#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৩৩
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে দু’টো বাইক ছুটে আসছে বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামের দিকে। চারপাশে অন্ধকার পাহাড়, কোথাও ঘন কুয়াশায় আলোর রেখা মিশে যাচ্ছে। তৃষার বাইকের লাইট পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে কেটে যাচ্ছে রাতের পর্দা, আর প্রেম সামনের দিকে গতি ধরে রেখেছে।
“প্রেম, এই আঁকাবাঁকা পথেও তুমি আমাকে হারাতে পারবে না,” তৃষা গর্জে উঠল হেলমেটের ভেতর থেকে।
প্রেম একপলক তাকাল পিছনে। “চলো তবে দেখা যাক, পাহাড় জয়ের পর শহরের রাস্তায় কার রাজত্ব!”
পাহাড় পেরিয়ে বাইক দু’টো নেমে এলো চট্টগ্রামের ফ্লাইওভার ঘেঁষা হাইওয়েতে। রাত তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই। শহরের আলো পেছনে ফেলে একদল বাইক রাইডার ইতিমধ্যেই জড়ো হয়েছে। অবৈধ রেসের উন্মাদনা ছড়িয়ে আছে বাতাসে। হেলমেটের ভেতর থেকে ভেসে আসছে শিস, হাসাহাসি আর ইঞ্জিনের গর্জন। তৃষার দলের পুরোনো সদস্যগন তাকে এতদিন পর দেখতে পেয়ে খুশি। তারই মাঝে কেউ কেউ প্রেমের এটেনশন পাওয়ার জন্য তার পেছন ঘুরঘুর করছে। তৃষাদের দলের যেই সিনিয়র লোকটা সে প্রেম বাইক থেকে নেমে হেলমেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে এসেই তার সঙ্গপ হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘গত বছর আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম। আপনার রেইস দেখার জন্য। আমি আপনার অনেক গুলো মুভিই করার চেষ্টা করি। তবুও কেন জানি আপনার মতো পারফেক্ট হয় না।’
তৃষা সেদিকে তাকালো। তার সিনিয়র তার সঙ্গে কথা না বলে এত কিসের প্রেম নেওয়াজের সঙ্গে কথা বলছে? প্রেম কথা বলে ফিরতেই তৃষা আর সে বাইক নিয়ে রাস্তায়প্রবেশ করল। তা দেখে নতুনদের মধ্যে অনেকেই অবাক হয়ে তাকাল। একজন বলে উঠল,“ওরে! মেয়ে নাকি রেস করবে প্রেমের সাথে?”
অন্যজন হাসল, “দেখ, আজ রাতটা জমবে।”
প্রেম বাইক স্টার্ট দিল, গর্জন উঠল বুক চিরে। তৃষা সমান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গিয়ার পাল্টাল। চোখে চোখ পড়তেই দু’জনের ভেতর প্রেমময় দহন জ্বলে উঠল।
থ্রি… টু… ওয়ান… ভ্রূঁউউউমমম!!! দু’টো বাইক ছুটল একসাথে। হাইওয়ের বাতাস ছিঁড়ে যাচ্ছে, লাইটপোস্টগুলোর আলো পিছনে ঝাপসা হয়ে পড়ছে। তৃষার চুল হাওয়ায় কাঁপছে, বুকের ভেতর ঢাকের মতো বাজছে হৃদস্পন্দন। প্রেম মাথা নিচু করে গতি বাড়াচ্ছে, চোখে কেবল রাস্তার রেখা।
“প্রেম! আজ কিন্তু আমি হারব না,” তৃষার কণ্ঠ ভেসে এলো ইঞ্জিনের শব্দের ফাঁক দিয়ে।
প্রেম হেসে উঠল, নিটরো আরও টেনে দিল, “আমাকে হারাতে হলে কেবল গতি নয়, হৃদয়ের সাহসও চাই, তৃষা।”
গতি ছুঁলো ১৪০… ১৫০… ১৬০ কিলোমিটার। রাস্তায় হঠাৎই একটা ট্রাক ঢুকে পড়ল পাশ থেকে। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে দু’জনেই বাইক কাত করে বেরিয়ে গেল ট্রাকের পাশ দিয়ে। চাকায় ঘর্ষণের শব্দ ছড়িয়ে পড়ল রাতের নিস্তব্ধতায়। দর্শকরা শিস দিল, উত্তেজনায় হাততালি বাজল। শেষ ল্যাপের সময় দুই বাইক এতটাই পাশাপাশি এল যে হ্যান্ডেল প্রায় ছুঁই ছুঁই। দু’জনের চোখেই উত্তেজনা। কেউ ছাড়বে না কাউকে।
ব্রিজের কাছে এসে হঠাৎ প্রেম গিয়ার পাল্টে গতি বাড়িয়ে দিল। অল্প কয়েক ইঞ্চি সামনে চলে গেল সে। তৃষা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রেম এক নিশ্বাসের ব্যবধানে ফিনিশ লাইন ছুঁয়ে ফেলল।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা। তারপর দর্শকদের চিৎকার, শিস, হাততালি। প্রেম বাইক থামিয়ে হেলমেট খুলল, ঘামে ভিজে যাওয়া মুখে জয়ের দুষ্টু হাসি। তৃষাও হেলমেট খুলে চুল ছিটকে দিল। মুখটা কালো হয়ে গেল। সঙ্গে অজানা একটা ভয়। কি করে হারল? তার জয় তো নিশ্চিত ছিল? রাগ হচ্ছে তার। ভীষণ রাগ হচ্ছে। কি করে সে একজন প্রফেশনাল রাইডার হয়ে প্রেম নেওয়াজের কাছে এইভাবে হেরে গেল? প্রেম বাইক থেকে নেমে আসতেই চারপাশের মানুষজন ছুটে এসে তাকে ঘিরে ধরল। ছবি তোলার জন্য, কেউ নিজেদের শরীরে অটোগ্রাফ লিখিয়ে নিতে। প্রেমের চোখ তখন যেমন তৃষার দিকে, তৃষার চোখও ভীড় ঠেলে প্রেমের দিকে। প্রেম এগিয়ে তৃষার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কানের সামনে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘এখান থেকে বাড়িতে যেতে দুই-আড়াই ঘন্টা লাগবে। এত অপেক্ষা করার সময় নেই সোনা আমার হাতে।’
তৃসা এগিয়ে এসে বলল, “এক মুহূর্তে জিতেছো, প্রেম। কিন্তু মনে রেখো আমি হেরে যাইনি, শুধু থেমেছি।”
প্রেম হেসে উঠল, কণ্ঠ নরম হয়ে এলো, “এই জন্যই তো তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বী… আর বিটারহার্ট।”
হাইওয়ের ফিনিশ লাইনের পর ভিড় জমে গেছে। হাততালি, শিস, আর উন্মাদনার মাঝেই হঠাৎ এক তরুণী এগিয়ে এলো প্রেমের দিকে। গায়ে লেদারের জ্যাকেট, লম্বা চুল খোলা। লেদার জ্যাকেটের চেইন খুলে রেখে বারবার চুল নাড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ দু’টো প্রেমকে আকর্ষণ করার চেষ্টায় ব্যস্ত। তৃষা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই মেয়ের কান্ড কলাপ দেখছে। এসব দেখতে তার আবার মন্দ লাগে না। মেয়েটি প্রেমের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আমি ফ্রি আছি। চলো ওইপাশে যাই।’
প্রেম মেয়েটির হাত নিজের কাঁধের থেকে সরিয়ে কাঁধটা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘ফ্রি মাল প্রেম গিলে না। আমার কাছে ইনটেক ব্যান্ডেড প্রোডাক্ট আছে।’ মেয়েটির মুখটা কালো হয়ে গেল। সে আরেকবার প্রেমকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তৃষা এসে প্রেমের সামনে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে প্রেমের বুকে হাত রাখল। প্রেম কেবল চেয়ে আছে। মেয়েটি এখনো পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার রাগ হচ্ছে। যেখানে সে একটা কথা বলাতেই এই ছেলের এমন উত্তর সেখানে এই মেয়ে তো শরীর স্পর্শ করছে। তাকে কেন কিছু বলছে না? তৃষার হাতের ছোঁয়া একটু একটু করে বুক বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। প্রেমের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। তৃষার হাত আচমকা থমকে গেল প্রেমের হোলস্টারে। পিস্তলটা বের করে এক মুহূর্ত দেরি না করে তাক করল মেয়েটির কপালের কাছে। মেয়েটি যেন আন্দাজই করতে পারেনি তার সঙ্গে এমন কিছু হবে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তৃষা তাকে বলল, ‘পুরুষ মানুষ দেখলেই গায়ে ঢলে পড়তে ইচ্ছে করে? ৩ সেকেন্ডের মধ্যে রাস্তা না ধরলে তোমার জায়গা মতো এই পিস্তল ভরে দেব শালী লাফাঙ্গা কোথাকার।’
মেয়েটি ভয়ে চলে যেতেই প্রেম তৃষার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, ‘উফ এখনি জেলাস। যাই হোক বউ তোমার সময়, যাকে মন চায় পিস্তল ভরে দিতে পারো আপত্তি নেই। আমি তো রেসে জিতেছে পরের বার আমার পালা।’
তৃষা জবাব দিলো না। কেবল এখান থেকে কেটে পড়লেি বাঁচে। একটু হেরেছে বলে বার বার খোঁচা দিতে হবে নাকি? পরেরবার একেবারে মজা বুঝিয়ে দেবে।
ঠিক তখনই ভিড়ের ভেতর থেকে কয়েকজন নেশাগ্রস্ত বাইকার গণ্ডগোল শুরু করল। হাতে বোতল, কারও হাতে ছুরি। তারা হৈ-হুল্লোড় করে অন্য গ্যাংয়ের লোকের সঙ্গে মারামারি শুরু করে দিলো। ঝামেল
পরিস্থিতি মুহূর্তেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল। চারপাশে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎই রাতের নিস্তব্ধতা চিরে ভেসে এলো পুলিশের সাইরেন “পুলিশ! পুলিশ চলে আসছে!” কেউ চিৎকার করে উঠল।
এক’মুহূর্তেই চারপাশ অস্থির হয়ে উঠল। রাইডাররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করল। প্রেম দ্রুত বাইকে উঠে চিৎকার করল, “তৃষা! ওঠো এখন নয় তো আর কখনো না!”
তৃষা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তার বাইকে চেপে বসল। গিয়ার ঘুরতেই ইঞ্জিন গর্জে উঠল। পাহাড়ের দিকের অন্ধকার ফাঁকা রাস্তায় দু’টো বাইক ছুটে গেল বজ্রগতিতে। চারপাশে কেবল বাতাসের হুইসেল, কানে বাজতে থাকা পুলিশের সাইরেন, আর পেছনে ঝাপসা হয়ে যাওয়া আলো। তৃষা হেলমেটের ভেতর দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ বৃষ্টি নামবে বোধ-হয়।’
প্রেম গতি বাড়িয়ে পাশ ফিরে হেসে বলল, ‘তাহলে তো প্রসেসিং আরো নতুন ভাবে ঘটিত হবে।’
‘আচ্ছা যদি এখন আমি আপনাকে ছেড়ে এখন চলে যাই?’
‘পারবে না। আমি তোমার সবচেয়ে বিপজ্জনক আসক্তি, তৃষা। এই নেশা ছাড়লে মৃত্যু নিশ্চিত তোমার।’
রাত তখন চারটা। পাহাড়ি আকাশ হঠাৎ মেঘে ঢেকে গেছে। টুপটাপ বৃষ্টি ঝরে পড়ছে, রাস্তার আলোয় চিকচিক করছে ভেজা পিচ। প্রেম বাইকের গতি কমিয়ে বান্দরবানের এক রিসোর্টের সামনে থামাল। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু বৃষ্টির শব্দ আর দূরে জঙ্গলের ঝিঁঝিঁর ডাক। তৃষা হেলমেট খুলতেই ভিজে চুল কপালের ওপর লেপ্টে এলো। বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “প্রেম… থেমে গেলে কেন?”
প্রেম জবাব দিলো না। রিসোর্টের ভেতর ঢুকে চাবি নিয়ে সরাসরি রুমে প্রবেশ করল। তৃষার ভেজা শরীরে উসখুস লাগছে। প্রেম বিষয়টি লক্ষ করে বলল, ‘জামাকাপড় খুলে ওখানে মেলে দাও। কাজ শেষ হতে হতে ওইসব শুঁকিয়ে যাবে।’
‘মা…নে? কিসের কাজ?’
প্রেম তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে তাকালো। বৃষ্টির ধোঁয়াটে পর্দার মধ্যে দাঁড়িয়ে দু’জনেই হঠাৎ থেমে গেল। প্রেম ধীরে ধীরে তৃষার হাতটা ধরল। আঙুলের ফাঁকে আঙুল গেঁথে দিল। তৃষা প্রথমে কিছু বলল না, শুধু বুক ওঠানামা করতে লাগল দ্রুত। চারপাশে কুয়াশা, মাটির গন্ধ, ভেজা বাতাস… প্রেম তার কানে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, “তুমি জানো, এই পৃথিবীর সব রেস আমি হেরে যেতে রাজি… যদি তুমি আমার পাশে থাকো। তবে জিতে গিয়ে যদি তোমার সঙ্গ পাওয়া যায় তবে আমি বার বার তোমায় হারিয়ে জিততে প্রস্তুত।’
তৃষার চোখ ভিজে উঠল। ভেজা ঠোঁট সামান্য কাঁপছিল। সে নিচু গলায় জবাব দিল, “কি করছেন আপনি….আমি বাড়ি যাব।’
বৃষ্টি আরও জোরে নামতে শুরু করল। রিসোর্টের বারান্দার ছাদে ফোঁটা পড়ার শব্দ যেন তাদের নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেল। প্রেম ধীরে ধীরে তৃষার মুখটা নিজের হাত দিয়ে সরিয়ে নিল চুল থেকে। তারপর অপেক্ষা না করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। তৃষা কিছু বলতে গিয়েও বলার সুযোগ পেল না। প্রেমের থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আকুপাকু করল। তবে প্রেম যেন আরো শক্ত করে স্পর্শ করল তাকে। এত কষ্ট করে জিতল, ট্রফি ছাড়া ফেরার অভ্যাস নেই প্রেম নেওয়াজের।
চলবে?
#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৩৪
রুমের চারদিকে নরম হলুদ আলো। জানালার পর্দার ফাঁক গলে অন্ধকার-গাঢ় নীল আকাশের একচিলতে রেখা দেখা যাচ্ছে। বাইরে যেন বৃষ্টি আর হাওয়া একসঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে। শিস দিয়ে, ছাদে ধুপধুপ করে আঘাত করছে। একটানা মেঘের গর্জন আর বজ্রের শব্দে মনে হয় চারদিকের পাহাড়গুলোও নিঃশ্বাস আটকে আছে। বাতাসে কাঁচা মাটির গন্ধ, ভেজা ঘাসের তাজা গন্ধ মিশে আছে। হালকা ঠান্ডা হাওয়া এসে পর্দা উড়িয়ে দিচ্ছে। ভেতরে উষ্ণতার সঙ্গে মিশে তৈরি করেছে নিস্তব্ধতা। বিছানার চাদরও সামান্য ভিজে আছে তৃষার শরীরের ভেজা ছোঁয়ায়। প্রেমের চুলের ডগা থেকেও টুপটুপ করে জল পড়ছে। লেদারের জ্যাকেট থেকে ঘামের সঙ্গে বৃষ্টির গন্ধ। প্রেম তৃষার দিকে এগিয়ে এসে তাকে বুকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তৃষা এবার হালকা চাপ দেয়, সরে যাওয়ার মতো। প্রেম থমকে গেল। তার চোখে একরাশ অনিশ্চয়তা, ঠোঁটে কাঁপা কাঁপা প্রশ্ন। “প্রত্যুষকে ভালোবাসো তুমি?” তার কণ্ঠে যেন আটকে থাকা ক্ষোভ আর কষ্ট একসঙ্গে ঝরে পড়ল।
তৃষা নিচু গলায় নিচের দিকে চেয়ে বলল, “সেই কথা আবার কখন বললাম?”
বজ্রপাতের আলো ঘরের অন্ধকার কেটে মুহূর্তের জন্য দু’জনের মুখ স্পষ্ট করে তুলল। বাইরে বৃষ্টি আরেক দফা জোরে নেমে এল। প্রেম কয়েক ধাপ এগোল। তৃষা এক পা পিছিয়ে গেল। প্রেম থেমে গিয়ে বলল, “আমার স্পর্শ তোমার জন্য ভয়ের? বলে দাও। দায় থেকে আমি মুক্তি পাবো, তুমি-ও আর আমি-ও।”
তৃষা হঠাৎ গুঙিয়ে উঠল, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা কোনো ব্যথা শব্দ হয়ে বেরোল। প্রেম ধীরে ধীরে তার কাছে গিয়ে তাকে বিছানায় বসাল। লেদারের ভেজা জ্যাকেট খুলে বলল, “শরীরটা একেবারে ভিজে গেছে। এই পোশাকে বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। আচ্ছা, আমি রিসোর্টের লোকদের দেখি কোনো শুকনো জামাকাপড় আছে কিনা।” সে উঠে দাঁড়াতেই তৃষা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তার কব্জি ধরে ফেলল। ভেজা আঙুলের স্পর্শে প্রেম থেমে গেল। তৃষার চোখে অদ্ভুত এক অস্থিরতা, আবার আকুলতা। “বসুন। যাবেন না এখন।”
প্রেম ধীরে ধীরে আবার বসে পড়ল তার পাশে।
বৃষ্টির শব্দ যেন আরও তীব্র হয়ে উঠল।
প্রেম নরম গলায় বলল, “কথা দিচ্ছি, তোমার অনুমতি ছাড়া আর কখনো তোমায় স্পর্শ করব না। তবু কেঁদো না প্লিজ। এমনিতেই আমি খারাপ মানুষটা তোমায় কল্পনার থেকেও বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।”
তৃষার চোখ ভিজে উঠল। সে হালকা গলায় বলল,
“আপনি বলুন তো, আপনি কি আসলেই আমাকে ভালোবাসেন?”
প্রেম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বাইরে বৃষ্টি, ঘরের নীরবতা, দুজনের নিঃশ্বাস, সব যেন একসঙ্গে কাঁপতে লাগল। তারপর সে নিচু স্বরে বলল, “একটু অনুভব করলেই তো পারো।”
তৃষার চোখে হঠাৎ এক চিলতে রাগ আর কষ্টের মিশ্রণ, “অনুভব করেছিলাম তো একবার। বিনিময়ে আমায় নরকে ফেলে আপনি হারিয়ে গেলেন।”
প্রেমের মুখে একরাশ ক্লান্ত হাসি। “আমরা কেউ হারাতে চাই না। আমাদের হারিয়ে দেয় পরিস্থিতি, নিয়তি।”
তৃষা নিঃশব্দে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে।
ভেজা পাহাড়ের বুক থেকে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা উঠছে।
দু’জনের মাঝখানে ঝুলে থাকে অদৃশ্য এক প্রশ্ন,
এবার কি সত্যি তারা একে-অপরকে খুঁজে পাবে, নাকি নিয়তিই আবার তাদের আলাদা করে দেবে? তৃষার বুক
উঠানামা করছে দ্রুত, যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জানালার কাচ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। প্রতিটি ফোঁটা যেন তার বুকের ভেতরের অশ্রুর প্রতিধ্বনি। সে হঠাৎ ঘুরে প্রেমের দিকে তাকাল। চোখ দুটো লালচে, কণ্ঠ ভাঙা। “আপনি জানেন, আমি কেন ভয় পাই? কারণ আপনার আসা-যাওয়া সবকিছুই অনিশ্চিত। একদিন ভালোবাসেন, পরদিন হারিয়ে যান। আমার কাছে ভালোবাসা মানেই নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা… অথচ আপনার কাছে ভালোবাসা শুধু আবেগের ঝড়।”
প্রেম চোখ নামিয়ে ফেলে, হাত দুটো মুঠো করে রাখে হাঁটুর ওপর। বাইরে বজ্রপাতের আলো আবার ঝলসে ওঠে, তার মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট হয়। “আমি হারিয়ে যায়নি তৃষা। আমায় হারিয়ে দেয় সময়, মানুষ আর সেই অভিশপ্ত পরিস্থিতি। বিশ্বাস করো, প্রতিটি মুহূর্তে তোমার জন্য বুকটা ভেঙে গেছে।”
তৃষা মাথা নেড়ে ফেলে, চোখের পানি চেপে রাখতে না পেরে বলে ওঠে, “ভালোবাসা কি শুধু বুক ভাঙার গল্প? আমি চাইনি এত দুঃখ, আমি চাইনি এত কষ্ট। আমি শুধু চাইছিলাম আপনার হাতটা আমায় শক্ত করে ধরে থাকুক।”
প্রেম তার হাত ধরতে চাইলে তৃষা প্রথমে সরে যায়, কিন্তু পরক্ষণেই আঙুলগুলো ধরা পড়েই যায়।
প্রেমের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, “তুমি জানো, আমি পারলে তোমাকে পৃথিবীর সব কষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখতাম। কিন্তু আমি নিজেই তো ভাঙাচোরা মানুষ। তবু একটা কথা শোনো তৃষা আমি যতোই ভুল করি না কেন, আমার ভালোবাসার সত্যিটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন রেখো না।”
তৃষা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ভেতরে রাগ আর টান একসঙ্গে জ্বলে ওঠে। “তাহলে কেন প্রত্যুষের নাম নিলেন? কেন বারবার আমার বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে চান?”
প্রেমের ঠোঁট শক্ত হয়ে ওঠে, “কারণ আমি হিংসে করি। তোমাকে অন্য কারও ছায়াতেও কল্পনা করতে পারি না। আমি চাই তুমি শুধু আমার হও। আমি তোমায় ভালোবাসি এর মানে কি জানো?”
‘ কি?’
“জগতের সকল পুরুষ তোমার জন্য নিষিদ্ধ, হারাম।”
ঘরটা নীরব হয়ে যায়। শুধু বৃষ্টির শব্দ আর দুজনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে চলতে থাকে।
তৃষার চোখে আবারও জল গড়ায়, কিন্তু এবার তা একেবারে ভিন্ন রকম—মিশে আছে অভিমান, আবার অস্বীকার করতে না পারা ভালোবাসা।
সে ধীরে ধীরে বলে, “প্রেম, আপনি যদি আমার ভেতরের ভয়টুকু মুছে দিতে পারেন… তবে হয়তো আমি আবার বিশ্বাস করতে পারব।”
প্রেম তার মুখের ভিজে চুল সরিয়ে দেয়, নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলে, “তাহলে আমাকে সময় দাও। আমি প্রমাণ করব, এইবার আর কোনো ঝড় তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।”
জানালার বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু ভেতরের এই দুজনের রাত এখনো শেষ হয়নি।বাইরে বৃষ্টির শব্দ ধীরে ধীরে কমে এসেছে। পাহাড়ের বুক থেকে কুয়াশা গড়িয়ে পড়ছে নিচে। আকাশে ফিকে আলো ফোটার ইঙ্গিত। রাতের কালো রঙে মিশে গেছে ভোরের হালকা সোনালি আভা। রুমের ভেতর যেন এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছে। কিন্তু সেই শান্তির নিচে জমাট বেঁধে আছে অজস্র না-বলা কথা।
তৃষা বিছানায় বসে আছে, তার ভেজা জামা এখনো গায়ে। দৃষ্টিতে আরেক রকম নরমতা। প্রেম ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে আসে। নিঃশব্দে মেঝের ওপর হাঁটুর ভাঁজ ফেলে বসে পড়ে। তার চোখ সরাসরি তৃষার চোখে আটকে যায়। “তুমি ভয় পেও না, তৃষা। আমি যদি আবারও তোমার হাত ছাড়ি… তবে সেটাই হবে আমার জীবনের শেষ ভুল।”
তৃষা থমকে তাকায় তার দিকে। ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু কথা বেরোয় না। চোখে জমে থাকা জল গড়িয়ে গালে পড়ে যায়। “আমি জানি না আপনাকে আবার বিশ্বাস করা ঠিক হবে কিনা। কিন্তু আমার ভেতরে… সব রাগ, সব ভয় পেরিয়েও আমি আপনাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না।”
প্রেম হাত বাড়িয়ে তার অশ্রু মুছিয়ে দেয়। হাতটা ধরা পড়েই তৃষা আর ছাড়ায় না। ঘরটা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে শোনে তাদের কথোপকথন। বাইরে ভোরের আলো একটু একটু করে বেড়ে উঠছে। পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে। তবু এই দুজনের ভেতরের অন্ধকার এখনো কাটেনি পুরোপুরি। প্রেম নিচু স্বরে বলে, “তৃষা, আমি যদি তোমার কাছে আবারও সুযোগ চাই… তুমি কি আমায় ফিরিয়ে দেবে?”
তৃষা চোখ নামিয়ে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর কাঁপা গলায় বলে, “সুযোগ চাইছেন, তাই তো? তবে শর্ত আছে, আমার হাত ছাড়বেন না আর কখনো।”
প্রেমের চোখ চকচক করে ওঠে। সে নিঃশব্দে মাথা ঝুঁকিয়ে তৃষার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। বাইরে ভোরের প্রথম সূর্যের আলো জানালা ভেদ করে ঘরে এসে পড়ে। তবে স্পর্শের দরজাটা এখনো দুই দেশের মধ্যকার বর্ডারের মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রেমের চোখের কোণে তখন জল। তবে ভেতরকার কষ্ট সে আর প্রকাশ করতে চাইছে না। ওঠে যেতেই এবার যেন তৃষা আরো শক্ত করে জাপ্টে ধরল তাকে। এক মুহূর্তে তৃষা প্রেমের লেদারের জ্যাকেটটা খামচে ধরে ঠোঁটে শক্ত চুমু বুলিয়ে দিলো। মুহূর্তেই যেন অপাশের ভেঙে যাওয়া প্রেম নেওয়াজটা প্রাণ ফিরে পেল। বিটারহার্টকে আরও শক্ত করে চেপে ধরল বুকে। শরীরের ভেজা পোশাক গুলো শরীরে লেপ্টে থাকার দায়বদ্ধতা গুলো একে একে শেষ হতে লাগল। তৃষার দেহের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রাখা রহস্যের জট খোলার তাড়নায় মরিয়া হলো প্রেম নেওয়াজ। হাতে প্রতিটি স্পর্শে খুলতে থাকল এক একটি গল্পের পেছনকার রহস্য। দু’জনের নিশ্বাস ভারী হলো ঠিক সেই রাতের আঁধারের মতো। দু’টো হৃদয়ের মিলন থেমে যাওয়া বৃষ্টিকে বাড়িয়ে তুলে তাঁদের অভিমানের পাল্লাকে ভালোসার উষ্ণ চাদরে ঢেকে দিলো।
চলবে?
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষ্ণা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১
-
প্রেমতৃষা ৪২ ( শেষ অর্ধেক)
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৫+১৬
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৮+৯+১০
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩৭+৩৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩১+৩২
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২+৩
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩০(বিবাহ স্পেশাল পর্ব)
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩৯ ( প্রথম অর্ধেক+শেষ অর্ধেক)
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৯+সারপ্রাইজ পর্ব