#ডেনিম_জ্যাকেট— পর্ব ২৬
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
শামিমা কাব্যের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। কাব্যও চুপচাপ মায়ের কোলে মাথা রেখে বসে আছে মেঝেতে। ওর দৃষ্টি শান্ত; এক দৃষ্টিতে মাটিতে পরে থাকা ফ্যামিলি ফটোটার দিকে চেয়ে আছে তখন থেকে।
হঠাৎ শামিমা কাব্যের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে বসলেন———‘মেয়েটা কে কাব্য?’
কাব্য অবাক হয়ে গেল;আচমকা মাথা তুলে তাকালো শামিমার দিকে। শামিমা ভীষণ স্বাভাবিক গলায় বললেন——-‘কাকে ভালোবাসিস? কে ওই লাকি মেয়েটা, যে আমার কাব্যকে এতটা পাগল করে ছেড়েছে? কে, মেয়েটার নাম বল আম্মুকে।’
কাব্য মায়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, ওর চোখে-মুখে হতবিহ্বল ভাবটুকু শামিমা দেখলেন স্রেফ।
উনার বড় ছেলে কাব্য সবসময়েই চাপা স্বভাবের ছিলো। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলতে গেলে পায়ের চামড়া উঠে ফেটে যেত পা; কখনোই ওই ছোট কাব্য শামিমার কাছে কেঁদে আসেনি সেটার জন্যে। বরং রুমে চুপচাপ বসে নিজে নিজে ড্রেসিং করেছে। বাড়ির কেউ দেখতে পেলে গম্ভীর কণ্ঠে স্রেফ বলতো———‘অল্প ব্যথা; ঠিক হয়ে যাবে।’
অথচ শামিমা জানতেন— ব্যাথাটা অল্প কখনোই থাকেনা। বরং কাব্যের পায়ে এভাবে দৈনন্দিন ব্যথা পেতে পেতে ইনফেকশন হয়ে চামড়া পচে গিয়েছিল। পরবর্তীতে কাব্যের ডান পায়ে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে হয়েছিল। তারপর থেকে আনোয়ার; অর্থাৎ কাব্যের বাবা ওর ফুটবলের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জুড়ে দিলেন। কাব্য অবশ্য জেদি ছোট থেকেই, বাড়ির সমস্ত তালাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেয়াল টপকে ঠিক বিকেলে ফুটবল খেলতে বেরিয়ে যেত।
কাব্য চুপচাপ শামিমার দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠলো——-‘আম…আমার এই অস্থিরতা; এই পাগলামো তোমার কাছে লাভ মনে হচ্ছে আম্মু? আর ইউ সিরিয়াস?’
শামিমা এ যাত্রায় কেমন গম্ভীর হলেন; কাব্যের গালে হাত রেখে দারুণ মমতা নিয়ে শোনালেন———‘ঝগড়া হয়েছে ওর সাথে? হু? মেয়েটা আমার কাব্যকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে বুঝি? কে ওই মেয়ে? নাম কি? আমি কি তাকে চিনি?’
কাব্য আহাম্মক ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। এটা কি হচ্ছে? শামিমা বলছেন কাব্যের এই অস্থিরতা-টার নাম ভালোবাসা; যেমন করে ওই হাদারাম তানিম কাব্যের কানের কাছে জিকিরের মতো বলে যাচ্ছে। এদের দুজনের আসলেও হচ্ছেটা কি?
কাব্য মায়ের থেকে সরে গেল। শামিমার হাত কাব্যের গাল থেকে তখন নেমে গেল, শামিমা তাকিয়ে রইলেন কাব্যের মুখের দিকে। কাব্য সামান্য মুখটা পিছিয়ে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে নার্ভাস কণ্ঠে বললো——‘আ. . .আম নট ইন ল. . লাভ আম্মু। তোমাদের কেন এটা মনে হচ্ছে?’
শামিমা অবাক হলেন যেন, পরপর সামান্য হেসে কাব্যের চুলে হাত রেখে কাব্যের মুখের দিকে ঝুঁকে এসে ছোট মিছে রাগ দেখিয়ে বললেন ————‘সত্যি তো? তারপর আমার কাছে কখনো কারোর নাম উচ্চারণ করে যেন না বলিস- তুই একে বিয়ে করতে চাস। আমি সাহায্য করবো না কোনপ্রকার! আগেই বলে দিলাম।’
কাব্য মায়ের চোখের দিকে তাকাল; শামিমা চুপ করে কাব্যের রিঅ্যাকশন দেখেন শুধু। কাব্য শামিমার মুখ দেখে মুখভঙ্গি গম্ভীর করে ফেললো তাৎক্ষণিক; তারপর কাঠকাঠ গলায় জবাব দিল———‘ইয়াহ; কোনো মেয়ে নেই আমার জীবনে। বেশি বুঝে ফেলেছো তুমি আম্মু।’
শামিমা ভ্রু কুচকে ফেললেন এবার। কাব্যের দিকে চেয়ে রইলেন সন্দেহ নিয়ে। কাব্য খানিক পর কুহুর সাথে থাকা ফটোর দিকে চেয়ে রইলো। হঠাৎ আনমনে বিড়বিড় করে অস্ফুটে বলে বসলো—-——‘সব শেষ আম্মু, আর কিচ্ছু হবার নেই। আই অ্যাম এলোন; ফ্রম নাউ আই অ্যাম অল এলোন লাইক এ ড্যাম ব্ল্যাক হোল!’
শামিমা কাব্যের চোখের ইশারা লক্ষ করে নিজে কেমন করে যেন মেঝেতে ভেঙ্গে পরে থাকা ফোটোটার দিকে তাকালেন। কাব্য ওই ছবিতে কি দেখছে এত? শামিমার সন্দেহ শুরু হলো ঠিক তখন থেকেই।
___________________________
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি; ১২:৩০ দুপুর।
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে নবীনদেরকে নিয়ে ট্যুরে যাওয়া হবে আগামী পরশু। এবং তাদেরকে গাইড করবে সিনিয়রদের পক্ষ থেকে সাতজনের একটা টিম। যে ভলান্টিয়ার হতে চায় সে যেন নিজের নাম এন্ট্রি করে আজকের মধ্যেই।
সিয়াম তো কথাটা শুনে দেরি করে না আর একমুহূর্ত, দ্রুত নাম দিল ভলান্টিয়ারের খাতাতে। কুহুর সাথে এই প্রথম ট্যুর,এই সুযোগ ও মিস করতে চায় না একদমই। সিয়াম ভীষণ আশাবাদী ওদের সম্পর্কটা নিয়ে।
সিয়ামের ধারণা- কুহু ভীষণ ঘরুয়া মেয়ে। সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকতে জানে। একসাথে সবাইকে নিয়ে হাসতে জানে। আপাতত ঊর্মির থেকে জেনেছে—- কুহু এখন গম্ভীর; চুপচাপ হয়ে গেছে একমাত্র কাব্যের জন্যেই। সিয়াম চায়—- কুহুকে আবার আগের মতো করে ফেলতে। নাহলে কুহুর কথা সিয়াম বাড়িতে বলতে পারবে না।
সিয়ামদের বনেদি বাড়ি; যৌথ পরিবার। এখনো আগের যুগের চাল-চলন ওদের পরিবারে রয়ে গেছে। সেজন্যে সম্ভবত সিয়ামের মায়ের এ বাড়ির বউদের নিয়ে অনেক খুতখুতে। বড় ভাইয়ের বউ এনেছেন প্রায় দেড় বছর খুঁজেখুঁজে। সুন্দরী; হাসিখুশি, ধার্মিক আর মিলেমিশে থাকতে জানা এক মেয়ে বিয়ে করিয়ে এনেছেন বটে— এখন চারিদিকে শুধু বড় বৌর জয়গান চলে ওদের বাড়িতে। তাই সিয়ামের মায়ের ইচ্ছে—- বড় বউয়ের সাথে টক্কর দিতে জানে এমন ছোট বউ দরকার এ বাড়িতে।
এটাই তো সমস্যা আসলে। কুহু এমন নয়। ও বরাবর স্বাধীনচেতা, বাবা-মায়ের লাডলি। ঊর্মি অবশ্য বলেছে—- বিয়ের পর সব মেয়েই বদলে যায়। তখন এসব বাবা বাড়ির আদর ভুলে স্বামীর বাড়িকেই আপন করে ফেলে— এটা তেমন কোনো সমস্যা না। তাই এবার হয়তো সিয়াম একটুখানি আশ্বস্ত হতে পেরেছে।
ওদিকে কুহু এসব ট্যুরে যেতে চায়নি একদমই। ওর এসব ঘোরাঘুরি, হই-হল্লোর এখন আর ভালো লাগে না। একা একটা রুম, সারাক্ষণ অন্ধকার করে চুপচাপ বসে থাকা কুহুর কাছে এখন বাইরের উজ্জ্বল দুনিয়া ভীষণ পাঁনসে। মানুষের শোরগোলে মাথাটা ধরে যায় এখন ওর।
কুহু এখনো খাতায় নাম এন্ট্রি করেনি; সেটা দেখার পর সিয়াম বারবার কল করে যাচ্ছে কুহুকে। বিছানার উপর পড়ে থাকা কুহুর ফোনে বিরক্তিকর ভাইব্রেশন হয়েই যাচ্ছে, বিছানাটা কাঁপছে ভাইব্রেশনের গুনগুন আওয়াজে। কুহুর মাথা ধরে যাচ্ছে ওই ফোনের আওয়াজে; মন চাইছে সিয়ামকে ফোনের ভেতরে গিয়ে একটা ঘুষি বসাতে। অসভ্য ছেলে— সারাক্ষণ ওর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা। কেন যেন নিজের মাথায় এই সিয়াম নামম বোঝা নিজেই চাপিয়ে দিয়ে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে কুহু।
কি আর করবে এখন? শেষ অব্দি কুহু কলটা রিসিভ করলো, নীরস কণ্ঠে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে সিয়াম ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল———‘কই ছিলে কুহু? অনেকক্ষণ ধরেই কল করছিলাম। ফাইনালি রিসিভ করলে।’
কুহু জোরে একটা শ্বাস টেনে নিজের রাগ; নিজের হতাশা দূর করার চেষ্টা করে জবাবে শুকনো করে হাসার চেষ্টা করে বলল———‘আম্মুর কাছে ছিলাম; রান্নাঘরে।’
সিয়াম খুশি হয়ে গেল; দারুণ আগ্রহ নিয়ে এবার বলল———‘সিরিয়াসলি, তুমি রান্না পারো?’
কুহু ভ্রি কুচকালো সিয়ামের এমন আগ্রহ দেখানোতে। পরপর নিরাসক্ত গলায় বলল———‘না; শিখিনি কখনো। আপনি এত ইনটারেস্টেড কেন আমার রান্না নিয়ে, স্ট্রেঞ্জ!’
কুহুর এমন খোচা দেওয়াতে সিয়ামের মুখটা ছোট হয়ে গেল সাথেসাথেই। কুহুর উত্তরে মনে হচ্ছে—- সে সিয়ামের ফ্যামিলির লোকদের রেঁধে খাওয়াতে আগ্রহী নয় একদম। অথচ সিয়ামদের পরিবারে বাড়ির বউদের রান্নাবান্না করতে হয়। সিয়ামের মা এসব ব্যাপারে নিশ্চয় কুহুকে স্বস্তি দেবেন না। সিয়াম মুখটা ছোট করে বলল———‘হুঁ, না, তেমন কিছু না এমনি।’
কুহু বাকি কথা শোনার ইচ্ছেও রাখেনা, এই আপদকে দ্রুত তাড়ানোর জন্যে এবার তাড়া দেখিয়ে বলল———‘কি বলতে কল দিয়েছেন দ্রুত বলুন, আম্মু ডাকছে।’
সিয়াম এবার মনে পড়ায় দ্রুত বলল———‘তুমি যাচ্ছো না নাকি ট্যুরে?’
কুহু ছোট করে জবাবে বললো———‘না, যাচ্ছি না।’
সিয়াম এটা শুনে এবার ভীষণ অনুরোধ করে বলল———‘এটা আমাদের প্রথম ট্যুর কুহু; প্লিজ আসো। ট্রাস্ট মি আমি থাকব তোমার সাথেসাথে অলওয়েজ, বোর ফিল করবে না একদমই।’
এটা শুনে, কুহু মনেমনে বিড়বিড় করে—‘এটার জন্যেই তো আরো যাব না।’
কুহু ভদ্র মেয়ে: সিয়ামকে কেন যেন কষ্ট দিল না এসব বলে। মুখে কুহু জবাবে বলল———‘আমার শরীরটা ভালো নেই সিয়াম। আমি এক্সট্রিমলি সরি আমি আপনার মন ভাঙছি; কিন্তু আমি পারবো না। আমাকে এটা নিয়ে জোর করলে আমার উত্তর বদলাবে না একদমই।’
সিয়াম এবার কি বলবে? চুপ করে ‘বাই’- বলে কল কেটে দিল। কুহু বুঝল—সিয়াম রাগ করেছে। কিন্তু ও কি করবে এতে? এই জীবনে একজনের রাগ; একজনের অভিমান কুহু ভীষণ-ভীষণ পাত্তা দিয়েছে। সেই একজনের রাগ-অভিমান মন-প্রাণ দিয়ে মানানোর চেষ্টা করেছিল। আজ সেই মানুষটাকুহুর জীবন থেকে হারিয়ে যাবার পর আর এসবে আর আগ্রহ রয়নি। ইদানীং ভীষণ ন্যাকামো মনে হয় কারোর এসব রাগ; অভিমান—যেমনটা সিয়ামের বেলায় মনে হচ্ছে।
কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা আসলেই বন্ধ করে ফেলল এইবার। কম্ফোরটার টান দিয়ে শুতে যাবে হঠাৎ ওর রুমে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গেল শার্লিন।
কুহু অবাক হয়ে দেখলো ওকে। উঠে বসে গেল; আর শুতে পারলো না। শার্লিন এসেই কুহুর ট্যুর ব্যাগটা খুঁজতে শুরু করল হন্যে হয়ে।ওদিকে কুহু শার্লিনকে ওর রুম তন্নতন্ন করে খুঁজতে দেখে বিছানার উপর থেকে ভ্রু কুঁচকে ডাকল———‘শার্লিন; কি খুঁজছিস? আর তুই এখন? কোনো দরকার? বলে এলি না!’
শার্লিন ব্যাগটা পেয়ে গেল; কুহুর দিকে ফিরতেই ওর হাতের ব্যাগ দেখে কুহু ভ্রু কুঁচকালো।
ভ্রু নাচাতেই,শার্লিন জবাবে দারুণ আগ্রহ নিয়ে, এক্সাইটমেন্ট নিয়ে বলল———‘তুই ট্যুরে যাচ্ছিস আমার সাথে। ব্যাগ প্যাক করবি না? আমি হেল্প করবো তোকে-তাই এসেছি।’
কুহু এটা শুনেই ভ্রু কুচকে তাকাল; পরপর বিরক্ত হয়ে ছোট একটা শ্বাস ফেলে শার্লিনের হাত থেকে ব্যাগ টেনে নিজের হাতে নিয়ে বলল———‘আমি যাচ্ছি না কোথাও শার্লিন। আমি নাম এন্ট্রি করাইনি।’
শার্লিন এসব যেন একটুও পাত্তা দিল না, ও আরাম করে কুহুর হাত থেকে জোর করে টেনে নিয়ে নিলো। কুহু হতবাক হয়ে ব্যাগটার দিকে একবার চেয়ে ভ্রু কুচকে রেগে তাকালো শার্লিনের দিকে।
শার্লিন ব্যাগটা হাতে রেখে, মহা ফুর্তি নিয়ে বলল———‘আমি আমাদের দুজনের নাম আর ফি দুটোই এন্ট্রি করে আসছি। ভেবে নে এই ফি আমার পক্ষ থেকে তোর জন্যে ট্রিট।’
কুহু হতবাক; আশ্চর্য হয়ে বলল———‘আমি রাজি না। আমাকে না জিজ্ঞেস করেই তুই—-‘
শার্লিন ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে কুহুর আলমারি খুলে জামা কাপড়গুলো বাছতে বাছতে নির্বিকার গলায় বলতে থাকলো——-‘কি জিজ্ঞেস করতাম তোকে? তুই তো এখন দেবদাসের ফিমেল ভার্সন হয়ে ঘুরছিস। আমার কাছে মনে হয়েছে— বহুদিন দুই বান্ধবী মিলে এনজয় করিনি। তাই আর না ভেবে নাম এন্ট্রি করে দিয়ে এসেছি। আচ্ছা—- আমার জামার সাথে মিলিয়ে তোর জামার কালারগুলো নিলাম।’
তারপর হঠাৎ কুহুর দিকে চেয়ে বলল——-‘ওহ; হ্যাঁ। সেনোরা নেওয়া লাগবে?’
কুহু জবাব না দিয়ে বিরক্ত চোখে শার্লিনের দিকে চেয়ে আছে। শার্লিন সেটা দেখে আর তেমন ঘাটালো না; নিয়ে নিলো একটা সেনোরার প্যাকেট। তারপর আরামদায়ক কিছু কুর্তি বেছেবেছে নিয়ে লাগলো, কুর্তির সাথে জিন্স, আর সাথে সিল্কের দোপাট্টা নিলো— ছেলেরাও সাথে যাবে তাই।
কুহু বিছানায় কম্ফোর্টার গায়ে দিয়ে শুধু দেখছে শার্লিনের এসব কাজ। এবার না সহ্য করতে পেরে কুহু ভীষণ জেদ দেখাল: একগুয়ের মতো বলল———‘আমি যাব না মানে যাব না শার্লিন। তুই আমার রাগ উঠাচ্ছিস এবার, রাখ এই কাপড়।’
শার্লিন এবার ওর বেছে-বেছে ড্রেসের স্তূপ দুহাতে আগলে রেখেছে; মুখটাও ঢেকে ফেলেছে ড্রেসের স্তূপ। সেভাবেই ওই ড্রেসগুলো এনে কুহুর ব্যাগটার উপর ঠাস করে ফেলল। তারপর জোরে একটা শ্বাস ফেলে এইবার কুহুর সামনে বসে কুহুর দিকে তাকালো ভালো করে।
কুহু ভীষণ রেগে আছে; সেভাবেই শার্লিনের দিকে চেয়ে আছে। শার্লিন এইবার রাগলো একটুকুও; ও ভীষণ ধৈর্য নিয়ে কুহুর হাত ধরে বলল———‘এভাবে দিন চলে না কুহু। ইউ শুড বি ইজি; রাইট? তুই যে জীবন এখন লিড করছিস এটাকে একটা স্বাভাবিক জীবন বলে না কুহু। তুই মানসিকভাবে ঠিক নেই।’
কুহু ভ্রু কুচকে চেয়ে রয়েছে। শার্লিন কুহুর বালিশের পাশ থেকে ইনহেলার টেনে এনে নিজের হাতে নিলো; কুহুকে সেটা দেখিয়ে বলল———‘এটা, এস. . এসব তোর জন্যে না কুহু। তুই একটা বেস্ট লাইফ ডিজার্ভ করিস। তার জন্যে আগে নিজেকে হিল করা দরকার তোর।’
কুহু ইনহেলারের দিকে একবার চেয়ে পরপর ইনহেলার খামচে ধরে আবার বালিশের পাশে রেখে সাফসাফ গলায় বলল———‘আমি এভাবেই ভালো আছি। আমার হিল হওয়ার দরকার নেই।’
শার্লিন কুহুর দিকে তাকাল, ইচ্ছে করেই ভীষণ উত্তেজনা: আগ্রহ দেখিয়ে বলল——-‘ভাব একবার কুহু; এই তিনদিন আমরা স্বপ্নের দিন কাটাব, জাস্ট ইমাজিন। তুই-আমি আর টেন্ট-ক্যাম্প; সুইমিংপুল; খাল বেস্ট কম্বিনেশন কুহু। রাজি হয়ে যা না বেবস; প্লিজ। জান আমার, আমার এতগুলো টাকা ফি তুই জলে ডুবাবি? পকেটমানি থেকে দিয়েছি আমি; বুঝ আমার দুঃখ।’
শার্লিনের ইমোশনাল ব্লেকমেইলের কাছে কুহু হেরেই গেল শেষ অব্দি। কুহু এবার ছোট একটা স্বাদ ফেলে বলল———‘ওই সিয়াম আমাদের সাথে যাবে। ও গেলে আমি যেতে পারব না। প্যারা দিবে আমাকে।’
সিয়ামের কথা শোনামাত্রই শার্লিন মুখ বাকিয়ে ফেলল। মুখ দিয়ে চ্যাহ আওয়াজ করে বিরক্ত হয়ে বলল——-‘আপদ একটা নিজেই মাথায় নিয়েছিস, এখন কেন প্যারা মনে হবে আপনার? আচ্ছা ঠিকাছে, ওকে আমি দেখে নেব। তুই জাস্ট রেডি হবি আর আমার সাথে আসবি। বাকিটা আমার দায়িত্ব।’
——————————————
ড্রিম স্কোয়ার রিসোর্টে’——-
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ট্যুর ডেস্টিনিশন. ! সেখানে তিনদিন থেকে ঘুরেফিরে তারপর ফিরে আসবে সবাই। সমস্ত একটিভির দায়িত্বে রাখা হয়েছে কাব্য-তানিমকে। কাব্য শুরুতে যেতে চায়নি এসবে। ওর মন-মেজাজ এবার ভালো নেই। কিন্তু প্রায় প্রতিটা ট্যুর অরগানাইজার হিসেবে কাব্যের বেশ সুনাম হয়ে গেছে ভার্সিটিতে। তাই স্যাররা এবারেও কাব্যকে বগলদাবা করে নিয়ে চলেছে ট্যুরে। কাব্য তখনো জানেনা—-কুহু যাচ্ছে। কারণ এন্ট্রি খাতার তালিকায় কুহুর নাম দেখেনি কাব্য প্রথমদিন। তারপর থেকে এন্ট্রি খাতার দায়িত্বে আরেকজনকে রাখা হয়েছে। ওটার দায়িত্বে যেহেতু কাব্য নেই— তাই ওর জানার কথাও না কুহুর ব্যপারে।
কাব্য কিছুসময়ের জন্যে লেকচারারের রুমে গিয়েছিল একটা কাজে। ঠিক তখন কুহু ব্যাগটা নিয়ে বাসে উঠে দাঁড়ালো।
ওর গায়ে একটা হোয়াইট কুর্তি; জিন্স আর গলায় একটা কালারফুল ওড়না পেঁচিয়ে রাখা। সেজেছে বললে— ওই ব্লাশটিন্ট— ব্যস! আজকাল নিজেকে নিয়েও এত মেতে থাকতে কুহুর ইচ্ছেও করেনা। যেমন চলছে চলুক না—- এমন একটা ভাব।
বাসে উঠে আশেপাশে কোথাও শার্লিনকে খুঁজে না পেয়ে কুহু পানি খেতে খেতে কল দিল শার্লিনকে
——-‘কোথায় তুই?’
শার্লিন জবাবে তাড়াহুড়ো করে বলল——-‘আসছি বেবস। অপেক্ষা কর অল্প। প্লিইজজ!’
কুহু ‘আচ্ছা’— বলে কলটা কাটল। জোরে একটা শ্বাস ফেলে আশেপাশে নিজের সিট খুঁজতে লাগলো, কোথায় বসবে ও? ওর সিট নাম্বার তো শার্লিনের কাছে রাখা। আচ্ছা. . সিয়াম কি এসেছে? এখন ওকে সামনে দেখলেই একটা নাটক শুরু করবে—- বিরক্ত লাগছে কুহুর। এই শার্লিনটা আজই এত দেরি কেন করছে?
কুহু যখন সিট খুঁজছে; তখন পেছন থেকে কেউ যেন গম্ভীর কণ্ঠে কাউকে আদেশ দিচ্ছে—- ‘গাড়িতে মিনারেল ওয়াটার লাগবে; এই সবুজ মিনারেল ওয়াটারের বোতল আনসস কিনে?’
এটা…এটা কাব্য ভাইয়ের গলা না? উনি… উনিও ট্যুরে যাচ্ছেন? কুহুর চমকে উঠে পেছনে তাকালো; ওর বুকটা ধুকপুক করে উঠেছে যেন একটুর জন্যে।
ওই তো কাব্য ভাই! একটা ছিমছাম গড়নের ছেলেকে রাগে ঝাড়ি দিচ্ছেন; কপাল কুচকাচ্ছেন; ছেলেটা মাথা নামিয়ে দাড়িয়ে শুনছে উনার গালাগাল। কুহু থমকেই গেল যেন পুরোপোরি। কাব্য ভাই ওদের সাথে যাবেন— এটা. . এটা কুহুকে কেউ জানায়নি কেন? এখন. . এখন কি হবে? এক বাসে; তিনটাদিন ওরা একসঙ্গে থাকবে? অসম্ভব. .! কুহু এই লোকের সাথে এক মুহূর্ত থাকতে চায়না।
কুহুর বুক কাপছে: হালকা করে ও মাথাটা ঘুরিয়ে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে আবার নিজেকে সামলে নিলো।
কুহু. . কুহু কাব্য ভাই একটা পাস্ট তোর। দ্যাটস ইট! তুই ফেইস করতে পারিস তাকে, তুই দুর্বল নস; তোর তার প্রতি আর কোনো ফিলিংস অবশিষ্ট নেই; সব শেষ। কাব্য ভাই আর এক্সিস্ট করেন না তোর জীবনে; উনি যাচ্ছে যাক। তুই যাবি তোর জন্যে; উনার সাথে তোর কোনো লেনাদেনা নেই। ওকে; ইটস ফাইন; ফাইন, ফাইন!
কুহু এভাবেই মনেমনে নিজেকে সান্ত্বনা দিল কয়েকবার। তারপর আবার মাথা ঘুরিয়ে ভীষন স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করে কাব্যের দিকে তাকালো। কাব্য তখন গাড়িতে মিনারেল ওয়াটারের প্যাকেট উঠাচ্ছে ওর ভারি-পেশিবহুল হাত দিয়ে; গায়ে আজ একটা ব্লু চেকের শার্ট; শার্টের নিচে একটা হোয়াইট টিশার্ট; টিশার্টের কলারে সানগ্লাস ঝুলানো. . আর জিন্স!
কুহু তাকিয়ে দেখছিল; হঠাৎ সেভাবেই কাব্যেরও চোখ চলে গেলো কুহুর দিকে। কুহু আতকে উঠেছে যেন এতে; দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে ফেলল ও চোরের মতো। অন্যদিকে চেয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে কুহু নিজেকে যখন সামলাতে ব্যস্ত; তখন কাব্য কিছুটা অবাক! কুহু ওদের সাথে যাচ্ছে? ও তো জানতো না। নিশ্চয়ই সিয়ামের জন্যেই যাচ্ছে। নতুন নতুন প্রেম কি না! কাব্যের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো স্রেফ; ও আলগোছে চোখটা নামিয়ে কাজে মন দিল।
বাস ছাড়ার টাইম পোস্টপন্ড করা হয়েছে। গ্রুপ সেটা বলা হয়েছিল—- কিন্তু একমাত্র আহাম্মক কুহুই হয়তবা সেটা জানতো না। এত আগেআগে এসে গেছে ও; বিরক্ত লাগছে। কুহু সামনেই দুটো খালি সিট দেখে একটাতে বসে গেলো; কতক্ষণই বা দাড়িয়ে থাকা যায়!
ইতিমধ্যে গাড়িতে সবাই উঠে বসেছে যে-যার সিট দখল করে। একমাত্র কুহুর সিটেই কেউ বসেনি এখনো। কুহু আশেপাশে সিয়ামকে খুঁজছে; এই আপদ কখন যে চলে আসে কে জানে। না আসলেই ভালো! নাহলে সারারাস্তা কুহুকে জ্বালিয়ে মারবে। কুহু আবার শার্লিনকে কল করলো; ধরছে না ও। বিরক্ত হয়ে কুহু কল কেটে বসে থাকলো থম মেরে। আড়চোখে একবার কাব্যকে দেখলো— কাব্য কপালের ঘাম মুছতে মুছতে অন্যপাশে আবার চলে যাচ্ছে। কুহু ছোট করে একটা শ্বাস ফেললো।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সমস্ত কাজ শেষ করে; কাব্য এতক্ষণে বাসে উঠে দাঁড়ালো। কুহুর সামনে এসে সিট নম্বর দেখছে ও ঝুঁকে। হঠাৎ কুহুর মুখের সামনে কাব্য ঝুঁকে সিট নম্বর দেখাতে কুহু চমকে উঠে মাথাটা খানিক পিছিয়ে নিয়ে থমথমে গলায় বলল———‘কি হচ্ছে এটা?’
কাব্য সরে গিয়ে নিজের মতো সিট নম্বর কাগজ বের করে কুহুর মুখের সামনে ধরল। কুহু ভ্রু কুচকে মাথা তুলে একবার কাব্যের মুখের দিকে চেয়ে আবার সিট নম্বর পড়তে শুরু করল। কাব্য নির্বিকার গলায় বললো ———‘তোর পাশেরটা আমার সিট; সো মে আই? মানে বসবো আমি।’
সিট নাম্বার সঠিক; কুহু ভ্রু-ট্রু মারাত্মক কুচকে মাথা তুলে লম্বা-উঁচু কাব্যের দিকে তাকালো; কাব্যের অবশ্য কুহুর এসব রাগে একটুও মাথা-ব্যথা নেই। ও আলগোছে কুহুকে সামান্য সরিয়ে ভেতরে ঢুকে নিজের সিটে বসে পড়লো।
তারপর কুহুর দিকে একবার চেয়ে কুহুকে পরখ করল; কুহু রেগে তাকিয়ে আছে কাব্যের দিকে। ওর রাগ হচ্ছে এইজন্যে নে—- কাব্য ইছে করেই ওর পাশে বসলো কি? অন্য সিট নেই আর?
অথচ নির্বিকার কাব্য সিটে বসে কুহুকে পাত্তাই দিল না। নিজের মতো প্রথমে সিট ঠিক করল ওর। ওর লম্বা পাগুলো টেকানো যাচ্ছে না সিটে ভালো করে। কুহু কাব্যকে এমন নিষ্প্রাণ দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। পরপর নিজের মেজাজ সামলাতে না পেরে ঠাস করে কিছু না বলেই উঠে গেল কাব্যের পাশের সিট থেকে; ব্যাগটা নিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল অন্যদিকে সিট খুঁজতে। কাব্য সিট ঠিক করতে করতে একবার ওর যাওয়া দেখলো স্রেফ, মুখে কিছুই বলল না। ও তো জানতো এটাই হবে—- ইচ্ছে করেই তাই কুহুকে তেমন কিছু বলেনি কাব্য। ভরা বাসে স্যারদের সামনে ওদের পার্সোনাল ব্যাপার টানার মানে নেই।
কুহু ব্যাগ কাঁধে হেঁটে হেঁটে পুরো বাস দেখে ফেলল। কোনো সিট খালি নেই। দুটো সিট খালি, কিন্তু ওই দুটো সিটে আপাতত দুই স্যার বসে গল্প করছেন—- এইজন্যেই কাব্য ভাই ওর পাশের সিটে এসে বসেছিলেন। যদি সিট থাকত খালি—- নিশ্চয়ই কাব্য ভাই ওর পাশে বসতে চাইতেন না।
বাসে এক্সট্রা সিট না পেয়ে কুহু এসে আবার কাব্যের পাশের সিটে মুখটা থমথমে করে বসলো। কাব্যের দিকে ভুলেও একবারের জন্যে তাকালো না। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। কাব্য ওর মতো করে মিনারেল ওয়াটারের বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে বলল——-‘ইগোওয়ালির জন্যে এক্সট্রা সিট রাখেনি বাস? ভেরি ব্যাড।’
কাব্য মজা নিচ্ছে; অথচ মুখে হাসি নেই— যেন সিরিয়াস কথা বলছে। কুহু মারাত্মক ফুসে উঠে কাব্যের দিকে একবার তাকালো। কাব্যও তখন তাকালো; পরপর বোতলের ছিপি খুলে পানি খাওয়া শুরু করলো। যেন কুহুর ওই রাগ; ফুঁসে উঠাতে ওর কোনো যায়-আসেই না।
কুহু কাব্যকে নির্বিকার দেখে আবার মুখটা ঘুরিয়ে ফেলল। ভুলেও তাকালো না কাব্যের দিকে। কাব্যের আজ কোনো তাড়া নেই—- কুহুকে মানানোর কোনও প্রয়াস নেই। বরং ও খুশি। যাচ্ছেই তো ওরা রিসোর্টে। একসাথে থাকবে কদিন। কুহুর সঙ্গে তখন কথা বলা যাবে। নিজের এই অস্থিরতা সম্পর্কেও শিউর হওয়া যাবে— যে এটা আদৌ কি? কাব্যের মনের এই অস্থিরতার নাম কি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবে কাব্য এই ট্যুরে।
কাব্য এইবার দু পা লম্বা করে আরাম করে বসে ফোনে সব আপডেট নিচ্ছিল—- কারণ ও চিফ অর্গানাইজার। কুহু পাশে বসে থাকা সত্ত্বেও কাব্যের কোনো রিয়াকশন নেই; ব্যাপারটা কুহুর কেন যেন খুব গায়ে লাগলো। ও জানে— কাব্য ওকে পছন্দ করে না একদমই; দেখতে পারে না দু-চোখে। তবুও কুহুর কষ্ট লাগল ভীষণ; আবারও আরেকবারের মতো। পরমুহূর্তে ঘাড় হালকা বাকিয়ে কাব্যকে ফোনে থাকতে দেখে কুহু নিরস মুখে বিড়বিড় করল——‘ঊর্মি আপুকেই মেসেজ দিচ্ছে হয়তো।’
কেন যেন ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কুহুর।পরপর কুহু নিজেকে সামলে নিলো। ওর কি আসে যায় তাতে। তাকাবে না ও কাব্য ভাইয়ের দিকে। জাহান্নামে যাক এই লোক! কুহুর কিচ্ছু হয়না এই মানুষটা; কুহুর আর একটুও অনুভূতি নেই তার প্রতি——-সবটাই মরে গেছে।
এই শার্লিন আজকেই এত দেরি করছে! কুহু এবার মহা বিরক্ত হয়ে আবার শার্লিনকে কল করল। এই অপদার্থ কল ধরছে না কেন? ফোনটা আবার ব্যাগে রাখলো কুহু। কাব্য ওদিকে নির্বিকার; ও আনমনে ফোনে নিজের কাজ করছে। কুহুর অস্থিরতা ও দেখছে শুধু আড়চোখে; কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না ইচ্ছে করেই।
হঠাৎ কাব্য ডান হাতে ফোন চেপে কথা বলতে বলতে বাম হাতটা সিটের হাতলে রাখলো; জানালার দিকে মুখটা ঘুরিয়ে কথা বলছে কলে কারোর সঙ্গে। কুহুও কেন যেন এইবার হঠাৎ হাতটাও হাতলে রাখতে গেল।
ব্যাস! দুজনের হাত-দুটো একে অপরকে স্পর্শ করল। কুহু স্পষ্ট অনুভব করল—- কাব্যের বা হাতের শিরার উপস্থিতি; ওর গরম হাতের পেশির স্পর্শ! কাব্য তখন একহাতে ফোন কানে ধরে ওদের দুজনের হাতের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। কুহুর বুকটা আবার ধুকপুক করছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে—- এইবার. . ঠিক এইবার কাব্যের নিজের বুকটা ধুকপুক করে উঠল কেমন যেন।
কাব্য হঠাৎ চোখ খিচে উঠে; নিজের বুকের ধুকপুক অনুভব করার চেষ্টা করলো। এটা. . এটা কি হচ্ছে? ওর হার্ট এত জোরে বিট করছে কেন? কাব্য চোখ-মুখ খিঁচে হঠাৎ অস্থির ভঙ্গিতে কুহুর হাত থেকে নিজের হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে ফেলল। কুহু ভীষণ অবাক হয়ে কাব্যের দিকে তাকালো তখন! কাব্য বা হাতটা দিয়ে ও নিজের বাম পাশের বুক খামচে চেপে ধরে আছে। এটা. .এই পাশটা এত অস্থির হচ্ছে কেন? কি হচ্ছে ওর সাথে এটা?
কাব্য শুধু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে চোখ খিঁচে—— ও নিজেই শুনতে পারছে ওর হৃদয়ের ধুকপুক এই অসহ্য শব্দটা! !
কুহু নিজের অনুভূতি ভুলে কাব্যের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কাব্য ভাইয়ের কি হার্টের সমস্যা শুরু হয়েছে? উনি. . উনি এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন। কুহুর মনে হলো— একবার কাব্যর গা ছুয়ে জিজ্ঞেস করবে—- কি হয়েছে? অসুস্থ বোধ করছেন কি না।
পরমুহূর্তে ঠিক কুহু নিজেকে সামলে নিলো। ও জিজ্ঞেস করার কে এসব? কেউই না।
কাব্য স্বাভাবিক হয়েছে; তবে এখন কেমন যেন নীরব হয়ে গেছে একদম। আর ফোন দেখছে না; একদৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। কুহু তাকাবে না করেও— আড়চোখে দু-একবার কাব্যের দিকে তাকাল। এই মানুষটা হঠাৎ আচমকা এমন নীরব হয়ে গেল কেন?
‘হাই কুহু! হোয়াট এ সারপ্রাইজ!’ ———— সিয়াম হঠাৎ এসে কুহুর সামনে দাড়ালো কুহুর কাঁধে হাত রেখে। কাব্যও তখন তাকালো সিয়ামের দিকে।
কুহু একবার কাব্যের দিকে চেয়ে আবার সিয়ামের দিকে তাকালো। পরপর ভেতর থেকে উপচে এলো বিরক্তির শ্বাস। আলগোছে সিয়ামের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ইশারায় শাসিয়ে বলল——‘হাই সিয়াম।’
কাব্য তাকিয়ে ছিলো। সিয়াম শুরুতে কাব্যকে দেখেওনি। কাব্য ওপাশে থাকায় কুহুর অস্বস্তি খেয়াল করল না: ও শুধু দেখেছে কুহু সিয়ামের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দুজনের চোখে-চোখে হয়তো কথা-বার্তা হচ্ছে এখন। হোয়াট রাবিশ!
সিয়াম আবার কুহুর বাম কাঁধে হাত রেখে হেসে বলল——‘আমাকে বললেও না তুমি আসছো। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলে নাকি?’
কুহু ‘না’—— বলতে যাবে হঠাৎ ওর মনে পড়ে কাব্য ওর পাশে। কুহু এবার কি মনে করে মন খুলে হাসলো। হেসেহেসেই আহ্লাদ দেখিয়ে জবাবে বলল——‘হু; সারপ্রাইজ হয়েছেন?’
সঙ্গেসঙ্গে কাব্য ভ্রু কুচকে ফেললো। কুহু এত আহ্লাদে গলে পড়ছে কেন? এটা তো কুহুর ক্যারেক্টার না। কুহু. . কুহু কি এসব জোর করে করছে?
সিয়াম হালকা হাসলো; বললো———‘বেস্ট সারপ্রাইজ! থ্যাংক ইউ আমার আবদার রাখার জন্যে।!’
কাব্যের ভ্রু আগের তুলনায় আরো কুচকে গেছে। ও কিরমির করে সিয়ামের হাতের দিকে চেয়ে আছে যা এখন কুহুর কাঁধ স্পর্শ করে আছে। একটু আগে কাব্যের হাত ছুয়ে ছিলো কুহুর হাতটা। আর এখন. . এখন… সিয়ামের সাথে চিপকে আছে। কুহুর প্রতি হঠাৎই রাগটা তরতর করে বাড়ছেই কাব্যের।
কাব্য স্রেফ কুহুর দিকে তাকিয়ে রইল; কুহু কেন মানা করছে না সিয়ামকে। তার মানে কুহুর সায় আছে এতে, বাহ। দুদিনের রিলেশনে স্পর্শ করারও পারমিশন পেয়ে ফেলা যায়? মেজাজ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে কাব্যের।
সিয়াম হঠাৎ এবার কাব্যের দিকে তাকাল; কাব্য ভ্রু-কুচকে ফুসে উঠে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। কাব্যকে দেখেই সিয়াম অবাক হয়——‘কাব্য তুই? ভলান্টিয়ার নাকি?’
কাব্য দাঁত পিসে জবাবে বলল——‘বুড়ো হয়ে ট্যুরে যাচ্ছি, মানে মাস্ট বি ভলান্টিয়ারই হবো। কমনসেন্স তো তাই বলে।’
সিয়াম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল কাব্যের এমন ত্যাড়া উত্তরে। ও হাসার চেষ্টা করলো। কাব্য এবার সিয়ামের চোখে চোখ রাখল; পরপর সিয়ামের হাতের দিকে চোখ দিল আবার— কুহুকে এখনো স্পর্শ করে আছে ওই হাতটা।
কাব্য হাড্ডি মাপছে— এই হাতটা ভেঙ্গে গুড়গুড় করতে কত মোটা লাঠি লাগবে কাব্য মেপে নিচ্ছিল হয়তো। কুহুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো সিয়াম; হঠাৎ কাব্যের চোখে চোখ পড়তেই দেখে কাব্য এবার দাঁত পিষে, চোখ দিয়ে সিয়ামের দিকেই শাসানো নজরে তাকিয়ে আছে।
যা বোঝার বুঝে গেল সিয়াম। আলগোছে সিয়াম হালকা কেশে কুহুর কাঁধ থেকে হাত ধীরে ধীরে সরিয়ে নিলো। কাব্য এবার ভ্রু বাঁকাল স্রেফ, মুখে কুহুর সামনে কিছুই বলল না।
সিয়াম গলা কেশে কাব্যের দিকে আড়চোখে চেয়ে কুহুর দিকে চেয়ে বলল——‘কুহু আমার সাথে চল; আমার সিটে বসবে। কাম!’
কাব্য তাকিয়ে রইলো কুহুর দিকে। দেখা গেল কাব্যকে অবাক করে দিয়ে কুহু দুবার না ভেবে ব্যাগ নিয়ে সিয়ামের সিটে চলে গেল।
কাব্য হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল। সোজা হয়ে বসে পড়লো সিটে। কুহু গেল ওই বাস্টার্ডের সাথে। কেন গেল? কাব্য রাগে রাগ ফুঁসতে ফুঁসতে তানিমকে কল করল। তানিম মাত্রই এন্ট্রি খাতাটা নিয়েছে ওর হাতে। কাব্যের ফোন দেখে রিসিভ করে ‘হ্যালো’ —বলতেই কাব্য রেগে বলল——‘সিয়ামের সিট আমার বাসে কে প্ল্যান করেছে ছাগল?’
তানিম হতবাক; কিছু না বুঝে বলল——‘বাসের সিটের ব্যাপারে তো তুই আমাকে কোনো প্ল্যান বলিস নি। তাই আমি এসব কেমনে ঠিক করবো? কেন কি হয়েছে?’
কাব্য দাঁত পিষে গালাগাল করে গেল——‘তুই একটা গর্দভ; তুই একটা হাদারাম: আস্ত মাথামোটা ছাগল তুই। এই পুরো তিনদিন তুই আমার সামনে আসবি না একদম, আমি তোরে আজ কুরবানি দিব তানিম। এন্ড আই মিন ইট।’
কাব্য কল কেটে ফেলল ঠাস করে। তানিম হতবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। এই কাব্যের হঠাৎ হলোটা কি?
হঠাৎ তানিমের ওর হাতে থাকা খাতার দিকে তাকালো। হঠাৎ খাতার এন্ট্রি লিস্টে কুহু আর শার্লিনের নাম দেখে তানিম সাথেসাথেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। পরপর আচমকা পেট চেপে হেসে উঠল শব্দ করে। হাসতে হাসতে বললো———‘আগুন জ্বলে গেছে। রুড-ইন্ট্রোভার্ট কাব্য ফাইনালি ফেসে গেছে।এইবার এই স্টাডি ট্যুর কাব্যকে লাইফের সেরা একটা লাভ লেসন দিবে— জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ!’
#চলবে
Share On:
TAGS: অবন্তিকা তৃপ্তি, ডেনিম জ্যাকেট
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১২
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৯
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৪
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৩
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৯
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৫
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৯
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩৩
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২০
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৭