নিষিদ্ধ_রংমহল 🥀
পর্ব_২২
লেখিকাঃ Atia Adiba – আতিয়া আদিবা
গজনবী এস্টেটের গগনচুম্বী খিলানগুলোতে কপোত কপোতীর কলকাকলি আজ বড় ম্রিয়মাণ, যেন এক করুণ বিলাপের সুর ধ্বনিত হচ্ছে মহলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। উত্তরের হিমেল সমীরণ অন্দরমহলের সেই স্থূল যবনিকাগুলোকে আন্দোলিত করছে ঠিকই, কিন্তু সেই বায়ুপ্রবাহে আজ কোনো স্নিগ্ধতা নেই। বরং এক নিগূঢ় আশঙ্কার আঘ্রাণ তাতে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। পাথুরে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফেরা সেই বাতাসের হাহাকার যেন কোনো অশুভ পরিণতির সংকেত দিচ্ছে।
জমিদার সিকান্দার গজনবী তার খাস কক্ষের সংলগ্ন প্রশস্ত বারান্দায়, আলিশান মখমলের গদিতে দেহখানি এলিয়ে বসে আছেন। তার স্থির দৃষ্টি সুদূর দিগন্তের ধূসরতায় নিবদ্ধ। বাম হস্তের অঙ্গুলিতে শোভা পাচ্ছে একটি নবক্রীত এবং বহুমূল্য রত্নখচিত অঙ্গুরীয়, ভোরের লোহিত রশ্মি যখন তাতে আপতিত হচ্ছে, তখন এক পৈশাচিক দীপ্তিতে তা ঝলমলিয়ে উঠছে। সিকান্দার গজনবীর ললাটে আজ কোনো দুশ্চিন্তার রেখা নেই। বরং সেখানে এক পৈশাচিক তৃপ্তির আভাস প্রদীপ্ত। তিনি বিলক্ষণ জানেন, মনসুর আলীর সহিত সম্পাদিত সেই নিভৃত চুক্তি আজ এক নব্য ইতিহাসের সূত্রপাত ঘটাবে, যে ইতিহাস রচিত হবে প্রেমের বলিদান আর জেদের জয়গানে।
দাউদের অতি সতর্ক পাদক্ষেপে জমিদারের ধ্যান ভঙ্গ হলো। সে অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে, মস্তক অবনত করে বারান্দায় পদার্পণ করল। সে অবগত যে, এই অসময়ে কর্তার চিত্তের প্রশান্তি বিঘ্নিত হওয়া কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। দাউদ তার কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব অবনমিত করে আরজ জানাল,
- হুজুর, আপনার আজ্ঞানুসারে বাঈজী হেমাঙ্গিনী অন্দরমহলের সিংহদ্বারে দণ্ডায়মান। তিনি আপনার সদয় অনুমতির প্রতীক্ষা করছেন।
সিকান্দার গজনবীর ওষ্ঠাধরে এক চিলতে কুটিল হাসির রেখা ফুটে উঠল। তিনি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে বললেন,
- তাকে অন্তঃপুরে নিয়ে এসো দাউদ। আর শোনো, কক্ষের চতুর্পার্শ্বে যেন কোনো কাকপক্ষীও না থাকে। আমাদের এই নিগূঢ় মন্ত্রণার প্রতিটি শব্দ যেন এই পাষাণ দেয়ালের অভ্যন্তরেই সমাহিত থাকে।
দাউদ পুনরায় ভূমিষ্ঠ হয়ে কুর্নিশ জানিয়ে প্রস্থান করল।
ক্ষণকাল পরেই অলিন্দে নূপুরের সেই চিরপরিচিত নিক্বণ শ্রুত হলো। তবে আজ সেই ধ্বনিতে কোনো চপলতা বা মাধুর্য নেই। বরং এক প্রগাঢ় জড়তা আর বিষণ্ণতা তাতে বিদ্যমান। হেমাঙ্গিনী প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করল। তার মুখাবয়বে প্রসাধনের বিন্দুমাত্র লেশ নেই, তবুও সেই প্রাতঃকালীন ম্লান আলোয় তার স্বাভাবিক শ্রী যেন এক বিমূর্ত কাব্যের ন্যায় দীপ্যমান হয়ে উঠছে। অন্দরমহলের এই অযাচিত এবং অকাল তলব তার নিকট অত্যন্ত রহস্যময় ও অনভিপ্রেত ছিল। সে জমিদারের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে আভিজাত্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনপূর্বক কুর্নিশ জানাল।
সিকান্দার গজনবী তার সেই গম্ভীর ও গুমোট কণ্ঠে আলাপন শুরু করলেন,
- উপবেশন করুন, বাঈজী সাহেবা। আপনাকে আজ এক বিশেষ রাজকীয় ও জমিদারিক প্রয়োজনে আহ্বান করেছি। আপনি এই গজনবী এস্টেটের কেবলমাত্র এক নর্তকী নন, আপনি আমাদের গরিমা ও আভিজাত্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আপনার অনুপম নৃত্যকলা আর পরিশীলিত আচরণ এই অঞ্চলের প্রতিটি পরগনায় আমাদের বংশের শৌর্য বৃদ্ধি করেছে।
হেমাঙ্গিনী বিনীত স্বরে উত্তর দিল,
- হুজুর, আপনার এই প্রশংসা আমার ন্যায় এক নগণ্য সেবিকার জন্য পরম আশীর্বাদ স্বরূপ। তবে অন্দরমহলে এই প্রভাতকালীন আহ্বানের গূঢ় কারণটি যদি অধমকে অবগত করতেন, তবে কৃতার্থ হতাম।
সিকান্দার গজনবী ইষৎ সম্মুখপানে ঝুঁকে বসলেন। তার সেই তীক্ষ্ণ নেত্রপল্লবে এক বিচিত্র ও ভয়ংকর অগ্নির ঝলক।
- আমাদের পরম হিতৈষী এবং এই অঞ্চলের দাপুটে তুলা ব্যবসায়ী মনসুর আলী সাহেব তার আবাসে এক বিশাল জলসার আয়োজন করেছেন। তার এই পারিবারিক মহোৎসব কেবল বিনোদনের নিমিত্ত নয়, বরং গজনবী এস্টেটের সহিত তার আগামী দিনের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সন্ধির এক প্রলয়ঙ্করী স্তম্ভ। মনসুর আলী সাহেবের ঐকান্তিক বাসনা এই যে, গজনবী এস্টেটের সর্বশ্রেষ্ঠ অলঙ্কার যেন তার সেই জলসাঘরকে আলোকিত করে। আমি তার সেই প্রার্থনাকে সম্মান জানিয়ে স্থির করেছি, আপনিই সেখানে আমাদের প্রতিনিধি হয়ে পদার্পণ করবেন।
হেমাঙ্গিনীর অন্তরাত্মা এক মুহূর্তের জন্য যেন হিম হয়ে গেল। গজনবী মহলের সুরক্ষিত গণ্ডির বাইরে এভাবে কোনো সাধারণ ব্যবসায়ীর আবাসে গিয়ে নৃত্য প্রদর্শন করা তার নিকট নিদারুণ অবমাননাকর ও আশঙ্কাজনক বলে প্রতীয়মান হলো। জমিদারি প্রথায় বাঈজীদের বহিরাগত কোনো মাহফিলে প্রেরণ করা এক ধরণের অঘোষিত নির্বাসন বা অমর্যাদার নামান্তর। সে ঈষৎ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
- হুজুর, আমি এই প্রাসাদের রঙ্গমঞ্চ এবং আপনার আভিজাত্যের মর্যাদা রক্ষা করতেই অভ্যস্ত। বিজাতীয় কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন উৎসবে অংশগ্রহণ করা কি গজনবী বংশের ঐতিহ্যের সহিত সংগতিপূর্ণ হবে? তদুপরি, কোনো ব্যবসায়ীর কুঠিতে গিয়ে নর্তন করা…
সিকান্দার গজনবী এবার তার কণ্ঠস্বরে শৈত্য ও কাঠিন্য আনলেন। জমিদার হিসেবে তার আদেশ যে ধ্রুব সত্য এবং প্রশ্নাতীত, তা তিনি তার প্রখর চাহনিতেই স্পষ্ট করলেন। তিনি বললেন,
- আপনার শৈল্পিক দক্ষতা আর প্রজ্ঞা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। কিন্তু আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে, জমিদারের আদেশ অলঙ্ঘনীয়। মনসুর সাহেবের সহিত আমাদের আগামী দিনের যে স্বার্থ নিহিত আছে, তার গুরুত্ব অপরিসীম। আপনি সেখানে উপস্থিত হলে গজনবী বংশের শ্রেষ্ঠত্বই প্রতিপন্ন হবে। আপনি আজই আপনার প্রসাধন ও আনুষঙ্গিক সজ্জা সুসংগঠিত করুন। সূর্যাস্তের পূর্বেই সুসজ্জিত পালকিতে করে আপনাকে মনসুর আলী সাহেবের কুঠিতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে। মনে রাখবেন, এটি আমার চূড়ান্ত আজ্ঞা, কোনো প্রস্তাব নয়।
হেমাঙ্গিনী অনুধাবন করল যে তর্কের আর কোনো অবকাশ নেই। তার চতুর্পার্শ্বের প্রাচীরগুলো যেন এক নিমেষেই সংকুচিত হয়ে এল। সে এক দীর্ঘশ্বাস অন্দরেই সমাহিত করে মস্তক অবনত করল। বলল,
- আপনার আদেশ শিরোধার্য হুজুর। আমি প্রস্তুতির নিমিত্ত বিদায় নিচ্ছি।
বাঈজী মহলে প্রত্যাবর্তন করে হেমাঙ্গিনী যখন স্বীয় প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করল, তার পদযুগল যেন আর চলনক্ষম ছিল না। বাতায়ন দিয়ে আগত রৌদ্ররেখায় ধূলিকণাগুলো চঞ্চলভাবে বিচরণ করছিল ঠিকই, তবুও হেমাঙ্গিনীর চক্ষুর সম্মুখে সব অন্ধকার প্রতিভাত হচ্ছিল।
বিলকিস বানু তখন কক্ষের দ্বারের পার্শ্বে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হেমাঙ্গিনীর বিমর্ষ বদন আর পাণ্ডুর চাহনি দর্শনে তিনি বিচলিত হয়ে অগ্রসৃত হলেন।
- কী ঘটিয়েছে বেটি? হুজুর কেন তলব করেছিলেন তোকে? তোর ললাটে এমন দুশ্চিন্তার করাল রেখা কেন?”
হেমাঙ্গিনী টাল সামলে একটি কাষ্ঠাসনে উপবেশন করল। অত্যন্ত ক্ষীণ ও ম্লান স্বরে বলল,
- খালা, আমাকে আজই এই প্রিয় মহল ত্যাগ করতে হবে। হুজুর আজ্ঞা করেছেন, আমাকে আজ এই অঞ্চলের ধনাঢ্য তুলা ব্যবসায়ী মনসুর আলী সাহেবের কুঠিতে গিয়ে নৃত্য প্রদর্শন করতে হবে। গজনবী এস্টেটের নজরানা হিসেবে আমাকে সেখানে প্রেরণ করা হচ্ছে।
বিলকিস বানুর হস্তস্থিত পানের বাটাটি সশব্দে মৃত্তিকায় পতিত হলো। তিনি ক্ষণকাল নিস্পন্দ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর বিস্মিত স্বরে শুধালেন,
- মনসুর আলীর কুঠিতে? এই অশুভ সময়ে? বেটি, আমার অন্তর আজ বারবার অমঙ্গলের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। উচ্চবংশীয়দের এই মৌখিক সৌজন্যের আড়ালে অনেক সময় হলাহল লুক্কায়িত থাকে। গজনবী প্রাসাদের শ্রেষ্ঠ বাঈজী কোনো এক সাধারণ ব্যবসায়ীর আড়তে গিয়ে নাচবে! এই রেওয়াজ তো এই মহলের শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসে বিরল। হুজুর তোকে কোনো নিগূঢ় অভিসন্ধি নিয়ে পাঠাচ্ছেন না তো?
হেমাঙ্গিনী বিলকিস বানুর হস্তদ্বয় শক্ত করে ধরল। তার করতল তখন বরফখণ্ডের ন্যায় শীতল।
- আমিও ঠিক সেটাই অনুধাবন করছি খালা। কিন্তু হুজুরের বাক্যের ওপর বাক্য বলার স্পর্ধা এ পরগনায় কার আছে? আজ যদি আমি অস্বীকার করি, তবে তা কেবল ধৃষ্টতা নয়, বরং বিদ্রোহ হিসেবে পরিগণিত হবে। আর তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। হয়তো আমি কেবল অমূলক সন্দেহ করছি।
এই বলে হেমাঙ্গিনী স্বীয় বহুমূল্য পরিচ্ছদগুলো কাষ্ঠাধারে সঞ্চিত করতে লাগল। বিলকিস বানুও অগ্রসর হলেন। হেমাঙ্গিনীর সেই দুর্লভ অলঙ্কারগুলো মখমলের পেটিকায় পরম মমতায় সজ্জিত করতে লাগলেন তিনি।
বিলকিস বানু ফিসফিস করে সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন,
- পুরুষ জাতির মতিগতি বড় বিচিত্র ও কুটিল। বিশেষ করে মনসুর আলী সাহেবের ন্যায় ধূর্ত ব্যবসায়ী যখন কোনো কিছুর আবদার করে, তখন তার পশ্চাতে লালসার বহ্নি থাকাটাই স্বাভাবিক। তুই অতীব সতর্ক থাকিস বেটি। সেখানে কোনো বিপদের আভাস পেলে বা কারো দৃষ্টি যদি কলুষিত মনে হয়, তবে তৎক্ষণাৎ কোনো ছলে সেখান হতে নিষ্ক্রান্ত হস।
হেমাঙ্গিনী একটি ম্লান ও ম্রিয়মাণ হাসি দিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। তার হৃদয়ের মণিকোঠায় তখন কেবল একটি নামই প্রদীপ্ত হচ্ছিল, নবাব তাইমুর গজনবী। তিনি কি অবগত আছেন যে তার প্রাণের স্পন্দনকে আজ অন্য এক জনপদে, অন্য এক পরপুরুষের মনোরঞ্জনের নিমিত্ত অর্পণ করা হচ্ছে? নাকি নিয়তি আজ তাদের বিচ্ছেদের এক অমোঘ ও বিষাদময় নীল নকশা অঙ্কন করে রেখেছে?
সূর্যকিরণ তখন প্রাসাদের পূর্ব দিকের অলিন্দে এক অপার্থিব ও মায়াবী আভা বিকিরণ করছে। সুলতানা আজ ঊষালগ্নেই শয্যা ত্যাগ করেছে। সে আজ অত্যন্ত নিপুণভাবে নিজেকে সজ্জিত করল। পরনে তার নীলকান্তমণি সদৃশ গাঢ় নীল মসলিনের এক অপূর্ব বসন। অঙ্গে স্বর্ণালঙ্কার, কেশদামে সুগন্ধি তৈলের সৌরভ। তার মুখাবয়বে আজ এক বিজয়ী হাসি দীপ্যমান।
সুলতানা আজ তার আধিপত্য বিস্তারের প্রথম বাস্তব পদক্ষেপটি গ্রহণ করতে যাচ্ছে। সে অবগত আছে যে, কেবল অন্তঃপুরে বসে থাকলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। নবাব তাইমুর গজনবীর হৃদয়ে এবং মস্তিষ্কে স্বীয় স্থান সুদৃঢ় করতে হবে। সে আজ নিজ হাতে অত্যন্ত যত্নসহকারে ‘লবঙ্গ লতিকা’ এবং জাফরান মিশ্রিত শাহী ফিরনি প্রস্তুত করল।
সুলতানা অত্যন্ত ধীর ও ললিত পদে, আভিজাত্যের চরম পরাকাষ্ঠা নিয়ে নবাব তাইমুর গজনবীর ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠের সম্মুখে উপস্থিত হল। তার পশ্চাতে দুজন খাদেম সেই উপঢৌকনগুলো বহন করে নিয়ে আসছিল। দ্বাররক্ষীরা জমিদারপুত্রের পূর্ব নির্দেশানুসারে সুলতানাকে অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করল।
সুলতানা কক্ষের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত বিনীত অথচ সুমিষ্ট স্বরে আহ্বান করল,
- হুজুর! আপনার প্রাতঃভোজের বিরতি গ্রহণের লগ্ন সমাগত।
তাইমুর ধীরলয়ে মস্তক উত্তোলন করলেন। সুলতানার এই প্রভাতকালীন উপস্থিতি তাকে ঈষৎ বিস্মিত করল। তবুও তিনি তার বংশীয় আভিজাত্য ও সৌজন্য বজায় রাখলেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
- আসুন সুলতানা! আপনি এই অসময়ে এত ক্লেশ স্বীকার করে এখানে কেন? কোনো বিশেষ বার্তা আছে কি?
সুলতানা মৃদু হাসল। সেই হাসিতে এক মোহিনী আকর্ষণ ছিল। সে হস্তস্থিত রেকাবিটি তাইমুরের পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র মেহগনি কাষ্ঠের আধারের ওপর রাখল। স্বহস্তে মিষ্টান্নের একটি পাত্র সম্মুখে এগিয়ে দিয়ে অত্যন্ত কোমল কণ্ঠে নিবেদন করল,
- শ্রুত হলো যে আপনি প্রাতঃকাল হতে কিছুই গ্রহণ করেননি। আজ আমি স্বহস্তে আপনার নিমিত্ত এই মিষ্টান্ন প্রস্তুত করেছি। যদি কিঞ্চিৎ আস্বাদ গ্রহণ করেন, তবে আমার এই নগণ্য শ্রম সার্থক হবে।
তাইমুর সুলতানার মুখমণ্ডলের দিকে একবার তীক্ষ্ণ অথচ স্থির দৃষ্টিতে অবলোকন করলেন। সুলতানার নয়নে এক অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান থাকলেও তার অবয়বে এক নিখুঁত আভিজাত্য ছিল। তাইমুর সুলতানাকে অসম্মান করার কথা চিন্তাও করতে পারলেন না। তিনি তাকে আসন গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়ে বললেন,
- আপনি যখন এতটা যত্নসহকারে এবং স্বহস্তে এটি প্রস্তুত করেছেন, তখন তা প্রত্যাখ্যান করার সাধ্য আমার নেই। আপনিও উপবেশন করুন সুলতানা। একাকী মিষ্টান্ন গ্রহণ করা তো এই প্রাসাদের শিষ্টাচার বিরুদ্ধ।
সুলতানা অত্যন্ত প্রীত হল। সে ধীরপদে পার্শ্ববর্তী মখমলের আসনে উপবেশন করে তাইমুরের সহিত নানাবিধ বিষয়ে আলাপন শুরু করল। সে এই অঞ্চলের বর্তমান শাসনপ্রণালী, গজনবী এস্টেটের গৌরবময় ইতিবৃত্ত এবং স্বীয় বংশের শৌর্যগাথা অত্যন্ত নিপুণভাবে উপস্থাপনা করতে লাগল। সুলতানার প্রতিটি বাক্যের অন্তরালে তাইমুরের চিত্ত জয় করার এক প্রচ্ছন্ন অথচ বলিষ্ঠ প্রয়াস ছিল। সে প্রত্যাশা করছিল তাইমুর যেন অনুধাবন করেন যে সুলতানাই এই প্রাসাদের যোগ্য সম্রাজ্ঞী হওয়ার সকল গুণের অধিকারিণী।
তাইমুরও স্মিতহাস্যে সুলতানার বাক্যের প্রত্যুত্তর প্রদান করছিলেন, কিন্তু তার মনের গহন অরণ্যে কেবল একজন নারীরই প্রতিচ্ছবি প্রদীপ্ত হচ্ছিল। তিনি যখন মিষ্টান্নের আস্বাদ গ্রহণ করছিলেন, তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠছিল হেমাঙ্গিনীর সেই সলজ্জ ও অপার্থিব চাহনি। সুলতানা যখন কথা বলছিল, তাইমুরের কর্ণে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল হেমাঙ্গিনীর সেই নূপুরের সুমধুর নিক্বণ। সুলতানা সশরীরে তার সম্মুখে উপবিষ্টা থাকলেও তাইমুরের সমগ্র চেতনা জুড়ে বিরাজ করছিল তার সেই চিরকাঙ্ক্ষিত বাঈজী সাহেবা। তার মনে হচ্ছিল, এই পার্থিব মিষ্টান্নের স্বাদের চেয়ে হেমাঙ্গিনীর সহিত যাপিত সেই নিভৃত মুহূর্তগুলো শতগুণে অধিক মধুর।
সুলতানা এক মাহেন্দ্রক্ষণে তাইমুরের নেত্রদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ের সহিত বলল,
- হুজুর, এই গজনবী প্রাসাদ যেমন বিশাল, এর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখা ঠিক ততটাই দুরুহ। আমি প্রত্যাশা করি, আপনি যেন এই এস্টেটের প্রতিটি ধূলিকণায় স্বীয় পূর্ণ আধিপত্য বজায় রাখেন। আর আমি আপনার সেই রাজকীয় অভিযাত্রায় একনিষ্ঠ ছায়া হয়ে অনুগমন করতে চাই।
তাইমুর একটু ম্লান হাসলেন। তার সেই হাসির অন্তরালে এক অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর ছিল যা সুলতানা ভেদ করতে অক্ষম ছিল। তাইমুর রেশমী রুমাল দিয়ে হস্ত পরিষ্কার করে বললেন,
- ‘আধিপত্য আর অধিকার’ এই দুইয়ের মধ্যস্থলে এক অতি সূক্ষ্ম ও গভীর সীমারেখা বিদ্যমান। তবে আপনার এই সহমর্মিতা আর আপনার হস্তনির্মিত এই অসাধারণ মিষ্টান্নের জন্য আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আপনি গজনবী মহলের একজন পরিশীলিত ও মর্যাদা সম্পন্ন সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করেছেন।
সুলতানা মনে মনে অত্যন্ত পুলকিত ও গর্বিত হল। সে ধারণা করল যে তার মায়াজালে তাইমুর হয়তো কিঞ্চিৎ হলেও অভিভূত হয়েছেন। সে স্বীয় কল্পনায় এক সুখের সাম্রাজ্য নির্মাণ করতে লাগল, যেখানে সে হবে এই সুবিশাল প্রাসাদের একচ্ছত্র কর্ত্রী।
বেলা যখন দ্বিপ্রহরে উপনীত হল, গজনবী এস্টেটের প্রধান তোরণ দিয়ে একটি সুসজ্জিত, যবনিকা ঘেরা পালকি ধীরগতিতে নিষ্ক্রান্ত হল। সেই পালকির চতুষ্পার্শ্বে ছিল দশজন সশস্ত্র প্রহরী, যাদের হস্তে প্রদীপ্ত বল্লম আর কটিদেশে লম্বিত কৃপাণ। পালকির অভ্যন্তরে উপবিষ্টা হেমাঙ্গিনী যবনিকার এক ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে একবার প্রাসাদের সেই গগনচুম্বী গম্বুজগুলোর দিকে অন্তিমবারের ন্যায় দৃষ্টিপাত করল। তার নয়নে আজ কোনো অশ্রুধারা নেই, আছে কেবল এক রাশ গাঢ় অন্ধকার আর অনিশ্চয়তা। সে অনুভব করছিল, সে যেন এক অজ্ঞাত ও অন্ধকার গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন হয়তো তার ললাটে নেই।
ওদিকে প্রাসাদের নিভৃত খাস কামরায় বসে সিকান্দার গজনবী পৈশাচিক শান্তিতে হাসছিলেন।তার সেই অট্টহাসির প্রতিধ্বনি কক্ষের প্রাচীরগুলোতে যেন এক ভয়ানক আতঙ্কের সৃষ্টি করছিল। তিনি দাউদকে আহ্বান করে অত্যন্ত শীতল ও কঠোর কণ্ঠে বললেন,
- দাউদ, মনসুর আলীকে সংকেত প্রেরণ করো। তার কাঙ্ক্ষিত উপঢৌকন যাত্রা শুরু করেছে।
৪০০০ লাইক আর ৬০০ কমেন্ট টার্গেট পূরণ করবেন।
পর্ব ২৩ আগামীকাল সন্ধ্যা ৫:৪০ এ আসবে ❤️
উপন্যাসঃ #নিষিদ্ধ_রংমহল 🥀
Share On:
TAGS: আতিয়া আদিবা, নিষিদ্ধ রংমহল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৫
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৭
-
নিষিদ্ধ রংমহল গল্পের লিংক
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৪
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৩
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৬
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৮
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৯
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১১
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৭