born_to_be_villains
methuburi_মিথুবুড়ি
পর্ব_১১
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌
‘ইমামা যখন কেবিনে প্রবেশ করে, তখন অফিসার মাহেশ ল্যাপটবে সেই রাইটার ‘ক্যালভিন কৌহিলো’ কে নিয়ে স্টাডি করছিল। এমন অসময়ে হঠাৎ ইমামাকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও তা বুঝতে দেয় না মাহেশ। ইমামা ফুলের বুকেটা স্ট্রেচারের পাশে রেখে টুলে বসল। শ্যেনদৃষ্টিতে পরখ করল অফিসার মাহেশকে। শরীরের তেমন গুরুতর আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও পায়ের গোঙালির হাড় বেঁকে গেছে। যার জন্য বেড রেস্ট দিয়েছে ডক্টর। যদিও রেস্টে নেই অফিসার। এখানে বসেও নিরলস তার তদন্ত সে চালিয়ে যাচ্ছে।
‘ইমামা শীতল কণ্ঠে জানতে চাইল,”কীভাবে এক্সিডেন্ট হলো?”
‘অফিসারের মুখে একরাশ বিরক্তি। কপাল খিঁচে গজগজ করে বলল,”আরেহ্ কীসের এক্সিডেন্ট! ওটা এক্সিডেন্ট ছিল না।”
‘ইমামা সরু ভ্রুদ্বয়ের মাঝে কুঁচকানো ভাব সুস্পষ্ট হয়। কণ্ঠে বিস্মিত কৌতূহল,”মানে?”
‘অফিসার ঠোঁট কামড়ে চোখমুখ খিঁচে রাখে। সত্য বলতে তার অস্বস্তি হচ্ছে, তবুও বলল,”তখন তো আপনি হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলেন। অনেক খুঁজেও পেলাম না। পরে যখন জানতে পারি আপনি হসপিটালে,তখন আপনাকে দেখতে হসপিটালে যাই। পরে শেষরাতে আমি আমার বাইক দিয়ে আশ্রমে ফিরছিলাম। তখনই হঠাৎ আরেকটা বাইক এসে আমার বাইকের পাশাপাশি যেতে শুরু করে। তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে। বডি-ফিগার ভালোই ছিল। একটু বেশি হট। একসাথে যেতে ভালোই লাগছিল। আমাদের মধ্যে কিছুক্ষণ রেস-ও হলো। পরে একটা সময় হঠাৎ মেয়েটা আমাকে চোখ মারে। বুঝতে পারলাম মেয়েটাও লাইন মারতে চাইছে। আমি আশেপাশে তাকালাম। পাশেই একটা নির্জন জায়গা দেখে বাইক একটু স্লো করতেই শালি আমাকে একটা লাথি মেরে বাইক সমেত ফেলে দেয়। তারপর হঠাৎ করেই আঁধারে মিলিয়ে গেল মেয়েটা। এখন, অফিসের লোকেরা যদি জানতে পারে, একটা মেয়ে আমাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে, তখন কী আমার মানসম্মান থাকবে? সম্মান তো আর গুলিস্তানের মোড়ে কিনতে পাওয়া যায় না, তাই মিথ্যে কথা বলেছি।”
‘ইমামা এতোক্ষণ ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল হাসি ধরে রাখার। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর সফল হলো না। হঠাৎই ফিক করে হেসে দেয়। তার হাসিতে অফিসার প্রথমে বিরক্তিতে তাকালেও পরক্ষণেই তার চোখে মুগ্ধতা ভেসে ওঠে। আজ প্রথম এভাবে ইমামাকে হাসতে দেখেছে সে। একটা জিনিস খেয়াল করেছে এই ক’দিনে, এই মেয়ে খুব কম হাসে। কিন্তু, যখনই হাসে, তখন তার ঠোঁটের সাথে চোখও হাসে।
‘কিন্তু আচমকা অফিসারের চিবুক শক্ত হয়ে যায়। মস্তিষ্কের কোষে যেন বিদ্যুতের মতো রক্ত ছুটছে। হাতের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। অকস্মাৎ শরীরের রক্তপ্রবাহ বেড়ে গেছে। বুকের ভেতর কেমন অনিয়ন্ত্রিত কম্পন। নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টায় ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে সে তাড়াতাড়ি বলল,
“হাসি থামান। সুন্দরীদের হাসি দেখলে আমার প্রবলেম হয়।”
“প্রবলেম? কীসের প্রবলেম?” ইমামা হেসেই জবাব দেয়।
‘অফিসার দৃষ্টি সরিয়ে রাখে। শুকনো চৌচির তার গলা। সে অনবরত শুকনো ঢোক গিলতে থাকে। নিজেকে শক্ত করে গলা নামিয়ে বলে,”নাথিং।”
‘ইমামা এবার হাসি থামায়। মুখের রেখা গম্ভীর হয়ে ওঠে। ও বলল,”ওই লোকটাকে পরে কী করলেন?”
“রাখতে পারিনি। ওরা নিয়ে গেছে।”
‘ইমামার মুখে অসন্তোষের ছায়া। তেমনি অফিসারের চোখে ব্যর্থতার দাগ। সে আবার আগের মতো গম্ভীর হয়, দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“শালাকে ধরে হাজতে নিয়ে দু’টো ডলা দিতে পারলেই সব বের করতে পারতাম। কুত্তার মতো নজর পড়েছে আমার ওপর৷ কোনোদিকেই জো পাচ্ছি না।”
‘রাগে গিজগিজ করছে অফিসার। ইমামা চারপাশে তাকায়। কেবিনজুড়ে ছমছমে ভাব। বেডের পাশেই এখনো ছড়ানো সকালবেলার খাবার, হসপিটালের সস্তা ট্রেতে রাখা। কিছুই ছোঁয়া হয়নি। ইমামা তাকায় অফিসার মাহেশের দিকে। নত কণ্ঠে জানতে চাই,
“আপনার পরিবারের কেউ আসেনি?”
“এতিমের আবার পরিবার?”ঠোঁটে কটাক্ষের হাসি টেনে জবাব দেয় মাহেশ।
“আত্মীয়স্বজন?”
“আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই।”
“কারোর সঙ্গে পরিচয় নেই?”
“তাদের কাউকেই আমি কোনোদিন দেখিনি।”
‘ইমামার চোখে বিস্ময় বাড়ে। সে যতদূর জানে, অফিসার নিউইয়র্কে পড়াশোনা করেছে। জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবকিছু নিউইয়র্কে। দীর্ঘদিন নিউইয়র্কের স্পাই হিসেবে কাজ করেছে সে। বাংলাদেশে ব্যাক করে চারবছর আগে। প্রথমে পিবিআই-এ যোগদান করে। পরবর্তীতে যোগ্যতার ভিত্তিতে তাকে বিশেষ ইউনিটে (সিআইডি) ডেপুটেশন করা হয়।
‘ইমামা অবাক হয়ে বলল,”আপনি জানেন না আপনার পৈতৃক ভিটে কোথায়?”
‘অফিসার মাথা তুলে তাকায়। ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গ-হাসি খেলে যায়। প্রত্যুত্তরে নিজেকে নিজে কটাক্ষ করে বলল,
“জানবো না কেন? আমি খানদানি বংশের ছেলে। দিনাজপুরে গিয়ে আমার দাদার নাম নিলেই সবাই চিনবে। জমিদার ছিলাম আমরা। তবে যারা কখনো আমাকে মেনে নেয়নি, তাদের খোঁজ করে কি করবো?”
‘একটু থেকে, তারপর একদম সোজা হয়ে বসে ঠান্ডা গলায় বলল,
“আর আপনি কেন পার্সোনাল কথায় যাচ্ছেন? আমি অফিসিয়াল আলোচনায় আছি, সেখানে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের কী দরকার? আমি কি একবারও আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি, আমরা যে তদন্তে নেমেছি, আপনি কেন সেই তদন্তের আসামির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন?”শেষের কথাটা ছুড়ে দেয় খোঁচা মেরে।
‘ইমামা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নড়েচড়ে বসে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত গলায় বলে,
“একদম বাজে কথা বলবেন না। কে কার প্রেমে পড়েছে? আর সে যে খুন করেছে, তা কিন্তু এখনো প্রমাণ হয়নি।”
‘অফিসার বরাবরের মতো খুব মজা করে হাসল। সেই পরিচিত হাসিতে ডান গালের টোলটা আলোর মতো ফুটে ওঠে। মাহেশ মৃদু স্বরে বলে,
“আহ, মিস চটে যাচ্ছেন কেন? রাগলেন তো, হেরে গেলেন।”
‘একটু থেমে যোগ করে,”বোকা আপনি নন, আর নয়তো আমি। শুরুতেই বলেছিলাম—আপনাদের লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট হয়েছিল। সেদিন পার্টিতে সিডের কারণে আপনি কষ্ট পেয়েছিলেন, আর সেই কষ্টই তাকে খুনে প্ররোচিত করে। আর ঠিক পরেরদিনই সিডের লাশ আপনার বাড়িতে পৌঁছানোটা কাকতালীয় ছিল না, রাইট?”
‘ইমামা স্তম্ভিত। মাহেশ চোখ সরু করে তাকায় ইমামার দিকে। এবার তার গলায় একরাশ ব্যঙ্গ,
“আর সেই চিরকুটটা? ওটা কী মিথ্যে ছিল? তারপর তো এমন আরও চিরকুট পেয়েছেন। কি পাননি? আর কার কাছ থেকে পেয়েছেন বলুন তো — ওই, আপনার লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট!”
‘ইমামা নিথর হয়ে যায়। এই কথাগুলো সে আগেও ভেবেছে, শতবার। উত্তরও পেয়েছে, কিন্তু মেনে নিতে পারেনি কখনো।
‘ইমামা বলতে চাওল,”তাহলে রোহিত…
“আপনি কী এতটাই বোকা?” অফিসারের গলায় বিরক্তি,পাশাপাশি কটাক্ষ, “বুঝতে পারছেন না? রোহিত, কারিব—যেই হোক, খুনি শুধু একটাই উদ্দেশ্যে কাজ করেছে। আপনার কষ্ট বাড়ানো। আপনার কাছের মানুষদের একে একে সরিয়ে আপনাকে ভেঙে দেওয়া। তারপর কুকুর, লাইব্রেরি, ইমন, ইবরাত— সবাই ছিল একই খেলার টার্গেট।”
‘ইমামা অস্পষ্ট স্বরে বলে,”রোহিত আমার কেউ ছিল না।”
‘অফিসার গম্ভীর গলায় বলে,”ওকে খুন করা হয়েছিল আপনাকে ফাঁসানোর জন্য। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে প্রতি পদে পদে বিপদে ফেলা, কষ্ট দেওয়া, হেনস্তা করা। সে প্রায় সফলই ছিল। শুরুতে আমার সন্দেহের তালিকায় কিন্তু আপনার নামই প্রথমে উঠেছিল। কিন্তু সে হয়তো ভাবতে পারেনি আপনি সেই ভিডিওটা আমাকে দেখাবেন।”
‘তারপর থেমে যায় মাহেশ। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয় কিছুক্ষণ। একটু ভেবে আস্তে করে বলে,
“তবু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না… আপনার তার ওপর এত রাগ কেন?”
‘ইমামাও একইভাবে বলে,”আমিও জানি না।”
‘অফিসার মাহেশকে এবার বেশ গুরুগম্ভীর দেখা গেল। মুখে পেশাদার ভাব ফুটে উঠেছে। চোখে কঠিন মনোযোগ। সে ফিরে গেল নিজের চৌকস ফর্মে। গলায় দাম্ভিক ভর দিয়ে বলল,
“দেখুন মিস, আমি আবারও জিজ্ঞেস করছি, আপনার জীবনে কি এমন কোনো অতীত আছে…
‘তার কথা শেষ হবার আগেই ইমামা জ্বলে উঠল,”শাট আপ, অফিসার! আমি প্রথমেই বলেছি, আমার কোনো পাস্ট নেই। ওটা একটা সাইকো, একদম পাগল। আমাকে তার ওয়াইফ বলছে, দুই বছরের সংসার, বাচ্চা—যা-তা বকছে! আই ডোন্ট ইভেন হ্যাভ মাই ফার্স্ট কিস।”
‘অফিসারের মুখ থেকে মুহূর্তেই গাম্ভীর্য উবে যায়। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি টেনে ভুরু নাচাতে নাচাতে বলল,”ওয়াহ, দ্যাট কিলার মাস্ট বি সো লাকি।”
“শাট দ্য ফাক আপ, অফিসার!”
‘মিইয়ে যায় অফিসার। ইমামা কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলল,”ওই বাইকের নাম্বার প্লেটের যে ছবি পাঠিয়েছিলাম, কিছু জানতে পেরেছেন?”
‘অফিসার গম্ভীর গলায় বলল,”বাইকটা দেশি নয়। বিশ্বের সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের বাইক—Kawasaki Ninja H2R। ইমপোর্ট করা। বিআরটিএ থেকে তেমন কিছু জানা যায়নি, কারণ নাম্বার প্লেটটাও ফেইক।”
‘ইমামা তৎক্ষণাৎ বলল,”তাহলে ট্যাক্স? ইমপোর্ট করতে তো ট্যাক্স দিতে হয় নিশ্চয়ই?”
“দালালের মাধ্যমে আনা হয়েছিল।”
“তাহলে সেই দালালটাকে খুঁজে বের করুন। তাহলেই তো সব জানা যাবে।”
‘ইমামার গলায় টগবগে অস্থিরতা টের পায় অফিসার। তবু সে নির্লিপ্ত গলায় বলল,”দালাল আর নেই।”
‘চমকে ওঠে এলিজাবেথ,”নেই মানে?”
“সম্ভবত আর.কে.-এর লোকজন ওকে তুলে নিয়েছে।”
‘ইমামার মুখটা মলিন হয়ে গেল। নিঃশব্দে চোখ নামিয়ে রাখল। তা দেখে মাহেশ একটু সাহস জুগিয়ে নরম গলায় বলল,
“এতো সহজে হতাশ হলে হবে, মিস?”
‘ইমামা হতাশ নয়। বরং একদিক দিয়ে খানিকটা স্বস্তি পাচ্ছে যে কমপক্ষে সেই ম্যাডবিস্ট (সুরাকার) লোকটাকে গায়েব করার আগেই আর.কে.-এর লোকেরা তাকে তুলে নিয়েছে।
‘কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ ও বলল,”আচ্ছা, ফোন বন্ধ থাকলেও তো, খোলা হলে ট্রেস করা যায়, তাই না? সে তো দুই দিন পরপর আমাকে মেসেজ পাঠায়। তখন তার লোকেশনগুলো কোথায় দেখাতো?”
‘মাহেশ শান্ত গলায় বলল,”আপনার আশেপাশেই।”
‘ইমামা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই মাহেশ মাথা নাড়িয়ে বলল,”জি, সে সবসময় আপনার আশেপাশে থেকেই মেসেজ পাঠাতো। নিজ চোখে আপনার চোখে আতঙ্ক দেখতো, উপভোগ করতো।”
‘ইমামা এবারও কিছু বলার আগেই অফিসার নিজেই বলতে শুরু করল,”দেখুন, এটা আমাদের ব্যর্থতা যে আমরা তাকে চিনতে পারিনি। একজন আসামিকে ধরতে হলে ক্লু লাগে, তাই না? আপনি বলেছিলেন, সে কালো বাইক চালায়, ডেনিম জ্যাকেট পরে, মুখে নিনজা মাস্ক, মাথায় কালো হেলমেট, আর হাতে সাপের ট্যাটু আছে ঠিক তো?”
‘ইমামা মাথা নাড়ল। মাহেশ বলতে থাকল,”আমরা এতদিন সেই বর্ণনাকেই আঁকড়ে ধরে তাকে খুঁজছিলাম। অথচ সে ছিল আমাদের একদম চোখের সামনে। আমাদের নাকের ডগায়।”
‘ইমামার চোখে কৌতূহলের ঝলক,”মানে?”
‘অফিসার ঠোঁটে চাপা হাসি টেনে ল্যাপটপটা ইমামা দিকে বাড়িয়ে দিল,”এই দেখুন তার ছদ্মবেশ।”স্ক্রিনে সিসিটিভি ফুটেজের স্ক্রিনশট। প্রতিটিতে কোথাও না কোথাও ইমামা আর তার পাশে বা কখনো একটু দূরে, মার্ক করা একজন মানুষ। কখনো সাধারণ যাত্রী সেজে কখনো ব্যাঙ্কার, কখনো শিক্ষক। মাথায় ক্যাপ, মুখে মাস্ক দরুন চেহারা বোঝা যায় না। কিন্তু তার অস্বাভাবিক উচ্চতা আর গঠন ইমামার ভেতর কাঁপন তোলে। শিরায় জমে ওঠে পরিচিত আতঙ্কের ঠান্ডা স্রোত। তবুও নিজেকে সামলে ইমামা অফিসারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“কিন্তু কীভাবে বুঝলেন, এটা সে-ই?”
‘মাহেশ কোনো কথা না বলে আস্তে করে হাতার ভাঁজ গুটিয়ে নিল। তারপর ঝুম করে হাতের পিঠে উল্কির মতো খোদাই করা সেই ভয়ংকর সাপের মাথাটা দেখালো। ইমামার নিঃশ্বাস থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য। রক্ত জমে গেল শরীরে। এই সেই ট্যাটু! এই সেই চিহ্ন! তাহলে শয়তানটা তার আশেপাশেই ছিল? এতদিন ধরে এত কাছে অথচ সে টেরই পায়নি?
‘মাহেশ গম্ভীর মুখে বলল,”তাছাড়া, সে দিনে খুব একটা বের হয় না। কারণটা এখনো নিশ্চিত নয়। হয়তো বাইকের জন্য, আবার অন্য কিছুও হতে পারে। দু’টো থানায় রিপোর্ট এসেছে ট্রাফিক পুলিশ বাইকটা জব্দ করতে চেয়েছিল, কিন্তু সে প্রতিবার স্পিড তুলে পালিয়েছে। কোটি টাকার বাইক বাংলাদেশের রাস্তায় খুব সহজেই চোখে পড়ে। ইতিমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় বাইকের ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে।”
‘ইমামা মাথা নেড়ে নিচু গলায় বলল,
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। একটা জিনিস লক্ষ করছি, সে আমাকে প্রতিদিন বিরক্ত করে না। কিন্তু যখনই মেসেজ দেয়, প্রায়ই রাত বারোটার পর।”
‘মাহেশ ঠোঁটের কোণে মৃদু বাঁক এনে বলল,”হুম। কারণ তখন শহরটা ঘুমিয়ে পড়ে। আর সে সেই নিস্তব্ধতারই সুযোগ নেয়।”
‘ইমামা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আওড়ায়,”সুযোগ?”
“ওই যে বলেছিলাম, সে আপনার আশেপাশে থেকেই মেসেজ দেয়। আপনাদের বাসার পিছনে ছোট্ট একটা জঙ্গল আছে, রাইট? আর জঙ্গলটা ঠিক আপনার বেলকনির বরাবর।”
‘ইমামা মাথা নাড়ল,”হুমম।”
‘মাহেশ ল্যাপটপ ঘুরিয়ে বলল,”লেট মি শো ইউ সামথিং… এই ফুটেজগুলো দেখুন।গত পনেরো দিনের। এগুলো আপনার বাসার আশেপাশের সিসিটিভি থেকে নেওয়া। দেখুন, প্রতি রাতে কালো বাইকটা আপনার বাসার পিছনের জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। আর ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই ফিরে যাচ্ছে। মানে, সে প্রতি রাতে আপনাকে দেখতে আসত। সারারাত জঙ্গলে থাকত শুধু আপনাকে এক নজর দেখার জন্য।”
‘ইমামার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে এলো। মাহেশ শান্ত গলায় বলল,”এখনই মাথা গরম করবেন না, মিস। এখানে আরও গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। আমাদের ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।”
‘ইমামা হঠাৎ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,”তাহলে জঙ্গলে সার্চ চালালেই তো তাকে ধরা যাবে!”
‘অফিসার হালকা হাসল, চোখে অদ্ভুত এক ঝলক,”উঁহু। জঙ্গলে যাওয়ার সব পথ এখন বন্ধ।”
“মানে?”
‘মাহেশের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটল,”ইউ আর ইন আ ট্র্যাপ, মিস ইমামা।”
‘মাহেশের কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, যা ইমামার শরীর কাঁপিয়ে দিল। পশম দাঁড়িয়ে গেল এক নিমিষে।
“মানে কী?”
‘অফিসার রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,”আপনাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে মিস ইমামা। এখন একটা মাছিও তাদের ছায়া এড়িয়ে আপনার কাছে পৌঁছাতে পারবে না।”
‘ইমামা অবাক বিস্ময়ে মিইয়ে গেল। তখন ন্যাসোর কথাটা মাথার ভেতর যেন ঘূর্ণিঝড়ের মতো পাক খেতে লাগল। এজন্যই কী হঠাৎ করে লোকটা তার বিষয়ে এতটা তৎপর হয়ে উঠেছে? তার দৃষ্টি গেল ল্যাপটপে। অফিসার মাহেশ বাম পাশে থাকা (Back) আইকনে ক্লিক করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক নাম “Calvin Couhilo.”
‘ইমামা চমকে উঠে অস্পষ্ট স্বরে বলল,”ক্যালভিন কৌহিলো?”
‘অফিসার মাহেশ ল্যাপটপটা পাশে রেখে গম্ভীর গলায় বলল,”হুম। আচ্ছা, আপনি তো তার সব বই পড়েছেন, তাই না?”
‘ইমামা বিস্মিত চাহনিতে মাথা নেড়ে বলল,”পড়েছি। আই’ম আ বিগ ফ্যান অফ হিম।”
“তার শেষ বইটা পড়েছেন? শুনেছি, সে ডার্ক সাইকোলজি নিয়ে লিখেতো।”সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ইমামার দিকে তাকায় অফিসার।
“ওনার জনরা ছিল সাইকো থ্রিলার, ডার্ক থ্রিলার। নিষিদ্ধ আর অন্ধকার জগতের গল্প লিখতেন তিনি। সেই জগত থেকে কখনও বের হননি। উনার বইয়ে থাকত তীব্র সহিংসতা, বিকৃত মনস্তত্ত্ব। তবুও তার পাঠকরা পাগলের মতো ভালোবাসতো তার লেখ। আমিও তাদের মধ্যে একজন। সবাই অপেক্ষা করত তার পরের বই কবে আসবে। অনেকেই চেয়েছিল, তিনি যেন একবার অন্তত রোমান্সে লিখেন। আর তারপর…
‘অফিসার মাহেশ তার কথা কেটে দিয়ে বলল,”তারপরই বের হয় তার প্রথম রোমান্টিক বই, ‘ILOVEYOU, ROJABETH.’ পড়েছেন?”
‘ইমামা মৃদু স্বরে মাথা নাড়িয়ে বলল,”না। পড়তে পারিনি। শুনেছিলাম, ওটা লেখকের ব্যক্তি জীবনের গল্প। অসমাপ্ত প্রেমের খণ্ডচিত্র। বইটা প্রকাশের আগেই তুমুল হাইপ ওঠে। শুধু প্রি-অর্ডারেই পঞ্চাশ হাজার কপি ছাপা হয়। সারা দুনিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। আমি বইটা হাতে পাইনি। পরে নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু…
‘অফিসার মাহেশ নিচু গলায় যোগ করল,”কিন্তু নতুন মুদ্রণ আর আসেনি। কারণ জানেন কেন?”
“না!”
‘অফিসার মাহেশ একটু থেমে গম্ভীর স্বরে বলল,” রহস্যজনক ভাবে এই বইটা প্রকাশের পর থেকেই সেই রাইটার ‘ক্যালভিন কৌহিলো’ হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। ঠিক তখনই, যখন বইটার ডিমান্ড আকাশছোঁয়া আর কাহিনী অসমাপ্ত। দুই বছর কেটে গেছে কিন্তু তার কোনো হদিস নেই। এখনো নেটিজেনদের মাঝে তুমুল আলোচনা হয় এই নিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার পাঠক অপেক্ষা করছে বইটির পরবর্তী খণ্ডের জন্য। কিন্তু লেখকের অনুমোদন ছাড়া কিছুই প্রকাশ করা যাচ্ছে না।”
‘ইমামা নিজের অজান্তে ফিসফিস করে বলে উঠল,
“কেউ কি সত্যিই এভাবে হঠাৎ করে হারিয়ে যেতে পারে?”
‘অফিসারও যেন নিজের মনেই উত্তর খুঁজতে থাকে,”আমি সেটাই ভাবছি। কেউ কি এত সহজে নিজের গড়া একটা ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে পারে?”
‘ইমামা গভীর চিন্তায় তলিয়ে যায়। তার চোখে অন্যমনস্কতা।
“গতরাত থেকে তাকে নিয়ে রিসার্চ করছিলাম। যতদূর জানতে পেরেছি, বইটার মেইন লিডের নাম ছিল ক্রীশ, আর লিড অ্যাক্ট্রেস এর নাম রোজাবেথ। তার নামেই বইয়ের নাম রাখা হয়। নেটিজেনদের ধারণা, ওটা ছিল তার নিজের প্রেমকাহিনী। বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা যেমন অপূর্ণতায় থেমে যায়, তেমনি হয়তো তার জীবনেও কোনো অপূর্ণতা ছিল। সেই শোক, সেই হারানোর বেদনা থেকেই হয়তো সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।”
‘অফিসার মাহেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”কিন্তু তাই বলে এমন একটা ব্রাইট ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করে দেবে নিজের হাতে? তার প্রতিটি বই ছিল বেস্টসেলার, অগণিত পুরস্কার পেয়েছে লেখার জন্য। আপনি জানেন না অফিসার তার নতুন বই বাজারে আসার আগে কেমন হাইপ তৈরি হতো! সেখানে সে যখন এনাউন্সমেন্ট দেয়, অবশেষে সে তার জনরা থেকে বেরুতে যাচ্ছে তখন তো রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়।
‘মাহেশ মৃদু হেসে বলল,”এটাই তো প্রেম, যদি প্রেমে সত্যিই কিছু না থাকত, তাহলে সামান্য একটা বইয়ের লাইন এতটা কাঁদাতো কেন?”
‘এক মুহূর্তের নীরবতা নেমে এল। অফিসার মাহেশ আবার ল্যাপটপটা ইমামার দিকে ঠেলে দিল। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে ক্যালভিন কৌহিলোর অফিসিয়াল পেজ। শেষ পোস্ট আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে। নিচে এখনও বয়ে চলেছে হাজারো মন্তব্য। অপেক্ষা, উদ্বেগ, আর এক অদ্ভুত শূন্যতার হাহাকার ঘিরে রেখেছে কমেন্ট বক্স।
“দেখুন, সবাই কীভাবে ছটফট করছে তার কামব্যাকের জন্য। কেউ বইটার পরের অংশ চাইছে, কেউ জানতে চাইছে ক্রীশ আর রোজাবেথের কী দেখা হয়েছিল! সবাই জানতে মরিয়া, তারা কি শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে হয়েছিল, না গল্পটার মতোই তাদের জীবনও অপূর্ণ থেকে গেছে!”
‘অফিসার মাহেশ একটু থামল, তারপর ধীরে বলল,
“আর তিনি এমনিতেও তেমন ঘন ঘন বই লিখতেন না। বছরে একটা মাত্র। বাকিটা সময় তিনি প্রায় অদৃশ্য হয়েই থাকতেন। বই বের হওয়ার আগে অফিসিয়াল পেজে একটা পোস্ট দিতেন, তারপর হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে যেতেন। প্রথমে তার এই নিখোঁজ হওয়া কেউ গুরুত্ব দেয়নি। স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছিল। কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে সবাই অস্থির হয়ে ওঠে। সবসময়ের মতো এবার আর সে ধামাকা নিয়ে ফিরে আসেনি।”
‘অফিসারের মুখে মিশ্র ভাব। কৌতূহল, গাম্ভীর্য, আর এক অজানা টান। ইমামা বুঝতে পারল না বিদেশের এক লেখককে নিয়ে এই অফিসারের এত ভাবনার কারণ কী। হয়তো বইয়ের মতোই তার নিজের জীবনেও কোথাও একটা অপূর্ণতা লুকিয়ে আছে। তাই এভাবে থেমে যাওয়া।
‘ইমামা দৃষ্টি সরিয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করল। গলায় হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল,”ধান বানাতে কেন শিবের গীত শোনাচ্ছেন? এখন আমাদের ফোকাস থাকা উচিত শয়তানটাকে ধরার দিকে।”
‘অফিসার মাহেশ বাঁকা হাসল। সোজা হয়ে বসল,”গোয়েন্দাসুলভ মন তো, তাই সবকিছু নিয়েই কৌতূহল কাজ করে। যাকগে সে-সব। পা’টা একটু ভালো হোক, তারপর আমি নিজেই মাঠে নামব।”
‘ইমামা ঘড়ির দিকে তাকাল। সময় হয়ে গেছে তাকে যেতেই হবে। যাওয়ার আগে দাঁড়িয়ে বলল,”সাবধানে থাকবেন।”
‘মাহেশ কপাল কুঁচকে তাকাল,”কিসের সাবধান?”
“আইনের লোকদের অনেক শত্রু থাকে। এভাবে রাতবিরেত একা চলাচল করবেন না।”
‘মাহেশ হালকা হেসে গা-ছাড়া ভঙ্গিতে উত্তর দিল,”এসব আমি ভয় পাই না।”
‘ইমামা মৃদু কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল,”একটুও ভয় পান না?”
“না…”বলেই হঠাৎ থেমে গেল মাহেশ। তার চোখের সামনে যেন ধোঁয়াটে কিছু স্মৃতি ভেসে উঠে। আনমনে ফিসফিস করে বলে,”ভয় আমি জীবনে একবারই পেয়েছিলাম… চার বছর আগে।” তারপর নিস্তব্ধতা। বালিশের পাশে রাখা মোবাইলের স্ক্রিনে তখনও জ্বলছে পনেরো মিনিট আগে আসা অপরিচিত নাম্বারের মেসেজটি,
“তোর ভয়ার্ত চোখ দুটো আজও আমি ভুলতে পারিনি, অফিসার।”
‘ইমামা কিছু বুঝতে পারল না। ভ্রু কুঁচকে বলল,”জি?”
‘মাহেশ তড়িঘড়ি করে বলল,”কিছু না, আপনি আজ যেতে পারেন।”
‘ইমামা আর কিছু না বলে চুপচাপ উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে গিয়ে থেমে ফিরে তাকাল,বলল,
“আর হ্যাঁ, প্রেম বলেকয়ে আসে না। দমকা হাওয়ার মতো হঠাৎ এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায়। যদি আমাকে ছুঁতে আসে, আমি বাধা দেব না।”
‘বলে চলে গেল সে। মাহেশ ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে মাথা নাড়ল। এই মেয়ে যে ভয়ংকরভাবে প্রেমে পড়েছে তা সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।
‘হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। বাইকের চাবি আর হেলমেট হাতে তুলে নিল। পায়ের ক্ষত তখনও পুরো সারেনি। তবুও সে ছুটে গেল অজানা কোনো গন্তব্যের পথে।
‘হঠাৎ জানালার ফাঁক গলিয়ে দৃষ্টি গেল বাইরে। ইমান ওয়াসিমকে দেখে চমকে উঠল ইমামা। সে মাথা বাড়িয়ে দেখল বনশ্রী পিবিআই অফিস থেকে বেরোচ্ছে ইমান ওয়াসিম। ভদ্রলোক আর চুপ থাকতে পারেনি বোধহয়। নাকের ডগায় যা ঘটছে, তা জানার কৌতূহলে নিজেই নেমেছে গোপন তদন্তে। ইমামা বিরক্ত হয়ে পড়েছে। এই রহস্য, রহস্য খেলায় হাঁপিয়ে উঠেছে সে। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে। দুনিয়ার এসব বালের রঙতামাশা দেখার চেয়ে ঘুমানোই ভালো।
‘পিছনের গাড়িতে ছিল ন্যাসো। এক মুহূর্তের জন্যও ইমামাকে চোখের আড়াল করেনি সে। এবার নিজের দায়িত্ব সে নিখুঁতভাবে পালন করছে। নয়তো আগের বারের মতো বসের গর্জনে ছারখার হতে হবে (যখন ইমামা সুরাকারের বাইকে উঠেছিল)। ন্যাসোর ফোনের ওপারে বসে আছে তার বস—স্টাবর্ন, আরোগ্যান্ট, রুড, টক্সিক অ্যান্ড দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস ম্যান—রিচার্ড কায়নাত।
‘ন্যাসো এক হাতে ড্রাইভ করছে, অন্য হাতে ফোন ধরে বলল,
“বস, ম্যাম শুধু শুধু এভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে। যেখানে আমরা এখনো শয়তানটাকে ট্রেস করতে পারিনি, আর উনি তো এক অবলা নারী।”
‘ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে রিচার্ডের ভারি কণ্ঠ ভেসে এলো,”ফাস্ট অফ অল শি ইজ নট অবলা নারী। অ্যান্ড সেকেন্ডলি, উমেন আর অলওয়েজ কিউরিয়াস বাই নেচার। লেট হার ডু হোয়াটএভার শি ওয়ান্টস, লেট হার পাস দ্য টাইম। ইট’স নট লাইক আই’ম দেয়ার উইথ হার টু রোমান্স এনিওয়ে।”
‘ভারি কণ্ঠের সেই কথাগুলো শুনে ন্যাসোর হেসে ফেলতে ইচ্ছে হলো। তবে এমুহূর্তে হাসা পাপ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে ভেতরে চেপে রাখা কথাটা আজ বলেই ফেলল,
“এভাবে এক দেখায় এতটা বিশ্রীভাবে কারও প্রেমে পড়া, এটা আদৌ সম্ভব, বস?”
“প্রেম একটা মহামারী, ন্যাসো। কখন, কার ভেতর ছড়িয়ে পড়বে কেউ জানে না। একবার এই রোগে যে আক্রান্ত হয়, সে আর কখনো সুস্থ হয় না। আমি বড্ড অসুস্থ, ন্যাসো… প্রেমের সর্বনাশে বেহাল দশা আমার।”
‘ন্যাসো হতবাক। চোয়াল ঝুলে যায় তার। তার মনে হলো সে কোনো অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা বলছে। এটা রিচার্ড কায়নাত হতে পারে না৷ যে মানুষ সর্বদা কঠিন, কর্কশ, আর নির্মমতার প্রতিমূর্তি, তার কণ্ঠে এরূপ নমনীয়তা! ওদিকে রিচার্ড চুপচাপ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিজের ডান হাতের সোজা পিঠে। রগজ্বলা বলিষ্ঠ সেই হাতে ফুটে আছে একজোড়া ভেজা চোখের ট্যাটু। একদম নতুন। আজই করানো।
‘তবে কী ওই চোখদুটি সেদিনের পার্টির সেই অশ্রুসিক্ত
চোখ? তাহলে কি সত্যিই প্রেম এক দেখাতেও হয়? এতটাই অদ্ভুত, এতটাই পাগল করা হয় প্রেম? ক্ষণিকের সাক্ষাৎও কি কাউকে এমন গভীরে টেনে নিতে পারে!
‘চাঁদ কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়েছিল শুকতারার খোঁজে। কিন্তু এখন চাঁদ-শুকতারা উভয়ই নিখোঁজ। আকাশ মেঘলা হওয়ায় অন্যান্য নক্ষত্রও দেখা যাচ্ছে না। ইমামা রক্তশূন্য মুখে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার কোলে মায়া। ভয়ে ইমামার বুকের সঙ্গে একেবারে মিশে আছে। মায়া এই ঈগলটিকে মোটেও পছন্দ করে না। অথচ ঈগলটি প্রতিদিন আসে। ঠোঁট দিয়ে তার মালিকের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে। আজকাল সে লাল গোলাপ নিয়ে আসে। ইমামা ঈগলের ঠোঁট থেকে গোলাপ নিতেই ঈগলটি উড়ে চলে যায়।
‘ইমামার মন আজ ভারাক্রান্ত। হঠাৎ মনে হচ্ছে তার শরীরের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। হয়তো সে আর দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারবে না নিজের মাঝে। তবুও এত সহজে নিজেকে হারাতে দিবে না। এখনও তার অনেক কাজ বাকি। কারিবের খুনিকে শাস্তি দেওয়াই তার প্রতিজ্ঞা। কিন্তু এভাবে কতদিন? সে কি আদৌ খুনিকে খুঁজে বের করতে পারবে?
‘অনেকক্ষণ ভেবে ইমামা আর দ্বিধান্বিত হলো না। মায়াকে কোল থেকে নামিয়ে ফোন হাতে নিল। ফোন হাতে নিয়েও কিছুক্ষণ ভাবল৷ কীভাবে শুরু করবে, বা আদেও ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিল না। কয়েক মুহূর্তের চিন্তাভাবনার পর অবশেষে সে কাজটি করেই ফেলল। সেই দিনের তুলা বাইকের নাম্বার প্লেটের ছবি রিচার্ডকে পাঠিয়ে লিখল,
“ডু ইউ নো হিম?”
‘সে জানে রিচার্ড সবটা জানে তবু কৌশল অবলম্বন করল। কয়েক মিনিটের মধ্যে রিপ্লাই এলো অচেনা স্বরের আড়ালে বিষ্ময়খাওয়া মনটাকে আরও অবাক করে দিয়ে,
“ইউ ডোন্ট নিড টু থিঙ্ক অ্যাবাউট হিম; জাস্ট থিঙ্ক অ্যাবাউট মি, লাল পরি।”
‘ইমামা চমকে উঠল। আবার নতুন কোনো নাম? এই লোকটা কী শুরু করেছে! নামের গোডাউন খুলবে নাকি এই লোক? চিন্তার সূত্র ধরে মন অনমনস্ক হয়ে পড়ল। ততক্ষণে আরেকটা মেসেজ এসে পড়ল:@
“স্বামী রেখে পরপুরুষে কথা ভাবতে নেই। আমার কথার আগে হাত চলে বেশি। ঘুমিয়ে পড়ুন। আপনাকে আমি আঘাত করতে চাই না। আমি আপনাকে ভালোবাসি; অর্থাৎ, পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ আপনার জন্য নিষিদ্ধ, প্রিন্সেস। ঘুমান। আপনি যত তাড়াতাড়ি ঘুমাবেন, আমি তত তাড়াতাড়ি আপনার স্বপ্নে আসব।বি রেডি, মাই সুন-টু-বি উয়াইফি। আই’ল ইউ সো হার্ড টুডে।”
‘ইমামার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ নিয়ে পড়ছিল। মাঝে মাঝে মুখে লালচে আভা ভেসে উঠেছিল। কিন্তু শেষে যখন সে আসল কথাটা বুঝল, আঁতকে ওঠে ফোনটা ছুঁড়ে মেরে ফেলল বিছানায়।
‘রিচার্ডের কথা কাজে লেগেছিল। লজ্জা আর ভয়ের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণে ইমামা গভীর ঘুমে ডুবে গেছে। ঘুমন্ত ইমামার মুখের দিকে বিমোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রিচার্ডের ঠোঁট থেকে হঠাৎ ঝরে পড়ল,
“আপনি আমার খুব শখের,এলিজান।”
‘ইমামা যখন গভীর ঘুমে তখন পরিবাগের এক পুরোনো ব্রিকে এক রমণী দাঁড়িয়ে আছে। কারচুপি করা কামিজের গলা এতোটাই বড় যে বক্ষের উপরিভাগ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, ঠোঁট টকটকে লিপস্টিকে রঙিন। হাতে লাল রেশমী চুড়ি, কানে বড় দুল, চোখের নিচে মোটা কাজল। দেখলেই বোঝা যায়, সে যৌনকর্মী। হঠাৎ এক বাইক থামল তার সামনে। কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে সে হেসে বাইকে উঠে বসল। আর ঠিক দুই দিন পর বুড়িগঙ্গার তীরে তার লাশ পাওয়া যায় মুখ বিকৃত অবস্থায়।
❌
[আমার লেখালেখির বয়স একবছর অতিক্রম করেছে সেপ্টেম্বর মাসে। এর ভেতর অসুস্থতা আর জরুরী কাজ ছাড়া কখনো লেখালেখি থেকে দূরে থাকিনি। নিরলস লিখে গিয়েছি। এবার বোধহয় একটু বিরতির দরকার। মস্তিষ্কে এই জটলা খিচুরি পাকানো থেকে একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। এলোমেলো জীবনটাকে এবার একটু গোছানো প্রয়োজন, নতুন রঙে রাঙানো উচিত। তাই, আমি গল্প থেকে মধ্যবিরতি নিলাম। চিন্তা করবেন না, সম্পূর্ণ গল্পটা আমি ফেসবুকেই শেষ করবো। এটা শেষ করার জন্য হলেও আমাকে আবার ফিরতে হবে। ততদিন অপেক্ষা করবেন আর দোয়ার রাখবেন। ভুলে যাবেন না……
Share On:
TAGS: born to be villains, মিথুবুড়ি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
Born to be villains পর্ব ৯
-
Born to be villains পর্ব ৩
-
Born to be villains গল্পের লিংক
-
Born to be villains পর্ব ১
-
Born to be villains পর্ব ২
-
Born to be villains পর্ব ১০+বোনাস
-
Born to be villains পর্ব ৫(প্রথমাংশ+শেষাংশ)
-
Born to be villains পর্ব ৭
-
Born to be villains পর্ব ৪
-
Born to be villains পর্ব ১৫