নিষিদ্ধ_রংমহল 🥀
পর্ব_৬
আকাশে তখন ছেয়ে আছে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। অর্ধচন্দ্রের জ্যোস্না মর্তের অস্পষ্টতা ঘোচাতে অসক্ষম। তারাগুলো যেন নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে মেঘের বিপরীতে। শুধুমাত্র চতুর্দিক থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক।বারান্দার থামের গায়ে লেপ্টে থাকা সতেজ জুঁইফুলের তীব্র সুবাস ছড়িয়ে পড়ছিল গজনবী মহলে।
জমিদার সিকান্দার গজনবীর শয়নকক্ষটি গজনবী মহলের সবচেয়ে সুরক্ষিত কক্ষ এবং ঐশ্বর্যমণ্ডিত অংশও বটে। খিলানওয়ালা বিশাল ঘরটির মেঝে ছিল ভেনিস থেকে আনা মার্বেল পাথরে মোড়া। সর্বদা আলোর প্রতিফলিত খেলা করে মেঝেতে। কক্ষের ঠিক মাঝখানে পেল্লাই রূপার পালঙ্ক। তাতে পুরু মখমলের চাঁদোয়া ঝোলানো। পালঙ্কের চারটি কোণে লেগে আছে সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত হাতির দাঁতের কাজ।
কক্ষের ডানপাশে অবস্থান করছে একটি বিশাল চন্দন কাঠের আলমারি। তাতে জমিদারের পূর্বপুরুষদের বহু মূল্যবান সামগ্রী রাখা আছে। তরবারি, বন্দুক আর শিকারের সামগ্রীগুলিও সেখানে সুসজ্জিত।
দেয়ালে ঝুলছে ব্রোঞ্জের বিশাল দীপাধার। মশালে জ্বলছে মৃদু আগুন। সেই মশালের লালচে কম্পমান আলোয় দেয়ালে তৈরি হচ্ছে রহস্যময় ছায়াশিল্প। তবুও কক্ষের পরিবেশ কিছুটা ভারী এবং থমথমে। গল্পটি সবার আগে লেখিকা ‘Atia Adiba – আতিয়া আদিবা’ র পেইজে বিকাল ৫ টায় পোস্ট করা হয়। গল্প লেখিকার পেইজে খুঁজবেন।
নবাব সিকান্দার গজনবী তখন পালঙ্কে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। তার প্রশস্ত কপালজুড়ে অসংখ্য চিন্তার ভাজ। তিনি আজ গভীর চিন্তায় মগ্ন। তার চিন্তার বিষয়বস্তু ‘বংশের মর্যাদা’।
নবাব সিকান্দার তার জীবনে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন বংশের মর্যাদা। অথচ তার বড়পুত্র তাইমুর সেই মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছেন অন্যায়ভাবে!
সিকান্দারের আদেশে তার প্রধান খিদমতগার দাউদ নিঃশব্দে তাইমুর গজনবীকে ডেকে আনল। তাইমুর ভেতরে প্রবেশ করে দেখলেন। সিকান্দার একা বসে আছেন। গড়গড় করে হুক্কা টানছেন। তার মেজাজ দেখে তাইমুর ঘটনা কিছুটা আঁচ করতে পারলেন। আজ গজনবী বাড়িতে কোনো মাহফিলের আয়োজন হয় নি। এমন নিস্তব্ধ রাতে বাবার মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টি তাইমুরের টগবগে রক্তকেও শীতল করে দিচ্ছিল বারবার।
- আসো, তাইমুর। ভেতরে আসো।
জমিদার ভারী কণ্ঠে ডাকলেন পুত্রকে। তার স্বরে বিন্দুমাত্র আবেগ পরিলক্ষিত হল না।
তাইমুর নতজানু হয়ে বাবার পায়ের কাছে বসলেন। গায়ের রক্ত হীম হলেও তার চোখে এখনো বিচরণ করছে বাঈজী হেমাঙ্গিনীর জন্য লড়ে যাওয়ার উদ্ধত সাহস। যদিও পিতার ভারী কণ্ঠস্বর সেই সাহসকে ভঙ্গুর করে তুলছিল।
সিকান্দার সরাসরি তাইমুরের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেন,
- আজ রাতে কেন কোনো মাহফিল বসেনি তা তুমি জানো?
তাইমুর আগ্রহ না দেখিয়ে উত্তর দিল,
- অবশ্যই আপনার হুকুম হয়েছে, পিতা। তাই আমি কারণ জিজ্ঞেস করার ধৃষ্টতা দেখাইনি।
সিকান্দার চোখমুখ শক্ত করে বললেন,
- কারণ জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই, তাইমুর।পুরো জমিদারবাড়ির গুমোট হাওয়ায় ভাসছে আজ মাহফিল না বসার কারণ।
তাইমুর মাথা আরোও নিচু করে নিমজ্জিত স্বরে বললেন,
- মাফ করবেন পিতা কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই।
সিকান্দার তার পালঙ্ক ছেড়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন। তার বজ্রকণ্ঠে কেঁপে উঠল গোটা মহল।
- আজ মাহফিল বসেনি, কারণ আমার জমিদারির ইতিহাসে তুমি একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের রচনা করেছো।
তাইমুর না জানার ভান বহাল রাখলেন। বিস্ফোরিত চোখে অটুট থেকে শুধালেন,
- আমার জন্য! আমি কি করেছি পিতা?
জমিদার সিকান্দার টেবিল থেকে একটি চিঠি তুলে নিলেন। এরপর সেটি ছুঁড়ে দিলেন পুত্রর পানে।
- এটা কী, পড়ে দেখো।
চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন তাইমুর। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। কুলুপ এঁটে রইলেন। তার দৃষ্টি মার্বেলের মেঝের দিকে স্থির।
পুত্রের এমন নীরবতা মেনে নিতে পারলেন না নবাব সিকান্দার। তিনি হুংকার দিয়ে বললেন,
- তাইমুর! আমার মুখের দিকে তাকাও। তোমার কি একবারও মনে হচ্ছে না তুমি গর্হিত অন্যায় করেছো? তুমি শুধু আমাদের অতিথির হাত কাটোনি, তুমি আমার আভিজাত্যের গায়ে কালি লেপে দিয়েছ! পার্শ্ববর্তী স্টেটের মশহুর জমিদার ঈশা খাঁ – এর ক্ষমতার শেকড় অনেক দূর বিস্তৃত। তিনি তাঁর প্রধান খিদমতগারকে দিয়ে আমার নিকট এই বার্তা প্রেরণ করেছেন। উক্ত ঘটনার কারণ জানতে চেয়েছেন। অতিথি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার ওপর তলোয়ার চালিয়ে তুমি শুধুমাত্র সেই অতিথিকে অপমান করো নি, জমিদার ঈশা খাঁ এর আত্মমর্যাদার ওপর আঘাত হেনেছো। একজন সামান্য বাঈজী, যার কিনা সদ্য অভিষেক ঘটেছে, যার কদর ওই মাহফিলের বাইরে আর কোথাও নেই – তার জন্য তুমি এত বড় ঘটনা কিভাবে ঘটালে, তাইমুর? জবাব দাও!
তাইমুর ধীরে ধীরে মাথা তুললেন। বললেন,
- পিতা, তিনি বাঈজী হেমাঙ্গিনীর দিকে কুদৃষ্টি দিয়েছেন। তার সাথে অসভ্যতা…
সিকান্দার তাইমুরের কথা শেষ হতে দিলেন না। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
- আমি জানি মাহফিল শেষে কী হয়েছিল। কিন্তু এমন পরিস্থিতি তুমি কিভাবে সামলাবে তার যৎসামান্য জ্ঞান থাকবে না? তুমি এই অঞ্চলের ভাবি জমিদার। তোমার হাতে আমি অতি শীঘ্রই এই অঞ্চলের শান্তি ও সম্মান তুলে দিতে চেয়েছি। আর তুমি কিনা তলোয়ার ধরছো? সামান্যতম উত্তেজনা সামলাতে পারো না? তুমি জানো? এ জাতীয় ব্যক্তিগত ঘটনার রেশ ধরে দুটি প্রতাপশালী জমিদারির মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে?
তাইমুরের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন,
- আমি ভীরু নই, পিতা। যদি জমিদার ঈশা খাঁ, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর হয়ে প্রতিশোধ নিতে চান, যুদ্ধের ঘোষণা করেন, তবে আমি তার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু নারীর সম্মান বিকিয়ে দিতে প্রস্তুত নই। এ নিয়ে আমি কোনো আপস করতে পারব না।
জমিদার সিকান্দার গজনবী চোখ বন্ধ করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন পুত্রের মনের অবস্থা। তাইমুরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় এখন বাঈজী হেমাঙ্গিনীর মুগ্ধতা বহমান। সে এখন হেমাঙ্গিনীর মায়াজালে পরিপূর্ণভাবে আবদ্ধ। সিকান্দার বিস্মিত স্বরে শুধালেন,
- সামান্য একজন বাঈজীর জন্য তুমি যুদ্ধ চাও, তাইমুর? তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?
তাইমুর কঠিন গলায় উত্তর দিলেন,
- মাফ করবেন, পিতা। আমার নিকট তারা সামান্য নয়।
- তারা নাকি শুধুমাত্র হেমাঙ্গিনী?
সিকান্দারের প্রশ্নটি তীরের মত আঘাত হানল তাইমুরের হৃদয়ে। তিনি সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নীরব রইলেন।
সিকান্দারের দুই অক্ষিকোটর হতে তখনও শীতল ক্রোধ ঝরে পড়ছিল। তিনি থমথমে গলায় বললেন,
- তুমি যাও। তোমার কক্ষে ফিরে যাও। কাল ভোরে আমরা ঈশা খাঁ-এর কাছে একজন দূত পাঠাবো। বৈঠকে বসব। এই অঞ্চলের দায়িত্ব পাওয়ার আগে এরকম গুরুতর ভুল আর করবে না, তাইমুর।
তাইমুর মাথা নত করে কক্ষ ত্যাগ করলেন।সিকান্দার গজনবীর মনে তখন আসন্ন বিপদের অশনিসংকেত। তিনি জানেন ঈশা খাঁ ছেড়ে দেবার মানুষ নয়। উক্ত ঘটনার প্রতিশোধ তিনি নিবেন। অবশ্যই নিবেন।
এছাড়াও তাইমুরের চঞ্চল মন হতে হেমাঙ্গিনীর প্রমত্ততা দূর করা প্রয়োজন। রাতের বিনোদনের জন্য বাঈজী হেমাঙ্গিনীর মোহে মত্ত হলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু তাইমুরের চোখে হেমাঙ্গিনীর প্রতি অনুরাগের তপ্ততা দেখেছেন, সিকান্দার। এ হতে দেওয়া যাবে না।
তিনি দীর্ঘ এক শ্বাস নিলেন। এরপর দাউদকে ডাকলেন। দাউদ নীরবে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
- দাউদ!
সিকান্দার কণ্ঠে গভীর চিন্তার ছাপ রেখে বললেন,
- আমাদের মাহফিলে কিছু পরিবর্তন আনা বিশেষ প্রয়োজন। আমাদের জমিদার বাড়ির বাঈজীরা অর্থাৎ বিলকিস সাহেবার দলটি অত্যন্ত দক্ষ। তবে মাহফিলে নতুন মুখের প্রয়োজন।
জমিদার পালঙ্কের তক্তপোশে হাত রেখে বললেন,
- তুমি এক কাজ করো। বাংলা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সকল নতুন এবং নামকরা বাঈজীদের আমন্ত্রণ পাঠাও। তাদের নাচের ভঙ্গিমা এবং গানের সুর ও রূপে যেন মাহফিলে ভিন্নতা দৃষ্টিগোচর হয়। এমন আয়োজন করো, যাতে মাহফিলের আকর্ষণ কয়েক’শ গুণ বাড়ে।
দাউদ বিনীতভাবে উত্তর দিল,
- হুজুরের আদেশ শিরোধার্য।
- ঠিক আছে তুমি এখন যাও। উক্ত বিষয়টির প্রতিফলন যেন আমি আগামীকাল থেকেই মাহফিলে দেখতে পাই।
দাউদ কুর্নিশ করে কক্ষ হতে বেরিয়ে গেল।
জমিদার সিকান্দার স্থির দৃষ্টিতে মশালের শিখার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মনে এক অজানা শঙ্কা। পুত্রের মন ঘোরাতে না পারলে ঈশা খাঁ – এর সাথে আসন্ন সংঘাতের চেয়েও বড় বিপদ মহলের দরজায় কড়া নাড়বে। গল্পটি সবার আগে লেখিকা ‘Atia Adiba – আতিয়া আদিবা’ র পেইজে বিকাল ৫ টায় পোস্ট করা হয়। গল্প লেখিকার পেইজে খুঁজবেন।
★★★★★★★★★★
বাঈজী মহলে তখন মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা জেঁকে বসেছে। মাহফিল নেই বলে বাঈজীরাও আজ বেশ আয়েশে মত্ত। মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে তাদের কক্ষ হতে।
হেমাঙ্গিনীর ঘরেও বিরাজ করছিল নীরবতা। সে এখনো একটি ঘোরের মাঝে রয়েছে। তাইমুরের মুখমণ্ডল, চাহনি, বাচনভঙ্গি সবকিছুর মোহে সে আজ আবৃত।
দরজায় মৃদু টোকা পড়তেই হেমাঙ্গিনী বুঝতে পারল বিলকিস বানু এসেছেন।
হেমাঙ্গিনী শোয়া থেকে উঠে বসল। বিলকিস ঘরে প্রবেশ করলেন। হেমাঙ্গিনীর পাশে এসে বসলেন।
বিলকিস বানু কৌতুক করে বললেন,
- কীরে, বেটি? ক্যায়া হুয়া? জমিদারপুত্র তাইমুর গজনবীর সাথে মধাহ্নভোজ সেড়ে এত উদাস হয়ে গেলি কেন? তার কথা মনে পড়ছে?
হেমাঙ্গিনীর ঠোঁটের কোণে লজ্জামিশ্রিত হাসির দেখা মিলল। নিচু স্বরে বলল,
- ধুর! কি যে বলো তুমি। তবে..
বিলকিস বানু আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলেন,
- তবে কী?
হেমাঙ্গিনী তার দেহ আলগোছে পালঙ্কে এলিয়ে দিয়ে সিলিং এর পানে তাকাল। মুচকি হেসে বলল,
- তিনি সারাক্ষণ কেবল আমার কথাই বলছিলেন। আমার রূপ, আমার নাচ, আমার গান – ভীষণ পছন্দ করেছেন। জানো খালা? মাহফিলের ওই ঘটনার জন্য তার মাঝে কোনো অনুশোচনা নেই! বরং তিনি এটিকে ‘সম্মান রক্ষার কাজ’ বলে মনে করছেন।
বিলকিস বানু খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,
- মাশা আল্লাহ! মাশা আল্লাহ! ক্যায়া বাত হে! রূপের জাদুতে প্রথমদিনই জমিদারপুত্রকে ঘায়েল করে ফেললি? আব হামারা ক্যায়া হোগা?
- মজা করা বাদ দাও তো। এত রাতে হঠাৎ এ কক্ষে এলে যে? কিছু হয়েছে?
বিলকিস বানু ছোট্ট করে শ্বাস নিলেন। বললেন,
- তোর সাথে জরুরি আলাপ আছে।
- বলে ফেলো।
বিলকিস বানু বলতে শুরু করলেন,
- তু তো জানিস তোর মা সরলতা ছিলেন এই অঞ্চলের সেরা বাঈজী। তাঁর রূপ ছিল পূর্ণিমার চাঁদের মত। আর তাঁর নৃত্য ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। বহুত মশুর জমিদার তাকে কিনে নিতে চেয়েছেন। কিন্তু নবাব সিকান্দার গজনবী – তাকে চোখের আড়াল করেন নি।
বিলকিস এবার উঠে দাঁড়ালেন। দেয়ালে ঝুলে থাকা লন্ঠনের দিকে এগিয়ে গেলেন মৃদুপায়ে। অগ্নিশিখার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললেন,
- সরলতার একটা গোপন ইচ্ছে ছিল। যাব তু আঠারো মেঁ কদম রাখেগি, তো ওহ তুঝে এক খাস নাচ শিখাবে। তোর মায়ের নিজের নৃত্যবিন্যাস।
হেমাঙ্গিনীর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উদ্দীপনায় শরীর কেঁপে উঠল তার। অস্ফুটে বলে উঠল,
- আমার মায়ের নিজের নৃত্যবিন্যাস!
বিলকিস বানু হেমাঙ্গিনীর দিকে ফিরে জবাব দিলেন,
- হা। কেবলমাত্র সরলতা নিজে সেই নাচ মঞ্চস্থ করতে পারত। অর কোই উসকি তরাহ নাঁচ নেহি সাকতা থা।
বিলকিস বানু এক মুহূর্তের জন্য থামলেন। চোখ বন্ধ করে পুরনো স্মৃতি হাতড়ালেন। এরপর বললেন,
- সরলতার কাছ থেকে ও নাচ আমি বহু কষ্টে শিখেছিলাম। মেইনে কসম খাইথি, অন্য কোনো বাঈজীকে ওই নাচ আমি শেখাব না। কারণ উত্তরাধিকার সূত্রে ওই নাচের মালিক শুধুমাত্র তুই। ইয়ে আমানত সিরফ তেরি লিয়ে থা।
হেমাঙ্গিনী জানতে চাইল,
- তাহলে তোমাকে কেন সেই নৃত্য শিখালো?
বিলকিস বানু মুখ ফিরিয়ে নিল। সামান্য ঢোক গিয়ে বলল,
- মুঝে নেহি পাতা। লেকিন আব ওয়াক্ত আ গায়া হে। তোর সেই নাচ শিখতে হবে।
- আমি শিখব, খালা! আমার মায়ের বিশেষ নৃত্য আমি অবশ্যই নিজের মাঝে ধারন করব।
বিলকিস বানু হাসিমুখে বললেন,
- বেটি, আজ রাতেই শেখাবো তোকে। আসমান মে আধি চাঁদ কি ঝালাক হে আজ!
তোর কামরার বারান্দায় যাব আমরা। কেবলমাত্র দুটি লণ্ঠন জ্বলবে। সেই লণ্ঠনের দপদপে আলো-ছায়ার খেলায় তুই তোর মায়ের বিশেষ নৃত্য শিখবি। ইয়ে নাঁচ তেরে ফান কি বুলন্দি কো অউর ভি বাড়হা দেগা, জো কিসি অউর বাঈজী মে নেহি হ্যায়। জলদি কর, বেটি! শুভ প্রহর শেষ হল বলে!
হেমাঙ্গিনী চোখ বন্ধ করল। অনুভব করল তার মায়ের আত্মা ছায়ারূপে প্রবেশ করছে তার অভ্যন্তরে। হেমাঙ্গিনীর কাছে এই নৃত্য কেবলমাত্র একটি শিল্প নয়। বরং নবাব তাইমুর গজনবীর মতো একজন প্রেমিকের আকর্ষণ ধরে রাখা এবং জমিদারবাড়ির সংঘাতপূর্ণ জীবনে টিকে থাকার অন্যতম অস্ত্র।
বিলকিস বানুর শরীরে যেন পুরোনো দিনের মাহফিলের জৌলুস ফিরে এলো। তিনি হেমাঙ্গিনীর মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তার চোখে মুখে কঠোর নির্দেশের আভাস। তবে কণ্ঠে ছিল মাতৃত্বের ছাপ এবং একজন প্রকৃত শিল্পীর আবেগ।
হেমাঙ্গিনীও ছিল সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।
বিলকিস বানু গম্ভীর গলায় বললেন,
- বেটি, এই নাচ শুধু শরীর দিয়ে নয়, রূহ দিয়ে নাচতে হয়। এর প্রথম ভঙ্গি হল তোর তাকাতের ভঙ্গি। ভুলনা মাত, তুই প্রথমদিনই নিজের রূপ দিয়ে, শিল্প দিয়ে জমিদারপুত্রের মন জয় করেছিস। তেরি আন্দার কই ভি কামজোরি নেহি হ্যায়। হাত ইয়েসি উঠা জ্যায়সে তুনে সারা দুনিয়া কো আপনি মুঠঠি মে লে লিয়া। উঠা হাত!
বিলকিস বানু নৃত্যের প্রথম প্রথম ভঙ্গিটি নিজে করে দেখালেন। লণ্ঠনের আলোয় তাঁর শরীর থেকে ছায়াগুলো লম্বাটে আকার ধারণ করল দেয়ালে। মনে হলো, বিলকিস বানুর ছায়াটি যেন হেমাঙ্গিনীর মা সরলতাকে মূর্ত করে তুলছেন।
হেমাঙ্গিনী মনোযোগ সহকারে প্রতিটি ভঙ্গি আত্মস্থ করছিল। প্রথম ভঙ্গিটির মাঝে ছিল এক ধরনের আহ্বান। যেখানে দুহাত কপালে তুলে সম্মান জানানো হয়। এরপর সেই হাতজোড়া প্রসারিত করে যেন পৃথিবীর সব সৌন্দর্যকে নিজের কাছে টেনে আনা হয়। হেমাঙ্গিনীর শরীর তখনও উত্তেজনায় কাঁপছে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে এক ধরনের অদম্য প্রত্যয়।
বিলকিস বানু এবার দ্বিতীয় ভঙ্গি দেখালেন। যার মানে প্রেম। তিনি বললেন,
- পা দুটোকে হালকা করে ফেল। যেন তুই বাতাসের উপর ভাসছিস। কামাড় কো ইয়েসি হিলা, জ্যায়সে তেরে জিস্ম কে হর আংঙ্গ মে মোহাব্বত অউর ইশক কা তেজ ধারা বাহ রাহা হে। এই সিরফ নৃত্যের ভঙ্গি না বেটি। পেয়ার কি পারছাঁই হে।
হেমাঙ্গিনী তার উস্তাদনীর নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিল। লণ্ঠনের দপদপে আলোয় তার ছায়া বারান্দার দেয়ালে এক জীবন্ত চিত্রকরের মতো ওঠানামা করছিল প্রতিনিয়ত। যখন সে ভালোবাসার ভঙ্গিটি আয়ত্ত করল, তখন তার শরীর নেমে এলো বিষাদ। এই নৃত্যের ভঙ্গিমায় যেন প্রকাশ পেল একজন প্রেমিকার অপ্রাপ্তি।
বিলকিস বানু এবার গলার স্বর আরোও গম্ভীর এবং কঠিন করে বললেন,
- আব আখেরি ভঙ্গি। ইয়ে ভঙ্গির মানে হল ঠুকরানা অউর বগাওয়াত। জিন্দেগী মে মহব্বত চিরস্থায়ী নারে, বেটি। কিন্তু বাঈজীর শিল্প হামেশা জিন্দা রহেতা হ্যায়। ইস লিয়ে, দোনো হাথ মাথার ওপর নে। এরপর বজ্র কি রফতার সে নীচে নিয়ে আয়। জিস্ম কো তেজ ঘুমা কার পেছনে চলে আয়। যেন তুই হমেশা নিজের অনুভূতিকে প্রত্যাখ্যান করতে প্রস্তুত। আপনে জাজবাত সে বগাওয়াত হি তুঝে আজাদি কা মজা দেগি, বেটি!
হেমাঙ্গিনী এই শেষ ভঙ্গিটি করার সময় তার চোখে এক গভীর দৃঢ়তার দেখা মিলল। দুটি লন্ঠনের টিমটিমে আলোয় তার নৃত্যরত ছায়াটি দেখে মনে হল সেই ছায়া তীব্র গতিতে ঘুরছে। শেষ পর্যায়ে সেটি রয়ে গেল একাকী কিন্তু স্থিত হল অত্যন্ত শক্তিশালী এক রূপে। হেমাঙ্গিনী যেন নাচের মাধ্যমে বুঝে গেল প্রত্যাখ্যান এবং বিদ্রোহের মাঝেই স্বাধীনতা লুকিয়ে আছে। গল্পটি সবার আগে লেখিকা ‘Atia Adiba – আতিয়া আদিবা’ র পেইজে বিকাল ৫ টায় পোস্ট করা হয়। গল্প লেখিকার পেইজে খুঁজবেন।
বিলকিস বানুর চোখ দুটি চকচক করে উঠল। তার মনে হতে লাগল সেই ছায়া যেন হেমাঙ্গিনীর নয়। তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সরলতার!
বিলকিস বানু তৃপ্তির হাসি হাসলেন। চোখে পানি নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন,
- সাব্বাস! সাব্বাস বেটি! বিলকুল সহি! এই নৃত্যকে তুই আজ জীবন দিলি।
সে রাতে গগণের অর্ধচন্দ্র যেন সাক্ষী হয়ে রইল একজন বাঈজীর হৃদয়ের গভীরতম আকাঙ্ক্ষা, তার শিল্প এবং জন্মগত অধিকারের গল্পের।
( ৪০০ কমেন্টস এবং ২৪০০ লাইক হলে আগামীকাল বিকাল ৫ টায় ৭ম পর্ব আসবে। লাইক, কমেন্ট করুন)
উপন্যাসঃ #নিষিদ্ধ_রংমহল
লেখনীতে, Atia Adiba – আতিয়া আদিবা
Share On:
TAGS: আতিয়া আদিবা, নিষিদ্ধ রংমহল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১০
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৭
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১১
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৭
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৫
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৩
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৪
-
নিষিদ্ধ রংমহল গল্পের লিংক
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৮