Golpo romantic golpo অন্তরালে আগুন

অন্তরালে আগুন পর্ব ২৬+২৭


#অন্তরালে_আগুন

#পর্ব:২৬

#তানিশা সুলতানা

দেবেন্দ্র কলেজের ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট পুরোটাই ফাঁকা। সকলেই মন্ত্রী এবং তার ছেলেকে দেখতে ব্যস্ত। এদিকে কারো আসার সময় নেই। নুপুর ফাঁকা দেখে একটা ক্লাসে ঢুকে পড়ে। ধপাস করে দরজা লাগিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বারবার অসম্মানিত হতে হতে নিজেকে কেমন মূল্যহীন মনে হয়।

এই মানুষটাকে নিয়েই নুপুর ভাবে। একটা মাস না দেখতে পেয়ে কেমন ছটফট করছিলো। প্রতিরাতে এই মানুষটার ফেসবুক আইডি সার্চ করে তার পিকচার দেখতো। কি হয়ে গেলো নুপুরের?

নিজেকে হারিয়ে ফেলল একটা বেপরোয়া হার্টলেস খারাপ মানুষের মাঝে। যে শুরু থেকে এই পর্যন্ত শুধু তাকে সম্মান করেই এসেছে। নিজের লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেছে সে।

কি করার স্বপ্ন ছিল আর এখন কি করছে?

ছিহ নুপুর

__

একে একে সকলেই ছোটখাটো বক্তব্য শেষ করে। কি শ্রুতি মধুর তাদের কথা বলার ধরন। যেনো জনগণের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করতে প্রস্তুত তারা। ভোটে জয়ী হলে মানিকগঞ্জ শহরটাকে সুইজারল্যান্ড বানিয়ে দেবে।

সাধারণ জনগণ তাদের বক্তব্য শুনে হাততালি দিতে থাকে। অবশ্য তারা বক্তব্য শুনছে কিনা কে জানে।

সকলের নজর আটকে আছে নওয়ান তালুকদারের দিকে।

পায়ের উপর পা তুলে আয়েশী ভঙ্গিমায় বসে আছে সে। দুই ভ্র আড়াআড়ি ভাবে কুঁচকে গভীর মনোযোগে ফোন দেখছে। ঠোঁটের ভাজে সিগারেট।

তার সিগারেটের টান দেওয়ার দৃশ্যটাও একটা আর্ট। শত শত রমণী পাগল হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

সিগারেটের একটু ছাই নওয়ানের টি শার্টে লেগে যায়। নায়েব তালুকদার খুবই যত্ন সহকারে টি শার্ট হতে ছাই টুকু মুছে দেয়। এবং বাতাসে একটু এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো খুবই যত্ন সহকারে ঠিকঠাক করে দেয়।

সাধারণ জনগণের হৃদয়ের দাগ কেটে যায় এই দৃশ্য খানা। বাবা তো বাবাই

সে ধনী হোক বা দরিদ্র।

সন্তানের কাছে সে সর্বদাই সুপার হিরো। বাবাদের কাছে সবকিছুর আগে তার সন্তান।

তবে যে বাবারা প্রচন্ড পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে তারাও সন্তানদের ভালোবাসে কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনা। কি করে ২ টাকা রোজগার করবে কিভাবে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবে এসব ভাবতে ভাবতেই তাদের সময় চলে যায়। কখন একটু ভালোবেসে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাবে?

আবির ছিলো ভিড়ের মধ্যে। কিছু ছেলেদের সঙ্গে মিশে। এই ছেলেগুলো শিক্ষামন্ত্রীর হায়ার করা। এত বডিগার্ড পুলিশ থাকার পরেও নায়েব তালুকদার চিন্তিত। সেজন্য তার ছেলেপেলে দেরও এখানে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচনের আগে কোন ভুল ত্রুটি করা চলবে না।

আবিরের খুব খারাপ লাগে। সেও তো ছেলে। তাকেও তো জন্ম দিয়েছে। তাহলে তার জন্য ভালোবাসা বরাদ্দ নেই কেনো? কেনোই বা তাকে ভালোবাসা যায় না?

মায়ের কাছে শতবার প্রশ্ন করেছে সে। তবে তিনি জবাব দেয়নি।

এড়িয়ে গিয়েছে। এই যে যেমন এখন মানিকগঞ্জ ছেড়ে রংপুর গিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকছে। আবিরও গিয়েছিলো সাথে কিন্তু গতকাল রাতে নায়েব তালুকদার কল করে আসতে বলেছে।

আবিরের চোখের কোনে অশ্রু জমে। অতি গোপনে চোখ মুছে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

সকলের বক্তব্য দেওয়া ইতিমধ্যেই শেষ। এবার সকলে আবদার করেছে তারা নওয়ানের থেকে একটা গান শুনতে চাই। বলা বাহুল্য সকলে নওয়ান তালুকদারের গানের ফ্যান। গর্বে নায়েব তালুকদারের বুকটা ফুলে ওঠে। তার ছেলের গানের গলা অপূর্ব। মহান আল্লাহ তা’আলা তার ছেলেটাকে খুবই যত্ন সহকারে সৃষ্টি করেছে। মাশাল্লাহ সবদিক থেকে পারফেক্ট সে। এমন রাজপুত্র শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ভার।

এমনটাই ভাবে নায়েব তালুকদার।

বল্টু কোথা থেকে একটা গিটার জোগার করে নিয়ে আসে। সেটা নওয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে

“ভাই মেলাদিন হয়ে গেল আপনার গান শুনি না।

গাইয়া ফেলান একখান গান।

নওয়ান ফোন বন্ধ করে পকেটে পুরে। ঠোঁটের ভাজে থাকা সিগারেটটা ফেলে দিয়ে গিটার হাতে নেয়।

দুই হাতের কায়দায় টুং টাং আওয়াজ তুলে। হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত রয়েছে এখানে। মানুষ বেশি সোরগোল একটু হবেই। তবে গিটারের আওয়াজে সকলে সাইলেন্ট মুডে চলে যায়।

নওয়ান চোখ দুটো বন্ধ করে মধুর সুরে গেয়ে ওঠে

“এ বুকে এতো প্রেম, তার চোখে ঘৃনা”

চায়না শুনতে সে এই বুকের কান্না..

আমি চোখের বালি,কি করে তাকে বলি

এই বুকে কি বেদনা…

বোঝেনা সে বোঝে না

সে তো আজও বোঝে না”

কাঁদে মনের কথা,প্রেম কি শুধু ব্যথা

উত্তর আজও মেলে না..

মেলে না,মেলে না…

সকলেই গভীর মনোযোগে নওয়ানের গান উপভোগ করে। নুপুরের কানেও পৌঁছে যায় এই সুর। সেও আখি পল্লব বন্ধ করে গান শুনে। হারিয়ে যায় শ্রুতিমধুর মন ভোলানো বিরহের গানে। ভুলে যায় কিছু মুহুর্ত আগে খাওয়া থা/প্প/ড়ের কথা। নিজেও ঠোঁট নারিয়ে একটু আধটু সুর মেলায়।

গান শেষ হতেই হাত তালির আওয়াজে চারিদিক মুখোরিত হয়। চাপা গুঞ্জন শুরু হয় সমাবেশে। নওয়ান তালুকদার এমন বিরহের গান কেনো গাইলো? সকলের জানামতে তার জীবনে তো কোনো দুঃখ থাকার কথা না। হ্যাঁ মাস খানেক আগে চেয়ারম্যানের মেয়েকে জোর করে বিয়ে করেছিলো সে, এবং চার পাঁচ দিন পরে সেই বিয়ে ভেঙে ও দিয়েছে। আজকে প্রাক্তন স্ত্রীকে সকলের সামনে থাপ্পড় কেন মারলো? আর কেনোই বা এমন বিরহের গান গাইলো।

তবে কি প্রাক্তন স্ত্রীর বিরহে ব্যথিত মন্ত্রীর ছেলে?

স্বয়ং মন্ত্রী সভার আয়োজন করেছে সেখানে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে না? সেটা কি হয়?

ভরপুর বিরিয়ানি খাওয়ানো হচ্ছে সবাইকে।

নওয়ান স্টেজ থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের ভেতরে ঢুকে পড়ে।

তার পেছন পেছন বল্টু সহ আরো কয়েকজন যায়। মূলত মন্ত্রীর ছেলেকে প্রটেকশন দেয়ার জন্যই তারা সঙ্গে গিয়েছে।

ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টটা একটু বেশি সুন্দর। দুপাশে দুটো বড় বিল্ডিং। একটা তিন তালা এবং অপরটা দুই তলা। সামনে বিভিন্ন ফুল গাছ এবং কলেজ চত্বর। বিশাল বড় বটগাছও রয়েছে।

বল্টু বলে

“ভাই আপনি এদিকে আসলেন যে?

নওয়ান জবাব দেয় না। হাতে থাকা ফোন খানা পকেটে পুরে একটা সিগারেট ঠোঁটের ভাজে গুঁজে নেয়। শেষ এই একটা সিগারেটই ছিলো প্যাকেটে। বেনসন সিগারেটের খালি প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলে দূরে। তারপর বল্টুর দিকে তাকাতেই বল্টু আগুন জ্বালিয়ে দেয় সিগারেটে।

নওয়ান মনের সুখে টান দেয়।

তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে

“এখানেই ওয়েট করো সবাই। আমি পাঁচ মিনিটে আসছি।

নওয়ান সামনে এগোতে যেতেই দেখতে পায় আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে এদিকে আসছে নুপুর। বল্টু আঙুল তাক করে জোরে বলে ওঠে

“ভাই ওই যে দেখুন ভাবি আসছে।

নুপুর ও শুনতে পেয়েছে বল্টুর কথা। সে দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে আসে।

নওয়ানের দিকে আঙুল তুলে বলে

“আমাকে থাপ্পর দেওয়ার সাহস হয় কি করে? কি ভাবেন নিজেকে? সব সময় সব জায়গায় ইনসাল্ট করবেন? আমি মানুষ না?

নওয়ান পকেটে দুই হাত পুড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া উড়াতে ওড়াতে বলে

“আঙ্গুল নামিয়ে কথা বলো।

নুপুর সত্যিই আঙ্গুল নামিয়ে নেয়। চারিপাশে নজর বুলিয়ে সবাইকে এক পলক দেখে। তারপর সরে গিয়ে দু পা পিছায়।

“বল্টু ওকে ওর বাসায় দিয়ে আয়।

“আমি একাই যেতে পারবো।

” আই নো

তবুও বল্টুর সাথে যাবে।

নুপুর আরও কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু তাকে বলতে না দিয়ে নওয়ান পূণরায় বলে

“স্টপ ইউর মাউথ।

যাও

নুপুর নওয়ানকে এক পলক দেখে বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। পেছন পেছন বল্টুও দৌড় দেয়।

____

একমাস পরে বাড়ি ফিরবে নওয়ান। তালুকদার বাড়ি মেতে উঠেছে অন্যরকম সাজে। আমিনা বেগমের খুশি যেনো ধরছে না। ছেলে যা যা খেতে ভালোবাসে সবকিছু নিজে হাতে রান্না করছে। ছেলের ঘর গুছিয়েছে জামাকাপড় ঠিকঠাক করে রেখেছে।

দুপুর হওয়ার আগেই সব কাজ শেষ করে বাড়ির মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার কলিজাটা ছটফট করছে। কখন দেখবে রাজপুত্র কে। একটা মাস দেখেনি। চোখ দুটো যেন তৃষ্ণার্ত কাকের মতো এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে এক পলক দেখার লোভে।

আমিনা বাচ্চা ছেলেটির নাম রেখেছে আয়াশ। সে এখন অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছে। মীরা স্নেহা সবাই তাকে আদর করে।

আয়াশও আমিনার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে।

এমন মুহূর্তে তালুকদার বাড়ির গেট দিয়ে পরপর চার-পাঁচটা গাড়ি ঢোকে। গার্ড সহ নায়েব তালুকদার গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। শুধু দেখা মেলে না নওয়ান তালুকদারের। আমিনা যেনো হতাশ হলো। চাতক পাখির ন্যায় নজর ঘুরিয়ে ছেলেকে খুঁজতে থাকে।

নায়েব যেনো বুঝলো আমিনার মনের কথা।

সে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বলে

“আব্বা টাউনে রয়ে গেছে। একটু পরে চলে আসবে। তুমি আপসেট হইও না।

আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে নায়েব তালুকদার আয়াসের চুলের ভাজে হাত বোলায়। হাতে থাকা চকলেটের বক্স এগিয়ে দেয় বাচ্চাটার দিকে।

আমিনা অবাক না হয়ে পারে না। ফ্যাল ফ্যাল নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকে!

চলবে

#অন্তরালে_আগুন

#পব:২৭

#তানিশা সুলতানা

বদলে গিয়েছে স্নেহা। পুরোপুরি বদলে যাওয়া যাকে বলে। এখন আর সে কক্ষ থেকে বের হয় না। কারো সঙ্গে কথাও বলে না। পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে। কলেজে যেতেও ইচ্ছে করে না। ওই মাঝেমধ্যে একটু বেওথা ব্রিজে যায় নুপুরের সঙ্গে দেখা। সেটাও আবার খুব সকালে। যাতে মানুষের ভিড়ভাট্টায় না পড়তে হয়। দুজনের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। স্নেহার একাকীত্ব জীবনের একমাত্র সঙ্গী নুপুর। সেও নওয়ানের মতো নুপুরকে চাঁদ নামেই ডাকে। শুধু হৃদয়ে জমানো দুঃখগুলো কেউ কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না।

আজকে নওয়ান বাড়িতে ফিরবে জানে না স্নেহা। স্বভাব সূলত কক্ষেই বন্দি ছিল গোটা দিন।

কয়েকখানা উপন্যাসের বই শেষ করেছে। আগে সে ভাবতো কি আছে উপন্যাসে? কেনো মানুষ রাত জেগে, সময় নষ্ট করে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে? কি সুখ পায় তারা?

তবে এখন বুঝতে পারে একাকীত্বে বিভোর মানুষদের একমাত্র সঙ্গী এই উপন্যাস। মন ভাঙ্গা মানুষ গুলোর একমাত্র শান্তি জায়গা শুনশান নীরবতায় বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকা। উপন্যাসের কিছু চরিত্রের মধ্যে নিজেকে খুঁজে বেড়ানো। স্নেহাও সেটাই করে।

মা কিছু মুহূর্ত আগে এক কাপ চা দিয়ে গিয়েছে। তিনিও এখন স্নেহার সাথে কথা বলে না। বলবেই বা কি করে? মেয়ে যে তার কথা শোনে না।

অবশ্য এসব নিয়ে স্নেহার আফসোস নেই। কাউকে লাগে না তার। একাকীত্বই সুন্দর। ভয়ংকর সুন্দর।

চায়ের কাপে চুমুক দিতেই স্নেহার ফোন বেজে ওঠে।

বড় বোন সিনথিয়া কল করেছে।

বোনের সঙ্গে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক নয় তার। ভাই বোনদের মধ্যে আলাদা একটা সম্পর্ক থাকে না? কিছুটা খুনসুটি, দুষ্টুমি, হইহুল্লোড়।

এরকম সম্পর্ক তাদের তিন ভাই বোনের মধ্যে কখনোই ছিলো না। থাকবেই বা কি করে। কেউ কাউকে ঠিকঠাক কাছেই পায় নি কখনো।

স্নেহা কলখানা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে সিনথিয়া বলে

“কেমন আছো তুমি?

” ভালো আছি। তুমি?

“ফাইন।

পড়ালেখা বাদ দিয়েছো শুনলাম।।

” মাথায় ধরে না।।

“নিজেকে এতো চাপ দিলে কি করে মাথায় ধরবে? সহজ কথা বুঝতে কেনো পারছো না? নওয়ান ভাইয়া তোমার নয়। তাকে মাথা থেকে বের করো।

প্রচন্ড রাগ হয় স্নেহার। সবাই একই কথা বলে। স্নেহা কি নওয়ানকে পাওয়ার জন্য পাগলামি করছে? না কি ভিলেন হয়ে গেছে? শুধু মানুষটাকে ভালোবেসেছে। আর সরল মনে সবাইকে বলেছে। এটাই কি তবে তার দোষ ছিল? ওয়ান সাইট লাভ কি তবে এতই খারাপ?

কল কেটে দেয় স্নেহা। ফোন খানা ছুঁড়ে মারে দেওয়ালে। মুহূর্তেই একমাস আগে কিনে আনা iphone 16 pro দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। ডিসপ্লে তে ভালোই আঘাত পেয়েছে তবে ভেঙে গুড়িয়ে যায়নি। স্নেহা দুই হাতে নিজের চুলগুলো খামচে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে।

“গোটা দুনিয়া বলে সে আমার নয়।

আরেহহ আমি সবাইকে কেমনে বোঝাই শরীর না ছুঁয়েও ভালোবাসা যায়।

একটু থেমে কাঁপা স্বরপ আবার বলে

“আমাকেই কেউ বুঝলো না। কে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল না “কিছু হয়নি। জীবন ছোট। তুমি মানিয়ে নিতে শিখো। নাই বা সে তোমার হলো। তাকে সারা জীবন দেখতে পাবে এটাই বা কম কি? একটা জীবন তাকে দেখেই কাটিয়ে দাও”

কেউ বুকে জড়িয়ে বলে না “তুমি ভালো আছো তো”

কেউ কি কাঁদার জন্য তার কোলটা এগিয়ে দেয় না।

আমার যে কত কষ্ট হয়। কি যে দুঃখে জীবন অতিবাহিত করছি।

তাকে পায়নি বলে আমি যতটা আঘাত না পাই। সে আমার নয় এটা ওনাদের থেকে শুনলে আমার দুঃখ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এই সামান্য কথাটা কেউ বুঝলো না।

কেউ জানলো না আমি ম/রে গেছি।

স্নেহার মনটা ম/রে গেছে। শুধু শরীর খানা জীবিত।

___

একমাস পরে অভিও মানিকগঞ্জ এসেছে। কোন কাজে নয় নুপুরকে এক পলক দেখার জন্য। সেইবার শুধু একটু দেখা পেয়েছিলো। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলা হয়নি। তবে আজকে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে কথা না বলা পর্যন্ত মানিকগঞ্জ থেকে নড়বে না। কিছুতেই না কোনো মতেই না।।

মানিকগঞ্জ স্বাধীনতা চত্বর এবং শিশু পার্কের মাঝের রাস্তা টাকে খালপার বলা হয়। টাউন বা বাস স্ট্যান্ড থেকে আসা অটো বা রিকশাকে দাঁড় করিয়ে তবেই বেওথা যেতে হয়। প্রতিদিনের ন্যায় আজকেও নুপুর খাল পার এসে দাঁড়ায়।

প্রচন্ড রোদে নুপুরের মুখখানা লাল হয়ে গেছে। পেছন থেকে বল্টু অনবরত বলছে

“ভাবি ভাই আপনাকে গাড়িতে যেতে বলেছে। দয়া করে উঠুন। না হলে ভাই খুব বকবে আমারে।

সেদিকে নুপুর পাত্তা দিচ্ছে না। সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অটো খুঁজতে ব্যস্ত।

তখনই কালো রঙের একটা গাড়ি এসে থামে নুপুরের সামনে। গাড়ির জানালায় থাকা কালো গ্লাস সরাতেই অভির মুখ খানা দেখতে পায় নুপুর।

বরাবরের মতোই ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝুলে আছে।

“নুপুর আমার সাথে যাবে? তোমাদের বাসায় যাচ্ছি।

অদ্ভুত আবদার। এভাবেও বলতে পারত “গাড়িতে এসো”

কিন্তু লোকটা অধিকার ফলাতে পছন্দ করে না। সবসময় অনুমতি নিবে। এই দিকটাই নুপুরের খুব ভালো লাগে। এমনই তো হওয়া উচিত। সম্পর্কের আগে আমরা সবাই মানুষ। আমাদের আলাদা আলাদা মতামত বা ইচ্ছে থাকতে পারে। সেজন্য অনুমতি নেওয়াটা অতিব জরুরী। সব সময় অধিকার ফলাতে হয় না।

নুপুর দু পা এগিয়ে যায়। অভি বুঝতে পারে মেয়েটা তার সঙ্গে যাবে। সেজন্য তাড়াহুড়ো করে গাড়ির দরজা খোলে।

“তোমার কি আমার পাশে বসতে সমস্যা আছে? নাহলে আমি ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসবো।

নুপুর মৃদু হেসে দু দিক মাথা নাড়ায়। মানে তার সমস্যা নেই। তারপর গাড়িতে বসে পড়ে। অভির মুখে একরাশ প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে।

বল্টু তখনই ছোটে নওয়নের কাছে। নওয়ান ছেলেদের উদ্দেশ্যে কিছু বলছিলেন। তাদের টাকাপয়সা দিচ্ছিলো

” দশটা হুন্ডা

বিশটা গুন্ডা

ব্যাস নির্বাচন ঠান্ডা”

তোমরা তোমাদের কাছে লেগে পরো। বাকি সবটা আমি দেখে নিবো।

বল্টু নওয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলে

“ভাই জরুরী কথা আছে।

নওয়ান সবাইকে চলে যেতে বলে তারপর নিজের এসি গাড়িতে গাড়িতে উঠে পড়ে। বল্টু ড্রাইভারের পাশে বসে।

“ভাবি প্রধানমন্ত্রীর ছেলের গাড়িতে বসেছে। ছেলেটা ভাবিকে দেখে হাসতেছিলো। আমার মনে হয়েছে উনি ভাবিকে পছন্দ করে।

বল্টুর কথা শুনতে পায় নওয়ান। চোখ দুটো বন্ধ করে সিগারেটে টান দিতে দিতে মনোযোগ দিয়েই শুনেছে। তবে প্রতিত্তোরে কিছু বলে না।

যেন উত্তর দেওয়ার থেকে এই মুহূর্তে সিগারেট খাওয়াটা বেশি জরুরী।

বল্টু যেনো হতাশ হলো এমন নয়নে তাকায় নওয়ানের দিকে। বিড়বিড় করে বলে

” বউ আর জামাইয়ের যে কি হয়।

বল্টু তুই এসব বড়লোকি কারবার বুঝবি না।

__

অনবরত বেজে চলেছে অভির ফোন খানা। কাউকে কিছু না জানিয়েই সে মানিকগঞ্জ চলে এসেছে। সামনে নির্বাচন। বিপক্ষ দল যখন তখন এট্রাক করতে পারে। অভিকে বারংবার বলা হয়েছে সিকিউরিটি ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। তবে অভির সে কথায় পাত্তাই দেয় না।

এই যে এই মুহূর্তে অতিরিক্ত ফোন বাজায় বিরক্ত হয়ে ফোন খানা বন্ধ করে ফেলে।

নুপুর সেটা লক্ষ্য করে এবং বলে

“ইমপর্টেন্ট কল হতে পারে।

অভি যেনো অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে বলে ওঠে

“ও……ওই বা……বাসা থেকে কল এসেছে।

অভিকে তোতলাতে দেখে নুপুর ভ্রু কুচকে ফেলে। এবং বলে

“আর ইউ ওকে?

পকেট থেকে রুমাল বের করে অভি। এসি গাড়িতেও দরদর করে ঘামছে। কোনমতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। শখের নারী পাশে বসে থাকলে অবশ্যই নিজেকে শান্ত রাখা যায় না।

নুপুরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভির নার্ভাসনেস আরও বেড়ে যায়। সে শুকনো ঢোক গিলে বলে

” ঠ…..ঠিক আছি আমি।

নুপুর আর কিছু বলে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এই রাস্তা দিয়ে যতবার আসা যাওয়া করে ততবারই সে তালুকদার বাড়ির পানে তাকিয়ে থাকে। উচু বিল্ডিংটার দুই তালার উত্তর দিকে নওয়ান তালুকদারের কক্ষ। বেওথার রাস্তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায় সেই কক্ষের ব্যালকনি টা। ফুলের গাছগুলো নেতিয়ে পড়েছে। পড়বে না? গাছগুলোর মালিক যে বাসায় নেই। কে যত্ন করবে? নওয়ান বাসায় না থাকলে রেবেকা খালার পাখা গজিয়ে যায়। কোন কাজে মন থাকে না তার।

ভাবতে ভাবতে মুচকি হাসে নুপুর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নজর ফিরিয়ে নেয়। মনে মনে বলে

“আমার মনে আপনার জন্য ভালোবাসা নেই নওয়ান। আছে এক রাশ ঘৃণা। অতি তাড়াতাড়ি আপনাকে আর আপনার পরিবারকে ধ্বংস করে দিবো আমি। করবোই।।

বেওথা ব্রিজটা পার হতেই তাদের বাড়ি দেখা যায়।

গাড়ি থামতেই সবার আগে নুপুর নেমে পড়ে। অভির সঙ্গে কোন কথা না বলেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে।

নেহাল ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিল।

নুপুর নিজ কক্ষে যেতে যেতে নেহাল কে উদ্দেশ্য করে বলে

“ভাইয়া তোমার বন্ধু এসেছে। এগিয়ে আনো তাকে।

নুপুর তার কক্ষে ঢুকে পড়ে। নেহাল টিভি বন্ধ করে বাইরে বের হয়। অভির সঙ্গে আলিঙ্গন করে তাকে ভেতরে নিয়ে আসে। ওইবারের মতো আজকেও অনেক অনেক জিনিস নিয়ে এসেছে অভি৷ তার জন্য রাগ দেখাতেও ভোলপ না নেহাল।

____

“স্টপ দ্যা কার

হঠাৎ করে বলে ওঠে নওয়ান। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে ফেলে। তাদের পেছনে থাকা গাড়ি গুলোও থেমে যায়। স্বাধীনতা চত্বরে সামনে থাকা ফুল গাছের মাঝে ছোট্ট একটা কুকুরছানা বসে আছে। খুব বেশি অসুস্থ সে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

নওয়ান গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ে। তার দেখাদেখি বাকি গাড়ি থেকে গার্ডরাও নেমে পড়ে। নওয়ান এগিয়ে গিয়ে কুকুরছানাটির গায়ে হাত দিতে যায়। বাধা দেয় বল্টু। বলে ওঠে

“ভাই আমি নিচ্ছি। ওর গায়ে নোংরা লেগে আছে।

নওয়ান ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকায় বল্টুর পানে। বল্টু ভয় পেয়ে দু পা পিছিয়ে যায়। নওয়ান কুকুরছানা টিকে কোলে নিয়ে পুনরায় গাড়িতে ফিরে আসে। এবং ড্রাইভারকে আদেশ দেয় গাড়ি স্টার্ট করার জন্য। বাকি গার্ডরাও তাদের গাড়িতে ফিরে যায়।

কিছু মুহূর্তের মধ্যেই তালুকদার বাড়ির গেট দিয়ে সবগুলো গাড়ি প্রবেশ করে। এখনও আমিনা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। থাকবে না? কতদিন হয়ে গেল তার কলিজার ছানা টাকে দেখে না। হৃদয়টা ছটফট করছে একটু দেখার জন্য।

অবশেষে আমিনার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়।

কুকুর ছানাটিকে কোলে করে গাড়ি থেকে নামে নওয়ান। মাকে দেখে মুচকি হাসে।

ঠোঁটের ভাজে থাকা সিগারেট ফেলে দিয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে যায়।

এক হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে। খুবই যত্ন সহকারে চুমু খায় কপালে।

আমিনা অনেক কথা বলতে থাকে। নওয়ানকে বড্ড ধৈর্যশীল দেখালো। চুপচাপ মায়ের সব কথা শুনতে থাকে।

তারপর বলে

“তোমার ছোট ছানা কোথায়?

আয়াশ ঘুমিয়েছে। আমিনা সেটা নওয়ানকে জানায়। এবং জলদি ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে। একসাথে খাবে ছেলের সঙ্গে।

নওয়ান বাধ্য ছেলের মত মায়ের কথা মেনে নেয়। চলে যায় ফ্রেশ হতে।

সবিতা তালুকদার আড়াল থেকে মা ছেলের এমন দৃশ্য দেখছিলেন। বড্ড হিংসে হয় তার। ছেলেকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করতে পারলে যেন বাঁচে। কিন্তু ওই বেপরোয়া নওয়ানকে বড্ড ভয় পায় সে। তাইতো ঠিকঠাক কোনো প্ল্যানিং করতে পারে না।

___

রাত আটটা বেজে ১০ মিনিট। আজকে বোধহয় নওয়ানের মনটা ভাল নেই। অবশ্য সব সময়ই সে এমন গম্ভীর থাকে।

তালুকদার বাড়ির সামনে থাকা সুইমিংপুলে পা ডুবিয়ে গিটারে টুং টাং আওয়াজ তুলছে নওয়ান। ঠোঁটের ভাজে সিগারেট। বড় বড় চুলগুলো এলোমেলো। পরনে হাতা কাটা ঢোলাঢালা টি শার্ট এবং শট প্যান্ট। ছোট্ট কুকুর ছানাটিকে পরিষ্কার করে সুন্দর একটা জামা পরিয়ে দিয়েছে রেবেকা। আজকে থেকে তার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। এই কুকুর ছেলেটির ও যত্ন করতে হবে। এই মুহূর্তে কুকুর ছানাটি নওয়ানের কোল দখল করে বসে আছে।

বল্টু তারই পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নওয়ান তাকে কয়েকবার বসতে বলেছে। কিন্তু সে বসতে নারাজ।

সিগারেট শেষ। তার শেষ অংশ সুইমিং পুলের পানিতে ফেলে দিয়ে আখি পল্লব বন্ধ করে নেওয়ান। মধুর সুরে গেয়ে ওঠে

“কি জ্বালা দিয়া গেলা মোরে

নয়নের কাজল পরানের বন্ধুরে

না দেখিলে পরাণ পোরে

কি দুঃখ দিয়া গেলা মোরে

নয়নের কাজল পরানের বন্ধুরে

না দেখিয়ে পরান পোরে

স্নেহা নিজ কক্ষ থেকে নওয়ানের গান শুনতে পায়। এবং মুহুর্তেই দৌড়ে বেলকনিতে চলে আসে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পাষাণ পুরুষটিকে। কারণ ছাড়াই আখি পল্লব ভিজে ওঠে।

গানটা বড্ড বুকে লাগে। ঝাপসা নয়ন, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নেরে স্নেহা বিড়বিড় করে বলে ওঠে

“ইচ্ছে তো করে নিজেকে সান্তনা দিতে। বলতে

দুনিয়াতে পাইনি তো কি হইছে হাশরের ময়দানে তাকে পাওয়ার দাবি নিয়ে দাঁড়াবো।

কিন্তু আমিতো জানি

সেখানেও তাকে আমি পাব না।

দুনিয়া পরকাল হাশর সবখানেই সে নুপুরের।

আমি স্নেহা বরাবরই অসহায়।

গান শেষ হতে নওয়ান বলে ওঠে

“বল্টু তোর ভাবিকে কল কর।

তার সঙ্গে একটু কথা বলি।

সত্যি সত্যি বল্টু নুপুর কে কল করে।

রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলখানা রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই নওয়ান বলে ওঠে

“আই নিড ইউ চাঁদ।

প্রচন্ড রোমান্স করতে ইচ্ছে করছে।

তোমার ব্যালকনির দরজা খোলা রেখো। আমি আসছি

চলবে

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply