Golpo romantic golpo উড়াল মেঘের ভেলায়

উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৪


উড়ালমেঘেরভেলায়

লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক

পর্ব_৪

[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ!]

দুপুর বারোটা।
আভিয়ান ফ্রেশ হতে গিয়েছে। তা-ও আবার কিনা রানিয়ার ওয়াশরুমে৷ রানিয়া রুমের মধ্যে পায়চারি করছে। ওদিকে ওয়াশরুমের ভেতর হতে শাওয়ারের শব্দ ভেসে আসছে। রানিয়া বারবার ওদিকে তাকিয়ে গজগজ করতে। গজরাতে গজরাতে ও বিরক্তি স্বরে বিরবির করলো, “এসেই আমার ওয়াশরুম দখল করা হয়ে গেছে। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে লোকটা। এমন একটা ভাব করছে, যেন এটা তার শ্বশুরবাড়ি, হুহ!”

কথাটা বিরবির করতেই জিভ কাটলো রানিয়া। তারপর বললো, “ওহ হ্যাঁ, ব্যাটার তো শ্বশুরবাড়ি-ই এটা। ব্যাটার ঘাড়ে ব্যাডিং ব্যাগ দেখেছি। তারমানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর সোজা এখানে চলে এসেছে। নিজ বাসায়ও যায়নি। কথা হচ্ছে, ব্যাটাকে তাড়ানো যায় কীভাবে?”

কথাটা ভাবতে ভাবতেই মিশা আর জাহিনের কথা মনে পরলো রানিয়ার। সঙ্গে সঙ্গে ফোন নিয়ে মিশাকে কল করলো। কিন্তু মেয়েটাকে তৎক্ষনাৎ কলে পাওয়া গেল না। ব্যস্ত বলছে। নিশ্চয়ই নিজের হবু স্বামীর সাথে কথা বলছে ফোনে। মিশাকে ব্যস্ত পেয়ে জাহিনকে কল করলো রানিয়া। একবার রিং বাজতেই জাহিন কল রিসিভ করলো। রানিয়া ফোন কানে তুলে চাপা স্বরে বললো, “দোস্ত, আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেল রে।”

“কীসের আবার সর্বনাশ হলো তোর?”

ফোনের ওপাশ থেকে জাহিনের চাপা কন্ঠস্বর শোনা গেল। রানিয়া গলার স্বর আরো কিছুটা নামিয়ে এনে ফিসফিস করে জবাব দিলো, “ওই ব্যাটা আভিয়ান এখানে চলে এসেছে, আমাদের বাসায়। এসে আমার রুম, বিছানা, ওয়াশরুম সব দখল করে নিয়েছে। আমাকে এখনো পর্যন্ত কিছু বলেনি। কিন্তু ভাবসাব ভালো মনে হচ্ছে না দোস্ত। কোনো কথা বলেনি আমার সাথে। কেমন যেন গম্ভীর হয়ে আছে। ঝড়ের পূর্বাভাস বুঝলি। যখন-তখন ধরে কানের নিচে দু’টো বসিয়ে দিতে পারে। কী করবো দোস্ত বল তো? এই লোককে তাড়ানো যায় কীভাবে?”

“দাঁড়া ভাবতেসি।”

কথাটা বলে জাহিন ফোনের ওপাশে চুপচাপ দুই মিনিচ নিরব থাকলো। এরপর ফট করে লাফিয়ে বললো, “পাইসি রে দোস্ত। জ্বালাতে হবে।”

“আগুন জ্বালাতে হবে? ওনার গায়ে? যদি কেস খেয়ে যাই?”

“আরে আগুন জ্বালাতে হবে না গাধী। দুলাব্রোকে জ্বালাতে হবে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে অতিষ্ঠ করে ফেলতে হবে। যাতে উনি নিজে থেকেই তোকে মুক্তি দেন।”

“কিন্তু কীভাবে জ্বালাবো?”

“সবভাবে, প্রতিটা মুহূর্তে।”

কথাটা বলে একটু থামে জাহিন। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করে, “দুলাব্রো এখন কোথায় আছে?”

“ওয়াশরুমে। আধাঘন্টা হয়ে গেল ভাই। পুরুষ মানুষের কি এতো সময় লাগে গোসল করতে?”

“আমার তো দেড়ঘন্টা লাগে দোস্ত।”

জাহিন কথাটা বিরবির করলো। তবে সেটা রানিয়া ঠিকমতো শুনতে পেল না। জাহিন বললো, “এখন আমি যা যা বলি, তাই কর। দেখবি, দুলাব্রো আজ-ই তোকে ছাড়ছে।”

জাহিন রানিয়াকে কতোগুলো পরামর্শ দিলো। রানিয়া মনোযোগ সহকারে সব কথা শুনলো।
.
.
আভিয়ানের সাধারণত ওয়াশরুমে এতো সময় লাগে না৷ তবে সারারাত দীর্ঘ জার্নির পর ক্লান্ত শরীরে এসে এমন একটা দীর্ঘ সময়ের ফ্রেশনেস ভীষণ দরকার ছিল ওর। নাহলে ক্লান্তি কাটতো না সহজে। ঠিকমতো ঘুমিয়েও নয়। তাছাড়াও, আভিয়ান অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ বা অন্য কোনোকিছু একদম পছন্দ করে না। শাওয়ারের নিচে একটানা ভিজছিল ও। মাথা বেশ গরম আছে। রানিয়ার মুখটা দেখলেই ওর রাগ চরম মাত্রায় বেড়ে যায়। তারওপর মেয়েটার কর্মকাণ্ড! রীতিমতো অসহ্যকর! অত্যন্ত ধৈর্যশীল আভিয়ানকেও ওই মেয়ে নিজের কর্মকান্ড দ্বারা ধৈর্যহারা করে ফেলে। শাওয়ারের ছিটেফোঁটা পানি আভিয়ানের ক্লান্তি এবং রাগ— দু’টোই একইসাথে কমিয়ে দিচ্ছিল। তখনই হঠাৎ বদ্ধ দরজায় টোকা পরলো। আভিয়ান শাওয়ার অফ করে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, “কে?”

“আমি, আপনার অলক্ষ্মী বউ।”

জবাবটা শুনে আভিয়ানের ভ্রু ত্রিমাত্রিক আকারে আরো বেশ কুঁচকে গেল। রানিয়াকে তোয়াক্কা না করে বিরক্তিভরে ও আবারও শাওয়ার নিতে লাগলো। তখনই বাইরে থেকে রানিয়া বলে উঠলো, “বলছিলাম ভাইসাব, আপনি কি বাথরুম সিঙ্গার নাকি? এতো দেরি হচ্ছে যে বের হতে?”

আভিয়ান ওর কথাবার্তা শুনে শাওয়ার বন্ধ না করেই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত পিষে জবাব দিলো, “এখান থেকে বের হয়ে প্রথমে তোমার গালে আগে দু’টো থাপ্পড় বসাবো বেয়াদব৷ থাপড়ে গাল লাল করে দেবো। একটা থাপ্পড় দেবো ভাইসাব বলার জন্য। আরেকটা থাপ্পড় দেবো এসব রিডিকিউলাস টাইপের কথাবার্তা বলার জন্য। আর আমি কে, সেটা তোমাকে এখান থেকে বের হয়ে দেখাচ্ছি।”

রানিয়া তবুও সেখান থেকে সরলো না। বরং একটা ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক কাজ করে বসলো। আভিয়ান কথাটা বলার সাথে সাথেই খুব সাবধানতার সহিত আস্তে-ধীরে বাইরে থেকে ওয়াশরুমের সিটকানি আঁটকে দিলো।
এর মিনিট পাঁচেক পরে আভিয়ান বের হওয়ার জন্য দরজা ভেতর থেকে খুলে টান দিতেই দেখলো, দরজা আর খুলছে না৷ তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের আভিয়ানের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং কাজটা কার। ও চেঁচিয়ে বললো, “রানিয়া দরজা খোলো। কুইক!”

রানিয়া সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। ও জবাব দিলো, “আগে আপনি স্যরি বলুন আমাকে৷ তারপর দরজা খুলছি।”

“হোয়াই শুড আই সে স্যরি?”

“আমাকে বিয়ে করার জন্য।”

“হোয়াট!”

আভিয়ানের ভ্রু স্বয়ংক্রিয়ভাবে কুঁচকে গেল। রানিয়া ক্রুর হেঁসে বাইরে থেকে জবাব দিলো, “হোয়াট না স্যরি, স্যরি বলুন আভিয়ান।”

আভিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। তবু এই মুহূর্তে নিজের মেজাজ সামলানো প্রয়োজন৷ ও হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখ বুঁজে নিজেকে শান্ত রেখে জোরে বললো, “স্যরি।”

রানিয়া বাইরে থেকে চেঁচিয়ে বললো, “শুনতে পাচ্ছি না। আবার বলুন।”

“স্যরি।”

উচ্চস্বরে বলা শব্দটা শোনামাত্র-ই রানিয়া সিটকানিতে এক টান দিয়ে খুলে সেখান থেকে ভোঁ দৌড় দিলো। ওকে আর পায় কে!
.
.
সেই দুপুর বারোটার কর্মকাণ্ডের পর থেকে রানিয়া আর আভিয়ানের ধারেকাছে যাওয়া তো দূর, সামনেও যায়নি৷ তবে লুকিয়ে দেখেছে, আভিয়ান ওকে নিরব দৃষ্টিতে দিয়ে খুঁজছে। কাউকে প্রশ্ন না করলেও ওর খোঁজ করছে প্রচন্ড মেজাজে। তা দেখেই রানিয়ার বুকে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। সারাটা দিন আজ বুক দুরুদুরু কাঁপছে ওর। দুপুরে আভিয়ান খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রানিয়ার আব্বা, অর্থাৎ তার শ্বশুরের সাথে বাইরে বেরিয়েছিল। সেই ফাঁকে রানিয়া দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছে।
এখন রাতের বেলা। আভিয়ান নাকি আগামীকাল বিকালে চট্টগ্রামে ফিরে যাবে। এখানে এসেছেই মূলত রানিয়ার সাথে দেখা করতে। রানিয়ার জন্যই নাকি আভিয়ানকে আসতে হয়েছে এখানে। একথা খাওয়ার সময় বলেছে ওই লোক। আজ রাতটা শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে আগামীকাল নিজের বাসায় একবার দেখা দিয়ে ফিরে যাবে। রানিয়া সব কথা শুনেছে ওর মায়ের কাছ থেকে। কিন্তু আভিয়ান যে সব দায় ওর ওপরে চাপিয়ে দিয়েছে— এটা ভেবে মনে মনে খুব ক্ষেপলো রানিয়া। আজ ও এর কৈফিয়ত নিয়েই ছাড়বে৷
.
.
রাত তখন সাড়ে এগারোটা। রানিয়া নিজের রুমে পায়চারি করছিল। প্রচন্ড নাভার্সনেস কাজ করছে। রাতের খাবারের পর ড্রয়িংরুমে বসেছিল আভিয়ান তার শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সাথে। একমাত্র ছোট শালার সাথে গল্প করছিল। তখনই রানিয়া উঁকি মারলে আভিয়ানের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। ওই চাহনি ভস্ম করে দেওয়ার মতো। রানিয়া সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে দ্রুত রুমের ভেতরে এসেছে। আজ ও আর এই রুমে থাকবে না৷ এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো ও। পেছনের বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা খুলতে হবে৷ ওপাশ থেকে অতিথি ঘরে গেলে ড্রয়িংরুমের কেউ দেখবে না। আর আভিয়ানের সামনেও পরতে হবে না। যাওয়ার আগে সামনের দরজায় একবার সবাইকে দেখে আসার জন্য গিয়ে দাঁড়াতেই একেবারে আভিয়ানের মুখোমুখি পরলো রানিয়া। ঘটনার আকস্মিকতায় এক হাত পিছু হটলো ও। বাইরে তাকিয়ে দেখলো, ওর বাবা-মা আর ছোটভাই সবাই ঘুমাতে চলে গেছে। সব রুমের দরজা বন্ধ। ড্রয়িংরুমেরও লাইট নিভে গেল। বাড়ি প্রায় অন্ধকার হয়ে আসলো। রানিয়া তা দেখে আঁতকে উঠলো। আবারও সামনে তাকিয়ে দেখলো, আভিয়ান ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখের হাবভাব ভালো ঠেকছে না রানিয়ার। লোকটা রেগে আছে নাকি? কথাটা ভেবে পরমুহূর্তে আভিয়ানের চোখের দিকে তাকাতেই বুক কেঁপে উঠলো রানিয়ার। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করলো ওকে। এখনই পালাতে হবে, এই মুহূর্তে। নচেৎ আজ ওর রক্ষে নেই। রানিয়া পিছু সরতে সরতে দৌড় দিলো পেছন দিকে ঘুরে। তবে খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। হাতে টান পরলো ওর। আভিয়ান ওকে সামনে টেনে এনে ঘরের দরজা আঁটকে দিলো। রানিয়ার দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। ও পিছু সরার চেষ্টা করতেই পা পিছলে পড়ে যেতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আভিয়ান ধরে বসলো ওকে৷ রানিয়ার পিঠ আর কোমরে হাত রেখে সামলে নিলো। রানিয়া একবার আভিয়ানের হাত, আরেকবার ওর চোখের দিকে তাকালো। আভিয়ান সরু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রানিয়া সম্মোহিত হবে ওই চাহনিতে, তৎক্ষণাৎ আভিয়ান কর্কশ স্বরে বলে উঠলো, “ব্যাপারটা একটু বেশিই ফিল্মি হয়ে গেল না? ওকে।”

কথাটা বলেই ঠাস করে রানিয়াকে ফ্লোরে ফেলে দিলো আভিয়ান। অকস্মাৎ এমন ঘটনায় রানিয়া হতভম্ব হলো। একইসাথে ব্যাথাও পেল কোমরে৷ “আহ” শব্দ করে উঠতেই আভিয়ান নিচু হয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো। এরপর সোজা নিয়ে বিছানার ওপরে ফেললো। রানিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিছানায় বসে ওর কাছে এগিয়ে চাদরের সাথে আঁকড়ে ধরা একটা হাত টেনে চেপে ধরলো। রানিয়া অপর হাতে শক্ত করে চাদর আঁকড়ে ধরে রেখেছে। আভিয়ানের চোখে চোখ পরলো ওর। দৃষ্টি কেমন অদ্ভুত শান্ত। এই চাহনি দেখেই রানিয়ার শরীর ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো৷ ও আভিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে কম্পিত স্বরে বলার চেষ্টা করলো, “আভিয়ান আমি আস. . .”

বাকিটা আর বলতে পারলো না রানিয়া। তার আগেই ওর নরম ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে ওকে থামিয়ে দিয়ে আভিয়ান ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, “হুশশ, চুপ।”

চলবে

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply