নির্লজ্জ_ভালোবাসা
লেখিকাসুমিচোধুরী
পর্ব ৫৬ (❌কপি করা নিষিদ্ধ❌)
⚠️ 🚫এই গল্পের পর্বে সংবেদনশীল ও হালকা রোমান্সের বর্ণনা আছে। অনুরোধ, প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকগণই পড়বেন।🚫
তুরা আর রৌদ্র রিকশা করে ফুটপাতে এসে নামল। আসলে রিকশা করে যাওয়ার আবদারটা তুরাই করেছিল, আর রৌদ্রও তুরার কোনো কথা ফেলতে পারে না। ফুটপাতে পা রাখতেই ঝালমুড়ির সুবাস তুরার নাকে লাগল। সে লোভ সামলাতে না পেরে রৌদ্রের শার্টের হাতা ধরে টানতে টানতে বলল।
“প্লিজ, প্লিজ! আমাকে এক প্যাকেট ঝালমুড়ি খাওয়ান। ঘ্রাণেই জিভে জল চলে আসছে।”
রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে একবার তুরার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর জিজ্ঞেস করল।
“তুই আগে কখনো এভাবে ঝালমুড়ি খেয়েছিস নাকি?”
তুরা জিভে জল আসার মতো করে ঢোক গিলে বলল।
“আরে কত খেয়েছি তার হিসাব নেই! এখন প্লিজ আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি কিনে দেন, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
কথাটা বলেই তুরা রৌদ্রের উত্তরের অপেক্ষা করল না। সে নিজেই চটজলদি ঝালমুড়ি ওয়ালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশ একটা হাঁক ছেড়ে বলল।
“এই যে মামা, জলদি আমাকে স্পেশাল করে এক প্যাকেট ঝালমুড়ি দিন তো!”
ঝালমুড়ি ওয়ালা মুচকি হেসে বলল।
“আচ্ছা মা, দিতাছি। একটু সবুর করো।”
রৌদ্র তুরার এই ছেলেমানুষি কাণ্ড দেখে নিজের হাসি চেপে রাখতে পারল না। সে ধীরপায়ে গিয়ে তুরার ঠিক পেছনে দাঁড়াল। ঝালমুড়ি ওয়ালা দুজনকে একসাথে দেখে আপন মনেই বলে উঠল।
“আপনারা কি স্বামী-স্ত্রী?”
রৌদ্র খুব সাবলীলভাবে আর ছোট করে উত্তর দিল।
“হুম।”
ঝালমুড়ি বানাতে বানাতে মামা আবারও বলে উঠল।
“মাশাল্লাহ! খুব মানিয়েছে কিন্তু আপনাদের দুজনকে।”
রৌদ্র হালকা একটু হেসে তাকে ধন্যবাদ জানাল। তারপর তুরার স্বাস্থ্যের কথা ভেবে নিচু স্বরে বলল।
“মামা, ঝালটা একটু কম দিয়েন কিন্তু।”
রৌদ্রের কথা শুনেই তুরা বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকাল। যেন খুব অপরাধ করে ফেলেছে রৌদ্র। তুরা গাল ফুলিয়ে বলল।
“কেন ঝাল কম দিবে শুনি? আপনি তো কিছুই বুঝেন না! এই যে মামা, আপনি একদম কড়া করে ঝাল দেন তো। ঝালমুড়ি ঝাল না হলে কি জমে নাকি!”
রৌদ্র আবারও সাবধান করে দিয়ে বলল।
“তুরা, পরে ঝাল লাগলে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবি না।”
তুরা এবার রৌদ্রকে উল্টো ধমক দিয়ে বসল। সে বেশ তেজ দেখিয়ে বলল।
“একদম চুপ থাকেন তো আপনি! আমি কি আজ প্রথম ঝালমুড়ি খাচ্ছি নাকি? এই ব্যাপারে আমার আশি বছরের অভিজ্ঞতা আছে।”
তুরার কথা শুনে ঝালমুড়ি মামা তো হাহা করে হেসে দিলেন। রৌদ্র নিজের তর্জনী ঠোঁটের ওপর রেখে হাসি চেপে ধরার চেষ্টা করল। তারপর কৌতুক মেশানো গলায় বলল।
“কী বললি? আশি বছরের অভিজ্ঞতা? তো তোর বর্তমান বয়সটা কত শুনি?”
তুরা এবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে জিভ কাটল। ঝালের চোটে কী বলতে কী বলে ফেলেছে! সে আর কথা না বাড়িয়ে ঝালমুড়ি মামাকে তাড়া দিয়ে বলল।
“মামা, আপনি কারো কথায় কান না দিয়ে নিজের কাজ করেন তো। জলদি দেন!”
এরপর ঝালমুড়ি মামা ঝালমুড়ি বানিয়ে দিতেই তুরা পরম তৃপ্তিতে আর আয়শ করে খেতে শুরু করল। তুরা জোর করেই রৌদ্রের মুখে এক চামচ তুলে দিল, রৌদ্রও তুরার আবদার রাখতে সেটা খেল। দুজনেই ঝালমুড়ি খাওয়া শেষ করে ফুটপাত ধরে অনেকক্ষণ পাশাপাশি হাঁটল। রাতের অন্ধকার নামার সাথে সাথে রৌদ্র তুরাকে নিয়ে একটা সিএনজিতে উঠে পড়ল।
সিএনজি কিছুটা পথ আসার পর হঠাৎ রৌদ্র পেছন থেকে তুরার দুই চোখ হাত দিয়ে চেপে ধরল। তুরা অবাক হয়ে কিছু বলতে চাইলে রৌদ্র বলল।
“একদম চুপচাপ থাক। তোকে একটা দারুণ জিনিস দেখাবো।”
তুরা আর কথা না বলে চুপ করে রইল। তার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে। কিছুক্ষণ পর সিএনজি থামার শব্দ হলো। রৌদ্র বেশ সাবধানে তুরার চোখ ধরে সিএনজি থেকে নামাল। তারপর ধীর পায়ে একটু হেঁটে এসে আস্তে আস্তে চোখ থেকে হাত সরিয়ে দিল। আর তুরা চোখ খুলতেই বিস্ময়ে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কারণ সে এখন এক জমজমাট রাতের মেলায়!
চারিদিকের দৃশ্য দেখে তুরা যেন স্বপ্নের জগতে চলে গেল। চোখ ধাঁধানো রঙিন আলোর রোশনাই ছড়িয়ে আছে মেলার প্রতিটি কোণায়। নানা রঙের ছোট ছোট বাল্ব, হ্যাংগিং ল্যান্টার্ন আর নিয়ন সাইনবোর্ড দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো মেলা প্রাঙ্গণ। বাতাসে ভেসে আসছে হরেক রকম খাবারের মনমাতানো সুবাস ফুচকা, চটপটি, জিলেপি, ঘুগনি আর গরম গরম কাবাবের লোভনীয় গন্ধ। একপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি দোকান। কোনো দোকানে মাটির পুতুল, খেলনা, শোপিস সাজানো, কোনো দোকানে হাতে গড়া গয়না আর বাঁশের তৈরি বাহারি জিনিসপত্র। এক কোণায় জাদুর খেলা দেখাচ্ছে এক জাদুকর, তার চারপাশে ভিড় করে আছে উৎসুক জনতা। পাশেই নাগরদোলা আর চরকিগুলো ঘুরছে সশব্দে, আর তাতে বসে থাকা মানুষগুলোর উচ্ছ্বসিত হাসির শব্দ ভেসে আসছে। শিশুরা বায়না ধরেছে খেলনার জন্য, প্রেমিক যুগলেরা হাতে হাত ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছে আলোর নিচে, আর পরিবারগুলো মিলেমিশে উপভোগ করছে ছুটির রাতের এই উৎসব। পুরো মেলাটা যেন প্রাণবন্ত হাসিতে আর কোলাহলে মুখরিত।
তুরা মুগ্ধ চোখে চারপাশটা দেখছে। রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে তার চোখ দুটো ঝলমল করে উঠল।
তুরা খুশিতে যেন ডানা মেলা পাখির মতো ছটফট করতে লাগল। ঝলমলে আলোর দিকে চেয়ে সে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল।
“আপনি আপনি জানলেন কী করে যে এখানে এত বড় একটা মেলা হচ্ছে?”
রৌদ্র মেলার প্রবেশপথের রঙিন তোরণটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।
“এটা আমার কাছে নতুন কিছু না রে। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে কতবার যে এই মেলায় এসেছি তার হিসেব নেই। এখন তো বড় হয়ে গিয়েছি, বাবার কাছে আগের মতো আবদার করার বয়সটা আর নেই। তাই ভাবলাম, এবার না হয় নিজের বউকে নিয়েই ছোটবেলার স্মৃতিগুলো ঝালিয়ে নিই।”
তুরা আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। রৌদ্রের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ভিড়ের মাঝখান দিয়ে টানতে টানতে মেলার গভীরে ঢুকে পড়ল। হরেক রকম বাদ্যি আর মানুষের কোলাহল ছাপিয়ে একসময় তারা বিশাল এক নাগরদোলার সামনে এসে থামল। তুরা আবদার মেশানো করুণ সুরে বলল।
“চলেন না, একবার নাগরদোলায় চড়ি! লক্ষ্মীটি, না করবেন না কিন্তু।”
রৌদ্র মুচকি হেসে তুরার কপালে আলতো করে টোকা দিয়ে বলল।
“ওকে সুইট হার্ট, তোর যখন এতই শখ, চল!”
টিকিট কেটে তারা ছোট্ট কাঠের কামরাটায় গিয়ে বসল। নাগরদোলাটা যখন ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে ধীরগতিতে চালু হলো, তুরা ভয়ে রৌদ্রের কনুইটা নখ দিয়ে খামচে ধরল। যত সময় যাচ্ছিল, ঘোরার গতি ততই বাড়ছিল। রৌদ্র আগে কখনো এই যন্ত্রে ওঠেনি, তাই ওপর থেকে যখন নিচে নামছিল, তার পেটের ভেতরটা কেমন যেন খালি হয়ে যাচ্ছিল। ভেতরে ভয় কাজ করলেও সে নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু তুরা ততক্ষণে ভয়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। সে চোখ বুজে রৌদ্রকে জাপটে ধরে থরথর করে কাঁপছে।
রৌদ্র নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল মেলা প্রাঙ্গণটা এখন কেবল বিন্দু বিন্দু আলোর মতো দেখাচ্ছে। কামরাটা যখন একদম মগডালে গিয়ে পৌঁছাল, তখন সে তুরাকে নিজের বুকের সাথে আরও নিবিড়ভাবে মিশিয়ে নিল। তুরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল।
“কীরে, খুব ভয় পাচ্ছিস?”
তুরা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, সে কেবল রৌদ্রের বুকে মুখ লুকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। রৌদ্রের ঠোঁটের কোণে তখন খেলে গেল এক দুষ্টুমিভরা হাসি। সে আর এক পলকও সময় নষ্ট করল না। তুরার থুতনি ধরে মুখটা আলতো করে উঁচু করল এবং নিমেষেই নিজের তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ডুবিয়ে দিল তুরার কাঁপতে থাকা ঠোঁটে। মুহূর্তেই যেন সময় থমকে গেল। তুরার ভয়ের কম্পন ছাপিয়ে এক তীব্র বিদ্যুতিক শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে। সে আবেশে চোখ বুজে রৌদ্রের শার্টটা শক্ত করে মুঠো করে ধরল এবং নিজের অজান্তেই তার গভীর সোহাগে সাড়া দিতে শুরু করল।
আকাশের এত উঁচুতে, চারপাশের হিমেল হাওয়া আর নাগরদোলার সেই নিভৃত কামরায় তারা দুজন যেন পৃথিবীর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকার আর উচ্চতার আড়ালে তাদের এই চরম রোমান্টিক মুহূর্তটা অজানাই থেকে গেল পৃথিবীর মানুষের কাছে। কেবল দুজনের তপ্ত নিঃশ্বাস আর হৃদস্পন্দনের শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে এক নতুন গল্পের সূচনা করল।
নাগরদোলা থেকে নামার পর তারা অনেকটা সময় মেলা চষে বেড়াল। রৌদ্র আজ যেন পণ করেছে তুরাকে দুহাত ভরে উপহার দেবে। এক জায়গায় রৌদ্র এক জোড়া রুপালি পায়েল পছন্দ করল। তারপর মেলার সবার সামনেই কোনো দ্বিধা না করে হাঁটু গেড়ে বসে তুরার পা নিজের হাঁটুর ওপর তুলে নিল এবং অতি যত্ন করে পায়েল জোড়া পরিয়ে দিল। তুরা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলেও রৌদ্রের এই পাগলামি তার মন ছুঁয়ে গেল। এরপর রৌদ্র তাকে এক জোড়া ঝুমকো কিনে নিজের হাতে কানে পরিয়ে দিল। লাল ফুল আঁকা নকশা করা চুড়ি দুই হাতে ভরে পরিয়ে দিতেও ভুলল না সে। সব শেষে রৌদ্র যখন বিশাল বড় একটা টেডি বিয়ার তুরার হাতে ধরিয়ে দিল,তুরা তখন খুশিতে আত্মহারা। রৌদ্র যে তাকে এভাবে সারপ্রাইজ দেবে,তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।
রাত যখন বেশি হয়ে যাচ্ছে,রৌদ্র তার বডিগার্ডদের ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বলল। মেলা থেকে বেরিয়ে তারা মেলা প্রাঙ্গণের ঠিক পাশেই বয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে চলে এল। মেলার আলোকসজ্জা নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। ঘাটে আর পাড়ে অনেক মানুষের ভিড় থাকলেও পানির কাছে জায়গাটা বেশ নির্জন।
তুরা তার সোনালী রঙের জর্জেট শাড়িটা একটু ওপরে তুলে ধরে পা টিপে টিপে হাঁটু সমান পানিতে নেমে পড়ল। পানির শীতল স্পর্শে তার সারা শরীরে এক প্রশান্তি বয়ে গেল। রৌদ্রও প্যান্টের নিচের অংশ কিছুটা গুটিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে পানির ভেতরে নামল। রৌদ্র নামা মাত্রই তুরা খিলখিল করে হেসে দুই হাত দিয়ে সজোরে রৌদ্রের গায়ে পানির ছিটা দিল। রৌদ্র অপ্রস্তুতভাবে ভিজে গিয়ে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। তারপর এক চিলতে দুষ্টু হাসি ঠোঁটে নিয়ে বলল।
“দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি!”
কথাটা বলেই রৌদ্র দুই হাত ভরে পানি তুলে তুরার দিকে ছুড়ে মারল। শুরু হলো দুজনের মিষ্টি এক জলকেলি। রাতের আঁধারে নদীর বুকে চাঁদের আলো আর মেলার রঙিন রোশনাইয়ের নিচে তাদের এই আনন্দঘন মুহূর্তটা যেন এক রঙিন জলছবি হয়ে ফুটে উঠল। দুজনের হাসি আর পানির ঝপাঝপ শব্দে নদীর তীরের নির্জনতাটুকুও যেন আনন্দে নেচে উঠল।
নদীতে অনেকটা সময় কাটানোর পর তারা পাড়ে উঠে এল। দুজনেরই অর্ধেক শরীর ভিজে সপসপে হয়ে আছে। রাস্তার ধারে আসতেই দেখল রৌদ্রের গাড়ি আর বডিগার্ডরা অপেক্ষা করছে। ক্লান্ত শরীরে তুরা আর রৌদ্র গিয়ে গাড়ির সিটে বসল। রৌদ্র নিজেই ড্রাইভিং সিটে বসে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। তুরা তার সেই বিশাল টেডি বিয়ারটা কোলে নিয়ে বাচ্চাদের মতো খেলতে লাগল, মেলার আনন্দ যেন এখনো ওর চোখেমুখে লেগে আছে।
গাড়ি ছুটছে রাতের নির্জন রাস্তা দিয়ে। তুরা আধো ঘুমিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর রৌদ্র সাইড মিরর আর লুকিং গ্লাসে একবার তুরার দিকে তাকাল। আর তাকাতেই রৌদ্রের বুকের ভেতরটা কেমন যেন তোলপাড় করে উঠল। তুরা ক্লান্তিতে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে আধো ঘুমে আচ্ছন্ন। অসাবধানতায় ওর সোনালী জর্জেট শাড়ির আঁচলটা কাঁধ থেকে অনেকটা নিচে নেমে গেছে। ভিজে থাকার কারণে পাতলা শাড়িটা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে, যা তুরার রূপকে এক অন্যরকম মায়াবী আর আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
রৌদ্র কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলল। সে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু বারবার চোখ জোড়া অবাধ্য হয়ে আয়নার দিকেই চলে যাচ্ছে। এক অদ্ভুত নেশা ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। রৌদ্র নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল, স্টিয়ারিং হুইলটা জোরে চেপে ধরে নিজের উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু মনের ভেতর যে তুরাকে কাছে পাওয়ার তৃষ্ণা জেগেছে, তা যেন কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছে না। এসির ঠান্ডা বাতাসেও রৌদ্রের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল। শরীর আর মনের এই যুদ্ধের মাঝে সে নিজেকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ড্রাইভ করার দিকে মন বসানো যেন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের জন্য।
রৌদ্রের শরীরের প্রতিটি শিরা যেন উত্তেজনায় কাঁপছে। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, চোখের দৃষ্টিতে এক আদিম তৃষ্ণা। নিজের সাথে লড়াই করতে করতে একসময় রৌদ্র চূড়ান্তভাবে হেরে গেল। সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল এবং অচেনা এক জঙ্গলের রাস্তার নির্জনে গিয়ে সজোরে ব্রেক কষল। টায়ার ঘষার শব্দে তুরার কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল। সে চোখ কচলাতে কচলাতে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“কী হলো? গাড়ি থামালেন কেন?”
রৌদ্রের শ্বাস প্রশ্বাস তখন অস্বাভাবিক রকমের দ্রুত। সে সিটে হেলান দিয়ে হাঁপাচ্ছে। তুরার দিকে তাকিয়ে নেশালো গলায় বলল।
“তুরা, তোকে আমার চাই। প্লিজ, সামলা আমাকে আমি আর পারছি না।”
তুরা বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। রৌদ্রের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে সে কিছুটা ভড়কে গিয়ে বলল।
“কী হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন?”
রৌদ্র এবার সরাসরি তুরার চোখের দিকে তাকিয়ে তীব্র নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে বলল।
“তোকে কাছে পাওয়ার এক মারাত্মক নেশা মাথায় চেপেছে।”
তুরা বিস্ময়ে থমকে গিয়ে বলল।
“কীহহ! আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? এই মাঝরাস্তায় এসব কী বলছেন!”
রৌদ্রের কানে যেন তুরার কোনো কথাই পৌঁছাচ্ছে না। সে উত্তেজিত হয়ে নিজের গায়ের শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করল। তুরা এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেল। তার গলা শুকিয়ে আসছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।
“রৌ রৌদ্র! আপনি শার্ট খুলছেন কেন? এখন কি এই মাঝরাস্তাতেই শুরু করে দিবেন নাকি?”
রৌদ্র যেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। সে গায়ের শার্টটা প্রায় ছিঁড়েই একপাশে ছুড়ে ফেলল। তার সুগঠিত জিম করা বডি দেখে তুরার বুকটা ধড়াস করে উঠল। রৌদ্র নেশালো আর উত্তেজিত কণ্ঠে বলল।
“আই কান্ট কন্ট্রোল মাই সেলফ জানবাচ্চা! তোর এই ভিজা রূপ দেখে আমার ভেতরে আগুন জ্বলছে। এখন বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া তো দূরের কথা, এক সেকেন্ড ধৈর্য ধরার ক্ষমতাও আমার নেই। উফফ কাছে আয় জানবাচ্চা! আজ তুই আর আমি মিলে গাড়িটাকে এমনভাবে কাঁপাবো যে গাড়িও আমাদের উন্মাদনা দেখে বলবে আরে ভাই থাম, তোদের লোড আমি আর নিতে পারছি না।”
কথাটা শেষ করেই রৌদ্র এক ঝটকায় গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। তুরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে ডোর খুলে তুরাকে কোলে তুলে নিল। পরক্ষণেই তাকে পেছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে নিজের ভারী শরীর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তুরার ওপর।
রাতের সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে, জনমানবহীন জঙ্গলের রাস্তায় রৌদ্র আর তুরার ভালোবাসার উত্তাপ বাড়তে লাগল। সময়ের গতিতে তাদের সেই বুনো উন্মাদনায় গাড়িটাও এক সময় মারাত্মকভাবে দুলতে শুরু করল। বনের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে কেবল দুজনের গভীর তৃপ্তির নিঃশ্বাস আর ভালোবাসার শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
যাই হোক, তাদের এই একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো এখন কেবল তাদেরই থাক। আমরা আর ভেতরে না যাই, ওরা ওদের মতো করে রোমান্সে ডুবে থাকুক।
অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল। গাড়ির ভেতরের সেই উন্মাদনা এখন শান্ত, কিন্তু বাতাসের গুমোট ভাবটা যেন এখনো রয়ে গেছে। তুরা রৌদ্রের চওড়া বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে নিঃশব্দে ফুপিয়ে কেঁদেই চলছে। তুরার কান্নার শব্দে রৌদ্রের ঘোর কাটল। সে বুঝতে পারল, আজ আবেগের বশে সে অনেকটা বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। তুরার এই অসহায় কান্না রৌদ্রের বুকের ভেতরটা মুচড়ে দিল।
রৌদ্র আলতো করে তুরার ঘামে ভেজা চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিল। তারপর ওর কপালে গভীর এক চুমু খেয়ে অপরাধীর সুরে ফিসফিস করে বলল।
“জান, আই অ্যাম রিয়েলি সরি। আমি সত্যি একদম পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না আমার। প্লিজ, আমার লক্ষ্মী সোনা বউটা, আর কাঁদিস না।”
তুরা কাঁদতে কাঁদতে ধরা গলায় বলল।
“কথা বলবেন না একদম! আপনার সাথে আমি আড়ি দিলাম। কোনোদিনও আপনার সাথে আর কথা বলবো না আমি। আপনি খুব খারাপ, আজকে আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন। আমি জীবনেও এত কষ্ট আর কোনোদিন পাইনি। আমাকে মেলায় ঘুরতে নিয়ে এসে আপনি শেষমেশ এইটা করলেন? আপনার মনের মধ্যে এই মতলব ছিল!”
তুরার এমন অবুঝ আর অভিমানী অভিযোগ শুনে রৌদ্রের ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ফুটে উঠল। সে বুঝল তুরার রাগটা আসলে অভিমান মেশানো। সে পরম মমতায় তুরার মুখটা একটু উঁচু করে ধরল এবং নিজের আঙুল দিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে বলল।
“আচ্ছা বাবা, সরি! আর কোনোদিন এমন হবে না। আমার সোনা পাখিটা, আমি বলছি তো আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না। নেশার ঘোরে কী করেছি আমি নিজেও জানি না। খুব বেশি খারাপ লাগছে পাখি?।”
তুরা ছোট বাচ্চার মতো নাক টানতে টানতে অস্ফুট স্বরে বলল।
“হুম।”
রৌদ্র এবার অপরাধীর মতো নরম সুরে বলল।
“আমার কলিজাটা, এবার আমাকে মাফ করে দে। বাসায় গিয়ে একটা ব্যথার ট্যাবলেট খেয়ে নিবি, তাহলেই আরাম পাবি। চল এখন বাসায় যায়।”
তুরা কোনোমতে নিজের অবিন্যস্ত শাড়িটা শরীরে পেঁচিয়ে নিল। রৌদ্র দেরি না করে ওকে আবারও পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে সামনের সিটে বসিয়ে দিল। এরপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ আগের ঝড়ো মুহূর্তগুলোর রেশ এখনো তার চোখেমুখে, তবে এখন সে বেশ ফুরফুরে মেজাজে গাড়ি চালাতে শুরু করল। রাতের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়িটা দ্রুত গতিতে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ-ওপাশ ছটফট করছে আয়ান। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়ে চলছে, কিন্তু কিছুতেই তার দুচোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না। সেই যে তিথি বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, তারপর থেকে আয়ানের ঘরটা যেন বড্ড ফাঁকা আর নিঃশব্দ হয়ে আছে। এতদিনে তিথিকে পাশে নিয়ে, তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর এমন এক অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে, আজ তাকে ছাড়া বিছানাটা মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে।
আয়ান প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে নিজের ওপরই রাগ ঝাড়তে লাগল। বিছানায় একটা জোরে ঘুষি মেরে বিড়বিড় করে বলল।
“অকারণে রাগটা কেন দেখাইতে গেলাম? এখন তো মনে হচ্ছে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি। ওইটুকু রাগের জন্য শেষে এখন সারারাত জেগে থাকতে হচ্ছে!”
সে বালিশ ছেড়ে উঠে বসল। দুহাতে নিজের মাথার চুলগুলো টেনে ধরে বিড়বিড় করতে লাগল। তার চেহারায় ফুটে উঠছে রাজ্যের বিরক্তি আর ছটফটানি। তিথির ওপর রাগের চেয়েও এখন যেন তার অভাবটাই বেশি টের পাচ্ছে সে। দাঁতে দাঁত চেপে আয়ান বলল।
“তিথির বাচ্চা, তোরে যদি একবার সামনে পাই! আমি যে কী করমু বুঝতে পারছি না। জীবনটা এক্কেবারে তেজপাতা বানাই দিতাছস তুই।”
আয়ান এক গ্লাস জল খাওয়ার জন্য খাট থেকে নামল। তার মনে হচ্ছে, তিথিকে আজই ফিরিয়ে না আনলে তার এই নির্ঘুম রাত আর কাটবে না।
আয়ান পানি খেয়েও শান্ত হতে পারল না। বুকের ভেতরটা যেন খাঁ খাঁ করছে। ঘরজুড়ে অস্থির হয়ে পায়চারি করতে করতে একসময় তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।লাজ-শরমের মাথা খেয়ে সে সোজা আনোয়ার খানের রুমের সামনে গিয়ে হাজির হলো। কারণ সে ভালো করেই জানে, আনোয়ার খান ছাড়া আর কেউ জানে না যে তিথি কোথায় লুকিয়ে আছে।
আয়ান প্রথমে কিছুক্ষণ দরজার সামনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে ভেতরে খুব ইতস্তত করছিল, কিন্তু তিথিকে ছাড়া এক মুহূর্তও তার আর সহ্য হচ্ছে না। শেষমেশ সব মান-সম্মান বিসর্জন দিয়ে সে দরজায় মাথা ঠেকিয়ে একদম ছোট বাচ্চাদের মতো করুন সুরে বিলাপ শুরু করল।
“চাচা ও চাচা গোওও! আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছো? নাকি বউ চিবিয়ে খাচ্ছো? ও চাচাআআ একটু দয়া করো, বলো না আমার বউটা কইইই!”
ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আয়ান এবার রীতিমতো কসম কাটতে শুরু করল। তার কণ্ঠ তখন কান্নায় ভেঙে পড়ার মতো শোনাল। সে আবার বলতে লাগল।
“চাচা, আমার কিডনির কসম! আমি আর কোনোদিন আমার বউয়ের ওপর রাগ দেখাবো না। পিলিজ চাচাআ, বলে দাও না আমার জানটা কই? ওই চাচাআআ রে বউ ছাড়া আমার বিছানা এক্কেবারে ঠান্ডা হয়ে আছে, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! চাচারেএএ তোমার সেই হারানো যৌবনের কসম, দোহাই লাগে বলে দাউউ না আমার বউটা কই গেছে।”
আনোয়ার খান মাত্রই চোখ বুজেছিলেন। হঠাৎ আয়ানের চিৎকারে তিনি পাশ থেকে চশমা নিয়ে পরে ভালো করে চোখ ক্লিয়ার করে বিরক্তি নিয়ে বললেন।
“কী হয়েছে আয়ান? এমন বাচ্চাদের মতো দরজায় এসে প্যাঁ পু করছিস কেন?”
আয়ান দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল।
“চাচা, তুমি এখনো প্যাঁ পু দেখছো? এখানে তো তোমার ভাতিজা বিরহে শেষ হয়ে যাচ্ছে! ওই রাক্ষসীটা তো আড়ি দিয়ে চলে গেছে। এখন বিছানায় শুইলে মনে হয় আমি উত্তর মেরুতে আছি, সব বরফ হয়ে আছে চাচা! তুমি তো নিজের বউ নিয়ে কম্বলের নিচে আরামে আছো, কিন্তু আমার কলিজার টুকরা তিথি ছাড়া আমি যে মরে যাচ্ছি। চাচা গো, আল্লাহর দোহাই লাগে, ওর লোকেশনটা দাও।”
আনোয়ার খান কপালে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বসে রইলেন। আয়ান থামার পাত্র নয়, সে আবার শুরু করল।
“চাচা, তুমি কি চাও তোমার একমাত্র ভাতিজাটা বউ ছাড়া পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াক? ও চাচা, কথা বলো! একটু দয়া করো এই এতিমটার ওপর। বউ ছাড়া আমার জীবনটা এখন লবণ ছাড়া তরকারির মতো পানসে হয়ে গেছে চাচাআআ! তোমার হাতে ধরি, পায়ে ধরি বলো না তিথি কোথায়?।”
আনোয়ার খান কোনো রকম হাসি থামিয়ে বললেন।
“আয়ান, আমি তো জানি না। বিশ্বাস কর, তিথি শুধু বলল একটা জায়গায় যামু, কিন্তু কোথায় যাবে সেইটা বলেনি।”
আয়ান এবার দরজার হাতল ধরে রীতিমতো ঝাঁকাতে শুরু করল। তার বিলাপের সুর আরও এক পর্দা ওপরে চড়ে গেল।
“মিথ্যা বলো না চাচা! তোমার ওই চশমা পরা চোখের দিকে তাকালেই আমি বুঝতে পারছি তুমি সব জানো। ও চাচা, তুমি কি চাও কাল সকালে মানুষ দেখুক তোমার ভাতিজা বউয়ের শোকে বারান্দায় ঝুলে আছে? আমি জানি তিথি তোমার কানে কানে সব বলে গেছে। পিলিজ চাচা, আমাকে বাঁচাও! বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। তুমি একবার মুখ ফুটে ঠিকানাটা বলো, কসম আমি তোমাকে ব্র্যান্ড নিউ একটা স্মার্টওয়াচ গিফট করবো। চাচারেএএএ, বউ ছাড়া এই রাত আমার কাছে একশ বছরের সমান মনে হচ্ছে গোওওও।”
আনোয়ার খান দুই কানে বালিশ চেপে ধরে বিরক্তি আর ধমকের স্বরে বললেন।
“কানের কাছে এমন প্যাক প্যাক না করে চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমা। ও তো আর শখ করে বাড়ি ছেড়ে যায়নি। তোর মেজাজ আর অহেতুক রাগের ভয়েই মেয়েটা পালিয়েছে। এখন ভুল যেহেতু করেছিস, এর শাস্তি তোকে ভোগ করতেই হবে।”
আয়ান আরও কিছুক্ষণ দরজায় মাথা কুটে অনুনয়-বিনয় করল। নানাভাবে প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করল কিন্তু আনোয়ার খান এবার একেবারে পাথরের মতো চুপ হয়ে রইলেন। ওপাশ থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আয়ান বুঝতে পারল এখান থেকে আর কিছু বের করা সম্ভব নয়। শেষমেশ কোনো উপায় না দেখে সে হাল ছেড়ে দিল। পরাজিত সৈনিকের মতো ধীর পায়ে নিজের অন্ধকার রুমের দিকে পা বাড়াল। যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলতে লাগল।
“শেষ পর্যন্ত চাচাও আমার মনের কষ্টটা বুঝল না। সবাই মিলে আমাকে একা করে দিল।”
আয়ান রুমে ঢুকে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। মনের ভেতরে রাজ্যের হতাশা আর অস্থিরতা নিয়ে সে যখন সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল, ঠিক তখনই হঠাৎ তার ফোনের নোটিফিকেশন টোন বেজে উঠল। এই অসময়ে কার মেসেজ এলো তা দেখার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু তবুও ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ অপশনে ঢুকতেই আয়ানের চোখ চড়কগাছ।
আয়ানকে জব্দ করার জন্য তার মাথায় ঝুঁটি করে, মুখে মেকআপ, ঠোঁটে লিপস্টিক আর কপালে বিশাল এক নজর ফোঁটা দিয়ে যে বিচ্ছিরি সাজটা করিয়েছিল, সেই ছবিগুলোই হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে তিথি। ছবিগুলোতে আয়ানকে এতটাই হাস্যকর দেখাচ্ছে যে সে নিজেই নিজের দিকে তাকাতে পারছে না। ছবির নিচে তিথি ছোট করে একটা মেসেজও জুড়ে দিয়েছে।
“হু হু হু ডিংকা চিকা ডিংকা চিকা। আমি আজকে এই দুইটা ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ছেড়ে দেব।”
আয়ান ছবিগুলো দেখে বা তিথির মেসেজে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সরাসরি টাইপ করতে শুরু করল। তার এখন মূল লক্ষ্য তিথিকে খুঁজে বের করা। সে দ্রুত মেসেজ করল।
“তিথি তুই এখন কোথায়?”
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ওপাশ থেকে রিপ্লাই এল। তিথি লিখেছে।
“সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। পারলে সাঁতার কেটে চলে আসো।”
আয়ান নিজের বিরক্তি চেপে লিখে পাঠালো।
“তিথি একদম মজা করিস না। সত্যি করে বল তুই ঠিক কোথায় আছিস?”
তিথি একটা ভেঙচি কাটার ইমোজি দিয়ে উত্তর দিল।
“ইইইইই জানি না।”
আয়ান এবার রাগের ইমোজি দিয়ে হুমকি দেওয়ার সুরে বলল।
“ভালো মেয়ের মতো বলে দে তুই কোথায়। নাহলে আমি যদি একবার তোকে খুঁজে বের করতে পারি, তবে কিন্তু তোর অবস্থা খুব খারাপ হবে।”
তিথি মোটেও দমে গেল না। সে আবারও সেই বিচ্ছিরি ভেঙচি কাটার ইমোজি দিয়ে লিখল।
“কচু করবা তুমি আমার। আমাকে তো আগে খুঁজে পাইতে হবে। আমি ঠিক করেছি এখন এখানেই বিয়ে করে সংসার শুরু করবো। তারপর আমার যখন বাচ্চা হবে, তখন সেই বাচ্চাকে দিয়ে তোমাকে মামা ডাকিয়ে তবেই আমি ওই বাড়িতে ফিরবো। এর আগে না।”
তিথির মেসেজ পড়ে আয়ানের চোখ কপালে উঠে গেল। তিথি ওকে মামা বানাবে এমন কথা শুনে আয়ান রাগে কাঁপতে কাঁপতে মেসেজ করল।
“কীহহ তুই আমাকে মামা বানাবি? আমি তোর হাসবেন্ড আর তুই আমাকে বাবা না বানিয়ে মামা বানাতে চাইছিস? সিরিয়াসলি তিথি?”
আয়ানের এই হাহাকার ভরা মেসেজে তিথি খুব মজা পেল। সে মেসেজটিতে হা হা রিয়েক্ট দিয়ে একদম ঘাড় ত্যাড়া ভাবে ছোট করে একটা উত্তর দিল।
“অফকোর্স।”
তিথির এই উত্তর দেখে আয়ান প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে নিজের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বিড়বিড় করে বলল।
“জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।”
আয়ান আর মেসেজে তর্কে না গিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ল্যাপটপটা খুলে বসল। সে খুব ভালো করেই জানত তিথিকে বাগে আনতে হলে এখন প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে। সে দ্রুত তিথির ফোন নাম্বারটা ব্যবহার করে লোকেশন ট্র্যাক করতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্ক্রিনে তিথির বর্তমান অবস্থান ভেসে উঠল।
লোকেশন পাওয়া মাত্রই আয়ান আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। সে ল্যাপটপ বন্ধ করে ত্বরিত গতিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। গ্যারেজ থেকে নিজের গাড়িটা বের করে সে স্টার্ট দিল। তার এখন একটাই লক্ষ্য, যত দ্রুত সম্ভব তিথির কাছে পৌঁছানো। রাতের জনশূন্য রাস্তা দিয়ে আয়ান ফুল স্পিডে গাড়ি চালাতে শুরু করল। তার চোখের দৃষ্টিতে তখন শিকারি বাঘের মতো জেদ। তিথি যে তাকে এত বড় কথা বলেছে, তার উপযুক্ত জবাব দিতে সে এখন বদ্ধপরিকর।
অনেকক্ষণ পর আয়ানের গাড়ি একটা ফ্ল্যাটের সামনে এসে থামল। পুরো ফ্ল্যাটটা এখন অন্ধকারে ডুবে আছে, হয়তো সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আয়ান ফোন বের করে লোকেশন চেক করতে করতে ঠিক একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ফোনের স্ক্রিনে সবুজ রঙের টিক চিহ্ন ভেসে উঠল, যার মানে তিথি ঠিক এই রুমের ভেতরেই আছে। আয়ান আর দেরি না করে কলিং বেলে চাপ দিল।
এদিকে এই মাঝরাতে কলিং বেলের শব্দ শুনে তিথির বান্ধবীর মা বেশ বিরক্ত হলেন। তিনি ঘুমের ঘোরে হেলতে দুলতে এসে দরজা খুলে দিলেন। আয়ানকে সামনে দেখে তিনি কিছুটা অবাক হলেন, আর আয়ান বিনয়ের সাথে সালাম দিয়ে বলল।
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
তিথির বান্ধবীর মা আগে কয়েকবার খান বাড়িতে গিয়েছিলেন, তাই আয়ানকে তাঁর চিনতে মোটেও কষ্ট হলো না। তিনি সালামের উত্তর নিয়ে বললেন।
“আয়ান! তুমি এত রাতে এখানে?”
“জি আন্টি, আসলে তিথিকে নিতে এসেছি।”
আন্টি অবাক হয়ে বললেন।
“ও আচ্ছা। তা এত রাতে না এসে কাল সকালে এলেও তো পারতে বাবা।”
আয়ান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য চটজলদি উত্তর দিল।
“আসলে আন্টি, কাল অফিসে আমার কাজের খুব চাপ থাকবে। তাই ভাবলাম আজ রাতেই ওকে নিয়ে যাই। তিথি কোন রুমে শুয়েছে আন্টি?”
তিথির বান্ধবীর মা হাত বাড়িয়ে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বললেন।
“ওই যে ওই পাশের রুমটায় আমার মেয়ের সাথেই ও ঘুমিয়েছে।”
“আচ্ছা আন্টি, অনেক ধন্যবাদ।”
আয়ান আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত সেই রুমের সামনে গেল। দেখল রুমের দরজাটা একটু ফাঁকা হয়ে আছে। সে ভেতরে ঢুকে যা দেখল তাতে তার মেজাজ আর হাসি একসাথে পেল। তিথি তার বান্ধবীর শরীরের ওপর হাত-পা তুলে দিয়ে একদম আয়েশ করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আক্ষরিক অর্থেই সে তার বান্ধবীর বারোটা বাজিয়ে ঘুমে বিভোর।
আয়ান কোনো শব্দ না করে পা টিপে টিপে বিছানার কাছে গেল। তারপর সাবধানে তিথিকে পাজাকোলা করে কোলে তুলে নিল। তিথি ঘুমের ঘোরে এতটাই অচেতন যে সে টেরই পেল না তাকে কে তুলে নিচ্ছে। আয়ান বাইরে এসে তিথির বান্ধবীর মাকে বিদায় জানিয়ে তিথিকে নিয়ে সোজা গাড়িতে চলে এল। সামনের সিটে ওকে সাবধানে বসিয়ে দিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসল। এরপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঝড়ের গতিতে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
আয়ানের মুখে এখন এক পৈশাচিক জয়ের হাসি। সে ভাবছে, তিথির যখন ঘুম ভাঙবে আর সে নিজেকে আয়ানের কবজায় দেখবে, তখন ওর সেই ‘মামা’ ডাকার শখ কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটাই হবে দেখার বিষয়।
শরীরের ওপর হিমেল বাতাস আর গাড়ির হালকা দুলুনিতে তিথির গভীর ঘুমটা ধীরে ধীরে ভেঙে গেল। নিজেকে গাড়ির সিটে আবিষ্কার করে সে প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কোনো স্বপ্ন দেখছে। তাই আবার চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই যখন দোলা থামছিল না, তখন সে বুঝতে পারল এটা কোনো স্বপ্ন নয়। তিথি এবার সজোরে চোখ খুলে পাশে তাকাতেই দেখল আয়ান অত্যন্ত গম্ভীর মুখে গাড়ি চালাচ্ছে। নিজের সামনে আয়ানকে দেখে তিথি বিকট এক চিৎকার দিয়ে উঠল।
“আআআআআআআআআ ভুত!”
আয়ান সামনের দিকে তাকিয়েই ধমকের সুরে বলল।
“চুপ কর! এটা কোনো স্বপ্ন না, একদম বাস্তব। চ্যাঁচাবি না একদম।”
তিথি বিশ্বাস করতে না পেরে নিজের হাতে জোরে একটা চিমটি কাটল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে সে নিশ্চিত হলো যে সে সত্যি আয়ানের গাড়িতে আছে। কিন্তু কীভাবে কী হলো সে কিছুই মাথায় ঢোকাতে পারছে না। সে তো বান্ধবীর বাসায় ঘুমাচ্ছিল, তাহলে মাঝরাস্তায় আয়ানের পাশে সে এল কীভাবে?
তিথির এই সাতপাঁচ ভাবনার মাঝেই আয়ানের গাড়ি সজোরে ব্রেক কষে খান বাড়ির সামনে এসে থামল। আয়ান ঝড়ের গতিতে গাড়ি থেকে নেমে ওপাশের দরজা খুলে তিথিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। কোনো বাধা দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে তাকে নিয়ে সোজা বাড়ির ভেতর নিজের রুমে ঢুকে পড়ল এবং ভেতর থেকে দরজা লক করে দিল। তারপর এক ঝটকায় তিথিকে বিছানায় ছুড়ে মারল।
বিছানায় আছড়ে পড়ে তিথির সব তালগোল পাকিয়ে গেল। সে হতভম্ব হয়ে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল।
“আ-আ-আয়ান! তুমি কি মানুষ নাকি কোনো জ্যান্ত পাগল? তোমাকে তো পাবনা দিয়ে আসা উচিত।”
আয়ান আর দেরি করল না। সে দ্রুত বিছানায় উঠে তিথির ওপর ঝুঁকে পড়ল। তার চোখ জোড়া রাগে আর নেশায় জ্বলছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ধরা গলায় বলল।
“আমার এই কাজগুলো যদি তোর কাছে পাগল মনে হয়, তবে আমি পাগলই সই। আর তখন মেসেজে কী বললি? তুই আমাকে ‘মামা’ বানাবি, তাই না?”
তিথি এবার প্রমাদ গুনল। সে ভয়ে কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলে মিনমিন করে বলল।
“আ-আ- আসলে আমি তো ওটা মজা করে বলেছিলাম। তুমি এত সিরিয়াসলি নিয়ে নিলা কেন?”
আয়ান এবার নিজের শরীরের সবটুকু ভর তিথির ওপর ছেড়ে দিয়ে একদম ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে এল। তার তপ্ত নিঃশ্বাস তিথির কপালে আছড়ে পড়ছে। সে বাঁকা হেসে বলল।
“তুই মজাই করিস আর যাই করিস, কীভাবে মামা থেকে বাবা হতে হয় তা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে।”
কথাটা শেষ করতে না করতেই আয়ান তিথিকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না। এক মুহূর্তেই উন্মাদনায় মেতে সে তিথির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো আয়ানের সেই পরিচিত বুনো পাগলামি আদর আর সোহাগের জোয়ার, যা মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া তিথির আর কোনো উপায় রইল না।
রানিং…!
Share On:
TAGS: নির্লজ্জ ভালোবাসা, সুমি চৌধুরী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১২
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩৮
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৩
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫২
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৩
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৪
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১১
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২১
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩৭
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪১