Golpo romantic golpo তাজমহল সিজন ২

তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৭+১৮


তাজমহল #দ্বিতীয়_খন্ড

পর্ব_১৭

প্রিমাফারনাজচৌধুরী

শাইনা আজ দেরী করে ঘুম থেকে উঠলো। বিয়ের পর থেকে তারমধ্যে চরম আলস্য চলে এসেছে। সব নিয়মের হেরফের। গত শীতেও সে দাদীমার সাথে সকাল সকাল উঠে নামাজ কালাম, কোরআন পড়তো। ঘরের কাজবাজ করতো। দুপুরে বিলে গিয়ে গরম রোদ গায়ে মাখতো। বেড়াতে যেত। একগাদা বাচ্চা কাচ্চা পড়াতো। সবার সাথে চিল্লাপাল্লা, হৈচৈ! রোজ একেকটা ইউনিক রান্না করে ভাইদের মুখ থেকে প্রশংসার আশায় হাঁ করে বসে থাকতো। সবাই খেয়ে প্রশংসা করলে তার আনন্দ দেখে কে?

গত বছর শীতে সে সবখানে বেড়িয়েছে। আপাদের শ্বশুরবাড়ি, মামার বাড়ি, খালাম্মাদের বাসায়, ফুপুদের বাসায়। বিয়ে হয়ে যাবে তাই হয়তো সবার বাড়িতে গিয়ে দেখে এসেছিল।

জানেনা আর কখনো ওভাবে বেড়ানো হবে না। সবাই তখন বলাবলি করছিল, বিয়ে হয়ে গেলে আর আসতে পারবে না। ঘর সংসার সামলে মেয়েরা আর কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। গত বছর এই দিনেও সে খুব ছটফটে, উচ্ছ্বসিত ছিল। অথচ একটা বছরের ব্যবধানে কি থেকে কি হয়ে গেল।

এমন না যে বিয়েটাকে সে এসবের পেছনে দায়ী করে। বিয়ের মতো এমন একটা পবিত্র সম্পর্ক কখনো তার এই অবসাদের, অনুভূতিহীনতার কারণ হোক তা সে চাইছে না।

কিন্তু সে এতদিন একটা কথা উপলব্ধি করেছে বিয়ের পর সে তার জীবনটাকে আগের মতো দেখছে না। তার উপর যা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা সে অনায়াসে গ্রহণ করার পর তার জীবনটা পাল্টে গেছে। তার মধ্যে থেকে আত্মবিশ্বাস চলে গেছে। নিজেকে নিয়ে সে ভাবছে না। অন্যরা কি ভাবছে, কি বলছে সেদিকে তার ফোকাস চলে গেছে।

নিজেকে সে সময় দিচ্ছে না। নিজের প্রতি তার ভালোলাগা, ভালোবাসা কমে গেছে। এমন জীবন তো সে চায়নি। সে সবসময় জীবনটাকে উপভোগ করতে চেয়েছে। মনখুলে হাসতে চেয়েছে, প্রাণ খুলে বাঁচতে চেয়েছে। কিন্তু এখন নিজেকে এত অসহায়, দূর্বল আর আত্মবিশ্বাসের অভাব বলে মনে হচ্ছে কেন?

ব্রাশ করতে করতে সে এইসব ভাবতে লাগলো।
কয়েকদিন ধরে এইসব ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার এখন কীসের অভাব? যখন থেকে বুঝ এসেছে তখন থেকেই সে চেয়েছিল পড়াশোনা শেষ করে কিছু একটা করবে যাতে কখনো কারো ডিপেন্ডেড হতে না হয়। তারপর বিয়েশাদি যা হবার হবে। তার মনের মতো মানুষকে সে বিয়ে করবে।

কিন্তু পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের আগে সে যথেষ্ট শক্তপোক্ত ছিল। এখন ততটাই নড়বড়ে। শুধু তাজদার সিদ্দিকীর উপর নির্ভর হওয়ার জন্য? নাকি বিয়ের আগে উপার্জন করে যে হাত খরচের টাকা সে পেত সেইসব এখন পায় না বলে, নিজের পয়সায় কিছু করতে পারছে না বলে এমন হচ্ছে? এমন তো না যে সে নিজের পয়সায় খেত পড়তো। টিউশনি করে যা পেত তা দিয়ে সে নিজের শখ পূরণ করতো। পরিবারের পেছনে খরচ করতো। এটা কিছুতেই মূল কারণ হতে পারে না। আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিটা ঠিক কি কারণে? কেন সে সবকিছু আগের মতো ভাবতে পারছে না। স্বামীর টাকা নিজের পেছনে খরচ করতে পারাটাও আল্লাহর একটা রহমত। যা সে পেয়েছে। কিন্তু তার অসন্তুষ্টিটা ঠিক কোন জায়গায় সে এখনো অব্দি বুঝে উঠতে পারছে না।

সে মোটেও চাইছে না বিয়েকে দায়ী করতে। অতীত সবসময় ঝামেলা বাড়ায়। অশান্তি টেনে আনে। সে এখন যা আছে সবটা নিয়ে বাঁচতে চায়। জীবনটা বড়ো একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। সে নিজেই নিজের উপর বিরক্ত। অথচ বিয়ের আগে সে আয়নায় নিজেকে দেখার পর নিজেই খুশি হয়ে যেত। বুকটা ভরে উঠতো। আর এখন? আয়নায় তাকাতেই ইচ্ছে করে না। জোরে করে হাসি টানতে হয় ঠোঁটের কোণায়। এভাবে তো সে বাঁচতে চায়নি।

ব্রাশ করে মুখ হাত ধুয়ে নিল সে। বাড়িতে বুয়া রাখা হয়েছে কাটাকুটি, ঘরদোর মোছা, থালাবাসন ধোয়া আর কাপড়চোপড় ধুয়ে দেয়ার জন্য। তাদের পাশের এলাকায় বাড়ি থেকে এসেছেন উনি। মোখলেসের মা ডাকে সবাই। স্বামী বিয়োগের পর ছেলেগুলোর অল্পবয়সে বিয়ে করে ফেললো। ছেলের বউরা উনাকে আর ঘরে রাখলো না। তার অবশ্য অপ্রয়োজনীয় কথা বলার রোগ আছে। তাসনুভা দু-চোখে সহ্য করতে পারে না। বেশি কথা বলা মহিলা তার পছন্দ নয়। তারউপর যদি এমন হয় কথা প্যাঁচানো মহিলা।

ওর জন্যই বাড়িতে বুয়া রাখা যায় না। কিছুদিন যেতে না যেতেই সে চরম বিরক্ত হয়ে পড়ে তাদের উপর। বুয়া থাকবে বুয়ার মতো। বাড়ির ব্যক্তিগত ব্যাপারে কেন নাক গলাবে? এই বাড়ির কথা কেন বাইরে গিয়ে বলবে? সে এইসব কাজকে ছোটোলোকি কাজকারবার বলে। আগে তাজদারও এইসব কাজের লোক সহ্য করতো না। তাদের বাড়িতে অন্য মানুষজন ঘুরে বেড়াবে এইসব তার একদম পছন্দ ছিল না।

তাই রওশনআরা থালাবাসন মাজা আর কাপড়চোপড় ধোয়ার জন্য বুয়া রাখতো তাদের এটা শর্ত দিয়ে যে রান্নাঘরের মধ্যেই যেন তারা সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে যেন কান না দেয়।

শাইনার কালকে হঠাৎ করেই চিতই পিঠা খেতে ইচ্ছে করছিল খেজুরের রস দিয়ে। শাহিদা বেগমকে ফোনে জানিয়েছে। তিনি বলেছেন, তোকে কাল নিয়ে আসবো আমি গিয়ে। গরম গরম পিঠা খাবি ইচ্ছেমতো। শাওনকে খেজুরের রস আনতে বলি।”

শাইনার এতদিনে যা খেতে ইচ্ছে হয়েছে সে সব খেতে পেরেছে। নোনতা ইলিশের ভুনা খেতে ইচ্ছে করছিল। আনিস পাঠিয়ে দিয়েছে গত সপ্তাহে। যদিও এটা নিয়ে রওশনআরা তাকে বকেছেন। কিন্তু শাইনা উনাকে আশ্বস্ত করেছে তাজদার সিদ্দিকী এইসব নিয়ে কিছু বলবে না। ওই বাড়িতে থাকলে ভাইয়ারা এমনিতেও তার পছন্দের খাবারদাবার আনতো। ওখানে যেতে দিচ্ছে না বলেই এই বাড়িতে পাঠাচ্ছে।

শাইনা সকালের নাশতা করার জন্য রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। তিতলি অন্যদিন তার ঘরে এসে ডেকে নিয়ে যায়। আজ তার সাড়াশব্দ নেই। তিতলির কথা ভাবতে ভাবতে সে তৌসিফের ঘরের সামনে গিয়ে থামলো।

সেখানে তিতলি কাঁদছে। আবার এলোমেলো বকে যাচ্ছে। তৌসিফের হাসি শব্দ ভেসে আসছে। পেট চেপে মানুষ যেভাবে হাসে তৌসিফ সেভাবে হাসছে। শাইনা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গোঁ গোঁ শব্দ করলো কোনো একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর।

সে ঘরে পা রাখতেই তার ঠোঁট হাঁ হয়ে গেল। তিতলির মুখ হাত পা বেঁধে মেঝেতে ফেলা রাখা হয়েছে!

তৌসিফের হাতে মোটা একটা বেত। তিতলির সামনে চেয়ারে ঝুঁকে বসে তিতলিকে ভয় দেখাচ্ছে। আর বলছে,

“কাঁদলে ছেড়ে দেব। নইলে ছাড়া পাবি না। একটু করে কেঁদে দে।”

তিতলি কাঁদলো না। বরং তাকে চোখের পুতলি ঘুরিয়ে দেখালো। সে কিছুতেই কাঁদবে না। এবার দুজন একসাথে শাইনাকে দেখলো। শাইনা অবাক হয়ে বলল,”এইসব কি ভাইয়া?”

তৌসিফ হেসে উঠলো।

“সত্যিটা বলবো?”

শাইনা কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। সকাল সকাল এরা কি শুরু করে দিয়েছে। তৌসিফ বলল,

“এই চোরোনি কাল আমার পকেট থেকে বিশ টাকা কট করেছে। সকাল সকাল আবারও এসে আমার শার্টের পকেটে টাকা হাতড়াচ্ছিল। হাতেনাতে ধরে ফেললাম।”

তিতলি আবারও চোখ উল্টে তাকে বিদ্রুপ করছে। তার হাত বেঁধে রেখেছে তাতে কি? চোখ তো আছে। শাইনা তৌসিফের কথা শুনে হেসে ফেললো। তিতলির দিকে তাকিয়ে বলল,”হায় আল্লাহ! ননদিনী চোর একথা শুনতে হচ্ছে!”

তিতলি কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না। শাইনার মনে হলো একপক্ষের কথা শুনে তিতলিকে বিচার করাটা ঠিক হবে না। সে তৌসিফকে বলল,

“বড়োআম্মু ডাকছে ওকে। আমি খুলে দিই?”

তৌসিফ বলল,”না, ওর শাস্তি হলো দশটা পর্যন্ত এভাবে বসে থাকবে। তার আগে ছাড়া পেতে হলে ওকে কাঁদতে হবে।”

তিতলি চোখ গরম করে তাকাচ্ছে। তারমানে সে কাঁদবে না। কিছুতেই না। কাঁদতে কাঁদতে কাঁদার জন্য বললেও সে কাঁদবে না। নো নেভার।

শাইনা বলল,”ও নাশতা খায়নি এখনো। আপনি খেয়েছেন?”

তৌসিফ বলল,”হ্যাঁ ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেয়েছি।”

হাসতে লাগলো সে। এইবার তিতলির দিকে নজর গেল শাইনার। তিতলির চোখজোড়া বলছে একবার ছাড়া পাই। তোকে কাঁদিয়ে ছাড়বো শালা।

রওশনআরার ডাক ভেসে আসছে হালকা। শাইনা ধীরেধীরে হেঁটে রান্নাঘরে চলে গেল। তাকে দেখামাত্রই জোহরা বেগম বললেন,

“সকালের নাশতা নিয়ে এত সময় চলে গেলে বাকি কাজ হবে কখন? ওই বজ্জাতটা কোথায়?”

শাইনা মুখ ফস্কে বলে ফেললো,”তৌসিফ ভাইয়ার ঘরে।”

জোহরা বেগম কপাল কুঁচকে বললেন,”আবারও ওর কাজে বিরক্ত করতে গিয়েছে নাকি?”

শাইনা বলল,”না, দেখলাম কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে।”

সত্যিটা বললে বিপদ বাড়বে মনে হলো শাইনার। তাসনুভা রান্নাঘরের এককোণে রাখা টেবিলের সামনের বসে ব্রেকফাস্ট করছে। আজ বোধহয় শোরুমে যাবে না। নইলে আরও আগে সে সকালের নাশতা খায়।

শাইনা নাশতা খেতে বসলো। ঠিক তখুনি শাহিদা বেগম এলেন আনোয়ারা বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে। শাইনা মাকে দেখে খাওয়া থামিয়ে দিল। শাহিদা বেগম বললেন,

“ওমা তোরা এখন নাশতা করছিস কেন?”

জোহরা বেগম বললেন,”সেই ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছি আমরা। এরাই দেরী করে ঘুম থেকে উঠে। একেকজন নবাবজাদি।”

তাসনুভা কপাল কুঁচকে মেঝ মা’র দিকে তাকালো। সে কাল শোরুম থেকে ফিরে ছোটো ভাইয়ার সাথে বসে বসে ভিডিও ইডিট করছিল। ভয়েস ওভার দিচ্ছিল। দেরীতে ঘুমালে দেরীতে ঘুম ভাঙবে। খুব স্বাভাবিক।

শাহিদা বেগমকে চা দিলেন জোহরা বেগম। শাহিদা বেগম খেতে চাইলেন না। শাইনার ইশারায় খেলেন। বললেন,”আমি ওকে নিয়ে যেতে এসেছি। কাল চলে আসবে। আজকে শাবরিন আর শারমিলা আসছে তো তাই।”

রওশনআরা বলল,”বোনকে দেখতে ইচ্ছে হলে শ্বশুর বাড়িতে আসবে। ওকে যেতে হবে কেন?”

শাহিদা বেগম ফ্যাকাশে হাসলেন। বললেন,”ওরাও আসবে এখানে। কিন্তু শানু এখন যাক আমার সাথে।”

শাইনা এবার কথা বললো।

“আমি উনাকে বলেছি বড়োআম্মু।”

রওশনআরা কিচেন কাউন্টারে কাপ রাখতে রাখতে বলল,”তাহলে যাও। ওর জন্যই সমস্যা হয়। চলে এসো। থেকো না ওখানে।”

“আচ্ছা দেখি।”

শাহিদা বেগমের সাথে করে বাড়ি চলে এল। দিনটা শুক্রবার। ভাইয়ারা সবাই বাড়ি আছে। আপা, দুলাভাই আর বাচ্চা কাচ্চারা সবাই আসবে। শাইনা ভাগ্নে ভাগ্নিদের বহুদিন পর দেখবে তাই খুব উত্তেজিত।

বাড়ির পেছনের উঠোনে দুটো জবা*ই করা মোরগ পড়ে আছে বাঁশের ঝুড়িতে। দেশী মুরগীর মাংস খেতে খুব পছন্দ করে বড় আপা আর মেঝ আপা। ওরা এলে আম্মা দেশী মুরগী রান্না করবেই। শাওন দাদীমার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে মুরগীর পালক ছিঁড়ছে। শাইনাকে দেখে শাওন বলল,

“আরেকটা চলে এসেছে ভাগ বসাতে।”

শাইনা মুখ মোচড় দিল। শাহিদা বেগম ধমকে বললেন,”ওকে এইসব বলবি না শাওন।”

শাইনা মায়ের আহ্লাদ পেয়ে শাওনকে আবারও জিভ দেখালো। দাদীমা বলল,”লন্ডনওয়ালার বউ হাজির! আজকে তাইলে লন্ডনওয়ালার সাথে লম্বা একটা ফোনালাপ হবে।”

শাওন বলল,”লুইচ্চামি ছাড়ো। ভালো হয়ে যাও মাসুদ থুক্কু থুক্কু মাসুদের বউ।”

দাদীমা মোরগের পা’টা দিয়েই শাওনের হাতো আঁচড় কাটলো। শাওন জোরে একটা চিৎকার দিল।

মায়ের পেছন পেছন রান্নাঘরে ঢুকলো শাইনা। সাবিনা ব্লেন্ডারে পেঁয়াজ রসুন দিয়েছে। শাইনাকে দেখে সে হাসলো। শাইনা বলল,"বাবু কোথায়?"

"ওর মেঝ চাচ্চুর কোলে করে বাইরে ঘুরতে গিয়েছে।"

শাহিদা বেগম বললেন,"চেয়ারে বোস। নারিকেল পুরি খাবি? সকাল সকাল বানালাম। নারিকেলগুলো ফ্রিজে ছিল জানতামই না। বউ মনে করিয়ে দিল। তখন ভাবলাম কয়েকটা পুরি বানাই। সবাই যেহেতু বাড়িতে থাকবে। আনিস আশরাফ আর তোর আব্বা কিছুক্ষণ পরপর চা খুঁজে।"

শাইনা বলল,"কিছুক্ষণ পর খাব। এখন খাব না।"

মা আর ভাবির সাথে সাথে কথা বলতে বলতে আফসার সাহেব এলেন। শাইনা বাবাকে দেখে খুশি হয়ে গেল। উঠে গিয়ে বাবাকে হালকা করে জড়িয়ে ধরলো। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। হাসলেন। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,

"জামাই ভালো আছে তো? তোর সাথে কথা টথা বলে? ফোনটোন দেয়?"

"হ্যাঁ দেয়।"

"ভালো ভালো মা। ওখানে সব ঠিকঠাক তো?"

"হ্যাঁ, তুমি মাঝেমধ্যে যেতে পারো না? দূরে হলে যেতে?"

"আচ্ছা যাব যাব। রাগ করিস না। আশরাফের মা ওকে কিছু খেতে দাও।"

শাহিদা বেগম বললেন,"ও কিছু খেতে চাইছে না এখন।"

শাইনা বুঝতে পারলো বাবার চা খেতে ইচ্ছে করছে। তাই সে নিজে গিয়ে গ্যাসের উপর চা বসালো। 

~~

শাওন মোরগের মাংস কেটেকুটে শাহিদা বেগমের হাতে দিয়ে দিল। বলল,"মাংস কেটেছি তার গিলা, কলিজা, লেগপিস সব আমার। লাস্টপিস খাবে দাদী।"

দাদীমা তার দিকে তেড়ে আসতেই শাওন হেসে উঠে দূরে চলে গেল। 

শাইনা সাবানদানি নিয়ে বেরোলো। শাওন ঘাটে নামতে নামতে বলল,

"মাংস কাটার জন্য আর কাউকে পায় না আম্মা। ধুর! মনে হচ্ছে গায়ে রক্ত মেখে হাঁটছি। মণি আমার জন্য গামছা আর লুঙ্গি, গেঞ্জি নিয়ে আয়।"

শাহিদা বেগমের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেল।

"মেয়েটা এসে একটু জিরোতে পারলো না। তুই ওকে কাজ ধরিয়ে দিচ্ছিস? বেয়াদব ছেলে কোথাকার!"

শাইনা খেয়াল করেছে বিয়ের পর মা তার প্রতি খুব যত্নবান হয়েছে। কেন? উত্তর নেই। অনেককিছুর উত্তর সে পায় না।

শাওন মায়ের বকুনি খেয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিতে দিতে বলল,"বউ এনে দাও।"

কথাটা শুনে শাইনা হেসে ফেললো। বাকিরা শুনতে পেল না অবশ্য।

সে জন্য তোয়ালে, গেঞ্জি, লুঙ্গি নিয়ে এল। শাওন ডুব দিচ্ছে একের পর এক। শেষমেশ ডুব মেরে উঠতেই শাইনা বলল,"ভাইয়া তোমার প্রেমিকা এখন কই?"

তার ঠোঁটের মুচকি হাসি ঝুলছে। শাওন ঝাড়ি দিল। 

"ওই শালী একটা ভন্ড! খালি আমার পকেট মারার ধান্ধায় থাকে। ওই ভন্ডকে দিয়ে হবে না। বাপে কিছুদিন পর ধরে বিয়ে দিয়ে দেবে।"

শাইনা বলল,"তুমি না বলেছ ওকেই বিয়ে করবে?"

"আনিচ্ছে বিয়ে করে ফেলতো তাহলে ওকে নিয়ে আসতাম আর কি।"

শাইনা মুখ বাঁকিয়ে বলল,"টাকাপয়সা কামাই না। সে করবে বিয়ে। ঢঙ!"

শাওন গায়ে সাবান মাখতে মাখতে বলল,

"তোর জামাইয়ের মতো যদি টাকা থাকতো। তাহলে বিদেশ থেকে এসেই খপ করে একটাকে ধরে বিয়ে করে ফেলতাম। পুরুষ মানুষের দাম টাকাপয়সায়। বুঝলি? দেখলি না তোকে কিভাবে বিয়ে করে ফেললো সবার কথা অগ্রাহ্য করে। টাকা থাকলে গুন্ডাগিরি হয়ে যায় হিরোগিরি। বুঝলি?"

শাইনা ঠোঁট বাঁকালো। 

"বুঝলাম। তাজদার সিদ্দিকীর গায়ে জ্বিন ভর করেছিল তখন।"

শাওন হো হো করে হাসলো। বলল,"বাপরে বাপ ওই মেয়েটার কথা ভাব! তখন গোটা পাড়া জানতো ওটার সাথেই তাজ ভাইয়ের বিয়ে হবে। কি প্রেম মাইরি!"

শাইনার এসব কথা ভালো লাগছে না শুনতে। কিন্তু  সে আর তাদের বয়সী ছেলেমেয়ে এমনকি ছোটো ভাইয়া, মেঝ ভাইয়ার বয়সী সব ছেলেমেয়েরা জানতো ওই মেয়েটার সাথে তাজদার সিদ্দিকীর প্রেমের সম্পর্ক আছে। 

আকারে ইঙ্গিত আর তাদের ভাবসাব দেখে সবাই একদম নিশ্চিত ছিল ওদের মধ্যে কিছু একটা চলছে। তখন তাদের সমবয়সীদের মধ্যে আলাপ আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল তাজদার সিদ্দিকী আর নাবিহা ইসলাম। 

তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর ছোটো ভাই যিনি আমেরিকায় থাকেন স্বপরিবারে তার বউয়ের বড়ো বোনের মেয়ে। ডাকনাম ছিল নিহা। তাসনুভার সমবয়সী ছিল। বলা চলে তাসনুভার প্রিয় ছিল সে। 

তখন গ্রামে তাসনুভা ছাড়া তেমন স্মার্ট কোনো মেয়ে ছিল না এই পাড়ায়।

মেয়েটি রোজ রোজ নতুন ডিজাইনের পোশাক পরতো যেটা তার সিগনেচার ছিল। সবাই তার পোশাকআশাক নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতো সবসময়। কারণ সে যে পোশাকগুলো পরতো গ্রামে তখন সেইসব পোশাক এখানকার মেয়েরা পরা তো দূর, পরার কথা ভাবতেও পারতো না। মেয়েটি বেশিরভাগ সময় একেক ডিজাইনের স্কার্ট পরতো। 

পাড়ার ছেলেদের একপ্রকার নজর কেড়ে নিয়েছিল মেয়েটি। আকাশ ছোঁয়া মুভিতে যে নায়িকা যে কালো লেহেঙ্গা পরে নাচতো তাকেই সবাই নিহা মনে করতো। 

আর এমন একটা সুন্দরী, শিক্ষিতা, শহুরে বড়লোক বাপের মেয়েকে গ্রামের সবচেয়ে বড়লোক পরিবারের ছেলে তাজদার সিদ্দিকীই ডিজার্ভ করতো বলে সবার ধারণা ছিল। 

কত কানাঘুঁষা হয়েছিল তখন। এমনও রটে গিয়েছিল যে ওরা বিয়েশাদি পর্যন্ত করে ফেলেছে আড়ালে। এমনকি আরও কতকিছু! 

তাজদার সিদ্দিকী আর তার পরিবারকে মানুষ ভয় পেত বলে তখন কেউ মুখফুটে কিছু বলতে পারেনি। 

শাইনার এখন ওইসব নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না যদিও। সেইসব যদি সত্যিও হয়ে থাকে তাহলেও তার কোনো মাথাব্যথা নেই। বয়সটাই খারাপ ছিল তখন। তাছাড়া তাজদার সিদ্দিকীর হাজারটা দোষত্রুটি মেনে নিয়েছে সে। এখন ওসব সামান্য মনে হয় তার কাছে।

শাওন তাকে ভাবনার জগত থেকে ফিরিয়ে আনলো। সে গোসল করে ফেলেছে। গামছাটা রশিতে মেলে দিতে দিতে বলল,"মণি পেয়ারা খাবি?"

"কোথা থেকে?"

"আমি এনেছি কাল। পাহাড়ি পেয়ারা। দাঁড়া।"

সে পেয়ারা কেটে নিয়ে এল। শাইনা শাহিদা বেগমকে ডেকে বলল,"আম্মা একটু লবণ মরিচ দাও তো।"

শাহিদা বেগম প্লেটে করে লবণ মরিচ নিয়ে এল। শাইনা পেয়ারায় মরিচ মেখে খাচ্ছিল তখুনি আনিস এল বাড়ির পেছনের উঠোনে। শাইনাকে দেখলো। বলল,"কি খাচ্ছিস এসব? রোদের মধ্যে আছিস কেন?"

"পেয়ারা ভাইয়া। রোদ ভালো লাগছে।"

আনিস ফোনের দিকে চেয়ে বলল,"তোকে নাকি ফোনে পাচ্ছে না।"

শাইনা হতচকিত হলো। সাথে সাথে প্রশ্ন করলো,"কে?'

" তাজ।"

শাইনা একটু লজ্জিত হলো। আনিস তার দিকে এগিয়ে এসে ফোন বাড়িয়ে দিল।

"আমারটাতে কথা বল আপাতত। কথা বলা শেষে ঘরে রেখে আসিস।"

শাইনা হাত বাড়ানোর আগেই শাওন ফোন কেড়ে নিল। বলল,"ভাইয়ে এই মডেলটা আমাকে দিয়ে দাও। তোমাকে এরচেয়ে একটা ভালো মডেল দেব।"

আনিস তার দিকে তাকালো। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,"তোকে গদা দিয়ে পেটানো দরকার।"

বলেই ভেতরে চলে গেল। 

শাওন দাঁত দেখিয়ে হাসছে। তাজদার সিদ্দিকীর ফোন আবারও এল। শাইনা বলল,"এগুলো খাওয়া শেষ করি। তুমি কথা বলো।"

সে দ্রুত পেয়ারা চিবোতে লাগলো। শাওন ফোন রিসিভ করতেই তাজদার সিদ্দিকী তাকে দেখে হেসে ফেললো। ব্রেকফাস্ট করছে সে। শাওনকে বলল,"ছোটা সম্বন্ধি!"

শাওন বলল,"ভাই এখন নাশতা করছেন নাকি?"

"হুম। আম্মুর সাথে কথা বললাম এইমাত্র। আম্মু বলল শাইনা ওই বাড়িতে। তাই ফোন করলাম।  কেমন আছিস তোরা?"

"আছি আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছ? ওখানে শীত নাকি গরম? একা একা রান্না করে খাও নাকি? অফিসে যেতে কতক্ষণ লাগে? ছুটি ক'দিন?"

এইসেই হাজারটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে। গল্প জমে উঠলো দুজনের। শাইনা আর বিরক্ত করলো না। অনেকক্ষণ পর সে শাওনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তাজদার অন্য কাজ করতে করতে কথা বলছিল তাই শাইনাকে খেয়াল করেনি। 

যখন ক্যামেরার সামনে এল তখুনি শাওনের পেছনে শাইনাকে দেখা যাচ্ছে। গুঁড়ো মরিচে লবণ মিশিয়ে পেয়ারা মেখে খাওয়ায় তার ঠোঁটের পাশে মরিচগুঁড়া লেগে আছে। তাজদার সরু চোখ করে তাকালো। শাওনকে বলল,

"তোর পেছনে গ্রামের চাচাতো বোনটিকে দেখা যাচ্ছে বোধহয়।"

শাওন হেসে উঠে বলল,"হ্যাঁ, গ্রামের চাচাতো বোন এখন আমার পাশের বাসার ভাবি।"

শাইনা ধুম করে তার পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল। শাওন বলল,"কি হাত মাইরি! কি খাস তুই? তাজ ভাই?"

তাজদার সিদ্দিকীর গলা ভেসে এল।

"হুম।"

"তোমার বউয়ের সাথে কথা বলো। আমাকে মেরেছে, নাও বকে দাও।"

শাইনার হাতে ফোন ধরিয়ে দিল সে। শাইনা মুখ মুছতে মুছতে ঘাটে গিয়ে বসলো। তাজদার সিদ্দিকী ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। 

"হাই!"

শাইনা মুচকি হাসলো। 

"সকাল সকাল ফোন দিতে হবে কেন? খেয়েদেয়ে অফিসে যান।"

"তুমি কাল ফোন কেটে দিয়েছিলে কেন? শেষমুহুর্তে কি বলেছিলে আমি শুনতে পাইনি।"

শুরু হয়ে গেছে লজ্জা দেওয়া। শাইনা বলল,"আমিও ভুলে গিয়েছি।"

"না আবারও বলো।"

শাইনার ভালো লাগে তাজদার সিদ্দিকী এমন পাগলামি করলে। এগুলোই তার কাছে পাগলামি। কারণ তাজদার সিদ্দিকীর মতো মানুষের সাথে এসব বেমানান। কয়েক বছর আগেও সে কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তাজদার সিদ্দিকীর মতো মানুষ তার স্বামী হবে। তার সন্তানের বাবা হবে। তাকে এতটা ভালোবাসা দেবে আর তার এত যত্ন নেবে। সে তখন এইসব চায়ওনি। কখনো ভাবনায়ও আসেনি। তাজদার সিদ্দিকীকে সে কখনো কল্পনাও করেনি ওভাবে।

তাই এখন তাজদার সিদ্দিকী এমন উদ্ভট কথাবার্তা বললে আর তার মুখে কিছু শুনতে চাইলে তার ভালো লাগে। বলা চলে তাজদার সিদ্দিকীকে জ্বালাতে তারও ভালো লাগছে আজকাল। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয় একসময় এইসব আর করবেন না তিনি। তখন এখনকার কথা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দেবেন। হয়তো ভাববেন আমি চাইলেই তো এরচেয়ে ভালো বাড়ির, সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে পারতাম। কেন শুধু শুধু এটার পেছনে এত মেহনত করলাম? কেন শুধু শুধু এত নিচু হলাম এইরকম একটা মেয়ের কাছে? 

"বলো কি বলেছ?"

শাইনার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। সে ছোট্ট করে বলল,"না।"

তাজদার সিদ্দিকী অবাক হয়ে গেল।

"কি না?"

শাইনা বলল,"কথা কম বলেন। চলুন আপনাকে সব দেখাই ঘুরেফিরে। বিলে যাই।"

শাইনা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনের বিলের কাছাকাছি চলে গেল। তাকে সেখানে দেখে রওশনআরা চিৎকার করছে।

"এমন সময় তুমি ওখানে কেন? এই অবস্থায় কেউ বিলের ধারে যায়? খারাপ বাতাস লাগলে তখন তাজের জন্য বাড়িতে টিকতে পারব? আশ্চর্য! তোমার মা কোথায়? আশরাফের মা!"

শাইনা দ্রুত চলে এল। উফ! একটু ঘুরলেও সমস্যা। 

~

চলনা সুজন, মিলে দু’জন
নীল ঐ আকাশে ভাসি
দেখুক লোকে এ দু’চোখে
তোর ঐ দু’চোখের হাসি
চলনা সুজন, হারাই দু’জন
বিনা দোষেই হোক ফাসি
দেখুক লোকে অবাক চোখে
কতটা ভালোবাসি।

তিতলি গান গাইতে গাইতে চুল শুকিয়ে নিয়ে আঁচড়াচ্ছে। ঘরের হিটার কাজ করছে না। রিপেয়ার করাতে হবে। তাসনুভা আজ ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকোয়নি। গোসল করার পর তার খুব ঠান্ডা লাগছে। ঘরের মধ্যে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

তাই সে চুল মুছে সোজা উঠোনে নেমে এল। তাদের উঠোনে রোদ পড়ে সকাল দশটার দিকে। এখন রোদ সরে চলে গিয়েছে শাইনার মেঝ চাচাদের উঠোনে।

তাসনুভার ইচ্ছে করছে একটু রোদ গায়ে মাখতে। এই সময় ছাদে উঠলে আম্মু বকবে। চুল খুলে দাঁড়ালে আরও বেশি বকবে তাই সে শাইনার মেঝ চাচাদের উঠোনের এককোণায় এসে দাঁড়ালো। ভেজা চুলগুলো খুলে রাখা। টুপটুপ করে পানি পড়ছে মাটিতে। সে হাতে তখনো সানস্ক্রিন মাখছে। পরনে সেলোয়ার-কামিজ। দুবাই সিল্কের ফ্লোরাল ডিজাইনের উপর। এই ফ্যাব্রিকটা তার কাছে ভীষণ আরামদায়ক এবং ক্লাসি লাগে।

হঠাৎই কি যেন হলো! সে শিউরে উঠলো।

পিঠের উপর গরম পানি পড়লো মনে হলো। চট করে পেছনে ফিরে তাকালো। কেউ নেই। সাথে সাথে উপরে শাইনাদের বাড়ির দোতলার বারান্দার তাকালো। কালো শার্ট পরা একজন চরম অভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।

আনিস ভাই আপনি!

আনিসের গলাব্যাথা। তাই সে বড়ো একটা মগে করে গরম পানি নিয়ে অল্প অল্প করে খাচ্ছিল। শীতকালে গরম পানি না খেলে তার গলাব্যাথা বাড়ে।

কিন্তু পানি বেশি হওয়ায় সে আর খেতে পারছিল না তাই ছুঁড়ে মেরেছিল মেঝ চাচাদের উঠোনের কোণায়। যেখানে মানুষ থাকার কথা নয়। তাসনুভা থাকার কথা তো প্রশ্নেই উঠে না। কিন্তু এটা কি হয়ে গেল? এখন মেয়েটা তো গোটা বাড়ির মানুষকে এক জায়গায় করবে। সে নিজ কর্মদোষে হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মগটা হাতে নিয়ে।

তাসনুভা তাকে কোনো কথা বলতেই দিচ্ছে না। তার চেঁচামেচি শুনে সবাই একসাথে বেরিয়ে এল। শাইনার আপা দুলাভাই, ভাবি ভাই সবাই। এমনকি শাহিদা বেগম আর আফসার সাহেবও। শাইনার চাচী আর অন্যান্য পাড়াপ্রতিবেশিরাও। শাহিদা বেগম তোয়ালে নিয়ে ছুটে এসে তাসনুভার পিঠ চুল মুছে দিতে দিতে বলল,”ও দেখেনি মা। তোমার দিকে কেন ও পানি ছুঁড়বে? রাগ করো না। চলো ঘরে চলো।”

“না আপনার সাথে কোনো কথা নেই।”
সে তখন থেকেই আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে একটা কথা বলে যাচ্ছে।

“আপনি নিচে আসেন আনিস ভাই।”

আনিস শান্ত ভাবে বলল,”ঘরে যাও। কাপড়টা পাল্টে নাও। জুমাবার। সিনক্রিয়েট করো না। তৌসিফ ওকে নিয়ে যা।”

তৌসিফ এতক্ষণ কোমরে হাত রেখে তাসনুভাকে দেখে যাচ্ছিল। এবার ইটের গাঁথুনির উপর বসে পড়লো। বলল,

“আরও চিল্লা। কুত্তাগুলো না আসা পর্যন্ত চিল্লা।”

তাসনুভার নাকমুখ লাল হয়ে গেছে রাগে। আনিস ভাই এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে। সে আঙুল উঁচিয়ে বলল,”আপনি নিচে নামুন। আপনাকে লাগবে।”

শাইনার দুলাভাইরা হাসছে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আনিসকে বলছে,”আপনাকেই লাগবে।”

আনিস আরও শান্ত কণ্ঠে একটু বিরক্তি মিশিয়ে বলল,”আমি নামবো না।”

তাসনুভা আরও রেগে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল,”আপনি কিভাবে না নামেন আমি দেখবো।”

আনিস মাথা নেড়ে বলল,”নামব না। দাঁড়িয়ে থাকো ওখানে।”

ততক্ষণে রওশনআরা আর তাজউদ্দীন সিদ্দিকীও বাইরে চলে এসেছে। এসেই দেখলো তৌসিফ বসে বসে তাসনুভাকে ভিডিও করছে। আর তিতলি তার পেছনে বসে বসে কপাল কুঁচকে মনোযোগ সহকারে ভিডিও ক্যাপচার দেখে যাচ্ছে।

শাহিদা বেগম, সাবরিনা, আশরাফ, আফসার সাহেব, দাদীমা কারো কথা কানে না তুলে তাসনুভা তখনো একটা কথাই বলে যাচ্ছে,

“আপনি নিচে আসুন আনিস ভাই। আমি আপনার সাথেই কথা বলবো। আমার আপনাকেই লাগবে। নিচে আসুন।”

আজ সালিশ বিচার না করে সে এখান থেকে নড়বে না।

চলমান…

তাজমহল #দ্বিতীয়_খন্ড

পর্ব_১৮

প্রিমাফারনাজচৌধুরী

“আপনি নামবেন না তাই তো? সরি বলুন নয়তো তাড়াতাড়ি নামুন। কোনোটাই না করলে আমিই উপরে উঠে যাব।”

শাহিদা বেগম আনিসকে বললেন,”কি বলতে বলছে বলে দে নারে আনিস। জুমাবারে তোর এসব করতে ভালো লাগছে?”

তাসনুভা রাগে লাল হয়ে উঠেছে। আনিস বলল,”ওটা কি যেমন তেমন কথা আম্মা? দোষ করিনি সরি বলবো কেন? এক্সিডেন্টলি এরকম অনেক ব্যাপার স্যাপার ঘটে। সরি বলতাম। যদি সিনক্রিয়েট না করতো। ও যা করেছে তাতে সরি বলা জায়গাটুকু রাখেনি।”

তাসনুভা একদৃষ্টিতে তার দিকে ক্ষোভসমেত চেয়ে রয়েছে। শাহিদা বেগম তাসনুভার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”আচ্ছা মা। আর রাগ করো না। ও দেখেনি।”

তাসনুভা বলল,”একশোবার দেখেছে। উনি ইচ্ছে করেই আমাকে ভিজিয়ে দিয়েছেন। আমাকে সরি না বললে এখান থেকে একপাও নড়বো না আমি। আপনি নামবেন নাকি আমি উপরে যাব আনিস ভাই?”

আনিস হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,”আচ্ছা তুমি উপরে আসো। আম্মা তুমিও চলে আসো।”

বলেই সে ভেতরে চলে গেল। তাসনুভা বলল,”আচ্ছা বেশ। আপনি ঘর থেকে বের হইয়েন। আপনাকে দেখে নেব আমি। কতক্ষণ ঘরের মধ্যে বসে থাকবেন। দেখে নেব।”

বলেই হনহনিয়ে সে তাদের বাড়ির দিকে চলে যেতে লাগলো। তৌসিফ পথ আটকে তার সামনে মাইক্রোফোন ধরার ভঙ্গি করে বলল,

“ম্যাডাম আপনি এভাবে হার মেনে নিয়েছেন? খেলা তো জমে উঠেছিল। আরেকটু খেলতে পারতেন। আনিস ভাইকে না নামানো অব্দি আপনি আন্দোলন করতে পারতেন। সিদ্দিক বাড়ির রাস্তা অবরোধ করতে পারতেন। এভাবে হাল ছেড়ে দিলেন?”

তৌসিফ প্রশ্ন করছে আর তিতলি তা ভিডিও করছে। আশেপাশের সবাই তাদের দুষ্টুমিতে হাসছে। তাসনুভা আবারও শাইনাদের বাড়ির দোতলার বারান্দায় তাকাতেই দেখলো আনিস এসে দাঁড়িয়েছে আবারও। তৌসিফের কথা শুনে কেমন করে যেন হাসছেও যা সহজেই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু তাসনুভা স্পষ্ট বুঝতে পারছে উনি হাসছেন। তাসনুভা রাগে লাল হয়ে এবার বিকট শব্দে গর্জে উঠলো,

“ভাইয়া! তিতলি!”

তিতলিকে বগলদাবা করে তৌসিফ ছুটলো এমনকি আশেপাশের পাড়াপড়শিরাও। তাজউদ্দীন সিদ্দিকী বললেন,”এত মাথা গরম করলে চলে না মা। ও তো বলছে দেখেনি।”

তাসনুভা বাবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো। রওশনআরা বলল,”একটাকে কোনোমতে লন্ডনে পাঠিয়েছি। আরেকটা আছে বাড়ি মাথায় তোলার জন্য। নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরতে হবে সারাক্ষণ।”

তাসনুভা ঘরে চলে যেতে যেতে জোহরা বেগমকে বলল,”ভাইয়ে কোথায়? আমি ওকে আর তিতলিকে কিছুতেই ছাড়ব না।”

জোহরা বেগম অবাক কণ্ঠে বললেন,”ও আবার কি করেছে?”

তাসনুভা থামলো। জোহরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,”ভিডিও করছিল আমাকে। আমি হাতের কাছে পেলে মেরেই ফেলবো।”

“কেমন অলক্ষুণে কথা নুভা!”

“একশোবার বলবো। তিতলি? কোথায় তুমি? বেরিয়ে আসো। তোমাকে একটা চড় মারবো।”

ঝিমলি হাসতে হাসতে বলল,”আনিস ভাই কাজটা ঠিক করেনি আমার ননদিনীকে রাগিয়ে দিয়ে। এর মাশুল দিতেই হবে।”

তাসনুভা ঘরের দরজা বন্ধ করলো শব্দ করে। বলল,”উনাকে আমি ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে না মারলে আমার নাম তাসনুভা সিদ্দিকী নয়।”

ঝিমলি হাসছে। জোহরা বেগম তৌসিফকে ডাকতে লাগলেন।

“তৌসিফ? নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। কোথায় তুই?”

তিনি তৌসিফকে ডাকতে ডাকতে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

আনিস নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিল। শাইনা তার ঘরে এসে ফিরনির বাটিটা টেবিলের উপর রাখলো। জুমার নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় বাড়ির ছেলেরা মিষ্টি জাতীয় কিছু মুখে দেয়। আনিস গায়ে খুশবু মেখে শাইনার দিকে তাকালো।

"কিছু বলবি?"

"আম্মা ফিরনির বাটিটা নর্মালে রেখেছে। ঠান্ডা হয়ে আছে। এখান থেকে শুধু দু-চামচ খেতে বলেছে। তোমার গলা ব্যাথা বাড়বে।"

ফিরনির বাটিটা হাতে তুলে নিয়ে আনিস গুণে গুণে শুধু দুচামচ খেল। তারপর শাইনার দিকে চেয়ে বলল,"আর দু-চামচ খাচ্ছি।"

শাইনা হেসে ফেললো। 

"শুধু দু-চামচ। আম্মা আমাকে বকবে।"

আনিস আর দু-'চামচ খেল। ফিরনিটা ঠান্ডা হওয়ায় বেশি মজা লাগছে। তারপর বাটিটা শাইনার হাতে দিয়ে কলার ঠিক করতে করতে বলল,

"উঠোনে তোর ননদ আছে কিনা দেখতো।"

শাইনা তার কথা শুনে হেসে ফেললো। 

"কিছু করবে না।"

"পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। পাঞ্জাবি ভিজে গেলে নামাজে যেতে পারব না। দেখ একটু।"

শাইনা বারান্দায় গেল। তাসনুভা ড্রেস পাল্টে আবারও রোদে এসে দাঁড়িয়েছে বুকে হাত ভাঁজ করে। মাথায় কাপড় তোলা। এলাকার সব মসজিদগুলোতে খুতবা পাঠ হচ্ছে। 

শাইনা আবারও ঘরে এল। আনিসকে বলল,

"ভাইয়া এমনি রোদে দাঁড়িয়েছে। কিছু করবে না। তুমি দুলাভাইয়ের সাথে যাও। নামাজে যাচ্ছ ওটা জানে। পানি ছুঁড়বে না।"

আনিস পকেটে পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বের হলো। বলল,"মেয়েটার মাথা খারাপ। বিশ্বাস নেই। জামিল ভাই?"

শাইনার দুলাভাই সাড়া দিল। 

"হ্যাঁ, যাচ্ছি। আপনি নামেন। আপনাকে দরকার।"

বলতে বলতে তারা শব্দ করে হেসে উঠলো একসাথে। আশরাফ আর আফসার সাহেবও তাদের সাথে ছিল। আনিস তাই তাদের পেছনে যেতে যেতে আর কিছু বললো না। তাসনুভা সরে দাঁড়িয়েছে ওই বাড়ি থেকে সবাইকে বের হতে দেখে। 

আনিস সবার পেছন পেছন চলে গেল। তাসনুভা সেদিকে ফিরেও তাকালো না। তৌসিফ তাদের পেছন পেছন বের হলো রায়হান, তাজউদ্দীন আর তৈয়বউদ্দীন সিদ্দিকীর সাথে। তাসনুভাকে দেখামাত্রই তাজউদ্দীন সিদ্দিকী বলল,

"এত রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা ঘোরাবে আম্মু।"

"আমার মাথা এত সহজে ঘোরায় না।"

তাজউদ্দীন সিদ্দিকী হেসে ফেললেন। 

"এখনো দেখছি রেগে আছে মেয়েটা।"

তাসনুভা তৌসিফকে বলল,"তোমার বিচার পরে হবে।"

তৌসিফ হেসে ফেলে বলল,"আমার সাথে ঝগড়া করতে এলে আমি ভিডিওটা মেঝ ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেব।"

তাসনুভা ঝাঁজালো কণ্ঠে বলল,"আমি তোমাকে..

তৌসিফ তাকে পুরোটা বলতে না দিয়ে বলল,"মসজিদ থেকে তওবা করে ফিরি। তারপর মারিস।"

তাসনুভার রাগ কমেনি। প্রতিশোধ সে নেবেই। কিন্তু এমনভাবে নেবে যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। তার গায়ে গরম পানি ছোঁড়ার স্পর্ধা উনি দেখায় কি করে? আনিস মসজিদ থেকে আসার সময়ও উঠোনে পা রেখেছিল আতঙ্কের সাথে। মেয়েটা কোন সময় পানি নিয়ে অ্যাটাক করে বসে কে জানে। এইরকম মেয়ে সে জীবনে দেখেনি। গোটা বাড়ির মানুষ একজায়গায় করে ফেলেছে চেঁচামেচি করে। 

তৌসিফ তাসনুভার চেঁচামেচির ভিডিওটা তাজদারকে দিয়েছে। তাজদার রিপ্লাই করেছে,"কেস তো সিরিয়াস।"

তৌসিফ বলল,"আনিস ভাইকে পুরা বেইজ্জতি করে ছেড়েছে। তোমাকে বলছি এই মেয়েকে বিয়ের ভয় দেখাও। ওর এখন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বরের সাথে ঝগড়া করার বয়স। করছে পাশের বাসার চাচাতো ভাইয়ের সাথে। এগুলো মানা যায় না।"

তাজদার মেসেজ সিন করলো। কিছুক্ষণ পর রিপ্লাই করলো,"ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে। যাইহোক তিতলি আর শাইনার ইনকোর্স পরীক্ষা কাল। দুজনকেই গাড়িতে করে নিয়ে যাবি। তুইও যাবি নয়তো শাওনকে যেতে বলবি। একা পাঠাবি না। আর খাবার কিনে নিবি যাওয়ার পথে। 

"ওকে।"

পরদিন শাইনার ইনকোর্স পরীক্ষা ছিল। তিতলির সাবজেক্ট একাউন্টিং, শাইনার ম্যানেজমেন্ট। শাইনার প্রস্তুতি যতটা খারাপ। তিতলির প্রস্তুতি তারচেয়েও বেশি। তবুও পরীক্ষা দিতে যেতে হবে। প্রস্তুতি ছাড়া পরীক্ষা দিতে যায় নির্লজ্জরা। তিতলিও নির্লজ্জ। 

শাইনার উপর দিয়ে রীতিমতো ঝড় গেল। সে মনে মনে সেইসব মেয়েদের প্রশংসা করছিল পরীক্ষার হলে বসে বসে যাদের সংসারের সমস্ত কাজ করে, তারপর পরীক্ষা দিতে আসতে হয়। পরীক্ষার পর তার শরীর এতটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল সে আশেপাশের কিছু খেয়ালও করেনি। গাড়িতে এসে প্রায় অজ্ঞানের মতো মাথা এলিয়ে দিয়ে বসেছিল। তিতলি জোর করলো কিছু খেতে কিন্তু সে খেল না। বাড়ি এসে গোসল করে সোজা বিছানায়। আর কোনোদিকে তাকানোর জোঁ নেই। তার দুই বোন তাকে দেখতে এসেছিল। 

সবার সাথে তাদের আলাপ জমে উঠেছিল তখনো শাইনা ঘুমিয়ে। কেউ তাকে ডাকেনি। যখন ঘুম ভাঙলো তখন  এতটা ক্লান্ত লাগছিল যে তার ইচ্ছে করছিল বসে বসে কাঁদতে। চোখে জল চলে এসেছিল। কিন্তু কেউ দেখার আগেই মুছে নিয়েছিল। মনে মনে পণ করলো সে আর জীবনেও বাচ্চা নেবে না। জীবনেও না।

সাড়ে সাতটা নাগাদ তাজদার ফোন করেছে। বাড়ির সবার সাথে কথা বলে যখন ফোনটা শাইনার কাছে গেল তখন সে কথা বলতে চাইছে না। তিতলিকে বলল,"রাতে বলবো। এখন না। বলো দশটার দিকে আমি ফোন দেব।"

তিতলি বলল,"ভাইয়া বলছে কথা বলতে হবে না। নাও। বেশি খারাপ লাগছে তোমার?"

"না, না। আমি পরে কথা বলবো। ফোন রেখে দাও।"

তিতলি ফোন রেখে দিল। শাইনা হালকা নাশতা খেয়ে আরেকটু ঘুমিয়ে নিল। আড্ডায় বসলো না। যখন ঘুম ভাঙলো তখন রাত দশটা। রওশনআরা এসে বললেন,"ভাত খাবে না?"

শাইনা দুপাশে মাথা নাড়লো।

"দুটো করে খাও। একেবারে না খেলে কিভাবে হবে?"

তিনি জোরাজোরি করলেন। শাইনার লজ্জা লাগছে। কিন্তু তবুও সে মানা করে দিল। তিতলি বাসন নিয়ে তার ঘরে চলে এল তন্মধ্যে। হাসিমুখে বলল,"শাইনা শাইনা আমি ফিশ ফ্রাই করেছি। তেলাপিয়া মাছের। দেখো দেখো কত্তবড়। ভাত খেতে হবে না বস। এই মাছটা খাও। খুব মজা হয়েছে। ভাইয়ে চেটেপুটে খেয়ে আবার আমারটাতে ভাগ বসিয়ে দিয়েছে। ওর দুটো মাইর বাকি আছে। নাও।"

রওশনআরা বলল,"এসবে পেট ভরে? আজব!"

তিনি বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। তিতলি প্লেটটা শাইনার সামনে ধরলো। সালাদ আর মাছটা প্লেট ভর্তি করে ফেলেছে। পাশে তিন রকমের সসও আছে। শাইনা কাটা চামচ দিয়ে মাছ তুলে নিয়ে মুখে পুরলো। ঝাল ঝাল ফিশফ্রাই। জিভে লাগছে বেশ। শাইনা খুব তৃপ্তি নিয়ে খেতে খেতে তিতলির দিকে তাকালো। তিতলি হাসলো। 

"মজা?"

"খুব। কিভাবে করেছ।"

"হি হি ভাইয়ার বুদ্ধি।"

শাইনা অবাক হয়ে বলল,"কিভাবে?"

তিতলি সবটা খুলে বললো। 

"ভাইয়া বলেছে তোমার মুড ভালো হয় পছন্দের কিছু খাবার-দাবার খেলে। তারপর বলল ফ্রিজে মাছ থাকলে ঝাল ঝাল করে ফ্রাই করে দাও। কাল ভাইয়ে বাজার থেকে টাটকা মাছ এনেছিল। ব্যস!"

"থ্যাংকস তোমাকে দেব নাকি তোমার ভাইয়াকে?"

"তোমার বাচ্চার বাপকে। আমি যাই। ভাইয়েকে দুটো গদাম গদাম মেরে আসি। রাক্ষসটা আমার মাছের একটা পিঠ সাবাড় করে দিয়েছে। ভাইয়ে বের হও। পঞ্চাশ টাকা ছাড়ো। নইলে তোমার বিয়ে হবে না গাধা।"

চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে গেল তিতলি।

খাওয়াদাওয়ার পর শাইনার মনমেজাজ সত্যি সত্যি ভালো হয়ে গিয়েছে। তাজদার সিদ্দিকীকে ফোন করতে গিয়ে তার ভয়ও হলো। আবার রেগে বোম হয়ে আছে নাকি?

সে ফোন দেওয়ামাত্রই তাজদার সিদ্দিকী রিসিভ করলো। শাইনা স্ট্যান্ডে ফোনটা রেখে পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লো। তাজদার সিদ্দিকী তাকালো ক্যামেরার দিকে ভালো করে। শাইনাও চেয়ে আছে। কোনো কথা বললো না সে তাজদার সিদ্দিকীর মেজাজ বোঝার জন্য।

তাজদার তার সাড়াশব্দ না পেয়ে কিছুক্ষণ পর বলল,”হাই!”

শাইনা বিড়বিড়িয়ে বলল মেজাজ তো দেখছি ফুরফুরে। তাকে বিড়বিড় করতে দেখে তাজদার আরও ভালো করে ক্যামেরার দিকে চেয়ে বলল,

“গালি দিচ্ছ?”

শাইনা হালকা হাসলো।

“আপনি আমার মুখে কখনো গালি শুনেছেন?”

“শুনিনি। তবে মেসেজে দিয়েছিলে বিয়ের শুরুতে।”

এই এক কথা বলে তাকে হাজারবার লজ্জা দিয়েছে তাজদার সিদ্দিকী। তবুও একই কথা বলে যায়। শাইনা এবার চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল,”থ্যাংকস!”

তাজদারের ভ্রু কুঁচকে গেল।

“কেন?”

সে আইরন টেবিলে কাপড়চোপড় আইরন করাচ্ছে। তারমধ্যেই কথাবার্তা বলছে। শাইনা বলল,”তিতলির কাছ থেকে জেনে নেবেন।”

তাজদার গম্ভীরমুখে বলল,”বুঝেছি। কিন্তু তোমার একটা স্বভাব ভীষণ খারাপ। তোমার টেস্ট চেঞ্জ হয়েছে। তোমার উচিত কোনটা খেতে ইচ্ছে করছে সেটা নিজে বানিয়ে খাওয়া নয়তো অন্য কাউকে বলা। একেবারে না খেয়ে থাকাটা কেমন?”

“কাউকে কাজ করতে বলতে লজ্জা লাগে আমার। আমি নিজের কাজ নিজেই করতে পারছি না এখন। আপনি থাকলে অবশ্য আপনাকে বলতাম।”

কথাটা বলেই সে হালকা হাসলো।

“তুমি মেয়ে ভালো নও।”

শাইনা অকপটে বলল,

“সেজন্যই আপনাকে বিয়ে করেছি।”

তাজদার সিদ্দিকী গোমড়ামুখে বলল,”মানে?”

“কিছু না।”

তাজদার সিদ্দিকী আঙুল তুললো,

“এই মেয়ে তুমি কিছু একটা বলতে চেয়েছ।”

শাইনা বলল,”মানে ভালো হলে আপনাকে বিয়ে করতাম না এটাই।”

তাজদার সিদ্দিকী ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”ভালো বলেছ। তাজদার সিদ্দিকী তার মতোই কাউকে ডিজার্ভ করতো। পেয়েছেও।”

শাইনা জিভ দেখিয়ে বলল,”ভ্যাঁ ভ্যাঁ।”

তাজদার সশব্দে হেসে ফেললো। বলল,

“তোমার খুশি হওয়ার কথা আমার মতো বর পেয়ে। তোমার মা বাবা টাকলা, ভুঁড়িওয়ালা চাচাদের ধরিয়ে দিত। তুমিও নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিতে।”

শাইনা বলল,”মোটেও না।”

“কথায় পারছো না। বিয়ের আজ কত মাস হয়ে গেল। তোমার এখনো মনে হচ্ছে না আমাকে পেয়ে তুমি ধন্য। ভীষণ ভালো।”

“আমি ধন্য সেটা আমার চেহারায় বোঝা যাচ্ছে। আপনারা চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বউ বাচ্চা হারিয়ে পথে বসেছেন। শরীর খারাপ নাকি?”

তাজদার সিদ্দিকী এবার ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়ালো। অবাককণ্ঠে বলল,”এতদিন ধন্য হইনি। আজ ধন্য হলাম। তুমি আমার চেহারা দেখে অন্তত বুঝেছ আমি সিক।”

শাইনা কপাল কুঁচকে বলল,”মেডিসিন নেননি?”

“নিয়েছি। কিন্তু বউয়ের সেবাশুশ্রূষা না পেয়েই এই রোগ হয়েছে। শত মেডিসিন নিলেও কাজ হবে না।”

শাইনা অতকিছু না ভেবেই বলল,”মেডিসিন নিন। তারপরও না কমলে দেশে চলে আসেন।”

তাজদার সিদ্দিকীর চোয়াল ঝুলে পড়ার মতো অবস্থা। শাইনা মমতাজ বলছে এই কথা?
সে বলল,”বিয়ের এই এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথাগুলো তুমি আজ বলেছ। দারুণ উন্নতি হয়েছে। সাবাশ সাবাশ।’

শাইনা খোঁচা মেরে বলল,”বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বাচ্চার বাবা হয়ে যাচ্ছেন। সাবাশ সাবাশ ঠু।”

তাজদার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,”তোমার গর্ব করা উচিত আমাকে নিয়ে।”

শাইনা তাকে ব্যঙ্গ করে বলল,”গর্ব করতে গিয়েই তো আমি আজ গর্ভবতী।”

তাজদার সিদ্দিকী হো হো করে হাসলো। বলল,

“লোকজন শুনলে বলবে আমাকে ভূতে ধরেছে।”

“ধরেছেই তো।”

“অবশ্যই ধরেছে। ভূতের নাম শাইনা মমতাজ।”

প্রায় দুই সপ্তাহ কেটেছে শাইনার এই অসুস্থতা দিয়ে। তারপর এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ তার লেবার পেইন উঠলো। যখন সে অপেক্ষায় ছিল তাজদার সিদ্দিকীর ফোনের।

তাজদার যখন ফোন করলো তখন তার ফোনটা ঘরের এককোণায় বাজছে। শাইনার দিকে সবার মনোযোগ এমনভাবে চলে গিয়েছিল যে ফোনের দিকে তাকালো না কেউ। এমনকি শাইনারও সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। দুপুরেও মেসেজে সে তাজদারের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করছিল যা সে আগে কখনো করেনি।

আনিস অফিস থেকে এসে আরাম করছিল নিজের ঘরে। তন্মধ্যেই তাসনুভার চেঁচামেচি কানে এল,”আনিস ভাই দ্রুত আসেন। ভাইয়ারা কেউ বাড়ি নেই। শাইনার শরীর খারাপ লাগছে। ভেজার জন্যও প্রস্তুতি নিয়ে আসেন। সুখবর শোনার পর আপনার মাথায় এক বালতি ঠান্ডা পানি ঢালবো আমি।”

আনিস তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে এল।

চলমান….

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply