নির্লজ্জ_ভালোবাসা
লেখিকাসুমিচোধুরী
পর্ব ৫৪ (❌কপি করা নিষিদ্ধ❌)
বেশ কিছুদিন কেটে গেল। সময় কারও জন্য থমকে থাকে না, সে তার আপন গতিতে বয়ে চলে। তুরা আর রৌদ্রের দিনগুলো এখন কাটছে অফুরন্ত রোমান্স আর হাসি-খুশিতে। অন্যদিকে আয়ান আর তিথির খুনসুটি আগের মতোই আছে, তবে তিথির পরীক্ষা থাকায় আয়ান এখন আর আগের মতো তাকে জ্বালাতন করে না। আনোয়ার খান, আশিক খান আর আরিফুল খান এখন বাসাতেই বেশি সময় কাটান। ফ্যামিলি বিজনেসের পুরো দায়িত্ব এখন রৌদ্র আর আয়ানের কাঁধে। রৌদ্র শুধু দেশি ব্যবসাই নয়, বরং সুইজারল্যান্ডের বিজনেসটাও ল্যাপটপের মাধ্যমে মিটিং আর ডিল ফাইনাল করে দারুণভাবে সামলাচ্ছে। এদিকে আরশি এখন শিহাবদের বাসাতেই থাকছে। আরশিও কিন্তু কম যাচ্ছে না, বেশ কিছুদিন ধরে সে শিহাবকে ভীষণ জ্বালাতন করছে। শিহাব ভেতরে ভেতরে ভীষণ বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলতে পারছে না। কারণ মিনহা চৌধুরী কড়া শাসনে জানিয়ে দিয়েছেন, আরশিকে যদি কেউ কিছু বলে তবে তিনি মেরে তার চামড়া তুলে ফেলবেন। মায়ের এমন মারমুখী আদেশের সামনে শিহাব এখন পুরোপুরি নিরুপায়।
সময়টা দুপুর। আরশি ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে মিনহা চৌধুরীর মাথায় যত্ন করে বিনুনি গেঁথে দিচ্ছে আর দুজনে মিলে গল্পে মেতেছে। হঠাৎ আরশির মনে একটা প্রশ্ন জাগল। সে কৌতূহলী হয়ে মিনহা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করল।
“আচ্ছা মা, শিহাব খেতে সবথেকে বেশি কী পছন্দ করে?”
মিনহা চৌধুরী ছেলের পছন্দের কথা শুনে মুচকি হাসলেন। তিনি পরম মমতায় বললেন।
“শিহাব সবথেকে বেশি পছন্দ করে পায়েস। ও ছোটবেলা থেকেই পায়েস দারুণ পছন্দ করে।”
আরশি মনে মনে কিছু একটা পরিকল্পনা করে বলল।
“আচ্ছা মা, আমি যদি নিজের হাতে পায়েস বানাই তাহলে কি উনি খাবেন?”
মিনহা চৌধুরী মেয়ের মতো আবদার শুনে হোহো করে হেসে উঠলেন। তিনি আরশির চিবুক ছুঁয়ে আদর করে বললেন।
“দেখো মেয়ের কাণ্ড! খাবে না কেন? তুমি যদি এত কষ্ট করে বানাও তবে ও অবশ্যই খাবে। বরং ও খুশিই হবে।”
আরশি মনে মনে ঠিক করে নিল যে আজ সে পায়েস রান্না করেই ছাড়বে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে ফোন থেকে পায়েস রান্নার রেসিপি বের করে মন দিয়ে দেখে নিল। তারপর প্রয়োজনীয় সব উপকরণ একে একে চুলার সামনে এনে গুছিয়ে রাখল। কাজ শুরু করার মুহূর্তে তার কাজু বাদামের কথা মনে পড়ল। কিন্তু রান্নাঘরের আশেপাশে কোথাও বাদামের কৌটা খুঁজে পেল না।হঠাৎ আরশির নজর গেল থাইয়ের ওপরের তাকে রাখা একটি বয়ামের দিকে।সেখানে বাদাম রাখা থাকলেও সেটা আরশির নাগালের বেশ বাইরে। সে হাত বাড়িয়ে নাগাল পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করল কিন্তু বারবার ব্যর্থ হলো। আরশি পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে বারবার চেষ্টা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠল। বিরক্ত হয়ে সে নিজেই বিড়বিড় করে বলল।
“ইয়া আল্লাহ এত উঁচুতে কেউ জিনিস রাখে? হাত বাড়াতে বাড়াতে তো আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে।”
ঠিক তখন পিছন থেকে কেউ বাদামের বয়ামটি হাত বাড়িয়ে অনায়াসে নামিয়ে নিল। আরশির একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বয়ামটি রাখতে রাখতে সেই পরিচিত গম্ভীর স্বরে বলে উঠল।
“ছোটবেলায় তোমার মা হয়তো তোমাকে ঠিকমতো হরলিক্স খাওয়ায়নি। তার জন্যই বোধহয় এত খাটো হয়ে রয়ে গেছো।”
হঠাৎ কারও কণ্ঠস্বর শুনে আরশি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে দেখল পেছনে শিহাব দাঁড়িয়ে আছে। শিহাবের মুখে এমন বাঁকা কথা শুনে আরশি ভ্রু কুঁচকে রেগে গিয়ে বলল।
“কী! আমি খাটো? তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আমি খাটো?”
শিহাব ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল। আরশির রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল।
“হ্যাঁ তা নয়তো কী। সামান্য এইটুকু উঁচুতে হাত পৌঁছায় না বলে বলছো ইয়া আল্লাহ জান বের হয়ে যাচ্ছে। এটাকে খাটো ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়?”
কথাটা বলেই শিহাব বয়ামটি আরশির হাতে দিয়ে পুনরায় একটু কৌতূহলী গলায় বলল।
“বাই দ্য ওয়ে, তুমি এই ভরদুপুরে রান্নাঘরে কী করছো?”
শিহাবের হঠাৎ এমন প্রশ্নে আরশি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তার গলার স্বর কিছুটা নিচু হয়ে এলো, লজ্জামাখা গলায় ছোট করে বলল।
“পায়েস রান্না করবো।”
আরশির কথা শুনে শিহাব থামল। সে খানিকটা বাঁকা দৃষ্টিতে আরশিকে ওপর নিচ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে বেশ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল।
“গুড, বানাও। তবে দেইখো আবার ওই ‘আই লাভ ইউ’ মুভির মতো ভুল করে চিনির জায়গায় লবণ দিয়ে দিও না।”
কথাটা শোনামাত্রই আরশির কানঝাঁঝা করে উঠল। অপমানে তার গলার রগগুলো যেন ফুলে উঠল। সে প্রচণ্ড রাগে তড়পিয়ে উঠে চড়া গলায় পাল্টা কিছু একটা বলতে যাবে, কিন্তু তার আগেই শিহাব ঠোঁটের কোণে একটা রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে বড় বড় পা ফেলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আরশি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হাতের বয়ামটা শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল।
“আজ রান্না ঠিকমতো পারি না বলে আপনার মুখ থেকে এসব কথা শুনতে হলো? অপমান! জাস্ট জ্যান্ত অপমান!”
রৌদ্রের আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল। মিটিং শেষ করে ক্লায়েন্টদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে সে রিসোর্ট থেকে বের হয়ে পড়ল। পকেট থেকে ফোন বের করে তুরার নাম্বারে কল দিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে ফোনটা কানে ধরল।
তুরা তখন ব্যালকনিতে বসে খুব মন দিয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিল। হঠাৎ পাশে থাকা ফোনটা বেজে উঠতেই সে চমকে তাকাল। স্ক্রিনে রৌদ্রের নাম দেখে তুরা দ্রুত কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রৌদ্র বেশ চনমনে গলায় বলল।
“বেবি, একটা পার্সেল যাবে। ওটা রিসিভ করে দেখে চটজলদি তৈরি হয়ে নে আমি আসছি।”
তুরা অবাক হয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে বলল।
“কোথায় যাব?”
“সারপ্রাইজ! এখন আর কথা না বলে জলদি রেডি হয়ে থাক, আমি আসছি।”
কথাটা বলেই রৌদ্র ফোনের লাইন কেটে দিল। তুরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বইয়ের পাতায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পার্সেলটা এসে পৌঁছাল। তনুজা খান নিজেই পার্সেলটা নিয়ে তুরার ঘরে এসে দিয়ে গেলেন। তুরা কৌতূহল নিয়ে প্যাকেটটা খুলতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ভেতরে একটা গাঢ় সোনালী রঙের জর্জেট শাড়ি, সাথে চমৎকার ম্যাচিং জুয়েলারি আর রেশমি চুড়ি। তুরা অবাক হলেও আর সময় নষ্ট করল না। রৌদ্রের কথা মতো সবকিছু পরে তৈরি হয়ে নিল। তনুজা খান গত কয়েকদিনে তুরাকে সুন্দর করে শাড়ি পরা শিখিয়ে দিয়েছেন, তাই আজ একা পরতে তেমন সমস্যা হলো না। সাজগোজ শেষ করে তুরা অধীর আগ্রহে ব্যালকনিতে পায়চারি করতে লাগল।
এদিকে রৌদ্র একমনে গাড়ি ড্রাইভ করছে। দুপুরের তপ্ত রোদ, তাই রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কিছুটা কম, বেশ নিরিবিলি পরিবেশ। রৌদ্র যখন আপন মনে গাড়ি চালাচ্ছিল, হঠাৎ তার চোখ গেল রাস্তার ধারে। দেখল কয়েকটা বখাটে ছেলে একটা মেয়েকে ঘিরে ধরে বিরক্ত করছে। মেয়েটা নিজেকে রক্ষা করার জন্য বারবার চেষ্টা করছে, কিন্তু ছেলেগুলো যেন আরও বেশি আসকারা পেয়ে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রৌদ্র এই দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারল না, বিকট শব্দে ব্রেক কষে গাড়িটা থামাল। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“সমস্যা কী? মেয়েটাকে ডিস্টার্ব করছো কেন?”
মেয়েটা রৌদ্রের বলিষ্ঠ কণ্ঠ শুনে আশার আলো দেখল। সে দৌড়ে গিয়ে রৌদ্রের পিঠের পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বলল।
“প্লিজ হেল্প মি! এই ছেলেগুলো আমাকে খুব নোংরা কথা বলছে। বাজেভাবে ছুঁতে চাইছে।”
ছেলেদের মধ্যে একজন রৌদ্রের দিকে তেড়ে এসে অবজ্ঞা ভরে বলল।
“আমরা কী করছি না করছি তার কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে?”
রৌদ্রের চোখদুটো রাগে লাল হয়ে উঠল। সে তর্জনী উঁচিয়ে সামনের দিকে এক পা এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলল।
“অফ কোর্স ইউ হ্যাভ টু। রাস্তার পাশে বোনদের সাথে অসভ্যতামি করবি আর বড় বড় কথা বলবি? এখনই মাফ চা। বল বোন আমার ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দাও। হারি আপ!”
ছেলেটা রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে রৌদ্রের দামী কোটের কলার শক্ত করে চেপে ধরল। সে দাঁত কিড়মিড় করে কদর্য ভাষায় গালি দিয়ে বলল।
“মা*দারচুদ! তোর সাহস তো কম না! তুই আমাদের মতো চিজদের বলিস মাফ চাইতে?”
কলার চেপে ধরায় রৌদ্রের শার্টের ওপরের বোতামটা একটু কুঁচকে গেল। কিন্তু রৌদ্রের চোখেমুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই, বরং সেখানে এক ভয়ানক শীতলতা ফুটে উঠল। সে একদম স্বাভাবিক কিন্তু হাড়হিম করা শান্ত কণ্ঠে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।
“হাত সরা। তোর এই নোংরা হাতের স্পর্শে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছে। আর সত্যি বলতে, আমার এখন প্রচুর রাগও লাগছে। ডোন্ট ট্রাই মাই পেশেন্স, গেট ইওর ডার্টি হ্যান্ডস অফ মি!”
ছেলেটা এবার আরও জেদ নিয়ে রৌদ্রের কলার আরও জোরে চেপে ধরল। সে রৌদ্রের মুখের ওপর মুখ এনে তাচ্ছিল্য করে বলল।
“হাত সরাবো না? তুই আমার কী করবি রে? দেখি তুই কী করতে পারিস।”
রৌদ্র তখনও অদ্ভুতভাবে শান্ত। সে কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে পকেট থেকে ধীরস্থিরভাবে তার আইফোনটা বের করল। কারো নাম্বারে ডায়াল করে ফোনটা কানে ধরতেই পাশের এক ছেলে ছোঁ মেরে রৌদ্রের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল। সে ফোনটা হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল।
“আরে বাহহ! আইফোন! দেখ দেখ, কী দামি আর কী সুন্দর জিনিস! আমার তো মনে হয় এই ছেলেটা অনেক বড় ঘরের ছেলে। আর দেখছিস না, কত হ্যান্ডসাম আর পরিপাটি হয়ে আছে।”
যে ছেলেটা কথাগুলো বলল সে কিছুটা হ্যাবলা টাইপের হলেও তার কথা শুনে যে ছেলেটা রৌদ্রের কলার চেপে ধরেছিল তার মাথায় যেন বাজ পড়ল। সে বুঝতে পারল রৌদ্র কোনো সাধারণ মানুষ নয়। আতঙ্কে সে সাথে সাথে কলার ছেড়ে দিয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। রৌদ্র নিজের কোটটা ঝেড়ে একটু সোজা করে নিল। তারপর ঠোঁটের কোণে একটা শীতল ও বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ছেলেদের উদ্দেশ্য করে বলল।
“মাফ চা বোনের কাছে।”
রৌদ্রের এই শান্ত কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ আদেশ শুনে ছেলেগুলোর বুকের ভেতরটা এবার কেঁপে উঠল।ছেলেগুলো এবার নিজেদের বিপদ বুঝতে পেরে কুঁকড়ে গেল। তারা সৃজনীর সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে কাঁপাকাঁপা গলায় বলল।
“বোন আমাদের ভুল হয়েছে। এবারের মতো মাফ করে দাও।”
মেয়েটার নাম সৃজনী। সে এতক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকলেও এখন রৌদ্রের উপস্থিতি তাকে সাহস জোগাল। সৃজনী এবার প্রচণ্ড রাগ নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল।
“মাফ তখনি করবো যখন এখানে দাঁড়িয়ে সবার সামনে একশ বার কান ধরে ওঠবশ করবি। আর সাথে বলবি আমি আর কোনো দিন কোনো মেয়ের দিকে খারাপ নজরে তাকাবো না। মেয়েরা আমার বোন আর মায়ের মতো, আমি তাঁদের খুব সম্মান করবো।”
ছেলেগুলো রৌদ্রের জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আর তর্কের সাহস পেল না। তারা কান ধরে রাস্তার মাঝখানেই সৃজনীর কথা মতো একশ বার ওঠবশ করতে শুরু করল আর চিৎকার করে প্রতিজ্ঞাগুলো করল। তাদের এমন অবস্থা দেখে আশেপাশের লোকজনও থমকে দাঁড়াল। শাস্তি শেষ করে হ্যাবলা ছেলেটা কাঁপাকাঁপা হাতে রৌদ্রের ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল। রৌদ্র ফোনটা নিতেই ছেলেগুলো প্রাণের ভয়ে উল্টো দিকে দৌড়ে পালালো।
সৃজনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিল। রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে বলল।
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে আজ আমার সাথে কী হতো আমি নিজেও জানি না।”
রৌদ্র একদম স্বাভাবিক গলায় শান্তভাবে বলল।
“ধন্যবাদের কিছু নেই। বিপদে পড়া মানুষকে রক্ষা করা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। আমি শুধু আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছি মাত্র। ইটস কমপ্লিটলি নরমাল।”
সৃজনী মুগ্ধ চোখে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বলল।
“যদি কিছু মনে না করেন তবে আপনার নামটা কি জানতে পারি?”
রৌদ্র লম্বা একটা শ্বাস টেনে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল।
“আব্রাহাম খান রৌদ্র। আসি তাহলে। ভালো থাকো আর একটু সাবধানে চলাফেরা করো বোন। অসময়ে এভাবে একলা বাসা থেকে বেরিও না।”
কথাটা শেষ করেই রৌদ্র আর দ্বিতীয়বার সৃজনীর দিকে তাকাল না। তুরার কথা মনে পড়তেই সে দ্রুত পায়ে নিজের গাড়িতে গিয়ে বসল এবং স্টার্ট দিয়ে চোখের পলকে সেখান থেকে চলে গেল। সৃজনী মোহাবিষ্টের মতো রৌদ্রের চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল।
“আব্রাহাম খান রৌদ্র। নামটা যেমন সুন্দর তেমনই চেহারা আর তেমনই তার মানসিকতা। সত্যি অসাধারণ একজন মানুষ।”
ভাবতেই সৃজনীর ঠোঁটের কোণে একটা লাজুক হাসি ফুটে উঠল। তার মনের গভীর কোণে অজানা এক অনুভূতির ঢেউ উথালপাথাল করতে শুরু করল। রৌদ্রের ব্যক্তিত্বের সেই ছাপ যেন সৃজনীর হৃদয়ে স্থায়ীভাবে বসে গেছে।
আজ তিথির শেষ পরীক্ষা ছিল। হল থেকে বের হওয়ার সময় মনটা ফুরফুরে থাকলেও কলেজের গেটে আসতেই সেই আনন্দ বিষাদে রূপ নিল। সামনেই আয়ান তার রাজকীয় গাড়িটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা অবশ্য তিথির গা-সওয়া হয়ে গেছে, কারণ আয়ান প্রতিদিন নিজের অফিসের কাজ ফেলে রেখেও তিথিকে কলেজে আনা নেওয়া করে।
কিন্তু আজ গেটের সামনের দৃশ্যটা দেখে তিথির শরীরের রক্ত টগবগ করে মাথায় চড়ে গেল। আয়ান একা নেই, তার সামনে এক সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আয়ান বেশ রসিয়ে রসিয়ে হেসে মেয়েটার সাথে কথা বলছে। এই দৃশ্য দেখে তিথির পিত্তি জ্বলে গেল। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে আায়ানের ওই হাসিমাখা মুখটা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে থেঁতলে দিতে। তিথি স্পষ্ট বুঝতে পারছে, অন্য কোনো মেয়ের সাথে আয়ানকে এভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলতে দেখে তার কলিজার ভেতরটায় কেউ যেন বিষাক্ত তীরের খোঁচা দিচ্ছে। অভিমানে আর রাগে তার চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে উঠল।
এদিকে আয়ানের মনের খবর একদম আলাদা। ভার্সিটি জীবনের এক পুরোনো বান্ধবীর সাথে মাঝরাস্তায় হুট করে দেখা। মেয়েটিই যেচে কথা বলতে এসেছে। আয়ান মনে মনে প্রচণ্ড ছটফট করছে কারণ তিথির পরীক্ষা শেষের সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সৌজন্যতার খাতিরে বাইরে কৃত্রিম হাসি বজায় রেখে মেয়েটার কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। সে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে কখন এই আপদ বিদায় হবে!
তিথি আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেল না। রাগে তার শরীর কাঁপছে, আর শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে আসছে। আয়ান তাকে দেখার আগেই সে গজগজ করতে করতে রাস্তার পাশে এসে একটা রিকশাকে ইশারা করল। তড়িঘড়ি করে রিকশায় উঠে বসে রিকশাওয়ালাকে জোরে বাড়ি যাওয়ার তাগিদ দিয়ে সে একরাশ অভিমান নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল।
তিথি বাড়িতে ঢুকে কারও সাথে কথা না বলে ঝড়ের বেগে নিজের রুমে গিয়ে ঢুকল। সজোরে শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে ভেতর থেকে লক করে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তার বুকের ভেতরটা তখন রাগে আর অভিমানে দাউদাউ করে জ্বলছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর বাড়ির সদর দরজা দিয়ে আয়ানও রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঢুকল। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে সে রাগে রীতিমতো কাঁপছে। আয়ান সোজা তিথির রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। সে জানে তিথি পরীক্ষা শেষ করে সোজা নিজের রুমেই আসবে। কিন্তু রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে আয়ানের মেজাজ সাত আসমানে চড়ে গেল। সে দরজায় বিকট শব্দে একটা লাথি মেরে হুঙ্কার দিয়ে বলল।
“তিথি, ভালোয় ভালোয় বলছি দরজা খোল! তোর কলিজাটা কত বড় হয়েছে আমি আজ একটু দেখতে চাই। তুই আমাকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও একা বাড়িতে চলে আসলি কোন সাহসে? দরজা খোল বলছি!”
ভেতর থেকে তিথিও সমান তেজে চিৎকার করে উত্তর দিল।
“খুলব না দরজা! কোন সাহসে এসেছি তা জানার তোমার দরকার নেই। আমার ইচ্ছে করেনি তোমার সাথে আসতে, তাই চলে এসেছি। এতে তোমার কী? যাও এখান থেকে, আমার ভালো লাগছে না!”
আয়ান রাগে বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে চোয়াল শক্ত করে গর্জে উঠল।
“দেখ তিথি, মাথা এমনিতেই গরম হয়ে আছে। আমাকে আর রাগাস না। ভালো মেয়ের মতো দরজাটা খোল, নাহলে কিন্তু আমি আজ দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকব। তখন কিন্তু খুব খারাপ হবে, বলে দিচ্ছি!”
আয়ানের এমন চিল্লাচিল্লি আর দরজায় লাথি মারার শব্দ পেয়ে তনুজা খান আর হিমি খান দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে আসলেন। হিমি খান আয়ানের এই রুদ্রমূর্তি দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বললেন।
“কিরে আয়ান? কী হয়েছে এমন? তুই মাঝদুপুরে এভাবে পাগলের মতো রেগে আছিস কেন? আর তিথির সাথে এভাবে চিল্লাচিল্লিই বা করছিস কেন?”
আয়ান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে হিমি খানের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় গর্জে উঠল।
“আম্মু, তিথিকে বলো এখনই দরজা খুলতে! নাহলে কিন্তু আমি এই দরজা ভেঙে গুঁড়ো করে ভেতরে ঢুকব। আর তখন ওর সাথে আমি কী করব, সেটা ও কল্পনাও করতে পারছে না!”
হিমি খান ছেলের এমন উন্মত্ত রুদ্রমূর্তি দেখে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গেলেন। তিনি জানেন আয়ান সচরাচর মেজাজ হারায় না, কিন্তু একবার রক্ত মাথায় চড়ে গেলে সে আসমান-জমিন এক করে ফেলে। হিমি খান ব্যাকুল হয়ে তিথির দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলেন।
“তিথি, মা আমার, দরজাটা খোল! ছেলেটা আজ একদম হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ওকে আর খেপাস না রে মা, বড় বিপদ হয়ে যাবে!”
ভেতরে তিথি পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কলিজা কাঁপলেও জেদটা তার পাহাড় সমান। সে দরজার ওপাশ থেকেই তড়পিয়ে উঠে বলল।
“আম্মু, ওই রাক্ষসটাকে এখান থেকে আগে বিদায় করো! ওকে দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। আমি ওর মুখদর্শন করতে চাই না, প্লিজ ওকে সরাও!”
তিথি এখন হিমি খানকে ‘আম্মু’ বলেই ডাকে, যেটা হিমি খানই তাকে ডাকতে বলেছে। কিন্তু তিথির মুখে এমন অবাধ্য কথা শুনে আয়ানের ধৈর্যের শেষ সুতোটুকুও ছিঁড়ে গেল। সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না। শরীরের সমস্ত শক্তি পায়ের তলায় এনে দরজার ঠিক মাঝ বরাবর এক প্রচণ্ড লাথি মারল। বিকট এক ‘ঠাস’ শব্দে কপাট জোড়া আলগা হয়ে দরজার লক ভেঙে চৌচির হয়ে গেল!
তনুজা খান আর হিমি খান আতঙ্কে কানে হাত দিয়ে পিছিয়ে গেলেন। তিথির বুকের ধুকপুকুনি তখন গলার কাছে চলে এসেছে। আয়ান এক ঝটকায় ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। কোনো কথা নেই, কোনো তর্কের অবকাশ নেই সে নিমিষেই তিথিকে পাঁজাকোলা করে তুলে বস্তার মতো কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। তারপর হনহনিয়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করল। তিথি উপায় না পেয়ে আয়ানের পিঠে অনবরত ধুমধাম কিল-ঘুষি মারতে শুরু করল আর চিৎকার করে বলতে লাগল।
“বাঁচাও আমাকে! আম্মু, এই রাক্ষসটার হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করো! নাহলে আমি কিন্তু আড়ি দেব তোমাদের সাথে!”
তনুজা খান আর হিমি খান কিছু বুঝে ওঠার আগেই আয়ান তিথিকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে সজোরে লাথি মেরে দরজা লাগিয়ে খিল এঁটে দিল। তনুজা খান অস্থির হয়ে দরজায় কড়া নেড়ে কাঁপা গলায় বললেন।
“আয়ান বাবা! মেয়েটা ভয় পাচ্ছে, পাগলামি করিস না। ও কী ভুল করেছে আমাদের বল, আমরা ওকে শাসন করব। তুই দরজা খোল!”
ঘরের ভেতর থেকে আয়ান তিথিকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে তার দুবাহু শক্ত করে মুঠোয় পুরে নিল। তারপর সব লজ্জা শরম একপাশে সরিয়ে তনুজা খানের উদ্দেশে চিৎকার করে বলে উঠল।
“আম্মু, একটা কথা পরিষ্কার শুনে রাখো তিথি এখন আমার ‘প্রপার্টি’। ও যখন অন্যায় করেছে, তখন শাস্তিটাও আমার স্টাইলেই হবে। এখন তোমরা কি বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার রোমান্স দেখবে নাকি? তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই, আমি এখন তোমার মেয়েকে আচ্ছা করে আদর করে ঠান্ডা করব, তোমরা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই আওয়াজই শোনো তাহলে!”
রানিং…!
ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আজকের গল্পটা একটু অন্য মুডে যাচ্ছে কারণ এখন শিহাব আরশির মিল হবে আয়ান তিথির মিল হবে এমন পর্যায় নিয়ে যাচ্ছি 🤍😊
Share On:
TAGS: নির্লজ্জ ভালোবাসা, সুমি চৌধুরী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৩
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫৭
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১২
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫১
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১০
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১৩
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩৩
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩৭
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩৬
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩৪