘আশেপাশে একটু ঘুরি। কি কি পাওয়া যায় দেখি। তারপর আরেকটা অটো নিয়ে চলে যাবো?’
সে কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো, ‘ওওওকেএএ।’
চলবে..
Share On:
TAGS: বাবরি চুল ওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৮
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৭
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৯
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৩
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৬