অর্ধাঙ্গিনী ( দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
নুসাইবা_ইভানা
পর্ব -২০, 21
জিয়ান আর নয়না সবে তালুকদার ম্যানশনে প্রবেশ করেছে। ঠিক সে সময় কল আসলো নাজিম চৌধুরীর ফোন থেকে।
জিয়ান কল রিসিভ করে ফোনটা কানের সামনে ধরতেই বলে, “এসব কখন হলো! আমি এক্ষুনি আসছি। কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছো?”
নয়না বোকার মতো তাকিয়ে রইলো জিয়ানের মুখের দিকে। জিয়ান কল কেটে নয়নাকে বলল, “তুমি বাসায় যাও, আমাকে এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে। আম্মুর অবস্থা ভালো নয়।”
“আমিও যাবো তোমার সাথে।”
“তুমি কিছু সময় রেস্ট নিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে তারপর আসো।”
জিয়ান আর অপেক্ষা না করে দ্রুত চলে গেলো।
নয়না বাসায় এসে গালে হাত দিয়ে সোফার উপর বসে আছে। সূচনা দরজা খুলে দিয়েছিলো। সূচনা নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, “কিরে টয়না, তুই বৌ সেজে কেনো বসে আছিস?”
“সূচনা, এখন আমার মন ভালো নেই, একদম কথা বাড়াবি না।”
সূচনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নরম কণ্ঠে বলল, “আপু, তোমার মন এখন কেনো ভালো থাকে না?”
নয়না অবাক নেত্রে তাকিয়ে রইলো সূচনার দিকে। মনে হচ্ছে সূচনা এই আট বছরে ভিষণ বড় হয়ে গেছে।
নয়না সূচনার গাল টেনে বলে, “কে বলল তোকে আমার মন ভালো থাকে না? আমার মন ভালোই ছিলো। কিন্তু আমার শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।”
“থাক, মন খারাপ করিও না। সুস্থ হয়ে যাবেন দেখিও।”
“পাঁকা বুড়ি! যাহ, দেখ টেবিলের উপর তোর জন্য চকলেটের প্যাকেট আছে। আম্মু কোথায় রে?”
“বাসায় নেই, ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন।”
নয়না নিজের রুমে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে শুয়ে পড়লো। মনটা ভিষণ খারাপ তার। এতগুলো দিন চলে গেলো, একটার পর একটা বিপদ যেনো লেগেই আছে। আবার কবে সেই সোনালী দিন ফিরে আসবে? নয়না বালিশে মাথা রেখে এসব ভাবনায় বিভোর।
শিল্পী বেগম এসে নয়নার দিকে এক গ্লাস ফ্রেশ অরেঞ্জ জুস এগিয়ে দিয়ে বলেন, “জুসটা খেয়ে নে। আমি তোর জন্য হালকা নাস্তা নিয়ে আসি, খেয়ে ঘুমা।”
নয়না বেশ অবাক হলো! শিল্পী বেগম কখনো সংসারের কোনো কাজ করেন না। এমনকি চাও কাউকে বানিয়ে দেন না। ছোট থেকেই দেখে আসছে এসব নয়না।
“ছোট আম্মু, জুসটা তুমি বানিয়েছো?”
“হ্যাঁ, নিজের হাতে বানিয়ে আনলাম। খেয়ে দেখ কেমন হয়েছে। বিয়ের পর থেকে এই সংসারের কোনো কাজ আমি করিনি। কোনো দায়িত্ব পালন করিনি। ভাবী একাই সবটা সামলে নিতেন। আমি নিজের উপর বিরক্ত ছিলাম। নিজেকে নিজের অসহ্য মনে হতো।”
“কেনো?”
“তুই জুসটা শেষ কর, আমি নাস্তা নিয়ে আসি।”
নয়না শিল্পী বেগমের হাত ধরে বলে, “তুমি এখানে বসো তো। তোমার সাথে গল্প করি। ভালো লাগছে না কিছু।”
শিল্পী বেগম বসলেন।
নয়না জুস শেষ করে বলল, “তা আমার ছোট আম্মু, এতো দায়িত্ববান কবে থেকে হলেন?”
“তোর হারিয়ে যাওয়া সব কিছু বদলে দিয়েছে। ভাবী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝেই উল্টো-পাল্টা কথা বলেন। নীলাঞ্জনার বেবি হয়। এই পরিবারটা কেমন ভেঙে যায়। এতো বছর ধরে এই সংসারে আছি, ভাবী কত যত্নে সংসারটা আগলে রেখেছেন। সেই সংসার কি করে ভেঙে যেতে দেই? তাই হাল ধরেছি।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হ্যাঁ, কর।”
“তুমি কি চাচ্চুকে পছন্দ করতে না?”
“আমি করতাম, তবে সে আমাকে পছন্দ করতো না। বাদ দে সেসব পুরোনো কথা।”
“কেনো পছন্দ করতো না! তুমি তো এই বয়সেও হেব্বি সুন্দরী, তখন তো আরো বেশি সুন্দর ছিলে।”
“সুন্দর হলেই কি কারো মন পাওয়া যায়? একসাথে সারাজীবন কাটিয়েও কারো মনের ধারে কাছেও পৌঁছানো যায় না। আবার হাজার মাইল দূরত্বে থেকেও কেউ কেউ হৃদয়ে থাকে।”
“কিছুই বুঝলাম না আম্মু। বুঝিয়ে বলো না।”
“এসব কথা কখনো পাঁচ কান করিস না। তোর চাচ্চুর আরেকটা বৌ আছে। আমি তার দ্বিতীয় বৌ। তোর দাদা মাহমুদ তালুকদার ছিলেন সমাজের গণ্যমান্য মানুষ। তার প্রভাব-আধিপত্য ছিলো বিশাল। তোর চাচা গোপনে বিয়ে করেছিলেন। সেই বিয়ে বাবা মেনে নেননি। যেদিন এই কথা জানতে পারেন, তার এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে তোর চাচার বৌ করে নিয়ে আসেন। এদিকে তোর বাবার ঘরে কোনো সন্তান হচ্ছিলো না। অন্যদিকে তোর চাচা আমার সাথে ঠিকভাবে কথাও বলতেন না। ছোঁয়া তো বহু দূরের কথা। এমন জীবন কি কোনো মেয়ে চায়? যে জীবনে তার স্বামী তার পাশে শুয়ে আরেক নারীর সাথে রাতভর কথা বলতো। তাও সে কথা জুড়ে থাকতো প্রেম-ভালোবাসা। ওই মহিলা জানতেন না তোর চাচা বিয়ে করেছেন আরেকটা। সে তখন কানাডায়, তার বেবি হয়েছে সেখানেই। কারণ দেশে তো কেউ জানে না সে বিবাহিত। তাই কানাডায় এক আত্মীয়ের বাসায় ডেলিভারি করিয়েছেন। একদিন, দুদিন, তিনদিন। কিন্তু সত্যি কি আর চাঁপা থাকে? মহিলা সম্ভবত অনেক ভালো ছিলেন। দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানার পর তোর চাচার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এই বছর খানেক পরে তোর চাচা আমার কাছে আসেন। তবে এই সংসারে শুধু আমি তার চাহিদা পূরণ করার এক হালাল মাধ্যম ছিলাম। কোনো ভালোবাসা কখনো দেখিনি তার হৃদয়ে আমার জন্য। দেখ, আমার মেয়ের কপালটাও আমার মতো খারাপ। মায়ের কপাল কেন পেলো আমার মেয়েটা?”
শিল্পী বেগম ওড়নার আঁচলে চোখের জল মুছেছেন।
নয়নারও চোখ ভিজে উঠেছে। এতদিন কত বাজে ভাবতো এই মানুষটাকে। অথচ মানুষটার মনের মধ্যে এক সমুদ্র দুঃখ পোষা। উপর থেকে দেখলে কারো ভেতর জানা যায় না। এতো সুন্দর সুখী ফ্যামিলি, সবাই দেখলেই বলবে কত ভাগ্যবতী সে। অথচ মনের মধ্যে কত হাহাকার আর বেদনা লোকানো।
🌿
ডাক্তার দ্রুত মিতা বেগমকে ওটিতে নিয়ে গেলেন। হার্ট অ্যাটাক করেছেন মিতা বেগম। ইমার্জেন্সি অপারেশন করাতে হবে।
জাহিন মাথা নিচু করে বসে আছে। তার চোখে অশ্রু। পৃথিবীতে একমাত্র এই মানুষটা তাকে ভালোবাসতেন। এই মানুষটা আজ তার জন্য মৃত্যুর মুখোমুখি। এসবের জন্য কি সে একা দায়ী? ছোটবেলা থেকে তার বাবা তাকে লুজার, অপদার্থ, না জানি আরো কত কী বলে এসেছেন। সেই রাগ, জেদ তাকে আজ এই রাস্তায় নিয়ে এসেছে। তার বাবার চেয়ে বড়লোক হওয়ার নেশা তাকে সহ আরো কত জীবন ধ্বংস করেছে। তার মাধ্যমে সে অনুভূতি কি জাগ্রত হবে জাহিনের মনে?
মেহনুর জাহিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। জাহিনকে কটু কথা শোনাতেই এসেছিলো।
জাহিনের উপর মেহনুরের ছায়া পড়তেই, জাহিন এক পলক মেহনুরের দিকে তাকালো। জাহিন হঠাৎ মেহনুর কোমর জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কান্না করতে করতে বলতে লাগলো, “আমি কি এতোই খারাপ যে কেউ আমাকে ভালোবাসে না? আমি ধ্বংস, তাই কেউ আমাকে ভালোবাসে না। মা, আমার মা, তাকেও আমি শেষ করে দিয়েছি। আমার মায়ের কিছু হলে শেষ করে দেবো আমি নিজেকে। এই জীবন আমার দরকার নেই। জঘন্য, নিকৃষ্ট একটা জীবন আমার। তোমার জীবনটাও আমি নষ্ট করছি। মেরে ফেলো আমাকে। আমি ক্ষমার অযোগ্য।”
মেহনুর জাহিনের মাথায় হাত রাখলো। চুপচাপ হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
ওই মুহূর্তে ওইটুকু স্পর্শ হৃদয় ছুঁয়ে গেলো জাহিনের। যে মানুষটাকে বিয়ের পর থেকে একটা দিনও শান্তি দেয়নি, সেই মানুষটার থেকে ওইটুকু সহানুভূতি যেনো জাহিনের পাপিষ্ঠ হৃদয়কে বরফের মতো গলিয়ে দিলো। জাহিন চুপ হয়ে সেইভাবেই আঁকড়ে ধরে রাখলো মেহনুরকে।
হঠাৎ নাজিম সাহেব জাহিনকে মেহনুরের কাছ থেকে টেনে এনে পরপর জাহিনের গালে থাপ্পড় দিতে লাগলেন।
মেহনুরের চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগলো। শতহোক, স্বামীকে এমন অসহায় অবস্থায় দেখে তার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
জিয়ান হাসপাতালে এসে এই অবস্থা দেখে দ্রুত নিজের বাবাকে সামলে নিলো।
নাজিম চৌধুরী চিৎকার করে বললেন, “চলে যেতে বল এই জানোয়ারটাকে। এতো মানুষ প্রতিদিন মরে, এই কুলাঙ্গার মরতে পারে না। আমার চোখের সামনে থেকে সরে যেতে বল এক্ষুনি, নয়তো আমি নিজের হাতে খুন করবো। এমন ছেলেকে মেরে ফেলতে আমার হাত এক বিন্দু ও কাঁপবে না।”
জিয়ান জাহিনকে বলল, “তুই আপাতত এখান থেকে চলে যা। পরে আসিস।”
জাহিন জিয়ানের পা আঁকড়ে ধরে বলে, “শুধু আম্মুর জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত এখানে থাকতে দে ভাই। তারপর আমি চলে যাবো।”
“বাবা রেগে আছেন। অতিরিক্ত রাগ বাবার স্বাস্থ্যের জন্য রিস্ক।”
জাহিন জিয়ানের পা ধরে বলে, “আমি ওই করিডোরের এক কোণায় পড়ে থাকবো। এইটুকু ভিক্ষা দে আমাকে। আমি কথা দিচ্ছি, আম্মুর জ্ঞান ফেরার পর চলে যাবো।”
জিয়ান জাহিনকে ইশারা করলো।
চলবে#অর্ধাঙ্গিনী (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
নুসাইবা_ইভানা
পর্ব -২১
হসপিটালের বারান্দার এক কোণে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে জাহিন। এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে নিজেকে। এত ক্ষমতা, এত টাকা—হঠাৎ করেই যেন সব কিছু মূল্যহীন মনে হচ্ছে। এই টাকা দিয়ে কী হবে, যে টাকা প্রিয়জনকে বাঁচাতে পারে না! এই টাকার জন্য জীবনে এত জঘন্য কাজ করেছি! অথচ এই টাকা মূল্যহীন।
জাহিন হাঁটু থেকে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তারা-ভরা আকাশে ঝলমল করছে এক ফালি চাঁদ। শূন্য আকাশের পানে তাকিয়ে বলে, “এ জীবনে আমি যা চেয়েছি, যেভাবেই হোক সেটা নিজের করে নিয়েছি। আমি এ জীবনে যা পাইনি, তা হচ্ছে ভালোবাসা। নিজের পিতার বাজে ব্যবহার। সব কাজে, সব সময় বাবা আমাকেই দোষী ভাবতেন। তাঁর চোখে জগতের সবচেয়ে জঘন্য সন্তান ছিলাম আমি। সিঙ্গার হতে চেয়েছিলাম, কত কটু কথা শুনিয়েছেন। আচ্ছা, আমার মধ্যে কি কোনো গুণ ছিল না, যেটা বাবার মন স্পর্শ করত? যে কাজের জন্য বাবা আমাকে একটু ভালোবাসতে পারতেন?
আমি যাদের কাছে ভালোবাসা চেয়েছি, তারা কেউ আমাকে ভালোবাসেনি। শুধু মা… আমার মা, এই মানুষটা আমাকে ভালোবাসতেন। আমার সব ভুল-ত্রুটি, সব কিছুর ঊর্ধ্বে ছিল আমার মায়ের ভালোবাসা। এই পৃথিবীতে এই একমাত্র মানুষ, যিনি আমাকে ভালোবাসতেন। আল্লাহ, তুমি আমার কাছ থেকে আমার মাকে কেড়ে নিয়ো না। আল্লাহ, আমার উপর দয়া করো।”
জাহিন চোখ মুছে আনমনে বলে, “এমন কত চাঁদনি রাতে আম্মু ছাদে আমার পাশে বসে আমার গাওয়া গান শুনতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, ‘তোর কণ্ঠে জাদু আছে বাবা। একদম হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দেখিস, একদিন তোর গান সবার মুখে মুখে থাকবে।’
আমি এমন ছিলাম না। আমাকে এই পরিবেশ, এই সমাজ এমন হতে বাধ্য করেছে। আমার এমন হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার বাবার।” কাঁদতে কাঁদতে একা মনে কথাগুলো বলছিল জাহিন। অবশেষে দু’হাত তুলে ধরল। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে, “আল্লাহ, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নি”কৃষ্ট মানুষ। আমার পা”পের সব শাস্তি আমাকে দাও। আমার মায়ের জীবনটা ভিক্ষা দাও, আল্লাহ। আমার পাপের শাস্তি তুমি আমার মাকে দিয়ো না। আমার জীবনের বিনিময়ে তুমি আমার মায়ের জীবন ফিরিয়ে দাও।”
মেহনুর বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে জাহিনের আকুতি দেখছিল। মেহনুরের চোখ জোড়াও ভিজে উঠেছে। নিজের পেটের উপর হাত রেখে বলে, “তোরা বাবা, আমাদের কাছে ফিরবে। এবার সব ঠিক হলেই তোর আগমনের সংবাদ জানাবো তোর বাবাকে। দেখবি, তোর আগমনে আমাদের সুন্দর একটা সুখী পরিবার হবে। আমার মতো তুই বাবার ভালোবাসা ছাড়া বড় হবি না। তুই সবার ভালোবাসায় বড় হবি।”
জিয়ান নাজিম চৌধুরীর পাশে বসে আছে। দু’জনেই চুপচাপ। মনে হাজার কথা, সান্ত্বনার বাণী, অথচ শব্দের সংকটে তা বেরোচ্ছে না মুখ ফুটে।
এর মধ্যেই ডাক্তার বেরিয়ে এসে বললেন, “পেশেন্টের অবস্থা ক্রি”টিক্যাল। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যা কিছু হওয়ার, তাই হবে। পেশেন্টকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।”
নাজিম চৌধুরী জিয়ানের হাতটা শক্ত করে ধরলেন।
জিয়ান নাজিম চৌধুরীর হাতটা আঁকড়ে ধরে বলল, “বাবা, আমি আছি তো। কিছু হবে না মায়ের। তুমি ভেঙে পড়ো না বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“কিছু ঠিক হবে না। ওই কু”লা”ঙ্গা”রটা সব শেষ করে দিল। আমার মিতাকে আমার কাছ থেকে কে”ড়ে নিল। মিতার কিছু হলে আমি ছাড়ব না ওকে। ভুলে যাব, ও আমার নিজের ঔরসজাত সন্তান।”
“শান্ত হও বাবা। জাহিন এই মুহূর্তে সবচেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। মাকে হারানোর শোক ও মেনে নিতে পারবে না। আমাদের চেয়ে ওর কষ্ট কোনো অংশে কম নয়। ওর জন্য হলেও আল্লাহ তা’আলা মাকে সুস্থ করে দিক।”
“ওই পা”পীর নাম নিবি না। এই নাম ধ্বং”সের নাম।” কথা বলতে বলতে নাজিম চৌধুরী সেন্সলেস হয়ে ঢলে পড়লেন জিয়ানের ওপর।
🌿
মেহনুর জাহিনের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আম্মিকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। আম্মির অবস্থা ক্রিটিক্যাল। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কিছু বলতে পারছে না ডাক্তাররা।”
জাহিন মেহনুরকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি বাঁচব না, আমার মায়ের কিছু হলে। নিজেকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করতে পারব না। সব ছেড়েছুড়ে ভালো হয়ে যাব আমি। আমার মাকে সুস্থ করে দাও প্লিজ। যা কিছু করতে হয় করতে বলো। ডাক্তারকে দরকার হলে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেব, তবুও আমার মায়ের কিছু হতে দেব না।”
“এখন এসব বলে কী হবে? এখন নামাজ পড়ো, আল্লাহ তা’আলার কাছে দোয়া করো। ভুল করার আগে ভাবতে হয়। একটা ভুল সারা জীবনের কান্না। সব ভুল শোধরানোর অপশন থাকে না। কিছু ভুল বুলেটের মতো এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় জীবনকে। তাই ভুল করার আগে তার পরিণতি ভেবে নিতে হয়। তোমার জন্য কতগুলো মানুষের জীবনে ঝড় চলছে। এই মানুষগুলো কী অ”ন্যায় করেছিল, বলতে পারো? এদের সবার অপরাধী তুমি।”
মেহনুর সরে এল। জাহিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। এই মুহূর্তে এত কঠিন কথা সে বলতে চায়নি। কিন্তু মাঝে মাঝে শক্ত হতে হয়। বোঝাতে হয়—একটা ভুল সারা জীবনের কান্না। কান্না করেও সেই ভুলের মাশুল শোধ করা যায় না।
জাহিন সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। আসলেই তো, কত মানুষের জীবন সে শেষ করেছে। সে জানত সামনের মানুষটার কোনো দোষ নেই, তবুও কত নিরীহ মানুষকে হ”ত্যা করেছে, গু”ম করেছে। দু’হাতে মাথা খামচে ধরে সে বসে পড়ল ফ্লোরে। ওই সব মানুষগুলোর আকুতিভরা মুখ ভেসে উঠতে লাগল চোখের সামনে। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে। এত কিছুর মধ্যেও সে ভুলে বসেছিল তুষির কথা। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে। জীবনের আয়ু যেন ফুরিয়ে আসছে। চোখের সামনে চারদিক ঝাপসা হয়ে এল। মুহূর্তেই “মা!” বলে চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল ফ্লোরে।
🌿
অন্তর পাগলের মতো তুষিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোথাও কোনো ক্লু পাচ্ছে না। হুট করে কীভাবে একটা মানুষ গায়েব হয়ে যেতে পারে? একবার জাহিনের প্রতি সন্দেহ হলো, কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানতে পারল জাহিন বাসায়। তুষির বাবা-মা সবাই পেরেশান। সকালে থানায় মিসিং ডায়েরি করেছে।
জাহিন চলে যাওয়ার পর তুষি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে আঁধার গভীর হচ্ছিল। তুষি চিৎকার করতে লাগল, “কে আছো? বাঁচাও আমাকে!” এভাবে চিৎকার করতে করতে তৃষ্ণায় গলা দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। রাত পেরিয়ে দিন, দিন পেরিয়ে আবার রাত—এভাবে ভয় আর তৃষ্ণায় এক সময় তুষির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, একবার যদি বাবা-মাকে ছুঁয়ে দিতে পারত! একবার যদি অন্তরের বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে পারত! চোখের জলের পরিবর্তে চোখের কোণ বেয়ে রক্ত ঝরছে। নয়নার মুখটাও ভেসে উঠছে। নয়নার কাছে ক্ষমা চাওয়া বাকি।
নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তুষি চিৎকার করে বলল, “আমি বাঁচতে চাই। একদিনের জন্য, এক ঘণ্টার জন্য হলেও প্রিয় মানুষগুলোর সাথে বাঁচতে চাই।” ধীরে ধীরে তার শ্বাস ভারী হতে লাগল। “আল্লাহ…” বলে ডাকল। পরের কথাটুকু আর মুখ থেকে বেরোনোর আগেই এ পৃথিবী থেকে মুহূর্তেই তুষির আত্মা বিদায় নিল।
তুষির নিথর দেহ, রক্তে ভেজা জামা—সেভাবে চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল। কেউ কি খুঁজে পাবে তুষির লাশ? নাকি এভাবেই পচে-গলে পোকামাকড়ের খাবার হবে তুষির দেহ? লাশটার কপালে কি কাফন আর দাফন জুটবে? তার প্রিয় মানুষেরা কি জানতে পারবে সে আর পৃথিবীতে নেই? তুষির লাল-নীল ভালোবাসার সংসার গড়া হলো না অন্তরের সাথে।
🌿
নয়না সেই কখন থেকে জিয়ানকে কল করছে, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। নয়না ড্রেস চেঞ্জ করে সুতির থ্রি-পিস পরে নিল। রান্নাঘরে ঢুকে প্লেটে একটু খাবার নিয়ে টেবিলে এলো। খাবার আর মুখে তোলার রুচি হলো না। খাবার রেখে এক গ্লাস পানি খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।
রাস্তায় বেরোতেই দেখা হলো ঈশানের সাথে।
ঈশান বলল, “কোথায় যাচ্ছ? দাওয়াত করে পালিয়ে যাচ্ছ নাকি?”
“আমার শাশুড়ি আম্মু অসুস্থ। সেখানে যাচ্ছি।”
“ওহ, সরি। কিছু মনে না করলে আমার সাথে চলো। কী হয়েছে উনার?”
“চলুন, যেতে যেতে বলছি।”
চলবে।
Share On:
TAGS: অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২, নুসাইবা ইভানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৭
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৫
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২ পর্ব ২২+২৩
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৯
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২ পর্ব ১৯
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ১১
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৩
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২ পর্ব ২৫
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ১৬
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ১