#আড়ালে_তুমি
#সামিয়া_সারা
#কাজিন_রিলেটেড_গল্প
পর্ব -২৬
সকাল সকাল এলাকাবাসীরা এসে হাজির হয়েছে রিফাতের কাছে। ঘুম থেকে উঠে রিফাত রীতিমতো হতবাক।
সবাই মিলে বলতে শুরু করেছে,
-আয়শার হউর বাড়ির একটা পোলা আইছে না কাইলগো, সুন্দার দ্যাখতে,ঐ পোলাডার অবস্থা বেশি ভালো না,ঈদগাহ -এর হোমকে রক্তে মাইক্কা পইড়া রইছে!
আরেকজন আবার তাকে থামিয়ে বললেন,
-ওই যে লম্ফা হইরা জম্মের ফর্সা মতোন..? হেরে হাসপাতালে নেওয়া লাগবে। নাইলে হে বাচপে না….
নীল,ইনায়া,আনায়া বেরিয়ে এসেছে। আনায়ার মাথায় কিছুই ঢুকছে না ওরা কী বলছে। তবে ইনায়া কিছু টা বোঝে। মানে আনানের অবস্থা খারাপ। ইনায়া হাত মোচড়াতে লাগলো। আতঙ্কে তার অবস্থা খারাপ। আনায়া ঠেলা দিয়ে ইনায়া কে বলল,
-কী বলছে ইনুপু? কীসের হাসপাতাল?
-আমিও বুঝতে পারছি না অনু্।
নীলের কানে কথা গুলো ঢুকতেই রিফাতকে ধাক্কা মেরে ঘরের মধ্যে ঢোকায়। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলে,
-বাইক বের কর রানিং! চাবি দে আমাকে।
রিফাত টেবিল থেকে চাবি নিয়ে নীলের হাতে দেয়। নীল এক ঝটকায় চাবি ছিনিয়ে বেরিয়ে বাইকে উঠে। রিফাত ও পেছনে এসে বসে সাথে সাথে। নীল দ্রুত বাইক স্টার্ট দেয়। ইনায়ার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে,চোখের পানি কোনো রকমে আটকে রেখেছে। আনায়াকে নাহলে শান্ত রাখা যাবে না।
.
.
.
আনানের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে মোড়ের পাকা রাস্তায়। নীল বাইক থেকে নেমে দৌঁড়ে সেদিকে যায়। আনানের মাথা তুলে নিজের কোলের উপর নেয়। গালে হাত রেখে দু বার ডাক দেয়,
-আনান! এই আনান!
আনান অচেতন। লম্বায় আনান আর নীল প্রায় সমান। আবার দৈহিক গঠনও কাছাকাছি। সুঠামদেহী। নীল রিফাতকে ডাকলো কাছে।আনানকে তুলতে তাকে সাহায্য করতে বলল। কোনো রকমে আনানকে নিয়ে সিএনজি তে তোলে নীল। রিফাত বাইক নিয়ে তাদের পেছন পেছন আসে। হসপিটালে এনে ইমার্জেন্সী ডক্টর কল করে। আনানের বেশ র*ক্ত ক্ষরণ হয়েছে। পাশাপাশি ঘাড়ে আঘাত লাগায় জ্ঞান নেই। ডক্টররা আনানকে অ্যাডমিট করে,দ্রুত স্যালাইন দিয়ে র*ক্ত ম্যানেজ করতে বলে। আনানের র*ক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ। এই র*ক্ত এখন কীভাবে জোগাড় করবে নীল। নীলের যে ও পজিটিভ। নীল মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো খামচে ধরলো। ঘেমে উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটার মধ্যে তামাটে ভাব এসেছে। চোখের কোণে হাত দিয়ে রিফাতের কাছে গিয়ে বলল,
-তোর র*ক্তের গ্রুপ কী?
-বি পজিটিভ…
-বি নেগেটিভ র*ক্তের গ্রুপ ম্যানেজ করে দে রিফাত! As soon as possible!
রিফাত মাথা নাড়ালো। ভার্সিটির গ্রুপে পোস্ট করে সাথে সাথে। কয়েকজনকে কলও করে। কাছের মানুষদের সকলেই তাকে বলে এই গ্রুপ এর র*ক্ত তো নেই। আর বাকি মানুষেরা ফোন তোলে না। মূলত পার্টির সবার সাথে ঝামেলা হলো গতকাল যারা রিফাতের বন্ধু ছিল। তাই সাহায্যকারীর সংখ্যা কম এখন। রিফাত আশাহত হয়ে নীলের সামনে দাঁড়ায়। দৃষ্টি ফ্লোরে রেখে বলে,
-ভাই পেলাম না।
নীল জবাব দেয় না। কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। ব্লাড ব্যাংকেও খোঁজ করেছিল। তবে লাভ হয়নি।
রিফাত কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলে,
-ভাইয়া…
-বল..
-ইনায়া এখন যে খুব ছোট তার নয়। আনানের জীবন টা…
-আমি ভাবছি রিফাত। আমার ইনু পাখিকে ছাড়া উপায় নেই। আমি ওকে নিয়ে আসছি রিফাত। তুই একেবারে আনানকে চোখে চোখে রাখবি। ওর যেন কোনো অসুবিধা না হয়।
কথা গুলো বলতে বলতে নীল চলে যায় বাইক নিয়ে। বাড়িতে তাড়াহুড়ো করে ঢুকে কোনো রকমে ইনায়াকে নিয়ে বেরিয়ে আসে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আর আনায়াকে ইনায়ার মামিদের কাছে রেখে আসে। ইনায়া একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে।
-কী হয়েছে নীল ভাই? আনান ভাইয়া কোথায়? কেমন আছে?
নীলের কানে কিছুই ঢুকছে না। কোনো জবাব দেয় না সে। ছোট ভাই এর এমন অবস্থা,তার উপর আবার র*ক্ত তার ইনুর থেকে নিতে হবে। সব এলোমেলো লাগছে নীলের। হসপিটালে যেতেই ইনায়াকে দেখে রিফাত এগিয়ে আসে।
বলে,
-আনানের অবস্থা খারাপ। র*ক্ত দিতে হবে,জ্ঞান নেই।
ইনায়া কান্না করে দেয় এবার। ফুঁপিয়ে উঠলো সে। বলল,
-আমার আর ভাইয়ার রক্তের গ্রুপ এক। আ…আমি দিব..
নীল কপালে তর্জনী আর বৃদ্ধা আঙ্গুল ঠেকায়। ঢাকায় থাকলে মুহুর্তে সব ম্যানেজ করে ফেলতো সে। এখনো হেলিকপ্টার এনে আনানকে নিয়ে যেতে পারতো। নীল এখানেই থাকার মতো এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়াতে নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকে। ইনায়াকে সাথে নিয়ে আনানের কেবিনে যায়। যাওয়ার আগে রিফাতের হাতে হাজার খানেক টাকা দিয়ে বলল,
-দুটো সিদ্ধ ডিম,চারটা ডালিম,চারটা বিটরুট,এক লিটার পানি,দুটো স্যালাইন এর প্যাকেট নিয়ে আয় জলদি গিয়ে। আর এক্সট্রা করে আরো এক লিটার পানি আন। সাথে একটা চাকু..
আনান চমকে তাকায়। নীল শান্ত করে বলে,
-ডালিম খাওয়ার জন্যে। ওয়ান টাইম প্লেটও আনিস।
রিফাত টাকা নেয় না। তবে নীল জোড় করে হাতে গুজে দেয়। বলে,
-যা তুই।
রিফাত টাকা টা বাধ্য হয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ইনায়া আনানের পাশাপাশি বেডে শুয়ে রয়েছে। প্রথম বার র*ক্ত দিচ্ছে। অনেক ভয় পেলেও আজ আনানের জন্য যেমন ভয় লাগছে তার কাছে ব্যাথার ভয় কিছুই না। নীল ইনায়ার পাশে বসতেই ইনায়া নীলের হাত শক্ত করে ধরল। নীল আরেক হাত নিয়ে ইনায়ার হাতের উপর রাখে। তারপর আলতো করে কপালে হাত দিয়ে বলল,
-কিচ্ছু হবে না….আমার দিকে তাকা ইনু…
ইনায়া নীলকে দেখে। কী গভীরতা চোখের মধ্যে। কী সুন্দর সরু নাক। ইনায়া তাকিয়ে থাকে একধ্যানে।ইনায়ার নাকের ডগা লাল হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নেয় নীলের।নীল ইনায়ার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর ইনায়ার দিকে তাকিয়ে মায়াভরা কণ্ঠে ডাক দেয়,
-ইনু
ইনায়ার যেন মাত্র হুস ফেরে। সাড়া দেয় নীলের ডাকে,
-হু…
-কষ্ট হচ্ছে?
ইনায়া ভ্রু ভাজ করে হাতের দিকে তাকালো। এক ঝলক হাতের দিকে তাকিয়েই নীলের দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,
-এতোকিছু কখন হলো?
-কী হয়েছে?
-আপনি ম্যাজিক জানেন?
এতো ঝামেলা চাপের মধ্যেও নীলের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো। মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো সে। ইনায়ার হাতের উপরে নীলের হাত। ডান হাতে ক্যানুলা দেওয়া। বাম হাত নীল ধরে রেখেছে। গতকালও নীল এই হাত ধরেছিল। ইনায়া একটু পরপর হাত ধরেছিল আর মুচকি হেসেছিল সারারাত ধরে। এখন আবার একই ভাবে ধরে রাখা দেখে ইনায়া মুচকি হাসে। নীল কপালে ভাঁজ করে প্রশ্ন করল,
-হাসছিস কেন?
-কী করলে আপনি এই হাত ছাড়বেন না?
-মানে কী?
-কাল থেকে এই হাতে আমি পানি লাগাইনি।
-কেন?
-গত রাতে এই হাতই ধরেছিলেন। তাই আমি আর কাউকে ধরতে দেইনি। এমনকি বাথরুমেও যাইনি।যেন হাত ধুতে না হয়…
নীল চোখ বড় করে ইনায়ার দিকে তাকালো। আচমকা এমন কথা শুনে দাঁত চেপে বলল,
-লাগাম টান! অসুস্থ ভাইকে পাশে অচেতন অবস্থায় রেখে প্রেমালাপ করছিস?
ইনায়া আনানকে দেখে। কিছু একটা ভেবে মায়া হয় তার। মুহুর্তেই মন খারাপ করে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে।
.
.
.
.
নীলের আদেশমতো রিফাত সব রেডি করে রেখেছে। এক্সট্রা করেও আরো অনেক কিছুই এনেছে। র*ক্ত দেওয়া শেষ হতেই নীল ওয়ান টাইম গ্লাসে পানি ঢালে। টিস্যু দিয়ে পেঁচিয়ে সিদ্ধ ডিম হাতে ধরিয়ে দেয় ইনায়ার। গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করে,
-দেরি করবি না, দ্রুত খাবি।
ইনায়া বেড থেকে নামতে গেলে নীল আবার বসিয়ে বলে,
-খবরদার ইনু! নড়বি না। এভাবেই থাকবি। আর যা যা দিব খাবি এখন।
ইনায়া চোখ টিপ টিপ করে নীল কে দেখলো। তারপর ঠোঁট উল্টিয়ে জিজ্ঞেস করে
-ভাইয়া সুস্থ হবে কখন?
-খুব দ্রুত ইনশাআল্লাহ। বাসায় জানানোর দরকার নেই কিছু।
-কেন?
-জানানো গেলে আমি ওকে ঢাকায় নিয়ে যেতাম ।রিস্ক নিয়ে এখানেই ভর্তি করেছি যাতে কেউ কিছু না জানে।
-এখানেও তো খারাপ না নীল ভাই…
-খারাপ বলতে তুই যা বুঝিস আমি তার বুঝাইনি। হসপিটালে কেউ ভর্তি হলে সবচেয়ে বেশি কী দরকার জানিস? জনবল,পাশে পাওয়া কাছের মানুষদের,পরিচিতি দরকার হয়। নাহলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। আর এখানে আমার কাছে এর কোনোটাই নেই।
ইনায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো নীলের কথা তে। প্রশ্ন করল,
-তাহলে বাড়ি ফিরবো কবে?
-আমি সাথে থাকতে বাড়ি ফেরার তাড়া কেন? যখন ছিলাম না তখন তো এই প্রশ্ন মাথায় আসেনি।
-আপনি সাথে থাকলে তো আমি..
-কথা বন্ধ! তোর এসব আউল ফাউল কথা তে আমি বিরক্ত হচ্ছি। খেয়ে নে চুপ চাপ।
ইনায়া মুখ ভার করে ফেলে। আশে পাশে হাতরে ফোন খোঁজে। ইনায়ার এমন হাবভাব লক্ষ্য করে নীল প্রশ্ন করল,
-কিছু লাগবে?
-আমার ফোন……
-চার্জ নেই নাকি! দিয়েছিলি?
-ওহ্ শিট্! বাদ দেন,লাগবে না।
-আমার টা নে
বলে নীল তার ফোন ইনায়ার দিকে এগিয়ে দেয়। ইনায়া সাথে সাথে ফোনটা নিয়ে নেয়। তার মনে হচ্ছে সোনার হরিণ পেয়ে গেছে। স্ক্রিন অন করেই নীল কে বলে,
-পাসওয়ার্ড?
-462921
-একি অদ্ভুত পাসওয়ার্ড! মনে রাখেন কী করে?
-বুদ্ধি থাকলে বুঝতি! গাঁধীর মতো আমায় জিজ্ঞেস করতে হতো না।
ইনায়া সন্দেহের দৃষ্টিতে নীলকে দেখে। পাসওয়ার্ড টা মাথায় প্যাঁচ লাগিয়ে দিল। হাতে হাতে গুনতে শুরু করে,
-4 মানে হলো D, 6 মানে F, 2 মানে B, 9 মানে..
-এতোটুকু মাথা নিয়ে আর কিছু ভেবো না । পা*গলি হয়ে একটু পরেই আবার বলবে dfbgba আমার বউ এর নাম! তারপর তোমায় নিয়ে পাবনা রেখে আসতে হবে। দেওয়ান বাড়ির বড়..
-থামলেন কেন? দেওয়ান বাড়ির বড় বউ?
গম্ভীর মুখে তাকালো নীল। বলল,
-বড় মেয়ে। বউ বউ করিস কেন! আর যেন না শুনি। যাই হোক একটু পরে বলিস না আবার যে dfbgba আমার বউ এর নাম।
ইনায়া মাথা চুলকায়। মনে মনে ভাবে,
-তাই ই হবে হয়তো। মনে হয় নাম উল্টো পাল্টা করে লিখা,যাতে কেউ না বোঝে।
সবগুলো অক্ষর একত্রিত করে নাম সাজাতে ব্যস্ত ইনায়া।
বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
-Dafbgb,fagbbd,gadbf…..
.
.
.
আনানের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হলো। নীল আনান দুজন মুখোমুখি। তবে কারো মুখে কোনো কথা নেই । আনান নীলের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারে ভাই এর উপর কেমন চাপ পড়েছে। আর নীলের চোখ যেন আনানকে বলছে,
-আমার জিনিসে আমার থেকে বেশি তোর টান থাকতেই পারে না আনান!
তবে কেউ কাউকে কিছুই বলে না। আনান পাশের বেডে ইনায়াকে দেখে প্রশ্ন করে,
-তোর কী হয়েছে ইনু?
-তোমায় র*ক্ত দিলাম ভাইয়া! জীবনে প্রথম বার দিলাম।
আনান কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। চকচক করতে থাকা চোখে ইনায়াকে দেখল।
বলল,
-আমাদের কতো মিল ইনু…
নীল আনানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সাথে সাথে জবাব দেয়,
-ভাই বোনের মিল থাকবেই! র*ক্তের সম্পর্ক তো,তাই র*ক্তের গ্রুপ ও এক। ঘুমা এখন।
ইনায়া শুনে অনেক খুশি হয়। ভাইয়া ভাইয়া করে ফেনা তুলে ফেলা মেয়েটার দিকে আনান হতাশ হয়ে তাকালো। সেদিকে এখন ঝলক দেখে চোখ বন্ধ করে নেয় আনান।
(পাসওয়ার্ড টার অর্থ কি আপনারা ধরতে পেরেছেন? গল্পটা অনেক স্পেশাল,আমি সাধারনত প্লান করে কাজ করি না। তবে এটা নিয়ে পরিকল্পনা অনেক বড়। আপনারা সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকবেন)
(চলবে……)
#Running
#episode:26
Written by #Samia_Sara
Story name: #আড়ালে_তুমি
আমার প্রিয় পাঠক পাঠিকারা, গল্পটি নিয়ে আপনাদের মন্তব্য শুনতে চাই। একদম সব্বাই কমেন্ট করে জানিয়ে দিন,কেমন লেগেছে আপনাদের কাছে। আর আগের পর্বে এতো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা। ভালোবাসা নিবেন
Share On:
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE