#অন্তরালে_আগুন
#পর্ব:২২
#তানিশা সুলতানা
একটা ভয়ংকর রাত অতিবাহিত হয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। টিনের চালের ফাকা দিয়ে এক ফালি রোদ্দুর ছোট্ট কক্ষে প্রবেশ করেছে। পাশে বাজার হওয়ার সুবিধার্থে অনেক মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। দরদাম করে জিনিস কিনতে ব্যস্ত তারা। ভোর রাতের দিকে হালকা বৃষ্টি পড়েছিলো। তাতেই রাস্তাঘাটে পানি জমে গিয়েছে। আনু পিটপিট করে চোখ খুলে। মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার রং চটে গিয়েছে। যখন নতুন ছিলো তখন বোধয় খুব সুন্দর ছিলো।
এই সিলিং ফ্যানটার মতো সমাজে কিছু মানুষ রয়েছে। যারা নতুন থাকতে চকচক করে। মনে হয় জীবনটাকে আলোকিত করতে এসেছি।
কিন্তু যত পুরনো হতে থাকে তত রং বদলায়। একটা সময়ে এসে মরীচিকায় ধরে যাওয়ার লোহার মতো জীবনটাকে ছারখার করে তারা চলে যায়।
বহু দূরে চলে যায়। আমাদের ফেলে দিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে। সেখান থেকে তীরে ফেরার আর কোন রাস্তা থাকে না আর তারাও কোনদিনও আসে না আমাদেরকে ডাঙ্গায় তুলতে।
মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে আনুর। সারারাত নির্ঘুম কেটেছে। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ভোর হয়ে গেলো বুঝতেই পারলো না। মাথা নিচে থাকা বালিশ খানা ভিজে জবুথবু।
সীমা আক্তার। মানুষটা নিজেকে যতই কঠিন দেখানোর চেষ্টা করুক আসলে সে খুব নরম মনের। বৃষ্টি ঠিকই বলেছিলো। তার মধ্যে মা মা একটা ব্যাপার আছে। এই যে গতকাল রাতে আনুর কক্ষে এসে কঠিন স্বরে বলে যায়
“ঘুমাও আজকে। আর যদি এখান থেকে পালানো রাস্তা খুঁজে পাও তাহলে পালিয়ে যেও।
ব্যাস আর কোনো কথা বলে না। ঠিক যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। আনুর হাসি পায়। অতি দুঃখেরও সে খিলখিল করে হেসে ওঠে।
বড্ড তাচ্ছিল্যের সুরে বলে
“পালিয়ে আর কোথায় যাবো? আমার জন্য যে সব রাস্তাই বন্ধ। এই আনু কে বাঁচানোর মতো কেউ নেই। বিশাল এই দুনিয়ায় আমি ছাড়া আমার কেউ রইলো না।
___
বেওথা ব্রিজের ওপর বসে আছে নওয়ান। সারারাত এভাবেই এখানে বসে ছিলো। কত প্যাকেট সিগারেট ফুরিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। শুধু হিসেব আছে পায়ে তলায় অনেক গুলো সিগারেটের ছোট ছোট অংশ পড়ে আছে। বল্টু এবং তামিম নওয়ানের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সারা রাত তারাও নওয়ানের সাথে ছিলো। আজকে আর নওয়ান তাদের যেতে বলে নি। থাকতেও বলে নি।
তামিমকে নিয়ে মারাত্মক জেলাস বল্টু। তার মতে নওয়ানের সাথে শুধু সে থাকবে। বিপদ দুঃখ কষ্ট সবটায় শুধু সে সঙ্গ দেবে।
পরিবারের পরে বল্টু থাকবে শুধু নওয়ানের জন্য থাকবে। অন্য কেউ না।
কিন্তু এই তামিম টা বড্ড খারাপ। সে শুধু নওয়ানের আশে পাশে থাকতে চায়। সুযোগ পেলেই খুঁটি গেড়ে বসে পড়ে।
বিষয়টা বল্টু বুঝলেও বুঝতে পারেনা নওয়ান।
তাইতো তামিমকে বারণ করে না তার সঙ্গে থাকতে।
বল্টুর ভাবনার মাঝে শুনতে পায় তামিমের কণ্ঠস্বর। সে বলছে
“ভাই সকাল হয়ে গেলো বাসায় ফিরবেন না।
নওয়ান আসমান পানে তাকিয়ে সিগারেটে দীর্ঘ টান দেয়। তারপর নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া উড়াতে ওড়াতে বলে
“আনু কোথায় আছে তামিম?
তামিম বোধহয় একটু চমকালো। চোখে মুখে ফুটে উঠে অস্বাভাবিক ভয়। গলা শুকিয়ে যেনো কাঠ হয়ে গেল মুহূর্তেই। দু পা পিছিয়ে যায়। বল্টুর হাসি পায়। যাক তামিম এবার আচ্ছা মতো ঝাঁড়ি খাবে। তার কি যে শান্তি লাগবে।
“আনসার মাই কোয়েশ্চেন তামিম। হোয়ার ইজ আনু?
বড্ড শান্ত নওয়ানের কণ্ঠস্বর। তবুও কলিজা কেঁপে ওঠে তামিমের। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে তোতা পাখির মত বলে
“ভাই আমি শুধু সেলফি বাসে টিকিট কেটে দিয়েছিলাম। আর কিচ্ছু জানি না। আনুকে আমি দেখিওনি।
নওয়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে।
“তোর জিভটা যদি আমি টেনে ছিঁড়ে দেই। কেমন হবে ব্যাপারটা?
তামিম নওয়ানের পায়ের কাছে বসে পড়ে। কান্না করতে করতে বলে
“আমি সব জানি ভাই কিন্তু বলতে পারবো না। আপনি আমাকে মেরে ফেললেও আমি বলতে পারবো না। ক্ষমা করুন আমায়।
বল্টু বলে
” তুই ভাইয়ের সাথে এই জন্য আছিস যেনো জানতে পারিস ভাই খোঁজ পেলো কি পেলো না?
তামিম কি বিরক্ত হলো? হলোই বোধহয়। হাবাগোবা বল্টু দিনকে দিন চালাক হয়ে উঠছে। ফটর ফটর কথা বলতে শিখে যাচ্ছে। ব্যাপারটা অবশ্যই তামিমের ভালো লাগা উচিত নয়।
“তামিম আমি আনুকে খুঁজে পাবো। আমার ইঁদুর ফাস্ট টাইম আমার কাছে কিছু চেয়েছে। তাকে খালি হাতে ফেরাবো না।
বাট বাট বাট
আনুকে খুঁজে পাওয়ার পরে তুই এন্ড এসবের সাথে যারা যারা জড়িতো রয়েছে সবাইকে জানে মে/রে দিবো। গড প্রমিজ।
তামিম মনে মনে বলে
“আপনি যেদিন জানতে পারবেন এসবের পেছনে কে আছে সেদিন হয়ত নিজেই নিজেকে মে/রে ফেলবেন।
তখনই নওয়ানের ফোন বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে তাকাতেই তার চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। যেনো এতক্ষণ এটারই প্রতীক্ষায় বসেছিলো। কল রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে সীমা বেগমের কন্ঠস্বর।
___
সকাল থেকেই তালুকদার বাড়িতে অন্যরকম আয়োজন চলছে। বাড়ি ঘর সাজানো থেকে শুরু করে রান্নার আয়োজনে অন্যরকম আমেজ লক্ষ করা যাচ্ছে। একটা রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার। নুপুরকে আজকে কেউ বিরক্ত করছে না। সবিতা তালুকদারও কাজে লেগে পড়েছে।
বুদ্ধিমান নুপুর চট করে বুঝে ফেলে স্পেশাল কেউ আসছে বাড়িতে।
সেও কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়।
আমিনা বেগম ছোট্ট ছেলেটাকে খাইয়ে দিচ্ছে। সেটা নিয়েও সবিতা কথা বলছে।
“বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে নাকি? রাস্তা থেকে বাচ্চা তুলে এনে নতুন নাটক করা হচ্ছে। আমার হয়েছে যত জ্বালা। সব নাটক দেখতে হয়।
নুপুর বাচ্চাটির পাশে বসে পড়ে। তার লাল লাল চুলের ভাজে হাত বুলিয়ে সবিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে
“আপনি রাগ করে চলে যেতে পারেন না? আমার দাদা শ্বশুরের মুখে ডিভোর্স পেপার ছুড়ে দিয়ে তেজ দেখিয়ে চলে যাবেন। সতীনের বাচ্চা কাচ্চাদের সাথে থাকতে আপনার আত্মসম্মানে বাঁধে না?
মীরা পোলাও রান্না করছিলো। মনোযোগ রান্নাতে থাকলেও কানটা নুপুরের দিকে ছিলো।
হঠাৎ করে সে হেসে ওঠে। আসলে নুপুরের বলা কথাগুলো একদম তার মনের কথা। বহুবার সে মুখ ফুটে বলতে চেয়েছে কিন্তু বলতে পারে নি।
মিরাকে হাসতে দেখে কবিতা রাগটা যেনো তর তর করে বেড়ে গেলো।
” এই মা**** মুখ সামলে কথা বল। কতো বেডার সাথে শুয়ে
বাকিটা শেষ করার আগেই নুপুর চোখ মুখ কুঁচকে বলে
“ছিহহহহ
বস্তি মার্কা মুখের ভাষা। অবশ্য আপনার মতো ছোটলোকের থেকে ভালো ভাষা আশা করাও যায় না।
খারাপ মহিলা। বারো বেডার সাথে শোয়ার অভ্যাস আপনার। তাই তো একজনের সংসার ভেঙে তাকে মেরে নিজে জায়গা করে নিয়েছেন।
আমিনা ভয়ার্তক দৃষ্টিতে তাকায় নুপুরের মুখ পানে। মীরাও চমকায়। সবিতা চায়ের কোটলি টা ছুড়ে ফেলে এগিয়ে আসে নুপুরের দিকে। ওর চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠোকর দেয়। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে যায় যে নুপুর কিংবা মীরা বা আমিনা কেউ ঠিকঠাক ধরতে পারে না। কিন্তু নুপুর যখন চিৎকার করে ওঠে। ওর মাথা ফেটে গল গল করে রক্ত গড়াতে থাকে তখনই হুঁশ ফেলে ওদের। মীরা দৌড়ে এসে সবিতার হাত থেকে নুপুরকে ছাড়িয়ে নেয়। দুই হাতে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে। সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। নুপুর অনুভব করে মীরা কাঁপছে। বাচ্চা ছেলেটি শব্দ করে কেঁদে ওঠে। আসলে সে এসবে অভ্যস্ত নয়। তার সামনে কেউ কখনো উচ্চস্বরে কথা বলে না। তাইতো বাচ্চা ছেলেটি এরকম পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছে না। সর্বক্ষণ ভয় ভয় থাকছে। আমিনা বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দেওয়ার ভঙ্গিমায় বলে
“কিচ্ছু হয়নি বাবা। আমি আছি তো। ভয় কেনো পাচ্ছো?
মিরা শাশুড়ির মুখ পানে তাকিয়ে বলে
“মা আপনি ভয়ংকর। হাসতে হাসতে মানুষ খু/ন করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।
কি বলেছি মেয়েটা আপনাকে? উচিত কথা শুনতে ভালো লাগে না?
সবিতা জবাব দেয় না। হন হনিয়ে চলে যায় রান্না ঘর থেকে।
নুপুর কিছু মুহুর্ত ঝিম মেরে বসে থাকে।
কপালের মাঝখানটা ফেটে গেছে। মিরা শাড়ির আঁচল দ্বারা কপালটা মুছে দেয়।
“আজকে স্নেহাকে দেখতে আসবে। তুমি প্লিজ এই ঘটনাটা নওয়ানকে বলিও না। সে সিনক্রিয়েট করবে। আর আমার মেয়ের পাকা কথা পেছিয়ে যাবে।
নুপুর একটু হাসার চেষ্টা করে বলে
“আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি কাউকে কিছু বলবো না।
মীরা যেনো নিশ্চিত হলো। পুনরায় রান্নার কাজে মনোযোগী হয়।
আমিনা শুধু নুপুরের মুখপানে তাকিয়ে থাকে। হয়তো এই মেয়েটার মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে বা মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে একটু আদর করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কোনো একটা দোটানোর কারণে সেটা করতে পারছে না।
নুপুর কিচেন থেকে চলে আসে। মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে। সারারাত ঘুমোতে পারে নি। নওয়ান আনুর কোনো খোঁজ নিয়ে আসবে এই আশায় থাকতে থাকতে সকাল হয়ে গেছে। কিন্তু নওয়ান আর ফেরে নি। আনুর কোন খোঁজও দেইনি।
কেনো জানি মানুষটাকে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিলো। মনে হচ্ছিল আর যাই হোক নওয়ান তার এই বিশ্বাসের মর্যাদা দেবে। খুঁজে আনবে আনু কে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে বিশ্বাসের যোগ্য নয়। একটা অযোগ্য মানুষকে ভরসা করেছে সে।
এসব ভাবতে ভাবতে নিজ কক্ষের পানে এগোচ্ছিলো নুপুর। তখনই স্নেহার কক্ষের দিকে নজর পড়ে। মেয়েটাকে আজকে দেখতে আসবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজকেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে যাবে। নির্বাচনের আগে স্নেহাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে। এমনটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে মীরা। এবং এটাও জানিয়েছে তার কথা মেনে না নিলে এই বাড়িতে থাকবে না সে। নিজের বাচ্চাদের নিয়ে চলে যাবে বাবার বাড়িতে।
মীরার বাবার বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো। তালুকদারদের সঙ্গে টক্কর দেয়ার ক্ষমতা রাখে তারা। তাইতো এই বাড়িতে মীরার পজিশন একটু ওপরে।
নুপুর স্নেহার কক্ষে ঢোকে। মেয়েটা গভীর মনোযোগ দিয়ে উপন্যাস পড়ছে। ইদানিং অপেক্ষা উপন্যাসটা বেশ ভালো লাগে তার। বেশ কয়েকবার পড়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। আজকে আবারও পড়ছে।
নুপুর স্নেহার পাশে গিয়ে বসে।
“আপু তুমি খুশি তো?
স্নেহা বোধহয় বুঝতে পারল না। সে বই খানা বন্ধ করে টি টেবিলের উপর রাখে। তারপর নুপুরের মুখপানে তাকিয়ে বলে
“কোন ব্যাপারে বলছো?
“এই যে তোমাকে দেখতে আসছে।
” আমাকে দেখতে আসছে মানে কি?
“তুমি এসব জানো না?
” না তো
“আজকে তোমায় দেখতে আসবে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আজকেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলবে।
চলবে
Share On:
TAGS: অন্তরালে আগুন, তানিশা সুলতানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২৮
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৪
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৩
-
অন্তরালে আগুন পর্ব (২৪+২৫)
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৭
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৬
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৪
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২৩
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১০