Golpo romantic golpo প্রিয় প্রণয়িনী

প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ৮ শেষ অংশ


#প্রিয়_প্রণয়িনী২

#জান্নাত_নুসরাত

(৮) শেষ অংশ

নীল অম্বরে কৃষ্ণ মেঘ জমেছে। পৃথিবী ধীরে ধীরে মেঘের গুমোট আবহাওয়ায় ডুবে পৃথিবীকে কালো অন্ধকারে ঢেকে ফেলছে। শনশন বাতাসের জোরে গাছপালা এদিক-সেদিক হেলছে-দুলছে। পার্কের মাটিতে পতিত কাগজ, পলিথিন, ধুলো বাতাসের বেগে ঘূর্ণিপাক খেয়ে নিজ জায়গার পরিবর্তন করছে। উড়ো সেই ধুলো এসে নাকে লাগতেই কব্জিতে হাত ঢেকে হা..হাচ্চি..হাচ্চি বলে ওঠে বিশার্ধ্ব মেয়েটি। কব্জি থেকে মুখ তুলে তাকাতেই আবারো নাসারন্ধ্রের ভিতর দিয়ে বালির সূল্ক কণা ঢুকতেই আবারো হাচ্চি দিয়ে ওঠল মেয়েটি। দূরে দাঁড়িয়ে তা সূক্ষ্ম চোখে লক্ষ করলেন হেলাল সাহেব। ইসরাত হাচ্ছি দিতে দিতে হেলাল সাহেবকে ক্রস করে যেতে নিবে পিছন থেকে হেলাল সাহেব ডেকে ওঠলেন,”দাঁড়াও!

রুঢ় পুরুষালি শক্ত কন্ঠ শুনে ইসরাতের বাড়ানো পা থেমে গেল। কপালের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুল আলগোছে কানের পিছনে গুজে একপেশে ভ্রু তুলে ফিরে তাকাল পিছনে। ভ্রু একটু কুঞ্চিত করে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল,”আমি!

হেলাল সাহেব কথা বললেন না। ইসরাতকে সোজা দাঁড় করিয়ে রেখে পিছন ফিরে ডেকে উঠলেন ইরহামকে। দু-বার নাম ধরে ডাক দিতেই সৈয়দ বাড়ির ফটকের ভিতর থেকে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে আসলো ইরহাম। মুখে জি জি বলে ফেনা তুলে হাপিয়ে গেল। তারপর হেলাল সাহেবের দিকে প্রশ্নাত্মক চাহনি দিতেই তিনি উদ্বেগহীন কন্ঠে আদেশ দিলেন,”RinoCLe’nil নিয়ে আয়।

ইরহাম কোনো প্রশ্ন ছাড়াই যেরকম হন্তদন্ত পায়ে এসেছিল সেরকম হন্তদন্ত পায়ে ফিরে গেল সৈয়দ বাড়ির ভিতর। কিছুক্ষণের মধ্যে হাতে করে নিয়ে আসলো স্প্রেনার।

ইসরাত তখনো দাঁড়িয়ে চুপচাপ লক্ষ করছিল হেলাল সাহেব ও ইরহামের কান্ডকারখানা। ইরহাম হাতের স্প্রেনার হেলাল সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভিতর আবার ফিরে গেল, হেলাল সাহেব কোনো কথা বলার পূর্বে। অনিহার সহিত ইরহামের যাওয়ার পথে তাকিয়ে উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে ইসরাতের দিকে RinoCLe’nil এর ছোট্ট স্প্রেনারটা এগিয়ে দিয়ে কঠোর গলায় বললেন,”এই নাও।

ইসরাত হাতে নিল না। ঠোঁট টিপে নিজের মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে দু-হাত আড়াআড়ি বুকে বেঁধে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”জি কাকে বলছেন?

হেলাল সাহেব কপাল কুঞ্চিত করে উল্টো দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাড়ানো RinoCLe’nil ইসরাত তখনো হাতে নিল না। সে ও বুকে হাত বেঁধে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিজ জায়গায়, হেলাল সাহেবের কথা শোনার অপেক্ষায়।

হেলাল সাহেব নিজের জায়গায় অটল থেকে বলে ওঠলেন,”নে তোকে দিচ্ছি।

“আমাকে দিচ্ছেন যখন তাহলে উল্টো দিকে তাকিয়ে দিচ্ছেন কেন? আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে দেন!

ইসরাতের নির্বিকার চিত্তে বলা কথায় হেলাল সাহেব মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন এবার ইসরাতের চোখের দিকে। তখনই দু-জনের চোখাচোখি হলো, তা নিমিষে ভেঙে দিয়ে ইসরাত নিজের মেয়েলি ডাগর ডাগর চোখগুলো নামিয়ে নিল নিচের দিকে। ভেসে ওঠল ঘন কালো পাপড়ি। হেলাল সাহেব ইসরাতের হাতে জোর করে RinoCLe’nil পুরে দিয়ে বললেন,” নাকে দে, তাহলে সর্দি, হাচি কমে যাবে।

ইসরাত মুখ খুলে পুশ করল কোনো প্রকার কিছু বের হলো না। শক্ত হাতে চাপ প্রয়োগ করতেই স্প্রেনারের ভিতর থেকে ফুসফুস করে কিছু ঔষধের তরল বের হয়ে আসলো। ইসরাত চারিদিকে ঘুরে বারবার স্প্রে করে দেখতে লাগল, তখনি হেলাল সাহেব ধমকে ওঠলেন,”এটা এভাবে নষ্ট করছিস কেন? জানিস এটার দাম কত?

ইসরাত প্রশ্নাত্মক চোখ তুলে তাকাল হেলাল সাহেবের দিকে। নিরুদ্বেগ কন্ঠে জানতে চাইল,”কত টাকা?

হেলাল সাহেব চোখ-মুখ বড় বড় করে বললেন,

“বাংলার পাঁচশত টাকা।

ইসরাত হা হা করে হেসে ওঠল৷ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হেলাল সাহেবের কথা উড়িয়ে দিয়ে চারিদিকে ভালো করে স্প্রে করে বলল,” মাত্র পাঁচশত টাকা।

ইসরাতের নির্বিকার ভঙ্গিতে তার কথা উড়িয়ে দেয়া দেখে হেলাল সাহেব চ্যাতলেন ইসরাতের ওপর। এক মুহুর্তে বিলম্ব না করে বললেন,”তোর কাছে আছে এত টাকা? যে বলছিস মাত্র পাঁচশত টাকা! কোনোদিন আয় করেছিস পাঁচশত টাকা?

ইসরাত হেলাল সাহেবকে রাগ করতে দেখে এবং তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে দেখে ঈষৎ হাসল। মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”আপনার কি মনে হয় আমি কিছু করিনা? এসব পাঁচশত টাকা আমার হাতের ময়লা, কারণ কারণ,, হাচ্চি।

কথা শেষ হওয়ার আগেই আবারো হাচ্চি দিয়ে ওঠল ইসরাত। হেলাল সাহেব ইসরাতকে হাচ্চি দিতে দেখে শক্ত কন্ঠে বললেন,”যা যা, বাসায় যা! পরে বলিস তোর টাকার কথা, এখন গিয়ে নিজের নাক আগে ঠিক করে আয়।

হেলাল সাহেব কথাটা শেষ করতেই ইসরাত মনে মনে হেলাল সাহেবকে ভেংচি কেটে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বিড়বিড় করে আওড়াল,”আমার বয়েই গেছে আপনার সাথে কথা বলতে।

____________________________________________

[নাবিলা সৈয়দ পেইজে এই গল্প পুরো পেয়ে যাবেন।]

আসরের নামাজ পড়ে নুসরাত আর সৌরভি হাওর বিলাস রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বাহিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। সৌরভি যথারীতি কুর্তি পরেছে যার কাজ কিছুটা কালোর মধ্যে ছোট ছোট সাদা সুতোর ইম্বোডারি করা, সাথে সাদা কার্গো প্যান্ট ও গলায় সাদা ওড়না পায়ে ছোটো ফিতের জুতো।

নুসরাত মাথায় ঝড়জেটের ওড়না, হাঁটু সমান হ্যালো কিট্টির টি-শার্ট, আর সাথে ব্যাগি প্যান্ট পায়ে স্লিপার। তা ও জুতো নিজের পায়ের থেকে দু-ইঞ্চি লম্বা। সৌরভি রুম লক করে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করল,”কোথায় যাবি?

নুসরাত নির্বিকার চিত্তে বলে ওঠল,

“যেখানে নিয়ে যাবি, সেখানে!

“হরিপুর রাজবাড়ি যাবি?

প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে সৌরভি উত্তর জানার আশায় চেয়ে রইল নুসরাতের উদ্দেশ্যে। নুসরাত আগের মতো মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,”যেখানে নিয়ে যাবি সেখানে!

দীর্ঘ-শ্বাস ফেলে সামনে হাঁটা ধরল সৌরভি। নুসরাত মোবাইলে কিছু একটা করতে করতে এগিয়ে গেল সৌরভির পিছনে।

_________________________________________

হরিপুর রাজবাড়ি যাওয়ার নাম করে রিসোর্ট থেকে বের হলেও রাস্তায় গাড়ি না পাওয়ায় দু-জন হাঁটছিল রাস্তায় এদিক-সেদিক। কাছেই তিতাস নদী হওয়ায় বাতাসে প্রকোপ একটু বেশি এখানে। সৌরভি আর নুসরাত আরো একটু সামনের দিকে হাঁটতেই একটি ছোট টিলা তাদের চোখের সামনে ভাসল। যেখানে বাচ্চারা খেলা করছিল, এবং রিসোর্টে আসা অনেক মানুষ এখানে হাঁটাহাঁটি করছিল। নুসরাত আর সৌরভি দু-জন হেঁটে হেঁটে উপরে ওঠল টিলার।

টিপার ওপর উঠে দু-জন দু-জনের থেকে আলাদা হয়ে আশে-পাশে হেঁটে প্রাকৃতিক এই পরিবেশ বেশ উপভোগ করছিল। নুসরাত মোবাইল দেখে দেখে হাঁটছিল সাথে বিড়বিড় করে গান গাচ্ছিল,” হি ইজ আ বেড বয় ইউথ আ টেইনিড হার্ট,

এন্ড ইভেন আই নো দিজ এইন্ট স্মার্ট,

বাট মামা আ’ম ইন লাভ উইথ আ ক্রিমিনাল ,

এন্ড দিস টাইপ অফ লাভ ইজ আ রেসোনাল ইট’স পিজিকায়ায়ায়া…

পরের অংশ গাওয়ার আগেই নুসরাতের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো অবাঞ্চিত শব্দ। আ আ আকারে শব্দ করে জুতোর সাথে জুতো লেগে, প্যান্টের সাথে প্যান্ট আটকে, পায়ের সাথে পা বেজে পড়ে যেতে নিবে বিড়বিড় করে আওড়াল,”লা হাওলা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আজিম। ও আল্লাহ এবারের মতো বাঁচিয়ে নাও, আমি এখনো বিয়ের লাড্ডু খাইনি। বিয়ের লাড্ডু খাওয়ার আগেই মরে গেলাম রে…। বাপ আমার কেউ বাঁচা আমারে, আগে বিয়ের লাড্ডু খেয়ে নিয় তারপর না হয় আরো দু-চারশত বছর বেঁচে মরে যাব। আমি এখনো আমার নাতি-নাতনীদের মুখ দেখিনী। প্লিজ বাঁচা কেউ আমারে আমি বিয়ের লাড্ডু খেতে চাই। এই জীবনে মনে হয় বিয়ের লাড্ডু খেতে পারলাম না। জীবনে করা সব পাপ মনে পড়ে গেল, এক নিমেষে । আ আ আ… আমি বিয়ের লাড্ডু খেতে চাই….

নুসরাত আলতু ফালতু বলে চিৎকার করতে লাগল। তখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছিল খিঁচে। ভয়ে চোখ খোলার কথা মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল মেয়েটার নিমেষে।

আরশ অদ্ভুত চোখে শ্যাম বর্ণের মেয়েলি মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। গোধূলি বেলার স্লান সূর্যের মিষ্টি লাল রশ্মি এসে টিলায় ঝুলে থাকা মেয়েটার মুখের উপর এসে পড়ল, যা শ্যাম বর্ণের মুখে পড়ার সাথে সাথেই মুখটা চিকচিক করে ওঠল। আরশ সূক্ষ্ম চোখে চেয়ে দেখল মেয়েটার সেকেন্ডে সেকেন্ড বদলে যাওয়া বিচিত্র মুখের ভাবভঙ্গি। একবার চোখ খিঁচে নিচ্ছে তো, একবার ভ্রু উপরে তুলছে, তো আরেকবার দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরছে।

আরশের মুখে চিরচারিত সেই গাম্ভীর্য। মেয়েটার মুখের দিকে সূক্ষ্ম চোখ অনেকক্ষণ বুলাল। বিরক্ত হলো না এতে সে! চুপচাপ শুধু দেখল, আর দেখতেই থাকল। সাথে অপেক্ষা করতে থাকল, মেয়েটার চিৎকার বন্ধ করে চোখ খোলার। কিন্তু এই মেয়ে দু-মিনিট চলে গেল, তারপর ও বাচালের মতো বিয়ের লাড্ডু খাওয়া নিয়ে বকবক করতে থাকল, আর তা নীরব শ্রোতা হয়ে আরশ চুপচাপ গভীর চোখে নুসরাতের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থেকে শ্রবণ করল।

সৌরভি একটু দূরে দাঁড়িয়ে কপালে হাত দিয়ে হালকা করে চাপড় মারল নিজের৷ কোন পাগলে তাকে বলেছিল এই পাগলকে একা ছাড়তে। মানুষের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সৌরভি দ্রুত কদমে এগিয়ে আসতে আসতে সতর্ক গলায় দাঁতে দাঁত চেপে ধমকে ওঠে বলল,”চুপ একদম চুপ! মরিসনি তুই। আমার মা, মুখ বন্ধ কর। মানুষ তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।

সৌরভির গলার স্বর শুনতেই নুসরাত বন্ধ করে রাখা চোখ তড়াক করে খুলে ফেলল। আর তখনি চোখাচোখি হলো কালোমনি বিশিষ্ট এক জোড়া পুরুষালি লম্বা পাপড়ি আড়ালে ঢেকে থাকা চোখের সাথে। চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজ মনে বিড়বিড় করে আওড়াল,”এই বেডার চোখের পাপড়ি এতো বড় বড় কেন?

তারপর মনে মনে নাক উপরের দিকে তুলে আওড়ায়,”এই বেডা, এরকম তাকিয়ে আছে কেন?

নুসরাত উপর দিক থেকে চোখ সরিয়ে মাথা কাত করে নিচের দিকে নিজের দৃষ্টি ঘুরাতেই দু-ঠোঁটের মধ্যে ফাঁক হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে সেদিকে চোখ রেখে নিজের হাত, রুক্ষ পুরুষালি হাতের ভিতর থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আরশ গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”বিবাহিত?

নুসরাতের চোখ অদ্ভুতোরেভাবে সরু হয়ে আসলো। মাথা ঘুরিয়ে আরশের দিকে তাকাতে তাকাতে চোখের দু-পাশ কুঁচকে গেল সাথে মেয়েলি ঠোঁট, আরশের অদ্ভুত কথা শুনে। সে এখানে মরে যাচ্ছে, আর এই বেডা কী না জিজ্ঞেস করছে তাকে বিবাহিত নাকি অবিবাহিত! বোকা চোখে নুসরাতকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরশ আবার জিজ্ঞেস করল,”বিবাহিত?

নুসরাত দু-পাশে মাথা নাড়াল। নুসরাতকে দু-পাশে মাথা নাড়াতে দেখেই, আরশের শক্ত করে ধরে রাখা নুসরাতের হাতখানা কিছুটা ঢিলে হয়ে আসলো।

নুসরাত উল্টো দিকে একবার চেয়ে শক্ত হাতে চেপে ধরল আরশের পুরুষালি রুক্ষ হাতজোড়া। মিনমিন করে বলল,”ভাইয়া বাঁচান! এখান থেকে পড়লে আমি দুনিয়া থেকে টপকে যাব।

আরশ নুসরাতের কথা না শোনার ভঙ্গিতে এড়িয়ে গেল। হাত আরেকটু ঢিলে করতেই নুসরাত অন্যহাত দিয়ে আরশের হাত চেপে ধরল। নুসরাতের হাতের লম্বা নখগুলো দেবে গেল আরশের হাতের পিঠে। ভয়ে জ্ঞানশূন্য নুসরাতের দিকে অবিচল চোখে চেয়ে আরশ বলল,”এখান থেকে পড়লে কিছু হবে না, জাস্ট আপনার দুটো হাড্ডি ভাঙবে। নাথিং এলস! মরে যাবেন না, এই আশা রাখতে পারেন।

আরশের গা ছাড়া কথায় নুসরাত ভেতরে ভেতর রাগে জ্বলে ওঠল ফুসফুস করে। তবুও উপরে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে নিজের মুখ ব্যাঙের মতো হা করে নিল। আরশের হাত আরো ঢিলে হয়ে আসতেই নুসরাত ভেচকানো মার্কা হাসি দিয়ে আরশকে মানানোর জন্য মাখনের মতো নরম কন্ঠে বলে,”ভাইয়া প্লিজ বাঁচিয়ে নেন।

আরশের গাম্ভীর্যেপূর্ণ স্বর, ঠোঁটে লেগে আছে অদৃশ্য এক হাসি, চোখ সরু করে জানতে চাইল,”আপনাকে বাঁচালে আমার কী লাভ?

মাহাদি আরশের পিছন থেকে উঁকি মেরে নুসরাতের দিকে তাকাল। যে নিচে পড়ার ভয়ে চোখ-মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে আরশের দিকে। আরশের হাতের মধ্যে নুসরাতের তিনটি আঙুল শক্ত করে ধরে রাখা। যদি এদিক-সেদিক হয়, তাহলে এই মেয়ে আজ দুনিয়া থেকে টপকাবে নয়তো হাত পায়ের হাঢ় ভেঙে হসপিটালে কমপক্ষে এক মাসের জন্য ভর্তি হতে হবে।

” বাচ্চা মেয়ে, বাঁচিয়ে নে দোস্ত! ওর কাছে তোকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই।

নুসরাত উপর নিচ মাথা দোলাল, মাহাদির কথায় সমর্থন করে। আরশ কথার উত্তর দিল না মাহাদির। নির্লিপ্ত চোখ নুসরাতের দিকে স্থির করতেই নুসরাত মিনতি করে বলে ওঠে,”আপনি আমাকে বাঁচালে আমার হাড্ডিগুলো ভাঙা থেকে রক্ষা পাবে। আর আমি এখান থেকে পড়লে দুটো হাড্ডি ভেঙে যাবে, তখন আমার বিয়ে হবে না। আর আমি বিয়ের লাড্ডু ও খেতে পারব না। আর যদি বিয়ে ও হয়, তাহলে আমার জামাই একজন হাঢ় ভাঙা স্ত্রী পাবে, যার এক হাত এক পা অকেজো। আমার বাচ্চারা একজন হাত-পা ভাঙা মা পাবে। তারা সমাজে মুখ দেখাবে কীভাবে? ভাবতেই তো আমার বুক কেঁপে ওঠছে। আজ আপনি আমাকে বাঁচিয়ে নিলে আপনার এই সাহসিকতার কথা আমি আমার ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের বর্ণনা করব। তখন আমার বাচ্চারা নামাজ পড়ে আপনার জন্য দোয়া করবে। আমার একটা বাচ্চাকে দিয়ে আমি লেখালেখি করাবো খবরের কাগজে, তখন আপনার নাম সোনালি অক্ষরে তুলবে খবরের কাগজে আমার না হওয়া বাচ্চা। আর শিরোনাম থাকবে, একজন অবিবাহিত, কুমারী কন্যাকে বিশ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে পড়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে পৃথিবী অন্ধকার হওয়ার হাত থেকে আলোকিত করেছেন একজন কুমার যুবক। আর সেই যুবকের নাম হলো মিস্টার ডট ডট ডট!

আরশ নির্বিকার চিত্তে জিজ্ঞেস করল,

“ওরা কেন আমার জন্য দোয়া করবে, আর কেনই বা আমার নাম খবরের কাগজে ছাপাবে?

নুসরাত আরশের আঙুলের ভাঁজে নিজের লম্বা লম্বা মেয়েলি আঙুলগুলো আলগোছে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে,” তখন তো আপনি আমার বাচ্চাদের মামা হয়ে যাবেন।

আরশ নুসরাতের চতুরতার সাথে তার হাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের হাত ঢোকানো লক্ষ করল আড় চোখে। মাহাদি পিছন থেকে বলে ওঠল,”তোমার চিন্তার বেগ দেখছি বাতাসের বেগের থেকেও বেশি। এত তাড়াতাড়ি কীভাবে এত চিন্তা করতে পারো?

নুসরাত আবেশিত কন্ঠে বলে,

” ভাইয়া এটা আমার নিজস্ব ট্যালেন্ট।

সৌরভির বিস্ময়ে নিজের মুখ দিয়ে শব্দ বের করতে ভুলে গেল। এতক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে নুসরাতকে ঠোঁটে হাত রেখে বারবার চুপ করার কথা বললে ও এখন উচ্চ শব্দে নুসরাতকে ধমকে উঠল, এবং বলল,”চুপ আর একটা কথা না।

নুসরাত মুখে জিপার টানার মতো মুখ আটকে নিল। আরশ অবিচল দৃষ্টিতে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে থেকে শক্ত হাতে উপরে টেনে তুলতে তুলতে আওড়ায়,”বাচাল।

যা স্পষ্ট নুসরাতের কান ভেদ করে গেল। নুসরাত এক আঙুল তুলে কিছু বলার আগেই পুরো শরীর ঝাঁকুনি খেয়ে ওপরে ওঠে আসলো। অবাক চোখ আশে-পাশে ঘুরাতেই সৌরভির সাথে চোখাচোখি হলো, যে কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে। নুসরাতের দিকে এগিয়ে এসে কাকড়া দিয়ে আটকানো চুলগুলো একটানে খুলে দিল। সেকেন্ডের গতিতে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে গেল পিঠ জুরে। সৌরভি নুসরাতের চুলগুলো দু-পাশ করে সামনে দিকে নিয়ে এসে বুকে দিতে নিবে তার আগেই আরশ নিজের পরণের টিশার্ট খুলে নুসরাতের গায়ের উপর দিয়ে দিল।

নুসরাত নিজের দিকে তাকাতে দেখল ওড়না নেই তার গায়ে। পিছন ফিরে উল্টে নিচের দিকে ঝুঁকতে নিবে আরশ ধমকে ওঠে,”এই মেয়ে, মরার শখ জেগেছে আপনার? তাহলে তখন বললে না কেন, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতাম আপনাকে।

নুসরাত নিষ্পাপ মুখ বানিয়ে মাহাদি আর আরশের দিকে চোখ বুলিয়ে মিনমিন করে বলল,”আমি কখন বললাম যে, আমি মরে যেতে চাই? আমি এখনো বিয়ের লাড্ডু খাইনি, আগে খেয়ে নিয়, তারপর না হয় ধীরে সুস্থে চার-পাঁচটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে মরব।

মাহাদি অবাক কন্ঠে জানতে চাইল,

“চার-পাঁচটা কেন?

” চার-পাঁচটা কম মনে হচ্ছে ভাইয়া, তাহলে এক কাজ করব এগারো জন বাচ্চার জন্ম দিব। তারপর এদের দিয়ে একটা ফুটবল টিম গঠন করব, আর আমি, আমার জামাই দর্শক হয়ে সেখানে ওদের খেলা দেখব।

নুসরাত বিগলিত কন্ঠে কথা শেষ করতেই আরশ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নির্লিপ্ত কন্ঠে জানতে চাইল,”কথা বানানো ছাড়া আর কি কি জানেন আপনি?

আরশের যে তাকে ঠাট্টা করছে, তা স্পষ্ট টের পেল নুসরাত। কিছু গালি দিতে যাবে, নিজের মুখ সামলে নিল, আলগোছে। ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে, মুখের পেশি বারবার সংকুচিত প্রসারিত করল, যাতে মুখ ফুসকে কোনো গালি-গালাজ বের না হয়। বেডাকে কোনোপ্রকার গালাগালি করা যাবে না। কারণ বেডা তাকে হাঢ় ভাঙার হাত থেকে রক্ষা করেছে। তাই কাউকে নিজের ভিতরের কথা বুঝতে না দিয়ে, আবেশিত কন্ঠে বলল,”জি, মানুষকে ভালো পাগল বানাতে জানি।

আরশ আর কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল না। শেষবারের মতো নুসরাতের উপর থেকে নিচে নিজের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া বুলিয়ে নিয়ে অগ্রসর হলো সামনে। মাহাদি ও আরশের পিছন পিছন যেতে নিয়ে থেমে গেল। আরশ আবার দাঁড়িয়েছে। হালকা ঘাড় কাত করে আরশ মাটিতে বসে থাকা নুসরাতকে জিজ্ঞেস করল,”সত্যি অবিবাহিত?

“আপনি কী আমাকে বিশ্বাস করছেন না? হ্যাঁ অনেকেই বিশ্বাস করেনা আমি যে, অবিবাহিত। এই যে, নোজ রিং দেখছেন এইটার জন্য অনেকে মনে করে আমার বিয়ে হয়ে দুইটা বাচ্চা ও আছে। এখন মানুষ কী একটু শখ করে নোজ রিং পরতে পারে না? এসব মানুষজন ও না! আবার অনেকে বলে তো আমার বয়স হলো বায়ান্ন, তখন আমি তাদের ভুল শুধরে দিয়ে বলি যে, আমার বয়স হলো গিয়ে ষাট বছর। আমাকে এখনো দেখতে এত যুবতি লাগে, সেটা মানুষ ভুল বয়স গেজ করে প্রমাণ করে দেয়।

নুসরাত শ্বাস নিয়ে একের পর এক কথা বলতে লাগল। আরশ শার্টের নিচে পরা ড্রপ সোল্ডার টি-শার্টটা এক টানে খুলে নুসরাতের মুখের উপর ছুঁড়ে মারল। তখনই নুসরাতের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। এবার আরশ একটু জোরেই নুসরাতের উদ্দেশ্যে বলল,” বাচাল মেয়ে,এত কথা বলেন কেন? একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে একশত উত্তর দিতে হবে কেন আপনার?

নুসরাত নিজের মুখের উপর থেকে টি-শার্ট টা সরাতেই নাকের ভিতর দিয়ে সুরসুর করে বয়ে গেল ব্ল্যাকবেরির মিষ্টি ঘ্রাণ। মুখ বাঁকিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলে

ধীর পায়ে আরশের দিকে,ততক্ষণে আরশ পুরোপুরি পিছন ফিরে নুসরাতের দিকে পূর্ণদৃষ্টি জ্ঞাপন করেছে। নুসরাতকে এগিয়ে আসতে দেখে গাম্ভীর্যে ভরা কন্ঠে বলল”আপনি জানেন কি, আপনার নোজ রিংটা দেখতে বিশ্রী?

নুসরাত রাগ করল না। ঠোঁট বাঁকিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বলল,”ধন্যবাদ।

আরশ তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় বালিকার দিকে। ভ্র যুগল কুঞ্চিত করে ব্যগ্র কন্ঠে আওড়ায়,”আপনার গলার আওয়াজ আপনার মতো বিশ্রী।

নুসরাত গা দুলিয়ে হাসে। পারলে সে এখানে গড়াগড়ি খেয়ে হাসত। ঠোঁট কামড়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করে, ফিকে হয়ে যাওয়া ঘোলাটে দৃষ্টি আরশের দিকে স্থির রেখে বলে,”আবারো ধন্যবাদ।

আরশের উজ্জ্বল মুখে এবার কিছুটা বিরক্তি ভর করে। সুদীর্ঘ লম্বা শরীর সামান্য বাঁকিয়ে নুসরাতের দিকে ঝুঁকে আসে। নুসরাতের মুখের কাছে নিজের মুখ রেখে, মেয়েলি চোখে নিজের দৃষ্টি স্থির করে, ডিপ গলায় বলে,”ইউ আর ফাকিং স্টুপিড গার্ল, আপনি পুরোটাই বিশ্রী।

নুসরাত পায়ের পাতায় হালকা ভর দিয়ে উঁচু হয়, নিজের মুখ আরশের আরেকটু সন্নিকটে নিয়ে যায়। ঠোঁট চোখা করে আরশের থুতনিতে সামান্য শ্বাস ফেলে বলে,”আপনার এই অপমান আমি সাদরে গ্রহণ করলাম মিস্টার। আবারো এই সুন্দর অপমানের জন্য আপনাকে থ্যাংকস!

সৌরভি আর মাহাদি নীরব দর্শক হয়ে এসব দেখছিল। নুসরাত হাসল, আরশের গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে।

“একটা কথা জানেন কী ভাইয়া?

আরশ কথা বলল না। ভ্রু বাঁকাল কিঞ্চিৎ। নুসরাতের কপাল আরশের নাকের কাছ পর্যন্ত হওয়ার ধরুন নুসরাত নিজের মুখ আরশের বাঁ-দিকে সরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,”ভাইয়া আপনি কিন্তু জোস বুঝছেন। আমি আবার ভদ্র মহিলা তাই আপনার এই অপমানে কিছু মনে করিনী। কিন্তু একটা সত্য কথা কী জানেন? আমি আপনার গলার এডামস অ্যাপলস আর এই গলার কাছের সুন্দর কলার বুন এদিকে নজর দিয়েছি।

নুসরাত নিজের কন্ঠ আরো নিচে নামিয়ে নিয়ে আরশের কানের কাছে বলে,”আর এই যে, কন্ঠনালির কাছে তিল, এদিকে সবথেকে বেশি নজর দিয়েছি।

আরশ হাসল। গ্রীবা নিচের দিকে নামিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল,”আমার উচিত হয়নি আপনার মতো একটা বেয়াদব মহিলাকে বাঁচানো। ছেলেদের দিকে খারাপ নজরে তাকান লজ্জা লাগে না?

নুসরাত ঠোঁট উল্টে নিষ্পাপ, নির্মল, মুখ বানিয়ে দু-পাশে মাথা না ভঙ্গিতে দোলাতে দোলাতে বলে,

“জি না ভাইয়া আমার একটু ও লজ্জা লাগে না। মানুষ সুন্দর ছেলে দেখলে তাদের দিকে তাকায়, আমি ও তার একজন। মানুষ তো কিছু বলে না নিজের মনে চেপে রেখে দেয়, আমি শুধু বলে দেই এই আর কী ডিফারেন্স আমাদের মধ্যে।

“বেয়াদব মেয়ে!

আরশ কথাটা শেষ করেই রাগী চোখ নুসরাতের মুখে বুলিয়ে দ্রুত কদমে চলে গেল। মাহাদি আরশকে চলে যেতে দেখে, আরশের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জিজ্ঞেস করল,”তুমি কি বলে আমার বন্ধুকে রাগীও দিয়েছ মেয়ে? তুমি মেয়ে বড় বিটকেল তো!

নুসরাত হাসল, হৃদয় ভুলানো হাসি। নুসরাতের হাসির মানে খুঁজে না পেয়ে আরশের পেছন পেছন দৌড়ে চলে গেল মাহাদি।

সৌরভি নুসরাতের এতো হাসির রহস্য কী উদ্মাঘাটন করতে পারল না। অদ্ভুতভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজেও দ্রুত পায়ে রিসোর্টের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল, নুসরাতকে ওখানে ফেলে রেখেই।

চলবে…

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply