#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৪০ ( প্রথম অর্ধেক)
রাতটা স্বামীর বুকে কেটে গেল অজান্তেই। প্রেম বাইক রেসার। প্রথম থেকেই আন্দাজ করেছিল তৃষা। তারপর অংকুর সব খুলে বলল। এই যে একটু আগে ঘুমিয়েছে লোকটা ক্লান্ত শরীর নিয়ে। ঘুমানোর আগে এই যাবৎ তার সকল বাইক রেস নিয়ে কথা বলল। শুনতে ভালোই লাগছিল। মজার বিষয় হচ্ছে এত বড় একটা বাইক রেসারের বুকে এই মূহূর্তে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। আহা আর কি চাই? তবে বাইক রেসের জন্য এতদূর তৃষার আসা। যদি সব মেনে নিয়ে সেদিন যুবরাজ সরকারের বউ হতো তাহলে আজকের প্রেম নেওয়াজকে কখনোই পাওয়া হতো না। তৃষা চোখটা বুজল পরম তৃপ্তি নিয়ে। এবার একটু ঘুমানো আবশ্যক।
সকালে ঘুম ভাঙল তৃষার খাবারের গন্ধে। প্রেম এসে তাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দেয়। কাজ শেষ করে তৃষার পাশে বসতেই মুচকি হেসে বলল, ‘ দু’টো সারপ্রাইজ আছে। কোনটা আগে শুনবে?’
‘দুটোই শুনব। তবে এক নম্বরটাই আগে বলুন।’
প্রেম ফোনটা বের করে কলে তৃষার সামনে ধরতেই ভিডিও কলের ওপাশে তৃষা তার বাবা মাকে দেখতে পেল৷ তৃষা মুহূর্তেই ইমোশনাল হয়ে গেল৷ কতদিন পর বাবা-মাকে দেখতে পাচ্ছে। প্রেমের মনে হলো এখন তৃষাকে একটু বাবা-মায়ের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে দেওয়া উচিত। নিজেদের ঝামেলা শেষ করুক। তারপর সে রুমে ফিরবে। সে তৃষাকে স্পেস দিয়ে দাঁড়ালো। নিচ থেকে আপেল কাটার জন্য ছুড়িটা এনেছিল। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছুড়িটাকে ছুঁয়ে দেখল। হাত ছুঁইয়ে দিতেই সামান্য একটু লেগে রক্ত বের হলে এলো। সে রক্তটার দিকে তাকালো। একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বিশ্বাসঘাতকদের মরে যাওয়াই ভালো। আজ হোক, কাল হোক তাদের দিন ফুরিয়ে। সময়ের চক্রের এবার মোড় পাল্টানো দরকার।’
তৃষা ফোন রেখে ডাকতেই প্রেম রুমের ভেতর এলো। তৃষা সঙ্গে সঙ্গে তাকে জড়িয়ে বলল, ‘আপনি এত কিছু করে ফেললেন আর আমি জানতেও পারলাম না।’
‘আমি সময় নিয়ে জানাতে পছন্দ করি। তো ঝামেলা মিটল? আমার বাবা শশুর বাড়িতে জামাই আদরের ব্যাস তাড়া ছিল তাই সাবমিটমাট করে দিলাম। এসব আর মেনে নেওয়া যাচ্ছিলো না৷’
‘তাই বলে এতোসব কি করে করলেন? বাবা-মায়ের মত কি করে পাল্টে দিলেন?’
‘তাহলে শুনো বলছি।’
তৃষাকে নিয়ে বিছানায় বসল প্রেম। তারপর বলল, ‘যেই রাতে আমি বাসা ছাড়ি সেই রাতে আমার এক্সিডেন্ট হয়। ফিরে আসতে চেয়েছিলাম তোমার কাছে তবে ব্যাড রেস্টে ছিলাম। তারপর মাথায় এলো তোমায় একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত। একেবারে হৃদয়ে যে আঘাত করলে একটু কষ্ট তো তুমিও ডিজার্ভ করো। ব্যাস পড়ে রইলাম হাসপাতালে। তোমার সঙ্গে কথা হয়নি এর মানে এই ছিল না তোমায় ভালোবাসতাম না। তোমার ওপর পুরো দমে নজর ছিল আমার। কোথায় কি করতে, কি খবর সব আমার কানে আসত। পুরো বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরা আমার ফোনের সঙ্গে সংযুক্ত৷ যাক প্রত্যুষের সঙ্গে কতবার বাইরে গিয়েছো, ঢং করেছো তার খবর পরে একদিন নিবো। এখন কথা হচ্ছে আমার পরিকল্পনায় যেই মানুষটা সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল সে ছিলেন সিদ্দিক নেওয়াজ। হু দাদা ভাই একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তাই না? তুমি সেদিন তার কাছে গিয়ে কুত্তার মতো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কান্না করেছো মনে আছে সোনা?
‘কুত্তার মতো?’
‘ইয়ে মানে। বাদ দাও না। পরে কি হয়েছে শুনো। আসলে ওইদিন দাদু অসুস্থ হননি৷ একটু নাটক করেছিলেন আর কি। তার সঙ্গে শুরু থেকে আমার যোগাযোগ ছিল। তুমি শুরুতে না জানলেও ওই মানুষটা জানতেন আমি তোমায় কতখানি ভালোবেসেছি, আজও বাসি । আমি অংকুরকে অনেক আগেই তোমার পরিবারের খবর জোগাড় করতে বলেছিলাম একবার। সে করেছেও। সে তোমার বাড়ির খবর জোগাড় করল। দাদা ভাইকে সব খুলে বললাম। সে বলল সে নিজে গিয়ে তোমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলবে। তাই হলো। মাঝে অংকুর আর দাদা সহ মোখলেস চাচা তোমার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। আমিও তাদের সঙ্গেই ছিলাম। তবে তোমার পরিবারের সাথে কথা বলার আগে আমি কথা বলেছিলাম যুবরাজ সরকারের সঙ্গে৷ মানে তোমার হয়েও না হওয়া স্বামী৷ মানুষটা ভালোই ছিলো। সব খুলে বলতে সে বললেন সাহায্য করবে। যদিও ক্ষোভ ছিলো তোমার প্রতি। সম্মানটা নষ্ট করে পালিয়েছো। তোমার মা-বাবা নাকি অনেকবার তোমাকে খুঁজে দেওয়ার জন্য সাহায্য চেয়েছিলো তার কাছে৷ সে মুখে সাহায্য করবে বললেও পরে আর করেনি। আমি কথা বলার পর একটু ভবল। তারপর সাহায্যটা করেই ফেলল। তোমার বাবা-মায়ের কাছে সে গেল। বলল, তোমায় পাওয়া গেছে। কিন্তু কাছে পেতে হলে একটা কাজ করতে হবে। তোমার বাবা-মায়ের তখন তোমায় দরকার ছিল, তোমায় পেলেই হলো। রাজি হলেন তারা সব শর্ত মানবে। তবে শর্ত এত কঠিন কিছু ছিল না। দাদা গেলেন, আমরাও গেলাম। কাজী বাড়ির মেয়ে নেওয়াজ বাড়ির বউ হোক এই টুকুই চাই। আমাদের পরিবার, তোমার এখানে আসা সবই খুলে বলা হলো তাদেরকে। সময় দিলাম ভাবার জন্য। শেষে দুই দিনের মাথায় তারা বিয়েতে রাজি হলো। পারিবারিক ভাবে তোমায় আমার বউ করার কথা ছিল। কিন্তু মাঝে দিয়ে তুমি বাল পাকনা কি করলে? প্রত্যুষের সঙ্গে বিয়ের পিড়িতে বসতে রাজি হয়ে গেলে? একটু ধৈর্য্য নেই শালীর ঘরের বউ? তোমার বাল পাকনামির জন্য আমার সাজানো পরিকল্পনা সব নষ্ট হলো। শেষে ভালোতো বাসতে তবুও তোমার মতো আটার বস্তাকে আমার কিডন্যাপ করতে হলো! নাটক সব। আর কবুল বলার সময় যখন এত বাহানা করছিলে বিশ্বাস করো মন চাইছিলো লাগিয়ে দিতে এক চড়। কতবড় নাটকবাজ তুমি ভাবা যায়?’
‘তাহলে সেদিন যে তৈমুরকে জিম্মি করলেন? ওইসব?’
‘শালা আমার কড়া মাল। তোমার ভাই তো, তাই তোমার থেকেও বড় ধান্দাবাজ। এই শুনো কি করে তোমায় বিয়ে করতাম তখনো বুঝতে পারছিলাম না। শেষে শশুড় আব্বাই কিন্তু তুলে এনে বিয়ের প্রোসেসটা বললেন। কঠোর শিক্ষা দিতে বলেছিলেন কিন্তু দিয়েছি কি? তো শুনো মিসেস, তুমি ভেবেছো তোমার টানে কিডন্যাপ করেছি। তবে শুনে রাখো প্রেম একটা নিশ্বাসও ফেলে পরিকল্পনা করে। মাইন্ড ইট। তোমায় এমনি এমনি পাইনি। বহুত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। যাকগে সেসব কথা এখন অতীত। ব্যাগ প্যাকিং করে নাও, আজকে কক্সবাজার যাব। সেখান থেকে সোজা যাব নেওয়াজ বাড়িতে। তোমার বাবা-মাও আসবেন। মা-বাবার ভালোবাসা সবার কপালে জুটেনা। ওটা পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। ভাগ্যকে এভাবে লাথি মারতে হয় না সুন্দরী।’ বলেই প্রেম তৃষার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘অনেক কথা হলো, অনেক ভাঙন হলো। এবার নতুনের গল্প নতুন ভাবে শুরু করা যাক। শুরুটা খারাপ হয়েছে তো কি? শেষটা সুন্দর হয়েছে কিনা তার ওপর গোটা জীবনটা নির্ভর করবে।’
তৃষা প্রেমকে জড়িয়ে ধরে। ‘বিশ্বাস করুন আমি পালাতে চাইনি। বাইক রাইডিং স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন পূরণ করতে এতদূর সব ছেড়ে চলে আসা।’
‘আমি আছি তো? স্বপ্ন তোমার তবে পূরণ করার দায়িত্বটা আমি নিলাম।’ তৃষা প্রেমের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। প্রেম তার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। হ্যাঁ এটাই বোধহয় জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত। আপনার জীবনে যতই কষ্ট থাকুক না কেন। আপনার জীবন সঙ্গী যদি আপনার জন্য কমফোর্টেবল হয়, আপনাকে বুঝে, আপনার সবকিছুতে আপনাকে সাপোর্ট করে তাহলে দুনিয়ার কোনো ভয়কে ভয় মনে হবে না, জীবন তখন সহজ ও সুন্দর হবে আপনার নিজের রচিত গল্পের মতোই।
চলমান…..
#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৪০ ( শেষ অর্ধেক)
সকাল থেকেই হেতিজা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। এত কেঁদেছেন যে শেষে শরীরটাই ভেঙে পড়েছে, বাধ্য হয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। প্রেমা তার পাশেই বসে আছে, চুপচাপ, কিন্তু মনের ভেতর অদ্ভুত একটা ভার জমে আছে আজ।
মেহরাব আবারও পাবনা চলে গেছে। প্রেমা ওকে সত্যিই ভালোবাসত না—কিন্তু এখন কেন জানি বুকের ভেতরটা হাহা করে উঠছে। দূরে চলে যাওয়া কি এত কষ্টের? শেষবার দেখা হয়েছিল ছাদে। অভিমান মেশানো গলায় মেহরাব বলেছিল, “তুমি আমার ভালোবাসা বুঝলে না, প্রেমা। যেদিন বুঝবে, তোমার প্রাণ তখন আমায় খুঁজবে। কিন্তু তখন আমি থাকব না, খোদার কসম।”
পাবনায় কাজ ফেলে এসেছিল সে। ফিরবে কি আর কোনোদিন? এখন কেন এত মায়া হচ্ছে? তখন কেন হলো না? প্রেমা তাকাল তার অসুস্থ মায়ের দিকে। আজ ভোরে প্রত্যুষ ভাই দেশ ছেড়ে গেছে। তার মিশনে যাওয়ার কথা ছিল আগেই, কিন্তু তৃষার জন্য সে যায়নি। ভেবেছিল সংসার করবে, পরে যাওয়া যাবে। কিন্তু যখন সবকিছু ভেঙে গেল, তখন এই দেশে থেকে আর লাভ কি! মিশনটা এক বছরের। এক বছর পর সে ফিরবে। মা ভোরবেলায় কাঁদছিলেন, বিলাপ করছিলেন, তবু কিছু করার ছিল না। এখানে থাকলে না সে ভালো থাকতে পারবে, না তার প্রিয়জন।
বাইকে করে কক্সবাজার আসতে সময় লাগে ৩ ঘন্টার মতো। তৃষা এইবার নিজের বাইকটা আর নিয়েও নিলো না। স্বামীর পেছনে বসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার মজাই আলাদা। শিমলা আর অংকুরও পাশে এসেছে। আজকে তৃষা শিমলাকে অনেকক্ষণ বুঝালো। অনেক হয়েছে এবার অংকুর আর শিমলার কিন্তু উচিত বাড়ির মানুষের সম্ভব কথা বলে ঝামেলা সব ঠিকঠাক করা। শিমলা সায় মেলালো। হয়তো কথাটা জলদি কানে নেবে। নিলেই ভালো। কক্সবাজারে এসে প্রথমে ঘুমিয়ে নিলো। ঘুরতে বের হবে সন্ধ্যায় উঠে। আগে খাওয়া দাওয়া করে একটা লম্বা ঘুম দিতে হবে। এমনিতেই বাইকে বসে এতটা পথ আসতে গিয়ে পাছা পুরো তক্তা হয়ে গেছে। প্রেম রুমে এসেই বিছানায় ধপাস করে বসে ফোনে গেইম খেলতে শুরু করে। তৃষার তা দেখে হেব্বি রাগ হয়। এ আবার কেমন মানুষ? কক্সবাজারে বউ নিয়ে এসে কেউ ফোনে গেইম খেলে? আহা ভাবলেই পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে। তৃষা পেটে হাত দিয়ে প্রেমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুখটা কুঁচকে বলে, ‘আহা রে পেটে অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হয় সর্বনাশ একটা ঘটে যাবে।’
প্রেম ফোনের থেকে চোখ তুলে তৃষার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি? এই গাঁজাখোর মহিলা তোর সঙ্গে হানিমুনে আসছি, এখনো হানিমুন করতেও পারিনি। কি সব বালের কথা কস?’
‘সত্যি বলছি। লক্ষণ ভালো না।’
‘ কিন্তু তারিখ! আচ্ছা প্রমাণ দেখি?’
‘হুম বাথরুমে চলুন। মনে হয় পেট পাতলা হয়ে গেছে। বাথরুম থেকে বের হতে সময় লাগবে। আপনি সঙ্গে গেলে ভেতরে বসে গল্পসল্প করে সময় কাটানো যাবে। ফোনে লুডু আছে? এক ম্যাচ খেললে কেমন হয়?’
“থু! বোমি পাচ্ছে।’
‘উহুম সুসংবাদ পাচ্ছি নাকি?’
‘যেহেতু বউ তোমার কিচ্ছু নেই তার মানে আমার থেকে উহুম নিউজ পাওয়ারও সুযোগ নেই। আর থাকলেও পেতে না।’
‘উফ কথা না বাড়িয়ে আসুন তো। কি জানি দেখবেন?’
‘যাহ খাচ্চোর শালির ঘরের বউ। ভাবলাম কি আর বললি কি? ইমোশনের ওপর হেগে দেওয়ার যে ব্যাপারটা!’
তৃষা হেসে ফ্রেশ হতে চলে যায়। এই লোকটাও না! ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখল প্রেমের শরীরে কাপড় নেই।
‘আপনি না টিশার্ট পরে ছিলেন?’
‘গরমটা বেড়েছো তো।’
‘গরমের সঙ্গে কি শরম বাড়ে না? ওইটাও একটু বাড়ানো দরকার।’
‘সরম বাড়লে দুই থেকে তিন হবো কি করে সোনা।’ প্রেম তৃষার কাছে এগিয়ে আসতেই তৃষা প্রেমের মুখে বালিশ ছুঁড়ে মারে। প্রেম সেই বালিশ ধরে ফেলে বলে, ‘বিটারহার্ট তোমার আজকাল পাখা গজিয়েছে তাই না? বটি দিয়ে ওই পাখা আজকে কাটব আমি।’ বলেই সে তৃষার দিকে এগিয়ে যায়।
–
প্রেম সমুদ্রতীরবর্তী বালুকাবেলায় বাইকের পাশে হেলান দিয়ে পোজ দিচ্ছে। অংকুর ক্যামেরা হাতে নিরন্তর তার ছবি তুলছে। শিমলা ও তৃষা প্রথমে তাদের সঙ্গেই ছিল, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তৃষার বিরক্তি জমে উঠল।
এরা যেন নিজেদের মধ্যেই নিমগ্ন। তৃষার চোখে সবকিছুই কেমন অর্থহীন মনে হলো। সে মনে মনে বলল, “এই লোকগুলোর সঙ্গে ঘুরতে এসে শান্তি নেই! কেউ একটুও বোঝে না।”
প্রেমের কথা মনে পড়তেই আবার খটকা লাগল। লোকটার কি ঢং। কোথায় বউকে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করবে, কিন্তু সে তো এখন মহাব্যস্ত নিজের মতো। কক্সবাজারে যাওয়ার আগে চিত্রাকে একবার কল করেছিল তৃষা। কারণ সেদিন মেয়েটা বলেছিল ইতালি থেকে আসবে বাংলাদেশে। কিশোরগঞ্জ এলাহী বাড়িতে যাবে। সেখান থেকে কক্সবাজার আসবে। ইশ সে এলে তো মজাই হতো। কিন্তু চিত্রাকে কল করার পর সে জানালো সে আসছে না। শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সমুদ্রের তীরে কিছুক্ষণ একা সময় কাটালো তৃষা। অংকুর শিমলাকে ডাক দিতেই সে চলে গেল। তৃষা কিছুক্ষণ একা সময় কাটাবে বলে ঠিক করল। চারপাশে একবার প্রেমকে খোঁজার চেষ্টা করল। সে নেই। এই তো একটু আগেও ছিলো। সুযোগ পেয়ে তৃষা আরো খানিকটা সময় সমুদ্রের ধারে কিছুক্ষণ একা থাকার সিদ্ধান্ত নিল । সবাই চলে গেলেও সে দাঁড়িয়ে রইল নিঃশব্দ ঢেউয়ের মুখোমুখি। নীল রঙের গাউনে তৃষা যেন সমুদ্রের রঙেই মিশে গেছে। হালকা বাতাসে তার চুল উড়ছে, সূর্যের আলোকরেখা গাউনের ভাঁজে ঝিলিক দিচ্ছে। পায়ের নিচে ভেজা বালির স্পর্শ, সামনে নীল অসীম জলরাশি। চারপাশে একবার প্রেমকে খোঁজার চেষ্টা করল সে। কোথাও দেখা গেল না। অথচ এই তো কিছুক্ষণ আগেও ছিল, হাসছিল, কথা বলছিল। এখন সে নেই। শুধু সমুদ্রের গর্জন আর তৃষার চোখের নিস্তব্ধতা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল একে অপরের। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলা ভেসে এলো।
“আপা গোলাপ নিবেন? এইডা আপনার জন্য।”
তৃষা বাচ্চা ছেলেটির দিকে তাকালো। তৃষা ফুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ” কে দিলো?”
“একটা ভাই দিছে।”
তৃষা ফুলটা নিয়ে আরো একবার চারপাশে তাকালো। নিশ্চিত প্রেম দিয়েছে। ‘সে কোথায় জানো?’
‘রুম নাম্বার ১০২ এ। ফুল দিয়া কইলো আপারে কইবা রুমে আইতে।’
‘১০২? কিন্তু আমাদের রুমের নাম্বার তো মেইবি ওইটা ছিল না।’ তৃষা হোটেলের দিকে পা বাড়াবে এমন সময় তার ফোনে একটা কল এলো। নাম্বারটা অচেনা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা গান ভেসে এলো।
~প্রেম আমার ওওওও প্রেম আমার~
তৃষা বার কয়েক “হ্যালো” বলল, কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়া আসেনি। শুধু নীরবতা, তারপর হঠাৎ লাইন কেটে গেল। ফোনের স্ক্রিনটা নিভে যেতেই যেন চারপাশের আলোও ম্লান হয়ে গেল। মুহূর্তেই তৃষার বুকের ভেতরটায় একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল।
হোটেলের করিডোরটা এখন প্রায় ফাঁকা। মেঝেতে পুরু কার্পেট, নরম আলোয় দেয়ালগুলোর দম বন্ধ হয়ে আছে। তৃষা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, তার পায়ের আওয়াজও গিলে নিচ্ছে এই নিস্তব্ধতা। রুম নাম্বার ১০২, দরজার সামনে এসে সে থেমে গেল। ঠিক তখনই, এক মুহূর্তে নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে উঠে এলো একটা মেয়েলি চিৎকার। চিৎকারটা একেবার তীক্ষ্ণ, কাঁটার মতো ছিল। মনে হচ্ছিলো দেয়ালের ভেতর কোথাও কেউ যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছে। তৃষা হঠাৎই স্থির হয়ে গেল। বুকের ভেতর ধকধক শব্দে শিরা-উপশিরা টানছে তার। চোখ তুলে চারপাশে তাকাল। করিডোরে আর কেউ নেই, শুধু একপাশে ফ্লিকার করা আলো, যেন চোখ টিপে টিপে কিছু বলতে চাইছে। রুমের দরজাটা ফাঁকাই ছিল।
ধীরে ধীরে বাতাসের টানে কাঁপছে। এখানেই তো আসতে বলা হয়েছিল, মনে মনে বলল তৃষা। কিন্তু অংকুর আর শিমলার রুম কোনটা ছিল? ওরা কোন রুমে এসে উঠেছে জানা হয়নি। এটাতেই নাকি? বোধহয়। নইলে এখানে কেন আসতে বলা হবে? আর তার চেয়ে বড় কথা তিন-তিনটে মানুষ তাকে রেখে একা চলে আসবে? এটাও কি সম্ভব? উফ মাথা কাজ করছে না। স্মৃতিগুলোয় জট বেঁধে যাচ্ছে। তৃষা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর হঠাৎ কৌতূহল আর অজানা টান তাকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এক ধাক্কায় সবকিছু থেমে গেল। তার হাতের ব্যাগটা কাঁধ থেকে গড়িয়ে পড়ল, হাত অসাড় হয়ে এলো।
রুমটা যেন সদ্য যুদ্ধক্ষেত্র। চাদর ছিঁড়ে ছিঁড়ে মেঝেতে পড়ে আছে, কাচ ভাঙা গ্লাসের টুকরো ছড়িয়ে আছে টেবিলের নিচে। দেওয়ালের ঘড়িটা ভেঙে বন্ধ হয়ে ফ্লোরে পরে আছে। তবে পেন্ডুলামের দোল থেমে গেছে মাঝপথে। কার্পেটের মতো মেঝেতে লাল রক্তের বন্যা।
তাজা, ঘন, আঠালো রক্ত সেই পিচ্ছিল রক্ত। তৃষার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। শরীর কাঁপছে, তবু চোখ সরাতে পারছে না। ঠিক তখনই
কোথা থেকে ভেসে এলো এক অদ্ভুত শব্দ। খসখসে একটা সূক্ষ্ম সুর। তারপর একটা গম্ভীর, দুলে ওঠা আওয়াজ। গ্রামোফোনে বাজছে গান।
“প্রেম আমার… ওওওও… প্রেম আমার…”
গানটা যেন অন্য জগতের। পুরনো, বিকৃত, তবু সুরে একটা অদ্ভুত মায়া লেগে আছে। সুরটা রক্তের গন্ধের সঙ্গে মিশে রুমের বাতাসকে আরো ভারী করে তুলছে।
রুমের ভেতর একটা মিষ্টি গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। হ্যাঁ গোলাপের গন্ধ ভাসছে, মিষ্টি তবুও কেমন যেন অস্বস্তিকর। রক্তের ধাতব গন্ধের সঙ্গে মিশে সেই গোলাপ যেন পচা পাপড়ির মতো গন্ধ ছড়াচ্ছে।
তৃষা ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। রুমের কোণে একটা পুরনো গ্রামোফোন। ঘূর্ণায়মান ডিস্কটা কাঁপছে, সুইটা লাফাচ্ছে, আর সুরটা কেঁদে উঠছে কারও দম বন্ধ করা আর্তনাদ হয়ে। তার চোখে পড়ল রুমের দেওয়ালে রক্তের দাগে আঁকা একটা চিহ্ন, হৃদয়ের মতো, তবু বিকৃত। আর সেই চিহ্নের নিচে গোলাপের একটা পাপড়ি আটকে আছে, সতেজ লাল রক্তে চুপচুপে সেই পাপড়ি। তৃষা এক পা পিছিয়ে গেল।
তার মনে হলো, কেউ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
কেউ যেন শ্বাস নিচ্ছে খুব ধীরে, তার গায়ের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা হয়ে। কিন্তু ঘুরে তাকাতেই কিছু নেই। তবু গ্রামোফোনটা বাজছেই,
“প্রেম আমার… ওওওও… প্রেম আমার…”
তৃষার পায়ের নিচে কাচ ভাঙার শব্দ হলো।
তার চোখ এখন রুমের কোণে। সেখানে আধখোলা পর্দার ফাঁক দিয়ে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে।
একটা হাত। স্তব্ধ, অনড় হয়ে মেঝেতে ছুঁয়ে আছে। তৃষা ঠোঁট কামড়ে এক ধাপ এগিয়ে গেল। তার হাঁটু কাঁপছে, কিন্তু চোখের দৃষ্টি আটকে গেছে। বিছানার চাদরটা টেনে পড়েছে মেঝেতে, তার নিচে ছড়িয়ে আছে গাঢ় দাগ।
তৃষা আরেক পা বাড়ালো। এবার আলো এসে পড়ল সেই দেহটার ওপর। এক মুহূর্তে তার নিঃশ্বাস থেমে গেল।
মাথার ভেতর একটা ঘূর্ণি, কান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তবু চোখ সরাতে পারছে না। খাটের পাশে শুয়ে আছে একটা মেয়ের দেহ। না, দেহ নয়, এক অচেনা বিকৃত দেহ।
তার চামড়া উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে জায়গায় জায়গায়। মাংস খসে গেছে ছুরি চালানোর মতো নিখুঁতভাবে।
শরীরের কোথাও কোনো চিহ্ন নেই যা একে মানুষ বলে চিনতে দেয়। চুল নেই, মাথার খুলিটা মসৃণ, কেটে ফেলা চুলের গন্ধ বাতাসে মিশে আছে। ঠোঁটের একপাশ ছেঁড়া, চোখ অর্ধেক খোলা। হয়তো শেষ মুহূর্তেও সে কারও দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিল। তৃষার হাত নিজের অজান্তে মুখে চলে গেল। গলায় শব্দ আটকে আছে। তার পেটের ভেতর হঠাৎ মোচড় খেল। বমি এসে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই বের হলো না। বাইরে কোথাও বজ্রপাত হলো, হালকা আলো এসে দেহটার ওপর পড়ল। রক্তে ভেজা ত্বক চকচক করছে। দেহটার পাশে পড়ে থাকা আয়নাটা নিজের অক্ষে কাঁপল।
তৃষা চমকে তাকাল। আয়নায় দেখা যাচ্ছে তার নিজের মুখ, কিন্তু তার পেছনে… কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে।
একটা ছায়া। কালো হুডি পড়া ব্যক্তি। তৃষার গলা শুকিয়ে গেল। বুকের ভেতর ঢেউ খেলল আতঙ্কের।
গ্রামোফোন তখনও বাজছে, “প্রেম আমার… ও প্রেম আমার…” গোলাপের গন্ধটা এখন আরও তীব্র, কিন্তু তা ফুলের নয়, রক্তে ডুবে থাকা গোলাপের। হুডি পড়া লোকটি এবার আলতো করে পেছন থেকে তৃষার থুতনি চেপে ধরল। হাতে তার ধারালো একটা ছুড়ি। তৃষা ততক্ষণে ট্রমায়। এত কিছু দেখে মাথা এমনিতেই ঠিক নেই। আশপাশের সব কিছু তার কাছে ভারী লাগছে। লোকটা হঠাৎ আয়নার দিকে তাকিয়ে তৃষার গলার কণ্ঠনালি বরাবর চাকু ধরে বলল, ‘তুমি প্রতারণা করেছো। প্রতারকদের আমি যে ছাড়ি না।’ গলার স্বরটা ভনভন করে, ভারী হয়ে কানে এলো। কে বলছে, কি বলছে বোধগম্য হলো না। তবে একেবারে খুব কাছের কেউ মনে হলো। হঠাৎ লোকটি হাসল। ছুঁড়িটা শক্ত করে ধরে বলল, ‘প্রেম আমার ওওওও প্রেম আমার….’
চলবে?
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষ্ণা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩৯ ( প্রথম অর্ধেক+শেষ অর্ধেক)
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৯+সারপ্রাইজ পর্ব
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩১+৩২
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২১+২২
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৯+২০
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৫+২৬
-
প্রেমতৃষা ৪২ (প্রথম অর্ধেক)
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৩+২৪
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৮+৯+১০
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩০(বিবাহ স্পেশাল পর্ব)