Golpo প্রণয়ের ব্যাকুলতা

প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৩


#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা

#সাদিয়া

#পর্ব_২৩

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

রাতের আঁধার কেটে ভোর নেমেছে। সূর্য তার উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রাকৃতিতে। প্রাকৃতিও যেন পরম আবেশে নিজেদের মিইয়ে নিচ্ছে সূর্যের আলোতে। রান্নাঘর থেকে টুং টাং আওয়াজ হচ্ছে। মৌমিতা নাস্তা বানাচ্ছে সবার জন্য। ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে আর ঘুমায়নি, সোজা রান্নাঘরে চলে এসেছে। সর্ভেন্ট আসতে এখনও ঢের দেরী। তারা সচরাচর এই ৭ টা বা সাড়ে ৭ টার দিকে আসে।

প্রচন্ড গরমে ঘুম ভেঙ্গে গেছে তাজের। এখন একটু ঠান্ডা পানি না খেলেই নয়। ঘুম ঘুম চোখে হেলে দুলে রান্নাঘরে পৌঁছালো সে। সোজা ফ্রিজের কাছে গিয়ে এক বোতল ঠান্ডা পানি বের করে মুখে দেওয়ার আগেই চেঁচিয়ে উঠলো মৌমিতা। হকচকিয়ে গেল তাজ। চকিত দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে মৌমিতা। মৌমিতা আবার চেঁচিয়ে উঠলো, বলল – এভাবে উদম গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? লাজ শরমের মাথা খেয়েছেন নাকি?

নিজের দিকে তাকালো তাজ। পড়নে শুধু মাত্র একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, গায়ের টি শার্টটা গরমে খুলে রেখেছিল রাতেই। কে বুঝেছে এই সকালে মৌমিতা এখানে থাকবে। ভিতরে ভিতরে অপ্রস্তত হয়ে পড়লো তাজ কিন্তু উপরে সে ভাবলেশহীন যেন কিছুই হয়নি। শান্ত কন্ঠে বলল – আমার বাড়ি আমি উদম গায়ে হাঁটছি তোমার কি? আর তাছাড়া তুমি আমার বউ তোমার তো আমার সবকিছু দেখার অধিকার রয়েছে এ তো কেবল শরীর। আস্তে আস্তে অভ্যাস করে নেও।

আর দাঁড়ালো না তাজ। কোনো রকমের দ্রুত পায়ে কেটে পড়লো মৌমিতার সামনে থেকে। মৌমিতা হতবাক, কি বলে গেল তাজ এসব। সত্যিই কি এই ছেলে লাজ শরমের মাথা খেয়েছে? কি অ’স’ভ্য মার্কা কথা বলে গেল এই মাত্র।

খাবার টেবিলে বসে আছে তাজ , মৌমিতা, রাদীফ। সবাই মৌমিতার হাতের রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রাদীফ হঠাৎ বলল – তোমার ফ্রেন্ড নীরা কোথায়? ওকেও বলতে আমাদের সাথে ব্রেকফাস্ট করতো।

– বলেছিলাম ও বলেছে এক সাথে কলেজের জন্য রেডি হয়ে আসবে।

– আচ্ছা তোমরা দুজনও রেডি হয়ে থেকো আজ একসাথেই যাবো কলেজে।

নড়েচড়ে উঠলো তাজ। একটু ইতস্তত করে বলল – আমি আজ কলেজে যাবো না।

অস্থির হলো মৌমিতা, অস্থির কন্ঠে বলল – কেন? আপনার শরীর কি খারাপ? অসুস্থ আপনি?

– না

– তাহলে কলেজে কেন যাবেন না?

– এমনি আর শুধু আমি না তুমিও যাচ্ছ না।

মৌমিতা অবাক হয়ে বলল – আমি কেন যাবো না?

তাজ উত্তর দিল না মৌমিতার কথার। পাশ ফিরে রাদীফের দিকে তাকিয়ে বলল – তুমি নীরাকে নিয়ে কলেজে চলে যেও আমি আর মৌ আজ যাব না বাড়িতেই থাকবো ‌।

তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রাদীফ। ফিসফিসিয়ে বলল – তোর বউ তো তোকে পাত্তা দেয় না শুধু শুধু বাড়িতে থেকে কি করবি। রো’ম্যা’ন্স টোম্যান্স হবে বলে তো মনে হয় না।

তাজ চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিল – তুমি একটু বেশিই কথা বলছো কাকাই। আমাকে নিয়ে তোমার এত না ভাবলেও চলবে তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবো। সেদিন দেখলাম নীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।

থতমত খেয়ে গেল রাদীফ, আমতা আমতা করে বলল – নীরা যার সাথে ইচ্ছে কথা বলুক তাতে আমার কি?

তাজ খেতে খেতে বলল – বুঝলে বুঝপাতা না বুঝলে তেজপাতা।

রাদীফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল – বুঝপাতা কি?

তাজ কোনো উত্তর দিল না তার ধ্যান জ্ঞান এখন শুধু খাওয়া।

রাদীফ নীরাকে নিয়ে কলেজে চলে গেল। সার্ভেন্টরা যে যার মতো কাজ করছে। মৌমিতা বসে বসে টিভি দেখছে। আর পাশেই বসে উসখুশ করছে তাজ। বারবার মৌমিতাকে রুমে যাওয়ার কথা বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে। কে জানে মৌমিতা আবার কি মনে করে। রুমে যাওয়ার কথা শুনেই যদি আবার রেগে যায়। এখানে দু দন্ড হাতে হাত রেখে কথা বলারও একটু পরিবেশও নেই। চারদিকে সব সার্ভেন্টরা। অবশেষে নিজের ইতস্ততবোধ ভেঙে বলেই ফেলল – মৌ রুমে চলো।

ভরকে গেল মৌমিতা। চোখ পিটপিট করে তাকালো তাজের দিকে। এই ভরদুপুরে রুমে ডাকছে কেন। তাছাড়া ওর সাথে তাজের সম্পর্কও তেমন না যে যখন তখন রুমে ডাকবে। মৌমিতাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাজ আবার বলল – কি হলো রুমে চলো।

মৌ থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল – কেন রুমে কি?

– একটু কথা ছিল।

– এখানে বলো।

তাজ আশে পাশে তাকিয়ে বলল – এখানে সার্ভেন্টরা আছে।

– কি এমন কথা যা সার্ভেন্টদের সামনে বলা যাবে না।

– সব কথা কি সার্ভেন্টদের সামনে বলা যায়?

মৌমিতা একবার আশেপাশে নজর বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। লম্বা লম্বা পা ফেলে রুমে চলে গেল। তাজও পিছু পিছু গেল। রুমে যেতেই মৌমিতা বলল – কি কথা বলুন এখন।

তাজ কিছু বলল না। বিছানায় বসে এক টানে মৌমিতাকে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দিল। মুখ গুজলো মৌমিতার ঘাড়ে। কেঁপে উঠলো মৌমিতা। শীড়দাড়া বেয়ে বয়ে যাচ্ছে শীতল এক রক্তস্রোত। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল – কি করছেন কি ? ছাড়ুন।

– উঁহু চুপ করে বসে বসে থাকো। ভালো লাগছে আমার। বুকের মধ্যে প্রশান্তি পাচ্ছি তোমার ছোঁয়ায়।

– এটা কিন্তু কথা ছিল না। বাবা মাকে জানিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করার আগে আমারা কাছাকাছি আসবো না এই কথাই তো ছিল।

– তোমাকে গভীরভাবে ছুঁতে না পারি এমন একটু আধটু ছোঁয়াই যায়। আর এমন একটু আধটু ছোঁয়ার বিষয়ে তো কোনো শর্ত ছিল না তাই না।

চুপ করে গেল মৌমিতা। এই মুহূর্তে এই কথার উত্তরে কি বলা উচিৎ মাথায় আসছে না ওর। তাজের গরম নিঃশ্বাস আঁচড়ে পড়ছে মৌমিতার ঘাড়ে। পরম আবেশে মৌমিতা খামচে ধরলো তাজের চুল।

_______________________________________

দুপুরের প্রখর রোদে দিশেহারা সবাই‌। এই সময় সূর্যি মামা একটু বেশিই চটে থাকে। মাথার উপর নিজের অগ্নীশিখা প্রজ্জ্বলিত করে নাচতে থাকে মনের আনন্দে। কলেজ ছুটি হয়েছে মাত্রই। সূর্য যেভাবে নেচে চলেছে এই সময় একটা আইসক্রিম হলে খারাপ হতো না। আইসক্রিমের কথা মাথায় আসতেই চোখ গেল রাস্তার ওপাশে। রাস্তার ওপাশে কিছু আইসক্রিম শপ দেখা যাচ্ছে। মৌমিতা আর তাজ এক সাথেই বেরিয়েছিল কলেজ থেকে। মৌমিতাকে আইসক্রিম শপের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুঝতে বাকি নেই মৌমিতা এখন কি চাইছে। তাজ একটা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে মৌমিতাকে রাস্তার এপার দাঁড় করিয়েই ওপার দৌড়ে গেল আইসক্রিম আনতে। দুটো আইসক্রিম হাতে নিয়ে কোনো দিকে না দেখে রাস্তার উপর থেকে দিল দৌড়। ব্যস্ত সড়ক, এভাবে কোনো দিকে না দেখে দৌড় দেওয়া আর নিজের বিপদ ডেকে আনা সমান কথা। হঠাৎ তাজের ডান দিক থেকে ছুটে এলো এক বিশাল মালবাহী দৈত্তাকার ট্রাক। ট্রাক চালক হঠাৎ সামনে এক যুবককে দেখে ব্রেক কষলো। কিন্তু ব্রেক কষতে বোধহয় একটু দেড়িই হয়ে গিয়েছিল। ট্রাকটার ধাক্কা লাগে তাজের শরীরের ডান পাশটায়। তাজের নাম ধরে চিৎকার করে ওঠে মৌমিতা। ততক্ষণে তাজ লুটিয়ে পড়েছে রাস্তার মধ্যিখানে। হাতের আইসক্রিম দুটো ছিটকে পড়েছে পাশেই। রাস্তার পাশের মানুষজন ছুটে আসতে শুরু করেছে তাজের কাছে। তাদের পায়ের নিচে পিষ্ট হলো তাজের সযত্মে আনা আইসক্রিম দুটো। তাজ নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আইসক্রিম দুটোর দিকে। হয়তো ভেবেছিল ব্যস্ত রাস্তায় প্রেয়শীর হাতে হাত রেখে আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটবে আজ দু’জন কিন্তু ভাগ্য তো অন্য কিছুই লিখে রেখেছিল।প্রেয়শীর হাতে হাত রেখে আর বোধহয় হলো না তাজের। সময় বুঝি ফুরিয়ে এলো। দমটাও কেমন আটকে আটকে আসছে । এই বুঝি চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে তার। পুরো শরীর অসাড় হয়ে পড়েছে। চাইলেও হাত পা নাড়াতে পারছে না। সম্পূর্ন ভাবে চোখ বন্ধ আগে ঝাপসা চোখে দেখতে পেল মৌমিতা ভীর ঠেলে দৌড়ে এসেছে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েছে তাজের শিয়রে। টেনে হিচড়ে তাজের মাথাটা কোলে তুলে নিল সে। কান্না বিজরিত কন্ঠে শুধালো – আপনার কিচ্ছু হবে না। আমি এক্ষুনি আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব। একদম চোখ বন্ধ করবেন না আপনি, চোখ খুলে রাখুন।

গাল বেয়ে অজস্র অশ্রু কনা গড়িয়ে পড়ছে মৌমিতার। তাজের বড্ড হিংসা লাগছে সে এখনও তার প্রেয়শীকে একটু ছুঁয়ে দিতে পারলো না। আর এই অশ্রু কনা কিনা বিনা বাধায় তার প্রেয়শীকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। তাজ নিজের রক্তমাখা হাত রাখলো মৌমিতার অশ্রু সিক্ত গালে। অস্ফুট স্বরে বলল – মৌ……

আর কিছু বলতে পারলো না সে। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। চোখ দুটো যে বড্ড অবাধ্য হয়ে গেছে এই মুহূর্তে, তার প্রেয়শীকেও একটু দেখতে দিচ্ছে না মন ভরে। চোখ দুটো আর খুলে রাখতে পারলো না তাজ। অসাড় হাতটা মৌমিতার গাল থেকে লুটিয়ে পড়লো ইট সিমেন্ট কংক্রিটে নির্মিত রাস্তার উপর। ডুকরে কেঁদে উঠলো মৌমিতা। চিৎকার করে বলল – আপনার কিচ্ছু হবে না। হতে দেব না আমি। আপনার কিছু হলে যে আমি বাঁচতে পারবো না, কিছুতেই না।

কথা বলছে না তাজ। চোখ মেলেও তাকাচ্ছে না। মৌমিতা আরও অস্থির হয়ে পড়লো। এই শহরের মানুষগুলো বোধহয় এই শহরে গড়া বিল্ডিংগুলোর মতোই ইট সিমেন্ট গড়া। সবাই কেমন তাকিয়ে তাকিয়ে দুই নরনারীকে দেখছে। একজন এই মাত্র ঘটা সড়ক দুর্ঘটনায় লুটিয়ে পড়েছে আর অন্য জন তার প্রিয়জনের ব্যথায় জর্জরিত, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে তার। বোকার মতো হাসপাতালে না নিয়ে প্রিয় মানুষটার শোকে বোধবুদ্ধিহীন হয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। ঐ যে কথায় আছে না বিপদের সময় মানুষের বোধ বুদ্ধি লোপ পায়। মৌমিতার ও হয়েছে তাই।

ভীর ঠেলে ভিতরে এলো রাদীফ। তাজকে এভাবে দেখেই কলিজার মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো তার। সেই মানসিক হাসপাতাল থেকে ছেলেটাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে নিজের কাছেই রেখেছিল সে। ছেলেটার জন্য তার এক আলাদা মায়া আছে। তার ও যে এই পৃথিবীতে পরিবার বলতে এই ছেলেটাই আছে। বাবা মাকে তো সেই ছোট বেলায়ই হারিয়েছে আর নিজের একটা ভাই যদিও আছে। কিন্তু ওটা শুধু নামেই আছে আর কিছু নয়। বিয়ে করে পর হয়ে গেছে। রাদীফ ছুটে গেল তাজের কাছে। রাদীফকে দেখে মৌমিতা আরও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। রাদীফ কোনো রকম সামলালো নিজেকে। একটা গাড়ি ডেকে কিছু পথচারীর সাহায্য নিয়ে গাড়িতে উঠালো তাজকে। মৌমিতাও উঠে বসলো। তাজের মাথাটা আবার নিজের কোলের উপর শোয়ালো। দুহাতে আগলে নিল তাজকে।

চলবে….

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply