বেলতুলি – [১১]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
নাহিয়ান আজ সকাল সকালই ভার্সিটির জন্যে বের হয়েছে। পেটে কিছু পড়েনি। আজ শুরুতেই প্রেজেন্টেশন, এজন্য আয়োজন মোটামুটি ভালোই। আজ সুন্দর করে শার্ট ইন করেছে, মাথার এলোমেলো চুলও পরিপাটি। শুধু মুখের দাঁড়িটা একটু গজামিল লাগছে। ভেবেছিল গতকাল রাতেই সেলুনে গিয়ে একটা নির্দিষ্ট শেপে আনবে। কিন্তু তার সুযোগ হলোই বা কোথায়? এক স্টুডেন্টের আজ ম্যাথ পরীক্ষা। ওকে পড়াতে গিয়েই আটটা বেজে গেল। এরপর বাড়ি ফিরে প্রেজেন্টেশনের কাজ।
প্রেজেন্টেশন শেষে নাহিয়ান আজ আড্ডা দিতে পারেনি প্রচন্ড খুদায়। তাই ওদের থেকে বিদায় নিয়ে সে বাইরে চলে আসল। এক টং থেকে চা আর বনরুটি নিয়ে নেয়। টঙের পাশেই এক ডাববিক্রেতা ভ্যান নিয়ে বসা। নাহিয়ান সেটা লক্ষ্য করেও করেনি। কেন যেন তার ডাব পছন্দ না। সম্ভবত ঘনঘন বাথরুম যাওয়ার ভয়েই। তার এই ছোট্ট জীবনে বাথরুম গিয়ে বসে থাকার সময় কোথায়?
বনরুটি খেতে খেতে আচমকা এক মেয়েলি গলা শুনতে পেল। নাহিয়ান চমকে পাশ ফিরে তাকাল। এক সুন্দরী মেয়ে হাতে ডাব নিয়ে দাঁড়ানো। পাইপের সাহায্যে পানও করছে। সেলোয়ার কামিজ পরিহিত, লম্বা চুল খোঁপা করা, কাঁধে ব্যাগ, উচ্চতায় সম্ভবত ৫” ২। কেমন যেন বড়ো মানুষি ভাব আনার চেষ্টা করেছে। তবুও মন্দ লাগে না, বয়স হিসেবে ঠিক আছে। শুহারা হেসে বলল,
–“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
শুহারা নাহিয়ানের স্টুডেন্ট। এবার সবে ইন্টার প্রথম বর্ষে। কলেজের পাশাপাশি কোচিং করছে।
–“তুমি এখানে যে?”
–“কোচিং যাচ্ছিলাম, ডাব খেতে ইচ্ছা করল।”
নাহিয়ান কখনোই কথা বলায় পটু ছিল না। তার জিভ চলে কাজের কথা নিয়েই। শুহারাকে সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। শিক্ষক, ছাত্রীর সম্পর্কটা বজায় রাখল। কিন্তু শুহারা মোটেও এটুকুতে থেমে যাবার পাত্রী নয়।
–“আপনি একটু চেখে দেখবেন স্যার? দাম আমি দিয়ে দিব।”
–“কখনো কাউকে দেখেছ চায়ের সাথে ডাব খায়?”
–“জীবনে নতুন কিছুর অভিজ্ঞতা নিতে তো ক্ষতি নেই স্যার।”
নাহিয়ান চোখ পাকিয়ে চাইলো শুধু। শুহারা বলল,
–“আজ আর আসবেন না স্যার। দীপ্ত পড়বে না।”
দীপ্ত শুহারার ছোটো ভাই, সেও নাহিয়ানেরই স্টুডেন্ট। নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে বলল,
–“কেন? আজ না ওর ম্যাথ পরীক্ষা?”
–“হুঁ। বিকালে সবাই নানুবাড়ি যাব। নানু অসুস্থ। নয়তো ইচ্ছে তো ছিল দীপ্তর বার্ষিক পরীক্ষাটা শেষ করেই যাব। কিন্তু খবর এসেছে নানু বেশ অসুস্থ। যেহেতু আগামীকাল এক সরকারি ছুটি আছে তাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বড়োরা।”
শুহারা বরাবরই অতিরিক্ত কথা বলে। যা বলা উচিত নয় তাও বলে। মেয়েদের মধ্যে এই বেশি কথা বলা নাহিয়ানের অপছন্দ। একমাত্র ছাত্রী বলেই সে শুনে।
–“শোনো শুহারা, স্যার হিসেবে একটা এডভাইস দেই.. রাস্তা-ঘাটে বেশি পটপট করবা না। এতে আশেপাশের মানুষ বিরক্ত হয়।”
শুহারা চোখ তুলে নাহিয়ানের দিকে তাকাল। হলদে রোদ মেয়েটার মুখের ওপর পড়েছে।
–“আপনি বিরক্ত হন?”
–“উত্তর জানো তুমি।”
–“আবারও শুনতে চাই।”
নাহিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“হই।”
নাহিয়ান ভেবেছিল শুহারার মুখের রং পালটে যাবে। কিন্তু তার ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না। শুহারা উলটো ডাব ফেলে দিয়ে বলল,
–“তা আমি জানি। তবুও আমি বলবই। আপনাকে এক্সপ্লেইন করা ছাত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব।”
শুহারা ডাবওয়ালাকে টাকা দিতে গেলে নাহিয়ান বাঁধ সাধল। আর যাই হোক, চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও শুহারাকে টাকা দিতে দেখা তার কাছে অদ্ভুত লাগবে।
–“তুমি যাও, আমি দাম দিয়ে দিব।”
মুহূর্তেই শুহারা চোখ চকচক করে উঠল। কিন্তু সে সত্যি সত্যি দাম দিয়ে দিল। মুচকি হেসে বলল,
–“আপনি কথার মাধ্যমেই দাম দিয়ে দিয়েছেন স্যার। মাঝেমধ্যে কাগজের টাকার চাইতেও মুখের কথার দাম বেড়ে যায়। আমি যাই, কোচিং এর জন্য দেরী হচ্ছে।”
বলেই শুহারা চলে গেল। বান্ধবীর থেকে শুনেছে কোনো পুরুষ যদি ভাড়া মিটিয়ে দেয়, সম্মান করে তাহলে সে নাকি গোপনে প্রেম নিবেদন করছে। এর মানে কি নাহিয়ানও তাকে প্রেমের নজরে দেখে? লাজে লাল হয়ে গেল মেয়েটা। রিকশা ডেকে উঠে গেল। এদিকে নাহিয়ান বোকা হয়ে দাঁড়ানো। কী বলে গেল মেয়েটা? কী বোঝাতে চাইল? বয়সই বা কত? নাহিয়ান হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে খালি কাপটা টঙে দিয়ে দাম মিটিয়ে দিল। মিনমিন করে আওড়াল,
–“পাগল!”
*****
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। বেশ শীত শীত অনুভব হচ্ছে আজকাল। প্রথম টিউশনির টাকা আগে পেয়ে গেলেও দ্বিতীয় টিউশনির টাকা আজই পেল সে। এ নিয়ে তার খুশির অন্ত নেই। এবার ভেবে রেখেছে এই টাকা গুছিয়ে রিমঝিম আর তার জন্য একই রঙের, একই রকম শাড়ি কিনবে। আগামীকাল পাত্রপক্ষ আসবে। মোটামুটি নিশ্চয়তা আছে রিমঝিমের এখানেই বিয়ে হয়ে যাবে। এজন্য যেই ভাবা সেই কাজ। রাতুলদের বাড়ি থেকে বের হতেই আচমকা নিবিড়ের মুখোমুখি হলো সে। মুহূর্তেই তার বুকটা ধ্ক করে উঠল। নিবিড়ের মুখমণ্ডল কী কঠিন। যেন সে জেনে গিয়েছে মৌনোই তার শু নষ্ট করেছে। মৌনো শুকনো ঢোক গিলে দুই ধাপ পিছিয়ে যায়। নাহ, কিছুতেই তাকে বুঝতে দেয়া যাবে না ওই অঘটন মৌনো করেছে।
নিবিড় মৌনোকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বলল,
–“বেতন পেয়েছিস?”
মৌনো বোকা বনে মাথা নাড়ায়।
–“চল আমার সাথে।”
মৌনো চমকে যায়।
–“কোথায়?”
নিবিড় জবাব না দিয়ে তখনই সিএনজি ডাকল। মৌনো যেতে চাইল না। কিন্তু নিবিড়ও নাছোরবান্দা।
–“তুই এত কাজেরও না যে তোকে কিডন্যাপ করে আমার লাভ হবে। আঙ্কেল আন্টি তিন বেলা ভাত দিয়ে যে এক ইউজলেস গোরু পুষছে এই অনেক।”
মৌনোর রাগ হলো। সিএনজিতে বসতে বসতে বলল,
–“আমি গোরু?”
–“তুই গোরু না তার প্রুভ কী?”
অতিরিক্তি রাগে মৌনো হতভম্ব।
–“সত্যি করে বলুন কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
নিবিড় মৌনোকে জবাব না দিলেও সিএনজিকে কাছাকাছি এক মার্কেটের ঠিকানা দিল। মৌনো ভেবে পেল না শপিংমলে কেন এই ভরদুপুরে?
নিবিড় বেছে বেছে এক বাটা ব্র্যান্ডের জুতোর দোকানে ঢুকল। মৌনোকে পাত্তা না দিয়ে সে নিজের মতো করে জুতো খুঁজছে। মৌনো এত বোকাও নয় যে নিবিড়-এর কাণ্ড ধরতে পারবে না। সে ভালো করেই বুঝে গেছে এবারও সে দারুণ রকম ধরা খেয়েছে। তার চুরি এবারও পার পায়নি। সে বুঝে পায় না, এত সাবধানে কাজ করা সত্ত্বেও নিবিড় কী করে তাকে ধরে ফেলল? সে ভেবে নেয়, কিছুতেই মুখ খুলবে না।
–“আপনি কী করছেন? আমাকে কেন এখানে এনেছেন?”
নিবিড় জুতো ট্রায়াল দিতে দিতে বলল,
–“তুই যে এত অবুঝও নস তা আমি জানি।”
মৌনো শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইল।
–“আপনি কি বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না।”
এবার নিবিড় তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। সেই চোখের ভাষা পড়তে মৌনোর সময় লাগল না। নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“সিনক্রিয়েট করতে বাধ্য করবি না। তুই মেয়ে মানুষ বলে বারবার বেঁচে যাস। ভাগ্যিস আমি কোনো কাপুরুষ নই, মেয়েদের গায়ে হাত তুলি না।”
মৌনোও এবার রাগ দেখাল,
–“জুতো নষ্ট করেছি বেশ করেছি! আপনি কেন আমার বাড়িতে খামাখা বিচার দিতে যাবেন? এই স্বভাব আমার একদম পছন্দ নয়।”
নিবিড় রক্তচক্ষু নজরে তাকাল, যেন ওই চোখ জোড়া দিয়েই তাকে ভষ্ম করে দিবে। মৌনো কিছুটা দমে গেল। নিবিড় চোখ সরিয়ে আবারও জুতো দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শেষমেষ এক জোড়া জুতো কিনল। দাম শুনেই নিবিড় বলল,
–“বিল পে কর।”
মৌনো যেন আকাশ থেকে পড়ল,
–“মানে কী?”
–“স্প্যানিশ বলেছি? বিল পে কর।”
–“আপনি আমার বড়ো হয়ে এত দামি জুতোর বিল..”
–“ক্ষতিপূরণ। তুই আমার জুতো নষ্ট করেছিস, আবার কিনে দিচ্ছিস। শোধ-বোধ।”
অগত্যা, নিবিড়ের ধমকের কাছে হার মেনে মৌনোর জুতো কিনে দেওয়া লাগল। হাতে বাকি মাত্র সত্তর টাকা। মৌনো দাঁতে দাঁত চেপে নীরবে হাঁটছে। রাগটা বেশিক্ষণ টিকল না। অদূরেই সে জাবিরকে দেখতে পেল। মৌনো ভয়ে তৎক্ষণাৎ নিবিড়কে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। নিবিড় কাউকেই লক্ষ্য করেনি। সে বিরক্ত হয়ে বলল,
–“কী হচ্ছে? কোথায় টেনে নিচ্ছিস?”
মৌনো কোনো কিছু পরোয়া না করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
–“আপনার আর কি লাগবে? শার্ট, পাঞ্জাবি, স্যান্ডো গেঞ্জি? নাকি ফ্রক-পায়জামা? শাড়ি..”
–“ইডিয়েট, আর ইউ লস্ট ইওর মাইন্ড? আমাকে তোর কোন দিক থেকে মেয়ে লাগছে?” নিবিড় গর্জে উঠল।
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে—
[যারা যারা পড়ছেন তারা রেসপন্স করবেন। এতে করে অন্যান্য পাঠকদের ফিডেও গল্প পৌঁছাবে।]
বিঃদ্রঃ অনেকদিন পর লিখেছি। ধারাবাহিকতা ঠিক আছে তো? যেহেতু অনেকদিন পর, হাতে একটু মরিচা ধরেছে। ধীরে ধীরে লিখা আবারও শুরু করলে তা কেটে যাবে। আর বলবেন না, কি জঘন্য রাইটিং ব্লকে যে পড়ে গেছি। এতদিন একটা অক্ষরও লিখতে পারিনি🙂
কেমন লাগছে জানাবেন। আমি নার্ভাস।😭
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ১৪
-
বেলতুলি পর্ব ৭
-
বেলতুলি পর্ব ১০
-
বেলতুলি পর্ব ৯
-
বেলতুলি পর্ব ১২
-
বেলতুলি পর্ব ৬
-
বেলতুলি পর্ব ৪
-
বেলতুলি পর্ব ১৬
-
বেলতুলি পর্ব ২
-
বেলতুলি পর্ব ১৩