Born_to_be_villains
methuburi_মিথুবুড়ি
পর্ব_১৪(প্রথমাংশ)
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌
‘ধানমণ্ডির চার নাম্বার রোড, পিবিআইয়ের সদর দপ্তরের সামনে বেপরোয়া গতিতে ধেয়ে আসা বেগে লাল রঙের একটা আরওয়ান-ফাইভ ভি-ফ্রোর জোরসে ব্রেক কষলো। পিজ ঢালা রাস্তার সাথে চাকার উগ্র ঘর্ষণে তৈরি কর্কশ শব্দে রাস্তার অপরপ্রান্তে মারবেল খেয়াল নিমজ্জিত পথশিশুরা হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল। কম্পিত চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে থাকল পিবিআই অফিসের রাস্তা লাগোয়া গেইটের দিকে৷ বর্তমান বাংলার বুকে লেডি বাইকার এবং শরীরের সাথে আঁটসাঁট হয়ে দৈহিক গঠন ফুটিয়ে তোলা ইসলাম বিরোধী পোশাক এখন এতোটাই মামুলী আর নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে যে তাদের কারো তটস্থ চোখে চকিতভাব লক্ষ করা গেল না৷
‘তবে যখনই মেয়েটি হেলমেট খুলে কাঁধ ছুঁই-ছুঁই চুলগুলো ঠিক করতে ডানে-বামে মাথা নাড়তে শুরু করে, তখন তার ভিন্ন দেশীয় আদল আর নিখুঁত দেহগঠন মুহূর্তেই সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়। একজন আরেকজনকে কনুই দিয়ে ইঙ্গিত করে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে,
“দেখ…দেখ বিদেশি মাল।”
‘মেয়েটির শ্রবণশক্তি ছিল হাঙরের মতো তীক্ষ্ণ। এত দূর থেকেও ছেলেগুলোর ফিসফাস স্পষ্টই পৌঁছে গেল তার কানে। হেলমেটটা ট্যাংকির ওপর রেখে, সেটার ওপর ভর দিয়ে নির্লিপ্ত ভাবনায় বসে পড়ল সে। অতঃপর গাঢ় খয়েরি ঠোঁটের কোণে একঝুলে হাসি তুলে বলে উঠল,
“ইট’স নট মাল।
ইটস কল্ড হট অ্যান্ড সে-ক্সি।
রাস্তা-ঘাটে চুরিচামারি করার বদলে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করলে উল্টাপাল্টা কমপ্লিমেন্ট দিতে হতো না, বাচ্চা।”
‘একজন মেয়ের কথায় এতো ধার থাকতে পারে ওরা সম্ভবত ধারণাই করতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যে ছেলেগুলো সরে পড়ল সেখান থেকে। আজ রাতে দু-মুঠো ডাল-ভাত জুটানোর জন্য অন্য রাস্তা বেচে নিতে হবে। এই রোডে আজ আর আসবে না তাঁরা। এই সমাজে চোরের জন্য শাস্তি বরাদ্দ আছে,কিন্তু ক্ষুধার্তদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা নেই।
‘মেয়েটি বাঁকা হাসি হেসে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ভেতরের দিকে হাঁটা ধরল। ব্রিফিং রুমে ঢোকার আগে তার চোখ আটকে গেল বাইরে দেয়ালের দিকে—গত চার বছরে পাওয়া বিকৃতমুখ যৌনকর্মীদের মরদেহের ছবি সারি করে টাঙানো। নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি হিসেবে সেগুলো ঝুলছে। তবে এখানে বিস্ময়কর সত্য হলো এই চার বছরে তাদের কারো পরিচয় মেলেনি, আর না কারো নামে কোনো মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে, না কেউ তাদের খোঁজ করেছে। এটা কি কেবলই এক আশ্চর্যজনক ঘটনা? নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও ভয়ংকর কোনো রহস্য? সে বিকৃতমুখ গুলোর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে চলে যায়। তার হাসিত ছিল কিছু একটা!
‘রামপুরা, খিলগাঁও, রমনা, তেজগাঁও, সবুজবাগ, মতিঝিল—সব থানা ইনচার্জরা, সঙ্গে একজন পিবিআই প্রধান এবং সিআইডি প্রধান মিলে সকলে ব্রিফিং রুমে অপেক্ষা করছেন নিউইয়র্কে এফবিআই-এর জন্য। কেবল অনুপস্থিত একজন। ডিজিপির একমাত্র ছেলে রোহিত হত্যার তদন্তকারী সিআইডি অফিসার মাহেশ আহসান। জানা গেছে বাইক এক্সিডেন্টের কারণে সে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
‘ব্রিফিং রুমে উপস্থিত সকল আইন রক্ষকের দার ঘুরে গেলেও এখনও রোহিত হত্যার কোনো সূত্র ধরা পড়ে নি। রোহিত ছিলেন ডিজিপির একমাত্র ছেলে। অত্যন্ত আদরের। নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করার পরও যখন কোনো আশাজনক ফলাফল আসে না, তখন ডিজিপি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের আইন বিভাগের উপর থেকে ভরসা হারাতে শুরু করেন। তখন তার মন ভর করে ছোটবেলার বন্ধু মার্কিনের দিকে। যিনি ছিলেন SAC-এর একজন ভেরিফাইড এবং অভিজ্ঞ এজেন্ট।
‘মার্কিন তখন পরিবারসহ ভ্যাকেশনে সুইজারল্যান্ডে ছিল।তবুও বন্ধুর অসহায় অবস্থা দেখে তিনি হতাশ করেননি। জানালেন, তাদের ফার্মের একজন সক্রিয় ও প্রভুত্বশালী এফবিআই এজেন্ট ভ্যাকেশনে এইমুহূর্তে বাংলাদেশে আছে। পরবর্তীতে অনুরোধ করা হলো রোহিতের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করার জন্য। যদিও ব্যক্তিগত সে কারণে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত বসের কথা মেনে নেয়। আজ সেই এজেন্টই এসেছে সকল অফিসারের কাছ থেকে রোহিতের কেসের তথ্য বুঝে নিতে দ্রুত তদন্ত শুরু করতে।
‘এফবিআই এজেন্ট ব্রিফিং রুমে প্রবেশ করতেই উপস্থিত সবাই রাস্তার ছেলেগুলোর মতো মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে যায়। কারণ তার পরিধান করা জামা এতটাই ফিট যে শরীরের স্পর্শকাতর রেখাগুলো খোলাখুলিভাবে দেখা দিচ্ছিল। অর্ধেক স্ত-ন ছিল উন্মুক্ত। টাইট জিন্সে ভেসে উঠেছিল নারীকায়ার নরম আকৃতি। তার আকর্ষণীয় ফিগার দেখে উপস্থিত সবাই চোখ মেলতে ভুলে যায়। সেই সাথে তার উজ্জ্বল ফর্সা ত্বক, ধারালো চিবুক, নির্ভীক ভঙ্গি—সব কিছু মিলিয়ে সে রুমের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলে দেয় মুহুর্তেই।
‘এদিকে এফবিআই এজেন্ট কারো দিকে তাকিয়ে না দেখে টেবিল থেকে ফাইলগুলো তুলে নিল পাথরের মতো শক্ত মুখে সরাসরি কেসের ভেতর প্রবেশ করল।
“এই কেসের প্রাইম সাসপেক্টের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই।”
‘নারীর কণ্ঠের ওমন গভীর, মার্জিত আর শীতল বাক্যে হুঁশ ফিরে পেল সকলে। কেউ গ্রীবা বাঁকিয়ে গরম নিশ্বাস ছাড়ে, কেউ অস্থির হয়ে নড়েচড়ে বসে। মেয়েরা যদি জানতো তাদের পোশাকের এই খোলামেলা স্বভাবের কারণে পুরুষদের নজর ঠিক কোথায় যায়, এবং তাদের অন্তরে কী ইচ্ছা জাগে, তবে হয়তো কখনোই তারা এতটা স্বচ্ছন্দভাবে এমন বেহায়াপনা পরিধান করত না।
‘কারোর তরফ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সে পাতা উল্টাতে উল্টাতে আবারও জানতে চাইল,
“কেসের লাস্ট আপডেট কী ছিল?”
‘এতোটাস্পষ্ট বাংলা বোধহয় কেউ আশা করেনি। মুগ্ধতা আর লালসা ক্ষণিকের জন্য কেটে গিয়ে সবার চোখে শুধু বিস্ময় দেখা গেল।
‘গলা পরিষ্কার করে পিবিআই প্রধান বললেন,”দেয়ার ইজ নো আপডেট।”
‘এতোক্ষণে মুখের সামনে থেকে ফাইল সরিয়ে সে শীতল চোখে তাকাল। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পেয়ে পিবিআই প্রধান থতমত খেয়ে গেলেন।
‘সে সন্দিহান গলায় বলে,”কোনো আপডেট নেই মানে?”
‘সিআইডি প্রধান ল্যাপটপ ঘুরিয়ে দেখালেন,”এটা ছাড়া আর কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি।”
‘ল্যাপটপের স্ক্রিনে ফুটেজ দেখা যাচ্ছে রোহিতের খুনের ঠিক আগের রাতের দৃশ্য। রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে রোহিত চায়ের দোকান থেকে চা খাচ্ছিল। পাশে বসে ছিল কালো হুডি পরিহিত এক ব্যক্তি। যার উচ্চতা ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাভাবিকভাবেই চা খেয়ে সে চলে যায়। আর তার কিছুক্ষণ পরই রোহিতও চলে যায়। কিন্তু সে গাড়ির কাছে যায়নি৷ হুডি পরিহিত ব্যক্তির পিছু পিছু জঙ্গলের রাস্তার দিকে চলে গেছে। সেদিন কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না, তাই দেখা যায়নি রোহিত আসলে কোনদিকে গেছেন। আর ঠিক দুই দিন পর তার নৃশংস লাশ পাওয়া যায়।
‘সম্পূর্ণ ফুটেজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একবার দেখে নিতেই সে কাঁধ ছুঁই-ছুঁই চুলগুলো অকারণে ঠিক করতে করতে নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
“কেস তো এখানেই ডিসক্লোজড।”
‘এক মুহূর্তে বিফ্রিং রুমে নেমে এলো অস্বস্তিকর স্তব্ধতা। কেউই বুঝতে পারল না। তেজগাঁও ইনচার্জ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ঠিক বুঝলাম না… কী বলতে চাইছেন?”
“খুনি হুডি পরা লোকটা।” অতি সহজ গলায় উত্তর দিল সে।
‘পিবিআই প্রধান তৎক্ষণাৎ আপত্তি তুললেন,”কিন্তু এর কোনো স্ট্রং প্রমাণ নেই। প্রথমত, তারা একে অপরকে চিনত না। ফুটেজে আলো কম ছিল, তবুও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তারা কেউ কারও সাথে কথা বলেনি। দ্বিতীয়ত, জঙ্গলের মধ্যে দুইটা রাস্তা। তারা দু’জনই যে একই পথে গেছে এটা অনিশ্চিত এখনও। এটুকু দিয়ে কাউকে খুনি বলা যায় না।”
‘সে ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। কথাগুলো হেলায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে শান্ত গলায় বলল,”রোহিতের লাস্ট লোকেশন?”
‘সিআইডি প্রধান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”ও ফোনটা বাসায় রেখেই বের হয়েছিল…” কণ্ঠে চাপা ব্যর্থতার তিক্ততা।
‘সে আবারও ভেবে নিল সব হিসেব। ফুটেজ, পথ, আচরণ সব মিলিয়ে নিশ্চিত স্বরে বলল,
“খুনি হুডি পরা লোকটাই। আর তাকে খুঁজে বের করাই এখন আমাদের একমাত্র কাজ।”
‘সবার মধ্য থেকে সর্বাধিক আগ্রহ দেখা গেল পিবিআই প্রধানের। সম্ভবত রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী, দৃঢ়চোখের, তীক্ষ্ণবুদ্ধি এফবিআই এজেন্টকে প্রভাবিত করতেই সুযোগ খুঁজছেন তিনি। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে আগ বাড়িয়ে বললেন,
“আমরা চায়ের দোকানদারের সাথে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, লোকটাকে তার একবারও সন্দেহজনক মনে হয়নি। এছাড়াও রোহিত প্রায়ই ওখানে চা খেতে যেত।
কিন্তু হুডি পরা লোকটা সেদিনই প্রথম আর শেষবার যায়।”
“খুনি নিশ্চয়ই খুন করার পর আবার সেখানে হাজিরা দিতে যাবে না, রাইট?”
‘এতোটা সোজা, সপাটে ছোঁড়া প্রশ্ন শূন্যে বজ্রপাতের মতো নেমে এলো। পিবিআই প্রধান স্পষ্টতই ভরকে গেলেন। কণ্ঠ আটকে গেল গলায়। থমথমে গলায় বলতে চাইলেন কিছু..
“না… মানে… আমি বলতে চাচ্ছিলাম…
‘হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল কর্কশভাষী এফবিআই এজেন্ট। তার চোখে বিরক্তির ধার। ঠোঁটেও ঠাণ্ডা অপমানের রেখা। চাহনি সরিয়ে এবার সে তাকাল সিআইডি প্রধানের দিকে। গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
“হুডি পরা লোকটার কোনো খোঁজ পেয়েছেন?”
‘সিআইডি প্রধান নিঃশ্বাস চেপে বললেন,”না। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা তাকে অনেক খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। তাকে ট্রেস করার মতো কোনো ক্লু ছিল না আমাদের হাতে।”
‘শব্দগুলো শুনে কিছুক্ষণ নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে রইল এফবিআই-এর জাঁদরেল, একরোখা, কর্কশভাষী এজেন্ট। দৃষ্টি পায়ের পাতার উপর, কপালের ভ্রু-জোড়া গুছানো। শান্তমূর্তির মতো স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ পকেটে হাত রেখে, গভীরভাবে কিছু ভাবল এই ভয়ংকর সুন্দরী। তারপর সেই নীরবতার ভেতরেই বজ্রের মতো রাশভারী স্বরে নির্দেশ দিল,
“সেদিন ওই এলাকায়—ওই সময়—কতগুলো সিম সচল ছিল, সব তথ্য বের করুন। তারপর একে একে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করুন। যার ওপরই সামান্যতম সন্দেহ হয়, তাকেই কাস্টডিতে নিন। স্পেশাল থেরাপি দেওয়া হলে ভেতর থেকে সব বের হয়ে আসবে। এদিক-সেদিক সন্দেহের তীর ছোঁড়ার প্রয়োজন নেই। খুনিকে আমরা পেয়ে গেছি। এবার গলা টিপে ধরার পালা। আই ওয়ান্ট দ্যাট ফাকিং বাস্টার্ড এট এনি কস্ট। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?” বলে নির্লিপ্ত ভাবে দুই স্ত-নের মাঝে গুঁজে রাখা সানগ্লাস বের করে চোখে ঠেলে দিল। চিবুকে পাহাড়সময় গম্ভীরতা।
‘উপস্থিত সকলে স্তব্ধ। সত্যিই এতোটা গভীর, এতোটা সুক্ষ্মভাবে তারা কেউ ভেবে দেখেনি। বয়সে তাদের হাঁটুর সমান এই তরুণী এফবিআই এজেন্টকে মুহূর্তেই অন্য চোখে দেখতে শুরু করল সবাই। তাদের কথোপকথন এখানেই শেষ হলো। তাকে দেখে মনে হলো এই কেসে তার উৎসাহ সামান্যই। যেমন অনেক তথাকথিত মুসলিম নামাজ ফরজ বলে কেবল আদায় করে ফরজ পালন করে,তেমনি সেও যেন যান্ত্রিকভাবে কেসটি ‘সলভড’ করে দিতে হবে বলে সলভড করতে চাইছে। তার চোখে নেই উত্তেজনা, নেই আগুন, নেই কোনো আবেগ।
‘সকলেই যখন চেয়ার সরিয়ে উঠতে শুরু করেছে,
তখনই সে হঠাৎ বলে উঠল,
“আচ্ছা… ওই যৌ-নকর্মীদের কেসগুলো এখনও পেন্ডিং কেন?”
‘যে পিবিআই প্রধান এতক্ষণ নরম গলায় তার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করছিলেন, এই প্রশ্ন শুনে তার মুখটাই বদলে গেল। রাগ, ঘৃণা আর উগ্রতার মিশেলে তেতে উঠলেন তিনি।
“ওদের সাথে এমনটায় হওয়াই উচিত! যেমন কর্ম—তেমন ফল! যে এদের খুন করেছে, তাকে কুর্নিশ দিতে হয়!
জানোয়ারগুলো… জাহান্নামেও এদের জায়গা হবে না!”
‘রুমের চারপাশে হঠাৎ নেমে আসে অস্বস্তিকর নীরবতা। সেক্স-ওয়ার্কারদের প্রতি ঘৃণার স্রোত হঠাৎই পুরো পরিবেশটাই অন্ধকার করে দিল। এফবিআই এজেন্টের চোখ তখন অন্যরকম সংকুচিত।
“পতিতাদের সাথে শুতে খুব মজা, তাই না?” ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি টেনে সরাসরি ছুঁড়ে দিল সে। কণ্ঠে ঠান্ডা তাচ্ছিল্য।
‘লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলেও থেমে থাকলেন না পিবিআই প্রধান।
“এরাঁ মানুষ? টাকার বিনিময়ে শরীর বিক্রি করে—হ্যাঁ, অনেকেই করে। কিন্তু এরা লোভী। নিজস্ব গ্যাং আছে এদের। এঁরা যাদের কাছে শরীর বিক্রি করে, তাদেরই খুন করে সব লুটে নেয়। অনলাইনে এদের একটা সাইট আছে সেখান থেকেই কাস্টমার ধরে। এদের বেশিরভাগ কাস্টমারই হয় মধ্যবয়স্ক লোক, বড় ব্যবসায়ী আর ডির্ভোসী। একান্ত সময় কাটানোর নামে এদের ভাড়া করে বাগানবাড়ি বা নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ এরা আগে থেকেই প্ল্যান সাজিয়ে রাখে। দেহ বিলানোর আড়ালে টাকা-পয়সা, গয়না সবই তো নেয়ই,সাথে জীবনটাও। তাই তো ধরা পড়ার ভয়ে এদের দলের কেউ কোনো মিসিং ডাইরি পর্যন্ত করে না। লাশও নিতে আসে না।”
‘মেয়েটি মনোযোগ দিয়ে পুরোটা শুনল। এ সমাজে বে-শ্যাদের ধর্ষণ করা জায়েজ, অথচ সেই ধর্ষকরাই আবার গলা উঁচিয়ে তাদের বে-শ্যা” বলে গালি দেয়। কিন্তু এখানে ঘটনাটা অন্যরকম। খুবই অস্বাভাবিক। কার এমন ক্ষোভ এদের প্রতি? কেন এমন নৃশংসতা?
‘ধানমন্ডি চার নম্বরে তারা যখন শিকারীকে নিয়ে আলোচনা করছিল, তখন সে-ই শিকারীই তার শিকার নিয়ে নৃশংস উল্লাসে মেতে উঠেছে।
‘পরিত্যক্ত ল্যাবরেটরির ভেতর চারদিক চাপা অন্ধকারে ডুবে আছে। দেয়ালের পুরনো লোহার পাইপে টপটপ করে জল পড়ার আওয়াজ নিস্তব্ধতাকে আরও আতঙ্কময় করে তুলছে। ল্যাবের মাঝখানে রাখা ঠাণ্ডা ধাতব টেবিলের উপর নিথর হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটি। তার হাত-পা শক্ত করে বেঁধে রাখা। এতোটাই শক্ত করে যে নড়ার শক্তিটুকুও নেই।
‘হঠাৎ টক করে উপর থেকে একটি সাদা আলো জ্বলে ওঠে। ঠিক দন্তচিকিৎসকদের সেই তীক্ষ্ণ, ধাতব আলো। আলোটা সোজা গিয়ে পড়ে কাঁপতে থাকা মেয়েটির মুখে। চোখ সঙ্কুচিত করে মেয়েটি শ্বাস নিতে চেষ্টা করে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোয় না।
‘ধীরে ধীরে অন্ধকারের গভীরতা থেকে একটি অবয়ব এগিয়ে আসে। ক্ষীণ আলোর নিচে এসে থামতেই বোঝা যায় তার হাত দুটো সাদা গ্লাভসে ঢাকা, আর মুখে একধরনের তিক্ত কঠোরতা। তার কালো, নিঃসাড় চোখের দিকে তাকাতেই মেয়েটির চোখ ভিজে ওঠে। মেয়েটি নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ ভয়, অসহায়তা, আর অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাঁপতে থাকে তার দৃষ্টি। তবুও মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। কারণ আগেই তার জিহ্বা কেটে ফেলা হয়েছে।
‘অবয়বটি কোনো কথা বলে না। শুধু ধীরে আর স্বাভাবিক শান্ত ভঙ্গিতে পকেট থেকে একটি চিকচিকে ধাতব ব্লে-ড বের করে। আলোয় ব্লে-ডের ধারটা ঠাণ্ডাভাবে জ্বলজ্বল করে ওঠে। তারপর নীরব ল্যাবের ভেতর শুরু হয় সেই মানুষটার অন্ধকার উ-ল্লা-স। শুরু হয় তার নিষ্ঠু-র-তা আর পৈ-শা-চিক আনন্দ।
‘সে প্রথমেই সূক্ষ্ম, হিসেবি আর এমন নিখুঁতভাবে
মেয়েটির ঠোঁটের চারপাশে ব্লে-ড চালাল, যাতে মনে হয় সৌন্দর্যচর্চার ছদ্মবেশে মৃ-ত্যু-র নৃত্য শুরু করছে। ধীরে ধীরে সে ঠোঁটের চারপাশে ব্লে–ড চালাতে শুরু করল। ঠিক যেভাবে মেয়েরা লিপলাইনার দিয়ে ঠোঁট আর্ট করে থাকে। কাটা জায়গা থেকে র-ক্তের ক্ষুদ্র রেখা বেয়ে নামতেই তার ঠোঁটে সর্বসুখ আনন্দ ফুটে ওঠে। শান্ত শীতল চোখে ফুটে পরম তৃপ্তি।
‘অতঃপর ধীরে ধীরে তার ব্লে-ডের ধার বিকট নির্ভুলতায় নামল মেয়েটির ঠোঁটের গায়ে। প্রতিটি স্পর্শেই মেয়েটির শরীর নিঃশব্দ কাঁপনে টান খায় কিন্তু বাঁধা দড়ি তাকে কোনো নড়ার সুযোগ দেয় না। মেয়েটির চোখ থেকে শুধু নিঃশব্দে অশ্রু ঝরে। সে ধীরে ধীরে ঠোঁটের চা-ম-ড়া তুলতে শুরু করে। কোরবানির ঈদে যেভাবে কসাই-রা গরুর শরীর থেকে চামড়া আলাদা করে, ঠিক সেভাবে। ঠোঁটের এক কোণে একটু চাপ প্রয়োগ করার পর, তীব্র শীতে শুষ্ক ঠোঁটের চামড়া যেভাবে উঠে আসে, সেভাবে মেয়েটির ঠোঁট থেকে চামড়া উঠে আসে। ছলকে ওঠা চামড়ায় একটান দিয়ে উপরের ঠোঁটের সম্পূর্ণ চাম-ড়া তুলে ফেলল সে। পাহাড়ি কলকলে নদীর মতো র-ক্ত ঝরতে থাকে ঠোঁট থেকে।
‘অবয়বটি প্রতিটি ধাপ অদ্ভুত নি-ষ্ঠায় আর অদ্ভুত আনন্দে সম্পন্ন করে। যেন সে কোনো ভয়ং-কর শিল্প সৃষ্টি করছে, যার ক্যানভাস হচ্ছে মেয়েটির নীরব যন্ত্রণা। অবয়বটি এবার টেবিলের একপাশে রাখা ধারালো কাঁ-চি তুলে নেয়। চুল কাটার মতোই স্থির, ধীর, নিষ্ঠুর ছন্দে সে তার ‘কাজ চালিয়ে যেতে থাকে প্রথমে। তবে তৃপ্তি না মেলায় পরবর্তীতে কাঁ-চি দিয়ে সে সবজির মতো চিকন, পাতলা পাতলা করে মেয়েটির উপরের ঠোঁট কা-ট-তে থাকে। তবে ঠোঁট থেকে আলাদা করে না। সমুদ্রের তীরে যেভাবে শুটকি রোদে শুকাতে দেওয়া হয়, দড়ির সাথে ঝুলিয়ে—ঠিক সেভাবে ঠোঁ-টের কা-টা অংশগুলো ঝুলে থাকে।
‘তারপর সে কিছু অচেনা গুঁড়ো, ঝাঁঝালো, দাহ্য, মেয়েটির ঠোঁটের প্রতিটি ছিটিয়ে দিল। মেয়েটি শব্দহীন চিৎকা-রে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। অসহায় মেয়েটির নিঃশ্বাস কেঁপে ওঠে, চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ে। এখানেই তার বর্ব-রতা থেমে থাকে না। তারপর সে প্রতিটি কা-টা অংশ যান্ত্রিক নির্লিপ্ততায় ফেলে দেয় পাশের রাসায়নিক দ্রবণে। এসি-ডে ঠোঁটের কাটা কাটা অংশগুলো ফেলতেই গলে মুহূর্তেই তা লীন হয়ে যায়। সবকিছু করতে করতে তার মুখে সেই একই নিষ্ঠু-র শান্তি সেই বিকট সন্তুষ্টি লক্ষ করা যায়।
“এবার নিচের ঠোঁটের পালা।”
‘শব্দটা উচ্চারণ করার সময় অবয়বের কণ্ঠ আরও গভীর, অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মেয়েটির চোখ ভয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে। মেয়েটি পালাতে নয়, মরতে চাইছে। কিন্তু তাকে মরতে দেওয়া হচ্ছে না। অবয়বটি নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আলোটা এবার ঠিক নিচের ঠোঁটের ওপর এসে পড়ে। সে ব্লে-ডের ধার আঙুলে ঘোরায়। সেই ক্ষুদ্র ধাতব শব্দ ল্যাবের ভেতর অস্বস্তিকর প্রতিধ্বনি তোলে। অবয়বটির হাতের শীতল স্পর্শ মেয়েটির শরীরকে কাঁপিয়ে তোলে। হাউমাউ করে কাঁদতে চাই, পালাতে চাই…….
‘নিচের ঠোঁটের কাজটা সে করে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে।
এখানে তার নি-ষ্ঠুরতা শুধু শারীরিক নয় মনস্তাত্ত্বিকভাবে মাটির নিচে নামিয়ে দেয় মেয়েটিকে। সে ব্লে-ডটা মুখের ঠিক কিনারায় থামিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলে। যা শুনে নরকযন্ত্রণার চেয়েও ভয়ংকরভাবে শিউরে ওঠে।
‘মেয়েটি কেঁপে ওঠে, শ্বাস আটকে আসে, চোখ দিয়ে নিরব অশ্রু পড়তে থাকে। আর সে শুধু তৃপ্ত চোখে দেখে।দেখে মেয়েটির ভেঙে যাওয়া,নিঃশব্দ চিৎকার, ত্রাস এসবই তার প্রকৃত আনন্দ। সে একে একে নিচের ঠোটের সব র-গ টেনে-টুনে ছিঁ-ড়ে বের করে মাংসের ভেতর থেকে। তবে হঠাৎই ব্লে-ড অসাবধানতার জন্য তার হাতে লেগে অনেকটা কেটে যায়। মৃদু আর্তনাদ করে উঠল সে,
“আহহহহ…
‘বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের তালু শক্ত করে চেপে ধরে র-ক্তপাত ঠেকালো সে। অনেকটাই কে-টে গেছে। এই হাতে আর কাটাকাটি সম্ভব না। সে মেয়েটার বিকৃত মুখের দিকে বিতৃষ্ণা ভরা চোখে চেয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। অন্ধকারাচ্ছন্ন ল্যাবে মেয়েটি ওভাবেই র-ক্তা-ক্ত মুখে পড়ে রইল। শরীরে একটা ফুলের আঘাতও নেই। যা নৃশংসতা, সবই মুখে, ঠোঁটে……
‘ঘন জঙ্গলের গভীরে দাঁড়িয়ে আছে এক ভাঙাচোরা কাঠের ঘর। সময়ের ভারে কুঁজো হয়ে পড়া এক নির্বাক স্মৃতি হয়ে। ভেতরে প্রবেশ করলেই বুঝা যায় এখানে নেই কোনো জীবনের ছাপ। একটা আধভাঙা কাঠের চৌকি ছাড়া কিছুই নেই। নেই আলো, নেই বাতাস, নেই মানুষের গন্ধ।শুধুই সেঁতসেঁতে অন্ধকার আর পচা কাঠের গন্ধ। কিন্তু এই নির্জন, ময়লা, অচেনা ঘরটাতেই রয়েছে এক অসম্ভব বিস্ময়।যা এখানে থাকার কথা নয়, ভাবারও নয়। ঘরের এক কোণে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সেই দামি হাই-সিসি সুপারবাইক। বিশ্বের সবচেয়ে দামের মধ্যে একটি। যা কয়েকদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছিল। ঘরটি যতই পরিত্যক্ত, অযত্নে ডুবে থাকুক না কেন, বাইকটির ওপর নেই ধুলোর দাগ পর্যন্ত। মনে হয় প্রতিদিন কেউ এসে আঙুলের ছোঁয়ায় তাকে নতুন করে তোলার চেষ্টা করে। অন্ধকারের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে আছে বাইকটির ধাতব দেহ।
‘চৌকিটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে এক ব্যক্তি। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পোড়া সিগারেটের ঠোটলা, ব্যবহৃত ইনজেকশন, ফাঁকা ওয়াইনের বোতল৷ সমস্ত ঘরটি নেশার জঞ্জালে ডুবে আছে। বদ্ধ দেয়ালের ভেতর মদের গন্ধ এতটাই ঘনীভূত যে নিশ্বাস নিতেও ভারী লাগে। কালো হুডি পরা লোকটির চোখ বন্ধ, কিন্তু তখনও মস্তিক সজাগ ছিল৷ অচেতন এক ঘোর তাকে ধীরে ধীরে টেনে নিচ্ছে। পাশে ছড়িয়ে থাকা ড্রাগস বলছে সে মাত্রই এই বি-ষ নিয়েছে। তবে এখনও সেই শক্তিশালী ড্রাগস তাকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি; শুধু চোখের পাতা ভার হয়ে এসেছে। দেহ ঢলে পড়ছে। মাথা ঝাপসা কুয়াশায় ডুবে যাচ্ছে।
‘তার চোখের কোণ তখনও ভেজা দাগ৷ হয়তো এই নেশাও তার বুকের গভীরে গুঁজে রাখা যন্ত্রণা মুছতে পারছে না। ঘুম তাকে ধীরে ধীরে তলিয়ে নিচ্ছিল। ঠিক তখনই কানে গোঁজা ব্লুটুথে ক্ষীণ এক সংকেত কেঁপে উঠল। মুহূর্তেই তার শরীর শক্ত হয়ে গেল। চোখ দুটো হঠাৎ খুলে উঠল। এক সেকেন্ডও নষ্ট না করে সে উঠে বসল। বুঝতে পারল জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ভেদ করে কেউ প্রবেশ করেছে। দেরি করলে চলবে না। দ্রুত ডেরার বাইরে বেরিয়ে গিয়ে কয়েক গাছ দূরে এক বিশাল গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। তার দৃষ্টি সোজা স্থির হয়ে আছে আধভাঙা সেই কাঠের ঘরের দিকে। ওখানেই লুকানো আছে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি। তার শেষ স্মৃতি। তার শেষ নিঃশ্বাসের মতো প্রিয় সম্পদ।
‘কিছুক্ষণ পরেই ঘরে ঢুকে পড়ে কয়েকজন। তাদের পোশাক, আচরণ বলে দেয় এরা সাধারণ কেউ নয়। তারা ঘরটাতে তন্নতন্ন করে কিছু খুঁজতে থাকে। কিন্তু তারা আশানুরূপ জিনিসটি না পেয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় ঘরে। মুহূর্তেই লেলিহান শিখায় জ্বলে ওঠে ভাঙাচোরা কাঠের দেয়ালগুলো। আগুনের প্রথম শব্দটুকুতেই সে অনুভব করে তার বুকের মধ্যে কোথাও যেন ধপ্ করে কিছু ভেঙে গেল। ওই আধভাঙা ঘরে যা পুড়ছে, সেটা শুধু দামি সুপারবাইক নয়। পুড়ছে তার আশ্রয়, তার শেষ স্মৃতি, তার হৃদয়ের একমাত্র অমূল্য অংশ।
‘দূর থেকে দেখা যায় বাদামি চোখের সেই লোকটা—ন্যাসো। গার্ডদের সাথে কর্কশ,ধারালো ভাষায় কী যেন বলছে। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটার চোখ ধীরে ধীরে ভরে আসে। লোকেরা বলে রাজনীতি আর বাইক, দুটোই ছেলেদের আবেগ আর শখের জায়গা। আর সেই আবেগ আর শখ যখন চোখের সামনে আগুনে পুড়তে থাকে, তখন সবচেয়ে শক্ত মানুষটাও কাঁদে। তার চোখ দিয়ে যখন পানি পড়ছিল, তখন ইমামা তার রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাচছিল।
❝dilnashin naajni mahru mehjabi
yeh sab hai naam tumhare❞
‘ফোনের স্পিকারে ভেসে আসছে গান। ইমামা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লিপস্টিক ছুঁইয়ে দিচ্ছে ঠোঁটে। কথায় আছে মেয়েরা যখন প্রেমে পড়ে, তখন তারা নতুন করে বাঁচতে শেখে। হৃদয়ের ভেতর সুখ জমা হয়, আর সেই সুখের হাত ধরেই শখ জন্ম নেয়। কখনো না সাজা সেই মেয়েটিও আজ অদ্ভুত এক আলোয় জ্বলে উঠেছে। ভেতরে জমে থাকা ভালোবাসা তাকে শেখাচ্ছে নতুন করে সাজতে, নতুন করে নিজেকে দেখতে। ইমামাও আজ ঠিক তেমনই নিজের আনন্দে, নিজের প্রেমে, নিজের সাজে উজ্জ্বল।
‘ও গুনগুন করে গানের সাথে ঠোঁট মেলাচ্ছিল আর নিজের মনের আনন্দে সাজছিল। উল্লেখিত লাইনটা গাওয়ার মুহূর্তেই হঠাৎ মনে হলো লাইনগুলোর সাথে সেই লোকটা যে ধরা দিয়েও ধরা দেয় না, অথচ স্পর্শ থাকে, কিন্তু নাগাল থাকে না তার অদ্ভুত মিল। কুয়াশার ভেতর জোনাকির মতো লুকিয়ে থাকা মানুষটাও তো তাকে এভাবে নানান নামে ডাকে। একেক সময় একেক নামে ডাকতে ডাকতে তাকে শিহরিত করে দেয়। তার প্রতিটি ডাকে, প্রতি বারই নারীহৃদয় তরঙ্গে কেঁপে ওঠে।
‘হঠাৎ করেই রমণীর দুলে ওঠা বুকের ভেতর উষ্ণ সুখ জমল। সাঁঝের শান্ত হাওয়ার দোলায় দুলতে দুলতে জাফরনের লালচে আভা এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল তার আদুরে নাকের টিপ। সব সময় গম্ভীর থাকা মেয়েটা অকারণেই মিটিমিটি হাসছে। এগুলোই তো প্রেমের লক্ষণ। মেয়েটা সব বুঝেও কেন যেন সত্যটার সঙ্গে পুরোপুরি মুখোমুখি হতে চাইছে না। আবার এই সত্য থেকে পালাতেও চাইছে না। অদ্ভুত এক খেলা চলছে এখানে।
‘এরপরের দুই লাইন ইমামা প্রায় নেচে নেচেই গাইল।
দুহাত পিছনে কোমরে রেখে কাঁধে তাল দিয়ে গানের ছন্দে শরীর দুলিয়ে নিখুঁতভাবে আয়নার সামনে নাচতে লাগল আর মনের আনন্দে গলা ছেড়ে মিহি কণ্ঠে গাইল,
❝mere itne sare
nam hai jab tum yeh kehte ho
achche lagte ho❞
‘মিহি কণ্ঠের সুরেলা সুর তখনও অস্তরাঙা সন্ধ্যার হিমেল হাওয়ায় লেগে ছিল। এই মধুরঙ্গ সুর মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আচানক পিনপতন নীরবতায় ঘেরা কক্ষে ধ্বনিত হলো একটি পুরুষালী বিমুগ্ধ কণ্ঠস্বর,
❝tum mujhe Aschi lagti ho❞
‘ঘটনার আকষ্মিকতায় চমকে উঠে কেঁপে উঠল ইমামা। তড়িৎ প্রবাহের মতো পিছন ঘুরল। বিস্ফোরিত দৃষ্টি জোড়া ছুটল ঘরের আনাচে-কানাচে। না কোথাও কেউ নেই। ইমামা শুষ্ক ঢোক গিলে। নির্ভীকতার আড়ালে দণ্ডভোগী স্পন্দনে সে কাঁপা কণ্ঠে শুধায়
“ক-কে?”
‘আবারও সেই ঠাণ্ডা যন্ত্রস্বরূপ কণ্ঠ,”Someone you should fall, red” তবে পরিচিত ডাক৷’
‘ইমামা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। পরমুহূর্তেই আগুনের মতো জ্বলে উঠল,”আপনি আবার আমার রুমে ক্যামেরা লাগিয়েছেন? আর এই স্পিকার! কোথায় লাগিয়েছেন? লিসেন, আই নিড প্রাইভেসি,ওকে?”
‘যান্ত্রিক স্পন্দনযুক্ত কণ্ঠ এবার সামান্য খাদে নামল। প্রায় ফিসফিস করে আওড়ানো শব্দে জবাব এল,
“প্রাইভেসি তো দূরের মানুষের জন্য। আপনার জীবনে আমি আছি ঘাড়ের রগের মতোই খুব কাছে, এলিজান আমার।”
‘তাৎক্ষণিকভাবে ঝিমঝিম বিদ্যুতের ঝাপট নারীর শরীরের প্রতিটি কোণ স্পর্শ করে ছড়িয়ে পড়ল। ইমামা তার দৃঢ়তাপূর্ণ কণ্ঠে যারপরনাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। লোকটার কথা আর ডাকগুলো জাদুর মতো। মুহূর্তের মধ্যে তার সচল মনকে স্থির করতে পারে, রাগের সব কারণ ভুলিয়ে দিতে পারে তার কণ্ঠের স্পর্শে। কণ্ঠ গভীর আর আবেগশূন্য, তবে জাদুময়। মাদকের মতো তীব্র সেই কণ্ঠের রেশ।
‘এক অনিন্দ্য ঘোরে ইমামা নিজেই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল,”আপনি কি সবাইকে এতো সুন্দর নামে ডাকেন?”
“নো। আই ডোন্ট কল এভরি উমেন সুইটহার্ট, বেবি, ডার্লিং, এলিজান, রেড, হানি…আই ওনলি গিভ নিকনেমস টু মাই উম্যান।”
‘ইমামা নিভে গেল। অজান্তেই ঠোঁটের এক কোণ নেচে উঠল। কিন্তু জমে থাকল না। গোয়েন্দাসুলভ চোখে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে হাঁটতে শুরু করল। হঠাৎ তার নজর গিয়ে ঠেকল কেবিনেটের ওপর রাখা পুতুলটায়। ইমামা একটু নড়ল৷ ঠিক সেই সঙ্গে পুতুলটার মাথাও নড়ল। বুঝতে পারল পুতুলটার ভেতর ক্যামেরা আছে। এর আগেও সে ঘরের নানা কোণ থেকে এমন ক্যামেরা উদ্ধার করেছে। হঠাৎ ইমামার ঠোঁটের কোণে বাঁকা একটি হাসি ফুটল। ডোলা ডালা টাউজার আর হুডি পরে সে জিমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। অনেকদিন হয়ে গেছে জিমে যাওয়া হয়নি। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে তার চিন্তায় হঠাৎ খানিকটা পরিবর্তন আসে।
‘ইমামা কেবিনেট থেকে কিছু জামা বের করে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে এলো। কিন্তু এবার পোশাকে বিরাট পার্থক্য। ঢিলে ঢালা টাইজারের পরিবর্তে এবার নিচে পড়েছে চামড়ার সঙ্গে সিটকে থাকা টাইট ও স্ট্রেচি লেগিংস, উপরে ট্যাং টপ। শরীরের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি একদম স্পষ্ট। কোমড় ছাপানো লাল চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা।ফলে উন্মুক্ত হয়ে গেছে কাঁধ, গলা, ঘাড়। ইমামা ইচ্ছাকৃতভাবে ক্যামেরার সামনে দিয়ে হেঁটে শর্টস পরতে থাকে। ওকে এভাবে অশালীন পোশাকে দেখে ওপাশের মানুষটার হিংস্র গর্জন দেয়ালের প্রতিটি কোণে বারি খেতে থাকে।
“রেড, নো। আই সেইড নো…
‘ইমামা উঠে দাঁড়াল। ক্যামেরার সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,”মাই লাইফ, মাই রুলস।”
‘বলে হাতে একটা জ্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে গেল। তারপর কিছুক্ষণ নিরবতা। শুধু শোনা যায় গরম নিঃশ্বাসের শব্দ। অতঃপর পুরুষালি হাস্কি স্বর:
“ইয়্যু আর হটার দেন আই ইমাজিনড… আও্যার মিটিং উইল বি অ্যামেজিং, মাই ফাকিং ডার্ক রেড।”
❌
‘সকলে চেষ্টা করবেন গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে মন্তব্য করার। নাইস, নেক্সট পার্ট এসব মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন। এতো পরিশ্রম করে লিখে এমন দেখলে মেজাজ আর লেখার আগ্রহ, দুটোই হারিয়ে যায়। যারা রচনার মতো লিখে গল্পের খুটিনাটি বিষয়গুলো কথা বলে তাদের চুমুওও😘।
born_to_be_villains
methuburi_মিথুবুড়ি
পর্ব_১৪(বর্ধিতাংশ)
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌
‘ভিড় আর কোলাহলের ভিড়ে দমবন্ধ লাগে যে মানুষটির, সেই ইমান ওয়াসিম নিজের স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তুলেছেন শহর থেকে অনেকটা দূরে, এক নির্জন ঢালু অঞ্চলে। এলিট জীবনের চাকচিক্য পিছনে ফেলে চাঁদনী আকাশের নরম আলোয় দাঁড়িয়ে আছে ওয়াসিম ভিলা।
‘সন্ধ্যার শীতল বাতাসে ভর করে নেমে আসছে ডিসেম্বরের কাঁপুনি। চারদিকের হিমেলতা যেন নিঃশব্দে গায়ে জড়িয়ে ধরছে ইমামাকে। পরণের জ্যাকেটের চেইন টেনে গেইট পেরোয় সে। গাড়ি নেয়নি সাথে। ওয়াসিম ভিলা থেকে জিমের পথটা ঢালু হলেও খুব বেশি দূরত্ব নয়। ঢাল বেয়ে নিচে নামলেই সরু রাস্তা। আর তার ঠিক অপর পাশে জিমের উঁচু কাচঘেরা ভবন। ইমন সাথে আসতে চাইছিল। কিন্তু ইমামা রাজি হয়নি। পর অবচেতন মন বলছে আজ কিছু হতে যাচ্ছে।
‘রাস্তার দুইধারে দাঁড়িয়ে থাকা ঘনসবুজ গাছগুলো জঙ্গলের মতো নিস্পন্দ। দু’কদম এগোতেই হঠাৎ পুরো পরিবেশে ঘনকালো আঁধার নেমে এল। একসঙ্গে নিভে গেল রাস্তার পাশের সব আলো। ইমামা চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন তাকিয়ে দেখল ওয়াসিম ভিলাও ডুবে আছে একই অস্বাভাবিক অন্ধকারে। ও ভাবল হয়তো বিদ্যুৎ বিভ্রাট। যদিও এমনটা বছরে একবারও ঘটে না।
‘তবুও সে হাঁটা থামাল না। চাঁদের স্বচ্ছ আলো পথ চিনতে যথেষ্ট ছিল। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালানোর প্রয়োজনও হয়নি। অথচ তার করুচিপূর্ণ পোশাকের আড়ালে থাকা প্রতিটি অঙ্গরেখাকে শহরের কদর্য চোখ থেকে রক্ষা করতে সমগ্র শহরের বিদ্যুৎ সংযোগ জোরপূর্বক ছিন্ন করে দেওয়া হলো, নির্বোধ সে তা জানতেই পারল না তার নিরাপত্তার বিনিময়ে আলোহীন এক নগরী ঢেকে গেল গভীর অন্ধকারে।
‘ইমামা হাঁটতে হাঁটতে ফিরে গেল সেদিনের সেই বিচিত্র মুহূর্তে। যেদিন তার অবচেতন মনই তাকে জানিয়ে দিয়েছিল লোকটা তার ফোন হ্যাক করেছে। প্রথমে বিক্ষিপ্ত রাগে একের পর এক কল করছিল সে। কিন্তু কেউ ফোন তোলে না, রিভিউও করে না। ধীরে ধীরে ইমামার ভেতরে জমতে থাকা রাগ আগুনের মতো ফেটে উঠছিল। কয়েকবার মনে হয়েছিল ফোনটাই ছুড়ে ভেঙে ফেলবে। কিন্তু পরক্ষণেই মাথায় এসে যায় যে একবার হ্যাক করতে পেরেছে, সে চাইলে বারবারই করবে।
‘ঠিক তখনই হঠাৎ তার খোলা জানালার ফ্রেমে চারটে হাত একসাথে ভেসে উঠল। ভয়ে শরীরের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল ইমামার। হাত ফসকে ফোন মেঝেতে পড়ল। কিন্তু পরের সেকেন্ডেই আতঙ্কের জায়গায় আসে বিস্ময়। জানালার ওপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে দুই পরিচিত মুখ। ইবরাত আর হিয়া। মই বেয়ে উঠে আসা সেই দু’জন এক লাফে রুমে ঢুকে ইমামাকে জড়িয়ে ধরল। হিয়া ইবরাতের মতোই কেঁদে কেঁদে নিজের ভুল স্বীকার করল, ক্ষমা চাইতে লাগল। ইবরাত মাথা নিচু করে চুপ ছিল। হতবিহ্বল ইমামা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। তবে এটা স্পষ্ট ওদের এই হঠাৎ আচরণের পেছনে অদৃশ্য কারিগর সেই লোকটাই। সেটা তখনও তার অজানা।
‘বিহ্বল ইমামা তখন নিজেও নিজের আবেগ সামলাতে পারেনি। হঠাৎ করেই ওদের জাপ্টে ধরে কেঁদে উঠেছিল। তিনজনের কান্নাকাটির সেই ছোট্ট ঝড় থেমে গেলে ইবরাত আর হিয়া হঠাৎ জানাল আজ রাতে তারা লং ড্রাইভে বের হবে। ইমামা তড়িঘড়ি করে আপত্তি জানাল। যদিও মধ্যে রজনীতে খোলা আকাশের নিচে, বন্ধুদের সাথে লং ড্রাইভে যাওয়ার ইচ্ছে তার বহুদিনের। তবে বাবার কঠোরতা আর মায়ের কর্কশ আচরণের কাছে কখনোই সে কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনি। ইচ্ছে ছিল, তবে সাহস ছিল না।
‘তবে তার সেই ইচ্ছে পূরণ হয় সে রাতে। সে রাতে আর কেউ তার নিষেধাজ্ঞা শুনেনি। তার নিষেধ যেন ওদের কানেই পৌঁছায়নি। জোর করে হাত ধরে মই দিয়ে সাবধানে নিচে নামিয়ে আনে ওরা। গার্ডগুলো ইমান ওয়াসিমের নিয়ন্ত্রণে ছিল না বিধায় কেউ ওদের দেখেও কিছু বলেনি। সেদিন যেভাবে ইমামা চুপিসারে বের হয়েছিল, ঠিক একইভাবে বের হল তিনজন। আর আশ্চর্যের বিষয় হুবহু সেই জায়গাতেই, একইভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেই কালো গাড়িটা।
‘বন্দিত্বের বুক ফুঁড়ে যখন নিজের বহুদিনের অব্যক্ত ইচ্ছে হঠাৎ বাস্তব হয়ে উঠল, তখন আর নিজেকে থামাতে পারেনি ইমামা। গাড়িটাকে দূর থেকে দেখেই চিৎকার করতে করতে ছুটে যায় সে। সেদিন ড্রাইভটা করেছে ইমামা নিজ হাতে। রাত চারটার পর তারা ফিরেছিল। সেই অবিস্মরণীয় রাত ইমামা কখনোই ভুলবে না।
‘সেদিন পৃথিবীর সব শেকল খুলে গিয়েছিল। কোনো গার্ড ছিল না, কোনো বাঁধা ছিল না, কোনো নিয়মের শীতল শাসন ছিল না। তিন বান্ধবী ঠিক যেন রাতের আকাশে মুক্তি পাওয়া হালকা, উচ্ছ্বসিত, স্বাধীন তিনটি পাখি। তারা রাস্তায় নেচেছে, উচ্চস্বরে গেয়েছে, হাসির ঢেউয়ে কাঁপিয়েছে নির্জন রাতকে। মাঝরাস্তায় হুট করে থেমে গেছে গাড়ি। তারপর তিনজনই ছুটে নেমে পড়েছে টলমলে অন্ধকারের ওপর। কেউ মাথা রেখে শুয়ে থেকেছে ঠাণ্ডা রাস্তায়, কেউ হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চেয়েছে তারাভরা আকাশকে। টংয়ের দোকানের হলুদ আলোয় বাষ্প ওঠা রং চায়ের স্বাদে ছিল বুনো স্বাধীনতার গন্ধ। আর তাদের এই উন্মুক্ত উড়াল পাহারা দিচ্ছিল সেই ঈগল। গাড়ির চাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছিল সে তীক্ষ্ণ এক রক্ষক হয়ে।
‘আর ঠিক এভাবেই শেষ রাতের ঘন আঁধারের সঙ্গে গলে মিলিয়ে গিয়েছিল ইমামার জমে থাকা সব রাগ। লোকটাকে তো আর সে শুধু শুধুই ঝোপের আড়ালের ধুরন্ধর বাঘ বলে না। সেদিন বাড়ি ফিরেও ইমামা কিছুতেই ঘুমোতে পারেনি। আনন্দের ঢেউ তখনও তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বন্ধুদের উচ্ছ্বসিত হাসি কানে বাজছিল, আর চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল তার হাসিমাখা মুখ। যেটা সে গত কয়েক বছরে দেখেনি।
‘চুপচাপ শুয়ে থেকে শুরু থেকে সবটা ভাবছিল ইমামা। অনেক ভাবার পর একটা সময় হঠাৎই বুঝতে পারল এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনটা যেন নিঃশব্দে গুছিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছিল আড়াল থেকে কেউ দৃঢ় হাতে তার ছড়িয়ে থাকা সবকিছু ঠিকঠাক সাজিয়ে দিচ্ছে।
‘কেউ একসময় বলেছিল,
“দুনিয়ার সবাই আপনাকে ভাঙতে চাইবে, আমি একা আপনাকে গড়ে তুলব।”
‘হ্যাঁ, লোকটা এখন ঠিক সেই কথাটাই সত্যি করে দেখাচ্ছে। দূরে থেকেও সে ইমামাকে ভালোবাসার এমন কোমল অনুভবে ঢেকে রাখছে, যা থেকে ইমামা নিজেকে সরাতে পারে না। একসময় যার কথা তাকে শুধু বিভ্রান্ত করত, বদমেজাজী মনে হতো—আজ মনে হচ্ছে লোকটা সত্যি। তার ভালোবাসার ভেতরেও আছে এক অদ্ভুত জাদু। আর সেই জাদুর উৎস একটাই, তাকে গুছিয়ে দেওয়া, তাকে ভালো লাগা। আর কোনো দ্বন্দ্ব নয়। এবার স্পষ্ট তার উদ্দেশ্য ভালো।
‘একসময় যে অচেনা নম্বরের কল আর হুমকি তাকে কুরে কুরে খেতো, এখন সেসব আর আসে না। যে মায়ের কর্কশ শব্দে তার বুক হুহু করে উঠত, কান্না চেপে রাখতে রাখতে গলা শুকিয়ে যেত; তবুও সে বেহায়ার মতো একটু আদরের আশায় মায়ের কাছে ছুটে যেত। কিন্তু এখন আর যেতে হয় না। এখন আর সে আদরের সামান্য টুকরোর জন্য তৃষ্ণার্ত থাকে না। এখন তার মনে হয় সারাক্ষণ কেউ তাকে নরম, অদৃশ্য স্নেহে আচ্ছন্ন করে রাখছে। একটা সময় যে বন্ধুরা ভুল বুঝে দূরে সরে গিয়েছিল, তারা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। স্বল্পভাষী ইমামার আর একা লাগে না। তার মনে হয়, সারাক্ষণ কেউ তার পাশে হাঁটে। তার নিঃশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে কেউ আছে নীরবে। তার একাকী জীবনের সঙ্গী হয়েছে মায়া, আর……
‘সে এখন আর কাঁদতে পারে না। কাঁদতে দেওয়া হয় না তাকে। তার মনে হয় তার চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু ঝরলেই কারোর বুকের ভেতর তীব্র ঝড় উঠে। কারোর মাথায় আগুন চেপে বসে। এখন সে স্বাধীনভাবে হাঁটতে পারে। রাস্তায় কেউ আর তাকে বাঁকা চোখে মাপে না। গায়ের ওপর অবাঞ্ছিত স্পর্শের ছায়া নামে না। সে প্রথমবারের মতো নিজেকে এতোটা নিরাপদ মনে করছে। কারণ কেউ একজন দূর থেকে পাহারা দেয় তাকে অদৃশ্য ঢাল হয়ে।এখন তার জীবনে এমন একজন মানুষ আছে, যাকে সে যেকোনো সময় কাছে পায়। তাদের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব থাকলেও মানুষটা তাকে প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করায়,
সে আছে। পাশেই আছে।
‘লোকটা জাদুঘর। সত্যিই জাদুঘর। কাকে কীভাবে কাবু করতে হয়, কীভাবে হৃদয়ের গভীরতম জায়গায় নরম করে আঘাত করতে হয়, তা সে নিখুঁতভাবে জানে। রাগ গলে গিয়ে ভোরবেলা ইমামা তাকে কল করেছিল। ধীর কণ্ঠে শুধু একটাই প্রশ্ন করেছিল,
“আমি কি সত্যিই এত ভালোবাসার যোগ্য?”
‘ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর খুব স্থির, গভীর সুরে উত্তর এলো,
“ভালোবাসা অদ্ভুত এক জিনিস। যাকে দেয়, সবটা দেয়। আবার কারো কাছ থেকে কেড়ে নেয় সবটা। আপনাকে আমি সবটা দিতে প্রস্তুত, এলিজান।”
‘সেদিনের সেই অমলিন ক্ষণ,অমৃত স্মৃতি আর গুরুগম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠের বিমুগ্ধ সে বাক্য আজও শ্রুতির কিনারায় গভীর মন্ত্রোচ্চারণের মতো প্রতিধ্বনি তোলে৷ রূপলাবণ্যে মত্তা নারীর পাথর-ঢাকা কোমল মুখশ্রীতে ফুটে ওঠে নরম দীপ্তি। রক্তাভ আদুরে ঠোঁটের এক কোণ ঢলে পড়ল শিরশিরে অনুভূতির তাড়নায়। ইমামা এখন অনুভব করছে, গভীরভাবে অনুভব করছে অন্ধকারের কিনারায় দাঁড়ানো সেই অচেনা পুরুষটিকে। সে নত স্বীকার করছে ভালোবাসার কাছে। সবশেষে সে-ও ভালোবেসে ফেলেছে তাকে। তো যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে নিশ্চয়ই একটু বাজিয়ে দেখাও যায়, তাই না? সুতরাং আজ দেখা যাক তার জেলাসি লেভেল!
‘ইমামা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ খেয়াল করল তার বরাবর একটা মানব ছায়া হাঁটছে তার সাথে। তৎক্ষনাৎ সর্তক হল সে। সচকিত চোখের মনিযুগল ঘুরিয়ে মন্থর গতিতে গ্রীবা বাঁকিয়ে পাশে তাকায় সে। সেই মুহুর্তে ওর নিশ্বাস আঁটকে ছিল বুকের ভেতর। তবে সেখানে কোনো ভয় ছিল না। ছিল হৃদয়ের দোলাচাল। মনমঞ্জিল থেকে আভাস আসছিল হয়তো সে হবে! সেই লোকটা নিশ্চয়ই আজ সামনে আসবে। এসে কঠিন গলায় শাসিয়ে বলবে,”আই ইয়্যু আউট অব ইয়্যুর মাইন্ড?” তারপর তীব্র অধিকারসুলভ নিজের গায়ে চাপানো কালো ওভারকোট দিয়ে তাকে ঢেকে দিবে। অতঃপর দৃঢ়বদ্ধ বেষ্টনে চেপে ধরে সকল অশুভ দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য করে ফেলবে৷
‘কিন্তু না,অপ্রকাশ্য রহস্যে ঢেকে থাকা মানুষটি আজও আসেনি রমণীর শুষ্ক হৃদয় প্রেমোবর্ষণের বানভাসি জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে হলো বাতাসের মতো। শরীর ছুঁয়ে দেয়, অস্তিত্ব টের পাইয়ে দেয়৷ তবু ধরতে গেলে আঙুল ফাঁকি দিয়ে মিলিয়ে যায়। সে থাকে, কিন্তু ছোঁয়া যায় না; শুধু অনুভবের নিঃশব্দ স্পর্শে বেঁচে থাকে।
‘ইমামা আলগোছে ভারি শ্বাস ফেলে সর্দপনে প্রশ্ন ছুঁড়ে,”আপনার নাম যেন কী?”
‘ইমামা ছিল রাস্তার ডান পাশে। আর ছায়া মানব ছিল বামে।তাও রাস্তা ছাড়িয়ে গাছের সরু লাইন ধরে সরু দীর্ঘ পদযুগল ধীর কদমে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল। ছায়ায় মোড়া সেই নীরব মানব হয়তো ভাবেনি এতো সহজে ধরা পড়ে যাবে। আর ধরা পড়ে গেলেও যে চিৎকার চেঁচামেচির পরিবর্তে সপাটে এমন প্রশ্ন তেড়ে আসবে, তা যে ছিল কল্পনীয় সেটা তার ভেবাচেকা খাওয়া অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠে। মেয়েটা যে খুব চালাক সেটা সে এতোদিনে বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সবসময় বসের দেওয়া সর্তকবাণী— ‘ওর থেকে সাবধানে থাকবে অলওয়েজ। ’শি ইজ স্লাই, সলিড অ্যান্ড ইম্পসিব্ল টু ফুল’ এর যথাযথ কারণ খুঁজে পেল।
‘সামান্য গলা খাঁকারির শব্দ শোনা গেল। তারপর বাতাসে মিশে এল বেগবান কণ্ঠের নিচু স্বর,
“নিকোলাস। নোন অ্যাজ ন্যাসো।”
“ওই-যে আরেকজন ছিল, মোটা করে…… তার নাম?”
‘গুদামের বস্তার মতো দেখতে সুস্বাস্থ্যবান আর অমাবস্যার অন্ধকারে ঢাকা লোকটাকে সরাসরি ‘কালো’ বলতে পারছিল না ইমামা। ওর ইতস্তত ভাব বুঝতে পেরে ন্যাসো নিজে থেকেই বলল,
“ওর নাম লুকাস।”
“ওটাকে কোন দেশ থেকে আমদানি করেছে আপনার বস?”
“লোকা আফ্রিকান।”
“ওহ, আই সি।”
‘আবার নিস্তব্ধতা। ন্যাসো যান্ত্রিক ভঙ্গিতে উত্তর দিয়ে এমনভাবে চুপ করে গেল যেন তার অস্তিত্বই নেই এখানে। ইমামা শেষমেশ নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল,
“তা আজ আপনার বস কেন পাঠিয়েছে আপনাকে?”
‘সেই একই ঠান্ডা, রোবটিক স্বর,”আপনাকে নজরে রাখার জন্য।”
“কিন্তু আপনি তো চোখ বন্ধ করে হাঁটছেন।”
‘কথা শেষ হতেই সামনের ছোট্ট গর্তে হুড়মুড় করে পড়ে গেল ন্যাসো। বসের কমান্ড ফলো করতে গিয়ে এভাবে এক মেয়ের সামনে লজ্জায় পড়তে হবে এটা বোধহয় তার ক্যালকুলেশনে ছিল না। মৃদু শব্দ করে উঠে ন্যাসো। কিন্তু ইমামার হাসির শব্দ শুনে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। শরীর ঝেড়ে শুকনো পাতা আর মাটি ফেলতে লাগল তড়িঘড়ি।
‘নিজেকে ঠিক করতে করতে ইতস্তত কণ্ঠে বলল,”স্যরি,, বাট আই লাভ মাই ব্রাউন আইস।”
‘ইমামা হাসি গুটিয়ে নিল। নিজের মতো হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“আমার একটা কাজ করবেন?”
‘আবার সেই রোবটিক কণ্ঠ,”অফর্কোস, ম্যাম।”
“আজ আপনাকে আপনার বসকে মিথ্যা বলতে হবে।”
“স্যরি ম্যাম।”
“আচ্ছা, দু’টো।”
“স্যরি ম্যাম।”
“আচ্ছা একটা?”
“নো ম্যাম।”
“প্লিজ?”
“স্যরি ম্যাম।”
‘ইমামা বিরক্তও হলো, “আচ্ছা, তাহলে বলুন আজ আপনাকে ঠিক কোন কাজে পাঠানো হয়েছে?”
‘ন্যাসো এবার একদম যন্ত্রের মতো বলল,”পুরো শহর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। তাই বস আপনাকে দেখতে পারছে না। আমার ডান কাঁধে ক্যামেরা আছে। আপনি রেকর্ড হচ্ছেন, ম্যাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুটেজ বসের কাছে পৌঁছে যাবে।”
‘ইমামা মনে মনে মুখ বাঁকাল। দরদী ভালোবাসা এমন উথলে উঠেছে যে এক মুহূর্তও চোখের সামনে না দেখলে চলে না। অথচ কাছে আসতে পারে না। যত্তসব নাটক!
‘কিছুক্ষণ চিন্তা করে ইমামা ধীর গলায় জিগ্যেস করল,”তা আপনার বস কি বলেছে জানা যাবে?”
“বলেছে—শহরের বুকে হেঁটে যাচ্ছে তার ব্যক্তিগত নারী। যাকে দেখার এখতিয়ার রয়েছে শুধুমাত্র তার। তিনি ছাড়া সকল পুরুষের জন্য আপনি হারাম।”
‘ইমামা জিমে পা রাখতেই দু’টি অদ্ভুত ঘটনা একসাথে ঘটল।প্রথমত, তার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলো বিদ্যুৎ।টিমটিম করে জ্বলে উঠল সব লাইট, সচল হলো সব ক্যামেরা। দ্বিতীয়ত, গোটা জিম অস্বাভাবিকভাবে ফাঁকা। কাকপক্ষীও নেই।৷ শহরের এমন নামকরা জিম হঠাৎ এত নির্জন বিষয়টা কোনোভাবেই হজম করতে পারল না ইমামা। আর যদি আজ সত্যিই অফ-ডে হতো, তাহলে গেট তার জন্য খোলা থাকত না নিশ্চয়ই!
‘প্রশ্নগুলোর ভিড়ের মাঝেই ইমামা ঠোঁট অদ্ভুতভাবে তুষ্ট হেসে উঠল। ধীর হেসে গা জ্যাকেট খুলে এক পাশে রাখল। তারপর কানে এয়ারপিচ লাগিয়ে ট্রেডমিলের ওপর দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করল।
‘ওদিকে মনিটরিং রুমে চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করে বসল একজন। তার সামনের বিশাল স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে ইমামাকে। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। তবে এই সিগারেটের থেকেও বেশি পোড়ায় সামনের মেয়েটির। মেয়েটার সৌন্দর্য তার ইস্পাতের মতো ধারালো নিয়ন্ত্রণে কম্পন তোলার জন্য যথেষ্ট। ডিসেম্বরের ঠান্ডায়ও উত্তাপ ছড়ানো রমণীর শরীরের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে গরম নিঃশ্বাস বের হয় তার ভেতর থেকে। গলার টাই টেনে খুলে ফেলল সে।
‘তবে হঠাৎ ফায়ার স্প্রিংকলার থেকে টুপটাপ তরল ঝরতে শুরু করল। শুধুমাত্র ইমামা দাঁড়িয়ে থাকা কর্ণারটি বাদে। কপাল কুঁচকে পায়ের গতি থামিয়ে স্থির হয়ে গেল ইমামা। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ক্যামেরার দিকে তাকাতেই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল রিচার্ডের অধরকোণে। মুহূর্তেই সে হাতে থাকা সিগারেটের শলা ছুঁড়ে ফেলল। ঠিক তখনই বাংলাদেশের নামকরা সেই জিমের কাঁচ ভেদ করে জ্বলন্ত একটি সিগারেটের শলা ভিতরে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আগুন দাউ দাউ করে উঠল। দূর থেকে ছায়ামুখো কাউকে দৌড়ে পালাতে দেখা গেল।
‘আগুন দেখামাত্র শিরদাঁড়া বেয়ে শীত নেমে গেল ইমামার। ঠিক সেই মুহূর্তে আগুনের লালাভ আলোয় থরথর করে ওঠা জিমজুড়ে বজ্রকণ্ঠের মতো গর্জে উঠল কেউ,
“এই আল্লাহ বান্দি এই, শুনে রাখ—ইয়্যুর লাইফ, মাই রুলস, ওকে ডার্লিং? অ্যান্ড ইফ আই সে নো… দ্যান নো মিনস ফাকিং নো, গট ইট মাই ফাকিং ডার্ক রেড?”
‘আগুন দেখে যতটা না ভয় পেয়েছিল, তার চেয়েও বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল স্পিকারের মধ্য দিয়ে ভেসে আসা হুংকার। ইমামা পিছাতে গিয়ে ছিটকে পড়ে গেল। আগুন ক্রমশ তার দিকে তেড়ে আসছে। ভয়ে এককোণে গুটিয়ে বসল ও। জবুথবু হয়ে কাপছে পুরো শরীর। ও ভেবেছিল কিছু একটা ঘটবে, কিন্তু এতো ভয়ংকর হবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি। হঠাৎ ধোঁয়া আর অগ্নির মধ্যেই যে তখনকার নিস্তব্ধতার ভেতরে লুকানো বিশাল ঝড়ের আভাস ছিল, তার নিম্ন মস্তিষ্ক সেটা এখন ধরতে সক্ষম হয়।
‘ইমামা কাঁপতে কাঁপাতে বলে,”আপনি কি আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চাইছেন?”
‘প্রত্যুত্তরের পরিবর্তে আসে বিদঘুটে হাসির ঝংকার। আগুন এখনও ওর থেকে অনেকটা দূরে থাকলেও তাপ ওর নরম চামড়া ছুঁয়ে দিচ্ছে। দিশেহারা সে এদিক-সেদিক তাকায়। কিন্তু না…কেউ নেই।
‘ইমামার চোখে ভয়। ও কাঁপা কাঁপা গলায় আবার বলে,”আপনি না আমাকে ভালোবাসেন?”
‘দাঁতে দাঁত পিষার ফলে যে ঘর্ষণ তৈরি হয়, সে ঘর্ষণের সাথে এলো জবাব,”দ্যাটস ফাকিং ট্রু। ইফ ইট’স কম টু মাই ইগো
দেন দ্য হোল গেম বিকাম ওয়ান সাইডেড। যেটা আমার, সেটা শুধুই আমার। আমার দেখার জিনিস শুধু আমিই দেখবো।”
‘বিশাল এক শব্দ ধ্বনিতে ভেসে উঠল। হয়তো পাশের কর্ণারে কিছু ব্লাস্ট হয়েছে। আগুনের উত্তাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। শরীরের মাংস যেন এবার গলে পড়বে। ইমামা পিছতে পিছতে কাঁচের পাশে গিয়ে ঠেকল। যত পিছায়, আগুন ততই তাড়াহুড়ো করে এগোয়। ওর কোনো অনুরোধ, আর্তনাদ হৃদযন্ত্রহীন পাষাণ লোকটির কানেও লাগে না। চোখের এক ফোঁটা অশ্রুও তার পাথরের মতো শক্ত বুকে কোনো দাগ কাটতে পারে না।
‘একটা সময় ইমামা রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,”ভেবেছিলাম আপনার প্রেমে পড়বো। অলমোস্ট পড়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু না…আই ওয়াজ আ ফাকিং ফুল। আপনারে মতো শয়তানের সাথে প্রেম হয়না। হার্টলেস কোথাকার।”
“উফফস, এলিজান…প্রেমে আপনি তো পড়বেনই, সাথে আপনার বাবাও পড়বে, মিস বিউটিফুল।”
‘ইমামা চমকে ওঠে। ভুরু কুঁচকে ওঠে,”বাবা পড়বে মানে! আপনি গে?”
“হোয়াট রাবিশ।”
“ছিঃ।”
“শাটআপ।”
“আপনি গে৷”
“জাস্ট ফাক অফ।”
“না আপনি গে।”
“ফালতু কথাবার্তা।” চিড়বিড় করে সে৷
“তাহলে প্রমাণ দিন আপনি গে না!”
“কী প্রমাণ।”
“এক্ষুণি আগুন নেবানোর ব্যবস্থা করুন।”
“এই প্রমাণ তো এভাবে দেয় না, বেইব। এই প্রমাণ দিবে আমার চাঁদ।”
‘কাঁপতে থাকা ইমামা ভড়কে গেল,”চাঁদ?”
‘হিসহিসিয়ে বলল সে,”ইয়ের বেইব। ইয়্যুর প্রাইভেট প্রপার্টি।”
“আমি আগুনে পুড়ে যাচ্ছি আর এদিকে মস্করা হচ্ছে? জানোয়ার…আমি শুধু আজ বেঁচে ফিরি। ওটার আগে তোকে মারবো। শয়তান।” ইমামার কণ্ঠ কেঁপে উঠছে যন্ত্রণায়।
“বেস্ট অব লাক, সুইটহার্ট।!” নিরুদ্বেগ সে। থরাই কাঁপে না তার স্বর।
‘আগুন এবার ইমামার পা ছুঁয়ে ধরে। সেই দহন সহ্য করতে না পেরে ইমামার চোখ ভেঙে অশ্রু গড়ায়। শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। ও কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে, “আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে!”
‘পাষাণ হৃদয়েও তখনও বিন্দুমাত্র মায়া নেই তার মুখে। বরং তীব্র ক্ষোভে বলে,”কেউ যখন আমার কথা শোনে না… তখন আমার শরীরও এভাবেই জ্বলে রে জান। একদম জ্বলে-পুড়ে ঝলসে যায়।”
‘একটা আগুনের উল্কা এসে পড়ে ইমামার হাতে। বিকট আর্তনাদ ফেটে বেরোয়,”আহহহহহ্!”
“আরও জোরে!”
“ইয়্যু ফাকিং বাস্টার্ড!”
“মোন, বেবি… জাস্ট মোন।”
“আপনার ওপর আল্লাহর গজব পড়ুক… নরখাদক, জানোয়ার, শয়তান, কুত্তা।”
‘সে হেসে ওঠে,”শ্যুড আই সে আমিন?”
“আগুন নেভান… প্লিজ… আমার কষ্ট হচ্ছে।”
…………….
“আচ্ছা, আচ্ছা আমি স্যরি বলছি। আমি আর কখনো এমন করবো না… স্যরি… খুব করে স্যরি।”
“তখন কে জানি বলছিল, মাই লাইফ….
“ই..ইয়্যুর রুলস। মা..মা-মাই লাইফ, ইয়্যুর রুলস।”যন্ত্রণায় হাঁপাতে হাঁপাতে অবশেষে জ্ঞান হারায় ইমামা।
“সো সুইট অব ইউ মাই রেড।” এতোক্ষণে তার ঠোঁটের কোণে সন্তুষ্টির হাসি ফুটে ওঠে একটা অদ্ভুত বাঁকা রেখায়। তারপর ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই তার এক ইশারাতেই উপর থেকে পানি নেমে আসতে শুরু করে। একজন মেয়ে দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়ে। ইমামাকে তুলে উদ্ধার করা হয় তৎক্ষনাৎ।
‘ইমামাকে উদ্ধার করা হলে সে উঠে দাঁড়ায়। দু-হাত তখন পকেটে গোঁজা। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে মনিটরিং রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইমামা এতোক্ষণ শুধু, শুধু তাকে গালা-গাল করছিল। তার উদ্দেশ্য তো ভালো ছিল। নয়তো কি আর তার ঠোঁট থেকে ঝড়ে পড়ে…
“ওমন সুইট ফুলের মতো একটা মেয়েকে ধমক দিয়ে আমি কেন বোঝাতে যাবো, এসব আমার পছন্দ না৷ হাউ লেইম।”
❌
‘এই পর্বে তিন হাজার রিয়েক্ট এবং সকলের গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। বাকিটা আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম। ওদের মান-অভিমান নিয়ে ছোট্ট একটা পর্ব আসবে কালপরশু।
📌বিশেষ নোট : আমার লেখা চতুর্থ রোমান্টিক ই-বুক আল্লাহ চাইলে দশ তারিখ মানে কাল বিকালে প্রকাশ পাবে। আবারও আসতে চলেছে কারো খুব প্রিয় কারো অপ্রিয় একটি চরিত্র। নিজের ইচ্ছে নয়, পাঠকদের অনেক অনেক রিকোয়েস্টে আসছে ই-বুকটি। দাম আনুমানিক ৬০/৭০ এর ভেতর থাকবে। আশা করছি পূর্বের দু’টো ই-বুকের মতোই এবারও আপনাদের অগাধ ভালোবাসা পাবো। প্রস্তুত থাকবেন সকলে। আপনাদের বুড়ি ও সকলের নানী বোম নিয়ে আসছে… 🤭
Born_to_be_villains
Methuburi_মিথুবুড়ি
বোনাস_পর্ব
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌ কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
‘মনিটরিং রুম থেকে বেরিয়ে ডোর লক করে সামনে তাকাতেই ফাদারের মুখোমুখি হলো রিচার্ড। ফাদার তার অপ্রভিত অভিব্যতি অগ্রাহ্য করে হাত ধরে টানতে টানতে সোজা নিয়ে গেল গ্যারেজে।
‘ড্রাইভওয়ের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিচার্ডের তিনতলা ব্যক্তিগত গ্যারেজ। যেখানে তার পুরো ম্যানশনই মাত্র দোতলা। গ্যারেজে নেই এমন কিছু নেই! স্পোর্টস কার, সুপার কার, হাইপার কার থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রায় সব নামী ব্র্যান্ডের গাড়িই রয়েছে তার কালেকশনে। তিনতলা গ্যারেজ পরিপূর্ণ থাকলেও সে গাড়ি কিনে। মন ভালো থাকলে গাড়ি কেনে, মন খারাপ থাকলেও গাড়ি কেনে। মোট কথা গাড়ি তার আসক্তি। কারো শখ যেমন বাইক, রিচার্ডের শখ তেমন গাড়ি; নতুন মডেল দেখলে তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করে নতুন গাড়ির ঘ্রাণ নেওয়ার।
‘The Weeknd-এর Starboy গানের সেই লাইন দুটো আছে না…
“We don’t pray for love,
We just pray for cars”
‘লাইনটা যেন রিচার্ড কায়নাতের জন্যই তৈরি হয়েছে।
গ্যারেজের অভিমুখে অচঞ্চল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে একটি BMW M5—নীল হেডলাইটের দু’টি চোখ ব্ল্যাক পাইথনের মতোই শিকারী, স্থির ও হিংস্র দৃষ্টিতে রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে। ফাদার নিঃশব্দে হাসল। শুধু গাড়ির চাবিটা এগিয়ে দিল রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড এক পলক গাড়ির দিকে তাকাল। তারপর মন্থর, নিয়ন্ত্রিত গতিতে গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকাল ব্ল্যাক বিউটির চোখে অতি সূক্ষ্ণ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। মুহূর্তটায় যেন মুখোমুখি হলো দুই শিকারী দৃষ্টি। শুরশুরে হাওয়ার সঙ্গে নতুন গাড়ির তীব্র, মারাত্মক রঙের ঘ্রাণ ভৌ ভৌ করে ঢুকে পড়ল রিচার্ডের নাকে। সে চোখ বুজে ড্রাগসের মতো টেনে নিল সেই ঘ্রাণ। নেশার মতো, ক্ষমতার মতো করে টানল ঘ্রাণ।
‘ফাদার ক্ষুরধার নজরে রিচার্ডকে নিরীক্ষণ করে তৃপ্ত হাসিতে বললেন,
“আ লিটল গিফট ফর ইয়্যু মাই বয়।”
‘লিটল গিফট! রিচার্ড নিঃশব্দে ঠোঁটের এক কোণ এলিয়ে হাসল। নিকোটিনের ধোঁয়ায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কালচে ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গমাখা হাসি ঝুলিয়ে সে সরাসরি তাকাল ফাদারের দিকে। কাটাছেঁড়া দৃষ্টি নিয়ে সে অকপটে জানতে চাইল,
“লোভ? তাও আবার রিচার্ড কায়নাতকে?”
‘স্নেহার্দ রিদের ওমন ধারালো, বিদ্ধ কণ্ঠে ম্লান ভঙ্গিতে মুখ আচ্ছন্ন হয় ফাদারের গৌরবদীপ্তি তেজোময় মুখশ্রী৷ ফাদার আহত কণ্ঠে বলতে চাইলেন,
“না রিদ, তুমি আমাকে ভুল ব….
‘তাকে বাক্য সম্পূর্ণ করতে দিল না হিমালয়ের মতো নিটল সে। উলটে উগড়ে দিল তীব্র ব্যঙ্গপূর্ণ বাক্য,
“চার বছরে আপনার বিজনেস কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এসেছি, ডু ইয়্যু হ্যাভ এনি আইডিয়া ভিনসেনজো ক্যাসিনো?”
‘ফাদারের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি রিচার্ডের চোখের তিক্ততা আর বিষাদ আড়াল করতে পারল না। তবে অকৃতজ্ঞতার ছাপ ফাদারের মধ্যে ফুটে ওঠে না। তার ক্ষমতাই যথেষ্ট নয় এই শীতল, অদম্য, বলিষ্ঠ দেহধারী মানুষের কৃতজ্ঞতাকে অস্বীকার করার। তাই তো সে কৃতজ্ঞ হৃদয় আর কণ্ঠে আকুতি নিয়ে বললেন,
“আমি জানি, জানি….সব জানি মাই বয়। আমি তোমাকে যা দিয়েছি, তুমি তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দিয়েছো আমায়। আমার হারিয়ে ফেলা সকল সম্পদ আমায় ফিরিয়ে দিয়ে আবারও আমাকে আমার সিংহাসনে বসিয়েছো তুমি। তোমার কথা আমি কীভাবে ভুলি রিদ? সেই ক্ষমতা যে আমার নেই। পুরো বিশ্বের কাছে আমি ক্ষমতাবান হলেও একটা জায়গায় এসে আমি দূর্বল, আমি ভঙ্গুর। আর সেটা আর কেউ নয়, তুমি রিদ।”
‘রিচার্ড তখনও বরফের মতো শীতল। চিবুকে চিরায়ত গম্ভীরতা। অনুভূতির ছাপহীন মুখে শাণিত দৃষ্টিতে সে ফাদারের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাদারের কণ্ঠে ধীরে ধীরে খাদে নামছে। কৃতজ্ঞতা না কি তা বোঝা গেল না, তবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তার কণ্ঠ ভিজে আসছিল।
“তোমার করা কাজ ভুলে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব, রিদ। যাকে আমি একদিন আশ্রয় দিয়েছিলাম, সেই ছেলেটাই আজ আমার ভেঙে পড়া সাম্রাজ্যকে দাঁড় করিয়েছে। ব্যবসার ধস থামিয়েছো, রক্তপাত থামিয়েছো, হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছো। আমার নামের ওজনকে আবার ক্ষমতার দরজায় গর্জে উঠতে শিখিয়েছো। ভেঙে পড়া আমার সাম্রাজ্যের প্রতিটি ইট তুমি নতুন করে জোড়া দিয়েছো। যে ব্যবসা একসময় দেউলিয়া হওয়ার মুখে ছিল, তুমি সেটাকে রাতারাতি বহু-দেশীয় চেইনে রূপ দিয়েছো। তোমার হাতেই উদ্ধার হয়েছে আমার সমস্ত ব্যাংকক্রাপ্ট বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো। সুইস থেকে সিঙ্গাপুর, দুবাই থেকে আমস্টারডাম পর্যন্ত সব… সব। বিভিন্ন দেশের শেয়ার মার্কেটে তুমি আমার নামকে আবার টেনে তুলেছো। ওয়াল স্ট্রিট থেকে টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ… সব জায়গায়। সব… সব সব। তুমিই তো সব হারানো চুক্তি ফিরিয়ে এনেছো, ভাঙা ডিল নতুন করে লিখিয়েছো। আর…আর যেই ক্ষমতার টেবিলে আমার জন্য আর চেয়ার ছিল না, সেই টেবিলে তুমি আমাকে নতুন চেয়ার বানিয়ে বসিয়েছো। তুমি তো শুধু আমার পাশে দাঁড়াওনি… তুমি আমাকে আমার সিংহাসনে ফিরিয়ে বসিয়েছো, রিদ। দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছো—যে ক্ষমতা একদিন আমার ছিল, আজ তার অধিপতি আমি। কিন্তু দুনিয়া সে কথা জানলেও আমি তো জানি এর প্রকৃত অধিপতি তুমি।”
“অনেক কিছু করেছি তো? তবে কিছুই আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নয়। কৃতজ্ঞতার ছদ্মবেশে আমার ক্ষমতার এক ঝলক দেখিয়ে দিয়েছি পুরো বিশ্বকে। এবার পালা আপনার। আপনাকে এবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে, ফাদার। প্লিজ, লিভ মি এলোন।”
‘সপাটে ওমন জ্বালাময় আর তপ্ত ঝড়ানো বাক্যে বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হয়। আজ ফাদার ব্যাথা, অভিমান, অপমান ভুলে সমস্ত দূরত্ব দূর করে কাছে এলেন। রিচার্ডের হাত ধরে ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে বলতে থাকেন,
“অতীতের জন্য তুমি আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, সেটা আমি কখনোই চাইনি রিদ। এটা তুমিও জানো। আমি তোমাকে ছেলের আসনে বসিয়েছিলাম। জায়গা দিয়েছিলাম হৃদয়ের ভেতরে। কিন্তু তুমি সেই স্থানটাই চাওনি। তোমার পুরুষতান্ত্রিক অহং এত প্রবল ছিল যে আমার স্নেহও তোমার কাছে করুণা বলে মনে হত।”
‘রিচার্ড তুষ্ট হেসে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,”আমার একটা নীতি আছে, জানেন তো? রিচার্ড কায়নাত শোধবোধে বিশ্বাসী। যতদিন আপনার স্নেহে কোনো ছলনা ছিল না, ততদিন আমি আপনাকে সম্মান করেছি। কিন্তু যখন আপনি সম্পর্কের মাঝে স্বার্থ ঢুকালেন, তখন থেকেই শুরু হয়ে গেল দেনাপাওনা। আপনি আমাকে যা দিলেন, আমি তা ফেরত দিয়েছি। এবার সেটা যদি ছলনা হয়, তবে ছলনা। যদি ভালোবাসা হয়, ভালোবাসা।”
‘ফাদারের চোখের কোল কালো মেঘে ঢেকে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে দুর্বল গলায় বললেন,
“আমার স্বার্থ ছিল না রিদ। সম্পর্ক করতে চেয়েছি তোমার সাথে। তোমাকে বিশ্বাস করে আমার মে….
‘থমকে থাকা মন ফিরল পৈশাচিক রূপে, হঠাৎই হিংস্র শিকারীর মতো গর্জন করে উঠল রিচার্ড,
“দ্যাটস ফাকিং বুলশিট!”
‘ফাদার কাঁপলেন না। এই হুংকারের সাথে সে চিরপরিচিত। রিচার্ডের গর্জনে গার্ডগুলো কেঁপে উঠল। লুকাস ছুটে এসে দাঁড়াল ফায়ারের পিছনে। ফাদার এবার অশ্রু ছেড়ে দিলেন। দাম্ভিক অহংকারে ভরা মানুষটি হঠাৎ করেই আবেগের বন্যায় ভেসে গেল। ব্যথিত পিতার মতো ফাদার আবারও রিচার্ডের হাত দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে থাকে,
“রিদ, রিদ…..আমার বাঘের বাচ্চা। তুমি মন থেকে বলো তো—তুমি কি কখনো আমার ছোঁয়ায় বাবার স্নেহ পাওনি? তোমাকে যে আমি কোন স্থানে রাখি, সেটা কী তুমি এতো বছরেও বুঝতে পারোনি?”
‘রিচার্ড নির্বাক, নির্লিপ্ত। পাহাড়ের মতো শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। কোনো আবেগই তার মেশিনজাত হৃদয়কে প্রভাবিত করতে পারছে না। ফাদার কাঁপা কাঁপা হাত রাখলেন মরুভূমির মতো খরখরে চিবুকে। সকল তৃষ্ণা, আকাঙ্খা দুস্থ কণ্ঠে ঢেলে দিয়ে অনুরোধ করে বলে,
“একটাবার আমাকে বাবা বলে ডাকো,রিদ।”
‘নির্জ্জীব অভিব্যক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নেয় রিচার্ড। লুকাস
বিস্ময়ে ভরা চোখে তাকিয়ে আছে ফাদারের দিকে। এই মানুষটাকে সে মেয়ের বিপর্যস্ত অবস্থাতেও কাঁদতে দেখেনি। অথচ আজ কাঁদছে এই লোকটা, যার ভয়ে কাঁপে ইতালির অলিগলি। তবে রিচার্ডের কাঠিন্য সদাতেজি মুখ দেখে অবাক হয় না সে। খুব কাছের মানুষের কাছ থেকে আঘাত পেলে মানুষ পাথর রুপান্তরিত হয়।
‘ফাদার কম্পিত হাতে রিচার্ডকে নিজের দিকে ঘুরালো। তার চোখের কোলে অশ্রুর প্লাবন। সকল গার্ডদের মাঝে বিস্ময়ের স্রোত ছড়িয়ে দিয়ে ফাদার মুমূর্ষু ব্যক্তির ন্যায় বলতে লাগলেন,
“নিজের মেয়ের মুখে বাবা ডাক শোনার আগে, তোমার মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে চেয়েছি আমি। তুমি তো আমার সেই রিদ, যে আমার এক কলে নিজের স্বপ্ন ছেড়ে এসেছিল। তুমি তো আমার সে-ই রিদ, যে আমার জন্য জান দিতে প্রস্তুত। আর কতদিন রাগ করে থাকবি বাবা? আমি জানি, আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি, জুলুম করেছি তোমার সাথে। কিন্তু আমি কি করতাম বলো? আমার হাত যে বাঁধা ছিল।”
‘কাঁপা ঠোঁটের রিচার্ডের কপালে ঠোঁট রাখলেন ফাদার। রিচার্ড চোখ বুঁজে। অল্প হাসে৷ তার হাসির মধ্যে একধরণের রসিকতা ছিল। কিন্তু কণ্ঠে ছিল এক আকাশ পরিমাণ অভিমান।
“যদি সত্যিই আপনার ভালোবাসায় আমি থাকতাম, তাহলে আমার সাথে এমমটা করতে পারতেন না, ফাদার৷”
‘ফাদার জাপ্টে ধরলেন রিচার্ড’কে। অনবরত মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলতে থাকে,”রিদ…..রিদ জান বাচ্চা আমার…আমার বাঘের বাচ্চা.. আমি আর কি করতাম বলো তো? বাবা হয়ে আমার হাত যে বাঁধা ছিল। এক সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক সন্তানকে আঘাত করেছি আমি। এতে করে আমিও ভালো নেই। বিশ্বাস করো রিদ, আমি একটুও ভালো নেই। তিনশো চোট্টাটিটা দিন ধরে আমার সাথে ঠিকভাবে কথা বলো না তুমি, আমার পাশে বসো না, আমার রিদ আমার চোখে চোখ রাখে না, আমার রিদ আমার ওষুধের খবর নেয় না, আমাকে সম্মান করে… এতো এতো যন্ত্রণা নিয়ে আমি একটুও ভালো নেই রিদ। আমার রাতে ঘুম হয় না। সারাক্ষণ ছটফট করি, কখন আমার রিদ আসবে। আমার সাথে একটু কথা বলতে। কিন্তু তুমি ফিরো না। ছোট্টো রিদ বড় হয়ে এখন আর একটু পরপর ফাদারের কাছে ছুটে আসে না। শুধু আমার একটা স্বীদ্ধান্তের জন্য কতটা পর করে দিয়ে আমায়, তুমি ভেবে দেখেছো?”
“সবচেয়ে বড় আঘাতটা আপন মানুষই দিয়ে থাকে।”
‘ফাদার পাগলের মতো রিচার্ডের সারা মুখে চুমু খেতে থাকেন। ঠিক যেভাবে প্রথমদিন রিচার্ডকে কোলে নিয়েছিল সময় খেয়েছিল৷
“তোমাকে ছাড়া আমি কিছু না, রিদ। তুমি অন্তত এভাবে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। আমি তিলে তিলে মরে যাবে।”
‘রিচার্ডের চোখ তখনও বন্ধ করা। ঠোঁটের কোণে অল্পস্বল্প হাসি,”আমি তো আপনার জন্য জানও দিতে পারবো।আপনিই শিখিয়েছিলেন—প্রয়োজনে সঙ্গীর জন্য জীবনও দিতে হয়। সম্পর্কে রয়ালিটি থাকতে হয় তাই না? এখন বলুন আপনি কি পারবেন আমাকে সেই অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিতে?”
‘ফাদার থমকালেন,”রিদ….
‘রিচার্ড চোখ খুলল। এবার তার কণ্ঠে ফেটে পড়ল যন্ত্রণা,
“আমার তো মা-বাপ কেউই ছিল না। আমার একমাত্র আশ্রয় আর ভরসার জায়গা তো আপনিই ছিলেন। কই একটা বার-ও তো ভাবলেন না, একটা ছেলে তার স্বপ্ন ছেড়ে কীভাবে বেঁচে আছে, একটা বারও তো জানতে চাইলেন না, বিষ পান করতে কেমন লাগে?”
“ওটা ভালোবাসা ছিল রি…..
“ঘৃণিত জিনিস আমার জন্য বিষ।”
‘ফাদার কিছু বলতে যাবেন, তখনই রিচার্ডের ফোন শব্দ করে উঠল। রিচার্ড ফোন বের করে দেখল ইমামার মেসেজ,
“ফর মি, দ্য রিয়াল ডেফিনিশন অব হ্যান্ডসাম ইজ আ ম্যান উইথ ম্যানার্স, রেসপেক্ট, অ্যান্ড আ কালম টোন দ্যাট নেভার ডিসরেসপেক্টস।”
‘তৎক্ষণাৎ রিচার্ডের অভিব্যক্তিতে পরিবর্তন আসে। গুরুগম্ভীর, কঠিন মুখে এক ধরনের অজানা আলোড়ন ফুটে ওঠে। ফাদার চমকে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“ড্রাগন কুইন!… হু ইজ ড্রাগন কুইন?”
‘রিচার্ড বাঁকা হাসল। সোজা জবাব না দিয়ে পা বাড়িয়ে সামনে চলে গেল। যেতে যেতে বলল,
“ওনার অব রিচার্ড কায়নাত।”
‘জানালায় এখনও অনবরত ভূতুরে কম্পনের মতো থকথকে শব্দ হচ্ছে। ভেতরে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য চিরকুট আর ফুল। খাটের এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে ইমামা। চিবুক মটমট করছে তীব্র ক্রোধ আর একরাশ বিতৃষ্ণায়। ডান হাত তখনো বরফের পানিতে ডোবানো। তখন আগুনের উল্কা এসে যে জায়গাটায় পড়েছিল, ওই জায়গাটায় ফোসকা পড়ে গেছে।
‘ফোনটা আবার বেজে উঠল। ইমামার ক্রোধ ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে। এখন রাত চারটা। চারপাশে নিস্তব্ধতা এখন কিছুটা শান্ত। জিম থেকে কে বা কারা তাকে উদ্ধার করেছিল, তার কিছুই মনে নেই। জ্ঞান ফিরেছিল নিজ ঘরে।তখন ঘড়িতে বারোটা। আর সেই মুহূর্ত পর থেকেই শুরু হয়েছে হৃদয়হীন লোকটার অবিরাম কল। যে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল, সে-ই এখন ভালোবাসার মুখোশ পরে ফিরে এসেছে!
‘ইমামা কল রিসিভ করে না। তারপরই শুরু হয় অদ্ভুত সব কাণ্ড। যে ঈগলটা রোজ একবার আসে, আজ সে এসেছে চব্বিশ বার। একবারও খালি হাতে নয়। কখনো ফুল, কখনো চিরকুট। সেও যেন চোখের ভাষায় মালিকের হয়ে ক্ষমা চাইছে। কিন্তু আজ ইমামার মন আর গলে না। ফুল আর চিরকুট ছুঁয়েও দেখে না সে। উল্টো জানালাটা বন্ধ করে দেয়। তবু জানালার ওপাশ থেকে ঠকঠক শব্দ থামে না। আর ফোন…..সে তো এখনও বাজছেই।
‘একটা সময় বাধ্য হয়েই ইমামা ফোনটা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তারপর যা ঘটল, তা ছিল আরও ভয়ংকর। গভীর মাঝরাতে হঠাৎ করেই ল্যান্ডলাইন বেজে উঠে। অন্ধকারের ভেতর বসার ঘরে এগিয়ে যায় ইমামা। বুকের ভেতর অজানা শঙ্কা নিয়ে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে কণ্ঠের ধমক,
“Don’t ignore me red.
You know that—I won’t breathe.”
‘ইমামা ফোনটা রেখে দ্রুত নিজের রুমে চলে যায়। তারপর থেকে অনবরত বাজতেই থাকে ল্যান্ডলাইন। কিন্তু ইমামা আর যায় না। শব্দে ইমান ওয়াসিমের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি কল রিসিভ করলে ওপাশ থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসে না। এভাবে চারবার হলো। উপর থেকে সবকিছু লুকিয়ে দেখছিল ইমামা। ইমান ওয়াসিম রুমে ফিরতেই সে চুপিচুপিই এসে ল্যান্ডলাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিন্তু সেখানেই শেষ হয় না। এরপর শুরু হয় আরও ভয়ংকর কাণ্ড।
‘হঠাৎ করেই বিকট শব্দে কলিং বেল বাজতে থাকে। রাত তখন দু’টো। অন্ধকারে ঢাকা ওয়াসিম মঞ্জিল হঠাৎ আলোয় ভরে ওঠে। ইমন দরজা খুলে দেখে বাইরে কেউ নেই। দরজা বন্ধ করে ঘরে ফিরতেই আবার কলিং বেল। এভাবে কয়েকবার ঘটতে থাকে একই ঘটনা। বাড়িজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক অজানা আতঙ্ক। মনে হচ্ছিল যেন এটা কোনো ভুতুড়ে বাড়ি।
‘ইমন ভয়ে কাঁপতে থাকে। সারাটা সময় ইমামা ছিল নীরব। সবার ভেতরেই চাপা শঙ্কা, দমবন্ধ করা আতঙ্ক। ঠিক তখনই হঠাৎ ওয়াসিম ভিলার ওপর দিয়ে চার-পাঁচটা হেলিকপ্টার পাক খেতে শুরু করে। এবার আর বুঝতে বাকি থাকে না আসলে কী হচ্ছে। সকলের সন্দিহান দৃষ্টি গিয়ে পড়ে ইমামার ওপর। সে কিছু না বলে রুমে চলে যায়। বাধ্য হয়ে ফোনটা অন করে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সবকিছু থেমে যায়।
‘আর তারপরই মেসেজ আসে নিদারুণ অনুরোধে,
“আমার সঙ্গে একটু কথা বলুন, মিস। আপনাকে খুব মিস করছি। আচ্ছা, আমি সরি, খুব করে সরি।”
‘কিন্তু ইমামার অভিমানে কঠিন হয়ে থাকা মুখে এমন আলতো অনুরোধেও একফোঁটা মায়ার ছাপ পড়ে না। ফোন দিতে দিতে ক্লান্ত সেই মানুষটা আবার মেসেজ পাঠায়, এবার আর্ত স্বরে,
“একটু কথা বল না রে, লক্ষীটি।”
‘তবু ইমামার মন গলে না। আদুরে আদুরে ডাকে একের পর এক মেসেজ আসতেই থাকে,
“আচ্ছা, আমি সরি তো। আমি অনুভূতি এক্সপ্রেস করতে পারি না রেড। ওকে, আমি মানছি। ওটা বাড়াবাড়ি ছিল। সরি, রেড রোজ।”
“আমার সাথে কথা বলুন এলিজান।”
“জান?”
“ও জান?”
“জান রে!”
“আমার জান।”
“এলিজান…”
“রেড।”
“মাই ডার্ক রেড।”
“মাই ফাকিং ডার্ক রেড।”
“মাই গর্জিয়াস লেডি।”
“হৃদয় হরিণী আমার।”
“বেইব?”
“হানি?”
“সুইহার্ট?”
“ডার্লিং?”
“সুন টু বি ওয়াইফি।”
“বেটার হাফ।”
“স্টপ ইগনোরিং মি, ইয়ার।”
“আই সেইড নো রেড।”
‘এক মুহূর্তের নীরবতার পর আসে শেষ লাইনটা ভারী আর হাহাকারভরা,
“আমি ঘৃণা নিতে পারি, রেড…কিন্তু অবহেলা সহ্য করতে পারি না।”
‘ওপাশের মানুষটা যেন প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজের রাগটাকে দমিয়ে রাখতে। ক্লান্ত শরীর, ক্ষয়ে যাওয়া ধৈর্য, তবুও হাল ছাড়ে না। তবে এবার ভাষা বদলায়, দেশের সীমানা পেরিয়ে ডাকে সে,
“Rouhi— আমার আত্মা।”
“Omri— আমার জীবন।”
“Azizam” — আমার প্রিয়।”
“Joonam” — আমার প্রাণ।”
“Em yêu” — প্রিয়তমা।”
“Mi Cielo” — আমার আকাশ।”
“Mi Reina” — আমার রানি।”
“M wangu” — আমার হৃদয়।”
“Lubirea mea” — আমার ভালোবাসা।”
“Mi Linda” — আমার সুন্দরী।”
‘কিন্তু ইমামা তখনও অনড়, নিরুত্তর। শূন্য চোখে শুধু মেসেজগুলো দেখে যায়। তবে এবার আর ধৈর্য ধরে না ওপাশের মানুষটার। হঠাৎ থেমে যায় ফোন মেসেজ।
‘কয়েক সেকেন্ড পর নিস্তব্ধতা চিরে ভেসে আসে এক হিংস্র হুংকার,
“এই আল্লাহর বান্দি এই—একদিনই বলছি আমি মানুষটা অতটা ভালো না। মাথায় একবার রক্ত উঠে গেলে, তোর রক্তে হাত ভেজাতেও বুক কাঁপবে না আমার। সো প্লিজ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না। আমার সঙ্গে একটু কথা বলুন ভালো করে, আমার হাতে সময় কম।’
‘ইমামা কেঁপে উঠল। তারপর হঠাৎই মনে পড়ল রুম থেকে স্পিকারটা সে এখনও সরায়নি। ঠিক তখনই আবার মেসেজ এলো। এবার ইমামা ঝাঁঝালো ভঙ্গিতে রিপ্লাই দিল। কিন্তু উত্তরটা এলো আদুরে, অভিমানী সুরে,
“আমার সঙ্গে কথা না বললে আপনার কী হবে? কিছুই হবে না। কিন্তু… কিন্তু আমার হবে।”
“কি হবে?” ইমামা লিখল।
“ঘুম হবে না।”
“কেন?”
“Call me addicted, but I can’t sleep without getting a good conversation with you, my love”
“কেন?”
‘উত্তরে এলো, “Ankhon ki nami hai tu,
Sab hain, par kami tu.
Meri zindagi hai tu”
‘দু’টো লাইনেই ইমামার সর্বাঙ্গে শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে কি সত্যিই এতটা স্পেশাল, যার রাগ ভাঙাতে কেউ এত দূর যেতে পারে? তবু সে কিছু প্রকাশ করল না। হাতের গতি বাড়িয়ে দ্রুত লিখল,
“Texting is sweet, but I want your hands on my waist when I talk.”
‘ইমামার কথার সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে এতক্ষণে রিচার্ডের বিচলিত মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। রিচার্ড ট্যারেসে অস্থিরচিত্তে পায়চারি করছিল অনেকক্ষণ ধরেই। এবার মনে হলো ভেতরের অস্থিরতা খানিকটা প্রশমিত হয়েছে। রিচার্ড বসে পড়ল। লিখল,
“Wanna meet?”
“Yes.”
“আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার হবো আমি। আর সেরা জিনিসগুলো দেরিতেই আসে।”
ই’মামা জানে এ মানুষটা সহজে ধরা দেওয়ার নয়। তবু সে নিজের জায়গা থেকে নড়ল না। লিখল,
“Wanna see you.”
“আমাদের দেখা হবে সামনাসামনি। আপনাকে আমি খুব কাছ থেকে দেখব, এলিজান।”
‘রাগে ইমামা ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল বিছানার ওপর। অথচ সত্যিটা অন্য৷ লোকটাকে দেখার তৃষ্ণায় সে অস্থির। কল্পনায় তাকে নানা রঙে আঁকে, এক ঝলক দেখার আকাঙ্ক্ষা প্রতিদিন তাকে নিঃশব্দে দুঃখী করে রাখে।
‘আবার ফোন হাতে নিল সে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে,
“আমাকে সময় দিন।”
‘দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমামা লিখল,”সুনীল আকাশের সৌন্দর্যে ঘেরা আপনার সেই নীল চোখ দু’টি আরেকবার দেখতে চাই।”
‘এবার আর তাকে নিরাশ করা হলো না। কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই ভেসে এলো সমুদ্র-নীল চোখের ছবি। ইমামা টের পেল তার নিঃশ্বাস থমকে গেছে। সে তলিয়ে যাচ্ছে ওই সমুদ্রের মায়ায়। পলক পড়ে না তার; একদৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে। এই চোখের মায়ায় আর কতবার যে সে ঘায়েল হবে তার নিজেরও জানা নেই।
‘তবু ইমামা সহজে কিছু প্রকাশ করল না। তার রাগ নেমে গেছে এটাও বুঝতে দিল না। বরং সে করে বসল চূড়ান্ত এক কাজ।
“আপনি আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছেন।”
“What the fuck! Are you insane? মারার চেষ্টা মানে! আপনি মারা গেলে আমার কী হবে?”
“না। আপনি আমাকে মারার চেষ্টাই করেছেন।”
‘রিচার্ড সহজেই হাল ছেড়ে দিল। মেল ইগোর ধার ধারল না একটুও। আজকাল অধিকাংশ সম্পর্কের অধঃপতনের মূল কারণই তো এই মেল ইগো। সে সব দোষ নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে শান্ত গলায় জানতে চাইল,
“আচ্ছা, সব আমার দোষ। এখন কী করলে রাণীর রাগ কমবে, জানতে পারি?”
“কান ধরে ছবি দিতে হবে।”
‘ঠিক তখনই ফরজের আজান ধ্বনিত হচ্ছিল। ইতালির মতো পাপ-পুণ্যের শহরে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে না, তবু সময়টা বলে দিচ্ছিল বাংলাদেশে আজানের সময় হয়ে গেছে। রিচার্ড কিছুক্ষণ থমকে রইল। মনে হলো নিজের সঙ্গে নিজেরই যুদ্ধ চলছে। পরপর কয়েকবার গরম নিঃশ্বাস ফেলল। চোখ-মুখ কুচকে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়াল। তার বাঁ হাত ফোনের কিবোর্ডে স্থির, আর ডান হাত ভেজা ছিল রক্তে। রিচার্ড ঝেড়ে ফেলল রক্ত। সোজা ওয়াশরুমের দিকে এগোল। যাওয়ার সময় মনে মনে যেন বলে উঠল,
“প্রেমে পড়ার পর তোর কী দিন এলো রে, রিচার্ড কায়নাত! হাতের রক্ত ধুয়ে এখন কানেও ধরতে হয় একটা মেয়ের মন পাওয়ার জন্য।”
‘রিচার্ড যখন ক্যামেরা অন করে হাত কানের কাছে নিচ্ছিল, তখন বারবার তার হাত থেমে যাচ্ছিল। চোখ-মুখ কুঁচকে যাচ্ছিল। তবু অবশেষে ছবি তুলল এবং ইমামার কাছে পাঠাল। ইমামা হাসতে হাসতে ছবি দেখল। এভাবে তার রাগ গলে গেল। রিচার্ড নিজেই নিজের উপর বিস্মিত। অবিশ্বাস্যের সঙ্গে আওড়ালো,
“Aisssh, I’m fucking obsessed with her.”
‘এরপর তাদের আলাপ আরও গভীর হলো। দিনের আলো ফুটতে লাগল। কথা বলতে বলতে ইমামা ঘুমিয়ে পড়ল। পায়ের কাছে পড়ে থাকল ল্যাপটপ, কানের কাছে ফোন। ল্যাপটপ আর ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে সমুদ্র-নীল চোখ দু’টো। ল্যাপটপের উপর ছড়িয়ে আছে কতগুলো চিরকুট আর সানফ্লাওয়ার। আজকে আর সে লাল বা কালো গোলাপ দেয়নি। ঘর ভরিয়ে দিয়েছে শুধুই সানফ্লাওয়ার দিয়ে। এই সানফ্লাওয়ার দেওয়ার পিছনেও আছে এক বিশেষ কারণ।
‘লোকমুখে শোনা যায় সানফ্লাওয়ারের এক রোমান্টিক মিথ যখন কেউ কাউকে সানফ্লাওয়ার উপহার দেয়, তখন একা নয়, দু’টি দিতে হয়। কারণ দিনের প্রখর রোদে সানফ্লাওয়ার সূর্যের দিকে মুখ তুলে রশ্মির মতো আলো ছড়ায়। কিন্তু রাত নামলে যখন আলো নিভে আসে, তখন তারা একে অপরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নিজেদের মাঝেই খুঁজে নেয় আলো।
এই মিথের ভাষায় কাউকে সানফ্লাওয়ার দেওয়া মানে শুধু ফুল দেওয়া নয়, না বলেও বলে দেওয়া—সব অন্ধকারে তুমিই আমার আলো।”
‘বাংলাদেশে তখন কেবল ভোরের আলো ফুটছে। তবে ইতালিতে সময় অনেকটাই এগিয়ে গেছে। রিচার্ড এলিজাবেথের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। এই মুহূর্তে তার ভেতরটা অদ্ভুতভাবে হালকা। স্ট্রেসমুক্ত লাগছে তাকে। রিচার্ড উঠে দাঁড়াল। ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়েই নীচু স্বরে বলে উঠল,
“আমি আপনার জন্মদাগ থেকে শুরু করে আপনার প্রতিটি রেখা জানি, প্রতিটি অনুভূতি চিনি। অথচ আপনি… আমাকে না দেখেও ভালোবেসেছেন। এই বিশ্বাসের ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না, এলিজান। আপমার বিশ্বাস আমি কখনোই আপনার বিশ্বাস ভাঙব না। কখনোই না। দরকার হলে এই অভিশপ্ত রাজ্যও ত্যাগ করব।”
‘কথা শেষ করেই সামনে এগোতে গিয়েই থমকে গেল সে। সামনে লুকাস দাঁড়িয়ে। তার মুখের ভাবই বলে দিচ্ছিল সবকিছু সে শুনেছে। সন্দিহান চোখে রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে লুকাস বলল,
“একটা মেয়ের জন্য নিজের রাজ্য ছেড়ে দেবেন?”
‘রিচার্ড এক মুহূর্তও দেরি করল না। স্থির, নির্ভার কণ্ঠে উত্তর দিল,
“আমার উনিশ বছরের আকাঙ্ক্ষা, লোকা। ভালোবাসার মানুষটাই যদি জীবনে না থাকে, তাহলে রাজ্য দিয়ে কী হবে?”
❌
‘আজকের পর্বটা একটু অগোছালো লাগছে পারে। অনেক চাপের মধ্যে লিখতে হয়েছে। পরিবর্ততে আবার এডিট করা হবে। আর হ্যাঁ, #ভিলেনক্যানবিআলাভার-এর রিচার্ড কায়নাতের সাথে এই রিচার্ড কায়নাতকে মেলাতে যাবেন না। সকল চরিত্র নতুনভাবে সাজানো হবে। আশা রাখছি সকলের রেসপন্স পাবো আজকের পর্বে।
Share On:
TAGS: born to be villains, মিথুবুড়ি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
Born to be villains পর্ব ৫(প্রথমাংশ+শেষাংশ)
-
Born to be villains পর্ব ৪
-
Born to be villains পর্ব ৩
-
Born to be villains পর্ব ১০+বোনাস
-
Born to be villains পর্ব ৯
-
Born to be villains পর্ব ১১
-
Born to be villains পর্ব ১৫
-
Born to be villains পর্ব ১৩
-
Born to be villains পর্ব ১
-
Born to be villains পর্ব ২