Golpo romantic golpo নিষিদ্ধ রংমহল

নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৩


৩.
গজনবী জমিদারের মাহফিল দীর্ঘায়িত হল প্রায় ভোর পর্যন্ত। হেমাঙ্গিনীর পর বিলকিস বানুর অন্যান্য শিষ্যরা পর্যায়ক্রমে গীত গাইলেন। নৃত্য প্রদর্শন করলেন। কিন্তু তারা জমিদার কিংবা অতিথিদের মনোরঞ্জনের খোরাক হতে পারলেন না। সকলের কানে এখনো বাজছে হেমাঙ্গিনীর কোমল কণ্ঠস্বর। চোখের সামনে ভাসছে তার সুগঠিত নবোদ্ভিন্ন দেহের আলোড়ন। মেয়েটির নৃত্য দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে নিরূদ্যম। কি সুন্দর তার হাতের কারুকাজ! ধবধবে ফর্সা শরীর আভিজাত্যের সাথে দুলিয়ে নিচ্ছিল প্রতিটি ছন্দে। সে এক অপূর্ব সম্পাদন!

চোখের ঘুম লুকিয়ে রেখে দাউদ জমিদারের অনুমতি সাপেক্ষে অনুষ্ঠানের ইতি টানল।

“হুকুম হইয়াছে! নবাব সিকান্দার গজনবী হুজুরের আদেশ অনুযায়ী আজকের মত মাহফিলের সমাপ্তি ঘোষণা করা হল।”

সিকান্দার এরপর দাউদকে বললেন,

  • পাইকদের বলে দাও অতিথিদের তাদের ঘর দেখিয়ে দিতে। তারা যেন প্রাতরাশ সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরে। দেখবে, উনাদের যত্নের কোনো ত্রুটি যেন না হয়। গজনবী জমিদার বাড়ির অতিথিসেবা গোটা এস্টেটে প্রসিদ্ধ। কোনো ভুল করা চলবে না। ভুল হলে এর ফলাফল কি হবে তা অবশ্যই তুমি জানো, দাউদ।

দাউদ মাথা নত করে বলল,

  • হুজুর, আমি কথা দিচ্ছি। অতিথিদের যত্নে কোনো ত্রুটি হবে না। আমি নজর রাখব।

সিকান্দার এবার তাইমুরের দিকে তাকালেন। বড় পুত্রের পিঠ চাপড়ে বললেন,

  • চলো তাহলে অন্দরমহলে যাওয়া যাক?

তাইমুর আজ অতিরিক্ত বিলেতি মদ পান করে ফেলেছেন। তবে তার আচরণে তেমন কোনো অসংলগ্নতা নেই। যদিও তাকে দেখতে বেশ তন্দ্রাচ্ছন্ন লাগছে। তিনি মৃদুস্বরে উত্তর দিলেন,

  • চলুন, পিতা।

মাহফিল শেষে জলসাঘর যেন ভিন্ন রূপে মেতে উঠেছে। পাইকরা অতিথিদের সেবায় নিযুক্ত। অনেকে অসংলগ্ন কথা বলছে, আচরণ করছে। অনেকে মেতে উঠেছে অহেতুক হৈ হুল্লোড়ে।

বিলকিস বানু তখন হেমাঙ্গিনী আর বাকি বাঈজীদের নিয়ে নিজেদের মহলে ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। হেমাঙ্গিনীর দুচোখ ভর্তি ঘুম। ক্লান্তিরা ভীষণ জাগ্রত। হাতে আলগোছে ধরে আছে রূপার পাত্র। সেই রূপার পাত্র ভর্তি টাকা পয়সাসহ নানান মূল্যবান সামগ্রী।

হেমাঙ্গিনীর সম্পাদনে মুগ্ধ হয়ে এসব ছুঁড়ে মেরেছে উপস্থিত অতিথিবৃন্দ। ভাবি জমিদার তাইমুরও নিজের গলায় পরে থাকা মূল্যবান সোনার চেন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন হেমাঙ্গিনীর পানে।

আলোকমাখা মাহফিলের ভেতরকার গুঞ্জন ধীরে ধীরে মিইয়ে আসছিল। হেমাঙ্গিনী প্রায় বাকি বাঈজীদের সাথে হলঘরের মূল ফটকের সামনে চলে এসেছে।

সহসা, এক মাতাল অতিথি উঠে দাঁড়াল তার আসন থেকে। হোচট খেতে খেতে এগোতে থাকল হেমাঙ্গিনীর দিকে। অতিথির অক্ষিজোড়ায় বিলেতি নেশার ঘোর। মুখে বিশ্রি বক্র হাসি।

আচমকা সে হেমাঙ্গিনীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে ব/ক্ষ/যুগলের মৃদু ভাজ। সেই বুকের ভাঁজে হাত বাড়িয়ে দিল অসভ্য ভঙ্গিতে।

হেমাঙ্গিনী মুহূর্তেই পিছু হটে গেল। তার দুচোখে জেঁকে বসল আতঙ্ক। সে প্রতিবাদী সুরে চিৎকার করে উঠল,

  • জনাব, এ কি করছেন আপনি?

অতিথির বক্র হাসি আরোও প্রশস্ত হল। তার হাত এবার জানোয়ারের মত খামচে ধরল হেমাঙ্গিনীর ব্লাউজ। জলসাঘরে উপস্থিত সকলের মাঝে নেমে এলো স্তব্ধতা। সকলে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে।

ঘটনার আকস্মিকতায় বিলকিস বানু এবং বাকি বাঈজীরা ঘাবড়ে গেল। তবে বিলকিস বানু চুপ করে থাকার মানুষ নয়। শিষ্যর অপমান এবং লাঞ্চনা তিনি নিজের অঙ্গে মেখে নিলেন। প্রতিবাদ করতে যাবেন ঠিক এমন সময় নব বজ্রকণ্ঠে গোটা হলঘর কেঁপে উঠল।

  • ছাড়ুন! ছাড়ুন বলছি!

মাতাল অতিথি ভ্রুঁ কুঁচকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। দেখল নবাব তাইমুর গজনবী এগিয়ে আসছেন ঝড়ের গতিতে। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন পাইকের কাছ থেকে এক ঝটকায় তলোয়ার ছিনিয়ে নেন তাইমুর। গোটা মাহফিলের বিস্মিত চোখগুলো তার ওপর তখন নিবদ্ধ।

মাতাল অতিথি তখনও হেমাঙ্গিনীর ব্লাউজ ধরে আছে। তাইমুর অগ্নিদৃষ্টির সহিত সেদিকে একবার দেখলেন। এরপর হুংকার দিয়ে অতিথির নোংরা হাতের ওপর তলোয়ার চালিয়ে দিলেন। নিমিষেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল অতিথির হাত থেকে। রক্তাক্ত হয়ে গেল জলসাঘরের দামী মোজাইকের মেঝে।

অতিথি ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠল। চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তাইমুর তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। রাগে কাঁপছেন থরথর করে। সে আগুনের মতো তপ্ত চোখে অতিথির দিকে তাকিয়ে বললেন,

  • এই মাহফিলের প্রতিটি বাঈজী সাহেবার সম্মান রক্ষার্থে আমি তৎপর। ভবিষ্যতে তাদের প্রতি কোনো অসভ্য আচরণ করার আগে যেন এই পরিণতির কথা সকলের মনে থাকে।

তাইমুর ধীর গতিতে তলোয়ারটা পাইকের হাতে ফিরিয়ে দিলেন। এরপর স্নিগ্ধ চোখে তাকালেন হেমাঙ্গিনীর দিকে।

হেমাঙ্গিনী তখনও ভয়ে কাঁপছে। রক্তের ছিটেফোঁটা তার উন্মুক্ত বুকে এবং মুখে এসে লেগেছে। সেদিকে তার হুশ নেই। হেমাঙ্গিনী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে দেখছে তাইমুরকে।

ক্ষণিককাল আগেও নবাব তাইমুর গজনবী’কে দেখে মনে হয় নি তার মাঝে লুকিয়ে আছে হিংস্রতা। সে যেন এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। প্রয়োজনে জাগ্রত হয়ে ওঠেন। অপ্রয়োজনে থাকেন নিমজ্জিত।

হেমাঙ্গিনী কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে ফেলল তাইমুরের সামনে। তাইমুর বিলকিস বানুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

  • অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত এবং লজ্জিত। হেমাঙ্গিনীকে নিয়ে উনার কক্ষে যান। উক্ত ঘটনা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই।

বিলকিস বানু নিচু স্বরে বললেন,

  • শুকরিয়া, হুজুর। এই হেমাঙ্গিনী। চল চল। ঘরে চল।

হেমাঙ্গিনী আর এক মুহুর্ত দেরি করল না। বিলকিস বানুর সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তাদের অনুসরণ করল বাকি বাঈজীরাও।

হলঘরে আর কেউ কথা বলার সাহস পেল না। শুধুমাত্র হাত বিহীন অতিথির চিৎকার শ্রবণগোচর হতে লাগল। অপ্রত্যাশিত শঙ্কা ছড়িয়ে গেল সবার মনে।


হেমাঙ্গিনী নিজের কক্ষে প্রবেশ করল। বিলকিস বানু বাকি বাঈজীদের নিজেদের ঘরে চলে যেতে বললেন। এরপর হেমাঙ্গিনীর পিছু তার কক্ষে ঢুকলেন।

হেমাঙ্গিনী শরীর থেকে ভারী পোশাক, অলংকার অসতর্কতার সাথে খুলে ফেলতে চাইল। বিলকিস বানু এগিয়ে এলেন। হেমাঙ্গিনী কে পোশাক খুলতে সাহায্য করলেন। খানিকটা ব্যস্ত হয়ে বললেন,

  • আরে বেটি, কি করছিস? এত দামী পোশাক! অলংকার! এইসে খোলতাহে কই?

হেমাঙ্গিনী গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বিছানায় ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিল। নিজের শরীরে পাগলের মত হাত বুলিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। বিলকিস বুঝলেন হেমাঙ্গিনীর মনের অবস্থা। তিনি পঞ্চাদশী কণ্যার পাশে গিয়ে বসলেন। মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন,

  • মন খারাপ করিস না, হেমা। এইসা হোতা হে। মাহফিলে নাচ গান করতে গেলে এমন অসভ্যতামি সহ্য করতে হয়। কিছু করার নেই, বেটি।

হেমাঙ্গিনী কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন করল,

  • আমি কেন বাঈজীর ঘরে জন্ম নিলাম বলতে পারো? এই জীবন তো আমি চাই নি!

বিলকিস হেমাঙ্গিনীকে আশ্বস্ত করে বললেন,

  • অনেক ভালো আছিস, হেমা। প্রজাদের দেখেছিস? সারাদিন গাধার মত খাটলে তবেই পেটে দুবেলা অন্ন জোটে। খাজনা সময় মত না দিলে বা কম দিলে জমিদার জানে মেরে ফেলে। ও ক্যায়া কই জিন্দেগী হে? ইয়াহা তুঝে সাব কুচ মিলছে। আচ্ছা খানা, পোশাক, গয়না – হে না বেটি?

হেমাঙ্গিনী চোখ মুছে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

  • আর এসবের পরিবর্তে নিজের যৌবন তাদের বিলিয়ে দিতে হবে। আজ তো জমিদার শয়নকক্ষে ডাকলেন না। আগামীকাল নিশ্চয়ই ডাকবে?

বিলকিস দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,

  • মুঝে নেহি পাতা। আচ্ছা শোন, পরিষ্কার হয়ে নে। চোখের কাজল, ঠোঁটের লিপস্টিক এসব মুছে একটু স্নান সেরে নে। আরাম লাগবে। তেরি মুমে ভি রক্ত লেগে আছে।

হেমাঙ্গিনী ভাঙ্গা গলায় অনুরোধের স্বরে বলল,

  • একটু গরম জলের ব্যবস্থা করে দিতে বলবে?
  • বলছি।

বিলকিস প্রধান পরিচারিকার খোঁজ করতে হেমাঙ্গিনীর কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।

হেমাঙ্গিনী বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। তার মুখে লেগে থাকা রক্তের ওপর আলগোছে হাত বুলিয়ে নিল। তাইমুরের সেই হিংস্র চেহারা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। কানে ঝনঝনিয়ে উঠল সেই কথাগুলো _

“এই মাহফিলের প্রতিটি বাঈজী সাহেবার সম্মান রক্ষার্থে আমি তৎপর। ভবিষ্যতে তাদের প্রতি কোনো অসভ্য আচরণ করার আগে যেন এই পরিণতির কথা সকলের মনে থাকে। “

হেমাঙ্গিনী নিজেই নিজেকে অবুঝের মত প্রশ্ন করল।

  • আমার স্থানে যদি অন্য কোনো বাঈজী থাকত, তাহলে কি জমিদার পুত্র একই প্রতিক্রিয়া দেখাতেন?

বিলকিস বানু ফিরে এলেন ক্ষণিককাল পর। বললেন,

  • স্নানঘরে গরম পানি রাখা আছে, হেমা। চল তোকে গোসল করিয়ে দেই। বহত দের হ গ্যায়া।

সাধারণত বাঈজীদের গোসল করার সময় সাহায্য করে পরিচারিকা রেশমা কিংবা শেফালী। জিনিসপত্র এগিয়ে দেয়। স্নান করিয়ে দেয়।
গায়ে তেল মালিশ করে দেয়। সারারাত নাচ-গান পরিদর্শনের পর বাঈজীদের শরীরে বেদনা ছড়িয়ে পড়ে। মৃদু অঙ্গসংবাহন শান্তি বয়ে আনে দেহের প্রতিটি মাংসপিণ্ডে। সে কাজও তারা সম্পন্ন করে নিষ্ঠার সাথে।

হেমাঙ্গিনী বিস্মিত স্বরে শুধালো,

  • তুমি কেন? রেশমা বা শেফালীকে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়।

বিলকিস কিছুটা ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দিলেন,

  • কিউ? আমাকে তোর পছন্দ হচ্ছে না?

হেমাঙ্গিনী মৃদু হাসল। বলল,

  • এমন কিছু না। তুমিও তো ক্লান্ত। একটু জিরিয়ে নিতে। সেই তো ঘন্টাখানেক পর উঠে নাচ- গান শেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
  • আমি আর কই এমন ক্লান্ত। এখন তো আর আগের মত নাচা গানা করতে পারি না। কাবিল নেহি হে হাম।

কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিলকিস বানু।
হেমাঙ্গিনী তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

  • এই যে এতগুলো বাঈজীদের নাচ – গান শেখাও। এও বা কম কিসে?
  • হা হা! সামাঝ মে আয়া মুঝে। এখন চল। স্নান করবি চল।

হেমাঙ্গিনী হেসে উত্তর দিল,

  • ঠিকাছে। চলো।

হেমাঙ্গিনী যখন স্নানঘরে প্রবেশ করল তখন ভোরের আলো ধরনী স্পর্শ করেছে। চারিদিকে মৃদু ঠান্ডা বাতাস। স্নানঘরের দেয়ালের একদম উপরের দিকে বড় জানালা। ধবধবে সাদা পর্দা পতপত ধ্বনিতে উড়ছে বাতাসের তোড়ে। লন্ঠনগুলোর ভেতর মোমবাতির নিভু নিভু হাল।

বড় পাথরের চৌবাচ্চায় কুসুম গরম জল ভরা। সেখানে গোলাপের পাপড়ি ভাসছে। গোটা স্নানঘর জুড়ে সুগন্ধি তেলের সুবাস। হেমাঙ্গিনী ধীরে ধীরে চৌবাচ্চায় নিজের দেহ ডুবিয়ে দিল। বিলকিস তার নিকট এগিয়ে দিল উপটানের বাটি।

মুখে উপটান মেখে জলে গা ভাসাতেই সারারাতের ক্লান্তি যেন মোমের মত গলতে শুরু করল। হেমাঙ্গিনী চোখ বন্ধ করল। চরণ জপল ভোরের প্রথম প্রহরের রাগ ভৈরবের।

যদিও এই মুহূর্তে তার গলার কোমল সুর অন্য কেউ শুনবে না বিলকিস ছাড়া। তবুও হেমাঙ্গিনী তার একান্ত সময় এভাবে কাটাতে পছন্দ করে।

দীর্ঘ স্নানের পর বিলকিস হেমাঙ্গিনীর কোমল দেহ আলতোভাবে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিলেন। পরিয়ে দিলেন আরামদায়ক পোশাক। চুলে দিয়ে দিলেন হালকা সুগন্ধি তেল।

হেমাঙ্গিনী কক্ষে ফিরে দেখল পরিচারিকা নানাবিধ নাস্তা সাজিয়ে রেখে গেছে। হালকা নাশতা সেরে নিল সে। এরপর জানালার পাশে রাখা পালঙ্কে পিঠ হেলিয়ে ঘুম ঘুম চোখে বাইরে তাকাল।
সব পর্ব পাবেন Atia Adiba – আতিয়া আদিবা পেইজে।

ভোরের পাখিরা জেগেছে আরোও ঘন্টাখানেক আগে। জনজীবনের কোলাহল এখনো শুরু হয় নি। সবার যখন একটি সুন্দর দিনের সূচনা হয়, তখন হেমাঙ্গিনীর মস্তিষ্ক ইতি টানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

একটু ঘুমিয়ে উঠেই পরবর্তী মহড়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। হেমাঙ্গিনীর চোখ ধীরে ধীরে ভারী হয়ে এলো। সে নিমজ্জিত স্বরে বলল,

  • খালা দরজাটা ভিড়িয়ে যাও। আমার সামান্য ঘুম প্রয়োজন।

বিলকিস হেমাঙ্গিনীর মাথায় চুমু এঁকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।


নবাব তাইমুর গজনবী তার ব্যক্তিগত শয়নকক্ষের সোনার কারূকাজ খচিত পালঙ্কে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তার মনে তখনও তোলপাড় করে চলেছে হেমাঙ্গিনীর ঠুমরি নাচের রেশ। হেমাঙ্গিনীর আবেদনময়ী লাজুক চাহনি যতবার মনে পড়ছে ঠিক ততবার হৃদপিণ্ডের ধকধকানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তার।

​তাইমুরের প্রধান খিদমতগার শোবহান মির্জা পালঙ্কের পাশে উপস্থিত ছিল। সে সর্বদা তাইমুরের সেবায় নিয়োজিত। বর্তমানে আলগোছে বাতাস করছিল পাখা দিয়ে।

তাইমুরের চোখে অস্থিরতা দেখে শোবহান কিছুটা আঁচ করতে পারল। আজ হয়ত নবাবের খাস দাসী নূর তার মনোরঞ্জনের জন্য উপযুক্ত নয়। তবুও সে সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে মৃদুস্বরে প্রশ্ন করল,

  • হুজুর, শ্রদ্ধেয় দাসী নূর আপনার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে অপেক্ষা করছেন। আপনি হুকু…

কথা সম্পূর্ণ করা হল না শোবহানের। হঠাৎই হাত উচিয়ে থামিয়ে দিলেন তাকে নবাব তাইমুর। হুক্কা গড়গড় করে টেনে ধোঁয়া ছেড়ে গম্ভীর গলায় বললেন,

  • আজ থাক!

সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তাইমুর। এরপর শোবহানের দিকে সামান্য ঝুঁকে বললেন,

  • মির্জা, আজ আমার মনটা বড় চঞ্চল, অস্থির, বুঝলে? ওই যে নতুন দাসীটি সেদিন নিলাম থেকে আনা হল? তার নাম যেন কি?
  • পারিজাত। হুজুর।
  • তাকে নিয়ে এসো আমার কক্ষে। হয়তো অপরিচিত মুখের সান্নিধ্য ক্ষণিককালের জন্য হলেও আমাকে অস্থিরতা থেকে মুক্তি দেবে।

শোবহান তাইমুরের এই অস্থিরতার কারণ ঠাহর করতে পেরেছে। মাহফিলে সেও উপস্থিত ছিল। হেমাঙ্গিনীর মত অতি রূপসী নারী এই অন্দরমহলে আর দ্বিতীয়টি নেই। আড়চোখে সেও দেখেছে তাকে।

কাজেই, হেমাঙ্গিনীর মতো বাঈজীর প্রতি আকর্ষিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। নবাব তাইমুর গজনবী এখন হেমাঙ্গিনীর রূপের অনলে জ্বলছেন। তার হৃদয় ভস্ম হয়ে যাচ্ছে একবার ওই সদ্য প্রস্ফুটিত দেহটি ছুঁয়ে দেখবার তাড়নায়। এই তাড়না থেকে মুক্তি পেতে তিনি আশ্রয় নিতে চাইছেন স্থুল বিনোদনের। অন্য শরীরী নৈকট্য যদি এই অস্থিরতা কিছুটা হলেও লাঘব করে? তারই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।

ভাবি জমিদার নবাব তাইমুর গজনবী এর আদেশে
কিছুক্ষণের মাঝেই একজন খাস পরিচারিকা পারিজাতকে নিয়ে শয়নকক্ষের সামনে এসে হাজির হল। সব পর্ব পাবেন Atia Adiba – আতিয়া আদিবা পেইজে।

তাইমুর তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন। কিন্তু কই সে আবেদনময়ী দীপ্তিময় চাহনি? যা হেমাঙ্গিনীর চোখজোড়ায় রাজত্ব করছিল? কোথায় সে রূপ? যার সামনে হাজারটা জৌলসপূর্ণ জলসাঘর হার মানবে?
পারিজাতের মাঝে তো তার ছিটেফোঁটাও নেই!

এই মেয়ের অক্ষিজোড়ায় শুধুমাত্র বিচরন করছে জড়তা আর ভয়।

তাইমুরের বুকের গহীন থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ভীষণ ভারী শোনাল সে দীর্ঘশ্বাস।

সহসা তিনি অনুভব করলেন, এই মেয়েটিকে নিজের অস্থিরতার প্রতিকার হিসেবে ব্যবহার করা আর নিষ্ঠুর পাপের মাঝে ব্যতিক্রম কিছু নেই।

সে মৃদুস্বরে পারিজাতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

  • ভয় পেয়ো না। আমি তোমার কোনো অনিষ্ট করব না। মির্জা, পারিজাতকে বসতে দাও।

পারিজাত একটি সুসজ্জিত গদিতে জড়তা নিয়ে বসল। খাস পরিচারিকা খুব অল্প সময়ের মাঝে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে এসেছে।

ভয়ে পারিজাতের চোখের জল ঠিকরে বেরোবার উপক্রম। কিন্তু হায়! ভাবি জমিদারের সেবা করতে এসে কি চোখের জল ফেলা যায়? সে দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলল। জমিদারের পুত্রর সামনে কাঁদার অপরাধে তাকে কি শাস্তি দেওয়া হবে তা তো জানা নেই!

তাইমুর পালঙ্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। জানালার কাছে গিয়ে থমকে গেলেন। সুসজ্জিত ভারি পর্দার আড়াল হতে দেখলেন ভোরের বার্তা। সূর্যের আলো ক্রমশ সরিয়ে দিচ্ছে রাতের আঁধারকে।

তাইমুর বুঝলেন। পারিজাতের দেহ তার মনের অস্থিরতা নিমজ্জিত করতে পারবে না। সে এনে দিতে পারবে না শান্তির আবহ। বরং তাকে স্পর্শ করলে নিজের মন তাকে অপরাধী হিসেবে হাজতবাসী করে রাখবে আজীবন।

তাইমুর দৃষ্টি জানালার বাহিরে স্থির রেখে বললেন,

  • যাও, পারিজাত। তোমার কক্ষে ফিরে যাও। আমার পাশে আজ কাউকে প্রয়োজন নেই।

পারিজাত বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল তাইমুরের দিকে। ভয় আর স্বস্তি মিলে অভ্যন্তরে এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করছে। তবুও সে দাঁড়িয়ে গেল গদি ছেড়ে।

তাইমুর এবার শোবহান মির্জার দিকে ফিরলেন। বললেন,

  • মির্জা, পারিজাতকে মুক্ত করে দাও। তাকে তার পিতা মাতার নিকট ফিরিয়ে দাও।

মির্জা মাথা নত করে বলল,

  • যো হুকুম, হুজুর!

তাইমুর ফের জানালার দিকে ফিরলেন। বুকের মাঝে এক ধরনের নিস্তব্ধ শূণ্যতা অনুভব করতে লাগলেন। এই শূণ্যতা পূরণ করতে পারবে শুধুমাত্র একজন। পঞ্চাদশী বাঈজীকন্যা হেমাঙ্গিনী।

[ পরবর্তী পর্ব পড়তে চাইলে কমেন্ট করবেন। লাইক করবেন। পেইজ ফলো দিবেন। ]

চলবে…

উপন্যাসঃ #নিষিদ্ধ_রংমহল
লেখনীতে, Atia Adiba – আতিয়া আদিবা

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply