born_to_be_villains
methuburi_মিথুবুড়ি
পর্ব_০৫(প্রথমাংশ)
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌
‘সরকার বাড়িটা আজ হঠাৎ শোকের আবরণে ঢেকে গেছে। দরজার সামনে দূর্ভেদ্য ভিড়। একঝাঁক অবিশ্বাস্য, হতবিহ্বল দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয়েছে বসার ঘরের ঠান্ডা মেঝেতে শুইয়ে রাখা সাদা কাপড়ে ঢাকা মৃতদেহের উপর। কারও মুখে স্তম্ভিত শূন্যতা, কারও চোখে অশ্রু-গঙ্গা। মূর্তির মতো নিশ্চল, নিস্পলক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বিমর্ষ মানুষগুলোর ঠোঁট একটু পরপর কেঁপে উঠছে হাহাকারে।
‘এ যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী। সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো নিস্তেজ দেহখানাকে ঘিরে রয়েছে অজস্র মানুষ, অথচ ঠোঁট কাঁপলেও কারো নিস্তেজ বিমর্ষ মুখ হতে শব্দ বেরোয় না। শুধু মাঝেমধ্যে ভেতর থেকে ভেসে আসছে বুকফাটা কান্নার শব্দ। শোর্কাত মানুষের কোলাহল, বুকফাটা কান্না, হাহাকার, বিলাপ, ক্রন্দন, মাতম, বুক চাপড়ানো, আর্তচিৎকার আর আগরবাতির গা-জ্বালানো বিদঘুটে গন্ধে শোকে গেয়ে উঠেছে সরকার বাড়ি। মনে হচ্ছে পুরো পরিবেশটাই যেন কান্না চেপে ধরে আছে৷
‘প্রচন্ড বেপরোয়া গতিতে দু’টো বাইক আর একটা স্কুটি এসে থামল সরকার বাড়ির প্রধান ফটকে। দামি ব্যান্ডের আকর্ষনীয়, নজরকাড়া মডিফাই করা বাইক টা তুচ্ছ বস্তুর মতো ফেলে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ভেতরে ছুটে গেল গৌরব আর অর্ক। পিছন, পিছন কান্নাভেজা মুখে ছুটে গেল ইবরাত আর হিয়া। তারা অন্দরে প্রবেশ করতেই আরেকটা দামি গাড়ি এসে থামল ফটকে। ইমান ওয়াসিম বেরিয়ে আসার আগেই ইমামা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ভেতরে গেল।
‘পাঁচ জোড়া স্তম্ভিত চোখ স্থির হয়ে রইল সেই নিস্তেজ মুখের ওপর। রক্তশূন্য মুখখানি, অথচ ফ্যাকাসে ওষ্ঠে লেগে আছে স্নিগ্ধ এক হাসির আবরণ। মনে হয় অভিমানী কোনো শিশু ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভাঙলেই আবার প্রাণবন্ত হয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করবে। কিন্তু আজ আর সে ওঠে না। পাশে বসে মায়ের বুকভাঙা ক্রন্দন, আকাশবিদারী আর্তনাদ—তাও কি তার কানে পৌঁছায় না? নাকি সে সত্যিই সকলের স্নেহ-ভালোবাসা পেছনে ফেলে চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছে!
‘কারিবের মা হাউমাউ করে কাঁদছেন। তার বড় ভাই মাকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। করিম সরকার স্নেহের ছোট ছেলের এই অকালমৃত্যু মানতে পারেনি। বর্তমানে লাইফ সার্পোটে আছেন চিকিৎসাধীন। কোন এক রক্তপিপাসু যেন একরাতের ব্যবধানে গ্রাস করে নিয়েছে সরকার বাড়ির আঙিনায় ঢেউ খেলানো বিস্তীর্ন হাসির ঢেউ।
‘পাঁচজোড়া পদযুগল যেন জমাট বাঁধা ভারি সীসার মতো আঁটকে গেল সেখানেই। চোখের পাতা নড়ে না। পাঁচজনের মুখেই নিস্তেজ বিমর্ষতা, ঠোঁট কেঁপে উঠল কথা বেরোতে না পেরে। তাঁরা নিস্পলক শূন্য দৃষ্টিতে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আছে—যা ছিল তাদের জন্য ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের থেকেও নিষ্ঠুরতম বাস্তবতা। হিয়া ফুঁপিয়ে ওঠে গৌরবের পেশল শক্ত বাহুবেস্টনে মুখ লুকাতে গিয়ে টের পেল পুরুষালী বলিষ্ঠ শরীর টা তীব্র এক ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠেছে। অর্ক তার শরীরের ভার ধরে রাখতে পারল না, পিছিয়ে যেতে নিয়েও আবার সোজা হয়। ইবরাত ধরতে চায় অর্ক, কিন্তু অর্ক দাঁড়ায় না, এগিয়ে যায় কারিবের কাছে। ইবরাত মুখে ওড়না চেপে ঠুকরে উঠল। এ মেয়েটিকে সবাই চিনত তার হাসি আর হাসানোর জন্য। অথচ ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া সেই ছেলে আজ তাকে-ও চোখ ভিজিয়ে কাঁদিয়ে দিয়ে গেল।
‘অর্ক কাছে যেতেই কারিবের লা-শের পাশে বসে থাকা বয়স্ক দু’জন ওঠে সরে গেল। অর্ক পরপর কয়েকবার গরম নিশ্বাস ত্যাগ করে কারিবের পাশে বসল। তারপর ধীরে, ধীরে ঝুঁকল কারিবের মুখের ওপর। আলতো করে হাত রাখল কারিবের গালে, অপর হাতে নিজের হাহাকার করা বুক চেপে ধরল। বরফের মতো ঠান্ডা ছেলেটার গাল, লোহার মতো শক্ত চোয়ালের পেশি। অর্ক ওর গাল চাপড়ে ডাকল,
“কারিব, দোস্ত? এই দোস্ত! তুই এটা কী করলি রে ভাই?”
‘দু’টো কথা বলতে না বলতেই গলা ভিজে আসে অর্কর।
ফিসফিসে কান্নায় হঠাৎ করেই ভেঙে পড়ল সে,,
“তোর ছোট্ট বুকে এতো কষ্ট জমা ছিল, আমরা টেরও পেলাম না, দোস্ত?”কারিবের চোখ মেলতে চাইল অর্ক,”এই দোস্ত, চোখ খুল বলছি৷ একটু কথা বল দোস্ত। বলনা রে দোস্ত, তোর এতো কীসের কষ্ট ছিল, যা আমরা ভাগাভাগি করে নিতে পারতাম না! এই দোস্ত, এই দোস্ত রে? বল না রে দোস্ত…
‘হঠাৎ করেই অধৈর্য হয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে তেতে উঠল অর্ক,
“আরে এই হারামি, চোখ খুল। পুরো একটা বন্ধুমহলকে কাঁদিয়ে তুই এভাবে চলে যেতে পারিস না। চোখ খুলে দেখ হারামি, সবাই কান্না করছে। আমরা তো একসাথে হাসতাম, তাহলে আজ কেন একা কাঁদতে হচ্ছে? উঠ দোস্ত! প্লিজ দোস্ত—আমরা আজকেও ক্লাস মিস দিয়ে রাইডে যাবো। দোস্ত রে চোখ খুল না। ভাই আমার বোঝার চেষ্টা কর—পোলা মানুষ আমি, তাও সবার সামনে কাঁদছি। মানুষ কী ভাবছে বল তো? আমার খুব লজ্জা লাগছে কারিব। তুই উঠ দোস্ত। সারাজীবন তোরা আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছিস, মেনে নিয়েছি। কিন্তু আজ মানব না। আজকে আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে রে দোস্ত। তুই শুধু একটা বার চোখ খুলে দেখ, তোর সব কষ্ট আমি দূর করে দিব। তোর বন্ধুরা তোর জন্য সুখ কিনে আনবে, তুই শুধু একটাবার চোখ খুল, ভাই আমার।”
‘অর্কর চোখের জল থামছেই না, বারবার গাল ভিজে যাচ্ছে। এতোদিনের বন্ধুত্ব—দশটা বছর একসাথে কাটিয়েছে তারা। হেসে খেলে, দুষ্টুমি করে পার করেছে কতগুলো বছর। আজ সেই ছেলেটা এভাবে চলে যাবে! কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? অর্ক বারবার চেষ্টা করে কারিবের চোখ খুলতে। কারিবের মা বুক চেপে ধরে আর্তনাদ করে বললেন,
“উঠবে না রে বাবা। আমার বাপ চলে গেছে। চলে গেছে আমার
‘অর্ক অবাক চোখে কারিবের মায়ের দিকে তাকায়। চোখের পাতা কাঁপছে তার। সে আবারও তাকাল কারিবের মুখের দিকে। আরেক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। চারপাশের কান্নার রোল হঠাৎ করেই যেন বেড়ে গেল। কেউ দু’হাত মাথায় রেখে হাহাকার করছে, কেউ চোখ মুছছে বারবার, তবু কান্না থামছে না। আবার কেউ অস্থির ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক হাঁটছে, কেউ হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে নীরবে কাঁদছে, কেউ দু’হাত মাথায় রেখে হাহাকার করছে। শুধু কাঁদছে না ইমামা। সে এখনও স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে আছে কারিবের মুখে। তার দৃষ্টিতে অবিশ্বাস, হতবিহ্বল ভাব। পিপাসার মতো শুকিয়ে যাওয়া চোখে সে শুধু তাকিয়ে থাকে ওই নিষ্প্রাণ মুখের দিকে। অথচ দূর থেকে কেউ একজন মোহাচ্ছন্ন হয়ে, নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকে গিলে খাচ্ছে। প্রফেসর আনাম সকলের চোখ এড়িয়ে, নিস্প্রভ ও দ্বিধাহীন নজর টানছে তার দিকে। চারপাশের সকলে শোকে কাতর হলেও, সে যেন তৃষার্ত। এই শোকাচ্ছন্ন পরিবেশে সকলের ভঙ্গুরতাকে সুযোগ করে নিয়েই সে সিক্ত করছে নিজের খরখরে অন্তঃকরণ
‘গৌরব হিয়ারে ছাড়িয়ে অর্কের পাশে গিয়ে বসল। ও পরপর ঢোক গিলছে অনবরত। এই ছেলেটা বড্ড চঞ্চল। তাকে গম্ভীর হতে খুব কম-ই দেখা যায়। রেলগাড়ীর মতো চলে তার মুখ। অথচ আজ তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। গৌরব নিজের সাথে যুদ্ধ করল। বহু কসরতে শব্দ বের করল। প্রথমেই গমগমে গলায় ডাকল,
“এই নটকির পোলা, অনেক নাটক হয়েছে, উঠ এবার। শ্লা, নাটকের জন্য এবার এওয়ার্ড পাবি তুই।”
‘কিন্তু কারিব উঠে না। সে নিস্তেজ, নিরুত্তাপ। গৌরবের কণ্ঠে রাগ ফুটতে থাকে,
“বাঙ্গির নাতি, নমুনা কর? উঠ বলছি শ্লা, দেখ কতগুলো মানুষ কাঁদছে তোর মতো একটা ‘গুড ফর নাথিং’-এর জন্য। এটা টু মাচ কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, শ্লা। আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনবো, এর ভেতর যদি না উঠিস, তোদের খোদার কসম কাটছি, নতুন জুতো করে তোর চাপায় লাগামু আমি।”
‘গৌরব এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনলো। কিন্তু কারিব উঠল না। গৌরব আবারও গুনলো। এবারও কারিব উঠল না। গৌরব যেন কোনো কঠিব বাস্তবতা থেকে পালাতে চাইছে। সে আবারও গুনলো। বারংবারের মতো তাকে নিরাশ করে দিয়ে কারিব এবারও উঠল না। তারপর যা ঘটল, তাতে উপস্থিতি সকলে অতিমাত্রায় বিস্মিত হল। তারা দেখল প্রাপ্তবয়স্ক, দাম্ভিক একজন কীভাবে বন্ধুর বুকের ওপর মুষড়ে পড়ে আহাজারি করে উঠল,
“দোস্ত রে! আমার বন্ধু, আমার ভাই তুই—শেষপর্যন্ত তুই-ও চলে গেলি আমাদের ছেড়ে? আমরা জানতেও পারলাম না তো কষ্টের কথা! এতো বড়ো গ্লানি দিয়ে কেম্নে চলে গেলি রে বন্ধু? তোরে তো কখনও বন্ধুর চোখে দেখিনি, আমার ভাই ছিলি তুই। তুই আর অর্ক ছিলি আমার দু’টো হাত, আমার শক্তি। আমি জানতাম, এই দুনিয়ায় সবাই আমাকে ছেড়ে গেলেও আমার দুইটা ভাই আর দু’টো বোন আছে; যাদের সাথে আমার সম্পর্ক শত্রুর মতো, তবুও তারা বিপদে জান দিয়ে দিবে আমার জন্য। এই অপদার্থ আমি টাকে কখনোই ছেড়ে যাবে না তারা—আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। তুই আমার বিশ্বাসে ক্যান আঘাত করলি ভাই? আজ যে আমার একহাত ভেঙে গেল, দোস্ত। আজ আমি আমার বন্ধু হারায়নি, আমার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমি দূর্বল হয়ে গেলাম—আমার খুব কষ্ট হচ্ছে দোস্ত।”
‘থেমে, গৌরব চুমু খেল কারিবের কপালে। বুক ফাঁটা আর্তনাদে গৌরব আরও বলল,
“তুই নেই খবরটার শোনার পর বিশ্বার করতে পারিনি দোস্ত। ছুটে গিয়েছিলাম মন্দিরে। ঈশ্বরের কাছে হাতজোড় করে প্রার্থনা করে এসেছি—এটা যেন স্বপ্ন হয়৷ আমার বন্ধু যে আমার-ই থাকে। কিন্তু এটা তো ভয়ংকর স্বপ্ন। এমন স্বপ্নের মুখোমুখি হতে চাইনি আমি কারিব। এতো ভয়ংকর স্বপ্নের মুখোমুখি ঈশ্বর আমাকে কেন করল,দোস্ত? হে ঈশ্বর ফিরিয়ে দাও আমার বন্ধুকে। এই জীবনে কিচ্ছু চাইনি তোমার কাছে, আজ চাইছি—ফিরিয়ে দাও আমার বন্ধুকে। হয় আমার এতোদিনের প্রার্থনা ফিরিয়ে দাও, নয় আমার বন্ধকে৷”
‘হিয়া ছুটে গিয়ে জাপটে ধরল শোকে উন্মাদ, উন্মত্ত গৌরবকে। হিংসা আর বিষাদে ভরা এই পৃথিবীতে যদি সবচেয়ে স্বচ্ছ আর খাঁটি কিছু থেকে থাকে, তবে তা হলো ছেলেদের বন্ধুত্ব। আজকের এই মুহূর্তে তা আবারও সবার সামনে প্রমাণিত হলো।
‘গৌরবকে থামানো অসম্ভব। তার মস্তিষ্কে ঝড়, সারা দেহে শিহরণ। অর্ক একপাশ থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে তাকে; নিজেও একটু পরপর ফুপিয়ে উঠছে। হঠাৎ গৌরব হঠাৎ ইমামার দিকে আঙুল তুলে তীব্র চিৎকারে ফেটে পড়ল,
“সবকিছুর জন্য তুই দায়ী! তুই ভেঙেছিস আমাদের বন্ধুত্বের আশ্রয়।”
‘ইমামা কেঁপে উঠল। নিশ্বাস আঁটকে যায় তার। অযাচিত ভয়ে কাঁপতে থাকে মাংসপেশি। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইবরাত ছুটে গেল। উচ্ছল কিশোরীর মতো চঞ্চল মেয়েটা কারিবের বুকে মাথা রেখে শব্দ করে কেঁদে উঠল,
“কারিব রে, ভাই আমার! এটা তুই কী করলি ভাই? তোর ইমু রে লাগত, আমারে বলতি ভাই। আমি ওর পায়ে পড়তাম, একটু কটু কথা শুনাইতাম। সকলে মিলে ওকে বোঝাতাম। সবার জোড়াজুড়িতে ও নিশ্চয়ই একদিন না একদিন ঠিকই রাজি হতো। কিন্তু তুই এটা কী করলি ভাই? সঙ্গী হারানোর এই নির্মম যন্ত্রণা আমরা কীভাবে বইয়ে বেড়াবো রে, ভাই? তুই তো মরে গিয়েও আমাদের গ্লাণিতে রেখে গেলি। আমাদের সারাজীবন এই গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে—আমরা পারিনি, আমাদের বন্ধুর অনুভূতিকে সম্মান জানাতে, আমরা পারিনি তার অনুভূতির মর্যাদা রাখতে।”
‘থেমে, ঘন নিশ্বাসের সাথে ফুঁপিয়ে ওঠে বলল,
“ভাই-রে উঠে যা। আমাদের আরেকটা বার সুযোগ দে। কথা দিচ্ছি, এবার আর তোকে নিরাশ করব না। দরকার হলে আমরা সকলে ইমামার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিবো। তুই তো জানিসই, ও আমাদের সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না; তখন নিশ্চয়ই ও রাজি হতো। তাই না? উঠে যা ভাই। তোকে ছাড়া আমরা খুব অসহায় রে ভাই। একসাথে কত স্বপ্ন বুনেছি আমরা, এবার সব বাস্তবায়নের পালা। ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম দিয়েই আমরা মালদ্বীপ ট্যুরে যাবো প্ল্যান করেছিলাম মনে আছে না? তারপর তো সবাই, সবার প্রফেশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব, তখন আর তেমন সময় হবে না কারোরই। কিন্তু আমরা তো একে-অপরকে কথা দিয়েছিলাম, যতই ব্যস্ত থাকি, নিজেদের জন্য সময় বের করব। কখনোই এই ফেন্ডশিপ নষ্ট হতে দিব না। তুই তো কথা রাখলি না দোস্ত। তোর কথার তো অনেক দাম, আর সবার মতো তুই না। সবথেকে আলাদা তুই। ম্যাচিউরিটি তো তোর মধ্যে সবার আগে এসেছিল, সেই তুই এতো বোকার মতো কাজ কীভাবে করলি দোস্ত?
ভাই আমার উঠে পড়৷ তুই না থাকলে এই গরুর বাচ্চার হাত থেকে আমাকে কে বাঁচাবে? ওই ফাজিল তো সারাক্ষণ আমার পিছে লাগে। তুই না থাকলে কে আমার সকল ছেলেমানুষী গুলোকে প্রশয় দিবে, বল? কে আমার সকল বাচ্চা, বাচ্চা আবদার পূরণ করবে? বলে দে কে আমাদের মান-অভিমান ভাঙিয়ে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে একসাথে আগলে রাখবে সারাজীবন? তুই তো আমাদের ফেন্ডশিপের মূল ছিলি। তোকে ছাড়া আমরা সত্যিই অসম্পূর্ণ। প্লিজ আমাদের ছেড়ে যাস না, দোস্ত।”
‘ইবরাত পাগলের মতো কাঁদছে আর বিলাপ করছে। এদিকে ইমামা স্তব্ধ। গৌরবের বলা কথাটা এখনও বুকে কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে। রাগান্বিত কণ্ঠের সূক্ষ্ণ খোঁচা টা যেন হাওয়ায় ধারালো ছুরির মতো কেটে গেল ভেতরটা। যন্ত্রণা বিবশ হয়ে যাচ্ছে অন্তস্থল। ইমামা ধীরপায়ে এগিয়ে গেল। সে কাছে যেতেই অর্ক, গৌরব আর ইবরাত সরে যায়। ওরা সরে যেতেই হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল শূন্যতার গর্জনে। ইমামা ভেঙে পড়ল কারিবের পাশে। ফাঁপা দৃষ্টিতে তাকাল কারিবের দিকে। গলার ভেতর দলা পাকানো কান্না গুলো শক্তের ঢোকের মাধ্যমে গিয়ে নিল। অতঃপর, হঠাৎ করেই ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল…
“হাহহাহাহা! চারপাশে কষ্ট, কান্না, আহাজারি। শুধু কাঁদতে পারছি না আমিই। কারণ… কারণ আমি অপরাধী। এই সমাজে আহতের চিকিৎসায় সবাই তৎপর হয়, কিন্তু নিহতের শরীরটাকে অবহেলায়, অবিন্যস্তভাবে এক কোণে ফেলে রাখে। আজ তুই মরে গিয়েও আহত, আর আমি? বেঁচে থেকেও নিহত।”
‘গলা শুকিয়ে আসে তার। ভারী নিঃশ্বাসে ফাঁকে, ফাঁকে বেরোয় আরও কিছু শব্দ,
“তুই আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করেছিস, আমাকে সকলের চোখে অপরাধী বানিয়েছিস, আমাকে আবারও বন্ধু-হারা করেছিস। যে মানুষগুলো আমাকে কষ্ট দেয়, আমি তাদের চিরকাল ঘৃণা করে এসেছি। কেউ আমাকে আঘাত করবে, এটা আমি কখনও মেনে নিতে পারি না। কিন্তু তুই একসাথে কষ্ট, ঘৃণা, অপমান, অপবাদ—সবই দিয়েছিস। তাও দেখ, তোকে ঘৃণা করতে পারছি না আমি। তোর জন্যই আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে রে কারিব। আমি জানি, আজ আমি শুধু একজনকে না, আমার সবগুলো বন্ধুকে হারিয়ে ফেললাম। তুই কাজটা ঠিক করিসনি, কারিব।”
‘ইমামা ঘন নিশ্বাস ফেলতে শুরু করল। চোখের সামনে ক্রমশ সব ঘোলাটে হয়ে আসছে৷ বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা। ইমামা যথাসম্ভব ঠোঁট কামড়ে কান্না ধরে রাখার বৃথা প্রয়াস চালাল। কিন্তু, যখন আর আঁটকে রাখা সম্ভব হলো, তখন কাঁদতে না পারা মেয়েটাও চিৎকার করে কেঁদে উঠল,
“তুই তো আমায় কষ্ট দিতেই চেয়েছিলি, তাই না? তাই তো এতো আয়োজন, এতো নাটক—সবই সেই জন্য নাহ? হ্যাঁ, তুই সফল। তোর প্ল্যান নিখুঁত ছিল৷ একদম মাস্টারপিস। দেখ, আমি কষ্ট পাচ্ছি। আমি ইমামা ওয়াসিম—যাকে তোরা সবসময় ‘ডেড কোল্ড ফিস’ বলে ডাকতি, সেই শীতল, শক্ত ধাতুর আমি আজ কাঁদছি। দেখ কারিব, আমি কাঁদছি। কান্নায় আমার গলা ভেঙে যাচ্ছে। তুই তাকিয়ে দেখ, ইমামার চোখে জল। তুই তো আমার ভেতর পড়তে পারতিস কারিব, ওরা না বুঝলেও তুই জানতিস আমি ভেতরে ভেতরে কতটা ভাঙা। তাও কেন এমনটা করলি দোস্ত? তুই জানিস মা আমি কষ্ট প্রকাশ করতে পারি না।? অথচ দেখ, আজ লুকাতেও পারছি না। আমার ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে রে কারিব। তুই চোখ খুলে দেখ! আমি জানি, তোকে আমি আবারও ফিরিয়ে আনতে পারতাম আমাদের বন্ধুত্বের জায়গায়, এই বিশ্বাসেই আমি নিজেকে গোছাচ্ছিলাম। কিন্তু তুই আমায় সেই সময়টুকুও দিলে না…
‘থেমে, কারিবের মুখের উপরে আঁচড়ে পড়ে; সারা মুখে হাত বুলিয়ে ফোঁপাতে, ফোঁপাতে বলতে থাকে,
‘এই কারিব, প্লিজ আমার সাথে এমনটা করিস না ভাই। এই-যে দেখ, এরা আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমি মরে যাবো রে দোস্ত। সত্যি বলছি দোস্ত, আমি মরে যাবো এদের ছাড়া। তোরা আমার অংশ। আমি কীভাবে বাঁচব নিজের অংশ ছাড়া? তোকে, গৌরব’কে, অর্ক’কে, ইবরাত’কে হিয়া’কে—তোদের সবাইকে আমার খুব প্রয়োজন। আমি তোদের ছাড়া থাকতে পারিনা জানিস তো। আমার বিষন্ন দিনের আলোকরশ্মি তোরা। পারিবারিক সব ঝামেলা, সব কলহ তোদের পেয়ে ভুলে যেতাম আমি।
এই কারিব, উঠ। তুই তো জানিস, আমার মা আমাকে কখনো খাইয়ে দেয়নি। তুই-ই না সেই ছেলে—যে নিজে না খেয়ে সবসময় আগে আমাকে খাইয়ে দিতি। এখন কীভাবে দায়িত্ব ফেলে চলে গেলি হুহ? উঠ যা দোস্ত…আমার খুব..খুব কষ্ট হচ্ছে রে।”
‘প্রাণশূন্য বুকে মাথা ঠুকতে থাকে ইমামা। চারপাশে কান্নার স্রোত। গৌরব অর্কের কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চুপে অশ্রু ঝরাচ্ছে, হিয়া ইবরাতকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। তবু, ওদিকে ছেলেটা কী নিস্তব্ধ শান্তিতে শুয়ে আছে! কোনো কথা নেই, কোনো হাসি নেই। শুধু নীরব এক অদ্ভুত সৌন্দর্যে ভেসে আছে। তবে কি সে এমনই হাসতে, হাসতে, সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল?
‘তবে কি আর কোনোদিন হবে না তাদের একসাথে হওয়া? টিএসসির সেই উচ্ছ্বসিত আড্ডা, ঢাকা শহরের গলি-ঘুপচি চষে বেড়ানো, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া, পরীক্ষার খাতা খালি জমা দেওয়া, কিংবা লাস্ট বেঞ্চে চোখাচোখি করে ফিসফিস হাসি এসব কি এখানেই শেষ?
‘হঠাৎ ইমামার হাতের আঘাতে সাদা কাফনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কারিবের এক নিস্তেজ হাত। মুহূর্তে স্থির হয়ে যায় সময়। হাতের দিকে চোখ পড়তেই কেঁপে ওঠে ইমামা।কারিবের আঙুলের ফাঁকে রক্ত দিয়ে লেখা স্পষ্ট,
“রেড ওয়াইন।”
‘আতঙ্কে ইমামার শুকনো ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে অস্পষ্ট স্বরে ফিসফিস করে ওঠে,
“খুন, এটা খুন।”
‘তখনই ইমামার ফোনে আবার আসে সেই সুরাকারের প্রাইভেট নাম্বার থেকে পাঠানো মেসেজ—
“যদি খুঁজো, অনেক পেয়ে যাবে। কিন্তু আমার মতো করে কে তোমাকে চাইবে, বলো? যতটা কষ্ট তুমি আমাকে দিয়েছ,তার দ্বিগুণ তোমাকে ফিরিয়ে দিব আমি। আই প্রমিজ! তোমার কাছ থেকে সব ছিনিয়ে নিবো আমি এক এক কোরে।”
‘মেসেজটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইমামের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ঠোঁট কেঁপে উঠল। সে চোখের কোণা থেকে অশ্রু মুছে নিল। চোখে জ্বলে উঠছে একরাশ অশ্রদ্ধার আগুন। কাবিনের হাতটাকে শক্ত করে চেপে ধরে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল ইমামা,
“তোর লাশ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম দোস্ত,
খোদার কসম—তোর খুনিকে নিজের হাতে শাস্তি দেব আমি। ইমামা ওয়াসিম, তাকে কষ্ট দেওয়া মানুষগুলোকে ছেড়ে দেয়না, সেও ছাড় পাবে না।”
❌
[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজকের পর্বতি লেখার সময় আমাকে বেশকিছু বার থামতে হয়েছে। যদিও এই প্রথম একদিনে, একটানা লিখেছি। তাও, কেন যেন বার বার বুক ভারি হয়ে আসছিল। আপনাদের কেমন লাগবে জানি না, তবে বন্ধুত্ব আমার কাছে খুবই কোমল জিনিস। আর হয়ত, এক ভয়ংকর, অভিশপ্ত সকালে এমন এক মৃত্যুপুরীর সাক্ষী হয়েছিলাম বলে, লিখতে গিয়ে আজ বার বার হোটচ খেতে হয়েছে। কে জানে কী! মন্তব্য করতে ভুলবেন না❤️]
born_to_be_villains
methuburi_মিথুবুড়ি
পর্ব_০৫ (বর্ধিতাংশ)
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌
“তোর লাশে কসম দোস্ত, খোদার কসম—তোর খুনিকে নিজের হাতে শাস্তি দেব আমি। ইমামা ওয়াসিম, তাকে কষ্ট দেওয়া মানুষগুলোকে ছাড় দেয়না, সেও ছাড় পাবে না।”
‘মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে সোজা হল ইমামা। ভেজা চোখের তাঁরাই দাউদাউ করছে প্রতিশোধের আগুন। সে আলতো করে কারিবের হাতটা রেখে দিল। শেষবারের মতো আরেক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কারিবের রক্তশূন্য হাতের ওপর। ইমামা বুক ভরে নিশ্বাস টেনে উঠে দাঁড়াল। তারপর আর কারোর দিকে না তাকিয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল।
‘আচড়ে পড়া আতঙ্কে ফর্সা মুখ ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করেছে ইতিমধ্যে। খুনসুটি করে উঠে আসা ভয় বাদামী রঙের মনিযুগল গ্রাস করে অসীম অন্ধকার টেনে ধরেছে নিস্পৃহ অক্ষিপটে। ভীতসন্ত্রস্ত হৃৎস্পন্দনে কাঁপছে চোয়ালের মাংসপেশি। অস্থিরচিত্তে পায়চারি করছে লোকটা। ফোনের ওপাশ হতে ভেসে আসছে অবিশ্রাম বন্য হুংকার,
“আমি তো শুধু ভয় দেখাতে বলেছিলাম। ছেলেটা মারা গেল কী করে? হাহ! আই ওয়েইল কিল ইউ। আই সোয়ার, আই ওয়েল বোথ অব ইউ।”
‘কপালের কার্নিশ প্রান্তে সরু পথ তৈরি করে শীতল ঘাম গড়িয়ে পড়ল। লোকটা কাঁপা কাঁপা গলায় কিছু বলার চেষ্টা করল,”ব-ব….
‘তাকে থামিয়ে দিয়ে ধৈর্যচ্যূত কণ্ঠে আবারও ভেসে এলো গর্জন,
“আই ডোন্ট নিড এনি ফাকিং এক্সপ্লেনেশন৷ জাস্ট টেল মি, হোয়াট ডিড হি ডিড উইথ হিম? জাস্ট টেল মি! ছেলেটা মারা কেন গেলে? আমি চাইনি, ওদের ফেন্ডশিপ নষ্ট হোক।আমি শুধু বলেছিলাম, ভয় দেখিয়ে ছেলেটার মাথা থেকে এসব ভূত দূর করার জন্য। দ্যান, হোয়াই শি ইজ ক্রায়িং? জাস্ট টেল মি ড্র্যামেট।”
‘লোকটা আবারও নিজেকে নির্দোষসাবস্ত করার চেষ্টা করল। দৃঢ়তাপূর্ণ কণ্ঠে বলতে চাইল,
“বস, সত্যি বলছি—ও শুধু ভয় দেখিয়েছে। আমি সাথে ছিলাম, ট্রাস্ট মি। ছেলেটা খুব সুন্দর করে মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন কাজ করে বসবে, তা অকল্পনীয়। এমনটা করবে জানলে, আমি সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখতাম।”
‘ভাঙচুরের আওয়াজ ভেসে আসছে ওপাশ থেকে। কাঁচ ভাঙার ক্র্যাচ, ক্র্যাচ শব্দে কপাল খিঁচে কান থেকে ফোন সরিয়ে নিল লোকটা। ওপাশে ধ্বংসাত্মক তান্ডব চালাতে থাকা রক্তপিপাসু চিৎকার করে উঠল,
“ইট’স নট সুইসাইড, ইট’স আ মার্ডার ইউ, ফাকিং ইডিয়ট।”
‘রক্তঝরা ক্রোধে ফুঁসতে থাকা ব্যক্তিটির ঝাঁঝালো কণ্ঠের হুংকারে লোকটার পুরু ভ্রুজোড়া কুঁচকে উঠল। ঘোর বিস্ময় কুয়াশার মতো ঘিরে ধরল চারপাশ থেকে। জাফরনের মতো শোভনীয় উষ্ণ লাজের পেলব মুখে ঘোর দুঃশ্চিতার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
“দুইদিন সময় দিলাম। দুইদিনের ভেতর বাস্টার্ড-টাকে আমার চাই৷”
‘ভারি কণ্ঠের শব্দগুলো কর্নগূহরে পৌঁছে দানবীয় তীব্রতা ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই কটকট শব্দ তুলে লাইন বিচ্ছিন্ন হল। লোকটার কপালের ভাঁজ আরও গভীর হয়ে উঠল। সে গম্ভীর নিশ্বাস ফেলে পিছন ঘুরতে যাবে, তখনই ছুটে আসা ইমামা অসাবধানতার জন্য ধাক্কা খেল কালো লেদারের জ্যাকেট পরিশেষ লোকটার সুবলিত পুরুষ্টু হাতের সমুখের অংশে। গোধূলি-রঙা চুলগুলো মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বেখেয়ালি দ্রুত গতিতে লোকটাকে ‘স্যরি’ বলে ছুটে গেইটের দিকে গেল ইমামা।
‘গ্রীবা সামান্য বাঁকিয়ে দিঘল বিস্ময়ের চাহনিতে লোকটা চেয়ে আছে ইমামার দিকে। ঠিক তখনই ভেতর থেকে উৎকণ্ঠিত মুখে ছুটে এলো ইবরাত। কিন্তু লোকটিকে দেখামাত্রই তার পা হঠাৎ থমকে গেল। চোয়াল অবাক হয়ে ঝুলে পড়ল। অপরিচিতের উচ্চতা আর জিমে গড়া শরীর যেন সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি কাড়ল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সে দেশীয় নয়। গায়ের রঙ গমের মতো চাপা উজ্জ্বল, আর সবচেয়ে দৃষ্টি-নন্দন হলো দু’টি বাদামি চোখ। ইবরাত বেহায়ার মতো স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। এদিকে লোকটা ফোন কানে নিয়ে সরে গিয়ে সাইডে দাঁড়াল।
‘বিশ্রামহীন ফোনটা বারবার ব্রিপ, ব্রিপ শব্দ করে চলেছে। ইমামা দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির জন্য৷ অথচ কোথাও খালি অটো বা সিএনজি চোখে পড়ছে না। নিজের গাড়ি নিয়েই এসেছিল সে কিন্তু এখন সেটি নিতে গেলে ইমান ওয়াসিম টের পেয়ে যাবে৷ যা সে একদমই চায় না। কারিবের দাফনের কাজে তিনি ব্যস্ত থাকায় হয়তো এখনও বুঝে ওঠেননি যে ইমামা বাইরে বেরিয়ে পড়েছে।
‘বুকের ভেতর অস্থিরতার টিপটিপ শব্দ যেন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ একটি গাড়ি এসে থামল তার সামনে। চমকে উঠে ইমামা দেখল প্রফেসর আনাম। গ্লাস নামিয়ে তিনি শান্ত স্বরে বললেন,
“কোথায় যাবে? চল, আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।”
‘জড়তা কাজ করলেও ইমামা বেশিক্ষণ ভাবল না। তাকে এখনই অফিসার মাহেশের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেদিন এত কথা হলেও নাম্বার নেয়া হয়নি, নয়তো ফোনেই সব বলা যেত। কারিবের খুনের বিষয়ে জানানোটাই এখন সবচেয়ে জরুরি। সে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, তখনই ফোনটা আবার বেজে উঠল। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তেড়েফুঁড়ে ভেসে এলো হুংকার,
“ডোন্ট গো উইথ হিম! আই সেইড, ডোন্ট গো উইথ হিম!”
‘ইমামা জানে এটা সুরাকার নয়। সুরাকার কখনো ফোন করে না। আর তার শীতল কণ্ঠে এমন ঝাঁঝও নেই। এইমুহূর্তে কিছু বলার অবস্থায় ছিল না ইমামা। ফোন কেটে দ্রুত গাড়িতে উঠে বসল। অনবরত ঘাম ঝরছে, হাঁপিয়ে উঠছে শরীর। একঝলক ইমামার উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে তাকিয়ে প্রফেসর আনাম গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
‘সেদিন অফিসার মাহেশ একটি আশ্রমের ঠিকানা দিয়েছিলেন, জানিয়েছিলেন সেখানেই তাকে পাওয়া যাবে। কেন একজন এত বড় অফিসার আশ্রমে থাকেন সে প্রশ্নটা আর করা হয়নি ইমামার৷ ইমামার মাথায় একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে—কী শত্রুতা তার সঙ্গে সুরাকারের? কেন সে এমন হুমকি দিচ্ছে, যে ইমামার কাছের মানুষদের একে একে কেড়ে নেবে? কেবল তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই কি কারিবের মতো নির্দোষ এক ছেলেকে নির্মমভাবে মেরে ফেলল? কী চাইছে আসলে এই সুরাকার?
‘চিন্তার জালে জড়াজড়ি হয়ে ইমামা এতোটাই গভীরে তলিয়ে গিয়েছিল যে খেয়ালই করল না প্রফেসর আনাম তার দিকে কাতর, নিঃশব্দ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷
‘গাড়ি গিয়ে থামল এক আশ্রমের সামনে। ইমামা তাড়াহুড়ো করে নেমে ভেতরে ঢুকে গেল। অফিসার মাহেশের নাম বলতেই জানা গেল তিনি আশ্রমের পিছনের লেকের ধারে মাছ ধরছেন। এই নীরব, একাকিত্বময় জীবনেই মাছ ধরাই তাঁর একমাত্র সঙ্গী। অবসরে তিনি সবসময় এ কাজেই ডুবে থাকেন।
‘ইমামাকে দেখে অফিসার মাহেশ খানিকটা অবাক হলেও কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। ইমামা নিশ্বাস ফেলার ফাঁক না রেখে আজকের সব ঘটনা খুলে বলল, ফোনের মেসেজগুলোও দেখাল। মেসেজগুলো পড়েই অফিসার মাহেশের কপাল কুঁচকে গেল। তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ইমামার ভেতরটাকে কাঁপিয়ে তুলল। ইমামার কণ্ঠ কেঁপে উঠল,
“আপনারও কি মনে হচ্ছে, আমার জন্যই কারিব মারা গেছে?”
‘অফিসার মাহেশ ধীরে বর্শা রেখে ঘাটে বসলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বললেন,
“আপনার কোনো পাস্ট আছে, মিস ইমামা?”
‘ইমামা মাথা নাড়ল, “না।”
“পূর্বে কোনো প্রেমঘটিত সম্পর্ক?”
“না। আমার জীবনের ফার্স্ট লাভ এখনও আসেনি।”
“বিষয়টা খুব অদ্ভুত নয়? আপনার কোনো অতীত নেই, নেই কোনো প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক; অথচ দু’জন সাইকো আপনার পিছনে লেগে আছে। আর তারা এতটাই ধূর্ত যে স্পেশাল ফোর্সও তাদের নাগাল পাচ্ছে না, ছুঁতে পারছে না!”
‘ইমামা মাথায় হাত চাপা দিয়ে অফিসার মাহেশের পাশে বসে পড়ল। ক্লান্ত, ভেঙে পড়া সুরে বলল,
“আমি জানি না… আমি সত্যিই কিছু জানি না, অফিসার। শুধু জানি কারিব আত্মহত্যা করেনি। ভয় দেখিয়ে কেউ ওকে মরতে বাধ্য করেছে। আত্মহত্যা করার মতো ছেলে কারিব না। আমি জানি না, কার সাথে আমার এতো বড় শত্রুতা! এটাও জানি না কেন সে এমনটা করছে। আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে অফিসার, সবকিছু।”
‘অফিসার মাহেশ ইমামার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন।
“প্রাইভেট নাম্বার দুইটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি; তবু কল-রুটের মাধ্যমে তাদের লোকেশন নিরূপণ করা গেছে। যদিও এটা শুধু একটি ক্লু—এককভাবে তাদের ধরতে পর্যাপ্ত নয়। আপনার বর্ণনা অনুযায়ী যে সুরাকার—তার লোকেশন বাংলাদেশে, আর অপর নম্বরটির লোকেশন ইতালি দেখায়।”
‘ইমামা চমকে উঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে,”ইতালিতে থাকে?”
‘অফিসার মাহেশ ওপর-নিচ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ইমামা গভীর ভাবনায় ডুবে গিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
“সে যে-ই হোক। আমার মনে হয় না সে আমার ক্ষতি করতে চাইছে। বরং সে এমন কিছু জানে, যা আমি জানি না। আর সেটাই প্রতিবার জানাতে চাইছে আমাকে।”
‘অফিসার মাহেশ উত্তর দিল,”সেটা হয়তো ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে।”
‘ইমামা কপাল কুঁচকে আবার বলল,”কিন্তু যদি আমার ধারণা সত্যি হয়ও, তাহলে তার লাভটা কোথায়?”
‘অফিসার ঠাণ্ডা স্বরে বলল,”আপনার পরিচয় ফিরিয়ে দেওয়াই হয়তো তার লাভ।”
‘চোখ গেঁথে তাকাল ইমামা,”কিন্তু কেন?”
‘মাহেশ মৃদু হেসে মাথা নেড়েই বললেন,
“ওটা কেবল সেই সাইকোটাই বলতে পারবে।”
“আমরা কি কোনোদিন এই সাইকোদের ধরতে পারব না?” ।
“পারব।”
“হাউ?”
‘মাহেশ ঠোঁটে একচিলতে রহস্যময় হাসি টেনে বললেন,
“আই হ্যাভ আ প্ল্যান।”
‘ইমামা চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে ফিসফিস করল,
“অলসো আই হ্যাভ।”
‘ওরা চোখে-চোখে কথা বলল। তারপর হঠাৎ করেই দু’জনে হেসে উঠল। অফিসার মাহেশ ইমামার আরেকটু কাছে এসে বসলেন। ইমামা ভুরু উঁচিয়ে তার দিকে তাকাতেই, তিনি ভুরু নাচালেন। ইমামা স্বাভাবিক হল। জোরপূর্বক খানিকটা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল ওষ্ঠপুটে। অফিসার মাহেশ নিচু গলায় বললেন,
“আশা করি—দুই ডিলে, দুই পাখি মরবে এবার৷”
‘ইমামার হাসি পেল। তবে সে হাসল না। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে জানতে চাইল,
“একজনের ইনফরমেশন চেয়েছিলাম যে, ওই বিষয়ে কিছু জানা গিয়েছে?”
‘অফিসার পানিতে আবারও বর্শা ছুঁড়লেন। অত্যন্ত গুরুতর ভঙ্গিতে মাছ ধরতে, ধরতে নিরেট ঠান্ডা গলায় বললেন,
“সেদিনের পার্টি থেকে কার্যকর কিছুই মেলেনি। ইতালি থেকে আসা ভিআইপি অতিথিদের সবাই ছিল আন্ডারগ্রাউন্ড জগতের ভয়ংকর সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ নিরাপত্তার আড়ালে তাদের আনা হয়েছিল। অথচ প্রাইভেসির অজুহাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অতিথিদের লিস্ট তো দূরের কথা, সিসিটিভি ফুটেজও আমাদের দেননি। শুধু একবার তদন্তের স্বার্থে দেখতে দেওয়া হয়েছিল। তবু গুপ্তচরদের সূত্রে জানা যায় তারা পরদিন ভোরেই প্রাইভেট জেট করে ইতালি ফিরে গেছে। আর সেই অতিথিদের ভেতরে ছিল ইতালির সবচেয়ে প্রভাবশালী নাম— ড্রাগন গ্রুপের লিডার। আপনার বর্ণনা ও ফিট অনুযায়ী কেবল তারই বৈশিষ্ট্য মিলে যাচ্ছে।
‘ইমামা চমকে উঠল,”তার নাম?”
“ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই তাকে চেনে আর.কে নামে। আন্ডারগ্রাউন্ডে সে পরিচিত মাফিয়া হিসেবে। তার সাম্রাজ্যে সে ড্রাগন লিডার। আর শত্রুরা তাকে ডাকে ব্লাডিবিস্ট।”
“একজন মানুষের এতোগুলো নাম? তার আসল পরিচয় কী?”
‘অফিসার ঠাণ্ডা হাসল,”ওটা কেবল সে-ই বলতে পারবে।”
“মানে, তার প্রকৃত পরিচয় কেউ জানে না?”
“ঠিক তা নয়। যতটুকু জানার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, ততটুকুই আমরা জানি। যেটা আড়ালে রাখা হয়েছে, সেটা জানতে দেওয়া হয়নি। তাই তার আসল পরিচয়টা আজও অন্ধকারেই রয়ে গেছে।”
‘কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইমামা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
“গুগলে? কোনো ছবি নেই?”
‘অফিসার এবার কণ্ঠ নামিয়ে বলল,
“অনলাইনে ছবি কেবল তাদেরই থাকে, যারা নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু সে একেবারেই অদৃশ্য মানুষ। সবাই তার নাম জানে, তার ক্ষমতার গল্প জানে, শত্রুরা তার ভয়ে কাঁপে। কিন্তু বাস্তবে কে সে—তা আজও কেউ জানে না।”
“অদ্ভুত!”
“একদমই নয়। অনেকেই আছেন যারা নিজেকে সামনে আনতে বা জাহির করতে পছন্দ করেন না। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে—আজও বহু শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি আছে, যাদের সুনাম ও র্যাংকিং বিশ্বমানের কিন্তু মালিকদের ব্যক্তিগত কোনো তথ্য প্রকাশ্যে নেই। একইভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড দুনিয়ায়ও অসংখ্য মাফিয়া ডন আছে যাদের নামে শহর কাঁপে, অথচ তাদের মুখ দেখাই যায় না।”
‘ইমামা এবার একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। সবকিছুই আরও বেশি রহস্যে আচ্ছন্ন হয়ে ধোঁয়াটে হয়ে উঠছে ক্রমে। তার ভাবনার সুতো হঠাৎই ছিঁড়ে গেল অফিসারের উচ্ছ্বাসে।বড়সড় এক মাছ ধরা পড়েছে বর্শিতে। মাছটাকে রেখে হাত মুছে অফিসার আকস্মিকভাবে এগিয়ে এল ইমামার দিকে। তারপর হঠাৎ এমন ভঙ্গিতে তাকে জড়িয়ে ধরল, যদিও শরীরে স্পর্শ করল না। তবে এতটাই কাছে এল যাতে করে লেকের অপরপ্রান্তে দেয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্ল্যাকমাম্মার লোক কিংবা আশ্রমের পেছনের সিসিটিভি হ্যাক করে ইতালি বসে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা লোকটা—দু’জনের কাছেই মনে হয় অফিসার সত্যিই ইমামাকে আলিঙ্গন করেছে।
‘ব্ল্যাকমাম্মায় বসে থাকা লোকটার হাতের রগগুলো তীব্র ক্রোধে ফেটে উঠতে লাগল এই দৃষ্টি অবলোকন করে। বাঁ-হাতের পিঠে খচিত ভয়ংকর সাপের ট্যাটুটি যেনো রক্তিম রোষে জীবন্ত হয়ে উঠতে চাইছে। অন্যদিকে স্ক্রিনের ওপাশে ইতালিতে বসে থাকা লোকটার সমুদ্র-নীল চোখ থেকে ঝরে পড়তে লাগল অগ্নিশিখার দহন।
‘ইমামা বিদায় নিয়ে পা বাড়াতেই পিছন থেকে ডাক ভেসে এল,
“হেই, বিউটিফুল।”
‘ইমামা ঘুরে দাঁড়াল। দৃঢ়তাপূর্ণ্য কণ্ঠে বলল,
“ইট’স ইমামা।”
‘অফিসার মাহেশ দাঁত চেপে একচিলতে হাসল। হাসতেই গালের ডিম্পল যেনো সৌন্দর্য বিস্তারের খেলায় মেতে উঠল। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মাথার চুল চুলকাতে, হেসেই বলল,
“উপসসস! স্যরি, ইমামা।”
‘ইমামা ঠান্ডা স্বরে আবারও বলল,”মিস ইমামা। আমরা না বন্ধু, না আত্মীয়।”
‘মাহেশ চোখ টিপে জবাব দিল,”মানে, গার্লফ্রেন্ড–বয়ফ্রেন্ড হওয়ার সুযোগ আছে?”
“শাট দ্য ফাক আপ, অফিসার।”
‘অফিসার আবারও হেসে উঠল। তারপর হঠাৎ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
“জাস্ট কিডিং। আপনার সেই ফেবারিট রাইটারটা কী যেন নাম?”
“ক্যালভিন কৌহিলু।”
“হ্যাঁ, সি.কে. ওকে নিয়ে কাল একটু রিসার্চ করলাম। দেখলাম, গত দু’বছরে তার একটাও নতুন বই বের হয়নি। অথচ নেটে তার বই নিয়ে তুমুল আলোচনা। পাঠকেরা পাগলের মতো অপেক্ষায়। তবুও তার দেখা নেই। বেস্ট সেলার এওয়ার্ড শো-তেও তাকে দেখা যায়নি। হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে গেল এত বড় লেখক কেমন অদ্ভুত না?”
“হ্যাঁ, বিষয়টা আমাকেও ভাবাচ্ছে।”
“আমাকেও। আচ্ছা, কাল দেখা হচ্ছে তবে।”
‘আশ্রম থেকে বেরিয়ে ইমামা দেখতে পেল প্রফেসর আনান তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ইমামাকে দেখামাত্র উনি এগিয়ে এলেন। বললেন,
“ইমামা, লেট মি ড্রপ ইউ।”
‘ইমামা কাঠিন্য সদাতেজি মুখে বলল,
“আই ক্যান ম্যানেজ।”
“হোয়াইট র…..
‘ইমামা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“একজন টিচার আর স্টুডেন্টের মধ্যে যোজন, যোজন দূরত্ব থাকে। আশা রাখছি সেটুকু দুরত্ব আপনি বজায় রাখবেন৷”
‘প্রফেসর আনামের চোখেমুখে ব্যাথা ফুটে উঠল। তিনি
আহত কণ্ঠে বললেন,”আমি তোমাকে ভালোবাসি ইমামা।”
‘ইমামার চোয়াল শক্ত, কণ্ঠে কঠোরতা, “আমি আপনাকে ভালোবাসি না স্যার। বিষয়টা আমি আগেও ক্লিয়ার করেছি৷”
‘প্রফেসরের কণ্ঠে ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। দুচোখ সজল হয়ে আসে।
“আমার মন কেন মানে না ইমামা, বলতে পারবে?”
“যে মন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না, তাকে প্রজ্বলিত করা উচিত। কারণ অনিয়ন্ত্রিত মন নিজেকে ধ্বংস করার আগেই আপনাকেও ভগ্নগোল করতে পারে।”
‘শক্ত গলায় কথাগুলো বলে একটা সিএনজিতে উঠে চলে গেল ইমামা। প্রফেসর আনাম ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ব্যস্ত রাস্তার দিকে। একফোঁটা গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে।
‘ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে রুমে ঢুকল ইমামা। আশ্রম থেকে সে গিয়েছিল কারিবের কবরস্থানে। সেখানেও কেউ তার সঙ্গে কথা বলেনি। ফিরে এসে ফোনটা দেখল৷ না, কোনো নাম্বার থেকে আর কল বা মেসেজ আসেনি। জামাকাপড় হাতে নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল সে। এই বাস্তবতার অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে এখন তার চাই এক লম্বা ঘুম। আর তার আগে দরকার গোসল।
‘সিঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইমামা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাদের স্মৃতিমাখা দিনগুলো, কারিবের হাসিমাখা মুখ। এই দুনিয়ায় সময়ের সাথে সাথে গুরুত্ব হারিয়ে যায়। কেউ কারও কাছে আর সেই প্রথম দিনের মতো থাকে না। অথচ ইমামা পেয়েছিল। সাতটা বছর ধরে, প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে সেই নির্দোষ ছেলেটা তাকে প্রথম দিনের মতোই গুরুত্ব দিয়েছিল। অথচ আজ তার কারণেই ছেলেটাকে মরতে হলো।
‘ইমামার হাতে ধরা ছিল ছোট্ট সাদা একটা ফুল। হঠাৎ হাত ফসকে তা বাথটবে পড়ে গেল। মুহূর্তেই ফুলটা গলে গেল পানির সাথে। বিস্ময়ে আঁতকে উঠল ইমামা। দ্রুত ছুটে গিয়ে বারান্দা থেকে আরও দুটো ফুল এনে বাথটবে ফেলল। কিন্তু একই ঘটনা ঘটল৷ ফুলগুলো মুহূর্তেই গলে গেল। বুক কেঁপে উঠল ওর। তবে কি কেউ বাথটবের পানিতে এসিড ঢেলে রেখেছে? অস্থির হাতে ট্যাপ চালিয়ে বাথটবটা ফ্লাশ করে দিল ইমামা। নতুন করে পানি ভরে দেখল এবার আর তেমন কিছু ঘটল না। তবুও তার ভেতরটা কেমন অদ্ভুত অশনি-আশঙ্কায় ভারী হয়ে উঠে।
‘ইমামা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে শাওয়ার নিয়ে রুমে ফিরল। বুকের ভেতরটা এখনও হিম হয়ে আছে। মুখে সিরাম মাখতে যাচ্ছিল,কিন্তু হঠাৎ কী মনে করে একফোঁটা সিরাম বেডশিটের ওপর ফেলল। মুহূর্তেই বেডশিটের কাপড়টা পুড়ে গেল। ধোঁয়া উঠতে লাগল। আঁতকে উঠে হাত কাঁপতে লাগল ওর থরথর করে। শিশিটা হাত থেকে ছিটকে সোফার ওপর পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে সোফার কভারও জ্বলসে গেল।
‘ঠিক তখনই ইমামার ফোন বেজে উঠল। কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেই ভারি কণ্ঠের ফিসফিস,
“বলেছিলাম—তুমি মুক্ত, স্বাধীন পাখি। কিন্তু তোমার আকাশ —আমার খাঁচা। মালিকের কথার অবাধ্য হয়ো না সুখপাখি। জ্বলসে যাবে একেবারে। আমি মানুষটা একটুও ভালো নই। আই রিপিট—জ্বলসে যাবে। আমি মানুষের জাতের মধ্যে না পড়লেও, এক কথার মানুষ।”
❌
[প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে লিখলাম। ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রেসপন্স করবেন সকলে ]
Share On:
TAGS: born to be villains, মিথুবুড়ি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
Born to be villains পর্ব ৬
-
Born to be villains পর্ব ২
-
Born to be villains পর্ব ১
-
Born to be villains পর্ব ১৩
-
Born to be villains পর্ব ৩
-
Born to be villains পর্ব ৯
-
Born to be villains পর্ব ১৪(প্রথমাংশ+শেষাংশ)+বোনাস
-
Born to be villains পর্ব ১৫
-
Born to be villains পর্ব ৭
-
Born to be villains পর্ব ৮