born_to_be_villains
methuburi_মিথুবুড়ি
পর্ব_১০
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌
‘ইমামা সরাসরি রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দিল। তারপর অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বিছানার দিকে ছুটে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে বালিশের নিচে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকল। তার চারপাশ হঠাৎই যেন এক অন্তহীন মরিচীকার মতো ধ্বংসযজ্ঞ আর পাপাচারের ছায়ায় ঘেরা। বেমালুম এই অন্ধকার বিভীষিকায় আটকা পড়ে গেছে সে। জানে, এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া সহজ নয়, তবুও সে নিজের ভেতরের তেজি মনোভাব দমিয়ে রাখতে পারেনি। স্ব-ইচ্ছায় এবং সজ্ঞানে জড়িয়ে পড়েছে সে, নিঃসাড় শূন্যতা ঘেরা মরিচীকায়। অথচ, প্রকৃতপক্ষে সে চেয়েছিল সুন্দর, সাধারণ একটা জীবন। তাহলে এই সব রহস্য, ষড়যন্ত্র, নিপীড়ন কেন তার উপর এসে পড়ল? সেই ‘ম্যাড বিস্ট’ নামের ভয়ঙ্কর ব্যক্তির কাছে তার কী অপরাধ, যে তাকে কলুষিত করতে, ভেঙে দিতে, সকলের চোখে খারাপ দেখাতে চায়? আর সেই রহস্যময় আর.কে–এর উদ্দেশ্যই বা কী? কেন সে আচরণে এত অস্থির,আর এত আগলে রাখে তাকে?
‘ইমামা উঠে কেবিনেট থেকে সেই কালো কোটটা বের করল। মাতাল করা ঘ্রাণ তার নিঃসঙ্গতা যেন আরও বাড়িয়ে দেয়। কোটটা বুকের সাথে চেপে ধরে ঠুকড়ে ওঠে ইমামা। ঠিক তখনই ফোনটা আবারও ভিজে উঠল। কল রিসিভ করা মাত্র ওপাশ থেকে অস্থির কণ্ঠে ঝরল গর্জন, গালিগালাজের ঝড়,
“কুত্তার বাচ্চা, জানোয়ারের বাচ্চা, তুই ফোন ধরছিস না কেন? কতক্ষণ ধরে কল দিচ্ছি তোকে,হুহ? শুয়োরের বাচ্চা, আন্সার মি! তুই তখন কেন কাঁদলি? কেন কাঁদলি, বল? স্পিক আপ ড্যামেট। তোকে বলিনি—তুই কখনো কাঁদতে পারবি না আমাকে ছাড়া? জবাব দে, কুত্তার বাচ্চা, কেন কাঁদলি তুই? আন্সার মি, ইউ ফাকিং ফুল…”
‘দীর্ঘক্ষণ ধরে অস্থিরতায় ছটফট করা মানুষ যেমন হাঁসফাঁস করে, অদ্ভুতভাবে সেই একই ছন্দে আচরণ করছিল অপর পাশের অচেনা, অদৃশ্য মানুষটা। কণ্ঠে ধরা পড়ছিল তার ছটফটের প্রতিফলন। তবে কি ইমামা তার দুঃখের সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে? খুঁজে পেয়েছে কি সেই স্বপ্নের পুরুষকে, যে তার দুঃখে অস্থির হয়ে পড়বে?
‘লোকটার ক্রোধের আগুনে ইমামার কান্না হঠাৎ বর্ষণ হয়ে নামল। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ইমামা অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“সবাই আমাকে এতো কষ্ট কেন দিচ্ছে? আমি কী করেছি? এসব কী হচ্ছে আমার সাথে?”
‘মটমট করে উঠল তার চোয়াল। সে অন্ধকার, সুবিশাল একটি কক্ষে দাঁড়িয়ে ছিল। ভূতুড়ে অন্ধকার আর শ্মশান ঘাটের নিস্তব্ধতায় ঘেরা কক্ষটির সম্মুখের দেয়ালে ছিল টিভির মতো ছোট ছোট অসংখ্য মনিটর। প্রতিটি মনিটরের স্ক্রিনে লাইভ ফুটেজ দেখা যাচ্ছিল ওয়াসিম মঞ্জিলের প্রতিটি কোণ। ইমান ওয়াসিম ব্যক্তিগত কক্ষ এবং ইমামার ওয়াশরুম ছাড়া, ওয়াসিম মঞ্জিলের প্রতিটি কোণায় রয়েছে অগণিত গুপ্ত ক্যারেমা। এমনকি ইমনের বেডরুমেও। সে নিজে ইতালিতে থাকলেও পুরো ওয়াসিম মঞ্জিল ছিল তার নখদর্পণে।
‘সবচেয়ে বড় স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল ইমামাকে। সে নিস্প্রভ দ্বিধাহীন নজরে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ঝুঁকে এলো। ঝুম করল ওর মুখে। বিশাল স্ক্রিনে ভেসে উঠল ইমামার ভেজা মুখশ্রী। ইমামার চোখ থেকে আরেক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই তার সমুদ্র নীল চোখে জ্বলে উঠল আগুনের শিখা। ডান হাতের পিঠে, ইতালিয়ান অক্ষরে লাইন আকৃতিতে খোদাই করা শব্দগুলো বেঁকে বসল, রক্তঝরা ক্রোধে হাতের শিরা-উপশিরায় ফুলে উঠতেই।
‘সে স্তব্ধ হয়ে গেলেও তার কণ্ঠের দৃঢ়তা একফোঁটাও কমেনি। সে একদৃষ্টিতে ইমামার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে টগবগে বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওড়ায়,
“আর ক’টা দিন সহ্য কর, এলিজান। কথা দিচ্ছি, রক্ত দিয়ে প্রেমের চুক্তি লিখব আমি। কাউকে ছাড়বো না।”
‘ইমামার কানে যেন তার কথাগুলো পৌঁছায়নি। সে কাঁদতে কাঁদতে ভেতরের সমস্ত যন্ত্রণা একপ্রকার ভেঙেচুরে ছড়িয়ে দিল। যন্ত্রণা বিবশ হয়ে কার সঙ্গে কথা বলছে সে হিতাহিত জ্ঞান তার ছিল না। সে শুধু অনর্গল বলে যাচ্ছিল,
“ওরা কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে না।”
‘ফোনের ওপাশের অভিশপ্ত রাজা যেন আজ স্বয়ং স্বপ্নপুরুষ রূপে ধরা দিয়েছে। তার স্বৈরাচারী মনোভাব, হিংস্র ভাব, পাপিষ্ঠ হৃদয় সব কিছু এক পাশে রেখে সে দৃঢ়তায় বিধ্বস্ত মেয়েটার পাশে দাঁড়াল। আস্থা ভরা কণ্ঠে বলল,
“আমি বলছি তো।”
“আমি একদম একা হয়ে পড়েছি।”
“আমি আছি।”
“সবাই আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।”
“আমি কখনো দেব না।”
“একদিন সবাই চলে যাবে।”
“এই দেহে প্রাণ থাকতে আমি কখনো যাবো না।”
“কেউ আমাকে ভালোবাসে না।”
“আমি ভালোবাসি তো।”
‘এবার ইমামা চমকে উঠল৷ হঠাৎ করেই হুঁশে ফিরল। শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“কি—হ?”
‘সে আরও দৃঢ়ভাবে বলল, “আমি ভালোবাসি তো।”
‘ইমামার গলা কাঁপে, “আ-আপনি কী বললেন?”
‘কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর দীর্ঘশ্বাস। এবং অবশেষে নিদারুন স্বীকারোক্তি,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি, এলিজাবেথ ইমরা এরিন।”
‘নতুন নামটি শুনে ইমামা কেঁপে উঠল। বিদ্যুতিক তরঙ্গ খেলে গেল অভ্যন্তরে। অস্পষ্ট স্বরে বেজে উঠে ওর কণ্ঠ,”এলিজাবেথ ইমরা এরিন?”
“ইয়েস, প্রিন্সেস এলিজাবেথ।”
‘ইমামা শিউরে উঠল বিমুগ্ধ পুরুষালী কণ্ঠের এমন সম্বোধনে। একই সঙ্গে অদ্ভুত এক অস্বস্তি কাজ করল এই নামটার কারণে। এই লোকটা সেই শুরু থেকে বলছে, ‘সে ইমামা না’। এমনকি কখনো তার নাম ধরে ডাকাও হয়নি। আজ হঠাৎ এই নাম! তাহলে কি…..? না, না, এসব ভাবতে চাই না ইমামা ডিএনএ রিপোর্ট আসার আগে কারো কথায় কানে নিতে চাই না সে।
‘ইমামাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে ওপাশের লোকটা যেন ওর মন পড়ে ফেলল। ফিচেল হাসল বোধহয় সে। তারপর,
ধূর্ততার সহিত মেয়েটা বানভাসি প্রেমের জোড়ারে ভাসিয়ে দেওয়ার ভয়ংকর ষড়যন্ত্র করে, হঠাৎ করে কোমল কণ্ঠে আরেকটি সম্বোধন করে বসলো,
“এলিজান।”
‘সেই ভারি কণ্ঠের এই নরম, কোমল ডাক বিদ্যুতের ঝিলিক হয়ে নারীকায়ার প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষীণ ক্ষনিকে ইমামার কান্না হঠাৎ থেমে যায়। এবার কষ্টের জায়গায় একরাশ অস্থিরতা এসে ভর করল অকুতোভয়ী হৃদিন্ড হৃদয়ে। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ভাসা অনুভূতি ঘেঁষে গেল।
‘সে আবার বলল,
“সবাই চেষ্টা করবে আপনাকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলতে।
আর আমি একা—পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়ে আকে গড়ে তুলব।”
‘বিস্ময়াকুলে ইমামার কৃষ্ণকালো চোখদুটো স্থির, স্তব্ধ। রহস্যের ভেতর থেকে এবার সবকিছুই অবিশ্বাস্য ঠেকছে। এই মানুষটা আসলে কী বলছে? শুকনো ঢোক গিলে ইতস্তত কণ্ঠে সে কোনোমতে বলল,
“আপনি?”
“হ্যাঁ, এই আমি।”
“এই আপনি?” বিস্ময়ের ঘোরে পাল্টা প্রশ্ন ইমামার।
“হ্যাঁ, আপনার আমি। শুধুই আপনার, প্রিন্সেস এলিজাবেথ।”
‘এলিজাবেথ স্তব্ধ। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বলল,
“এটা কখনোই সম্ভব নয়।”
‘কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল পাহাড়সম দৃঢ়তা,”সম্ভব নয়, আবার অসম্ভবও নয়। সবই নির্ভর করে ইচ্ছাশক্তির উপর।”
‘ইমামা নিঃশ্বাস আটকে গেল। মুখ কুঁচকে, কণ্ঠ ভেঙে বলল শুধু বলল,
“আমি অসুস্থ।”
“আমি জানি।”
“আমার হাতে বেশি সময় নেই।”
“যতটুকু আছে, পুরোটাই আমার।”
“আমি একদিন সব ভুলে যাবো। “একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ থেকে।
‘সে অধর এলিয়ে মৃদু হাসল ইমামার দিকে তাকিয়ে। তারপর নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়াল, বুক টানা দিয়ে। ফ্লোরলেংথ টর্চের আলোয় তার কালো ওভারকোটের ছায়া ছড়িয়ে পড়ছে দেয়ালে। পিছন থেকে দেখে মনে হচ্ছে অন্ধকারের রাজা যেন দাঁড়িয়ে আছে। সে একে একে প্রতিটি মনিটরের দিকে তাকিয়ে আবার ফিরল ইমামার চোখে। অতঃপর জড়তা ছাড়া, গভীর দৃঢ়তায় বলল,
“তবে, আমি হবো স্মৃতি তৈরির কারিগর।”
‘ইমামা তিক্ত হেসে বলল,”এসব ফিল্মি ডায়লগ। ফিল্মেই মানায়, বাস্তবে নয়।”
‘তার কালচে ঠোঁটে হালকা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল।
“নাটক-সিনেমার শেষটা ডিরেক্টর ঠিক করে। আর আমাদের প্রেমকাহিনীর ডিরেক্টর আমি নিজে। সুতরাং শেষটা সেভাবেই হবে, ঠিক যেভাবে আপনার আমি চাই।”
‘থেমে সামান্য হেসে, বুকের ভেতর জমে থাকা সমস্ত দোটানা ও পিছুটান ফেলে সে আওড়াল,
“আজ থেকে শুরু আমাদের প্রণয়ের আখ্যান। আর এই আখ্যানের লেখক স্বয়ং আমি নিজে। পূর্ণতার শেষ পাতায় এমনভাবে লিখব, যে সকলের মনে দাগ কাটবে এই ভিলেনের ভালোবাসা।”
‘ইমামার কপালে গভীর ভাঁজ পড়ল। বিস্ময়ের পর বিস্ময়ে ও স্তব্ধ হয়ে যায়। অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“ভিলেন?”
‘সে হালকা হেসে বলল,
“ইয়েস, বেবি। আই’ম ইওর ভিলেন। আপনাকে পাওয়ার যে যুদ্ধে নেমেছি, সেখানে জেতার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তাই পাওয়া না-পাওয়ার পথ ছেড়ে, ছিনিয়ে নেওয়ার পথটাই বেছে নিয়েছি আমি। কজ ভিলেনস নেভার লেট গো—দে টেক হোয়াট দে ওয়ান্ট।”
“কার কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নেবেন আপনি?”
“আপনার কাছ থেকেই।” বাঁকা হেসে বলল। গম্ভীর কণ্ঠের সেই হাসি কী অদ্ভুত শোনালো।
“আমার?” হতবিহ্বল ইমামা।
“ইয়েস, বিউটিফুল।”
“একদম মজা করবেন না।” ইমামা এবার বেশ সিরিয়াস।
“মজা? হাহাহাহা… কিছুদিন পর আপনি নিজেই আমার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন, ম্যাডাম। কারণ আমি আপনাকে বাধ্য করব আমার প্রেমে পড়তে। তখন আর মজা মনে হবে না।”
“বাধ্য করে প্রেম হয় না।”
“এটাই তো ভিলেনের ভালোবাসা। যা হয় না, সম্ভব না, সেটাই তারা আদায় করে নেয়—ঠিক যেমন আমি আপনাকে আদায় করব, আমার মতো করে।”
‘হতভম্ব ইমামা। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তাকে আরও অবাক করে দিয়ে সে আবার হাস্কি স্বরে হিসহিসিয়ে বলল,
“যখন ভিলেনের এন্ট্রি হয়, তখন আশেপাশে আর কারো জায়গা থাকে না। ইউর ভিলেন ইজ ব্যাক, মাই ফাকিং ডার্ক রেড!”
‘ইমামা থতমত খেয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো অস্পষ্ট। কিন্তু পরক্ষণেই হঠাৎ কেঁপে উঠল ওপাশের লোকটার রাশভারি কণ্ঠে। রাজার শাসনের মতো বজ্রকণ্ঠে হঠাৎ করে সে বলে উঠল,
“ফ্রম দিস পয়েন্ট অন, ইউ বিলং টু মি। ইউ আর মাইন—মাইন মিন্স অনলি মাইন। ইউ বিইং মাইন মিন্স নো আদার ম্যান সিজ ইউ, টাচেস ইউ, অর দ্যাট ইউ টাচ এনি আদার ম্যান। দেয়ার’স নো এস্কেপ। নো ওয়ান এলস, নো মোর এস্কেপ—জাস্ট ইউ অ্যান্ড মি।”
‘ইমামা থরথর করে কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর অস্থিরতার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে৷ ঘাম ঝরে চোখে পড়ল। সেই অস্থিরতা আগুনে রূপ নিল যখন সে আবারও তাকে ডাকল, তবে এবার আরও সরাসরি, আরও একনিষ্ঠ সম্বোধনে,
“রেড?”
‘এক নিমিষেই সবকিছু হিতে বিপরীত হয়ে গেল। ইমামার মনে পড়ে গেল শয়তানটার কথা, সে-ও সবসময় তাকে ‘রেড ওয়াইন’ বলে ডাকে। ইমামার ধারণা লাল চুলের কারণে তাদের ডাকের সাথে ‘রেড’ সংযুক্ত। বন্ধুরাও সবসময় কটাক্ষ করে রাশিয়ান বলে ডাকে, এই লাল চুলের জন্যই সকলে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। হঠাৎ করে নিজের চুলের ওপর সমস্ত রাগ ফুঁসে উঠল।
‘ইমামা ফোনটা বিছানার ওপর রেখে ছুটে গিয়ে কেঁচি বের করল। হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য হয়ে যখনি চুল কাটতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল, তখনই ফোনের ভেতর থেকে ওপাশের মানুষটার কণ্ঠে আসে। অনুনয়, আদেশ আর অধিকারের মিশেলে এক ধরণের সুর,
“ডোন্ট টাচ মাই থিংকস,রেড। রুশ কন্যার লাল চুল আমার খুব শখের। বহুদিন পর অন্ধকারে ঢাকা মনিকোঠায় একটা শখ জেগে উঠেছে। রুপান্জেলের সোনালী চুলে ফ্লিন রাইডার যেভাবে মুকুট পরিয়ে দিয়েছিল, আমিও তেমনই করে আমার প্রিন্সেসের রক্তিম কেশে মুকুট পরিয়ে দিতে চাই।”
‘ইমামা চিৎকার করে উঠল,
“আই’ম জাস্ট লুজিং মাই সেলফ। প্লিজ লিভ মি অ্যালোন, আই অ্যাম জাস্ট ডান অল অব দিস।”
“জাস্ট ফিল মি, বেবি।”
‘তার শীতল কণ্ঠে অদ্ভুতভাবে শীতল হয়ে এলো ইমামার ভেতরের সব অনুভূতি। সে আবারও ফোন হাতে তুলে নিল। বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল,
“ফিল ইউ?”
“ইন দিস মোমেন্ট, ওনলি আই ক্যান কমফোর্ট ইউ।”
“হাউ?”
“ডু আই নিড টু এক্সপ্লেন, হানি?”
‘ইমামা যেন তার ইশারা বুঝতে পারল। শুকনো ঢোক গিলে কোটটা হাতে তুলে নিল, বলল,”ইজ ইট?”
“ইয়েস, বেইবিগার্ল।”
‘তারপর তার কথামতো কোটটা গালের সাথে চেপে ধরে শুয়ে পড়ল ইমামা। একটা সময় এভাবেই ঘ্রাণে, ঘ্রাণে ঘুমের গভীরে তলিয়ে গেল। স্ক্রিনে ইমামার ঘুমন্ত মুখের দিকে রহস্য করে হাসল সে।
‘বা দিকে ঘুরে সে ফল্ডিং চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া শূন্যে ছেড়ে চোখ তুলে তাকাল বাম দিকের দেয়ালে। দেয়ালে বিশাল বড় ফ্রেমে টাঙানো ইমামার ছবি। এটা পার্টির দিনের ছবি। তাহলে কি অফিসার মাহেশের কথামতো ইমামাকে দেখে তার লাভ এট ফার্স্ট সাইট’ হয়েছিল?
‘সিগারেট শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে একনিষ্ঠ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ছবির দিকে। শেষ হলেই উঠে দাঁড়াল। মনিটরিং রুম থেকে বের হওয়ার পথে তার সামনে এসে দাঁড়াল পালোয়ানের মতো সুদৃঢ়, ঘুটঘুটে কালো একজন ব্যক্তি। তার ভেবাচেকা খাওয়া মুখভঙ্গি স্পষ্ট বলছিল সে সবটা শুনেছে। তার নাম লুকাস। এই রহস্যময় ব্যক্তির ডান হাত সে।
‘লুকাস ভ্রু উঁচিয়ে বলল,”এটা কি ব্ল্যাডিবিস্টের অথেন্টিক কনফেশন ছিল?”
‘সে উত্তর দিল না। গ্রীবা সামান্য বাকিয়ে সে পিছনে তাকাল। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলোর মাঝে ইমামার সমস্ত একাডেমিক সার্টিফিকেট, শৈশবের ছবি, স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানগুলোর স্মৃতিচিত্রও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কিন্তু সব থাকলেও ইমামার জন্মের সময়কার কোনো ছবি নেই। কাগজের স্তরে রাখা ছিল ইমামা ও ইমান ওয়াসিমের ডিএনএ রিপোর্ট। সে রহস্যময়ভাবে সেই রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল।
‘এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়,তবে কি সে নিজেও কোনো দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল? আর সেই দ্বন্দ্ব পার করার পরেই কি আজ প্রকাশ্যে এনেছে নিজের অনুভূতি?
‘লুকাসের কথায় বাঁকা হেসে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলল,”ফাকিং ইয়েস, লোকা।”
‘লুকাসের চোখে ভয় ফুটে উঠে। ওর কণ্ঠে কেঁপে ওঠা সুরে আগাম তান্ডবের আভাস। ভীতিবিহ্বল কণ্ঠে লুকাস বলল,
“ফাদার জানলে আপনাকে ধ্বংস করে ফেলবে, বস।”
“আই’ম গোয়িং তো ডেস্ট্রয় এভরিথিং ফর মাই প্রিন্সেস। বিকজ নাও, আই’ম কনফিডেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপ্যারেন্ট উইথ মাই ওন ফিলিংস। সো, ফ্রম টুডে, থিংস উইল গো দ্য ওয়েই আই ওয়ান্ট।”
‘রক্ত ছলকে ওঠা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে সে মনিটরিং রুম থেকে বেরিয়ে গেল। লিভিং রুমের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় পিছন থেকে ভেসে এলো ভারি দাম্ভিক কণ্ঠ,
“রিদ।”
‘সে পিছন ঘুরে তাকাল। এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। যদিও চেহারায় বয়সের ছাপ একদমই দেখা যায় না।
“ইয়েস, ফাদার?”
‘ফাদার দৃষ্টি সুচারু, সন্দিহান কণ্ঠে জানতে চাইল,
“তোমার কি এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
‘গম্ভীর সে আরও গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল,”নো, ফাদার।”
“নতুন ম্যানশনের জন্য জায়গা দেখছো, শুনলাম।”
“সে ফাদারের দিকে তাকাল না। চাপা ক্ষোভে ভরা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“শান্তির জন্য সবারই একটা জায়গার প্রয়োজন হয়, ফাদার।”
‘ফাদার আহত দৃষ্টিতে তাকাল,”তুমি কি এখানে শান্তি পাচ্ছো না, রিদ?”
“ফিজিক্যালি পাচ্ছি না।” মুখের উপর বলে সে হনহনিয়ে চলে গেল। ফাদার স্তব্ধ চোখে চেয়ে থাকল। দেখল তার রিদ তার থেকে কতোটা দূরে চলে গেছে। তার কঠিন স্বীদ্ধান্ত এই কঠিন ছেলেটাকে কী আরও কঠিন করে দিয়েছে?
‘আকাশে মেঘের তুলোর মতো সাদা ছায়া ভেসে আছে। জানালার পাশে বসে সূর্যের কোমল আলোয় ধুলোমাখা গাছের পাতা ঝিকমিক করছে। দূরে কারও চায়ের কাপে চামচের টুংটাং শব্দ, আর পাখিদের ডাকে ভরে আছে সকালটা।
‘তিনদিন লাগল ইমামার কাঁধের ক্ষত শুকাতে। এই তিনদিনে রুমের বাইরে বের হয়নি সে, যায়নি ভার্সিটিতে। বদ্ধ ঘরে মায়ার সাথেই তার তিনদিন কেটেছে। ইমান ওয়াসিম সেদিনের পর থেকে আর মেয়ের সাথে কথা বলেন না। মিসেস নীহারিকা তো মেয়ের রুমের দিকেও পা মারেনি।
বোনের যা যা যত্নের প্রয়োজন, সব একা হাতে করেছে ইমন। ভাইয়ের নিরলস প্রচেষ্টা আর যত্নে আজ কিছুটা সুস্থ ইমামা। ঠিক করেছে আজ ভার্সিটিতে যাবে। পরিক্ষার ডেট দিয়ে দিয়েছে। হাতে আর সময় নেই।
‘এর পর আর সেই শয়তানটা কোনো যোগাযোগ করেনি। করবেই বা কেন? সে তো তার লক্ষ্য পূর্ণ করেছে—ইমামাকে বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, বাবা-মায়ের চোখে অবিশ্বাস্য করেছে, সমাজের চোখে কুৎসিত করে তুলেছে। তাই হয়তো সে থেমে গেছে। অথবা হয়তো অপেক্ষায় আছে সেদিনে, যেদিন দেখবে ইমামা আবার নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে, সেদিন ফিরবে কবরে থেকেও।
‘কিন্তু এবার ইমামা নিজে দাঁড়াতে পারেনি। তার পাশে দাঁড়িয়েছে এক অদৃশ্য মানুষ৷ সুদূর ইতালিতে থাকা সেই রহস্যময় লোকটা। মাত্র তিন দিনে ইমামা টের পেয়েছে লোকটা তাকে নিঃশব্দে আগলে রাখছে। কারণ ছাড়া সে একবারও ফোন করে না, অথচ ইমামা জানে, সে সবসময় তাকে নজরে রাখছে।
‘ওষুধ খাওয়ার সময় হলেই তার ফোন আসে। তার গভীর, ভারি কণ্ঠে ধমক মিশে থাকে তাগাদা। আবার যখন বাবার অবিশ্বাস, মায়ের কঠিন মনে হলে ইমামা কান্নায় ভেঙে পড়ে, ঠিক তখনই ফোনটা বাজে। ওপাশ থেকে বুলেটের মতো ঝাঁপিয়ে আসে সেই কঠিন কণ্ঠ। লোকটার ভারি কণ্ঠের ঝাঁঝালো ধমকে আপনা-আপনি কান্না থেতো ইমামার। কিন্তু লোকটার প্রতিটি ধমকের ভেতরেও ইমামা খুঁজে পায় এক অদ্ভুত নিরাপত্তা। লোকটা অত্যন্ত বদমেজাজি, রূঢ়, তবুও তার রূঢ়তার মধ্যেই ইমামা খুজে পায় তার আশ্রয়ের নিশ্চয়তা।
‘লোকটা সেদিন বলেছিল, ‘একদিন ইমামা নিজেই তার প্রেমে পড়বে।’ সেদিন ইমামা অবাক হয়েছিল। কী অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস লোকটার কথায়। সেদিন সে বুঝতে পারেনি এমন নিশ্চয়তার উৎস কোথায়। কিন্তু এখন সময়ের পরতে পরতে কিছুটা হলেও আচঁ করতে পারছে, কেন সে তাড কথায় এতোটা কনফিডেন্ট ছিল। তবে ইমামা এতো সহজে ধরা দেবে না।
‘মায়াকে সারাদিনের খাবার দিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো ইমামা। গাড়িতে উঠতেই ফোনটা কেঁপে উঠে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল ইমামা। আবারও সেই শয়তানটার নাম্বার থেকে বিশাল বড় একটা মেসেজ এসেছে। ইমামা ‘ম্যাড বিস্ট’ দিয়ে তার নাম্বার সেভ করে রেখেছিল। নোটিফিকেশনে ক্লিক করে ভীতিগ্রস্ত হৃৎস্পন্দনে পড়তে শুরু করল ইমামা,,
“লং টাইম নো সি, বেব।চলো আজ তোমাকে শোনাই আরেকটা নরখাদকের গল্প—যাকে ডাকা হয় ব্রুকলিনের ভ্যাম্পায়ার নামে। তার আসল নাম অ্যালবার্ট ফিশ। নামের সঙ্গে তার কর্মের খুব অদ্ভুত, শিউরে ওঠা মিল।মনোবিকারগ্রস্ত এই মানুষরূপী দানব ছিল জিম করবেটের শিকার করা মানুষখেকো বাঘের থেকেও ভয়ংকর। বন্য জন্তু শিকার করে পেটের দায়ে, আর সে শিকার করত নিজের বিকৃত খায়েশ মেটানোর জন্য। অ্যালবার্ট ফিশ এতটাই বিকৃত মস্তিষ্কের ছিল যে, খুন করার পরও তার শান্তি আসত না। সে চিঠি লিখত। হ্যাঁ, চিঠি লিখত সেই দুর্ভাগা পরিবারগুলোর উদ্দেশে, যাদের সন্তান বা প্রিয়জনকে সে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। চিঠিতে বর্ণনা করত, কীভাবে সে তাদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কষ্ট দিয়েছে, আর সে বর্ণনা লিখতে লিখতে উপভোগ করত নিজের বিকৃত আনন্দ। চলো, তার একটা চিঠি পড়া যাক,
I took tools, a good heavy c’at-of-nine tails. Home made. Short handle. Cut one of my belts in half, slit these half in six strips about 8 in. long. I whipped his bare behind till the blood ran from his legs. I cut off his ears nose slit his mouth from ear to ear. Gouged out his eyes. He was de°ad then. I stuck the kn-ife in his belly and held my mouth to his body and drank his blo od. I picked up four old potato sacks and gathered a pile of sto nes. Then I cut him up. I had a grip with me. I put his nose, ears and a few s-lices of his belly in the gri-p. Then I c-ut him thru the middle of his b-ody. Just below his belly button. Then thru his legs about 2 in. below his behind. I put this in my grip with a lot of paper. I cut off the head – feet – arms – hands and the legs below the knee. This I put in sacks weighed with stones, tied the ends and threw them into the pools of slimy water you will see all along the road going to North Beach. Water is 3 to 4 ft. deep. They sank at once. I came home with my meat. I had the front of his body I liked best. His monkey and pee wees and a nice little fat behind to roast in the oven and eat. I made a stew out of his ears nose – pieces of his face and belly. I put onions, carrots, turnips,celery, salt and pepper. It was good. Then I split the cheeks of his behind open, cut off his monkey and pee wees and washed them first. I put strips of bacon on each cheek of his behind and put in the oven. Then I picked 4 onions and when meat had roasted about 1/4 hr., I poured about a pint of water over it for gravy and put in the onions. At frequent intervals I basted his behind with a wooden spoon. So the meat would be nice and juicy. In about 2 hr., it was nice and brown, cooked thru. I never ate any roast turkey that tasted half as good as his sweet fat little behind did. I ate every bit of the meat in about four days. His little monkey was as sweet as a nut, but his pee-wees I could not chew. Threw them in the toilet.”—Albert Fish (দূর্বল হৃদয়ের কেউ ট্রেন্সলেট করতে যাবেন না)
‘অ্যালবার্ট ফিশ ছিল চার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।ওয়াল্টার, এডউইন আর অ্যানির সঙ্গেই তার শৈশব কেটেছিল। তার পরিবারজুড়েই মানসিক অসুস্থতার ছায়া ছিল। মা ভুগতেন ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশনে, এক ভাইকে পাঠানো হয়েছিল পাগলাগারদে, বোন ও মামাও ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের অসুস্থতার কারণে অ্যালবার্টকে পাঠানো হয় এতিমখানায়। সেখানে শিশুরা তাকে ‘হ্যাম অ্যান্ড এগ’ বলে বিদ্রূপ করত তার আসল নাম হ্যামিল্টন ফিশ বিকৃত করে। অপমান ভুলতে ও নতুন পরিচয়ের আশায় সে মৃত ভাইয়ের নাম নিজের করে নেয়—অ্যালবার্ট ফিশ।
‘শৈশবে এতিমখানার অভিজ্ঞতাই অ্যালবার্ট ফিশের জীবন পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। সেখানে শিশুদের উপর চলত ভয়ানক নির্যাতন। সঙ্গী ছিল অভাব, অনাহার, আর প্রতিদিনের বেধড়ক মারপিট। প্রথমে সে ভয় পেত, কিন্তু কিছুদিন পর নিজের মধ্যেই আবিষ্কার করে এক অদ্ভুত পরিবর্তন। মার খেয়ে কষ্ট নয়, বরং এক ধরনের বিকৃত উত্তেজনা অনুভব করছে সে। মাত্র নয় বছর বয়সেই বুঝে যায় সে আর অন্যদের মতো নয়। ১৯৮০ সালে মা এলেন ফিশ সরকারি চাকরি পেয়ে তাকে এতিমখানা থেকে ফিরিয়ে আনলেও ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অ্যালবার্ট মুক্তি পেল জায়গা থেকে, কিন্তু বন্দী হয়ে গেল নিজের ভেতরের অন্ধকারে।
‘মায়ের সঙ্গে বসবাস শুরু করলেও তার ভিতরের শিশু অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছে। মাত্র বারো বছর বয়সে অ্যালবার্ট টেলিগ্রাফ অফিসের এক কর্মচারীর সঙ্গে অস্বাভাবিক যৌ-ন সম্পর্কে লিপ্ত হয়। কথায় আছে না ‘যেমনে তেমন মিলে?’ সেই কর্মচারী ও ছিল বিকৃতমনস্ক। সেই ছেলেই অ্যালবার্টকে মানুষের মূত্রত্যাগ দেখে আনন্দ পাওয়া এবং মানুষের মল খাওয়া শেখায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে Urolagnia এবং Coprophagia বলে। শুনে গা ঘিনঘিন করছে না? স্বাভাবিক। মলমূত্র খেয়েও তার যুতসই উত্তেজনা লাগছে না। তাই সে নতুন উপায় খুঁজে বের করল। নিজেকে আনন্দ দেয়ার জন্য তার নতুন উপায় হচ্ছে পেটে, কুচকিতে একের পর এক সূচ ফুটিয়ে ব্যথা পাওয়া। যত তীব্র ব্যথা, তত বেশি উত্তেজনা। তার এই অভ্যাস জীবনভর রয়ে গিয়েছিল। স্বীয় কৃতকর্মের জন্য গ্রেফতার হওয়ার পরে এক্সরে করা হলে তার শরীরের অভ্যন্তরে অনেকগুলো সূঁচ পাওয়া গিয়েছিল। এসবের পাশাপাশি পাবলিক গোসলখানায় যেয়ে ন-গ্ন কিশোর বা যুবাদের দেখা তার শখে পরিণত হয়। অজ্ঞাতপরিচয়ে বিভিন্ন নারীকে কুরুচিপূর্ণ চিঠি পাঠানোও তার আনন্দের অন্যতম উৎস ছিল।
‘১৯০৩ সালে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে অ্যালবার্ট ফিশ কুখ্যাত সিং সিং কারাগারে পাঠানো হয়। যেখানে অন্যরা ভয় পেত, সেখানে সে আনন্দ খুঁজে পায়। কারণ সেখানে সে দাগী অপরাধীদের সঙ্গে নিয়মিত যৌ-ন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারত। মুক্তি পেলেও পুরুষের প্রতি তার আকর্ষণ অটুট থাকে। সংসার ছিল, সন্তানও ছিল, তবুও গোপনে একের পর এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যায়। একদিন এক প্রেমিকের সঙ্গে জাদুঘরে ঘুরতে গিয়ে দেখে এক মূর্তির পুরু-ষাঙ্গ ভুলবশত ছু-রি দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। সেই দৃশ্যেই অ্যালবার্টের ভেতরে জেগে ওঠে এক বি-কৃত উন্মাদনা। সেদিনই সে ঠিক করে এই পরীক্ষাটি এবার সে বাস্তব মানুষের উপর চালাবে। এবং সে তা করেও ছিল ভয়ঙ্করভাবে।
‘অবৈধ প্রেম আর চুরিচামারিতে অ্যালবার্টের মন ভরছিল না। নতুন উত্তেজনার খোঁজে সে এগোতে থাকে আরও ভয়ঙ্কর পথে। ডেলাওয়ারে গিয়ে পরিচয় হয় থমাস কেডেন নামের এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী যুবকের সঙ্গে। থমাস তার জন্য ছিল আদর্শ শিকার। কেডেনকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিকৃত যৌ-ন সম্পর্ক গড়ে তোলে সে। তারপর দুই সপ্তাহ ধরে ফার্মহাউজে আটকে রেখে চালায় নৃশংস নির্যাতন। শেষে মোমের জাদুঘরের সেই দৃশ্যের অনুকরণে ধারালো ছু-রি দিয়ে কেডেনের পুরুষাঙ্গের অর্ধেক কেটে ফেলে। পরবর্তীতে জবানবন্দিতে অ্যালবার্ট বলেছিল,
“I shall never forget his scream and the look he gave me.”
ট্রাস্ট মি রেড ওয়াইন, ইমনের আত্মচিৎকার আমাকে প্রশান্তি দিবে।”
‘শেষের লেখাগুলো পড়ার সাথে সাথে ইমামার বুকের ভেতরে থেকে চিৎকার ভেসে আসে,
“ইমননননন! আমার ভাই।”
❌
চলবে….
born_to_be_villains
methuburi_মিথুবুড়ি
বোনাস_পর্ব
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌
‘যেখানে ওয়াসিম মঞ্জিল থেকে ইমনের স্কুল বিশ মিনিটের রাস্তা, সেখানে ঢাকা শহরের অসহ্যকর জ্যাম ঠেলে যেতে লাগল পয়তাল্লিশ মিনিট। আরেকটু দেরি হলে বোধহয় হৃৎস্পন্দন টা পাঁজরের হাড় ভেঙে বেরিয়ে আসতো। সারাটা রাস্তা গাড়িতে গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করেছে ইমামা। মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার বুক চিঁড়ে কলিজা ছিনিয়ে নেওয়ার বর্বর উল্লাসে মেতে উঠেছে। ইমামা যখন ইমনের স্কুলে পৌঁছায়, তখন ক্লাস ব্রেক টাইম চলছিল। ইমামা পাগলের মতো হন্নতন্ন করে পুরো স্কুলে ভাইকে খুঁজতে থাকে।
‘অনেক খোঁজার পর কোথাও খুঁজে না পেয়ে যখনই বিপর্যস্ত বোন বানভাসি কান্না ভেঙে পড়বে, তখনি হঠাৎ তার শঙ্কিত দৃষ্টি জোড়া গিয়ে ঠেকল অদূরে। মাঠের অপরপ্রান্তে ইমনের মাথা দেখা যাচ্ছে। একটা বেঞ্চিতে নির্ভারচিত্তে কারোর সাথে বসে আছে সে। পাশের লোকটা অতিমাত্রায় লম্বা; তার চুলে ঝরে পড়ছে গাঢ় বাদামি রঙের কোমল আভা। পেছন থেকে তার মসৃণ, দৃঢ় পিঠে চোখ পড়তেই ইমামার গলায় শুকনো ঢোক গিলার শব্দ চাপা পড়ে গেল নিঃশব্দ ঘরের ভেতর। অপ্রকৃতিস্থ আতঙ্কে কপাল বেয়ে নামল একফোঁটা শীতল ঘাম।
‘গতি-হারা হৃদস্পন্দনে ইমামা ছুটে গেল ইমনের দিকে।
উর্ধ্বশ্বাসে পৌঁছে ঝড়ো হাওয়ার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ভাইয়ের বুকে। স্বচকিত ইমন চমকে উঠল বোনের হঠাৎ আগমনে। তার পাশে বসা লোকটার মোমঢালা পেলব মুখে ফুটে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত ভাব।
‘ইমামা হাঁপাচ্ছে৷ ইমনকে খুঁজে পেয়েও তার ভয় প্রশমিত হয়নি। ইমামা অস্থিরচিত্তে ইমনকে খুঁটিয়ে-খাঁটিয়ে দেখতে দেখতে দেখতে ঘন নিশ্বাসের সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“তুই ঠিক আছিস তো, ভাই?”
‘পাশের অতিরিক্ত ফর্সা লোকটার নাম ন্যাসো। তার গায়ের দুধসাদা রং, গড়ন, উচ্চতা, বলিষ্ঠ দেহ, আর উচ্চারণের ভিন্নতা—কোনোটাই তাকে বাংলাদেশি বলে মনে হয় না। তীক্ষ্ণ চোয়ালের রেখায় স্পষ্ট ফুটে আছে বিদেশি ছাপ। ন্যাসো শান্ত গলায় বলল,
“ডোন্ট ওয়ারি, ম্যাম। ও ঠিক আছে।”
‘ইমামা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। অনুভব করল বুকের ওপর চেপে বসা জগদ্দল পাথরটা সরে গিয়েছে। অন্তগর্ত ভয় এতোক্ষণ ধরে তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছিল। নিজেকে ধাতস্থ করে ইমামা চোখ তুলে তাকাল ন্যাসোর দিকে। আর সাধারণ মেয়েদের তুলনায় উচ্চতায় ইমামা বেশ লম্বা। তবুও ন্যাসোর দিকে তাকাতে তাকে চোখ তুলতে হলো। সাদা শার্টের ওপর কালো কোট আর চোখে কালো সানগ্লাসে ন্যাসো যেন রোমান শিল্পীর ছাঁচে গড়া এক মানুষ। অথচ তার মুখে এমন এক তীক্ষ্ণ ধারালো ভাব, যা দেখলে গা শিউরে উঠার উপক্রম।
‘শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে ইমামা,”আপনি?”
‘ইমন চট করে বলল,”ইমায়, ও আমার নিউ ফেন্ড, ন্যাসো।”
‘ইমামা আড়চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল,”ফেন্ড?”
‘উপরনিচ মাথা নাড়ায় ইমন,”হুমম! আহ, তোমাকে তো বলা হয়নি। জানো, একটু আগে অনেক বড়ো একটা এক্সিডেন্টের হাত থেকে ন্যাসো আমাকে বাঁচিয়েছে।”
‘আঁতকে উঠল ইমামা,”এক্সিডেন্ট?”
“হুমম,” মাথা নাড়িয়ে বলতে শুরু করল ইমন,”ব্রেকে আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম কিছু কাজে। তখন হঠাৎ রাস্তার ওপাশ থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডেকে উঠল। লোকটার মাথায় কালো হেলমেট ছিল। আমি তার চোখের দিকে তাকাতেই সে আমাকে তার দিকে ডাকল। তারপর হঠাৎ আমার কী যেন হলো! আমার আর বিন্দুবৎ হুঁশ ছিল না। কোনোদিকে না তাকিয়ে আমি তার দিকে যেতে থাকি। ঠিক তখনি রাইট সাইড থেকে একটা ট্রাক আমার দিকে তেড়ে আসে। ভাগ্য ভালো ছিল বলে তখন ঠিক সময় ন্যাসো এসে আমাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। নয়তো আজ….
‘কথার মাঝেই ইমামা ইমনকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে। ওর আবেগশূন্য চেহারায় ভয়ের ছাপ অদৃশ্য হলেও ভেতরে ভেতরে সে কাছের মানুষগুলোর ব্যাপারে খুব তটস্থ আর মাত্রাধিক ভঙ্গুর। ইমামা জানে হেলমেট পরা লোকটা আর কেউ নয়, সেই বর্বর, নরপিশাচ, নরপশু, নরখাদক— ম্যাডবিস্ট। কিন্তু একটা জিনিস ইমামা বুঝতে পারল না, ইমন তার ডাকে হুঁশ হারালো কীভাবে!
‘ন্যাসো নীরবমূর্তির মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। তার বাদামী রঙের শান্ত, দূরদর্শী চোখ দু’টো ভুলক্রমেও স্পর্ধা দেখালো না ইমামার মুখের দিকে ফিরে তাকানোর। জানের মায়া সকলেরই আছে, তার-ও আছে। তাই শুরু থেকেই নিজ দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়েছে।
‘ইমামা কৃতজ্ঞ গলায় বলল,”থ্যাঙ্ক ইউ সো ম্যাচ।”
‘ন্যাসো সামান্য হাসার চেষ্টা করল। যদিও তার চেহারার সাথে এই হাসি মানানসই না। তবুও সে আন্তরিক হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ডু নট ম্যানশন, ম্যাম। ইট’স মাই ডিউটি।”
‘ইমামার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। মস্তিষ্কের ধূসর কোষে এক গুরুতর প্রশ্নের ছায়া নড়েচড়ে উঠে। কিন্তু প্রশ্নটা ঠোঁটে ফুটে ওঠার আগেই ফোনটা কেঁপে উঠল। রক্তাভ মুখে তড়িঘড়ি ব্যাগ থেকে ফোন বের করল সে। নীলচে পর্দায় ভেসে উঠেছে সারাক্ষণ ষাঁড়ের মতো খেঁকিয়ে থাকা মানুষটার দৃঢ়, মনশীতল বার্তা,
“আমি আছি!”
‘আমি আছি।’ লোকটা বোধহয় এই দুই শব্দ বরফের রাজ্য থেকে নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে কিনে এনেছে। নয়তো এমন কী আছে এতে, যা অস্থির মনকে মুহূর্তেই শান্ত করে দেয়? যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতে এই দুই শব্দ প্রশান্তির নিঃশ্বাস হয়ে ভূমিকা পালন করে। এতো কীসের ভালোলাগা শব্দ দুটোই? ইমামা জানে না। তবে এটা জানে, এই অনুভূতি প্রকাশ পেলে তার গাম্ভীর্য ভেঙে যাবে। তাই মুখে ত্যাঁড়া ভাব টেনে লিখল,
“আপনি আছেন তো? এখন কী আপনাকে কোলে নিয়ে মুড়ি খাবো?”
‘সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এলো,”চাইলে কলাও খেতে পারো।”
‘থতমত খেয়ে গেল ইমামা। মুহূর্তেই মুখভঙ্গি বদলে গিয়ে কানের পাশে গরম ধোঁয়ার মতো কী যেন উড়তে লাগল। তড়িঘড়ি করে ফোনটা ব্যাগে গুঁজে দিল সে। তারপর সামনে তাকাতেই আবার চমকে উঠে। না, লোকটা নেই। মুহূর্তের মধ্যেই উধাও।
‘হতবিহ্বল ইমামা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখল, ইমন বেঞ্চিতে বসে ন্যাসোর আনীত আইসক্রিম খাচ্ছে নির্বিঘ্নে। ও যেন কিছুই টের পায়নি।
‘ইমান ওয়াসিমের কালো রঙের প্লাডো টা এসে থামল ভার্সিটি গেইটের সামনে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন ইমামা গাড়ি থেকে নামে, তখন ড্রাইবার সচকিত চোখে ফ্রন্ট মিররে দিয়ে ইমামার দিকে তাকাল। বরফের মতো জমে বসে আছে ইমামা। অথচ, কপালে চিনি দানার মতো শীতল ঘাম জমেছে। বরাবরের মতোই মুখটা পাথরের মতো, অনুভূতির কোনো ছোঁয়া লেগে নেই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই শঙ্কিত।
‘পরদেশীয় গায়ের রং, ভিন্ন ধাঁচের আদল আর লালচে চুলের জন্য চলতে-ফিরতে এতোদিনে নানারকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে থাকে। কিন্তু কখনো অস্বাচ্ছন্দ্যকর অনুভব করেনি। কিন্তু আজ প্রথমবার নিজেকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করছে ইমামা। কারণটা অজানা নয়। সেদিনের সেই সাজানো ভিডিওটা নিশ্চয়ই অনেকেই দেখেছে। এরপর সবাই তার সম্পর্কে কী ভাবছে, বা ভাবতে পারে—অবচেতনে তা টের পাচ্ছে ইমামা।
‘নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো তার মোমঢালা লালিত চেহারা অসংখ্য ছেলের রাতের ঘুম হারাম করেছে। তার ধনুকের মতো লতানো দেহ, লালিত্যে ভরা ওষ্ঠ, হরিণী চোখ,গোধুলি রঙা চুলের বাহার হাজারো যুবকের মনে তুলেছে প্রেমের ঢেউ। প্রেমের লাহরীতে ভাসতে ভাসতে কল্পনার জগতে তাঁরা কতভাবে, কত রূপে সাজিয়েছে ইমামাকে, তার কোনো ইয়াত্তা নেই। সবাই যে শুধু মোহাবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়েছে তার দিকে, তা নয়। কেউ কেউ খ্যাঁকশেয়ালের মতো কামুক চোখে গিলে খেয়েছে তাকে আড়াল থেকে। তার জন্য অনেক সম্পর্কে ফাটল পর্যন্ত ধরেছে। যার ফলে অনেক মেয়ের মনে জমেছে হিংসা আর ক্ষোভ। সেই ক্ষোভই এখন নীরব প্রতিশোধে পুঞ্জীভূত। তবে মাথার ওপর ক্ষমতাধর বাবার ছায়া ছিল বলেই কেউ সাহস পায়নি সামনে এসে কিছু বলার। কিন্তু আজ? যখন তো সুযোগ এসেছে, আজ তারা নিশ্চয়ই থেমে থাকবে না।
‘সময় নিয়ে গাড়ি থেকে নামল ইমামা। গভীর এক নিশ্বাস ফেলে ধীরে সামনে এগোল সে। কিন্তু ও গেইটের কাছে যাওয়ার আগেই একসঙ্গে পঞ্চাশজন ছেলে ভার্সিটির ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঝকঝকে পোশাক, নিখুঁত চুলের ছাঁটে বাহ্যিকভাবে তাদের সাধারণ ছাত্র বলেই মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের আসল পরিচয় অন্য। এরা টাকায় কেনা ভাড়াটে লোক। যারা অর্থের বিনিময়ে রূপ বদলায়, চরিত্র বদলায়। যেখানে যেমন বেশ দরকার, সেভাবেই তারা হাজির হয়। তারা ক্যাম্পাসে ঢুকেই মুহূর্তের মধ্যে ভিড়ের ভেতর মিশে গেল।
‘ইমামা যত ভেতরে এগোয়, ততই অসংখ্য শাণিত দৃষ্টি তার গায়ে এসে বিঁধতে থাকে। নত দৃষ্টি হলেও সে টের পায়, চারদিকের চোখ তার উপর গাঢ় হয়ে বসে আছে। কিন্তু যখনই কেউ কটুক্তির জন্য মুখ খুলতে যায়, তখনি মুখ খুলার আগেই তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় সেই ছদ্মবেশী ছেলেগুলো। এমনভাবে দাঁড়ায় যেন কাকতালীয় কিছু। অথচ, ইচ্ছাকৃতভাবে শার্টের কোণ সরিয়ে কোমরের রিভলভার ভাসিয়ে তুলতেই সকলের হাসির পরিবর্তে জায়গা নেয় আতঙ্ক। ঠোঁটের কোণে জমে যাওয়া তাচ্ছিল্য মুহূর্তেই উবে যায়। ভয় তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়। কেউ আর কিছু বলার সাহস পায় না ইমামাকে। এমনকি ফিরেও তাকায় না আর।
‘এইভাবেই ইমামা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় দুইতলায়। তবে যেমনটা ভেবেছিল, তেমন কিছুই ঘটে না। সবকিছু আজ অদ্ভুতভাবে স্বাভাবিক। অন্যদিনের থেকেও বেশ শান্ত। কেউ ধাক্কা খায় না ইচ্ছে করে, কেউ দূর থেকে ব্যঙ্গ হাসে না, কিংবা কানাঘুষায় তার নাম ফোটায় না। হঠাৎ করেই সব যেন থেমে গেছে নিস্তব্ধ এক ষড়যন্ত্রের মতো।
‘তিনতলায় পৌঁছাতেই প্রফেসর তাসনিম দ্রুত এগিয়ে এসে স্নেহভরে ইমামার কাঁধে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আরে ইমামা! তুমি এতোদিন এলে না কেন? অসুস্থ ছিলে নাকি, বেটা?”
‘হঠাৎ প্রশ্নে আর কৃত্রিম মমতাময়ী স্পর্শে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় ইমামা। গলায় হালকা কাঁপন নিয়ে বলতে চাই,
“আসলে, ম্যাম…
‘তাসনিম ম্যাম তার কথা শেষ করতে দেয় না। ইমামার হাত টেনে ক্লাসরুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“ওই বিষয়টা নিয়ে এখনো কি আপসেট তুমি? একদম এসব নিয়ে ভাববে না, ইমামা। আমরা সবাই জানি ওটা তুমি ছিলে না। আমরা তোমার উপর বিশ্বাস রাখি। চলো, ক্লাসে যাই। আমি আর প্রিন্সিপাল স্যার তোমার বাবার সাথে কথা বলবো, বুঝাবো।”
‘আজ ক্লাসে কেউ আসেনি। না, কেউ আসেনি বললে ভুল হবে। ইমামার কেউ আসেনি। অর্ক, গৌরব, হিয়া, ইতরাত ওরা কেউই নেই আজ। চারপাশে হাসিঠাট্টা, চিৎকার, পদচারণার শব্দে পুরো ক্লাসরুম গমগম করছে, তবুও ইমামার ভেতরটা শুনশান। শান্তমূর্তির মতো কিছুক্ষণ বসে থাকে সে। নিস্পৃহ মুখে গ্রীবা বাঁকিয়ে আশপাশে ফিরে তাকায়। এই চাকচিক্য, এই মানুষ, এই কোলাহল, কোনোকিছুই ছুঁতে পারে না তাকে।
‘একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগটা তুলে নেয় সে। ওদের ছাড়া সে কখনো ক্লাস করেনি,আর না করতেও পারবে। যদিও সে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার মন স্থীর হয়নি সেই শূন্য ক্লাসে, যেখানে তার বন্ধুরা নেই। ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল ইমামা। সিঁড়ির দিকে এগোতে থাকে, তখনি ফোনটা উচ্চশব্দে চেঁচিয়ে উঠল। আবারও শয়তানটার কণ্ঠে ভেসে এলো বিরহে ভেজা সুর,
“তুমি ছাড়া শূন্য, শূন্য লাগে,
ঠোঁটে আসে নাম,তোমার বারে বারে
বোঝায় কাকে, এ-কেমন ব্যাথা…
তুমি বড়ো প্রিয়, আমার প্রিয়
তুমি আমার মনের আঙিনায় থাকো
তুমি এতো প্রিয় আমার কাছে, কতো প্রিয় আমার কাছে, এতো প্রিয় আমার কাছে, জানো না?”
“সন অব বিচ।” ইমামা লিখল।
‘উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে ফোন ব্যাগে রেখে দিল সে। হঠাৎ করেই নিজেকে কেমন অনুভূতিশূন্য লাগছে। মনে হচ্ছে, কোনোকিছুরই তাকে ছুঁতে পারছে না। অন্যমনস্ক হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ভুলবশত একজনের সাথে ধাক্কা লাগে। এই সুযোগে ছেলেটা অকস্মাৎ ওর বুকে হাত দেয়। ছদ্মবেশী ছেলেগুলো আড়াল থেকে ছুটে আসার আগেই ইমামা করে বসল এক ভয়ংকর কান্ড। হিলের সুচারু অংশ দিয়ে লাথি বসাল ছেলেটার গোপনাঙ্গে। ছিটকে গিয়ে মেঝেতে পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত জায়গা চেপে ধরে ব্যথায় কাতরাতে থাকে ছেলেটা। ইমামা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন যুদ্ধক্ষেত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।
“আরেকবার লাগতে আসলে কেটে হাতে ধরিয়ে দিবো, শুয়োর।”
‘ঝাঁঝালো বাক্য গুলো চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করে হনহনিয়ে চলে যায় সে। ইমামা চলে যেতেই সেই ছেলেগুলো নিচ থেকে আহত ছেলেটাকে তুলে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যায়।
‘ইমামা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সোজা গার্ডেনের পথে হাঁটল। জারুল গাছের ছায়ায় একা একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ল সে। আনমনে ভাবনায় ডুবে গেল—উপন্যাসে, কবিতা আর সাহিত্যজুড়ে কত লেখক, কত কবি নারীর সৌন্দর্য নিয়ে তো লিখেছেন। বলা হয়, মানুষ নাকি সৌন্দর্যের পূজারী। পুরুষ মুগ্ধ হয় নারীর রূপে। কিন্তু ইমামা এটা বিশ্বাস করে না। তার মতে পুরুষের মুগ্ধতা দিনের আলোর মতো—যতক্ষণ আলো থাকে, ততক্ষণই রূপের কদর। রাত নামলেই বদলে যায় সব। তখন সৌন্দর্যের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় শুধু বুকের নরম মাংসপিণ্ড আর একটা ছোটো পিচ্ছিল পথের। নয়তো সুযোগ পেলেই পুরুষের হাত নারীর শরীরে যায় কেন? সাহায্যের হাত বাড়ানোর বদলে শরীর ছোঁয়ার তাগিদটাই কেন এত প্রবল?
‘ইমামা পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করে না। করতে পারে না।
তার জীবনে বাবা আর ভাইয়ের পর সবচেয়ে বিশ্বস্ত পুরুষ ছিল তিন বন্ধু। একজন তো চলে গেছে, রয়ে গেছে দুইজন। ইমামা জানে সাময়িক অভিমান যত গভীরই হোক, তাদের প্রতি তার বিশ্বাস কখনো ভাঙবে না।
‘চব্বিশ বছরের জীবনে কোনো ব্যক্তিগত পুরুষ ছিল না তার। সিডকে মন থেকে বিয়ে করতে চায়নি সে, তবু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়েছিল অসহায়ের মতো অপারগভাবে। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে সিডকে বিশ্বাস করার চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানেও হার মেনেছে। বিশ্রিভাবে ঠকতে হয়েছে তাকে। ভাগ্যিস তখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। নয়তো আঘাতটা কতটা গভীর হতো, ভাবতেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।
‘তারপর থেকেই ‘বিশ্বাস’ শব্দটা তার কাছে ভয়ানক এক দানব। পুরুষের পাশে থাকলেই অস্বস্তি ঘিরে ধরে তাকে। কিন্তু, কিন্তু সেই মানুষটা, ওই অচেনা লোকটা অদ্ভুতভাবে তার ভেতরের প্রাচীরটা ভাঙতে শুরু করেছে। ইমামার কঠিন হৃদয় যেন ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছে। ইমামা বোকা না। সে সবই বুঝতে পারে। কিন্তু কেন? কেন এই অস্থিরতা, কেন না চাইলেই বিশ্বাস করে ফেলা, কেন এই স্বস্তি অনুভব করা? কারণটা কি সত্যিই সে জানে না, নাকি জানে কিন্তু স্বীকার করতে ভয় পায়? নাকি ভা…..
“বিষন্নসুন্দরী….
‘ভাবনার সুঁতোয় টান পড়ল মেয়েলী কণ্ঠে। চাঁদের গায়ে মেখে থাকা কুয়াশার কোমলতার মতো নির্মল মুখে সর্বক্ষণ মেলানকোলিক কবিতার ভারি নিঃশ্বাসের সাথে মিশে থাকা বিষন্ন ভাব লেপ্টে থাকত বলে দু’জন মানুষ তাকে সবসময় ‘বিষন্নসুন্দরী’ বলে ডাকত। একজন কারিব আর অপরজন ইবরাত। একজন তো চলেই গিয়েছে, আরেকজন..
তাহলে কি….
‘তুফানের বেগে গ্রীবা বাঁকিয়ে ডানে ঘুরে বসে ইমামা। সামনে তাকানোর আগেই ইবরাত ঝড়ের মতো দ্রুত এসে ইমামাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখে। ইমামা স্তম্ভিত। পাথরের মতো জমে যায় ওর শরীর। ইবরার দু’হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় করল। আশ্চর্যবিমূঢ় ইমামাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজে থেকে বলতে শুরু করল,
“আই’ম সো স্যরি রে ইমু। সো, সো, সো চড়ি বিদেশি অ্যাপস। পিলিজ আমাকে ক্ষমা করে দে। আমার চুনুমুনু, আমার ওপর রাগ করে থাকিস না। আমি মানছি, আমি ভুল করেছি—তোকে অবিশ্বাস করেছি, কষ্ট দিয়েছি, দূরে সরিয়ে দিয়েছি। তুই তো বুদ্ধিমান। তুই নিজেই একবার সবটা ভেবে দেখ তো; আমাদের জায়গায় থাকলে কী তুই রাগ করতি না বল? আমাদের রাগ করাটা কি অস্বাভাবিক ছিল? কারিব আমাদের কতটা আপন ছিল, সেটা তো তুই জানতি। ওর হঠাৎ মৃত্যু আমাদের সকলকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সবাই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিল। তখন মনে হয়েছিল, তুই বার বার রিজেক্ট করেছিস ওকে, সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে ও সুই-সাইড করেছে। কিন্তু এখানে তো তোর ভুল নেই। ভালোবাসা তো আর জোর করে হয়না। তুই তোর জায়গা থেকে ঠিক ছিলি। একটু দেরিতে হলেও আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। বাকিরাও বুঝবে। ওদের একটু সময় দে। ওরা সবাই আবার তোর কাছে ফিরে আসবে। আমার মতো ভুল বুঝতে পেরে মাফ চাইবে। হিয়া অসুস্থ; সেজন্য আজ আসেনি। গৌরব আর অর্ক একটা কাজে গিয়েছে। আমি ওদের বোঝাবো, সুন্দর করে বোঝাবো। খুব দ্রুত ওরা ওদের ভুল বুঝতে পারবে। প্লিজ আমাদের ওপর আর রাগ করে থাকিস না। আমরা কেউই তোকে ছাড়া ভালো ছিলাম। তুই অসুস্থ ছিলি সময় কতবার ইমনকে কল দিয়েছি আমরা, বিশ্বাস না হলে ইমনকে জিজ্ঞেস কর তুই।”
‘ইমামা জানে তার জ্বরের দিনগুলোতে তার বন্ধুরা কতবার ইমনকে ফোন দিয়ে তার খোঁজ নিয়েছে। সে সবই জানে। আর এটাও মানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে তাদের প্রতি রাগ দেখানো স্বাভাবিক। কিন্তু এই মুহূর্তে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর। শয়তানটা সেদিনও ইবরাতের কথা উল্লেখ করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। ইমামা চায় না, তার কারণে তার বন্ধুরা কোনো ক্ষতিগ্রস্ত হোক।
‘ইমামা ইবরাতকে টেনে সোজা করে করাল। দু’হাতের আঁজলায় ওর মুখ আলতো করে চেপে ধরে নরম গলায় বলল,
“ইবরাত, তোদের ছাড়া আমিও থাকতে পারি না। তোরা দূরে থেকেও আমার পাশে আছিস, সেটা আমি জানি। কিন্তু এখন সবকিছু পাল্টে গেছে। প্লিজ, আর ক’দিন আমার দূরে থাক। সব ঠিক হয়ে গেলে আমি সব খুলে বলব তোদের।”
‘ইমামা এসব কথার মানে ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না ইবরাত। সে আবারও ইমামাকে জাপ্টে ধরে বলল,
“আমি বুঝেছি, তুই এখনও রেগে আছিস, তাই তো? ওকে, যতক্ষণ না তোর রাগ ভাঙে, ততক্ষণ তোকে এভাবেই জড়িয়ে রাখব আমি।”
‘ইমামা কিছুতেই ইবরাতকে তার ভয় সম্পর্কে বোঝাতে পারে না। ইবরাতকে ছাড়াতে চায়, কিন্তু ইবরাত ছাড়ে না। অস্থিরতা তরঙ্গ ওর ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক তখনই ইমামার ফোনে আবারও আসে সেই শীতল মেসেজ,
“আমি আছি।”
‘অদ্ভুতভাবে ইমামা এক মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল। ভরসার একটা আঁচ পেল। ধীরে ধীরে বুঝতে পারল তার কথার মানে। ফোনটা আবার ব্যাগে রেখে অল্প হেসে বলল,
“আচ্ছা যা, মাফ করেছি।”
‘ইবরাত চট করে মাথা তুলল, চোখ বড় বড় করে জানতে চাইল,”সত্যি?”
‘ইমামা মিকি হেসে মাথা নাড়াল। ইবরাত ওর গাল বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তাহলে একটা চুম্মা দে।”
‘ইমামা নাক কুঁচকিয়ে বলল,”ছিঃ ইবরাত, তুই মেয়ে।”
“তো কী হইছে, চুম্মা দে একটা। তাহলেই বুঝবো তুই রাগ করে নেই।”
“না, আমি দিতে পারব না।”
“কেন?”
“তুই জানিস, এগুলো আমার ঘেন্না লাগে।”
‘ইবরাত ভেংচি কেটে বলল, “শালির ঘরে শালি, এতো যে ঘেন্না লাগে, বিয়ের পরে কি কলা খাবি? তোর জামাইয়ের কপাল পোড়া। আই ফিল সো ব্যাড ফর হিম।”
‘ইবরাতের কথা শুনে হঠাৎ ইমামার মনে পড়ল সেই চিরায়ত ব্যক্তির গম্ভীর কণ্ঠে কিছুক্ষণ আগে বলা নির্লজ্জ মার্কা কথাটা। পেটের ভেতর অদ্ভুতভাবে গুড়গুড় করতে লাগল। ইবরাত হঠাৎ ওয়াশরুমের নাম করে সরে গেল৷ কিন্তু ভেতরে গেল না; আড়ালে গিয়ে ফোনে কাউকে কল দিল। রিসিভ হতেই কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলল,
“থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ আর.কে, আমার ভুলগুলো ভেঙে দেওয়ার জন্য। সত্যিই, আমরা ভুল করেছিলাম। এতোদিন নিজের সঙ্গে লড়ে যে দ্বন্দ্ব থেকে বেরোতে পারিনি, তা এক ঝটকায় আপনি ভেঙে দিয়েছেন। আপনি সত্যিই জিনিয়াস। আপনার জন্য আমাদের ফেন্ডশিপ আবারও জোড়া লাগল। আশা করি, বাকিরাও তাদের ভুল বুঝতে পারবে। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।”
‘ওপাশের কণ্ঠস্বর পাথরের মতো গম্ভীর। কোনো সৌজন্য নেই, কোনো কোমলতা নেই, অথচ কথায় আছে অদ্ভুত ভার,
“ডু নট ম্যানশন। ইটস মাই ডিউটি টু মেক হার লাইফ লাইক আ হেভেন। ওর পাশে এই মুহূর্তে ওর বন্ধুদের প্রয়োজন। ইউ গাইজ এনজয় ইওর টাইম।”
‘লোকটা কল কেটে দিতে উদ্যত হলো। ইবরাত খুব অল্পেই বুঝে গিয়েছে এই লোকটা স্বল্পভাষী। কিন্তু কল কাটার আগে হঠাৎ ইবরাত তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
“আপনি কী সত্যিই ইমামাকে ভালোবাসেন?”
“মুখে বলে কী হবে? যদি কাজে প্রমাণ না পায়?”
‘মুখের ওপর কল টা কেটে গেল। কিন্তু ইবরাতের ছোট মস্তিষ্কে এই পেঁচানো কথার মানে ঠিকভাবে আটকালো না।
‘আজ রোদের প্রখরতা অসহনীয়। পচাঁ সূর্য মামা টা যেন মাথার ওপর খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গলা শুকিয়ে গেছে ইমামার। হঠাৎ তীব্র কাশি ধরে। কাশতে-কাসতে ওর গলা ব্যথা পাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে, কেউ হঠাৎ সামনে এগিয়ে দেয় একটি পানির বোতল।
‘ইমামা চমকে হাতের মালিকের দিকে তাকালো। যখন সে ন্যাসোর মুখ দেখল, অদ্ভুতভাবে কাশি থেমে গেল। ন্যাসোর দৃষ্টি অন্যদিকে। সামনের দিকে তাকালে যেন তার পাপ হবে। ইমামা বোতল নেবে না বুঝতে পেরে ন্যাসো সামান্য গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“ম্যাম, আমি আর.কে-এর লোক। আই মিন, হিজ রয়াল বডিগার্ড।”
‘দূরত্ব বজায় রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। ইমামার দৃষ্টি ক্রমশ সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। তেরছা কণ্ঠে বলল,
“তো?”
“আমি আপনার ডিউটি পালন করছি।”
“আপনার ডিউটি?” ইমামা জিজ্ঞেস করল। বলার মধ্যেই ন্যাসোর হাত থেকে বোতল নিয়ে তৃষ্ণা মেটালো। অতঃপর ইমামা নিজেই অবাক হয়ে রইল। সেদিন কুকুড়ের মাংসের সুপের পর থেকে ও আর কাউকে বিশ্বার করতে পারে না। সেদিনের পর থেকে কারো হাতের খাবারে খায় না,আর না তো বাইরের খাবার। এমনকি বাসায়ও নিজের রান্না নিজে করে খায়। কিন্তু ইমামা আজ নিজেই অবাক। শুধুমাত্র লোকটার নাম শুনে এভাবে নির্দ্বিধায়, কোনো সংকোচ ছাড়াই খেতে পারছে সে। একটুও ভয় কিংবা দ্বিধা কাজ করল না। এর কি মানে সে সেই লোকটাকে ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে?
‘ন্যাসো স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বুকের ওপর হাত ভাজ করে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“জি। আগে পার্ট টাইম ছিল, এখন ফুল টাইম। আই মিন এখন আপনাকে চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখছি—এটাই আমার ডিউটি।”
‘ইমামা ন্যাসোর কথায় থতমত খেয়ে গেল। এর মানে কী? সে কে, যে তাকে চব্বিশ ঘণ্টা নজরে রাখার সাহস দেখাচ্ছে? এই এখতিয়ার তাকে কে দিয়েছে? হঠাৎই মনে পড়ে গেল তাদের গতকালের শর্ট কনভেনশন,
“তুমি ফুলের চেয়েও সুন্দর, বিশ্বাস করো তো?”
‘ইমামা টাইপ করার আগেই তার মেসেজ আবার আসে,
“তুমি ভোরের চেয়েও স্নিগ্ধ, মানো তো?”
‘ইমামা হতভম্ব। হঠাৎ এসব কী বলছে এই লোকটা? আর এই তুমি! হঠাৎ তুই কেন? সে তো কখনো তাকে তুমি বলেনি, সবসময় আপনি ব্যবহার করেছে। রেগে গেলে তুইতোকারি করেছে। তখন ইমামাও কথা দিয়ে ছাড়েনি। চিবুক শক্ত করে ইমামা লিখল,
“না।”
‘সে আরও লিখল,
“তুমি সূর্যের মতো তেজি, মানো?”
“হ্যাঁ!”
“তোমার ভেতরটা মাঘের মতো শান্ত, বর্ষার মতো ভেজা, বুঝো?”
‘ইমামা চুপ। সে আবার জোর দিল,
“তোমার আমাকে প্রয়োজন, বিশ্বাস করো?”
“আমার কাউকে প্রয়োজন নেই।”
“আমার তোমাকে প্রয়োজন, বড্ড প্রয়োজন।”
‘ইমামা আবার চুপ। তখন সে শেষবার লিখল,
“মেরি ইস্ক ম্যে তেরি জান ফানাহ্ হো যায়!”
‘ইমামার মনে উদ্দীপনা আর সন্দেহ এক সঙ্গে জেগে ওঠে। লোকটা কি সত্যিই তাকে প্রেমে ফেলার জন্য এসব করছে? সে তো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল—সে ইমামাকে তার প্রেমে ফেলে ছাড়বেই। কিন্তু হারার মেয়ে তো ইমামা নয়।
‘হঠাৎ ইমামা সরাসরি ন্যাসোর উদ্দেশ্যে বলল,”আপনার শার্টে হিডেন ক্যামরা সেট করা আছে, রাইট?”
‘ন্যাসো ইমামার চতুর বুদ্ধিতে কিছুটা ভরকে গেলেও মিথ্যার আশ্রয় নেয়নি। শীতল কণ্ঠে বলল,
“শুধু আমার না, সবার!” সামনের দিকে ইশারা করল সে। ইমামা তাকালেই দেখতে পেল ছদ্মবেশী ছেলেগুলোকে। সে চমকে উঠল। ন্যাসো এবার গেইটের দিকে ইশারা করল। ইমামা সেদিকে তাকাতেই শিউরে উঠল. এতো গার্ড একসাথে সে আগে কখনো দেখেনি। শুকনো ঢোক গিলে ভেতরে, ভেতরে মিইয়ে গেলেও তেজ নিয়ে বলল,
“তারমানে, আপনার বস সবসময় আমাকে দেখতে পাচ্ছে, রাইট?”
“ইয়েস, ম্যাম।”
“চোখ বন্ধ করুন।”
“সরি, ম্যাম।”
“মানে?”
“এক সেকেন্ডের জন্য আপনাকে চোখের আড়াল করলে, আমার চোখ তুলে নেওয়া হবে,ম্যাম।
“আই সেইড, ক্লোজ ইওর আইসস!”
‘সারাক্ষণ কানে গুঁজে রাখা ব্লুটুথে তৎক্ষনাৎ সংকেত এসে পৌঁছল। উপরের হুকুম পাওয়ার পরই ন্যাসো চোখ বুজে। ইমামা সঙ্গে সঙ্গে মধ্যমা আঙুল বের করে দেখিয়ে দিল। তা দেখে ল্যাপটপের সামনে থাকা মানুষের ঠোঁটে এক চিলতে ক্রূর হাসি ফুটে উঠল। তার গভীর দৃষ্টি ল্যাপটপের স্ক্রিনে আটকে। অথচ স্ক্রিনের পিছনে রক্তের বন্যা। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অস্ত্র, ড্রাগস, আর মেঝেতে কয়েকজনকে জবাই করা হচ্ছে। নিশ্চয়ই এখানে কোনো কাজের ভুল বা প্রতারণার শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
‘ন্যাসো চলে যেতেই ইবরাত এসে ইমামার পাশে বসল। বসেই সবসময়ের মতো হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
“এহহহহ্, বিয়ে করে ফেলবো। বাঁচবোই বা আর ক’দিন?”
‘ইমামা বলল,”তুই মুখে রোজই বিয়ে করে ফেলিস।”
‘ইবরাত জবাব দেয় না। শব্দ করে শ্বাস ফেলে। ইমামা কি যেন ভেবে হঠাৎ বলল,
“কারিব কয় জানি তারিখে মারা গেছে, ইবু?”
‘ইবরাত সচকিত চোখে তাকাল ইমামার দিকে। ইমামার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। একবার একটা কিছু দেখলে সেটা আর কখনোই ভুলে না ইমামা।
“মানে? তুই কী সত্যি মনে করতে পারছিস না কারিব কবে মারা গেছে?”
‘ইমামা মাথা নাড়াল। সে চেষ্টা করল অনেকক্ষণ মনে করার। কিন্তু, যখনই বুঝতে পারল, সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না, তখন মনের অজান্তেই চোখের কোণ ভিজে আসে। অন্তরে নামে আঁধার।
‘ইবরাত ভাবল ইমামা হয়তো ওর অসুস্থতা নিয়ে চিন্তিত, তাই বেফাঁসে ভুলে গেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাত রাখল ইমামার পেটের বাঁ দিকে। মোম গলা নরম কণ্ঠে বলল,
“এবার অপারেশন টা করিয়ে নে, ইমু।”
‘ইমামা ইবরাতের হাত সরিয়ে দিয়ে বেঞ্চে গা হেলিয়ে চোখ বুঁজে। নিরেট ঠান্ডা গলায় বলল,
“আমার জন্য কারো জীবন রিস্কে পড়ুক, তা আমি চাই না ইবরাত।”
‘গর্জে উঠল ইবরাত,”তোর এসব কথা রাখ তো ইমু। একটা কিডনি নিয়ে দিব্বি বাঁচা যায়।”
‘ইমামার ঠোঁটে নির্জীব হাসি। চেহারার উজ্জ্বলতা আছে, কিন্তু প্রাণ নেই। হঠাৎ ও উঠে দাঁড়াল।
“আমার একটা কাজ আছে। আমি আসছি রে।”
‘তারপর ইবরাতকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। অফিসার মাহেশ সেদিন রাতে এক্সিডেন্ট করেছে। এখন হসপিটালে আছে। ওনার সাথে দেখা করা খুব প্রয়োজন। এখনো অনেককিছু জানার আছে। তার হাতে সময় কম, যা করার দ্রুত করতে হবে।
‘ইমামার গাড়ির ঠিক পিছনেই ন্যাসোর গাড়ি। পিছনে আরও কয়েকটা গাড়ি আছে। ন্যাসো চোখ এক মুহূর্তের জন্যও সামনে থেকে সরে না। আচমকা ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে লেখা—‘Boss’। বুকের মধ্যে শুকনো ঢোক গিলে কলটা রিসিভ করল সে।
“বস, নজরে আছে। ডোন্ট ওয়ারি।!
‘ওপাশ থেকে ভারি, ঠান্ডা কণ্ঠস্বর,”কাজে কোনো ভুল যেন না হয়, ন্যাসো।”
“ওকে, বস।” তারপর একটু থেমে নরম গলায় বলল,”লোকার কাছ থেকে শুনলাম ইদানীং ফাদারের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না?”
‘তার কণ্ঠে বজ্রপাত,”দ্যাটস নান অব ইওর বিজনেস।”
“সরি, বস।”
‘একটু নীরবতা। তারপর বসের কঠিন গর্জন,
“ওই বাষ্টার্ডটাকে খুঁজে বের করতে আর কতদিন লাগবে?”
‘ন্যাসোর গলায় চাপা ক্ষোভ আর অসহায় রাগ,”বস, রাস্কেলটা ভীষণ চালাক। চোখের সামনে দিয়েই ফসকে যায়। আর ওর সঙ্গে একটা সাপ আছে। যখনই ধরতে যাই, ওই সাপটা আক্রমণ করে। এখন পর্যন্ত আমাদের চারজন গার্ড মারা গেছে। ফরেনসিক রিপোর্টে বলেছে ওই সাপটা বিশ্বের সবচেয়ে বিষধর প্রজাতি সাপগুলোর মধ্যে একটা।”
‘তার কণ্ঠে জমে থাকা দুনিয়ার সমস্ত ক্ষোভ,”তাহলে আগে এই সাপটাকেই চাই।”
“ওকে, বস।”
‘ন্যাসো থেমে একটু ইতস্তত করল,”শুনলাম, ড্রাগসের চালানে নাকি দশ মিলিয়ন ডলারের লস হয়েছে?”
“হু কেয়ার্স?”
‘ন্যাসো চুপ করে গেল। তারপর গলা নিচু করে বলল,
“আমার মনে হয়, আপনার এবার একটা সিদ্ধান্তে আসা উচিত।”
“আই’ভ অলরেডি মেড আপ মাই মাইন্ড — শি’জ দ্য অনলি ওয়ান।”
‘বসের এই স্বীকারোক্তিতে ন্যাসোর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটল। কুটিল হেসে বলল,
“তা দেখা হচ্ছে কবে?”
‘ওপাশের কণ্ঠ হঠাৎ বিস্ফোরিত হল,”ওই বিচ কালকেও সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে!”
“কি বললেন?” আঁতকে উঠল ন্যাসো। “সোফিয়া আবার সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছে?
“রিল্যাক্স, মরেনি।”
‘ন্যাসো গভীর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ছোট্ট মুখে একটা কথা বলি, বস—এতটাও আসক্ত হবেন না, যতটা হলে ধ্বংস হবার সম্ভাবনা থাকে।”
‘ওপাশের কণ্ঠে নির্লিপ্ত দৃঢ়তা,
“তাকে পাওয়ার জন্য যদি ধ্বংস হতে হয়—তাহলে ধ্বংসের ময়দান নিজের হাতে সাজাবে, রিচার্ড কায়নাত।”
❌
‘এবার সব বাচ্চারা খুশি তো? নাম রিভিল করে দিছি। আরও ছয় পর্ব পর যেটা রিভিল করা হতো, আপনাদের অস্থিরতায় অস্থির হয়ে সেটা এখনই করে দিলাম। তারপরও যদি আজকে মনমতো রেসপন্স না আসে—যারা চুপি চুপি পড়ে চলে যায়, তাদের বললাম—লুকাসের থেকেও কাইল্লা জামাই জুটবে কপালে।🤢
Share On:
TAGS: born to be villains, মিথুবুড়ি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
Born to be villains পর্ব ১৪(প্রথমাংশ+শেষাংশ)+বোনাস
-
Born to be villains পর্ব ১৫
-
Born to be villains পর্ব ১১
-
Born to be villains পর্ব ৭
-
Born to be villains পর্ব ৯
-
Born to be villains পর্ব ১২
-
Born to be villains পর্ব ৪
-
Born to be villains পর্ব ৮
-
Born to be villains গল্পের লিংক
-
Born to be villains পর্ব ৩