ভবঘুরে_সমরাঙ্গন
পর্ব_৬৫
তাজরীন ফাতিহা
বাবা হওয়ার অনুভূতি আসলে কেমন? কেউ কি কখনো পিতা মাতা হওয়ার অনুভূতি পরিমাপ করেছে? করলে পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার ও সুন্দর অনুভূতি কি এটা হতো? আচ্ছা, পিতা মাতা হওয়ার অনুভূতি পরিমাপের কোনো যন্ত্রের উদ্ভাবন হয়নি? একটা স্কেল কি আবিষ্কার করা যায়না? আবিষ্কার করা গেলে ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে দেখানো যেতো, দেখো তোমরা হওয়ার খুশিতে আমাদের কি পরিমান আনন্দ অনুভূত হয়েছে। আচ্ছা বাবারটা নাহয় থাক কিন্তু মায়ের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানে কতটুকু কষ্ট সহ্য করতে হয় এটা পরিমাপের স্কেল অবশ্যই আবিষ্কার করা উচিত। সন্তান যেন পরবর্তীতে কিছুতেই মাতার অবাধ্য হতে না আরে এজন্য এটা আবিষ্কার করা অন্তত জরুরি।
আজকের দিনটা প্রচণ্ড সুন্দর। আমি বাবা হচ্ছি এর থেকে আনন্দের আর কিছুই এই পৃথিবীতে নেই, হতে পারেনা।
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া
১১ই অক্টোবর, ১৯৯০
২৬ আশ্বিন, ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ
(রোজ বৃহস্পতিবার)
ইহাব ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলল। বাবার এই ডায়েরিটা পড়লে মুখে অটোমেটিক হাসি চলে আসে। একজন মানুষ কি পরিমাণে স্ত্রী, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবান ছিল তা এই ডায়েরি পড়েই ইহাব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে। সে নিজেও ইদানিং ডায়রি লেখা শুরু করেছে। বাবাকে অল্প নকল করার চেষ্টা। আসলে ডায়েরি হলো মনের ভাব প্রকাশের সুন্দর মাধ্যম। কাউকে তেলিয়ে কথা শোনাতে বাধ্য করতে হয়না। আবোল তাবোল যা ইচ্ছে মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা যায়। এমনিতে মন চাইলেই ডায়েরি খুলে বসা যায়। ইহাব তার ব্যক্তিগত ডায়েরিটা খুলল। কি লিখবে ভাবতে লাগল। আনন্দ প্রকাশের ভাষা আসলে কেমন হওয়া উচিত? সে অনেক পৃষ্ঠা লিখল আর ছিঁড়ল। কোনোটাই মন মতো হচ্ছে না। শেষমেষ একটাতে মন আটকালো। ক্ষুদ্রাংশ –
প্রাতঃকালে ঘুম থেকে উঠে অধিকতর বিশেষ একটা সারপ্রাইজ পেয়েছি। আমি নাকি বাবা হবো! ইশ অনুভূতিটা অদ্ভুত! প্রথমবার বাবা হবো এজন্য বোধহয়। বাবা শব্দটা প্রচণ্ড ভারী। আমার এখনই নার্ভাস লাগছে। হাত, পায়ের তালু ঘেমে উঠছে। আমি প্রচন্ড ঘামছি। শীগ্রই আমাদের ঘর আলো করে ছোট্ট ছোট্ট হাত, পায়ের অধিকারীর আগমন ঘটবে। আমাকে বাবা ডাকবে। আর প্যানিক অ্যাটাককে মা। এই মেয়েটাও মা হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত! জগৎ সংসার কি দ্রুত গতিতে চলছে নাকি আমিই তাল মিলাতে পারছি না? এইতো কয়েকদিন আগেই না মেয়েটাকে ছুঁলেই অজ্ঞান হয়ে যেতো এত দ্রুত মা হয়ে গেল! যাক সেসব কথা। আমি বাবা হচ্ছি এটাই মূলত কথা। বাচ্চা মেয়ে হবে নাকি ছেলে ডাজেন্ট ম্যাটার। ও সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখুন এইটুকুই চাওয়া। দ্রুত আসো, তোমাকে ছোঁয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় বাবা অপেক্ষারত।
(বাবা ঠিকই বলেছিল বাচ্চা হবে এর অনুভূতি পরিমাপের জন্য একটা যন্ত্র আবিষ্কার হলে মন্দ হয়না। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং ও সুন্দর হতো।)
ইহাব ভুঁইয়া
২৭ নভেম্বর, ২০২২
৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
(রোজ বুধবার)
ইহাব ডায়েরি আগের স্থানে রেখে দিল। মানহা সকাল থেকে ইহাবের সামনে পড়ছে না। পালাই পালাই করছে। লজ্জা পাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। ইহাব বাবার ডায়েরি হাতে পিতামাতার রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া সম্ভবত পেপার পড়ছিলেন। ইহাবকে ঢুকতে পারমিশন দিলেন। ইহাব ভেতরে ঢুকে দেখল ইমতিয়াজ ভুঁইয়া গভীর মনোযোগের সহিত সংবাদপত্র পড়ছেন। উর্মি ভুঁইয়া এখন মোটামুটি সুস্থই বলা চলে। মানহার সঙ্গে খিটমিট করেন না। চুপচাপ থাকেন। উর্মি ভুঁইয়া তাকে দেখে বললেন,
“বসো। কিছু বলবে।”
ইহাব মায়ের পাশে বসে বলল,
“কেমন আছ আম্মু?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তোমাকে আজকে অন্যরকম লাগছে। ব্যাপারটা কি বলোতো?”
“বলবো। বাবা?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া পেপার থেকে চোখ উঠিয়ে ইহাবের দিকে চাইলেন। ইহাব হাতের ডায়েরিটা উঁচিয়ে ধরে বলল,
“এটা কি চেনো?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া অনেক আকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখতে পেয়েছেন এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন,
“আরে এই ডায়েরি তুই কোথায় পেয়েছিস?”
“পেয়েছি কোনো এক ভাবে। ধরো তোমার মূল্যবান জিনিস।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে সবকিছু ভালোভাবে দেখলেন। এই ডায়েরি সে হারিয়ে ফেলেছিল এজন্য কত কষ্ট যে পেয়েছিল! আবার পাওয়ার খুশিতে আনন্দ লাগছে তার। উর্মি ভুঁইয়া বাপ, ছেলের পানে চেয়ে আছে। ইহাব মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মম।”
“মম নয় আম্মু বলো।”
“ওকে আম্মু, শোনো তুমি দাদি হতে চলেছ।”
উর্মি ভুঁইয়া অবাক হয়ে বললেন,
“সত্যি?”
“হুম।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া লাফিয়ে উঠে বললেন,
“কোথায় আমার নাতি?”
উর্মি ভুঁইয়া কটমট দৃষ্টিতে চাইলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,
“দুঃখিত। কংগ্রাচুলেশন মাই সান। উইশিং ইউ’ল বি এন অসাম ড্যাড!”
“থ্যাংক ইউ পাপা।”
উর্মি ভুঁইয়া কিছুই বললেন না। চুপচাপ শুয়ে রইলেন। ইহাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কপালে চুমু দিয়ে চলে গেল। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,
“উর্মি আমার এত আনন্দ লাগছে কেন বলতে পারো?”
জবাব এল না কোনো।
মেজবাহ আহমেদ ও মারওয়ান উভয়ই চেয়াম্যান বাড়িতে এসেছে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া তাদের দেখে খুশি হলেন। হাত ভর্তি কয়েক পদের মিষ্টি, দই, ফলমূল, সবার জন্য জামা কাপড় অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন তারা। মারওয়ান যদিও আসতে রাজি ছিল না তবে মেজবাহ আহেমদের জোরাজুরিতে না করতে পারেনি। মানহা ফোন দিয়ে একটা জরুরি সংবাদ দেবে বলছিল এজন্য না চাইতেও এই চেয়ারম্যান বাড়িতে বহুবছর পর পা রাখলো সে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়াকে দেখে সালাম দিয়ে সরে গেছে। অতীতের কিছু ঘা কখনো মোছা যায়না। পুরো গ্রামের মানুষের সামনে একদিন এই লোক অপদস্ত করেছিল। যদিও অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটেছে তবে এসব দুঃস্বপ্ন কখনো ভুলবার নয়। হ্যাঁ এসব তার কাছে দুঃস্বপ্নই বটে।
মানহা অনেকদিন পর ছোট চাচা ও বড় ভাইকে দেখে দৌঁড়ে আসলো। জড়িয়ে ধরল চাচাকে। মেজবাহ আহমেদ ভাইস্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে দেখি?”
মানহা বলল,
“তুমিও তো বুড়ো হয়ে গেছ।”
মেজবাহ আহমেদ হেসে উঠেলেন। মানহা বড় ভাইকে দেখে কেঁদে ফেলল। জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো। বোনের শ্বশুরবাড়িতে প্রথম ভাইরা এলে বোধহয় বোনরা অনেক আনন্দিত হয়। মানহা খুশিতে পারেনা চিৎকার করতে। এমাসে সে শুধু খুশির খবরই পাচ্ছে। তার এত আনন্দে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। মহান রবের নিকট অজস্র শুকরিয়া ইতিমধ্যে জ্ঞাপন করে ফেলেছে। ইহাব বাসায় নেই। মিষ্টি আনতে গেছে। পুরো গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করে তারপর বাসায় আসবে। চেয়ারম্যান বাড়ির নাতির আগমনে মিষ্টি বিলিয়েই ক্ষান্ত না কেউ। বিরিয়ানিও খাওয়ানো হবে।
মানহা কিচেনে চলে গেল। আজকে নিজের হাতে রান্না করবে সে। চাচা ও বড় ভাইকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে সে। এখন হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করবে। চায়ের পানি বসিয়ে দিল। ফ্রোজেন চিকেন ফ্রাই, রোল, সসেজ, নাগেটস বের করল। সার্ভেন্ট হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে সব। সবকিছু তৈরি করে সার্ভিং ট্রলিতে সাজিয়ে নিল। সার্ভেন্ট ট্রলি নিয়ে গেল। মানহা কয়েক পদের মিষ্টি প্লেটে নিয়ে হলরুমে এল। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া খাবার এগিয়ে দিতে নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি চায়ের কাপ মেজবাহ আহেমদের হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন,
“আপনারা নিশ্চয়ই নাতি হওয়ার খবর শুনে এসেছেন?”
মেজবাহ আহমেদ হতবাক গলায় বললেন,
“নাতি? কার?”
“সেকি ইহাব, মানহা কেউ বলেনি আপনাদের? বুঝেছি শরম পাচ্ছে বোধহয়। বাবা, মা হচ্ছে তারা।”
মানহা বেশ লজ্জা পেল। মেজবাহ আহেমদ খুশিতে চিল্লিয়ে উঠলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া এবং মেজবাহ আহমেদ উভয়ই খেতে খেতে গল্পে মশগুল হয়ে গেল। মারওয়ান প্রতিক্রিয়া জানালো না। সে বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। আশেপাশের কোনো কিছুতে আপাতত তার আগ্রহ নেই।
ইহাব রুমের বাইরে থেকেই জোরে গেয়ে উঠল,
“খুদা কে লিয়ে হাম পে ডোরে না ডালো
হামে জিন্দা রেহে নে দো, অ্যা হুসনে ওয়া’লো
কালি কালি জুলফোন কে ফান্দে না ডালো
হামে জিন্দা রেহে নে দো, অ্যা হুসনে ওয়া’লো।”
মানহা মেজবাহ আহমেদের উরুতে শুয়ে শুয়ে গল্প করছিল। পাশেই মারওয়ান বসা। মেজবাহ আহমেদ ভাইস্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। ভাইস্তা, ভাইস্তি সবাই তার বেশ আদরের। তারাও তাকে বেশ সমীহ করে চলে, পছন্দ করে। হঠাৎ ইহাবের গলা শুনতে পেতেই মানহা চট করে উঠে বসল। এই লোকটা এত নির্লজ্জ! তাকে এখন গাইতে বলেছে কে? ইহাব রুমে ঢুকে মারওয়ান ও মেজবাহ আহমেদকে দেখতে পেতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবার উল্টো ঘুরে বেরিয়ে যেতে নিল। মেজবাহ আহমেদ গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“কি অবস্থা?”
ইহাব থতমত খেয়ে বলল,
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কি অবস্থা?”
মেজবাহ আহেমদ উদাসী ভঙ্গিমায় বললেন,
“ভালোই। এ বয়সে ভাইস্তা, ভাইস্তির প্রেম দেখছি ভালো না থেকে উপায় আছে?”
মানহা লজ্জা পেয়ে পগারপার। ইহাব নিজেও খানিকটা লজ্জা পাচ্ছে। অবিবাহিত চাচার সামনে ইজ্জতের ফালুদা। মারওয়ান চোখ কুঁচকে বলল,
“লজ্জা পাচ্ছিস কেন? তুই কি মেয়ে?”
“লজ্জা কি শুধু মেয়েরাই পায়?”
“আমি তো তাই জানি। এক হাত লম্বা গলা নিয়ে রোমান্টিক গান গাইতে পারবা আর মানুষ শুনলেই লজ্জায় হুটোপুটি খাবা? এর লজিক কি?”
“আমার বউয়ের জন্য আমি গেয়েছি। এখন লজ্জা পাব নাকি হাত, পা ছড়িয়ে কাঁদব এটা একান্তই আমার মর্জি।”
“বলি শরীরে কুরকুরানি কমবে কবে? আমরাও বিয়ে করেছি এমন বেহায়া তো হয়নি।”
“অবজেকশন ইওর টক। তোর আর আমার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। আমি রোমান্টিক আর তুই প্র্যাগম্যাটিক। আমি চাইলেই তোর জন্য গাইতে পারব, তুই পারবি?”
“হাটট..”
ইহাব মারওয়ানকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মারওয়ান নেত্রযুগল বড় বড় করে বলল,
“কী?”
ইহাব মারওয়ানের কাঁধে ভর দিয়ে তার কোকড়া চুল এলোমেলো করতে করতে বলল,
“কালি কালি জুলফোন কে ফান্দে না ডালো
হামে জিন্দা রেহে নে দো, অ্যা হুসনে ওয়া’লো ।”
(কালো কালো চুলের ফাঁদে আমাদের বেঁধো না,
হে সুন্দরীরা, আমাদের একটু বাঁচতে দাও।)
মারওয়ান কনুই দিয়ে গুতা মেরে বলল,
“সর! আমি পুরুষ। হুসনে ওয়া’লো(সুন্দরী রমণীগণ) কিভাবে?”
” দুঃখিত মার্দো (পুরুষগণ) হবে,
কালি কালি জুলফোন কে ফান্দে না ডালো
হামে জিন্দা রেহে নে দো, অ্যা মার্দো।”
“হ্যাঁ লিরিক্স তুইই বানা। সর, তোর এসব কপচাকপচি, ঢঙের আলাপ অন্য জায়গায় কর।”
“তোর কাছে এসব কপচাকপচি, ঢঙের আলাপই মনে হবে। তুম মেরি মুহাব্বত কি যবান নেহি সমঝোগে।”
“জায়গা বরাবর লাত্থি খেলে মুহাব্বত কি যবান বের হয়ে যাবে।”
“আশ্চর্য আমি প্রেমের ভাষায় কথা বলছি, তুই রাগারাগি করছিস কেন?”
“কারণ তোর এসব ইনিক পিনিকে আমার এলার্জি। সাংঘাতিক গা চুলকায়। এখনো চুলকাচ্ছে, সর।”
“গেন্দা কালে মুখে মধু দেয়নি?”
“না।”
“আমার হাতে অতীতে যাওয়ার ক্ষমতা থাকলে তোর মুখে একটু মধু ছুঁইয়ে আসতাম। এতে যদি মুখটা ঠিক হতো। সবসময় মুখটাকে হাঙ্গর মাছের মতো বানিয়ে রাখতে তোর কষ্ট হয়না?”
মারওয়ান চোখ রাঙিয়ে চাইল। মেজবাহ আহেমদ এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বললেন,
“বাদ দাও জাদ। হবু বাবাকে আমরা না বকি।”
ইহাব মাথা চুলকে বলল,
“আপনাদের কে বলল? মানহা?”
“কেউই বলেনি। আজকে এখানে আসার পরিকল্পনা ছিল। ভাইস্তির বিয়ে দিয়েছি কখনো তো আসা হয়নি তাই ভেবেছি একটু ঘুরে যাই। এখানে এসে তো একেবারে সারপ্রাইজড হয়ে গেছি। হোয়াট অ্যা কোএনসিডেন্স ভাবতে পারছ?”
“আসলেই। কোএনসিডেন্সই বটে। নাহলে আজকেই বাবা হওয়ার সুসংবাদ পেলাম, আজকেই আপনাদের আগমন! ব্যাপারটা কিন্তু ইন্টারেস্টিংও।”
“তা হবে। কিন্তু বাবা হবে জানালে না কেন?”
“স্যরি চাচ্চু। আজকে সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম। আমরা আজকে সকালে জেনেছি। ফ্রি হয়েই জানাতাম সবাইকে।”
_
দুপুরের খাবার খেয়েই মারওয়ান ঢাকা রওনা হয়েছে। মাহবুব আলম এসেছিলেন চেয়ারম্যান বাড়ি। তার সঙ্গে আলাপ করে রওনা হয়েছে মারওয়ান। মেজবাহ আহমেদ আজকে ভাইস্তির বাড়িতে থাকবেন। আগামীকাল নিজের বাড়ি যাবেন। মারওয়ানের বাসায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত দশটা বাজলো। নিশাত, নাহওয়ান বাসায় একা নয়তো আজকের রাতটা থেকে আসতো। সবাই অনেক জোরাজুরি করছিল।
ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুলো। নিশাত শরবত বানিয়ে এনেছে। ইতোমধ্যে নাহওয়ান বাবার কোলে উঠে বসেছে। শরবত খেয়ে নাহওয়ানকে কিছুক্ষণ আদর করল মারওয়ান।
“বাবা কুতায় গেচিলে?”
“তোর ফুপিকে দেখতে।”
“ডেকেচো?”
“হুম।”
“বালু আচে?”
“হুম।”
নাহওয়ান ফিচফিচ করে হেসে বলল,
“আমিও বালু আচি।”
মারওয়ান ক্লান্ত গলায় বলল,
“তোকে জিজ্ঞেস করেছে কে?”
“কেউ কলে নি। আমি বলেচি।”
“ভালো।”
নাহওয়ান হাত ছড়িয়ে অনেক বুঝিয়ে বলল,
“বিল্লু চানা এত্ত আকু কচ্চে।”
মারওয়ান চোখ বুজে বলল,
“তুইও তো করিস। তুই করলে দোষ নেই ও করলেই নালিশ?”
নাহওয়ান বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,
“ইননা। চলম চলম।”
“উদোম হয়ে ঘুরতে পারিস তখন শরম কই যায়?”
“গুমায়।”
“বাহ খুব ভালো।”
বাবার সঙ্গে অনেক কথা বলে নাহওয়ান ঘুমের দেশে পাড়ি দিল।
নিশাত তার কেশরাজি বহুদিন পর আঁচড়াতে বসল। প্রতিদিন আঁচড়াতে ইচ্ছে হয়না। যেদিন আঁচড়ায় হাত ব্যথা হয়ে যায়। একমনে দীঘল কেশরাশি আঁচড়াচ্ছে সে। মারওয়ান বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিশাতকে দেখছে। মাথায় হুট করে ইহাবের গাওয়া সুরগুলো ঘুরপাক খেতে লাগলো। বেয়াদবটা তার মাথা নষ্ট করে ফেলেছে। কিসব গান বাজছে মাথায়? সামনে পেলে জাস্ট উড়িয়ে ফেলতে হবে। সে মাথা কয়েকবার ঝাঁকালো। তবুও যাচ্ছে না। না চাইতেও মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল,
“কালি কালি জুলফোন কে ফান্দে না ডালো
হামে জিন্দা রেহে নে দো, অ্যা হুসনে ওয়া’লো।”
মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“তোমার কালি কালি জুলফো নিয়ে এখান থেকে ভাগো।”
নিশাত হতভম্ব গলায় বলল,
“কি হয়েছে আপনার?”
“কিছু না।”
“তাহলে কিসব বলছেন?”
“বলেছি তোমার চুল আঁচড়ানোর সময় পেলে না? মুখে এসে লাগছে।”
নিশাত আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল,
“আপনি কোথায় আর আমি কোথায়? আমি খাটের এপাশে আর আপনি ওপাশে। এত দূর হতে আমার চুল আপনার মুখে লাগলো কি করে?”
“লেগেছে কোনো এক ভাবে। কথা বোলো না তো। তোমার জুলফো অর্থাৎ চুল নিয়ে দাফা হো যাও, গেট লস্ট, কাস-তুয়া, গিট বুরাদান।”
“কিসব বলছেন? এসব কি ভাষা? মাথা কি পুরোই গেছে?”
“আমার মাথা ঠিক আছে। তোমাকে বলেছি গেট লস্ট হতে। গেট লস্ট বোঝো? নাকি সেটাও বোঝো না?”
নিশাত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বুঝি।”
“বুঝলে গেট লস্ট।”
এরকম মুখের উপর চলে যেতে বললে বসে থাকবে কি করে সে? অগত্যা নিশাত চিরুনি নিয়ে বেরিয়ে গেল। মারওয়ান মুখ গম্ভীর করে শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর আবারও নিশাত এসে বলল,
“আচ্ছা একটু আগে আপনি কি আমাকে গালি দিয়েছেন?”
মারওয়ান চোখ খুলে বলল,
“কখন? তোমাকে গালি দেব কেন?”
“কিসব বলছিলেন যেন? ওগুলো কোন দেশি ভাষা? কোনোদিন তো শুনিনি।”
মারওয়ান বিরক্তি নিয়ে বলল,
“সবগুলোর অর্থ দূর হও। আর কিছু জানতে চাও?”
“না। কিন্তু এগুলো কোন দেশের ভাষা?”
“উর্দু, ইংরেজি, ফরাসি, তুর্কি।”
“উর্দু আর ইংরেজি বুঝেছি। বাকিগুলো বুঝেনি।”
“ভেরি গুড। বোরো গম-শো।”
“এটা আবার কী?”
“একই অর্থ।”
“ওহ্ আচ্ছা, দাঁড়ান দূর হবো। কিন্তু এটা কোন দেশের?”
“ফার্সি।”
“আচ্ছা আপনি কতগুলো দেশের ভাষা জানেন?”
“অনেকগুলো। “
“সব আপনাদের সংস্থা থেকে শেখায়?”
“না। আমিই শিখেছি নিজ উদ্যোগে। বিভিন্ন দেশের ভাষার প্রতি আগ্রহ ছিল। এজন্য বেশ কয়েকটি ভাষা আয়ত্তে আছে আমার।”
নিশাত কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
“নাহওয়ানকে যেদিন কিডন্যাপ করা হয়েছিল সেদিনও এমন বিদঘুটে ভাষায় কিছু বলেছিল। আমার মনে নেই সঠিক। কিন্তু ভাষা গুলো অদ্ভুত। বাংলা না এটা বুঝেছি। আচ্ছা, ঐ লোকও কি আপনার মতো ভাষাপ্রেমিক?”
“জানি না।”
“আপনি কি কিছু লুকাচ্ছেন? ঠিক করে কথা বলুন। কিচ্ছু লুকাবেন না। ঐ লোকটার সাথে আপনার শত্রুতা ছাড়াও একটা কানেকশন আছে আমি শিওর। এখন সেই কানেকশনটা কী সেটা বলুন? আমার যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে।”
“বাহ আমার সাথে থাকতে থাকতে বুদ্ধিমান হচ্ছ। ভেরি গুড তবে মাথায় এত প্রেশার নিয়ে লাভ নেই। আমি তোমাকে বলব না। চিং জোউ।”
“এটাও বুঝি আগের অর্থ বহন করে।”
“হ্যাঁ, বুঝলে কিভাবে?”
“কারণ আপনি এই একটা শব্দ ছাড়া আর কোনো কিছুই জানেন না?”
“বোঝার জন্য ধন্যবাদ শা নু হাই (বোকা মেয়ে)।”
“এটা কি?”
“আগের অর্থই।”
নিশাত হেসে বলল,
“দেখেছেন আপনি এই একটা শব্দ ছাড়া কিছুই পারেন না?”
মারওয়ান নিশাতকে থাম্বস আপ দেখিয়ে বলল,
“শাস্ত বালা (সম্মতি জানানো)। এগেইন শান নু হাই।
_
ইহাবের আজকে সারাদিন ব্যস্ততায় কেটেছে। মেজবাহ আহমেদকে গেস্ট রুম সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে, কিছুক্ষণ গল্প করে তবেই ফুসরৎ মিলেছে তার। সে যদিও রুম গোছায়নি সব সার্ভেন্টরাই করেছে তবুও পাশে দাঁড়িয়ে তো থাকতেই হয়। আফটার অল বউয়ের চাচা তারউপর কর্মক্ষেত্রে সিনিয়র অফিসার। সবকিছু নজরদারি করে তবেই এসেছে। ইহাব রুমে ঢুকে মানহাকে চাদর ঠিক করতে দেখে পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে বলল,
“আমার ভবিষ্যত সন্তানের মা, আপনার কি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে?”
মানহা চমকে ঘুরে তাকালো। ইহাবকে দেখে লজ্জায় পালাতে চাইলে ইহাব তাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে বলল,
“পালাতে দেব না কভু তোমায় হে রজনীগন্ধা,
একসাথে সহস্র বছর বাঁচতে হবে যে অলকানন্দা।
পালাই পালাই করে আর ছাড় পাবে নাকো তুমি,
সুবাস ছড়িয়ে ঘায়েল করে কোথায় লুকাচ্ছ তুমি?
আসছে ভুবনে আমাদের ভালোবাসার ফুলকলি,
তোমার গর্ভফুল হোক সেই কলির পুষ্পথলি।
মাতৃণয়নী কতখানি করেছ আমায় ধন্য,
তোমার কারণে আজ আমি পরিপূর্ণ।
কি দিয়ে করব বলো তোমার ঋণের শোধ?
আসছে বছর তোমার ভালোবাসা বৃদ্ধি হোক।
মানহার কি যে হলো কবিতাটি শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। নিঃশব্দে মানুষটাকে আঁকড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এত মায়া মেশানো কবিতা এই লোকটা না থাকলে কে শোনাতো তাকে? এই মায়াকাড়া কবিতা শোনার জন্য হলেও তাকে হাজার বছর বাঁচতে হবে, এই শুদ্ধ পুরুষটির বুকে মাথা পেতে রাখতে হবে।
চলবে….
(আসসালামু আলাইকুম।)
Share On:
TAGS: তাজরীন ফাতিহা, ভবঘুরে সমরাঙ্গন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৭
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৫+৪৬
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৮
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৫+৩৬
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৭+৩৮
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৯+৩০
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৯+৪০
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন গল্পের সব লিংক