#অন্তরালে_আগুন
#পর্ব:১৬
#তানিশা সুলতানা
মানিকগঞ্জ পাটুরিয়া ফেরিঘাট। বিশাল পদ্মা নদী পার হওয়ার এই একটাই রাস্তা। এখান থেকেই ঢাকা যাওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকার বাস পাওয়া যায়। নদীর ওপারের মানুষ গুলো সাধারণত ফেরি দ্বারা নদী পার হয়ে এখান থেকে বাসে উঠে ঢাকায় যায়।
ফেরিঘাটে সারি সারি ভাবে লঞ্চ গুলো সাজানো রয়েছে। অন্যপাশে কিছু স্পিডবোর্ড আছে। যে যেভাবে নদী পার হতে চায় সে সেভাবেই পার হতে পারবে। লঞ্চে ভাড়া কম আর স্পিডবোর্ডের ভাড়া বেশি। কাউন্টারে দুজন লোক টিকিট কাটছে। সেখান থেকে টিকিট সংগ্রহ করে স্পিডবোর্ড কিংবা লঞ্চে উঠতে হবে। আনু ওড়না দ্বারা মুখ ঢেকে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। যদি আবার পরিচিত কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা যায়। সকাল সাতটা বেজে ৫ মিনিট। ইতিমধ্যেই ভিড় জমে উঠেছে ফেরিঘাটে। আটটার আগে স্পিডবোট বা লঞ্চ কিছুই ছাড়বে না। আবির প্রচন্ড বিরক্ত। সে দু খানা টিকিট কেটে পাশের এক দোকানে বসে সিগারেট খাচ্ছে। দুটো কলা একটা পাউরুটি এবং একটা জুসের বোতল আনুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছে। বলেছে “খেয়ে নিতে”
আনুর গলা দিয়ে কি আর খাবার নামবে? মাথা ভর্তি চিন্তা এবং মনে জমেছে অদ্ভুত চিন্তা।
আবির কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে? দ্বিতীয় বার বেইমানি করলে আনু কি করবে?
___
তালুকদার বাড়ির এই একটা নিয়ম। প্রতিবেলার খাবার সবাই একসাথে খায়। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশাল খাবার টেবিলে হরেক রকমের খাবার সাজানো এবং চেয়ার গুলো দখল করে বসে আছে বাড়ির এক একটা সদস্য। মজনু তালুকদার সবিতা তালুকদার নায়েব রাশেদুল নিরব নওয়ান।
নওয়ান জোর করে নুপুরকে বসিয়েছে খাবার টেবিলে। ব্যাপারখানা কারোরই ভালো লাগেনি তবে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। আমিনা এবং মীরা সকলের প্লেটে খাবার বেরে দিচ্ছে।
স্নেহা ও এসে পড়েছে। নুপুর এবং নওয়ানকে পাশাপাশি দেখে মুচকি হাসে সে। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারখানা টেনে তাতে বসতে বসতে বলে
“গুড মর্নিং নুপুর। শরীর ঠিকঠাক?
নুপুর মাথা নাড়িয়ে বোঝায় সব ঠিকঠাক। নওয়ান নুপুরের হাত খানা ছেড়ে নিজে হাতে নুপুরের প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে থাকে। ব্যাপারখানা ভালো লাগে না মজনু তালুকদারের।
সে কিছুটা মজার ছলেই বলে
“রক্ষিতার গোলাম হয়ে যাচ্ছো না দাদুভাই?
তুমি বোধহয় ভুলে গেছো রক্ষিততাদের স্থান পায়ের তলায়। একটু বেশিই আসকারা দিয়ে ফেলছো।
কথাখানা সবিতার মনের মত হয়েছে। সেটা তার মুখের হাসি দেখেই বোঝা যায়। বড়ই আয়েশ করে রুটির টুকরো মুখে পুরে বলে
” তোমার নাতি গোলাম হয়ে গিয়েছে। কবে জানি দেখবা এই মেয়ের পা টিপছে।
নুপুর হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে মাথা নিচু করে নেয়।
বিরক্ত নিরব কপাল কুঁচকে বলে
“ভাইয়া নুপুর কে বিয়ে করেছে। রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলবে দাদিমা।।
রাশেদুল বলে ওঠে
” ছোট ছোটোর মতো থাকবে। বড়দের মধ্যে কথা বলতে দেখলে থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিবো।
নিরব ছোট করে স্যরি বলে।
নায়েব তালুকদার বলে
“আব্বা এই মেয়ে আমাদের সাথে বসে খাবার খাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। ওক
নওয়ান দাঁড়িয়ে পড়ে। পূণরায় নুপুরের হাত ধরে বলে
” আম্মু আমাদের খাবার রুমে পাঠিয়ে দাও।
ব্যাসস বড় বড় পা ফেলে নুপুরকে নিয়ে চলে যায় নওয়ান। নায়েব চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে।।
স্নেহা মৃদু হেসে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
“চাচ্চু তোমার ছেলে ভালোবেসে ফেলেছে নুপুরকে। মেনে নাও তাদের।
মজনু তালুকদার বলে
” প্রশ্নই আসে না।
বোনু তুমি কেনো নিজের অধিকার ছেড়ে দিচ্ছো? আমরা আছি তোমার সাথে। ওই মেয়েকে তাড়িয়ে তোমার সাথে দাদুভাইয়ের বিয়ে দিবো।
হাসি পেলো স্নেহার। সে মুখে খাবার পুরে বলে
“আচ্ছা দিও।।
সবিতা বলে
” তোকে সব সময় নওয়ানের আশেপাশে ঘুরতে হবে।।নারীই তো পারে পুরুষকে বশ করতে। নিজের সৌন্দর্য কাজে লাগা।
বাবার ধমক খেয়ে চুপ থাকা নিরব আবারও ধমক খাওয়ার পরোয়া না করে বলে ওঠে
“ঠিক যেভাবে তুমি দাদাভাইকে বশ করেছিলে?
রাশেদুল চোখ পাকিয়ে তাকাতেই নিরব মাথা নিচু করে।
___
” ছাড়ুন আমায়। বেয়াদবের মতো টানাটানি করছেন কেনো?
থোরাই কেয়ার করলো নওয়ান। দরজা আটকে খাটের ওপর গিয়ে বসে এবং নুপুরকেও নিজের কোলের ওপর বসায়।
ছাড়া পাওয়ার তাগিদে ছটফট করতে থাকে। নওয়ানের হাতের আঘাত প্রাপ্ত স্থানে লেগে যায় নুপুরের হাতে। ব্যাথায় চোখ মুখ নীল হয়ে ওঠে মানুষটার। তবুও মুখ দিয়ে ব্যাথাতুল আওয়াজ বের করে না। বরং বিরক্ত স্বরে বলে
“সিডিউল করিস না বাল। এখন ইন্টিমেন্ট হওয়ার মুড নেই।
চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে নুপুর। ছটফট বন্ধ করে ফেলে। নওয়ান এক হাতে নুপুরের কোমর জড়িয়ে ধরে এবং অপর হাত দ্বারা টি টেবিলের উপরে থাকা ল্যাপটপ খানা খাটের উপর আনে। হাতের এক আঙুল দ্বারা ফটাফট কিবোর্ড এ টাইপ করে সাইয়ারা মুভি খানা প্লে করে দেয়।
” কি করতে চান আপনি নওয়ান?
এতো কেয়ার দেখানোর কি মানে?
“নওয়ান নিজের লাভ ছাড়া আর কিছুর কেয়ার করে না। বেড পার্টনার তুই আমার। বেস্ট পারফরম্যান্স করার জন্য সুস্থ থাকা ইমপটেন্ট।
নুপুর ঘৃণা ভরা নয়নে নওয়ানের পানে তাকিয়ে বলে
” সম্মান করতে শিখেন নি কখনো?
“সম্মান করি বলেই পারফরম্যান্স বললাম। নাহলে সে*** বলতাম।।
নুপুর কয়েকবার ” ছিহহহহ” শব্দ টা আওড়ায়।
তখনই বাড়ির কাজের লোক শারমিন খাবার নিয়ে চলে আসে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার নক করে।
“কাম ইন
বলে ভিতরে ঢোকার পারমিশন দেয় নওয়ান। মেয়েটা মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকে একবারের জন্য চোখ তুলে ওদের দিকে তাকায় না। নুপুর চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে বিড়বিড় করে কয়েকবার নির্লজ্জ বেয়াদব বলে গালি দিতেও ভোলে না।
শারমিন টি টেবিলের ওপর খবরের ট্রে নামিয়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় দরজা আটকে দিতে ভুলে না।
মেয়েটার বয়স ১৬ কি ১৭। দরিদ্র বাবার সন্তান। চার ভাই বোনের মধ্যে সেই বড়। বাবা রিকশা চালায়। একহাতে সংসারের ঘানি টানতে বেশ কষ্টই হয়ে যায়।তাইতো পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে তালুকদার বাড়িতে কাজ করতে চলে এসেছে।
শারমিন চলে যেতেই নুপুর বলে ওঠে
“সামান্য লজ্জা বোধটুকুও নেই আপনার?
কিভাবেন নিজেকে?
যা ইচ্ছে হবে তাই করবেন এতে অপর পাশের মানুষটার ভালো লাগল নাকি খারাপ লাগলো সেদিকে আপনার বিন্দুমাত্র
বাকিটা শেষ করার আগেই নুপুরের ওষ্ঠ জোড়া দখল করে নেয় নওয়ান। গোলাপি রঙে অধর জোড়া তার দুর্বলতা। যখনই অনবরত কথা বলতে থাকে, কথার ফাঁকে ফাঁকে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজায় এবং ঠোঁটের বা পাশে থাকা ডিম্পল খুব মনোযোগ সহকারে দেখে। এবং বরাবরই অধৈর্য হয়ে ওঠে। ওই গোলাপি অধর জোড়ায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করে সর্বদা।
নুপুর বড় বড় নয়নে তাকায়। লোকটা চুমু খাচ্ছে না শুধু ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিশিয়ে চুপচাপ বসে আছে। লোকটার গরম নিঃশ্বাস নুপুরের মুখে পড়ছে। সিগারেট এর কড়া গন্ধ নাকে লাগছে। ভেজা ওষ্ঠ জোড়ার ছোঁয়াও অদ্ভুত। বলা বাহুল্য নুপুরের ভালো লাগছে। মন বলছে “লোকটা গভীর ভাবে চুমু খাক”
নির্লজ্জ হয়ে গেলো কি সে?
নওয়ান সরে যায়।
নুপুর কে কোল থেকে নামিয়ে পাশে বসিয়ে খাবারের থালা হাতে নেয়। রুটি ছিড়ে তার মধ্যে ডিম ভরে নুপুরের মুখের সামনে ধরে এবং বলে
“খেয়ে নাও।।
নুপুর গাল ফুলিয়ে জবাব দেয়
” খাবো না।
নওয়ান খাবারের থালা হাত থেকে নামিয়ে বাম হাতে নুপুরের গাল চেপে ধরে শক্ত করে। দুই ঠোঁট ফাঁকা হাতেই মুখের মধ্যে রুটি ভরে দেয়। সেই মুহূর্তেই ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখাতে থাকে হিরো এবং হিরোইনের কিসিং সিন। সাইয়ারা মুভির সেই সমুদ্রের সাঁতার কাটতে কাটতে দুজনের ইন্টিমেন্ট হওয়ার কাহিনি।
নওয়ান বাঁকা হাসে। নুপুরের চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে তাকে নিজের দিকে নিয়ে আসে। এবং অধরে অধর চেপে তার মুখের খাবার নিজের মুখে নিয়ে নেয়।
মজা করে খাবার চিবতে চিবতে বলে
“বড্ড অধৈর্য আমি৷
আজকে সেন্সলেস হলে খু/ন করে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দিবো।
____
নায়েব তালুকদারের নির্দেশনায় একখানে স্পিডবোট ভাড়া করে নেয় আবির। ৩০০০ টাকা দিতে হবে স্পিডবোর্ড মালিককে।
সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। আনু কে নিয়ে বোর্ডে বসে পড়ে আবির।
স্পিডবোর্ড চালানো শুরু করার মুহূর্তে আনু আবিরকে জিজ্ঞেস করে
“আমরা এদিকে কোথায় যাচ্ছি?
ঢাকা বা অন্য কোন শহরে যেতে পারতাম।
আবির পদ্মা নদীর গভীর পানির দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়
“নতুন জীবন শুরু হতে যাচ্ছে তোমার। এই নদীর মতই গভীর হবে সেই জীবন। কুল খুঁজে পাবে না। শুধু সাঁতার কাটতে থাকবে বাঁচার তাগিদে।
আনু বুঝতে পারে না আবিরের কথা তবে একটুখানি আঁচ করতে পারে। হয়তো ভীষণ খারাপ কিছু হতে চলেছে তার সাথে।
আনুর কাছে একখানা বাটন ফোন রয়েছে। নিজেকে প্রটেক্ট করার জন্য ফোন খানা সঙ্গে আনতেই হলো তাকে। আবির যখন গভীর মনোযোগে নিজের ফোন দেখতে থাকে ঠিক তখনই আনু নিজের ফোন থেকে নুপুর কে ছোট্ট একটা টেক্সট পাঠায়।
তারপর ফোন খানা ফেলে দেয় নদীতে।
কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে স্নেহা। সাদা তার পছন্দের রং। ছোট থেকে সাদা জামাতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে সে। আর তার পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে মা সবসময় সাদা জামা কিনে দেয়।
আজকেও সাদা রঙের একটা গাউন পড়েছে। লম্বা চুলগুলো বেনুনি গাঁথছে তখনই সবিতা বেগম স্নেহার কক্ষে এসে।
তার পাশে দাঁড়িয়ে বলে
“কলেজে যাচ্ছিস?
স্নেহা দাদীর মুখপানে না তাকিয়ে জবাব দেয়
“হ্যাঁ
কিছু বলবে
” হ্যাঁ
নওয়ান আর
বাকিটা শেষ করার আগেই স্নেহা বলে
“তুমি আর চাচ্চু মিলে প্ল্যানিং করেছো আমার আর নওয়ানের বিয়ে দিবে। নুপুরকে বাড়ি থেকে তাড়াবে।
তাই তো?
” হ্যাঁ
স্নেহার বিনুনি গাঁথা শেষ। সে ব্যান্ড দিয়ে চুল আটকে সবিতার পানে তাকায়।
“আমি নওয়ান রিশাদ মুসতালিন নামক ওই মানুষটাকে অসম্ভব ভালোবাসি। তার জন্য মরতেও পারি।।
কিন্তু তাকে কখনো দুঃখী দেখতে পারবো না।।
ভালোবাসলে পেতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।।পাওয়ার থেকে না পাওয়ার মূল্যটা অধিক।।
এই যে আমি তাকে পেয়ে গেলে আমাদের একটা সংসার হতো। বাচ্চা হতো। পরিপূর্ণ হয়ে যেতাম। আফসোস করার কিছু থাকতো না।
রাতে ঘুমানোর আগে তার মুখটা দেখে শান্তিতে ঘুমাতাম। নির্ঘুম রাত কাটানোর দুঃখ বুঝতে পারতাম না।
আমি একটা জীবন দুঃখ আর আক্ষেপ নিয়েই কাটাতে চাই।
এভাবেই বাঁচবো।
না পাওয়া টাকেই নিজের প্রাপ্তি ভাবতে চাই।।
চলবে
Share On:
TAGS: অন্তরালে আগুন, তানিশা সুলতানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৭
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৫(৫.১+৫.২)
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২১
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৪
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৮
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৭
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৫
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২২
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৩
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২