অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (০৮)
সোফিয়া_সাফা
ড্রইংরুমের একদিকে বিস্তৃত ডাইনিং হলটি যেন রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতিচ্ছবি। রুমের মৃদু উষ্ণ আলোয় চকচক করছে গাঢ় রঙের পালিশ করা ওক কাঠের লম্বা টেবিল, একসঙ্গে দশজনের বসার মতো বিশাল। টেবিলের মাঝ বরাবর সাজানো আছে তাজা ফুলের ক্রিস্টাল সেন্টারপিস ও মিনিমালিস্টিক ক্যান্ডেলহোল্ডার, পুরোটা ফ্লোর গ্রিন রঙের মার্বেল পাথর দিয়ে বাধাই করা।
কিছুক্ষণ আগেই একজন শেফের সাথে মিলে রান্নার কাজ সম্পন্ন করেছে ফুল। এখন দুজন সার্ভেন্টের সাথে মিলে খাবার সার্ভ করছে। এরইমাঝে দুজনের সাথে পরিচয় পর্ব সেরে ফেলেছে ফুল। দুজনের মধ্যে একজন রুমা আরেকজন নাদিয়া। তারা বাংলাদেশি, চাকরি সূত্রে মেক্সিকো গিয়েছিল। বয়স আনুমানিক ২৪-২৫ হবে। গত ১ মাস যাবৎ উদ্যানদের সাথে তারাও বাংলাদেশেই অবস্থান করছে। কাজের চাপে এর থেকে বেশি কিছু জানতে সক্ষম হয়নি ফুল। ঠিক এগারোটা নাগাদ উদ্যান সহ বাকি সবাই ডাইনিং টেবিলে এসে বসল। খাবারের গন্ধ ছড়িয়ে পড়তেই সোহম উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠল,
“বাহঃ আজ দেখছি ইন্ডিয়ান খাবারও রান্না করা হয়েছে। রিদম তো নেই এগুলো কে রান্না করতে বলল?”
“আমি বলেছি।”
উদ্যানের শীতল বাক্যে টেবিল জুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। খাওয়া দাওয়ার একপর্যায়ে ফুলকে উদেশ্য করে অনিলা বলল,
“তুমিও বসে পড়ো আমাদের সাথে। আফটার অল তুমি তেহুর কাজিন হও।”
সারাদিন কিছু না খেয়ে থাকার কারণে ফুলের পেট তখন ক্ষুধায় কুঁকড়ে উঠছে। সে একটুখানি দ্বিধা নিয়েই চেয়ার টেনে বসতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে উদ্যান গর্জে উঠল,
“একজন মেইডের কোনো অধিকার নেই মাস্টারের সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার। এতে মাস্টারকে অসম্মান করা হয়।”
ফুল আঁড়চোখে একবার উদ্যানের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি নিস্তরঙ্গ কিন্তু ভিতরে তীব্র জ্বলন। চেয়ারটি আস্তে করে আগের জায়গায় ঠেলে রেখে সরে দাঁড়াতেই উদ্যান তেজমিশ্রিত কণ্ঠে আবার বলল,
“ও আমার কাজিন হয় এই কথাটা ভুলে যা সবাই। শিজ আ ইউজলেস মেইড। ট্রিট হার লাইক ওয়ান। নাথিং মোর, নাথিং লেস।”
টেবিলজুড়ে নেমে এল এক চেপে ধরা পিনপতন নীরবতা। উদ্যানের উপর পাল্টা কথা বলার সাহস পেল না কেউ।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে উদ্যান নিজের রুমে চলে যেতেই সবাই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। টেবিলের একপাশে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে ফুল। স্থবিরতার মধ্যে সোহম হঠাৎ উঠে এসে তার সামনে দাঁড়াল। ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বলল,
“ডোন্ট বি স্যাড, ট্রাস্ট মি—ইউ আর এক্সট্রিমলি ইউজফুল।”
ফুলের চোখেমুখে বিরক্তির রেশ ফুটে উঠল। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে সোহমকে পাশ কাটিয়ে কিচেনের দিকে চলে গেল। সোহম শুধু ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল, ফুল ঠিক কি বলল বুঝতে পারল না।
উদ্যানের তীক্ষ্ণ কথাগুলো ফুলের ভেতরের ক্ষুধাকে অনেকটাই নিঃশেষ করে দিয়েছিল, তবু পেটের টানে রুমা আর নাদিয়ার সঙ্গে মিলে কিছুটা খাবার খেয়ে নিয়েছে। কিচেনের শীতল মার্বেল ফ্লোরেই বসে খেতে হয়েছে তাকে। কিচেন থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমের ফ্লোরে বসে পড়ল ফুল। খানিকটা ফুরসৎ মিলতেই দৃষ্টি গেল নিজের ডান পায়ের দিকে। পায়ের পাতাটা উল্টিয়ে ক্ষতস্থানে চোখ বুলিয়ে দেখল, চামড়ার লালচে ক্ষতটা কমার বদলে যেন ধীরে ধীরে দগদগে ঘায়ে পরিণত হচ্ছে।
“কি হয়েছে পায়ে?”
আচমকা প্রশ্নে বিছিয়ে রাখা পা গুটিয়ে নিল ফুল। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল লুহান চিন্তিত নয়নে তার পায়ের দিকেই তাকিয়ে আছে। একহাত কুলারের হাতলে আরেকহাতে ঠান্ডা পানীয়। ফুল উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। তন্মধ্যেই লুহান কুলারের ডোর অফ করে পকেট হাতড়ে ফোন বের করল। ফোনে কিছু একটা টাইপ করে পুনরায় ফুলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কিচেনে নির্বিঘ্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে শেফ পপকর্ণ রান্না করছে। রুমা আর নাদিয়া তাকে সাহায্য করছে। লুহান কিছুটা এগিয়ে এসে ফুলের সামনে থাকা টুলের উপর বসল,
“তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো ঠিকঠাক উত্তর দেবে?”
ফুল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই লুহান শ্বাস ফেলে বলল,
“মেলোকে নিয়ে গিয়ে তেহ ঠিক কি করতে চেয়েছিল। আই মিন কোন কাজে মেলোর সাহায্য নিয়েছিল তেহ। তুমি কি এই ব্যপারে কিছু জানো?”
ফুল আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইল। লুহানের কথা শুনে মনে হচ্ছে সে উদ্যান আর মেলোর বিয়ের ব্যপারে কিছুই জানেনা।
“আমাকে এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
“কেন মানে? তুমি তেহুর কাজিন হও। আঠারো বছর ধরে ওদের বাড়িতে ছিলে তুমি, তো ওর ব্যাপারে অনেক কিছুই জানো নিশ্চয়ই? এই যেমন ওর ফ্যামিলিতে কে কে আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা মেলোকে ও ঠিক কোন কাজে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।”
এহেন কথায় ফুলের মাথা আউলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সে এবার সোজা হয়ে বসে পাল্টা প্রশ্ন করল,
“আপনি আগে বলুন এই বাড়িতে হচ্ছে টা কি, আপনারা কারা? তেহজিব খানাজাদার সাথে আপনাদের কিসের সম্পর্ক?”
লুহানের মুখাবয়বের গঠন পরিবর্তন হতে লাগল। শ্যামলা চেহারার কাঠামো শক্ত হয়ে গেল। লুহানকে প্রথম দেখেই ফুল বুঝে গিয়েছিল লুহান বাঙালি নয়। অনিলা আর তার মধ্যে সাদৃশ্য আছে।
“হেই ওয়ান্ডারফুল আর ইউ ফ্রী?”
ড্রইংরুমের দরজা পেরিয়ে ডাইনিং হলে প্রবেশ করল সোহম। লুহানকে বসে থাকতে দেখে সে অবাক হল।
“লুহান তুই এখানে কি করছিস?”
লুহান হাতে থাকা কোল্ড ড্রিংকস দেখিয়ে বলল,
“আমি তো এটার জন্য এসেছি। কিন্তু তুই এসেছিস কেন?”
সোহম লাজুক হেসে বলল, “আমি তো চেয়ারফুলকে নিতে এসেছি।”
সোহমের কথার তোড়ে ফুল আর লুহানের মুখ বেকে গেল।
“এসব উইয়ার্ড নামে ডাকা বন্ধ করবি?”
“সিরিয়াসলি! উইয়ার্ড লাগছে?”
“হুম। ফুল বলে ডাকলেই তো হয়। ফুল মিনস ফ্লাওয়ার; সিম্পল। নামটাকে এতো কমপ্লিকেটেড করার মানে কি?”
“মেরি বিল্লি মুঝসে মিয়াঁও?”
“বেশি হিন্দি ঝাড়িস না, রিদমের কাছে হিন্দির ফুল কোর্স করেছি আমি। তোদের সবার থেকে ফাস্ট শিখেছি হুহ।”
“হাহ নেমকহারাম একটা। তোকে বাংলা কে শিখেয়েছে হ্যাঁ? এই আমি শিখিয়েছি। আর তুই আমাকেই ফুল মিনস ফ্লাওয়ার শেখাচ্ছিস?”
“আমি অর্থ শেখাই নি। আমি শুধু বলেছি ফুল নামেই ডাকতে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তেহ কিন্তু তোকে উগান্ডা পাঠিয়ে দেবে।”
“বললেই হলো? আমি একশোবার ডাকবো এটা তেহুর ফাদার ইন ল’র এস্টেট নয় এটা সোলার এস্টেট। তাই চাইলেই আমাকে বিতাড়িত করতে পারবে না।”
ফাদার ইন ল’র কথা শুনে ফুলের চোখ বড়বড় হয়ে গেল।
“এক মিনিট, এক মিনিট। আপনি এর মাঝে ওনার ফাদার ইন ল’কে টেনে আনছেন কেন? ওনার ফাদার ইন ল আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে শুনি? ওনাকে নিয়ে উল্টো পাল্টা মন্তব্য করার দুঃসাহস করবেন না একদম। সাহস থাকলে তেহ নামক মনস্টারকে নিয়ে উদ্ভট মন্তব্য করুন।”
ফুলের অভিব্যক্তি দেখে লুহান ও সোহম দুজনেই তব্দা খেয়ে তাকিয়ে রইল। ফুলের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ দুজনের মধ্যে একজনেরও বোধগম্য হলো না। এদিকে ফুলের শেষ কথাটুকু শুনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অনিলা শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার মতো অবস্থা তার। তার হাসির শব্দে ফুলের শরীর জ্বলে যাচ্ছে। রাগের চোটে তার নাকের পাটা ফুলে উঠল, দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“আজব হাসছেন কেন? মনস্টারকে কিছু বলার সাহস তো নেই আপনাদের মাঝে। শুধু শুধু আমার বাবাকে…
কথাটুকু শেষ করার আগেই ফুলের চোখ আটকে গেল ধূসর বাদামী রঙা চোখজোড়ার উপর। এদিকে ফুলের পুরো কথাটা শোনার আসায় বাকিরা কান খারা করে আছে। যার দরুন ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে থাকা উদ্যানের উপস্থিতি কেউ এখন অবধি টের পায়নি। উদ্যানকে দেখে ফুল পেছনে থাকা দেয়ালের সাথে সিটিয়ে গেল। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। আচ্ছা মনস্টার টা কি এবারও তার কথাগুলো শুনে ফেলেছে? ফুলের ভীতসন্ত্রস্ত চাহনি অনুসরণ করে সবাই একসাথে দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। উদ্যান বহু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। শরীর সোজা থাকলেও উদ্যানের শীতল দৃষ্টি ফুলের উপর স্থির। ঘাড় বাকিয়ে একদৃষ্টিতে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চাহনি দেখে উপস্থিত প্রত্যেকে একটা শুকনো ঢোক গিলল। বেশ খানিকক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ধুপধাপ পা ফেলে উদ্যান বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। সে চলে যেতেই প্রত্যেকে যেন প্রাণ ফিরে পেল।
“তুমি কি যেন বলছিলে?”
লুহানের কথার উত্তর দিল না ফুল। সে তো কথায় কথায় বিয়ের কথাটা বেফাঁস বলেই ফেলতে যাচ্ছিল। কিন্তু এই কথাটা তো সে কাউকে বলতেই চায়না। কেন বলবে সে এই কথাটা? কি লাভ হবে বলে? যে সম্পর্কটা না সে মানে আর না উদ্যান মানে। তাহলে সেই সম্পর্কের কথা ঘটা করে জানানোর মানে কি? এতে শুধু কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটাই পড়বে। ফুলকে নীরব থাকতে দেখে সোহম প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল,
“আরে ১২ টার বেশি বেজে যাচ্ছে মুভি দেখব কখন? চলো সবাই।”
অনিলা ডাইনিং হল থেকে বের হতেই একজন ডাক্তারকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে থেমে গেল। এতরাতে ডাক্তারের প্রয়োজন কার পড়ল ভেবে পেল না অনিলা।
“এতরাতে আপনাকে কে ডেকেছে?”
“লুহান স্যার টেক্সট করেছিল। সে এখন কোথায় আছে?”
অনিলার কপালে ভাজ পড়ল। আঙুল দিয়ে ডাইনিং হলের দিকে ইশারা করতেই ডাক্তার সেদিকে চলে যায়। ব্যপারটা বোঝার জন্য অনিলাও পুনরায় ডাইনিং রুমে চলে আসে। এদিকে লুহানকে বসে থাকতে দেখে সোহম বেজায় বিরক্ত হচ্ছে।
“লুহান তুই যাচ্ছিস না কেন?”
“একই প্রশ্ন আমি তোকেও করতে পারি। রুমা আর নাদিয়া খাবার দাবার নিয়ে গেছে। তারপরও তুই এখানে কি করছিস? তোর তো থিয়েটারে থাকার কথা।”
সোহম বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করল, “তুই যা প্লিজ, আমি বিউটিফুলকে নিয়ে আসছি।”
লুহান কিছু বলার আগেই ফুল গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
“আমি কোথাও যাবোনা আপনারা যান।”
এরইমাঝে অনিলা ডাক্তারকে নিয়ে এলো, ডাক্তারকে দেখে লুহানের মনে পড়ল ফুলের পায়ের আঘাতের কথা। সে এবার ফুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ফুল, ডাক্তার এসেছে। তোমার পায়ের ক্ষতটা তাকে দেখাও।”
“কি হয়েছে ওর পায়ে?” অনিলা ও সোহম একসাথে প্রশ্ন করল।
ডাক্তার ফুলের সামনে বসতেই ফুল পায়ের পাতা উল্টো করে দেখাল।
“কাঁচ ঢুকেছিল?”
ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তরে ফুল মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ডাক্তার এবার নিজের সরঞ্জাম বের করে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন।
“আপনি ৫ বছরের মধ্যে টিটেনাস ইঞ্জেকশন নিয়েছেন?”
ফুল কিছুক্ষণ ভাবল তারপর না বোধক মাথা নাড়ল। ডাক্তার এবার একটা ইঞ্জেকশন বের করলেন। ইঞ্জেকশন দেখে ফুল ঘাবড়ে গেল,
“এটা না দিলেই নয়?”
ডাক্তার গম্ভীর গলায় বললেন,
“সংক্রামণের ঝুঁকি এড়াতে এটা নিতেই হবে।”
লুহান বুঝতে পারল ফুল ইঞ্জেকশন দেখে ভয় পাচ্ছে। সে অনিলাকে ডেকে বলল,
“অনিলা তুমি ফুলকে স্টেবল থাকতে হেল্প করো।”
অনিলা মাথা নেড়ে ফুলের পাশে এসে বসল। তারপর আলতো হাতে ফুলের চোখজোড়া ঢেকে ফেলল। এই ফাঁকে ডাক্তার ইঞ্জেকশন পুশ করে দিলেন। ভয় আর ব্যাথার সংমিশ্রণে ফুলের বন্ধ নেত্রপল্লব থেকে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
সোহমের জোরাজুরিতে ফুলকে বাধ্য হয়েই তাদের সাথে বসে মুভি দেখতে হচ্ছে। তার অবশ্য মুভির দিকে একটুও খেয়াল নেই। সে অবাক চোখে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে। দোতলায় যে এরকম একটা হোম থিয়েটার থাকতে পারে এটা ছিল তার কল্পনাতীত। দশ সিটের ব্যক্তিগত সিনেমা হল, সাউন্ডপ্রুফ দেয়াল ও 4K প্রজেক্টরসহ। আসার সময় ফুল লক্ষ্য করেছে অন্যপ্রান্তে একটি গেমিং রুম আছে, যেটা পুল টেবিল, আর্কেড মেশিন, আর হাই-এন্ড গেমিং কনসোল দিয়ে সাজানো গোছানো। সে মুভি দেখবে কি? এসব দেখেই তো তার চক্ষু চড়কগাছ।
“হেই সোলফুল, প্লিজ থিয়েটারের দিকে মনোযোগ দেও। ক্লাইম্যাক্স মিস করে ফেলবে কিন্তু।”
ফুলের পাশের সিটে অনিলা বসেছে তারপর অনি বসেছে। সোহম বসেছে ফুলের পেছনের সিটে। তার একপাশে বসেছে লুহান আর আরেকপাশে বসেছে মেলো। ফুল থিয়েটারের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল স্ক্রিনে একটা হলিউড মুভি চলছে। মুভিটা সম্ভবত অ্যাকশন জনরার। সত্যি বলতে এই জনরার মুভিতে ফুলের কোনো আকর্ষণ নেই। সে তো পছন্দ করে বলিউড রোমান্টিক জনরার মুভি। যদিও শাকিব খানের বরবাদ মুভিটা তার বেশ লেগেছে। ইশ আরিয়ানের মতো কেউ যদি তার জন্য পাগল হতো। কি ভালো হতো! আবেশ তাকে ভালোবেসেছে ঠিকই কিন্তু সেই ভালোবাসার কথাটা সে একদম শেষ মুহুর্তে এসে জানল। একই সাথে বুঝতে পারল এই জন্মে হয়তো আর কখনো ভালোবাসার স্বাদ অনুভব করার সৌভাগ্য হবেনা তার। আচ্ছা আবেশ কি তাকে ভুলে যাবে? ভাবনা টা মনের মাঝে উঁকি দিতেই চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। আবেশের কাছে চলে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা জাগল মন সায়রে।
“হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং?”
অনিলার প্রশ্নে ফুল দুহাতে চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। কোনোদিকে না তাকিয়ে একছুটে থিয়েটার থেকে বেরিয়ে গেল। সে এখানে থাকবে না, যে করেই হোক আবেশের কাছে চলে যাবে। ড্রইংরুমে একটা ল্যান্ডলাইনের ফোন দেখেছিল সে। উদ্যান এখন বাড়িতে নেই এই সুযোগেই আবেশের সাথে যোগাযোগ করবে সে। আজ একদিনেই ফুল বুঝতে পেরেছে পুরোটা জীবন সে এমন জাহান্নামে কাটিয়ে দিতে পারবে না। খুড়িয়ে খুড়িয়ে ল্যান্ডলাইন ফোনের কাছে এলো ফুল। সে এটা ব্যবহার করতে অভ্যস্ত নয়। তবুও কয়েকবার চেষ্টা করার পর ফুল নিজের ফোনে কল দিতে সক্ষম হল। নিজের ফোন নম্বর ছাড়া আর কারো ফোন নম্বর মুখস্ত নেই তার। দুবার রিং হতেই অপরপাশ থেকে কেউ একজন কল রিসিভ করল,
“হ্যালো…
আবেশের কণ্ঠ শুনে ফুল ডুকরে কেঁদে উঠল। ফুলের কান্নার শব্দ শুনেই আবেশ বুঝে গেল এটা ফুল।
“ফুল তুই? কোথায় আছিস জান? বল আমাকে,”
আবেশ নিজেও কান্না করে দিল। সে ফুলের রুমেই বসে ছিল এতক্ষণ যাবৎ। খুব আফসোস হচ্ছিল ফুলকে এতো দেরিতে মনের কথা জানানোর জন্য। সে যদি উদ্যানের আগমনের পূর্বেই ফুলকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিয়ে নিজের করে নিতো তাহলে আজকে আর উদ্যান তার থেকে ফুলকে এভাবে কেড়ে নিতে পারতো না। ফুল কান্নাজরিত কন্ঠে বলে উঠল,
“আবেশ ভাই আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। আমাকে এই জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করো। তোমার হাত ছেড়ে দিয়ে আমি ভুল করেছি। আমি ভুল পথে চলে এসেছি আবেশ ভাই। আমাকে তুমি ফিরিয়ে নেও।”
আবেশ পাগলের মতো ফোনের উপরেই চুমু দিয়ে বসল,
“কান্না করিস না জান। তোর কান্না আমি সহ্য করতে পারিনা। তুই শুধু বল যে কোথায় আছিস। আমি তোকে নিতে আসব।”
ফুল অসহায় কন্ঠে বলল, “আমি জানিনা এটা কোন জায়গা কিন্তু মনস্টার টা বলেছিল আমরা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে আছি।”
আবেশ সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “তুই চিন্তা করিসনা আমি তোর লোকেশন ট্রেস করে তোকে খুঁজে বের করে ফেলবো। হিশশশ কান্না করিস না, আমি ঠিক তোকে খুঁজে বের করবো।”
এরই মাঝে কল কেটে গেল। ফুল পুনরায় কল করতে চাইল কিন্তু কোনো লাভ হলোনা। আর সংযোগ পাওয়া যাচ্ছেনা।
“এটা তুমি কি করলে ফিয়ারফুল?”
হঠাৎ সোহমের কথায় ফুলের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। সেই সাথে প্রচন্ড ভয়ে সে ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠল। ঠান্ডা আবহাওয়াতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল। সে ওড়না দিয়ে কপাল মুছে ভয়ে ভয়ে বলল,
“কিছুনা, আসলে বাড়ির লোকের সাথে কথা বলেছিলাম।”
সোহম ফুলের মুখ বরাবর ঝুকে মিনমিনিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে বলতে পারতে আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম কিন্তু তুমি ভুল করে ফেললে।”
ফুল শুকনো ঢোক গিলে আওড়াল, “ভুল?”
সোহম এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। নিচে পড়ে থাকা ফোনটা তুলে আগের জায়গাতে রেখে বলল,
“আসলে এই লাইনের সাথে তেহুর ফোন সরাসরি কানেক্টেড।”
কথাটা শুনে ফুলের মাথায় বজ্রপাত হল।
“কিহ! তার মানে…
সোহম বাকি কথাটা সম্পূর্ণ করল,
“তার মানে তোমাদের সব কথাই তেহ শুনে ফেলেছে। Maybe…”
চলবে,,,
Share On:
TAGS: অবাধ্য হৃৎস্পন্দন, সোফিয়া সাফা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৬
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৭
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১০
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৮
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২২
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২০
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৬