born_to_be_villains
methuburi_মিথুবুড়ি
পর্ব_০৭
❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ❌
‘ঘড়ির কাঁটা নয়টায় থেমেছে। আকাশ জুড়ে রোদ্দুরের প্লাবন। সূর্যের প্রখর তেজ নেমে এসেছে ধরণীর বুকে; আশ্লেষে ছুঁয়ে দিচ্ছে আপনভুবনকে। সূর্যের তেজের মতোই আজ উত্তপ্ত ইমামার মনোভাব। বিক্ষিপ্ত মেজাজে ভার্সিটির জন্য রেডি হচ্ছে সে। দীর্ঘ নির্ঘুম ব্যর্থ এক রাত কাটিয়ে সকাল সকালই মেজাজ তুঙ্গে। শেষরাতের হিমেল হাওয়ার সাথে কৃত্রিম স্নোফলের অকৃত্রিম বৃষ্টি মিলিয়ে গেলেও মস্তিষ্কে পুঞ্জিভূত অবর্ণনীয় চিন্তাগুলো ধূসর রঙের প্রতিটি কোষে সাংঘাতিক ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
‘অফিসার মাহেশ নিরাশ বার্তা দেওয়া শর্তেও শেষরাতে অনলাইনের বিভিন্ন সাইটে গিয়ে আর.কে নামক রহস্যময় ব্যক্তিটির সন্ধান চালিয়েছে ইমামা। যদিও সে জানত, যেখানে অফিসার মাহেশের মতো একজন চৌকস অফিসার জানায় আশারূপ কিছুই পাওয়া যায়নি রিসার্চ করে, সেখানে সে তো একটা চুনোপুঁটি। তবুও সে চেষ্টা চালায় এই উদ্দেশ্য, সৃষ্টিকর্তা অশেষ কৃপায় যদি একটা কিছু পেয়ে যাই। আর সৃষ্টার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস থেকে সে পেয়েছেও অনেক কিছুই।
‘তার মূল উদ্দেশ্য একটাই—লোকটাকে দেখা। যার পেছনের দিক দেখেই সে এতটা আকৃষ্ট হয়েছিল, তার মুখটা কেমন দেখতে সেই কৌতূহল এখন তাকে গ্রাস করছে। অদ্ভুতভাবে লোকটা তাকে টানছে। যেন অজানা কোনো শক্তি বারবার কাছে ডাকে। সেখানে সুরাকারের মতো তার ঘৃণা জন্মানোর কথা, সেখানে সে ছটফট করছে অপরজনের মুখ দেখার জন্য। অথচ, দুজনেই তার সাথে গেইম খেলছে।
‘সে নিজেও জানে না কেন এমন হচ্ছে। কাল রাত থেকে সে নিশ্চিত পার্টির সেই ‘কোট ম্যান’ ই হলো অজ্ঞাত কলার, মানে আর.কে। ইতালির সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী, আন্ডারগ্রাউন্ডের আতঙ্ক, শত্রুদের বিভীষিকা। তবু একটা প্রশ্নটা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, এতো বড় একজন মানুষ তার মতো সাধারণ একজনের পিছনে কেন পড়ে আছে? কেনই বা বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাকে কোন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছে? বা কেনই তাকে অদৃশ্য ডাল হয়ে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে, তার কঠিন পথের কাটাগুলো মুছে দিতে চেষ্টা করছে? লোকটার আসল উদ্দেশ্য কী?
‘ইমামা জানে না এসবের আড়ালে কী লুকিয়ে আছে।
তবে অনেক ঘাটাঘাটির পর যতটুকু জানতে পেরেছে তা হল লোকটার দু’জন বিশ্বস্ত বডিগার্ড আছে। ন্যাসো আর লুকাস। তার মতোই রহস্যময় তারা; নাম ছাড়া নেই কোনো ছবি, নেই পরিচয়। আরও জানা গেছে, তার একজন ‘গডফাদার’ আছে। যার মাধ্যমেই ‘আর.কে’ নামের সূত্রপাত। গডফাদারই তাকে ড্রাগন গ্রুপের লিডার বানিয়েছে। এর বেশি কিছু আর খুঁজে পায়নি ইমামা। আসলে যারা ইচ্ছে করে নিজেদের পরিচয় গোপন রাখে, তাদের নাগাল পাওয়া সত্যিই দুষ্কর।
‘উৎকণ্ঠিত মুখে লাইব্রেরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ইমামা। যত এগোচ্ছে, ততই ভেতরে উদ্বেগ বাড়ছে। সে খুব করে চাইছে সবসময়ের মতো সকলে আজও উপস্থিত থাকুক তাদের সেই চিরপরিচিত লাইব্রেরির ‘গ’ শাখায়। ওদের হৈ-হুল্লোড়, হাসিঠাট্টায় অতিষ্ঠ হয়ে যাক সকলে। তীব্র বিতৃষ্ণায় চোখ রাঙিয়ে তাকাক তাদের দিকে৷ আর সবসময়ের মতো অভদ্র, বেপরোয়া, বেয়াদব গৌরব ভেংচি কেটে নতুন করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ুক। তবুও ওদের হাসি না থামুক। স্মৃতির পাতায় কখনোই মলিন না হোক এই ছয় চড়ুইয়ের সন্ধি। হয়তো এক পিশাচের নৃশংস খেলার শিকার হয়ে একজন চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে, কিন্তু আর কেউ না হারাক। এরা অন্তত থাকুক, ঠিক যেমন করে মৃত্যু পর্যন্ত থেকে যায় জন্ম দাগ।
‘কিন্তু তার মুখে একফোঁটা মলিনতার ছাপ ফেলে দিয়ে ওরা কেউই আজ ছিল না লাইব্রেরীতে। তবু ইমামা এতো সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়। টানা কয়েকবার গভীর নিশ্বাস টেনে সে নিজের ভেতরে নতুন করে আশার আলো জ্বালাল। ম্লান মুখে ধীরে ধীরে হাঁটা ধরল ক্লাসরুমের দিকে। পরনে ফ্লেয়ার জিন্সের সাথে মেরুর রঙের শর্ট কুর্তি। গোধূলি রঙা চুলগুলো সবসময়কার মতো চুড়ো করে বাঁধা, সবার বিস্মিত দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালিয়ে। অনিন্দ্য সুন্দর মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক।
‘স্টুডেন্ট হিসেবে সবাই দুর্দান্ত হলেও আড্ডার জমজমাট আসর জমাতে তারা সবসময়ই জায়গা নিত পেছনের সিটে। তাই তো মজা করে সবাই তাদের ডাকত—“ব্যাকবেঞ্চার টপার”।কিন্তু আজ সবটা ভিন্ন। আজ পিছনের সিট থেকে গৌরব আর ইবরাতের মারামারি আর ঠেসাঠেসির শব্দ ভেসে আসে না, হিয়ার খিলখিলে হাসি চারদেয়ালে ভারি খেয়ে বার বার প্রতিধ্বনি হয় না, অর্কের ঠেস মারা কথায় বিরক্ত হয়ে কারিব একটু পর পর ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো অর্কের দিকে তেড়েফুঁড়ে যায় না। আর সবশেষে স্বল্পভাষী ইমামাকে কথা কম বলার জন্য সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার হাতে-পায়ে ধরে শূন্যে দুলাতে দুলাতে পুকুরে ফেলে দেয় না । আর হয়তো কখন দিবে না। আজ সবাই থাকা স্বত্বেও একটা মানুষের অনুপস্থিতি যেন নিঃসাড় শূন্যতায় চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে।
‘ইবরাত আজ পেছনের সিটে নয়, বসেছে একদম সামনের দিকে। পাশে ইমামার জন্য কোনো জায়গাও রাখেনি। ইমামা তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে গেল ওর কাছে। কিন্তু তাকে দেখেও না দেখার ভান করে ইবরাত নিরাসক্ত মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল। ইমামা কিছু বলতে যাবে, তার আগেই অবহেলার ধূসর ছায়া ছুঁড়ে দিয়ে ইবরাত ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। ইবরাতের এরূপ আচরণে ইমামার বুকের গভীরে হালকা, চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল। ও কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল থরথরিয়ে,
“ইবু!”
‘ইবরাত সাড়া দেয় না। হনহনিয়ে চলে যায় ক্যান্টিনের দিকে। ইমামা ডাকতে ডাকতে ওর পিছু নিল। গৌরব, হিয়া আর অর্ক আগে থেকেই ক্যান্টিনে উপস্থিত ছিল। ইবরাত চুপচাপ অর্কের পাশে বসে পড়ল। ইমামাকে দেখামাত্র সকলের চোখে একধরণের ঝাঁঝালো ক্ষোভ ভেসে উঠল। যাদের উষ্ণ চোখের প্রীতিস্পর্শ চাহনিতে ছিল তার আস্থা, আজ তাদের চোখেই তার প্রতি তিক্ততা দেখে ইমামার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। ইমামা কিছু বলতে যাবে, তখনই ক্যান্টিনের দেয়ালের টাঙানো বড় টিভিতে চলতে থাকা নিউজ হতে অফিসার মাহেশের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে৷
‘গত চারবছরে ৪২ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর লাশ পাওয়া যায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। তদন্ত করে জানা যায় সকলে ছিল যৌনকর্মী। শরীরে ধর্ষণের আলামত পাওয়া না গেলেও খুবই বীভৎসভাবে মুখের আকৃতি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। জোরদার তদন্ত, নিরলস প্রচেষ্টা, গাদা গাদা সন্দেহভাজন, বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ, কঠোর অভিযান চালিয়েও খুনিকে ধরা সম্ভব হয়নি। কোনো চেষ্টায় ফলপ্রসূ হয়ে ওঠেনি এখনও পর্যন্ত। অথচ, খুনের সংখ্যা যেন স্বর্ণের দামের মতো ক্রমাগত
বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে। সকলের মাঝে এখন আতঙ্কের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন প্রশাসনের উপর। দেশে এতোগুলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকা স্বত্বেও একের পর এক খুন কীভাবে হচ্ছে? পুলিশ, প্রশাসন কী নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে? সাধারণ জনগণের এই আক্রোশ থেকেই সাংবাদিকদের তীক্ষ্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় অফিসার মাহেশকে। এ প্রসঙ্গে সিআইডি অফিসার মাহেশ জানান,
“হোক সে যৌনকর্মী বা সাধারণ নাগরিক—সবার আগে তিনি একজন নারী। আমাদের মা-বোনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের প্রথম ও অপরিহার্য দায়িত্ব। আমরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত খুনিকে দ্রুত ও শক্ত হাতে গ্রেফতার করব। আপনাদের কাছো অনুরোধ, উত্তেজিত হবেন না। আমাদের তদন্তকে সাহায্য করুন। যে কোনো তথ্য থাকলে তা সরাসরি থানায় জানাবেন বা নিকটস্থ পুলিশকে অবহিত করবেন। নিজেদের এবং অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখুন। কোনো অপরাধী ছাড় পাবে না—এটাই আমার দায়িত্ব এবং আমার ওয়াদা।”
‘চেয়ারের পায়ার কর্কশ শব্দে টিভির স্ক্রিন থেকে চোখ সরালো ইমামা। ওরা উঠে যাচ্ছে। ইমামা ছুটে গিয়ে গৌরবের হাত আকড়ে ধরল৷ কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“এমনটা কেন করছিস দোস্ত? তোরা ছাড়া আমার কেউ নেই।”
‘গৌরব ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল। ইমামা আহত চোখে তাকাল তার দিকে। গৌরব আর একমুহূর্তও দাঁড়াল না। হিয়াকে টানতে, টানতে নিয়ে চলে গেল। ইমামা অর্কের কাছে যেতে চাইলে, অর্কও একইভাবে ইবরাতকে নিয়ে চলে গেল। ইমামার চোখের কোল ভারি হয়ে আসে। কান্না পায় খুব। সে ওদের পিছু নিতে যাবে, তখনই ফোনটা কেঁপে উঠে৷ দুইদিন পর সুরাকারের নাম্বার থেকে আজ অনেক বড় একটা মেসেজ এসেছে..
“আজ কোনো গান বা ভিডিও নয়। আজ বলব এক নরপিশাচের গল্প। এমন এক মানুষের গল্প, যার জীবনের ভয়াবহতা নামকরা বই বা সিনেমার সবচেয়ে নিষ্ঠুর ভিলেনদেরও হার মানায়। নাম তার গ্যারি রিজওয়ে৷ সে নিজেই আতঙ্কের সমার্থক। গ্যারির শৈশব ছিল গভীর অন্ধকারে মোড়ানো। প্রায় প্রতিটি সিরিয়াল কিলারের মতোই তার শৈশবও স্বাভাবিক ছিল না। যন্ত্রণায় ভরা ছিল। অজানা কারণে তার মা তাকে ভালোবাসার পরিবর্তে দিতেন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। কখনো নগ্ন অবস্থায় তাকে ভাইদের সামনে হাঁটতে বাধ্য করতেন, কখনো অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতেন, আবার কখনো অকারণে গায়ে হাত তুলতেন।
‘বাবা ছিলেন কর্মব্যস্ত মানুষ৷ সন্তানের বন্ধু হওয়ার সময় বা ইচ্ছে, কোনোটাই ছিল না তার। মাঝে মাঝে যখন সময় দিতেন,তখন তিনি প্রায়ই কর্মস্থলের যৌনকর্মীদের নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। বলতেন, “যৌনকর্মীরা সমাজের কীট, এদের থেকে নিকৃষ্ট কিছু নেই।” শিশু গ্যারি সেই কথাগুলো বিশ্বাস করেছিল অন্ধভাবে। ধীরে ধীরে তার মনে যৌনকর্মীদের নিয়ে জন্ম নিতে থাকে বিকৃত ঘৃণা। যা ভবিষ্যতে পরিণত হয় এক অমানবিক নৃশংসতায়।
‘স্কুল জীবন থেকেই গ্যারি ছিল মানসিকভাবে অস্বাভাবিকভাবে শক্ত, নির্মম এক ছেলেমানুষ। কিশোর বয়সেই গ্যারি প্রথমবার তার অন্ধকার প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটায়। একটি নিরীহ বেড়ালকে ফ্রিজে আটকে রেখে হত্যা করে। সেটাই ছিল তার জীবনের প্রথম খুন। পরবর্তীতে গ্রেফতার হওয়ার পর সে নির্দ্বিধায় অপরাধ স্বীকারও করে। হাইস্কুল শেষ হওয়ার পরই গ্যারি তার প্রেমিকা ক্লডিয়া ক্রেইগকে বিয়ে করে। তবে সে এক নারীতে থামার মানুষ ছিল না। জীবনে তিনবার বিয়ে করেছে এই হারামজাদা। প্রথম বিয়ের কিছুদিন পর গ্যারি যোগ দেয় নৌবাহিনীতে। সেখান থেকে সরাসরি পাঠানো হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধক্ষেত্রে।
‘সেখানে গিয়ে সে অসংখ্যবার যৌনকর্মীদের সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সম্পর্কে জড়ায়। শেষমেশ সংক্রমিত হয় গনোরিয়া রোগে। নিজের বেপরোয়া আচরণের ফল ভোগ করেও গ্যারি দায় নেয়নি। শালা উল্টো যৌনকর্মীদেরই দোষারোপ করতে শুরু করে। শৈশবে বাবার মুখে শোনা ঘৃণার যে বীজ তার মনে রোপিত হয়েছিল, এই ঘটনা সেটাকে রূপ দেয় এক বিকৃত, অমানবিক মহীরুহে।
‘দেশে ফিরে গ্যারি পুলিশ বিভাগে আবেদন করে। কিন্তু তার আবেদনটি অনুমোদিত না হলে সে ওয়াশিংটনের বেলিংহ্যামে কার পেইন্টার হিসেবে কাজ শুরু করে। সেখানেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় কাটায় সে। গ্যারির প্রথম বিয়ে টেকেনি বেশিদিন। দ্বিতীয় বিয়ের পর গ্যারি ধর্মকর্মে মনোযোগী হয়ে ওঠে। শুধু নিজেই ধর্ম পালন করত না, আশেপাশের মানুষকেও ঈশ্বরের বাণী শোনাতে যেত। কিন্তু ধর্মভীরু এই মানুষটার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ছিল ভয়ংকর এক বিকৃতি। ধর্ম প্রচার চলত দিনে, আর রাতে ছুটে যেত যৌনকর্মীদের কাছে।
‘কারোর থাকে টাকার নেশা, কারোর ঘুরার নেশা। আর গ্যারির নেশা ছিল কামের। প্রতিদিনই সে শারীরিক সম্পর্কের ক্ষুধায় পুড়ত। কখনো কখনো তো সে অন্যদের সামনে অবমাননাকরভাবে স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করত। সে দিনে কয়েকবার স্ত্রী বা প্রমিকাদের শারিরীক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য জোর করত। স্ত্রী বা প্রেমিকারা অস্বীকৃতি জানালেই সে ছুটে যেত যৌনকর্মীদের কাছে। অথচ সে নিজেই প্রকাশ্যে ঘৃণা করত তাদের।
‘দিনের আলোতে তাদের প্রতি ঘৃণার বাণী ছড়াত সে, আর রাতের অন্ধকারে তাদের শরীরেই সুখ খুঁজত উন্মত্তভাবে। এই দ্বিচারিতা থেকেই জন্ম নেয় তার ভেতরের ভয়ংকর মানসিক দ্বন্দ্ব। যা শেষমেশ তাকে ঠেলে দেয় রক্তপিপাসু খুনির পথে। ১৯৮২ সালে শুরু হয় গ্যারি রিজওয়ের হত্যাযজ্ঞ। ধারণা করা হয় সে ৭১ জন বা তারও বেশি নারীকে হত্যা করেছে। যাই হোক, এতটুকুই আজ বলা যাক। কথা বাড়াতে চাচ্ছি না। যা বোঝাতে চাইছি, তারজন্য এটুকু এনাফ। ইবরাত কি ভয়ংকর সুন্দর না? বিশেষ করে ওর টানা টানা চোখগুলো। ট্রাস্ট মি রেড ওয়াইন, তোমার চোখের চেয়েও গভীর ওর দৃষ্টি। ইউ নো হোয়াট আই মিন, সুইটহার্ট…
‘ইমামার পায়ের থেকে ঝিমঝিম করে উঠল। শিরদাঁড়া বেয়ে বরফস্পর্শী শিহরণ বয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। এটা কি হুমকি ছিল?এভাবে কী তাকে তার প্রিয় মানুষদের কাছ থেকে সরিয়ে ফেলতে চাইছে নরপিশাচ টা? ইমামার নিশ্বাস ভারি হয়ে আসে। অস্থির হয়ে উঠে মন।
“আমার ধর্ম পরিবর্তন করলে কি তুমি আমার হবে?”
‘এমনিতেই আতঙ্কে গুম হয়ে আছে মন, তার মধ্যে আবার এই উটকো ঝামেলা হাজির। ইমামা বিরক্তিতে পিছন ফিরে তাকায়। প্রফেসর আনাম তৃষিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইমামা চাপা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এসব কী যা-তা বলছেন স্যার?”
‘প্রফেসর আনাম এগিয়ে এলেন। তার কণ্ঠে কম্পন, বিরস মুখে তিনি বললেন,”আমাদের ধর্ম আলাদা বলে কী তুমি আমাকে ভালোবাসছো না ইমামা? তাহলে বলো আমি আমার ধর্ম পরিবর্তন করবো।”
‘ইমামার রাগ মাত্রাধিক বাড়ছে। আশপাশের সকলে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে তাদের আর কানাকানি করছে।
“আমার চার বছরের ভালোবাসা কি তোমাকে একটুও ছুঁতে পারেনি ইমামা?”
‘লোকটার কণ্ঠে অনভ্যস্ত কোমলতা থাকলেও ভাঙা ভাব। মনে হচ্ছে পুরুষালি কণ্ঠটা যেকোনো সময় ভিজে উঠবে। ইমামা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল প্রফেসর আনামের বিরহবিধুর মুখে। তার গৌরবদীপ্ত চোখের কোল ভেজা। চোখের পাপড়ি কাঁপছে।
‘ইমামা স্পষ্ট গলায় জানতে চাইল,”আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন স্যার?”
“ইমামা, আমি যে কাঙাল—ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমার তিনকূলে কেউ নেই। বিশ্বাস কর, আমাকে আঁকড়ে ধরার মতো কেউ নেই। কেউ হয় টাকার ভিখারি, কেউ হয় দু’মুঠো ভাতের ভিখারি, আর আমি ভালোবাসার ভিখারি ইমামা। প্লিজ, এবার অন্তত আমাকে ফিরিয়ে দিও না। একটু ভালোবাসা দাও আমাকে, প্লিজ। কথা দিচ্ছি, যত্নে মুড়িয়ে রাখবো তোমায়।”
‘এবার সত্যি, সত্যি প্রফেসর আনামের দু-চোখ যন্ত্রণামাখা অশ্রুতে ভরে উঠেছে। কঠোর, সদাতেজি ব্যক্তিত্বপূর্ণ এই নিপাট ভদ্রলোক অত্যন্ত চাপা স্বভাবের। এতোটাই চাপা যে, তার হৃদয়ে দীর্ঘ চার বছর ধরে জমে থাকা নিষ্কলুষ ভালোবাসা কথা ইমামা ছাড়া আর কেউ জানে না। যেখানে ক্যাম্পাসের শত শত রমণী তার জন্য পাগল, সেখানে সে চারবছর ধরে এক পাক্ষিক প্রেমের লাহরীতে সুখের আসা বুক ভাসাতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ফিরে এসেছে বহুবার।
‘তবে আজ যে লোকটা হঠাৎ করে এতোটা ভেঙে পড়বে তা হয়ত ভাবতে পারেনি ইমামা। তাইতো চোখে-মুখে বিস্ময়ের স্রোত। বর্তমান পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে ইমামা আজ ধৈর্যচ্যুত হয়েও ক্ষিপ্ত হল না। বরং এগিয়ে এসে সরাসরি প্রফেসর আনামের সামনে দাঁড়াল। তারপর আশেপাশে গোয়েন্দাসুলভ দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নরম গলায় বলতে শুরু করল,
“সৃষ্টিকর্তা ভালোবাসার ক্ষমতা সবাইকে দেয় না। আপনাকে দিয়েছে, নিশ্চয়ই এর পিছনে মহৎ কোনো কারণ আছে। আপনি সেটা খুঁজে বের করুন। আমি আপনাকে ভালোবাসি না স্যার। আর না তো কখনো ভাসতে পারবো। প্লিজ আজকের পর থেকে আমার আশেপাশে আসবেন না। আমি আমার জন্য না, আপনার ভালোর জন্য বলছি। আপাতত আমার থেকে দূরে থাকায় আপনার জন্য মঙ্গলজনক। আমি চাই না, আমার জন্য কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হোক। কারণটা নাহয় অজানায় থাক। শুধু বলবো, আমি একটা ট্র্যাপে আছি। আমার আশেপাশে যারা আসছে, তারাও সেই নোংরা ট্র্যাপের শিকার হচ্ছে।”
‘প্রফেসর আনামের কপাল কুঁচকে উঠে। সে এসবের মানে কিছুই বুঝতে পারেনি। প্রশ্ন করতে যাবে, তখনই পেছন থেকে একটি দাম্ভিক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
“হেই, বেইব!”
‘অফিসার মাহেশের কণ্ঠ শুনে ইমামা বিস্ময়ে ঘুরে দাঁড়াল। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ ভার্সিটিতে এসে হাজির এই লোক! প্রফেসর আনাম শ্যেনদৃষ্টিতে মাহেশের আপাদমস্তক পরখ করতে লাগলেন। ছয় ফিট এক ইঞ্চি উচ্চতার উজ্জ্বল বর্ণের এই অফিসার কে দেখলে মনে হয় সিনেমার পর্দা থেকে নেমে আসা চরিত্র। পেটানো দেহ, পরিপাটি পোশাক, সিল্কি চুল, আর গালের সেই টোল—সপ্তদশী, অষ্টাদশীদের হৃদয় জয়ের জন্য যথেষ্ট। কিশোরী মহলে আকর্ষণের সংজ্ঞাই যেন নতুন করে লিখে দিয়েছে এই মানুষটি।
‘অফিসার মাহেশ ইমামার পাশে এসে দাঁড়াতেই প্রফেসর আনাম গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন,
“আপনি?”
‘প্রত্যুত্তরে অফিসার মাহেশ ঠোঁট কামড়ে হাসল। মুখ পাতলা লোকটা কী বলতে পারে, তার আগে থেকেই ধারণা করে ইমামা চটজলদি অফিসার মাহেশকে নিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ল।
‘ইমামা অফিসার মাহেশের গাড়িতে উঠে চলে গেল। গাড়িটা ক্যাম্পাসের প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে দৃষ্টিসীমা পেরোতেই আড়াল থেকে এক মেয়ে বেরিয়ে এলো। কাঁধ ছোঁয়া চুলে মুখটা প্রায় ঢেকে গেছে। মেয়েটার চোখে যেন ঝড় জমে আছে। হঠাৎই সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
“সন অফ এ বিচ।”
‘গাড়িতে উঠে প্রথমেই ইমামা গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে,”আপনার একটুও ভয় হচ্ছে না?”
‘অফিসার মাহেশ বেশ সচেতন চালক। সে রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরালো না৷ নির্বিক অবস্থানে থেকে জানতে চাইল,”কেন?”
“এই-যে আমার পিছনে দু’টো সাইকো পড়ে আছে, তাও আমার সাথে মিশছেন, আমাকে হেল্প করেছেন।”
‘অফিসার মাহেশ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে দাঁত কেলিয়ে হাসল। তারপর হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে পেশাদার দাম্ভিক কণ্ঠে বলল,
“আপনার সাথে মিশছি না। আমি আমার ডিউটি পালন করছি এন্ড আমার কেসের সূত্র ধরেই আগাচ্ছি।”
‘ইমামা কণ্ঠে ভয়,”এটা কিন্তু রিস্ক হয়ে যাচ্ছে অফিসার মাহেশ। দে আর নট হিউম্যান, দে আর প্যারানরমাল।”
“যেখানে রিস্ক, সেখানেই তো ইস্ক।” বলেই চোখ টিপল অফিসার মাহেশ।
‘চোখ রাঙালো ইমামা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ প্রশ্নের তীর ছুঁড়ে, “এতোদিন কী নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলেন?”
‘লম্বা করে শ্বাস টানল অফিসার মাহেশ, বলল,”জিজ্ঞেস করুন কীভাবে ফ্রি হয়ে আসলেন? শালার চাপ আর চাপ! সব হারামি খুনির জাত যেন বাংলাদেশে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। খুন করার জন্য যেন আর কোনো দেশ নেই। বাঙ্গালীদের সরল পেয়ে ইচ্ছেমতো মেরে দিচ্ছে। শালাদের একবার পেয়ে নিই শুধু, কোমরের হাড্ডি ভেঙে দিবো একদম।”
‘ইমামা মুখে হাত চেপে হালকা হেসে উঠল। অফিসার মাহেশ ভ্রু কুঁচকে তাকাল তার দিকে। খুব আশ্চর্য হল সে। আজব তো, এখানে হাসার কী আছে? যত্তসব!
‘এবার গম্ভীর ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল অফিসার মাহেশ,
“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হঠাৎ করেই সিড হত্যার কেস তুলে নিয়েছেন। যদিও এতে আমার তদন্ত থেমে নেই। তবে বিষয়টি আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। আশা করছি, খুব শীঘ্রই কারণটা জানতে পারবো। তাছাড়া ডিজিপির চাপ তো আছেই। এগুলো ছাড়াও একটা সিরিয়াল কিলিংয়ের কেস খুব খাটাচ্ছে। সবটা ক্লিয়ার হয়েও কোথাও যেন ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।”
“যেমন?”
“নিউজে নিশ্চয়ই শুনেছেন, ষোলো বছরের মেয়েদের নির্মমভাবে ধ-র্ষ-ণ করে হত্যা করা হচ্ছে। এই কেসের নিখুঁত তদন্তে একজন সন্দেহভাজন উঠে এসেছে। কিন্তু এখানেও সমস্যা আছে। সব প্রমাণ তাকে দোষী সাবস্ত করলেও একটা জায়গায় এসে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা। আর তা হলো, প্রতিটি মেয়ের শরীরে পাওয়া বীর্যের সাথে ক্রাইম সাসপেক্টের রক্তের গ্রুপ মিলছে না।”
‘ইমামা সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে হঠাৎ বলে উঠল,
“হয়তো খুনি নন সেক্রেটর।”
‘হঠাৎ জোরসে ব্রেক কষল অফিসার মাহেশ। ইমামার মাথা গিয়ে বারি খেলো গাড়ির সামনের অংশে। যদিও আঘাত তেমন গুরুতর নয়। অফিসার মাহেশ ইমামাকে তাৎক্ষণিক সেবা প্রধান করে ব্যস্ত গলায় জানতে চাইল,
“মানে ?ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
‘রক্ত না ঝরলেও কপালের বাঁ পাশটা একদম ফুলে উঠেছে। টনটনে ব্যাথা ছড়িয়ে পড়েছে ধূসর রঙের প্রতিটি কোষে। ইমামা ভেজা টিস্যু কপাল থেকে সরিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
“নন সেক্রেটরদের দেহের অন্যন্যা তরলের সাথে রক্তের মিল থাকে না।”
‘অবাক বিস্ময়ে অফিসারের মাহেশের চোখ দু’টো রসগোল্লার মতো গোল, গোল হয়ে গেল। হঠাৎ করেই তালি বাজাতে শুরু করে সে।
“ব্রাভো মিস ইমামা, ব্রাভো! আই’ম জাস্ট ইমপ্রেসড। এই বিষয়টা আমার মাথা আগে আসেনি। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ বিউটিফুল।”
‘আবারও গাড়ি স্টার্ট দিল সে। মাঝে ফোন করে সহকর্মীদের এই বিষয়ে অবগত করে রাখে। ইমামা একদৃষ্টিতে রেয়ার মিররের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে এখনো পর্যন্ত সন্দেহভাজন কাউকে চোখে পড়েনি। আর পড়বেই বা কীভাবে? শিকারী যদি চলে ডালে ডালে, তবে শিকার চলে পাতায়, পাতায়৷
‘হঠাৎ ইমামা বলে উঠল,”ওই কেসটার কী হলো?”
“কোনটা?”
“এতোগুলা প্রস্টিটিউডদের যে খুন করা হলো, সেটা?”
‘হঠাৎ করেই স্নান হয়ে যায় অফিসার মাহেশের উজ্জ্বল মুখশ্রী। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। তারপর হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“এখনও পর্যন্ত সামনে আগানোর মতো কিছু পাওয়া যায়নি৷”
‘ইমামা একদৃষ্টিতে অফিসার মাহেশের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ সুচারু দৃষ্টি! অফিসারের কথা শুনে সে সোজা হয়ে বসল। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ ভাবুক গলায় বলতে শুরু করল,
“খুনি আমাদের আশেপাশেই আছে । কিন্তু তাকে আমরা আইডেন্টিফাই করতে পারছি না। সে এমন কেউ, যার উপর কারো কিঞ্চিৎ পরিমাণ সন্দেহ আসার সম্ভাবনা নেই। চার বছরে এতোগুলা খুন, অথচ কেউ তার টিকিটিও ধরতে পারছে না? এক্সচুয়ালি এটাকে ইংরিজিতে বলে ‘হাইডিং ইন প্লেইন সাইট।’ সে আমাদের সাথেই মিশে আছে। অনেক সময় এমন হয়—যাদের সন্দেহ করা উচিত, আমরা তাদের সন্দেহ করি না। আরেকটু কেয়ারফুল হোন, অফিসার।”
‘অফিসার মাহেশ শুকনো মুখে মাথা নাড়ানেন।
‘ইমামা বলল,”প্লিজ দ্রুত খুনিকে খুঁজে বের করুন।”
‘অফিসার মাহেশ প্রসঙ্গ পালটে ফেলল, বলল,”আমরা যে-ই কাজে এসেছি, সেটা করি আগে?”
“সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়েছে?”
“ফাকিং নট।”
“ছি!”
‘দাঁত বের করে হাসল সে,”হিহিহিহি।”
‘ইমামা জানালা দিয়ে বার বার এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিরস মুখে বলল,”আমার চোখেও তো কাউকে পড়ছে না। তাহলে কী সে টের পাইনি?”
“পেয়েছে তো অবশ্যই। তবে গভীর জঙ্গলের শিকারীরা রাতে শিকারে বের হয়।”
‘ইমামা ঘাড় ঘুরিয়ে অফিসার মাহেশের দিকে তাকাল। চোখের ইশারায় জানতে চাইল,
“তাহলে রাতের প্ল্যান?”
‘অফিসার মাহেশ বাঁকা হাসল। ইমামার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে রহস্য করে বলল,”যেটা বলেছিলাম।”
“ওকে। একবার শুধু জানোয়ারটাকে পেয়ে নিই।” ইমামার চোখে আগুন।
‘অফিসার মাহেশ কথার মধ্যে চিমটি কাটল। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,”কোন জানোয়ারের কথা বলছেন?”
‘ইমামার চিবুক শক্ত হয়। কণ্ঠে ধীরে ধীরে ক্রোধের স্ফুরণ ঘটছে। সে চাপা গলায় বলল,”জানোয়ার তো একটাই।”
“না।”
“আমি কারিবের খুনির কথা বলছি।”
“আরেকজন কিন্তু আছে। সে সিডের খুনি। সুতরাং, জানোয়ার হলে তাঁরা দুজনেই।”
‘ইমামা নিশ্চুপ। শব্দ বেরোয় না মুখ দিয়ে। হঠাৎ করেই সে যেন অতলস্পর্শী ভাবনার গভীর তলিয়ে গেল। পাশে যে একজন তার দিকে সুচারু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সেদিকে বিন্দুবৎ হুঁশ নেই তার।
‘ইমামাকে বিজ্ঞ চোখে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে হঠাৎ
অফিসার মাহেশ প্রশ্ন ছুঁড়ে,”ইজ ইট ইনফ্যাচুয়েশন?”
‘ইমাম চমকে উঠল। প্রশ্নবিহ্বল চোখে তাকাল অফিসারের দিকে, “মানে?”
‘ইমামার হতবিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে অফিসার হাসল। হাসতে, হাসতেই বলল,
“মনে হচ্ছে তারজন্য আপনার মনে ইতিমধ্যে একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়ে গিয়েছে।”
‘ইমামা একটু নড়েচড়ে বসলো। কয়েকবার গভীর শ্বাস টেনে, কাটা কণ্ঠে বলল, “তেমন কিছুই না।”
‘অফিসার এবার স্বরটি টুকটুকে করে হাসল; গলাটা উঁচু করে বলল,”ইউ আর ফলিং, মিস ইমামা।”
‘কিছুক্ষণ থেমে, একটু সংযোগ করে যোগ করল,
“মেবি হি এলসো ফল ফর ইউ। দ্যাটস হোয়াই হি ডুয়িং অল অফ দিস।”
“ডুয়িং হোয়াইট?”
“এই-যে সিড, যে আপনাকে এত বাজে ঠকিয়েছিল, তাকে তার উপযুক্ত শাস্তি দিল সে। অথচ এই খুনে আপনার ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল দারুণ। কিন্তু দেখুন ফাঁসা তো দূর, কেসটাই ক্লোজ হয়ে গেছে। আর তারপর…”
“তারপর?” ইমামার কণ্ঠে কাঁচা কৌতূহল।
“অফিসার একটু হেসে বলল, “প্রেমে ছেলেদের একটা সাইকোলজি আছে—মেয়েরা সহজে বুঝবে না। সময় লাগবে; সময়ই আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবে।”
“সবটা?”
“হাঁ, সবটা—আপনার আর তার ভালোবাসা। খুব সম্ভবত আপনাদের দু’জনেরই লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয়েছিল।”
‘ইমামা অবাক হয়ে গেল। তবে কিছুই বলতে পারল না। অজান্তেই হাত দিল গলার চেইনে। পাতলা, নরম চেইনটি টেনে হাত ছোঁয়াল আংটিকে। এই আংটিটি আর.কে.-র দেওয়া। গত রাতে দিয়েছে। এটার মধ্যেও যে কোনো না কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে, সে সম্পর্কে অবগত সে। এই চেইন আর আংটির সাথে ছিল একটি চিরকুটে। যাতে লেখা ছিল কয়েকটি শব্দ…
“আমি মায়া হয়ে কলঙ্কের মতো মিশে যাবো তোমার মাঝে। তুমি চাইলেও কখনো আমায় মুছতে পারবে না, হৃদয়হরিণী আমার।”
‘হঠাৎ করে ইমামাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে অফিসার নিজে থেকে বলে উঠল,
“আচ্ছা আমাদের প্রথম ডেটে আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
‘ইমামা কপাল কুঁচকালো,”ডেট মানে?”
“ওমা, এটা তো একপ্রকার ডেটই বটে। জীবনের রিস্ক নিয়ে এসেছি, এখন একটু ভালো কোথাও না গেলে চলে?”
“বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। না হলে আজ আমার ডিনারে মিটের জায়গায় আপনাকেই খেতে হবে।”
“ইশশশ, হামকো পাকারনা ইতনি আহসানি নেহি হে!”
‘ইমামা কোনো উত্তর দিল না। তির্যক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ অফিসার মাহেশ ধমকে উঠল,
“এই মেয়ে, হাসো! একটুও হাসা যায় না নাকি? সারাক্ষণ এভাবে গম্ভীর হয়ে থাকো কেন? মেয়ে মানুষ মানেই বেশি হাসবে। হাসবে আর পুরুষের মন চুরি করবে।সেটা না করে সারাক্ষণ মুখে বাংলার পাঁচ!”
‘ইমামা কেঁপে উঠল। চোখ শক্ত করে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”আপনাদের মতো আমার এতো হাসি আসে না।”
‘অফিসার বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে তাকাল ওর দিকে। সে চেহারা দেখে না চাইলেও হালকা হেসে ফেলল ইমামা। অফিসার বুক চেপে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
“আহহহ! এভাবে হেসো না মেয়ে, বুকে কেমন কেমন করে!”
‘ইমামা অধরের কোণে হাসি রেখে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল,
“কেমন কেমন করে?”
“টুন টুন করে।”
‘ইমামা এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। অফিসার সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“এই মেয়ে, হাসো কেন? তুমি হাসলে আমার দিলে টুন টুন করে!”
‘ইমামা হাসি থামিয়ে গম্ভীর হলো,”ফ্লার্ট করছেন?”
‘অফিসার হেসে বলে,”ধরে ফেলেছো দেখছি।”
“কেন করছেন?”
“Kya karu o ladies mai ho aadat se majboor,”বলে চোখ টিপল অফিসার মাহেশ।’
‘ইমামা ভেংচি কাটল৷ গাড়ির ভেতর পিনপতন নীরবতা। কিছুটা দূর যেতেই অকস্মাৎ অদ্ভুত প্রশ্নের তীর তেড়ে যায় ইমামার দিকে।
“আপনার কষ্ট হচ্ছে না, মিস ইমামা?”
‘ইমামা অবাক হয়ে তাকাল অফিসারের দিকে।
“কষ্ট? কেন?”
“এই যে আপনার বন্ধুরা আপনাকে ইগনোর করছে।আপনাকে নিয়ে যতদূর আমি স্টাডি করেছি, তাতে আপনার আর কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই, এমনকি আত্মীয়রাও আপনাকে ভালো চোখে দেখে না। আপনার রূপটাই হিংসার কারণ হয়ে আপনাকে আলাদা করে রেখেছে সবার থেকে। অথচ যেখানে শুধু তারাই ছিল আপনার পরিবার, রক্তের বাইরের এক বিকল্প পরিবার।”
‘ইমামা হালকা হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে ছিল শূন্যতা। সে বলল,
“কষ্ট? হাহাহা… যেখানে আমি টের পাচ্ছি আমার শরীরের একটা অংশ ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে আমাকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে, আমি নিজের চোখে নিজেকে হারাতে দেখছি—তবুও ভয় পাচ্ছি না, কোনো অনুতাপ হচ্ছে না। সেখানে ওরা তো শুধু ক্ষণিকের সঙ্গী, অফিসার। আমি নিজেকে এবং অন্যকে হারাতে ভয় পাই না।”
‘মাহেশ চুপচাপ ইমামার কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
“আপনি চান, এই বিষয়ে আমি কিছু বলি?”
‘ইমামা শুকনো মুখে একটুখানি মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“বাবার মতো একই কথা বলবেন নিশ্চয়ই! থাক, দরকার নেই।”
‘মাহেশ হালকা মাথা নেড়ে বলল,”আপনি সত্যি এক ‘ডেথ-কল্ড ফিস’, মিস ইমামা।”
‘ইমামা তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠল,বলল,”আপনাদের কাছে আমাকে হয়ত তাই মনে হয়। কিন্তু কেউ দেখেনি—একটা ছোট্ট মেয়ে কীভাবে মায়ের আদর ছাড়া বড় হয়। কেউ দেখেনি, কীভাবে সে কাঁদত যখন তার মা যখন তার ভাইকে খাইয়ে দিতো, আর তাকে ফিরিয়ে দিতো চোখের পানি সমেত।”
“মা? সবাই কি মা হয় নাকি?”
“আপনার মা নেই?”
‘হঠাৎ অকারণেই চিবুক শক্ত হয়ে গেল অফিসারের। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“আমার কেউ নেই।”
“মায়ের ওপর আপনার কি খুব অভিমান?”
“যে নেই, তার ওপর আবার কীসের অভিমান?”
‘ইমামা আর কথা বাড়াল না। প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট আসবে কবে?”
“আর কিছুদিন সময় লাগবে।”
‘ইমামা নিশ্চুপ হয়ে সিটে গা এলিয়ে দিল। দু’হাতে পেটে চেপে ধরে হঠাৎ করেই আনমনে দুই লাইন গেয়ে উঠল,
“পাতা উলটে দেখো, একটা গল্প লেখা। একটু জানা কাহিনী, কিছু কিছু অজানা।”
‘ওর চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, নিরবে।
“খুব শীঘ্রই তোর সঙ্গে আমার ওপারে দেখা হবে, কারিব। তখন সময় নিয়ে তোর কাছে মাফ চাইবো। তখন অন্তত ওদের মতো করে মুখ ফিরিয়ে নিস না দোস্ত। চিন্তা করিস না, মরার আগে তোর খুনিকে মেরে মরবো আমি। ইমামা তার কথা রাখবে।”
‘দূরে থেকে কারিবের কবরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো বলে নির্বিকারভাবে গাড়ির দিকেই এগোতে লাগল ইমামা। গাড়ির কাছে যেতেই অফিসার মাহেশ কান থেকে ফোন নামিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,
“সরি মিস,আমাকে এখনই যেতে হবে। ইটস অ্যান ইমার্জেন্সি।”
‘ইমামা ঠাণ্ডা সুরে জবাব দিল, “ওকে। যে জিনিসটা চেয়েছিলাম, সেটা এনেছেন?”
‘মাহেশ তার চেনা হাসি একটু করে ফেলে পকেট থেকে একটি রিভলবার আর ধাতব এক যন্ত্র বার করে বলল,
“সুন্দরীদের কথা ফেলে দেয়া যায়, বুঝি?”
“শাট আপ,” বলে জিনিসগুলো হাতে নিল ইমামা।
“রাতে দেখা হবে,” বলে মাহেশ হালকা হেসে চলে গেল। ইমামা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা হাতে ধরা রিভলবারের দিকে৷
❌
📌গল্প নিয়ে আজ কিছু কথা বলি—অনেকের কাছে খুব পেঁচানো লাগছে না? আবার অনেকের মনে হচ্ছে আমি ইচ্ছে করে পেঁচাচ্ছি। কিন্তু আসলে তেমনটা না। বিশ্বাস করুন গল্পটাই প্যাঁচের। যার জন্য আপনাদের বুঝতে হয়ত অনেক সমস্যা হচ্ছে। এবার বুঝুন লিখতে আমার কতটা সমস্যা হচ্ছে। কাহিনী সাজাতে এবং লিখতে আমার অনেক খাটুনি যাচ্ছে। যার কারণে এতো দেরি হয়। আর গল্পটা আমি শুরু থেকেই টানছি। আমার মনে হয়না, কোনো গল্প আমি এতো ফাস্ট টেনেছি। অতিরিক্ত একটা লাইন লিখছি না, কোনো বিস্তর বর্ণনা দিচ্ছি না। বাট এবার টানছি শুধু আপনাদের জন্য—যাতে করে মেইন গল্পে দ্রুত ঢুকে যেতে পারি এবং আমাদের কাছে চরিত্রগুলো ক্লিয়ার হয়ে যায়। যারা আমার পূর্বের গল্পটা পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন বুড়ির গল্পের প্রতিটি চরিত্রে রহস্য থাকে; ঠিক তেমনি এই গল্পের প্রতিটি চরিত্রেরও আলাদা, আলাদা রহস্য রয়েছে। আর বরাবরের মতোই বুড়ির গল্পে, প্রথম পর্বের রহস্য শেষ পর্বের উন্মোচিত হবে। প্রতি পর্বে হিন্টস থাকবে, টুইস্ট থাকবে, নতুন চরিত্র নামানো হবে। যে যত নিখুঁতভাবে ঝট গুলো খুলতে পারবে, সে তত বেশি এনজয় করতে পারবে। বাইদ্যওয়ে আজকের নতুন চরিত্রটা কে হতে পারে, এনি আইডিয়া?
⛔আর কিছু কমন
Share On:
TAGS: born to be villains, মিথুবুড়ি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
Born to be villains পর্ব ৫(প্রথমাংশ+শেষাংশ)
-
Born to be villains পর্ব ২
-
Born to be villains পর্ব ১৪(প্রথমাংশ+শেষাংশ)+বোনাস
-
Born to be villains পর্ব ১০+বোনাস
-
Born to be villains পর্ব ৬
-
Born to be villains পর্ব ১২
-
Born to be villains পর্ব ১
-
Born to be villains পর্ব ১১
-
Born to be villains পর্ব ১৩
-
Born to be villains পর্ব ৪