Golpo ডার্ক ডিজায়ার ডার্ক রোমান্স

ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৬


Dark_Desire

পর্ব —৬

দূর্বা_এহসান

ডার্ক_ডিজায়ার

ঘড়িতে সকাল দশটা বাজে ।রোদ এখন পূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাতে একটা নরম উষ্ণতা আছে । চড়চড়ে নয়, আরামদায়ক।
জানালার পর্দা হালকা দুলছে, ভেতরে ঢুকে পড়া আলো ঘরের মেঝেতে নকশা এঁকে দিচ্ছে।আলো জানালা পেরিয়ে এসে বিছানার চাদরে গড়িয়ে পড়েছে, নরম উষ্ণতায় ভরে গেছে ঘরটা।মৃন্ময় আধঘুমে চোখ মেলে তাকায়। তরু তার বুকের উপর।গভীর ঘুমে।রোদে তার চুলে ঝিলিক পড়ছে।হাওয়ার হালকা ছোঁয়ায় চুল নড়ে উঠছে একটু।ঘরের ভেতর কেবল ফ্যানের মৃদু শব্দ আর বাইরে দূরের পাখির ডাক।
মৃন্ময় তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তরুর মুখে এমন একটা শান্তি ছড়িয়ে আছে, যেন ঘুমের ভেতর সে অন্য কোনো পৃথিবীতে চলে গেছে।যেখানে শব্দ নেই, ব্যস্ততা নেই, কেবল রোদ আর নিঃশব্দ নিশ্বাসের উষ্ণতা।মৃন্ময় ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে তরুর মুখের চুলগুলো সরিয়ে দিল। চুলের গন্ধে হালকা শ্যাম্পুর ঘ্রাণ।তরুর শ্বাস বুকের ওপর পড়ছে নিয়মিত ছন্দে। মৃন্ময় সেই ছন্দে ডুবে যায় কিছুক্ষণ।যেন সময়টা থেমে আছে।মৃন্ময় নিজের বুকের ওপর তরুর ওজনটা অনুভব করছে,হালকা।
তরুর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃন্ময় হঠাৎ নিজের বুকের ভেতর ব্যথা অনুভব করে।গত রাতের কথাগুলো, কিছু অব্যক্ত ঝাঁঝ, কিছু না বলা কথা।তরু ঘুমিয়ে, নির্ভার।মৃন্ময় চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো।

মৃন্ময় একটু হেলে তরুকে বিছানায় শুয়ে দিল।তরু নড়ল না, ঘুমের ভেতর যেন আরও গভীরে ডুবে গেল।মৃন্ময় কাথাটা আরো টেনে আলতো করে ওর গায়ে দিল।চুলের এক গোছা কপালে লেগে আছে,সেটাও সরিয়ে দিল ধীরে।এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল,তারপর কপালে ছোট করে একটা চুমু দিল।নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল সে।টাওয়ালটা তুলে কোমরে জড়িয়ে নিল।ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে একটু নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বাথরুমের দরজার দিকে হাঁটল।শাওয়ারের নিচে দাঁড়াতেই ঠান্ডা জল গায়ে পড়ল।
মৃন্ময় কেঁপে উঠল, যেন ভেতরকার কিছু ধুয়ে ফেলতে চাইছে।
মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।জলের আওয়াজে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও হারিয়ে গেল।

গত রাতের তরুর মুখটা মনে পড়তেই বুকের ভেতর একটা ভার জমে উঠল।সে চোখ বন্ধ করল, কিন্তু স্মৃতি থামল না।জল বইতে থাকল। তবু ভেতরের সেই ভারটা ধুয়ে গেল না।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে টাওয়াল আঁট করে কাঁধে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ,ধীরে।যেন কোনো শব্দ না হয়।দরজার কাছে এসে একবার ফিরে তাকাল ঘরের দিকে।তরু এখনও ঘুমিয়ে আছে। নিঃসৃত মুখে রোদ নরম ছোঁয়া দিচ্ছে।

সে অমনোযোগে কিন্তু যত্ন করে রান্না করায় ঢুকে পড়ে। চুলায় মৃদু আগুন জ্বালিয়ে প্রথমে পানি দিয়ে চা ঠিক করে।গভীর গরম, একটু কম চিনি।সে জানে তরুর পছন্দ। তারপর আলু কুচি করে হালকা মশলায় ভাজে। কাঁচা লেবুর ফালি রেখে দেয় পাশে। পরোটার লেইট, ময়দার বল হাতে নিয়ে, হাত দিয়ে আলতো করে মাখে।পরটাগুলো নরম হওয়া পর্যন্ত তেলে সোনালী করে সেঁকে নেয়।

রান্নাঘরের ছোট জানালা দিয়ে ভেতরে ঢোকে সকালে’র হাওয়া। কাঁচে হালকা ফোঁটা জমে আছে, গরমতা আর ঠান্ডার মিশ্রণ। মৃন্ময় চামচ দিয়ে চায়ের তীব্রতা টেস্ট করে।ঠিক আছে।প্লেট সাজায় অল্প করে আলু, দুই টুকরো মাখন পরোটা, ডিম ভাজা সাবধানে ছিটিয়ে। মাঝখানেই একটি ছোট করে কাটা লেবু ও ধনেপাতার হাল্কা ছিটা।তরু এই সাদামাটা আর ঘরোয়া জিনিসগুলোতেই খুশি হয়।

রান্না শেষ করে মৃন্ময় প্লেটটি নিয়ে ফিরে আসার সময় একটা দীর্ঘ, নীরব শ্বাস টেনে নেয়।মৃন্ময় খাবারগুলো ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রাখল।তরুর জন্য যত্ন করে বানানো সকালের প্লেট। চায়ের কাপ থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে, রোদে তার ভেতর দিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ছে টেবিলের ওপর। সবকিছু নিঃশব্দ। ঘরের বাতাসে থিতিয়ে থাকা উষ্ণতা।

সে এবার ঘরের দিকে ফিরল।তরু এখনও ঘুমিয়ে, একদম শিশুর মতো মুখে প্রশান্তি।মৃন্ময় একটু ঝুঁকে গিয়ে ধীরে ডাকলো,

“পাখি”

তরু একটু নড়ল।চোখ খুলে আধো ঘুমে কিছু বলল না শুধু মুখের কোণে একটুখানি ভাঁজ পড়লো।মৃন্ময় চুপচাপ হাসে।
তারপর দুই হাত দিয়ে আলতো করে তরুকে কোলে তুলে নেয়।
(এই গল্পের রাইটারের পেজের নাম — দূর্বা এহসান : Durba Ehsan)

তরু হালকা ভারে তার কাঁধে মাথা রাখে, ঘুমে আধো।
মৃন্ময় ধীরে ধীরে হাঁটে ওয়াশরুমের দিকে।
দরজার কাছে এসে বলে, “একা পারবে নাকি আমি সাহায্য করবো?”

“পারবো”

তরু আধখোলা চোখে তাকায়, তারপর মৃদু হাই তোলে।
মৃন্ময় তাকে দরজার ভেতর পর্যন্ত রেখে ধীরে দরজা টেনে দেয়।_

তরু ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।চুল ভেজা, কাঁধ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে টিশার্টের গলায়।পা টেনে ধীরে হেঁটে এল সে, চোখে তখনও ঘুমের ভার।মৃন্ময় টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
তরুকে দেখে কিছু না বলে তোয়ালেটা হাতে তুলে নিল।ধীরে এগিয়ে এল।চুপচাপ তোয়ালেটা চুলের উপর রাখল, আলতো করে চেপে ধরল।তার হাতের ভেতর দিয়ে তরুর চুলের ভেজা উষ্ণতা যেন গিয়ে লাগল তার নিজের বুকেও।কোনো কথা নেই।
শুধু তোয়ালে ঘুরছে ধীরে ধীরে।মাথার পাশে, গলার কাছে, কানের পেছনে।

তরু স্থির দাঁড়িয়ে আছে, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।চোখ নামানো, শ্বাস ধীর।মৃন্ময় মাঝে মাঝে চুল সরিয়ে দেয়, কপালে হাত বুলিয়ে দেখে জল লেগে আছে কিনা। চুল তার আঙুলে আটকে যায়।সে তা খুলে দেয় খুব সাবধানে, যেন স্পর্শেও আঘাত না লাগে।
মৃন্ময় তোয়ালে নামিয়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে তরুর মুখের দিকে।হাত বাড়িয়ে গালে চুল সরিয়ে দেয়,তারপর বলে,
“চা ঠান্ডা হয়ে যাবে, চলো।”

তরু কিছু বলে না, শুধু ধীরে পা বাড়ায়।কিন্তু পায়ের ভার সামলে দাঁড়ানোই কষ্ট হচ্ছিল তার।মৃন্ময় এক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল, তারপর এগিয়ে গেল।

“চল”
খুব নিচু গলায় বলল সে।আর তারপর কোনো জোর না করে, শুধু নিঃশব্দে তরুকে কোলে তুলে নিল।তরু কোনো প্রতিবাদ করল না।তার শরীর হালকা, নিস্তব্ধ।মৃন্ময়ের কাঁধে মাথা রাখল। সব ক্লান্তি জমে আছে সেই নরম ভরটুকুতে।ডাইনিং টেবিলের দিকে গিয়ে মৃন্ময় তাকে চেয়ারে বসাল।তরু স্থির।
মৃন্ময় প্লেট টেনে নিল কাছে, এক টুকরো পরোটা ছিঁড়ে তরুর মুখের কাছে নিয়ে বলল,
“খেয়ে নেও ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

তরু কিছু বলল না, শুধু ধীরে মুখ খুলল।আজ কোনো না-না নেই।সে খেয়ে নিল, শান্ত, নিরুত্তাপ।

মৃন্ময় হাত থামিয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।তরুর মুখে একটাও শব্দ নেই, একটাও অভিব্যক্তি নেই।সে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার খাওয়াতে শুরু করল।

তরু কেন তাকে ঘৃনা করে? ঘৃনা তোর তার করার কথা।তাকে তরু ধোঁকা দিয়েছে, সে তো দেয়নি। সে শুধু ভালবেসেছিল,নিজের সবটা দিয়ে।তাহলে সব কিছু উল্টো কেন?বিপরীত আচরণ কেন? উত্তর খুঁজে পায়না মৃন্ময়।


কেবিনের আলো ম্লান।সাদা দেয়ালগুলোয় দিনের আলো এসে পড়ছে ফিল্টার হয়ে। বেডের পাশে মেশিনের একঘেয়ে শব্দ।
বিপ… বিপ…।প্রতিটি ধ্বনি যেন জানিয়ে দিচ্ছে,জীবন এখনও টিকে আছে, খুব পাতলা সুতোয় ঝুলে।রোগীর শরীরে জড়ানো পাতলা সাদা চাদর।নাকের কাছে অক্সিজেন টিউব, হাতে স্যালাইন,বুকে ওঠানামা সামান্য, কিন্তু নিয়মিত।

চুলে একটু অগোছালো, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।চোখের পাতা বন্ধ, কিন্তু মাঝে মাঝেএকটা মৃদু কম্পন দেখা যায়।যেন ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি কোথাও আছে মানুষটা।বাইরে করিডোরে নার্সের পদশব্দ।দূরে কোনো ফোন বাজে, আবার থেমে যায়।
সবকিছুর মধ্যেও এই ঘরে যেন এক অচল সময়।যেখানে কেবল মনিটরের আলোয় মুখের ছায়া পড়ে।আর মনে হয় ,এই শরীরটা ঘুমাচ্ছে না, অপেক্ষা করছে -ফিরে আসার, বা একেবারে চলে যাওয়ার।

তরু থামল কেবিনের দরজার সামনে।দরজায় লেখা “ICU – Bed 7”।হাত উঠিয়ে দরজাটা ঠেলতেই গন্ধটা এল.অ্যালকোহল, স্যালাইন, ওষুধ, আর সেই নির্দিষ্ট হাসপাতালের নীরবতা, যেখানে শব্দও যেন মাপা হারে চলে।ভেতরে বিছানায় তার বোন।চোখ বন্ধ, মুখ শান্ত, কিন্তু সেই শান্তি জীবনের নয়.একটা অদ্ভুত, অচেনা থেমে যাওয়া।হাতে স্যালাইন। মনিটর জ্বলছে সবুজ আলোয়।প্রতিটি শব্দ তরুর বুকের ভেতর কাঁপন তোলে।

সে ধীরে এগিয়ে গেল, চেয়ারটা টেনে পাশে বসল।চুলের একটা গোছা মুখে লেগে আছে বোনের।তরু হাত বাড়িয়ে সরিয়ে দিল, যেমন একসময় বোন করত তার জন্য।চোখের কোণে জল জমে এল, কিন্তু সে কাঁদল না।শুধু হাত রাখল বোনের হাতের উপর, ঠান্ডা, নিস্পন্দ।শিরার ভেতর দিয়ে ওষুধের স্রোত যাচ্ছে
তরু ফিসফিস করে ডাকলো,
“আপাই,,”

কোনো উত্তর নেই।শুধু মনিটরের শব্দ, অক্সিজেনের হালকা সোঁ সোঁ আওয়াজ, আর নরম আলোয় নিস্তব্ধ মুখটা।তরু বসে থাকে চুপ করে। তার নিজের নিঃশ্বাসের আওয়াজই একমাত্র জীবন্ত জিনিস এখানে।

কেবিনের কাঁচের দরজার ওপারে তরু বসে আছে।
হাসপাতালের আলোয় তার মুখ সাদা, প্রায় রঙহীন।
সে বোনের হাত ধরে আছে, একদম স্থির। একজন জ্ঞানহীন, একজন জেগে।তবু দু’জনই কোনো এক নীরব জগতে আটকে আছে।মৃন্ময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।হাত পকেটে, চোখ স্থির কাচের ওপারে।
সে কিছু বলতে চেয়েছিল,কিন্তু গলা শুকিয়ে গেল।কেবিনের এই নরম আলোয় তরুর মুখে যে নির্লিপ্ততা,তাতে একটা অজানা দূরত্ব লেগে আছে।যা মৃন্ময় ছুঁতে পারে না।

হাতটা বোনের হাতের ওপর শক্ত করে ধরল সে।তাকালো মৃন্ময়ের দিকে।কি শান্ত,ভয়ানক চাহনি! এই চাহনির কারণ মৃন্ময় জানে না।শুধু জানে ওই চাহনিতে ঘৃনা,রাগ ভরা।কিন্তু কেনো? শুধু কি বিয়ের সেই রাতের জন্য?

“এখনি রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করবি নাকি তোর বোনের লা”শ উপহার নিবি?”

মৃন্ময় জানতো তরু তার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে বোনকে।তাইতো এক সেকেন্ড ও দেরি না করে সাইন করে দিয়েছিল।

চোখ বন্ধ করে ফেললো মৃন্ময়।এই মেয়েকে কাছে পেতে সে সব কিছুই করতে পারে।তাহলে কেন তার সেদিনের কথা ভেবে অপরাধবোধ হচ্ছে! সে তাকালো তরুর পানে।নাহ্ ওই চোখে শুধু সেদিনের ঘৃনা নেই।আরো কিছু আছে।যা তার অজানা।


“আপাই, উঠবা না তুমি?তোমার বনু কষ্টে আছে জেনেও উঠবা না? এতটা স্বার্থপর কিভাবে হতে পারো?”

ডুকরে কেঁদে উঠে তরু।ঠিক তখনই সেখানে প্রবেশ করে আরবাজ।তরুর খালাতো ভাই।তরুর দিকে তাকায় সে। তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দেয়।তরু মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে এটার ই যোগ্য।

“এভাবে কাদার কোনো মানে হয়না।চলে যা”
“আরেকটু থাকি?”
“না”

বোনের কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে উঠে দাড়ায় তরু।দরজার দিকে এগিয়ে যায়।পিছন থেকে আরবাজ বলে,

” আজকে তোর বাপের বউয়ের তিন দিনের কাজ।একবার দেখে আসিস”

বলেই অরুর পাশে চেয়ার টেনে বসলো সে।দুই হাতে আঁকড়ে ধরলো একটা হাত।
তার কথায় চমকে উঠলো তরু। ভূল শুনলো নাকি বোঝার চেষ্টা করলো।

চলবে?

Share On:

TAGS:



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply