অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (৩৩)
সোফিয়া_সাফা
উদ্যানের জ্ঞান ফেরা মাত্রই সোলার এস্টেটবৃন্দ ওর কেবিনে জমায়েত হয়। অচেতন ফুলকে শেষমেশ মেলো, অনিলা সহ আরও কয়েকজন নার্স মিলে অন্য কেবিনে শিফট করেছে। হাসপাতালের পোশাক ছেড়ে নিজের অফ হোয়াইট সিল্ক শার্ট পরে নেয় উদ্যান। ওকে এতো স্বাভাবিক দেখে প্রত্যেকের চক্ষু চড়কগাছ।
“মাস্টার, আপনার কি মনে হয় না একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন?” সোহমের খোঁচা মারা প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকায় উদ্যান।
শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে, “এটা হসপিটাল, কোনো রেস্ট রুম নয় যে বসে বসে রেস্ট নেবো।”
টেবিলের ওপর থাকা ফোন হাতে নিয়ে কেবিন ত্যাগ করে উদ্যান। ওর পিছুপিছু বাকিরাও বেরিয়ে আসে। লুহান অনির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “ফুলকে একা রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে?”
উদ্যানের পা থেমে যায়। ঘাড় বাঁকিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, “মেয়েটাকে কোথায় একা রেখে যাওয়ার কথা বলছিস?”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল লুহান। সোহম লক্ষ্য করল, উদ্যানের মাথার ব্যান্ডেজের পেছন থেকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। অত্যন্ত চিন্তিত গলায় সে বলে উঠল, “গেল রে গেল, এতো মূল্যবান রক্ত অপচয় হয়ে গেল।”
মাথার পেছনে হাত দিয়ে ভেজা অনুভব করল উদ্যান। হাত সামনে এনে দেখল রঞ্জক পদার্থ লেগে আছে,
“আহ কারাহো! ঠিকঠাক ভাবে সেলাই করেনি কামচোর গুলা।”
অনি হালকা গলায় বলল, “সেলাই ঠিকঠাকই করেছে; তুই শরীরের ওপর জোর খাটাচ্ছিস।”
মেলোর দিকে হাত এগিয়ে দেয় উদ্যান। সঙ্গে সঙ্গে টিস্যু বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দেয় মেলো। হাত মুছতে মুছতে উদ্যান বলে, “কোথায় রেখে এসেছিস আমার ওয়াইফকে? সবাইকে দেখছি, ওকে দেখছি না কেন? আমাকে দেখতে আসেনি?”
একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে লুহান বলল, “ও পেছনের কেবিনে আছে।”
থমকে গেল উদ্যান, “এক মিনিট, ও কেবিনে আছে মানে? কি হয়েছে ওর?”
শুকনো ঢোক গিলল সোহম। বোকা হেসে বলল, “সার্জারির পর আর্জেন্ট রক্তের প্রয়োজন পড়েছিল।”
ভ্রু উঁচিয়ে উদ্যান বলল, “সো হোয়াট? এ নেগেটিভ রক্তধারী দুজন তো ছিল; ফিট অ্যান্ড ফাইন। তবুও এই প্রসঙ্গ আসছে কেন?”
মাথা নিচু করে নিল প্রত্যেকে। ওদের নীরবতায় খটকা লাগে উদ্যানের। দাঁতে দাঁত পিষে তেঁতো গলায় বলে, “এবার এটা বলিস না যে লোক দুজন পালিয়ে গেছে।”
সাহস জুগিয়ে অনি মুখ খুলল, “এতো অবাক হচ্ছিস কেন? রিদম এই ব্যাপারে জানতো, যেখানে ও নিজে বেঈমানী করেছে সেখানে লোক দুজন পালিয়ে যাওয়া আহামরি কিছু নয়।”
পকেটে হাত রেখে ঘাড় কাত করে দাঁড়ায় উদ্যান। ঠান্ডা গলায় বলে, “ও রিদম ছিল না; রিহান ছিল।”
চোখ বড় বড় করে প্রত্যেকে তাকাল উদ্যানের দিকে। রাত আনুমানিক এগারোটা। হাসপাতালের করিডরটা নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। এই শান্ত পরিবেশের মধ্যেই ওদের মন অশান্ত হয়ে উঠল। সোহম প্রশ্ন ছুড়ল, “রিহান কেন তোকে মারতে চাইবে?”
অনি বলল, “কেন চাইবে না? তেহকে হিংসে করে শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মেলাতে যে দুবার ভাবে না, সে নিঃসন্দেহে তেহকে মেরে ফেলার ইচ্ছাও রাখে।”
লুহানের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল, “তাহলে রিদম কোথায় গেল? যতই হোক, রিহান ওর ভাই। বাই অ্যানি চান্স ও রিহানের সঙ্গে হাত মেলায়নি তো?”
উদ্যান কাঠখোট্টা গলায় বলল, “রিদম ওর সঙ্গে হাত মেলালে, রিহান আমাকে মারতে আসতো না। যেখানে ও জানে খুব সহজেই আমরা ওকে চিনে ফেলতে পারি সেখানে রিস্ক কেন নেবে?”
অনি জানতে চাইল, “তুই এতো নিশ্চিত কীভাবে যে ও রিহান ছিল?”
উদ্যান কিছু বলার আগেই মেলো বলল, “আমারও সন্দেহ হয়েছিল। ও আমাকে ‘মেলোড্রামা’ বলে টিজ করেছিল। আমি ভেবেছিলাম রিদম হয়তো রিহানের ট্রিকস অ্যাপ্লাই করে ঠাট্টা করছে। তাই বিশেষ খেয়াল করিনি।”
ওর কথায় তাল মেলায় লুহান, “হ্যাঁ, ওর কণ্ঠও অদ্ভুত শোনাচ্ছিল। উপরন্তু, রিদম কখনো মেলোর গায়ে হাত তোলে না। সেখানে কথায় কথায় ও মেলোর হাত ভেঙে ফেলতে নিয়েছিল।”
তবুও প্রশ্ন থেকেই যায় উদ্যান এতো সিওর কীভাবে? অনি পুনরায় উদ্যানকে প্রশ্ন করল, “তুই কীভাবে বুঝেছিস?”
উদ্যান ভাবলেশহীন গলায় বলল, “ও যেই মুহূর্তে ছুরি বের করেছিল সেই মুহূর্তেই বুঝে গিয়েছিলাম। রিদম যেখানে পিঁপড়ে মারার আগে ১০ বার ভাবে সেখানে আমার বুকে ছুরি চালানোর কথা ভাববে আর আমি টের পাবো না, সেটা অসম্ভব।”
উদ্যান লক্ষ্য করল পেছনে থাকা অনিলা তাদের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। যদিও অনিলা রিহানের ব্যাপারে জানে তবুও অযাচিত কিছু শুনে ফেলতে পারে। তাই আর কথা বাড়ায় না উদ্যান। কথা ঘুরিয়ে বলে, “বাকি কথা এস্টেটে ফিরে হবে। আপাতত ওয়াইফির কি হয়েছে সেটা বল।”
সোহম বলতে শুরু করল, “রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। ওর রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ হওয়ায়…”
“ও আমাকে রক্ত দিয়েছে?” বিস্ময় ভর করল উদ্যানের চোখেমুখে। কিয়ৎক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আচমকা দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল,
“ওর রক্ত আমাকে দিয়েছিস কেন? তোরা খুব ভালো করেই জানিস, আমি কারও করুণা গ্রহণ করতে রাজি নই। যাদের রক্তের জন্য আটকে রাখা হয়েছিল তাদের কাছে আমি পাওনা ছিলাম। তারপরও তাদের ফ্যামিলিকে অনেক টাকা দেওয়া হতো।”
“ও রক্ত না দিলে দেরি হয়ে যেত। বাইরে থেকে রক্ত আসতে আসতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে তুই হেলের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যেতিস।” অনির অবান্তর কথার জবাবে রাগী চাহনি নিক্ষেপ করে উদ্যান,
“আমি কারও দয়ার জীবন চাইনি। তার চেয়ে জাহান্নামে যাওয়া ভালো ছিল।”
উদ্যানের আচরণ বাড়াবাড়ি বলে মনে হলো লুহানের কাছে। “মেয়েটা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তোকে রক্ত দিয়েছে। দয়া কিংবা করুণা করে দেয়নি।”
সরু চোখে তাকায় উদ্যান, “তাই নাকি? কোন বিষয়ে কৃতজ্ঞ সে?”
সোহম বলল, “তোর বাপ-দাদার টাকায় লাইফ লিড করেছে সেই বিষয়ে কৃতজ্ঞ।”
কেবিনের দিকে হাঁটা ধরল উদ্যান। বিড়বিড় করে বলল, “যাক, কৃতজ্ঞতা বোধ আছে তাহলে।”
“ওর কৃতজ্ঞতা বোধ থাকলেও তোর নেই, তেহ।” অনির কথায় পেছনে ফেরে উদ্যান,
“কোন বিষয়ে কৃতজ্ঞ হব, শুনি? আমি বিনামূল্যে কারও থেকে কিছু নিইনি।”
ফিক করে হেসে ওঠে অনি, “তোর জন্য আমরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছি। সেই তথ্য শুনে কৃতজ্ঞ থাকতেই হবে।”
প্রাণহীন ভঙ্গিমায় ঠোঁট নাড়ে উদ্যান, “কী তথ্য? আগে শুনি, তারপর ভেবে দেখব।”
অনিকে থামিয়ে লুহান বলল, “সব প্ল্যান আমার ছিল। ফুলের পেট থেকে সত্য কথা বের করার পুরো ক্রেডিট আমার।”
উদ্যান এবার সম্পূর্ণ পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। কাঁধ ঝাঁকিয়ে উচ্চারণ করে, “কী কথা?”
লুহানকে থামিয়ে সোহম বলে ফেলল। “ডাউটফুল, আবেশকে ভালোবাসে না। এই মহামূল্যবান তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি। ও নিজের মুখে স্বীকার করেছে।”
কিঞ্চিৎ পরিমাণেও ভাবাবেগ হলো না উদ্যানের মাঝে। বিমূঢ় চিত্তে দাঁড়িয়ে রইল, তার অভিব্যক্তি অনুধাবন করে উল্টো অবাক হয়ে যায় বাকিরা।
“কিরে, তুই খুশি হোসনি?” অনির প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে যায় উদ্যানের। বিরসতা ঝেড়ে বলে,
“আমার কি খুশি হওয়া উচিত ছিল?”
উপর-নিচ মাথা নাড়ে লুহান, “হ্যাঁ, অবশ্যই।”
ঠোঁটের কোণে হাসি টানল উদ্যান। ওকে হাসতে দেখে বাকিরাও হেসে উঠল। পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে মুখ বাঁকায় উদ্যান, “কষ্ট করে তথ্য বের করার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, কথাটা আমি আগে থেকেই জানি।”
উল্টো ঘুরে কেবিনে ঢুকে গেল উদ্যান। বাইরে থাকা বাকিদের হাসিও থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। হতাশার শ্বাস ফেলে পরস্পরের পানে তাকাল। মুখ টিপে হেসে ওঠে অনিলা, “বেশ হয়েছে। আমি যখন বলেছিলাম ‘ফুল আবেশকে ভালোবাসে না’ তখন বিশ্বাস করোনি আমার কথা। তেহ একদম তোমাদের সাধনার ওপর জল ঢেলে দিয়েছে।”
কেবিনের খোলা জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া প্রবেশ করছে। আজ আবহাওয়ায় আর্দ্রতা বেশি। বৃষ্টি না হলেও, কেমন যেন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি কণা আছড়ে পড়ছে ধরণীর বুকে। হঠাৎ মুখের খুব কাছে কারও উত্তপ্ত নিঃশ্বাস অনুমান করে চোখ-মুখ খিঁচিয়ে নড়েচড়ে ওঠে ফুল। নেত্রপল্লব খুলে নিজের ওপর উদ্যানকে ঝুঁকে থাকতে দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে যায়। ঝাঁকুনি খেয়ে উঠতে গেলে উদ্যানের কপালের সঙ্গে ফুলের কপালের সংঘর্ষ হয়। শুধু কপাল নয়, তাদের মাঝে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত চুম্বন সংঘটিত হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। বেসামাল মুহূর্তে উদ্যান হাত দিয়ে ঠোঁট ঢেকে নেয়। ফুলের ওষ্ঠ উদ্যানের হাতের বিপরীতে ঠেকল। তাদের দুজনের ঠোঁটের মাঝে হাতের তালুর ব্যবধান মাত্র। ফুল স্তম্ভিত চোখজোড়া রাখে উদ্যানের চোখে। তৎক্ষণাৎ আবারও পেছনে ঢলে পড়ে ফুল। অবিশ্বাসী সুরে আওড়ায়, “আ…পনি, কি করতে চাইছিলেন?”
সোজা হয়ে বসল উদ্যান। নেশাতুর দৃষ্টিতে ফুলকে মাপজোখ করে বলল, “এই শাড়িতে তোমায় জীবন্ত ফ্লাওয়ার লাগছে। তুমি রিয়েল কিনা পরীক্ষণ করে দেখছিলাম।”
হতভম্ব হয়ে গেল ফুল। মাথায় আঘাত পেয়ে বোধবুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে নাকি দানবটার? সব ভাবনা পায়ে দলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ফুল,
“আপনার ফ্রেন্ডরা বলল, আপনার বাঁচার চান্স নেই। বেঁচে থাকলেও কোমায় চলে যাবেন। সেই আপনি হঠাৎ সুস্থ হয়ে গেলেন কীভাবে?”
উদ্যান নড়েচড়ে বসল, তারপর হঠাৎ করেই ফুলের বিস্ময়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে টেনে ওঠাল ওকে। ফুলের শুষ্ক ঠোঁটের ফাঁক গলে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এল, “ক… কী করছেন?” ফুল বুঝে উঠতে পারছে না সে তোতলাচ্ছে কেন।
উদ্যান দুহাতে ফুলের দুহাত মুঠোয় নেয়। পরপরই ফুলের দুহাত ওরই পেছনে নিয়ে কোমরের সঙ্গে চেপে ধরে। আড়মোড়া করে ফুলকে নিজের কাছে টেনে নেয়। হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় রীতিমতো ছটফট করছে ফুল। উদ্যানের কী হয়েছে নিজেও জানে না। ফুলের গালে নাক ঠেকিয়ে বড় বড় শ্বাস নিল সে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“জানো ওয়াইফি, আমি ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে আর কখনো হয়তো দেখা হবে না আমার। মৃত্যুকে বহুবার কাছ থেকে অনুভব করলেও; এবার ভয় পেয়েছিলাম আমি। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে তটস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। যদি আমি মরে যেতাম, তাহলে তোমাকে এই সাজে দেখার দিগন্ত ছোঁয়া আকাঙ্ক্ষাগুলোও দাফন হয়ে যেত।”
উদ্যানের মুখ-নিঃসৃত কথাগুলো যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলল ফুলকে। অস্থিরতায় শিউরে উঠল সমগ্র শরীর। লজ্জাবতী গাছের ন্যায় হেলে পড়ল বিপরীতমুখে। উদ্যান তবুও থামল না, ধীরে ধীরে ফুলের কানে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। ফুলের স্নায়ুকোষে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। বুজে আসা চোখ মেলে ছোটার চেষ্টা বাড়িয়ে দিল।
“নিজেকে সংযত করুন। নিষিদ্ধ কিছু করে আমার মনকে আরও বিষিয়ে দেবেন না।”
বিরক্ত হয়ে ‘চ’ ধ্বনি উচ্চারণ করল উদ্যান। আচমকা ফুলের হাতদুটো একহাতে চেপে ধরে আরেকহাত চুলে গলিয়ে দিল। মুখের সমান্তরালে মুখ নিয়ে হাস্কি টোনে বলল, “তুমি নাকি ওদের কাছে স্বীকার করে নিয়েছ যে আবেশকে ভালোবাসো না। তাহলে আমাকে গ্রহণ করতে সমস্যা কোথায়?”
শুকনো ঢোক গিলল ফুল। ঠোঁট নেড়ে থিতু কণ্ঠে বলল,
“আপনার এই হঠাৎ ভালোবাসা ঠিক হজম হচ্ছে না আমার। গরিব মানুষ তো, দামি খাবার পেটে সয় না। যদি খোলাসা করে বলতেন, কেন ভালোবাসেন আমায়, তাহলে উপকার হতো।”
ফুলকে ছেড়ে দিল উদ্যান। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমার ওয়াইফ, তাই তোমাকে ভালোবাসি।”
“তাহলে শুরুর দিকে অত্যাচার করতেন কেন?”
“তখন ওয়াইফের প্রয়োজন উপলব্ধি করিনি।”
“তার মানে আমি শুধুই আপনার প্রয়োজন; প্রিয়জন নই?”
“আমার প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষমতা সবার নেই। যার আছে সেই আমার প্রিয়জন।”
উদ্যানের কথার মারপ্যাঁচ কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয় ফুল। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে, “যদি শত্রু থেকে প্রিয়জন হওয়ার সেতু শুধুমাত্র ‘প্রয়োজন’ হয়? তাহলে প্রয়োজন নামক সেতু ভেঙে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন না তার কি গ্যারান্টি আছে?”
হঠাৎ করে পুনরায় ফুলের দিকে ঘুরে গেল উদ্যান। একহাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরল শাড়ি দ্বারা বেষ্টিত ফুলের মসৃণ, নারীসুলভ কোমর। শাড়ির ওপর দিয়েই যেন ফুলের কোমরের ভাঁজ অনুমান করতে পারছে দানবটা। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল ফুল। ভোলা-ভালা চোখে এদিক-ওদিক পালানোর পথ খুঁজতে লাগল। তার সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পায়ে ঠেলে ভরাট গলায় উদ্যান বলল, “গ্যারান্টি বলে আদতে কোনো কিছু নেই। সবকিছুই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। দ্বিধা, ভয়, সংকোচ নিয়ে ভালোবাসা যায় না। আমার ভালোবাসা আমার মতোই অপ্রতিরোধ্য, নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে। তোমার মতো অঙ্ক কষে কিংবা ভাবনা চিন্তা করে ভালোবাসিনি আমি।”
শেষবারের মতো ফুলের কানে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয় উদ্যান। তারপর উঠে দাঁড়ায়। গাম্ভীর্যের সহিত বলে, “এস্টেটে চলো।”
হাঁটা ধরল উদ্যান। টালমাটাল পায়ে বেডের বাইরে পা রাখে ফুল। পেছন থেকে বলে ওঠে, “শত্রু থেকে প্রিয়জন হওয়ার সেতু ‘প্রয়োজন’ হয়ে থাকলে, আমি অক্সিজেনের মতো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠব মিস্টার মনস্টার; সো বি কেয়ারফুল। ফুলকে পোড়াতে সাবধানে আসবেন। কারণ ফুল পুড়বে আর উদ্যান অক্ষত থাকবে, তা নেহাতই অসম্ভব।”
থমকে দাঁড়াল উদ্যান। কেমন যেন অদ্ভুত চোখে ফুলের পা হতে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। উদ্যানকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় ফুল। ওর পিছু পিছু হাঁটা ধরে উদ্যান।
“তাহলে উদ্যান যখন পুড়েছিল, তখন ফুল দগ্ধ হয়নি কেন? ফুল কেন সেই ভয়াবহ দাবানল সম্পর্কে অজ্ঞ?”
উদ্যানের বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো বুঝতে অক্ষম হয় ফুল। পাশ ফিরে বলে, “কিছু বললেন?”
ডানে-বামে মাথা নেড়ে ফুলের সঙ্গে পা মেলায় উদ্যান।
এস্টেটে ফিরতে ফিরতে রাত গভীরতার শীর্ষে পৌঁছায়। নিজের কক্ষে এসে হট শাওয়ার নিল ফুল। শাড়ি পাল্টে বাদামী রঙের থ্রি-পিস গায়ে জড়িয়ে নিল। তন্মধ্যে দরজায় কেউ নক করল। দরজার কপাট খুলতেই রুমা মৃদু হেসে বলল, “মিস্ট্রেসা, আপনার খাবার কি এখানেই দিয়ে যাবো? নাকি বাকিদের সঙ্গে বসে খাবেন?”
শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ফুলের, তবুও রুমে বসে খেতে ইচ্ছা করছে না একদম। “একসাথে বসেই খাব।”
মাথা নেড়ে চলে গেল রুমা। মাথার তোয়ালে খুলে চুলগুলোর পানি ভালো করে মুছে নিল ফুল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে ময়েশ্চারাইজার মাখছে সে। প্রতিবিম্বের দিকে নজর যেতেই ফুল কিছুটা মিইয়ে গেল। মনে পড়ে গেল উদ্যানের ঠোঁটের স্পর্শের কথা। মিটিমিটি হেসে উঠল ফুল। পরমুহূর্তেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। ওড়নার একপ্রান্ত মুঠোয় নিয়ে একাধারে কান ঘষতে শুরু করল।
ডাইনিং রুমে সবাই খেতে বসেছে।
“ও আসবে বলেছে?” উদ্যানের প্রশ্নে উপর-নিচ মাথা দোলায় রুমা। “হ্যাঁ, মাস্টার।”
“ঠিক আছে, খাবার সার্ভ করে দাও।”
“যত দ্রুত সম্ভব রিদমকে খুঁজে বের করতে হবে। না জানি ওর সাথে রিহান কী করেছে।” অনির কথায় সম্মতি জানায় উদ্যান, কিন্তু সোহম বলে,
“আরে ভাই হয় ভাই, আজেবাজে কিছু করবে না। চিন্তা করিস না।”
অনি বলল, “হ্যাঁ, তাছাড়াও রিদম আমাদের প্রজেক্ট সম্পর্কে সবকিছু জানে। কোনোভাবে ওর থেকে কথা আদায় করতে পারলে ঝামেলায় পড়ে যাব।”
উদ্যান টেবিলের ওপর হাত রেখে দায়সারা ভঙ্গিতে বলল, “ও কিছুই বলবে না। কারণ ও খুব ভালো করেই জানে রিহানের মতো খবিশকে কীভাবে ঘোল খাওয়ানো যায়। আমি ভাবছি, এস্টেটে অবস্থানরত কার এতো বড় স্পর্ধা হলো যে আমার সাথে বেইমানি করে রিহানের সাথে হাত মিলিয়েছে।”
জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছিল রুমা। উদ্যানের তিরিক্ষি মেজাজে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে সে। অনেকটা পানি গ্লাসের বাইরে ছিটকে পড়ে। নাদিয়া এগিয়ে এসে কিচেন টাওয়াল দ্বারা তৎক্ষণাৎ টেবিল পরিষ্কার করে ফেলল। এক মুহূর্তের জন্য বাতাসের পিঠে স্থবিরতা ভর করল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে লুহান বলল,
“বেইমানি করেছে মানে? কার ঘাড়ে মরার ভূত চেপেছে?”
মেলো বলল, “আমারও মনে হয় এস্টেট হতে রিহানের কাছে কেউ আমাদের তথ্য পাচার করছে। নইলে সোহম কোন রুটে মালামাল সাপ্লাই করবে সেটা ওর জানার কথা নয়।”
খুক খুক করে কেঁশে ওঠে অনি। সবাই কথা থামিয়ে খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। অনিলা তখনও গোল গোল চোখে চেয়ে আছে। ওর চোখে হতভম্বতার ছাপ। মাঝে মাঝে বাকিদের কথাগুলো ওর মাথার উপর দিয়ে যায়। পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না। আলতো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে ফুল। ডাইনিং রুমে এসে দেখে উদ্যান বাদে বাকিরা খাবার খাচ্ছে। উদ্যানের পাশের চেয়ার টেনে বসতে ইশারা করল নাদিয়া। ফুল দোনোমোনো করে বলল, “আমি তোমাদের সাথে বসে খেতে পারব না, নাদিয়া আপু।”
স্থির চোখে ফুলের গতিবিধি পরখ করতে লাগল উদ্যান। ঠোঁট নেড়ে যতটা সম্ভব নরম গলায় বলল,
“তুমি এখানে, আমার পাশে বসে খাবার খাবে।”
তেছরা চোখে তাকায় ফুল। আজ কিছুটা ত্যাড়ামি না করলেই নয়, “আমি আপনার পাশে বসে খাবো না। কারণ আমি আত্মসম্মানহীন নই।”
উদ্যান বসা থেকে উঠে ফুলের বাহু চেপে ধরে ওকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিল। কাঠ কাঠ গলায় বলল,
“হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ‘আত্মসম্মানহীন’? আমার পাশে বসে খাবার খেলে তোমার সম্মান বাড়বে বৈ কমবে না। চুপচাপ খাও; শরীর ভালো নেই আমার, তর্ক-বিতর্কে জড়াতে চাই না।”
বাড়তি কথা বলল না ফুল। এমনিতেও খিদে পেয়েছে। সারাদিন অভুক্ত থাকায় পেটের মধ্যে মেঘ গুড় গুড় করছে। ভাবতেও অবাক লাগছে, এই দানবটার চিন্তায় চিন্তায় সে সারাদিন উপোস ছিল।
হুহ্! এখন পেট পুরে খেয়েদেয়ে জম্পেশ ঘুম দেবে। একে একে প্লেটে সবগুলো পদের খাবার তুলে নিল ফুল। তারপর আয়েশ করে খেতে লাগল। সে খাওয়াদাওয়ায় এতোটাই মত্ত ছিল যে উদ্যানের গভীর দৃষ্টি অনুমান করতেই পারল না। উদ্যানের সেই নিগূঢ় দৃষ্টি প্রথমে ফুলের কপাল, চোখ, নাক, গালে বিচরণ করে ঠোঁটে গিয়ে থামল। শুকনো ঢোক গিলে চোখ সরিয়ে নিল উদ্যান। কিয়ৎক্ষণ পর আবারও নজর বুলাল ফুলের ফর্সা, নরম, আকর্ষণীয় হাত আর গলায়। নিশ্চয়ই ফুলের সবকিছুই ফুলের মতোই কোমল আর স্নিগ্ধ। খেতে খেতেই ফুলের নজর যায় উদ্যানের দিকে। চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের। ভুবন ভোলানো হাসি উপহার দিল ফুল, “খাচ্ছেন না কেন?”
ফুলের ওপর খানিকটা ঝুঁকে গেল উদ্যান। ফলস্বরূপ ফুল নিজেও পাশে থাকা অনিলার ওপর ঢলে পড়ল। সামান্য ‘খাচ্ছেন না’ বলার কারণে কেউ এভাবে তেড়ে আসে? মাঝেমধ্যে উদ্যানের কাজকর্মে ফুলের প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। উদ্যান ফুলের বাম হাত টেনে সোজা করে বসায়। তারপর ফুলের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা খাদ্যকণা মুছে দিয়ে বলে,
“আজ তোমার হাতে খাবো; সেই আশায় বসে আছি। খাইয়ে দাও।”
উদ্যানের আবদারে লুহান ও সোহম বিষম খেল। হিঁচকি উঠে গেল ফুলেরও। নাদিয়া, রুমাসহ আরও কয়েকজন সার্ভেন্ট এসে পানি এগিয়ে দিল। মেলো শুধু মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। তার উভয় কানে এয়ারপিস গোঁজা। ফুল আসার পরপরই শ্রবণশক্তিতে সীমারেখা টেনেছে। এক গ্লাস পানির সবটুকু ঢক ঢক করে খেয়ে হাঁফ ছাড়ল ফুল। উদ্যান তখনও নিষ্পলক চোখে চেয়ে আছে। ফুল ইতস্তত করে বলল, “আপনি নিজের সেন্সে নেই। তাই উদ্ভট আবদার করছেন।”
উদ্যান নিজের সিদ্ধান্তে অটল। “খাইয়ে দাও, ক্ষুধা লেগেছে।”
বোকা হাসল ফুল। ছোট ছোট চোখে উদ্যানের পানে তাকিয়ে একটা একটা করে আঙুল মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। ভাবাবেগ হলো না উদ্যানের মাঝে। ফুল নিজের হাত এমন ভাবে চেটে খাচ্ছে যেন ওটা হাত নয় আইসক্রিম। অতঃপর নিজের লালা মিশ্রিত হাত প্লেটে রেখে বলল, “এখনও আমার হাতে খেতে চান?”
ফুলের হাতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে উপর-নিচ মাথা দোলায় উদ্যান। মুখ ফুটে বলে, “হয় তুমি খাইয়ে দেবে নয় আমি…” মেলোর দিকে ইশারা করে, “মেলোর হাতে খাব।”
কানে এয়ারপিস থাকায় উদ্যানের কথা শুনতে পায়নি মেলো। বাকিরাও ওদের কাহিনী দেখছে আর হাসি আটকে খাবার গিলছে। শুধু লুহান উদ্যানের শেষ কথাটুকু শুনে খুশি হতে পারেনি। ফুল তো হাঁ হয়ে গেছে।
“কি হলো? খাইয়ে দেবে কি দেবে না?”
এতো কিছু করার পরেও, উদ্যান ফুলের হাতে খাবার খাবে এই কথাটা মানতে নারাজ ফুল। মনের সংশয় দূর করতে অবশেষে এক দলা খাবার নিয়ে উদ্যানের ঠোঁটের কাছে ধরল। উদ্যান নিজের প্রখর আঁখিদ্বয় ফুলের মাঝে নিবদ্ধ রাখল। ওর কাঁপাকাঁপা হাত স্থিতিশীল রাখতে আলতো হাতে চেপে ধরল। অতঃপর হাত সমেত ভাতের দলা মুখে পুরে নিল। ফুলের শিরদাঁড়া বেয়ে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। প্রত্যেকটা লোমকূপে আলোড়ন ছড়িয়ে পড়ল। অস্থিরতা ওর সমস্ত সত্তাকে ছাপিয়ে গেল। উদ্যান হাত ছেড়ে দেওয়া মাত্রই উঠে দাঁড়ায় ফুল। ফ্যালফ্যাল চোখে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে… এক ছুটে ডাইনিং হল ত্যাগ করে।
চলবে,,,
Share On:
TAGS: অবাধ্য হৃৎস্পন্দন, সোফিয়া সাফা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১২
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৪
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১১
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৫
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৬
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৫
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৬