তোমার_হাসিতে
ফারহানাকবীরমানাল
৮.
জায়েদা বলল, “সারপ্রাইজের কথা শুনে চমকে গেলেন নাকি?”
আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। জায়েদা মাটির দিকে তাকিয়ে আছে৷ হাত দু’টো কোমরের পেছনে লুকনো। উজ্জ্বল চোখ, ঠোঁটের কোণে হাসি ঝলমল করছে। ওর এই উদ্বেগ উদ্দীপনা আমার ভালো লাগল না। যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় বললাম, “কী ধরনের সারপ্রাইজ?”
জায়েদা হাত মেলে ধরল। একটা ডাইরি। নীল কভারের উপরে সোনালী রঙে ‘প্রিয় ভালোবাসা’ লেখা আছে। আমি বললাম, “এসব কী? ডাইরি কিসের?”
“আপনার জন্য এনেছি। এটাই সারপ্রাইজ।”
“মানে? এসব কোন ধরনের ফাজলামো?”
“আপনি এমন করছেন কেন?”
জায়েদার মুখ কালো করে ফেলল। আমি বললাম, “তুমি আমার জন্য ডাইরি নিয়ে এসেছ কেন?”
“আপনাকে দেবো বলে।”
“কেন দেবে?”
“এটা আমার ডাইরি না। তানহা আপুর ডাইরি। কাল রাতে আপুর মা আপুকে খুব মে’রে’ছে।”
“কেন মে’রে’ছে?”
“জানি না। জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু আমায় কিছু বলেনি।”
“ডাইরি পেলে কীভাবে?”
“আপু এটাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছিল। আমি ঘরে ঢুকতেই ওড়নার নিচে লুকিয়ে ফেলল। খেয়াল রেখেছিলাম। পরে চু’রি করে নিয়েছি।”
“কী! চু’রি করেছ? কেন চু’রি করেছ?”
“চাইলে আমায় দিয়ে দিতো নাকি?”
“তা দিতো না। তবে না বলে অন্যের জিনিস নিয়ে এমন কিছু করা উচিত না।”
জায়েদার মুখ চোখ কঠিন হয়ে গেল। বিড়বিড়িয়ে বলল, “যার জন্য চু’রি করি সেই বলে চো’র।”
“আমি তোমাকে চো’র বলিনি।”
সে মুখ বেঁকিয়ে অন্যদিক ঘুরে রইল। আমি বললাম, “ডাইরি খুঁজে না পেলে তোমাকেই সন্দেহ করবে। তখন কী হবে?”
“তানহা আপু বাড়িতে নেই। আজ সকালে তার নানাবাড়ি চলে গেছে। মে’রে ধরে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
“আচ্ছা৷ এখন যাও। একা যেতে পারবে? না পারলে বলো। এগিয়ে দিয়ে আসছি।”
“প্রয়োজন নেই। আমি পারব।”
জায়েদা হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করল। ব্যস্ত গলায় বললাম, “তোমার জন্য তেঁতুল এনেছি।”
“লাগবে না।”
সে দৌড়াতে শুরু করেছে। পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে না। শীতের দিনে বিকেলের সময় অল্প। বিকেল পড়তেই সন্ধ্যা নেমে যায়। এখনই চারদিকে কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে। আমিও আর দাঁড়ালাম না। বাড়ি চলে এলাম।
বাদশার মামা কল দিয়েছিল। আগামীকাল কাজে যেতে হবে না। ভদ্রলোকের শ্বশুর বাড়ি বেড়ানো শেষ হয়নি। সেই হিসেবে আগামীকাল আমার ছুটি। ছুটির দিনে সবার নানান ধরনের পরিকল্পনা থাকে। মনে মনে একটা ছক কষে ফেললাম। সকালে হোসেন উদ্দীন সাহেবের সাথে করতে যাব। সব ধরনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে হবে। আঠারো উনিশ হাজার টাকা সহজ ব্যাপার না।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে সাত পাঁচ ভাবছি। হঠাৎই মা আমার কাছে এলো। তরল গলায় বলল, “সত্যি করে একটা কথা বল তো, তোর কী হয়েছে?”
“আমার আবার কী হবে?”
“মুখ কালো হয়ে গেছে। চোখের দিকে তাকালে ভীষণ রকমের ক্লান্ত মনে হয়। সারাদিন কোথায় কী করিস?”
“এমনি ঘুরেটুরে বেড়াই। কলেজে ছুটি পড়ে গেছে। এ ক’দিন আর পড়তে ইচ্ছে করছে না।”
“পড়তে ইচ্ছে করে না বললেই তো হবে না বাবা। তোর আব্বা অনেক কষ্ট করে। আমাদের খরচ চালাতে গিয়ে নিজের জন্যও কিছু কেনে না। তারপরও যদি পড়াশোনায় এমন হেলাফেলা করিস তাহলে কী হয়?”
মায়ের কথার জবাব দিলাম না। কী বলব? বলার মতো কিছু নেই। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “এমন কিছু করিস না যেন আমাদের মানসম্মান নষ্ট হয়ে যায়।”
আমি মায়ের হাত চেপে ধরলাম। জড়ানো গলায় বললাম, “করব না৷ কখনো করব না। আমি তোমাদের মাথা নিচু হতে দেব না।”
মা হাসল। অসম্ভব সুন্দর হাসি। মা খুব সুন্দর করে হাসতে পারে। আমি আমার জীবনে এত সুন্দর হাসি দেখিনি।
রাতে খাওয়ার সময় রাঙা দাদি ছোট চাচার বিয়ের প্রসঙ্গ তুললেন। শক্ত মুখে বললেন, “মেয়ের বয়স কম হয়ে যাচ্ছে না?”
দাদি বললেন, “কম হয়ে যাবে কেন? মেয়ের বাড়ি থেকে দেখেশুনে তারপরই তো রাজি হয়েছে। তাছাড়া ছেলে সরকারি চাকরি করে। আজকালকার যুগে এসব খুব নরমাল ব্যাপার।”
“তবুও বনিবনার একটা ব্যাপার থাকে না?”
ছোট চাচা ফোন চাপছিল। ফোন থেকে মুখ তুলে বিরক্ত গলায় বলল, “বনিবনা হবে কি-না ওইটা আমি বুঝব।”
রাঙা দাদি বললেন, “তা ভালো। নিজের ব্যাপার নিজে বুঝলে তো কোন কথা নেই। তবে আমি শুনলাম সাজ্জাদ নাকি ওই মেয়েকে কোন ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। এ ব্যাপারে কী বলবে?”
ছোট চাচা অত্যন্ত সহজ গলায় বলল, “সাজ্জাদ মিথ্যে কথা বলেছে। যেমন মা, তার তেমন ছেলে। এরা আমার ভালো সহ্য করতে পারে নাকি?”
আমি ফিকফিক করে হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতে বললাম, “তা ঠিকই বলেছেন। আমার মা আপনার ভালো চায় না। সেজন্যই বেকার অবস্থায় নিজের বোনের কাছে দু’শ টাকা ধার চেয়ে পাননি। পরে আমার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছেন। কতদিন খেতে বসে দাদির কথা হজম করতে না পেরে রেগেমেগে উঠে চলে যেতেন। মা আপনার ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসত। ঠিকই বলেছেন আপনি! আমরা মা ছেলে আপনার ভালো সহ্য করতে পারে না।”
ফুফু বলল, “আগের কথা আগে চলে গেছে। ভাবী আগে ভালো ছিল। গহনা নেওয়ার পর থেকে কেমন একটা হয়ে গেছে৷ আগের মতো নেই।”
রাঙা দাদি বললেন, “থাকার কথা ছিল বুঝি? তোমরা সবাই একজন মানুষের মনে কষ্ট দিবে, তারপর আশা করবে সে তোমাদের এক রকম জানুক। এমন দিবা স্বপ্ন লোকে কীভাবে দেখে কে জানে!”
ফুফু কিছু বলতে যাচ্ছিল। দাদি তাকে থামিয়ে দিলেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, “খাওয়া শেষ করে যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।”
ফুফু আর কিছু বলল না। শুধু ফুফু নয়, বাকিরাও কিছু বলল না। খাওয়ার পর্ব নীরবেই শেষ হলো।
হোসেন উদ্দীন সাহেব পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। হাতে চায়ের কাপে। ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছেন। আমি তার সামনের চেয়ারে বসে উসখুস করছি। প্রায় অপরিচিত একজন লোকের সামনে বসে তার খাওয়া দেখা ভীষণ বিরক্তিকর ব্যাপার।
তিনি ধীরেসুস্থে কাপের চা শেষ করলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, “কী কথা বলবে?”
“কালকের ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা ছিল।”
“কালকের ব্যাপার? কালকের ব্যাপার ভুলে গিয়েছি। নতুন করে বলো।”
“বেশ ভালো অংকের লাভে ধান কিনতে চাইলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। আমার পরিচিত এক গ্রামে এ বছরে ধানের প্রচুর ফলন হয়েছে।”
“তাই নাকি? লাভের পরিমাণ কত?”
“আপনি যতটা ধারনা করেছেন তার চেয়ে কয়েক শতাংশ বেশি। আস্তা রাখতে পারেন।”
“আমাকে এত সাহায্য করে তোমার কী লাভ?”
“আমি বলেছি ধান কিনতে সাহায্য করব৷ এটা আমার ব্যবসা। সোজা বাংলায় মধ্যস্বত্বভোগী।”
“কী ধানের ব্যবসা করতে চাইছ?”
এতক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে গেলেও এবার থম খেয়ে গেলাম। এই সময়ে কোন ধানের চাষ হয় সেসবের কিছুই আমার জানা নেই৷ খুব করে চেষ্টা করলে দুই একটা ধানের নাম বলতে পারব। তা-ও ঠিকঠাক পারব কি-না সন্দেহ। হোসেন উদ্দীন সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ফ্যাকাসে মুখে বললাম, “যার যেমন চাহিদা তার সাথে তেমন ধানের কারবার করি। আপনাদের মত বড় মানুষের গ্রামের ঘুরে ধান দেখার সময় হয় না। ওই কাজটা করে দেই। এতে আমারও কিছু থাকে। দুই পক্ষেরও থাকে।”
“ভালো!”
শুধু ভালো! এই শুধু ভালোর মানে কী বুঝতে আমার বেশ সময় লাগল। হোসেন উদ্দীন সাহেব বললেন, “তাহলে কিছু স্যাম্পেল নিয়ে এসো। দেখেশুনে পছন্দ হলে ভেবে দেখব।”
ঘড়িতে সকাল নয়টা। নাস্তা না করেই বেরিয়ে এসেছি। ছোট চাচার বিয়ের খুব বেশিদিন বাকি নেই। এর মধ্যে গহনার ব্যবস্থা করতে হবে। গতকাল রাতে খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়েছি। শোবার পর হঠাৎই ডাইরির কথা মনে পড়ল। বাতি জ্বেলে ডাইরি খুলে বসলাম। নানান ধরনের কথাবার্তা লেখা। প্রেমের কবিতা, ছন্দ। ডাইরি যেমন হয় আর কী। পড়তে বেশ ভালোই লাগছিল। অন্যের ব্যক্তিগত জিনিস এভাবে ধরেছি ভেবে একটু খারাপ লাগছিল৷ কিন্তু আমার কিছু করার নেই। যে মানুষটা সামান্য একটা কথায় আমার জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে৷ তাকে আমি কোন ছাড় দিতে পারি না। এতে অন্যের প্রাইভেসি নষ্ট হলেও আমার কিছু করার নেই। আমার যেমনই লাগুক না কেন, কিছু যায় আসে না।
ডাইরি পড়তে পড়তে হঠাৎই একটা ছবি নজরে পড়ল। তাহনার সাথে সেই ছেলের একটা ছবি। যাকে ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। ছেলেটা তানহার কাঁধে হাত দিয়ে রেখেছে। ছবিটা নিয়ে ছোট চাচার ঘরে চলে গেলাম।
ছোট চাচা তখনও বসে বসে ফোন চালাচ্ছে। সে আমাকে দেখে ভীষণ বিরক্ত হলো। কর্কশ গলায় বলল, “এত রাতে তুই এখানে?”
“এই ছবিটা দেখাতে এলাম।”
ছোট চাচা ছবিটা হাতে নিলো। খানিকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর বলল, “তুই আসলে কী চাস?”
“আমি কী চাইব?”
“এই ছেলে তানহার বড় ভাই। কয়েক মাস আছে মা’রা গিয়েছে। তানহা নিজে আমাকে এই ছবি দেখিয়েছে।”
“এসব কী বলছেন?”
“আমি যা বলছি ঠিক বলছি। সত্যি করে বল, তুই আসলে কী চাস?”
“আমি! আমি মানে!”
আমাকে আমতা আমতা করতে দেখে ছোট চাচা ভীষণ রকমের ঝাড়ি দিলো। কড়া গলায় বলল, “তোর মায়ের গহনা নিয়েছি বলে আমার বিয়ে ভাঙতে চাইছিস? যদি এমন কিছু হয় তাহলে কান খুলে শুনে রাখ– তাহনাকে নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। ওর আগে পরে যে ছেলের সাথে যা কিছুই থাকুক না কেন, সে-সব নিয়েও আমার কোন সমস্যা নেই। শত চেষ্টা করলেও তুই বা তোর মা এই বিয়ে ভাঙতে পারবি না।”
“কথায় কথায় মাকে তোলেন কেন?”
“কারণ তোর মা তোকে শিক্ষা দিতে পারেনি।”
আমি তার কথার কোন জবাব দিতে পারলাম না। সত্যি বলতে নিজেই ভীষণ রকমের বিস্মিত হয়ে গিয়েছি। হাতে গোনা ক’দিন আগে নিজের চোখে এই ছেলেকে দেখলাম। আজ ছোট চাচ বলল– এই ছেলে মা’রা গেছে। চাচাকে তানহা নিজের মুখে সব বলেছে। ছবি দেখিয়েছে। তবে কী আমি ভুল দেখলাম? নাকি এখানে অন্য রহস্য আছে? জায়েদা আমার জন্য ডাইরি চু’রি করেছে নাকি কেউ ইচ্ছে করে ওর হাত দিয়ে এই ডাইরিটা আমার কাছে পাঠিয়েছে? আসলে এখানে চলছেটা কী? ভীষণ রকমের দ্বিধায় পড়ে গেছি। কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে এগারোটা বেজে গেল। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। ঘরে খাওয়ার মতো কিছু নেই। সকালের নাস্তায় পরোটার সাথে কষা মাংস হয়েছিল। সে-সবের কিছু নেই। মা আমার জন্য তুলে রাখতে ভুলে গিয়েছিল। সবাই সব খেয়ে ফেলেছে।
পরপর দুই গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। খিদে ম’র’ছে না৷ খানিকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে আরও এক গ্লাস পানি হাতে নিলাম। মা বলল, “খালি পেটে পানি খাস না।”
“তাহলে কী খাবো?”
মা আমার সামনে ভাতের থালা রাখল। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, চিংড়ি মাছ ভর্তা, ডিম ভাজি। মা বলল, “ভাত হয়ে গেছিল। ঝটপট এ দু’টো পদ বানিয়ে দিলাম। খেয়ে নে। বেশি দেরি করে খেলে পিত্তি পড়ে যাবে।”
মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। হঠাৎই চোখ জ্বালা করছে। চোখে পানি আসার আগে এমন করে চোখ জ্বালা করে। মা না থাকলে আমার কী হবে? যে বাড়ির লোকেরা আমার জন্য খাবার রাখতে ভুলে যায়, তারা আমার যত্নআত্তি করবে এই ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য না। দু-হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললাম। বিড়বিড় করে বললাম, “পৃথিবীর সব মায়ের হায়াত হাজার বছর হোক। আল্লাহ সবার মাকে সুস্থ রাখুক।”
খুব তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। হাত ধুয়ে প্লেট রাখতে যাব এমন সময় ফোন বেজে উঠল। বাদশার মামার কল। মামা বললেন, “বাড়িতে এসেছি। ইচ্ছে করলে এক বেলা কাজ করে যাও।”
“এখন আসব?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ চলে এসো। বারোটা বাজে। অর্ধেক দিন কাজ হয়ে যাবে। ধান বেশি পেকে গেছে। দুই একদিনের মধ্যে ঝরে যাবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
ভরপেট খাওয়ার পর ঘুম দিতে ইচ্ছে করছে। শরীরের ভেতরে মেজমেজ করছিল। নড়েচড়ে আড়মোড়া ভেঙে ফেললাম। অনেক কাজ বাকি। ধানের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে হবে। হাতে গোনা কয়েকদিন সময়। এর মধ্যে সবটা গুছিয়ে ফেলতে হবে।
প্রথম দিকে ধান কাটতে একটু আলস্য লাগছিল। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেল। বাদশার মামা বললেন, “একটু ভালো করে হাত চালাও। ধান কে’টে মাঠে ফেলে রাখা যাবে না। বাড়িতে নিয়ে রাখবে।”
আমি তার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলালাম। আসরের আজান দিয়ে দিয়েছে। গ্রামে ঘুরে ধানের খোঁজ নিতে হবে৷ সন্ধ্যায় হোসেন উদ্দীন সাহবের কাছে যাব।
প্রথমে বাদশার মামার কাছেই জিজ্ঞেস করলাম। মামা বললেন, “এখন আমন ধানের সিজন। লাল মোটা, সাদা মোটা এগুলোও আছে। গাঁয়ের লোকজন ধান মাড়াই করেই বেচে দেয়। নিতে চাইলে আজই খোঁজ খবর নাও। মাড়াই করা হয়ে গেলে আর পাবে না।”
আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। মামা বললেন, “আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে খেজুরের রসে ভেজানো চিতুই পিঠা দিয়ে দিয়েছে। দু’খানা খেয়ে যাও। এমন স্বাদ! মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়।”
পিঠা আমার খুব পছন্দের। না করতে ইচ্ছে করল না। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গাঁয়ের লোকজন বেশ ভালো। হেল্প ফুল যাকে বলে।
খোঁজ খবর করতে সন্ধ্যা নেমে গেল। চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে। ধান বাড়িতে নেওয়া হয়নি। মামাকে বলতেই তিনি বললেন, “পূর্নিমার রাত। একটু পরেই চাঁদ উঠবে। ফকফকা জোছনা। কষ্ট করে বাড়িতে নিয়ে রাখো। দরকার হলে আমি লাইট ধরছি। ধান মাঠে থাকলে ইঁদুরে নিয়ে যায়।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা দোলালাম। পকেট থেকে ফোন বের করে মা’কে কল দিয়ে বললাম, “মা, বাদশার মামার ধান বাড়ি নেবে। লাইট ধরতে হবে। কাটা ধান মাঠে রাখলে ইঁদুরে নিয়ে যায়। ফিরতে দেরি হবে৷ তুমি চিন্তা করো না। তেমন হলে রাতে না-ও ফিরতে পারি। বাদশার সাথে থেকে যাব।”
মা বলল, “ঠিক আছে। সোয়েটার গায়ে দিয়েছিস? গ্রামের দিকে ঠান্ডা বেশি। গলায় কিছু একটা পেঁচিয়ে নিস।”
“ঠিক আছে নেব।”
মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকার পরেও মামা এলেন না। বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগছে। বরফ শীতল বাতাস। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকলাম না। ছোট মতো একটা বোঝা মাথায় তুলে নিলাম। চাঁদ উঠে গেছে। চারদিক বেশ পরিষ্কার।
মাঠ থেকে মামার বাড়ির দূরত্ব কম না। মাঝামাঝি একটা শর্টকাট আছে। আগেরদিন দেখেছিলাম। বাগানের ভেতর দিয়ে খানিকটা গেলে মাঝারি ধরনের একটা খাল। খালের উপরে পুল দেওয়া। পুলের অবস্থা তেমন ভালো না। তবে যাওয়া আসা যায়। হেঁটে দেখেছি। সময় বাঁচাতে ওই রাস্তাই ধরলাম। প্রাইমারিতে থাকতে একটা গল্প পড়েছিলাম। নাম মনে নেই। মামা ভাগ্নে মিলে রাতে কোথাও যায়। মামা কলাপাতার উপরে চাঁদের আলো দেখে ভূত ভেবে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কথাটা ভাবতেই হেসে ফেললাম। শর্টকাট রাস্তা ভালো। সময় কম লাগছে। ধানের দুটো বোঝা রেখে এসেছি৷ মামার পেট কামড় দিচ্ছে। শ্বশুর বাড়ির ভালো মন্দ খাবার পেয়ে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছেন। এখন অবস্থা খারাপ৷ বাথরুম থেকে বের হতে পারছেন না। মামি বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছেন– “বারবার করে বললাম এত পিঠা খেও না। খেও না। তোমার পেটে সহ্য হবে না। কে শোনে কার কথা। এখন থাকো বসে। সারারাত বাথরুমে বসে ঠান্ডা লাগিয়ে সকালে খকখক কাশবে। আমার হয়েছে যত জ্বালা।”
মামির কথার ধরনে হাসি পেয়ে গেল। ধানের বোঝা রেখে মাঠে চলে এলাম। এইবার নিলে তিন বোঝা নেওয়া হবে। রাত বলে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। চাঁদের আলো ভালো। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হাঁটছি হঠাৎই পা সরে গেল। পুলের উপর থেকে সোজা খালে ভেতরে পড়ে গেলাম। ঝপ্পাত করে শব্দ হলো। ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে কিছুই বুঝতে পারলাম না। খালের ভেতরে কি ছিল জানি না তবে ডান পাশে কিছু একটা ফুটেছে। ভীষণ ব্যাথা করছে। পা নড়াতে পারছি না। ধানের বোঝাও পানিতে পড়ে গিয়েছে।
এতক্ষণ চাঁদের আলো স্পষ্ট মনে হচ্ছিল। হঠাৎই সব অন্ধকার গেছে। আমি কিছু দেখতে পারছি না। হাতের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। শক্ত একটা লাঠি পায়ের ভেতরে ঢুকে গেছে। র’ক্ত বের হচ্ছে কি-না বুঝতে পারছি না। লাঠিটা টেনে বের করার চেষ্টা করতে শুরু করলাম। তবে তাতে খুব একটা লাভ হলো না। লাঠি বের করতে পারলাম না। পা নড়াতে পারছি না। অবশ হয়ে যাচ্ছে। শরীরের ভেতরেও কেমন লাগছে। দুইবার মামা মামা বলে ডাকলাম। কারোর কোন সাড়াশব্দ নেই। জায়গাটা শুনশান। তেমন কেউ এদিকে আসে না। প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে খালের সব পানি খেয়ে ফেলি। খালের পানি ভালো না। মুখে তোলার রুচি হচ্ছে না।
চোখ বন্ধ করে ঘনঘন লম্বা শ্বাস নিলাম। শান্ত থাকার চেষ্টা করছি। যথাসম্ভব চেষ্টা করছি। পারছি না। দুই হাত দিয়ে ডান পা চেপে ধরলাম। এখান থেকে একা একা উঠে যাওয়ার শক্তি আমার নেই। মোবাইলও পানিতে পড়ে গেছে। এতক্ষণে হয়তো পানি ঢুকে তার হাল বেহাল। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া এখন আর কোন আশা নেই। তিনিই একমাত্র আমাকে সাহায্য করতে পারেন। চোখ বন্ধ করে দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করলাম। ঠিকঠাক পড়ছি কি-না বুঝতে পারছি না। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। শেষ মুহুর্তে মনে হলো আমি আয়াতুল কুরসি পড়ছি।
রাত বাড়ছে। কনকনে ঠান্ডা পানি। হিমশীতল বাতাস বইছে। ঠকঠক করে কাঁপছি। চোখের সামনে সব অন্ধকার। পূর্নিমার উজ্জ্বল রাত অমাবস্যার মত কুৎসিত এবং কালো। ভীষণ রকমের কুৎসিত! চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
চলবে
Share On:
TAGS: তোমার হাসিতে, ফারহানা কবীর মানাল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
তোমার হাসিতে গল্পের লিংক
-
তোমার হাসিতে পর্ব ৫
-
তোমার হাসিতে সূচনা পর্ব
-
তোমার হাসিতে পর্ব ১১
-
তোমার হাসিতে পর্ব ৬
-
তোমার হাসিতে পর্ব ৩
-
তোমার হাসিতে পর্ব ২
-
তোমার হাসিতে পর্ব ৯
-
তখনও সন্ধ্যা নামেনি পর্ব ২
-
তোমার হাসিতে পর্ব ৭