Golpo romantic golpo উড়াল মেঘের ভেলায়

উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১১


উড়ালমেঘেরভেলায়

লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক

পর্ব_১১

[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।]

রানিয়ার চারপাশ ঘুরছে। চোখ মেলে তাকালেই মনে হচ্ছে, এখুনি বুঝি ঘুরে পড়ে যাবে ফ্লোরের ওপরে। এজন্য চোখ চেপে ধরে বন্ধ করে রেখেছে ও। শরীরে একরত্তি শক্তি পাচ্ছে না রানিয়া। শক্ত হয়ে যে একটু দাঁড়িয়ে থাকবে, নিজেকে সামলাবে; সেই জোরটুকুও নেই ওর শরীরে। পাশের দেয়ালটা একহাতে ধরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সামনে এগোনোর প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
আভিয়ান ওকে রুমে যাওয়ার কথা বলেছে। অথচ রানিয়া এক পা-ও আগে বাড়াতে পারছে না৷ আভিয়ান কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গিয়েই রানিয়া আসছে না দেখে দাঁড়িয়ে গেল। ফের পিছিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। চুপচাপ নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় রত মেয়েটাকে দেখলো। রানিয়াকে এই মুহূর্তে ভীষণ অসহায় মনে হলো ওর। ওর মুখটা দেখামাত্রই আভিয়ান বুঝতে পারলো, ওর কি অসুবিধা হচ্ছে। তৎক্ষনাৎ কোনো কথা না বলে হঠাৎ ওকে কোলে তুলে নিলো। তারপর নিজের রুমের দিকে এগোলো।

আচনক এহেন কান্ডে রানিয়া হতভম্ব হলো। কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না৷ আভিয়ান ওর পিঠে আর বাহুতে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে কোলে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। রানিয়া পড়ে যাওয়ার ভয়ে দ্রুত হাতদু’টো দ্বারা আভিয়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো। ওর কাঁধের কাছটায় মুখ ঠেকিয়ে রেখে নত হয়ে বসে রইলো ওভাবেই। একটুও নড়াচড়া করলো না৷ আভিয়ান রুমের দিকে যেতে যেতে ওকে উদ্দেশ্য করে বললো, “মিসেস রানিয়া মাহমুদা।”

“জি।”

“তুমি কি একটু মোটা হয়েছো? আই মিন, তোমার হেলথ আগের চাইতে একটু বেটার হয়ে আই থিংক। কজ, গতবার যখন তোমাকে কোলে নিয়েছিলাম; তখন একটুও ওয়েট ফিল হয়নি। মনে হচ্ছিল, একটা বালিশ কোলে নিয়েছি। বাট…”

“বাট কী?”

“এবার একটু ওয়েট ফিল করতে পারছি। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করছো তাইনা? যাক, ভালো ব্যাপার।”

রানিয়া খুব একটা কথা বললো না। কারণ, কথা বলা শুরু করলেই এক কথায় দুই কথায় কথা বাড়বে। আর কথা বাড়তে থাকা মানেই বিপদ। শুধু বিপদ না, ঘোর বিপদ। আভিয়ানকে কোনোভাবেই টের পেতে দেওয়া যাবে না। এমনকি কাউকেই না। এই চৌদ্দ-পনেরো দিন একটু সমঝে-বুঝে চলতে হবে। সাবধানে থাকতে হবে। কারো নজরে পরলেই সমস্যা। কেন যে হঠাৎ আবার এই ট্যুরের ঝামেলা করা হলো! এতোদিন তো হয়নি। যখন রানিয়া প্রেগন্যান্ট হলো, ঠিক তখনই এই মুসিবত এসে খাঁড়া হলো। বিপদ যখন আসে, তখন সবদিক দিয়েই আসে! রানিয়ার আম্মারও বলিহারি। তিনি রানিয়াকে সারাজীবন জোরজবরদস্তি করে সব কাজ করিয়েছেন। মেয়েটার বিয়ের পরে এবেলায়ও ছাড়ছেন না তিনি। রানিয়া মাঝেমধ্যে ভীষণ বিরক্ত হয় মায়ের ওপর। তবে তার সিদ্ধান্তের ওপর চাইলেও যেতে পারে না৷ ওইযে মায়ের প্রতি ভালোবাসা! ওটা এড়ানো অসম্ভব ব্যাপার।
.
.
রানিয়াকে বিছানার ওপরে শুইয়ে দিয়ে আভিয়ান ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে কি যেন করছে। রানিয়া শোয়া থেকে কিঞ্চিৎ উঠে বসে দেখলো, আভিয়ান ওষুধ বের করছে। কীসের ওষুধ ওটা? রানিয়াকে খেতে দেবে নাকি?
প্রশ্নটা মনে উদয় হওয়া মাত্রই ওর কাছে এগিয়ে আসলো আভিয়ান। ঠিক আন্দাজমতো ওর হাতে ওষুধের একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো, এখান থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে খেতে। রানিয়া ট্যাবলেটের নামটা দেখলো।
‘ডমপেরিডন!’— ও যতদূর জানে, এটা তো প্রেগন্যান্ট মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। এমন পরিস্থিতিতে ওরস্যালাইনটা নিরাপদ ওর জন্য। কিন্তু এটা ওর জন্য বিপদজনক হতে পারে। খেলে যদি বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয় তখন?
এখন কী করবে? রানিয়া পরেছে মহাবিপদে। একের পর এক বিপত্তি ঘটেই চলেছে। এদিকে আভিয়ান সামনে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করছে ওকে। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে না, ও ওষুধ না খাওয়া পর্যন্ত সরবে এখান থেকে! রানিয়া নখ কামড়াতে লাগলো। তা দেখে আভিয়ান শান্ত কিন্তু কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললো, “নখ কামড়াবে না। এমন আনহাইজিনিক থাকো বলেই এভাবে অসুস্থ হয়ে পরো। এতো অসচেতন কেন তুমি?”

রানিয়া গজগজ করতে লাগলো। আভিয়ানের কথার বিপরীতে পাল্টা কোনো জবাব দিলো না। হাতের মুঠোয় থাকা সেই ওষুধের প্যাকেটটা ধরে কচলাতে লাগলো। ব্যাপারটা খেয়াল করে ওকে ধমকে উঠলো আভিয়ান। চড়া গলায় বললো, “কী হলো? মেডিসিন নিচ্ছো না কেন? তোমাকে কি এখন গালে উঠিয়ে খাওয়াবো আমি?”

কথাটা বলেই আভিয়ান হাত বাড়িয়ে ওর কাছ থেকে মেডিসিন নিতে বললো, “দেখি এদিকে দাও। আমাকেই খাইয়ে দিতে হবে।”

আভিয়ান ওষুধটা নিতে যাবে রানিয়ার হাত থেকে, তখনই ও নড়েচড়ে বসলো। মেডিসিন যেই হাতে ছিল, সেই হাতটা পেছনে সরিয়ে নিলো। আভিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে৷ হাত আরো এগিয়ে দিয়ে বললো, “কী হলো? মেডিসিন দাও এদিকে৷ আমি বের করে দিচ্ছি ট্যাবলেট।”

রানিয়া তবু হাত সামনে আনলো না। ওর কর্মকান্ড অদ্ভুত ঠেকলো আভিয়ানের কাছে৷ বিরক্ত হলো প্রচন্ড। ও এবার জোরজবরদস্তি শুরু করলো। রানিয়ার হাত শক্ত হাতে টেনে সামনে নিতেই ও অপর হাত দিয়ে আভিয়ানের হাত আঁকড়ে ধরলো। মেডিসিন বিছানার একপাশে ফেলে দিয়ে আভিয়ানকে আকুতি করে বললো, “প্লিজ আভিয়ান, আমি ওষুধ খাবো না।”

“কেন খাবে না?”

“খেতে পারি না। তিতা লাগে, এজন্য।”

রানিয়া একটু মিথ্যা বললো। ভাবলো, এতে বোধহয় কাজ হবে। কিন্তু ওকে নিরাশ করে দিয়ে আভিয়ান জবাব দিলো,

“ওষুধ না খেলে সুস্থ হবে কীভাবে? সুস্থ হওয়ার জন্য হলেও ওষুধ খেতেই হবে তোমাকে।”

আভিয়ান বিছানার ওপরে ওর সামনে বসে পাশে পড়ে থাকা মেডিসিনটা তুলে নিয়ে ট্যাবলেট খুলে বের করতেই রানিয়া আচনক একটা উদ্ভট কাজ করে বসলো এবার। আভিয়ানের হাতের বাহু দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো, “প্লিজ আভিয়ান না খাই, প্লিজ?”

হঠাৎ মেয়েটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আভিয়ান হতভম্ব হলো। একইসাথে ভ্রু কুঞ্চিত হলো ওর। মেয়েটার আচরণ এবার আসার পর থেকেই সুবিধার লাগছে না ওর। কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ব্যাপারটা যে আভিয়ানের তীক্ষ্ণ চাহনিতে পরেনি, তা নয়। বরং, সবচেয়ে বেশি বোধহয় ওর চোখেই পরেছে। তবে ও রানিয়ার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছে বলেই কোনোকিছু জানার চেষ্টা করছে না। আভিয়ান একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, “তাহলে ওরস্যালাইন আনি? ওটা নিশ্চয়ই খেতে পারো?”

“হ্যাঁ স্যালাইন খেতে পারবো।”

ওরস্যালাইনে কোনো সমস্যা নেই। তাই রানিয়া আভিয়ানকে ওটাই আনতে বললো।
আভিয়ান কিছুক্ষণের মধ্যে স্যালাইন পানি এনে রানিয়াকে দিলো। ও এক নিঃশ্বাসে পুরোটা খেয়ে নিলো। ওর খাওয়া শেষ হতেই আভিয়ান আর এক মুহূর্তও রুমে থাকলো না। সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা নিয়ে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেল।

রানিয়া এতোক্ষণ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ছিল। নিজের সন্তানের নিরাপত্তা ওর কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একারণেই বোধহয় ভয় পেয়ে আভিয়ানের সামনে এভাবে কেঁদে ফেলেছে। বাধ্য হয়ে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। আচ্ছা, আভিয়ানের মতো স্ট্রিক্ট এবং রুড পার্সোনালিটির লোক ওর এই সামান্য কান্নায় রাজি হয়ে গেল কেন? বুঝতে পারছে না রানিয়া। তবে ওর মনে হলো, এই রুমে থাকা ঠিক হবে না। তাই কষ্ট করে উঠে সেই গেস্ট রুমে চলে গেল। ওই রুমেই আজকে আলিশারা ঘুমাবে। ওদের সাথেই থাকবে রানিয়া। আভিয়ানের মুখোমুখি হবে না আর৷ ভুলক্রমে একবার হয়ে গেছে, এই-ই শেষ৷ আর এই সুযোগ আসতে দেবে না ও।
.
.
আভিয়ানের মুখোমুখি হবে না ভেবে পণ করলেও সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে সেই আভিয়ানের সামনেই পরতে হলো রানিয়ার। ও তখন ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে মাইশার সাথে বাইরে এসে আরেক রুম থেকে ওদের লাগেজ গুলো বের করে আনছিল। দরজার বাইরে লাগেজ নিয়ে এসে দাঁড়াতেই দেখলো, আভিয়ান ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। রানিয়া ওর দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পরলো। আভিয়ান সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো। রানিয়াও চোখ সরিয়ে নিলো। কিন্তু ওর কানে আভিয়ানের কথাগুলো ভেসে আসলো। এতোটা নরম সুরে! এতোটা নরম সুরে কার সাথে কথা বলছে আভিয়ান? সবসময় স্ট্রেইট-ফরওয়ার্ড এবং স্ট্রিক্টলি কথা বলা লোকটা এমন দারুণভাবে কার সাথে কথা বলছে? কৌতূহলবশত দুই কদম এগিয়ে আরো ভালোভাবে আভিয়ানের কথা শোনার চেষ্টা করলো। এবার শুনতে পেল ও, আভিয়ান ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটার উদ্দেশ্যে বলছে, “হিয়া, কখন আসছিস তোরা? আর কতক্ষণ? লেইট হচ্ছে কিন্তু। গাড়ি সাড়ে সাতটার। ইউ হ্যাভ ওনলি ওয়ান আওয়ার লেফ্ট।”

হিয়া! এই হিয়াটা আবার কে? এর নাম তো কখনো শোনেনি রানিয়া। তার সাথে কী সম্পর্ক আভিয়ানের? তারা কী এখানে আসছে? আসলেও বা কেন আসছে? ওদের সাথে ট্যুরে যাবে নাকি মেয়েটা!

চলবে

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply