born_to_be_villains
methuburi_মিথুবুড়ি
পর্ব_৯
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌
‘ধরুন আপনি একজন সাধারণ, সুস্থসবল মানুষ। আপনি সবকিছু দেখতে পারছেন, এবং অনুভব করতে পারছেন। আপনার গায়ের নরম চামড়ার ওপর সামান্য একটা হুল ফুটলেও আপনি তা টের পাচ্ছেন, ব্যাথা অনুভব করছেন। এমতাবস্থায় কেউ যদি আপনার চোখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে, খিজলিয়ে আপনার চোখের মনি দু’টো টেনে বের করে আনে, তখন আপনার কেমন লাগবে? আপনি নরকযন্ত্রণায় কাতড়াবেন, ছটফট করবেব, চিৎকার করবেন—তাই স্বাভাবিক, না? কিন্তু এই বীভৎস দৃশ্য যদি আপনার পরিবারের আপনজন, বা আপনার সহধর্মিণী, আপনার দুইবছরের ছোট বাচ্চা দেখে, তখন তাদের কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই তাদের গগনবিদারী আহাজারিতে চারপাশে কেঁপে উঠবে। তেমনি স্ক্রিনে রক্তহীম করা এটুকু নৃশংস দৃশ্য দেখামাত্র স্ট্রিফেনের স্ত্রীর আর্তচিৎকারে কেঁপে ওঠে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবন। নিঃশব্দ দুপুরে স্বপ্নে ভাসা দুতলা বাড়িটাতে
সকাল থেকে কান্নার রোল পড়েছে। শোকধ্বনি চিৎকারে নিঃশব্দ মন্দিরে পরিণত হয়েছে মন্ত্রী মসাইয়ের মেঘের মতো সাদা, শান্ত দুতলা বাড়ি—যেখানে শোকই একমাত্র প্রার্থনা।
‘লিভিং রুমে চিন্তিত মুখে বসে আছেন মন্ত্রী মসাই। ভেতর থেকে ভেসে আসছে মেয়ের অবিশ্রাম বিলাপ। সিডের খুনের তিনদিন পর স্ট্রিফেন নিখোঁজ হয়। একমাত্র ছেলের খুন এবং মেয়ের অসহায় আহাজারিতে মুষড়ে পড়েছিলেন মন্ত্রী মসাই। এরিমধ্য দুইদিন আগে একটি অজ্ঞাত নাম্বার থেকে কল আসে; বলা হয়—সিড হত্যার মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য, এতে করে তারা স্ট্রিফেনকে ফিরিয়ে দিবে। যে হােরিয়ে গিয়েছে, সে তো হারিয়েই গিয়েছে; যে আছে, তাকে এভাবে ভেঙেচুরে গুড়িয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর দ্বিমত পোষণ করেনি মন্ত্রী মসাই। তিনি দ্রুত মামলা তুলে নেন৷ কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয়নি। স্ট্রিফেন তার পাপ থেকে বাঁচতে পারেনি। তার পাপ তাকে গিলে খেয়েছে।
‘হঠাৎ আবারো সেই অজ্ঞাত নাম্বার থেকে কল আসে। মন্ত্রী মসাই রক্তক্ষয়ী তেজের সাথে কল রিসিভ করে সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলেন,
“জানোয়ারের বাচ্চা, তোর কথা মতো তো আমি কেস তুলে নিয়েছিলাম, তারপরও আমার মেয়েটাকে বিধবা করলি কেন? উত্তর দে,শুয়োরের বাচ্চা।”
‘ওপাশে কী বিচ্ছিরি হাসি! ভারিক্কি কণ্ঠের, বিদঘুটে হাসির ঝংকারে মন্ত্রী মসাইয়ের ওষ্ঠপুটে তেজের বিচ্ছুরণ ঘটে। চোখেমুখে বিদুৎচমকানোর মতো হিংস্রতা। ফের চিৎকার করে বললেন,
“উত্তর দে।”
‘হুয়াহাহাহাহা হাসির শব্দ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে। কিন্তু প্রশমিত হয় না অবদমিত রাগ। মিসাইলের মতো হিংস্র গর্জনের সাথে তেড়ে আসে টগবগে বজ্রকণ্ঠ,
“গলার আওয়াজ নামিয়ে, মন্ত্রী মসাই! আপনার জামাতা তার পাপের শাস্তি পেয়েছে। প্রজা হয়ে রাজাকে সরানোর মতো বিরাট চক্রান্ত রচনা করেছিল সে; তাই তার দণ্ড অপরিহার্য। ওই অধমের বুঝে নেওয়া উচিত ছিল—রাজা তো রাজাই। জিহ্বায় লাগাম টেনে চুপ করে থাক, নইলে ছেলের মতো মেয়েকেও হারাতে হবে।”
‘সংযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। মন্ত্রী মসাই এবার ঘামতে শুরু করল। এটা কী তবে আর.কে? যাকে স্ট্রিফেন অতিথিসেবা দেখানোর অজুহাতে জুজের বিষ খাইয়ে মারার পরিকল্পনা করছিল। যেখানে উদ্দেশ্য একটাই—ইতালিতে রাজত্ব কায়েম করা। তাহলে কী আর.কে সব জানতো? আর এজন্যই কি স্ট্রিফেনকে এত নির্মমভাবে নির্মূল করা হল? কিন্তু একটা জিনিস তার মাথায় টের পাওয়ার মতো ঠিকঠাক বসছে না, সেটা হলো আর.কে কেন সিডের কেস টোলার কথা বলল? সে কি খুনিকে চেনে? নাকি খুনি নিজে আর.কে? আর নাকি কেউকে বাঁচাতে চেইছে সে?
‘উত্তরগুলো এখনও অমীমাংসিত। একের পর এক প্রশ্ন জড়িয়ে পড়ছে মন্ত্রীর মনে। তাহলে এখন নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে সেদিন পার্টিতে জুজ খাওয়ার পর বিড়ালটা কেন নিথর হয়ে পড়েছিল। আর সেই সুউচ্চ, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী, আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা রহস্যময় লোকটার দৃষ্টিতে কেন এমন অদ্ভুত সতর্কতা ছিল? তা-ও হয়তো এবার পরিষ্কার।
“ঢাকা, বুধবার — রাজধানীর গুলশানের একটি বারের সামনে থেকে প্রাক্তন সংসদ সদস্য ইমান ওয়াসিমের একমাত্র মেয়ে ইমামা ওয়াসিমকে গতরাতে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইমামা ওয়াসিম মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে মদ্যপানের সময় কোনো ঝামেলার একপর্যায়ে তাকে আঘাত করে ফেলে রেখে যায় তারা। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা ইমামাকে উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান।
এ ঘটনায় ইতোমধ্যে ইমামার অচেতন অবস্থার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যা ঘিরে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা। ওয়াসিম পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ খবর পেতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন।”
‘খবরটি প্রথমে প্রকাশ পায় মাত্র দু’টি সংবাদমাধ্যমে এবং কয়েকটি ফেসবুক একাউন্টে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে মাত্র পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই সেই খবর উধাও হয়ে যায়৷ দু’টি চ্যানেলের ডাটা থেকে সংবাদটি মুছে ফেলা হয় চিরতরে, আর ফেসবুক একাউন্টগুলোও হঠাৎ করে ডিজেবল হয়ে যায়। তবুও ততক্ষণে অনেকেই ঘটনাটি জেনে ফেলে। খবরটি পৌঁছে যায় ইমান ওয়াসিমের কানেও। তিনি তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ছুটে যান। আর ইমামার জ্ঞান ফিরতেই তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন সাংবাদিকদের তীর্যক প্রশ্নের হাত থেকে মেয়েকে আড়াল করার জন্য।
‘দুর্বল শরীর আর বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইমামা। চোয়ালে আঙুলের দাগ স্পষ্ট। থরথর করে কাঁপছে চোয়ালের মাংসপেশি। এ নিয়ে তৃতীয় চড় এসে পড়ল ঠিক সেই জায়গাতেই। তবু ইমামা নিশ্চুপ। দৃষ্টি স্থীর করে রেখেছে মেঝেতে। নিজেকে সামলে রাখার মরিয়া চেষ্টা করছে সে। কিন্তু ইমান ওয়াসিম আর পারছেন না। জীবনে এই প্রথম মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন আজ। ইমামার নীরবতা তার রাগে যেন আগুন ঢেলে দিচ্ছে।
‘চিৎকার করে উঠলেন তিনি, “জবাব দিচ্ছো না কেন? কবে থেকে ড্রাগস নিচ্ছো?”
‘ইমামা এবার মুখ খুললো। আস্তে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি ড্রাগস নিইনি।”
‘ইমান ওয়াসিম ফের গর্জে উঠলেন,”মিথ্যা বলবে না! তোমার শরীরে ড্রাগস পাওয়া গেছে!”
‘সুযোগ পেয়ে পাশ থেকে মিসেস নীহারিকা তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“মেয়েকে আদর দিতে দিতে মাথায় তুলেছো! বলেছিলাম, বিয়ে দিয়ে আপদটা বিদায় করো। মুখ পুড়ি নির্দোষ তো ছেলেটার মাথাটাও খেলো৷”
‘এতক্ষণ বাবার ধমক, চড় সব চুপচাপ সহ্য করলেও এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না ইমামা।মায়ের কটাক্ষে চোখ ভরে উঠে জলে। পনেরো বছরের ইমন পাশে দাঁড়িয়ে বোনের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ইমন মায়ের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,
“মা, তুমি চুপ করবে? ইমায় আপুকে কখনো খারাপ কিছু করতে দেখেছো? কী হয়েছে, আগে ওর মুখে শুনে তারপর কথা বলো। তার আগে খবরদার একটা বাজে কথাও বলবে না আমার বোনকে।”
‘মিসেস নীহারিকা ছেলেকে কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই ইমান ওয়াসিম হাত তুলে স্ত্রীকে থামিয়ে দিলেন। তিনি এবার ঠান্ডা গলায় জানতে চাইলেন,
“তুমি আমার বিশ্বাস এভাবে ভাঙলে, মা?”
‘ইমামার বুক ভারি হয়ে আসে। সে কীভাবে বোঝাবে, সে কিছুই করেনি! সবটাই ছিল নিখুঁতভাবে সাজানো এক নাটক। শয়তানটা তার জালে আগেই ফাঁসিয়ে রেখেছিল তাকে। কাল, ইমামার রিভলভার থেকে গুলি বেরোনোর আগেই ম্যাড বিস্টের (সুরাকার) রিভলভার থেকে ছুটে আসে গুলি। তা গিয়ে বিদ্ধ হয় ইমামার কাঁধের নিচের কোমল মাংসে। বুলেটটিতে ছিল ড্রাগ মেশানো। মুহূর্তের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে ইমামা।
‘তারপর শয়তানটা তাকে বারের সামনে ফেলে রাখে এমনভাবে, যেন মনে হয় সে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছে। দূর থেকে ভিডিও করে সেই দৃশ্য৷ আর পরে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। যদিও এই খবর পাওয়া মাত্র আর.কে নিজের লোক দিয়ে দ্রুত সবকিছুর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা জানাজানি হয়ে যায়। এছাড়াও প্রকৃতপক্ষে, স্থানীরা নয়, বরংচ আর.কে-এর লোকেরাই উদ্ধার করেছিল ইমামাকে, এবং তারা-ই তাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে।
‘সেই বাদামি চোখের উজ্জ্বল বর্ণের মানুষটি—’ন্যাসো’—যে বিগত আট বছর ধরে আর.কে-এর অধীনে রয়াল বডিগার্ড হিসেবে কাজ করছে, সে তখনের গর্জনে নিজের যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে হন্নতন্ন হয়ে ইমামাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অনেক খোঁজার পর-ও যখন ইমমাকে খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন ইতালি থেকে তার বসের কল আসে। অদ্ভুতভাবে, ইতালি থেকে বসের পাঠানো লোকেশন অনুযায়ী পৌঁছে তারা ইমামাকে খুঁজে পায়।
‘মিসেস নীহারিকা, বক্ষপিঞ্জরের পুঞ্জিভূত সকল ক্ষোভ, আর তিক্ততা উগড়ে দিলেন আজ। ইমামার নিপতিত ভাবনার সুতো ছিঁড়ে প্রবল এক ধাক্কায়। অতর্কিত ধাক্কার বেগ পোহাতে না পেরে সিটকে গিয়ে পড়ল সোফার ওপর। ইমামা আহত চোখে তাকাল মায়ের দিকে। কিয়ৎক্ষণ অবুঝ ভঙ্গিতে মায়ের দিকে চেয়ে থেকে দৃষ্টি ফেরালো ফোনের স্ক্রিনে। ফোনটা সেই কখন থেকে অনবরত বেজে যাচ্ছে। সে জানে এটা আর.কে-এর কল। সে ছাড়া এতো অস্থিরভাবে আর কেউ তাকে কখনো কল দেয় না। নৈঃশব্দ্যে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ইমামার চোখ থেকে।
“অলক্ষী, অপয়া মেয়ে কোথাকার। আমার জীবনটা একদম শেষ করে দিয়েছিস তুই। যবে থেকে তুই আমাদের মাঝে এসেছিস, তবে থেকে জীবনটাকে একদম জাহান্নাম বানিয়ে ছেড়েছিস। এখন আমরা বাইরের লোকদের সামনে মুখ দেখাবো কোন মুখে, মুখ পুড়ি?”
‘মিসেস নীহারিকার মুখ দিয়ে আগুন ঝরছে। দু-চোখে গনগনে অগ্নিশিখা। ইমান ওয়াসিম আজ স্ত্রীকে বাঁধা দিলেন না। তার চোখেমুখে অসন্তুষ্টি। এদিকের ভদ্রমহিলার মুখনিঃসৃত প্রতিটি কথার ঝাঁঝ, ঝাঁঝরা করে দেয় ইমামার কোমল হৃদয়। ইমন ছুটে গিয়ে বোনকে সোজা করে। তারপর বোনকে বুকে আগলে ধরে প্রতিবাদী সুরে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই হাত খামচে ধরে ভাইকে রুখে দেয় ইমামা। ইমন বিমূঢ চোখে তাকাল বোনের বিধ্বস্ত মুখে। ইমামা চোখে পানি সমেত মাথা নাড়ায়। ইমন আশ্চর্য হয় না বোনের এরূপ আচরণে। কথায় আছে না—’শক্তের ভক্ত, নরমের জল’। ছোট থেকে মায়ের অনাদরে বেড়ে ওঠা মেয়েটা মায়ের প্রতি বড্ড দূর্বল। আর তার সেই দূর্বলতাকেই অস্ত্র বানিয়ে বার বার আঘাত হানে মিসেস নীহারিকা। হাতের মুঠো শক্ত হয় তার, অবদমিত রাগে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে।
‘মিসেস নীহারিকা আরও বললেন,”জন্মের পরই যদি তোকে নুন খাইয়ে মেরে ফেলতাম, তাহলে আমার সংসারে আজ এতো অশান্তি হতো না।”
‘ইমামা অনিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। তারপর রক্তার্ভ মুখে ততধিক বিস্ময় নিয়ে ফিরে তাকাল বাবার দিকে। কিন্তু ইমান ওয়াসিমের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, আচরণের নিস্পৃহতা, অবিশ্বাস্য চাহনি সব একজোট হয়ে ধারালো অস্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয় তার অন্তস্তল। দীর্ঘক্ষণ কান্না চেপে ধরার অক্ষুণ্ণ চেষ্টা চালিয়ে শেষমেশ ফুঁপিয়ে উঠল ইমামা। চোখের কোণে জমা চিকচিকে অশ্রু কণা বৃষ্টির মতো গড়িয়ে পড়ে। ঢেউহীন যন্ত্রণা টালমাটাল হৃৎস্পন্দনে ছড়িয়ে পড়ে নিশ্বাস কামড়ে ধরে। কান্নারা কণ্ঠনালিতে কুন্ডলী পাকিয়ে কণ্ঠরোধ করে দরুন নিশ্বাস ফুরিয়ে আসে ইমামার।
‘ধীরে ধীরে নীলচে আভা ছড়িয়ে পড়ে ইমামার গোলাপি কোমল মুখে। ইমামার অস্থির নিশ্বাসের শব্দ শুনে ইমান ওয়াসিম চমকে তাকান মেয়ের দিকে। ছোটবেলা থেকেই ইমামার শ্বাসকষ্টের সমস্যা। উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে মেয়ের দিকে এগোতে যাবেন, এমন সময় হঠাৎ এক ভারি পদাঘাতে কেঁপে ওঠে পুরো ওয়াসিম মঞ্জিল। চমকে ওঠে সবাই।
‘এক এক করে বাইরের সব গার্ড ভেতরে ঢুকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে তাদের। এতো ভারি পদচারণায় মনে হয় যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। ইমান ওয়াসিমের বিস্মিত দৃষ্টি স্থির হয় নিজের গার্ডদের দিকে, যারা এইমুহূর্তে তার দিকেই অস্ত্র তাক করেছে। ইমামা অবাকও হতে পারে না। সে দ্বিধায় পড়ে যায়—যে অবাক হবে, না আশ্চর্য হবে। কারণ গার্ডগুলো ভেতরে ঢুকে ইমান ওয়াসিম আর মিসেস নীহারিকার দিকে অস্ত্র তাক করা মাত্রই, ইমামার ফোন কাঁপা থেমে যায়। যেটা সেই শুরু থেকে অবিশ্রাম কাঁপছিল।
‘ইমান ওয়াসিম স্তব্ধ চোখে গার্ডদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যাদের তিনি এতদিন নিজের ভৃত্য ভেবেছেন, তারা আজ নির্ভীক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে। বাংলায় একটা কথা আছে,
“যখন তোমার পোষা কুকুরই তোমাকে ঘেউ ঘেউ করবে, তখন বুঝে নিও, সে অন্যের থালা থেকে খাচ্ছে।!
‘চৌকস রাজনীতিবিদ ইমান ওয়াসিমের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক সঙ্গে সঙ্গেই হিসেব কষে ফেলে, এই গার্ডগুলো নিশ্চয়ই বিক্রি হয়ে গেছে। তাই আর ঘুরিয়ে না বলে সরাসরি প্রশ্ন ছোঁড়েন,
“কত টাকায় বিক্রি হয়েছিস তোরা?”
‘গার্ডদের মধ্যে একজন গম্ভীর স্বরে বলে,”দশ মিলিয়ন।”
‘চমকে ওঠেন ইমান ওয়াসিম। দুই টাকার সাধারণ গার্ডদের কেউ দশ মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনেছে? বিস্ময়ে গলা শুকিয়ে যায় তার। আবার প্রশ্ন করেন,
“তোদের কী কাজ দেওয়া হয়েছে?”
‘গার্ড ঠান্ডা গলায় মাথা নেড়ে ইমামার দিকে ইশারা করে বলে, “ম্যামকে দেখে রাখার।”
‘ধীরে ধীরে ইমান ওয়াসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। হঠাৎ মাঝখান থেকে মিসেস নীহারিকা গর্জে ওঠেন,
“দেখেছেন? এই মেয়ের নষ্টামি কতদূর গিয়েছে! ওর প্রেমিক এখন বাড়ির লোকগুলো পর্যন্ত কিনে ফেলেছে! আমি বলছি ক….
‘তার কথা শেষ হওয়ার আগেই এক গার্ডের কানে থাকা ব্লুটুথে সংকেত আসে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসাথে গান পয়েন্ট নেয় মিসেস নীহারিকার দিকে। ইমান ছুটে যায় মায়ের সামনে, ভয়ের চোটে নীহারিকা লুকিয়ে পড়েন ছেলের আড়ালে।
‘ইমান ওয়াসিম নিজের রাগ আর বিস্ময় ধরে রাখতে না পেরে চেচিয়ে ওঠেন,
“কবে থেকে তুই অন্যের হয়ে কাজ করছিস?”
“উনিশ সেপ্টেম্বর থেকে।”
‘শিউরে উঠলেন ইমান ওয়াসিম। উনিশে সেপ্টেম্বরই তো সিড খুন হয়েছিল। মানে সেই পার্টির রাতেই। এরপর একে একে সিডের দেহের ছিন্নভিন্ন অংশ পাঠানো হয়েছিল তার বাড়িতে, আর সঙ্গে ছিল একটি চিরকুট, যেটি ছিল ইমামার উদ্দেশে। চিরকুটের কথা কাউকে বলেননি তিনি। ভেবেছিলেন কেউ হয়ত তার মেয়েকে ফাঁসাতে চাইছে। কিন্তু কিছুদিন পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনে সবকিছু বদলে যায়। মন্ত্রী জানান, কেউ নাকি তাকে ব্ল্যাকমেইল করছে, সিড হত্যার মামলা দ্রুত তুলতে হবে বলে। সে কথায় সামান্য স্বস্তি পেয়েছিলেন ইমান ওয়াসিম; কারণ ততদিনে নানা কারণে সিড হত্যার সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে ইমামার নাম।
‘তবু মাথা তার কাজ করছিল না। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। পার্টির রাতের পর থেকে চারপাশে ঘটে চলা অদ্ভুত ঘটনাগুলো যেন কারো অজানা ছায়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। হঠাৎ করে রোমিওর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, লাইব্রেরিতে আগুন, মাঝরাতে বাড়ির ওপর ঘুরতে থাকা অচেনা হেলিকপ্টার, আর বারবার সেই কালো গাড়িগুলো আর সেই কালো (ব্ল্যাকমাম্মা) বাইকটির উপস্থিতি বাড়ির চারপাশে। সবই তিনি দেখেছেন, টেরও পেয়েছেন; কিন্তু সেই রহস্যের জট ছিন্ন করার মতো শক্তি তার ছিল না। আর আজকের ধাক্কাটা তো আগের সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল। তার মেয়ে কীসের মধ্যে ফেঁসে গেল? এটা কী কোনো গোলকধাঁধা নাকি কোনো ফাঁদ? না অতীত ফিরে আসছে?
‘ভাবনার ভেতরেই গার্ড এসে ফোনটা ধরিয়ে দিল ইমান ওয়াসিমের হাতে। লাউডস্পিকারে দেওয়া কল। মুহূর্তেই বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ওপাশ থেকে বজ্রের মতো গর্জে ওঠে কণ্ঠ,
“এই মেয়েকে কাঁদানো পাপ। এই পাপের মাসুল খুব বাজে ভাবে দিতে হবে তোদের।”
‘ইমামা শিউরে উঠল চেনা সেই ভারি কণ্ঠে। ইমান ওয়াসিমও কেঁপে ওঠেন। কিন্তু নিজেকে সামলে নেন। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন,”কে তুই?”
‘ওপাশ থেকে বজ্রগম্ভীর উত্তর,”আর, কে।”
“ফুল ফ্রম?”
“তোর বাপ। ওর কান্না থামা, ইউ ফাকিং বাস্টার্ড!”
‘তার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে ঘর। ইমান ওয়াসিম চমকে তাকান মেয়ের দিকে। ইমামা তড়িঘড়ি করে নিজের চোখ মুছে ফেলে।
‘আবার প্রশ্ন করেন ইমান ওয়াসিম,”কে তুই?”
‘ওপাশ থেকে আসে তীব্র হুঁশিয়ারি,”ওর চোখ থেকে আর এক ফোঁটা পানি পড়লে, এক্ষুনি তোর বাড়িতে বোম পড়বে। খোদার কসম, আমি যা বলি, তাই করি।”
‘সঙ্গে সঙ্গে গার্ডরা গান লোড করে। ক্র্যাং ক্র্যাং
শব্দে থরথর করে ওঠে সবাই। মিসেস নীহারিকা ছুটে যায় ইমামার কাছে, নিজের আঁচল দিয়ে মুছে দেয় ইমামার চোখের পানি। ইমামার বুক ভারী হয়ে ওঠে৷ সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হয় তার। আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ছুটে যায় সে নিজের রুমে।
‘নিজেকে আর সামলাতে পারেন না ইমান ওয়াসিম।
চিৎকার করে ওঠেন,”কী বলতে চাইছিস তুই?”
‘ওপাশের কণ্ঠ এবার শীতল,”ওর চোখ থেকে ঝরা প্রতিটি ফোঁটার জন্য তোদের ভোগতে হবে।”
“মানে?”
‘নিমেষে স্বর নরম হয়ে যায় ওপাশের মানুষটার। তীব্র অধিকারসুলভ কণ্ঠে বলল,
“মানে—শি ইজ মাইন, জাস্ট মাইন। আমার আমানত কয়েকদিনের জন্য আপনার কাছে হেফাজতে রেখেছি, শ্বশুর মশাই। ওকে কষ্ট দেবেন না।” এবার গলে আসে তার কণ্ঠ, “আমি সহ্য করতে পারি না ওর কষ্ট। শুধু আর ক’টা দিন আপনারা ওকে আগলে রাখুন । খুব শিগগিরই আমি এসে আমার জিনিস নিয়ে যাবো। ততদিন বাঁচতে চাইলে ওকে ভালো রাখুন, খুশি রাখুন। একবার নিজের কাছে নিয়ে আসি, তখন আর কাউকে লাগবে না, ওকে ভালো রাখার জন্য। হার ম্যান ইজ এনাফ ফর হার।”
‘শেষের কথাগুলো টেনে, চিবিয়ে উচ্চারণ করে। তারপর হঠাৎই বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল সে,
“ফ্রম নাও অন, শি ইজ আন্ডার মাই প্রোটেকশন।
ফ্রম নাও অন, নোবোডি হার্টস হার অর টকস শিট অ্যাবাউট হার—আই রিপিট, নট এনিওন। নেক্সট টাইম ইফ এনিওন ট্রাইজ টু হার্ট হার অর টক শিট অ্যাবাউট হার, আই উইল কাট দেম অফ দ্য ওয়ে আই কাট অফ সিড; জাস্ট রিমেম্বার হাউ আই কিলড সিড।”
‘ইমান ওয়াসিম অবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারমানেই সে-ই সিডের খুনি? কিন্তু সে সিডকে এতো নৃশংসভাবে কেন টুকরো টুকরো করে হত্যা করল—শুধুমাত্র ইমামাকে কষ্ট দিয়েছিল বলে?
❌
চলবে….
Share On:
TAGS: born to be villains, মিথুবুড়ি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
Born to be villains পর্ব ১৩
-
Born to be villains পর্ব ১১
-
Born to be villains পর্ব ৩
-
Born to be villains পর্ব ১৫
-
Born to be villains পর্ব ৬
-
Born to be villains পর্ব ১০+বোনাস
-
Born to be villains পর্ব ৭
-
Born to be villains পর্ব ১
-
Born to be villains গল্পের লিংক
-
Born to be villains পর্ব ৪