#প্রিয়_প্রণয়িনী২
#জান্নাত_নুসরাত
(১১) প্রথম অংশ
সকাল দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। দো-তলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল আরশ। ড্রপ সোল্ডার টি-শার্টের জায়গায় জায়গায় ভাঁজ পড়ে আছে। চুলগুলো উস্কোখুস্কো ভঙ্গিতে পড়ে আছে কপালের উপর। আরশ দু-হাত উপরের দিকে তুলে ঘাড় চেপে ধরে। দু-পাশে মাথা ঘোরাতেই মটমট করে শব্দ হয়। কাঁধ একপাশে কাত করে নিচে নামতে নামতে লিপি বেগমকে উদ্দেশ্য করে হাক ছুঁড়ে,”মাম্মা নাস্তা দাও?
হেলাল সাহেব ড্রয়িংরুমে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। আরশের গলার আওয়াজ শুনে গোল গোল চোখে সামামে তাকান, মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”কখন এসেছ?
আরশ ডায়নিং এর দিকে যেতে যেতে থেমে যায়। আবার পেছন ফিরে এসে বসে হেলাল সাহেবের সামনের কাউচে। আরাম করে বসে ধীরে সুস্থিরে সালাম দেয় হেলাল সাহেবকে। তারপর উত্তর করে প্রশ্নের,”জি, গতকাল রাতে।
হেলাল সাহেব মাথা নাড়ালেন। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন,”অনিকা কে নিয়ে আসোনি?
আরশ কপালে ভাঁজ ফেলল। মনে করার জন্য মাথায় চাপ প্রয়োগ করল। মনে মনে ভাবল, অনিকাটা আবার কে? কিন্তু অনিকা নামক কারোর সন্ধান নিজের মস্তিষ্কে খুঁজে পেল না। তাই ভ্রু কুঁচকে অবহেলা নিয়ে হেলাল সাহেবকে জিজ্ঞেস করল,”অনিকা কে?
হেলাল সাহেব আঁতকে উঠেন। এই ছেলে বলে কী, অনিকা কে চেনে না!
আরশ তখনো প্রশ্নাত্মক চাহনি নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে। হেলাল সাহেব গর্জে ওঠার মতো করে বলে উঠলেন,”অনিকা চেনো না মানে কী? সেদিন তো বলে দিলাম ওকে সাথে নিয়ে আসতে।
আরশ বিটকেল মার্কা একটা হাসি দেয়। ভ্রুক্ষেপহীন গলায় জানতে চায়,”বলেছিলেন? মনে পড়ছে না কেন?
হেলাল সাহেব ঠাট্টার স্বরে বলে উঠলেন,
“এসব মনে থাকবে কেন? মনে থাকবে তো ওই মেয়ের কথা!
আরশ হেলাল সাহেবকে শেষের কথা মিনমিন করে বলতে দেখে জিজ্ঞেস করে,”পাপা কী মিনমিন করছেন?
হেলাল সাহেব কিছু বললেন না। তারপর তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করেন,”এতদিন তাহলে কোথায় ছিলে?
আরশ নির্বিকার কন্ঠে উত্তর দেয়,
“ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
হেলাল সাহেবের কপালে তিনটা গাঢ় ভাঁজ পড়ে। তিনি শুধু পারছেন না, আরশকে ধরে দুটো লাগিয়ে দিতে। শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন,”সেটা আমি জানি, কিন্তু কোথায় থেকেছ এতদিন?
আরশ নিজের থুতনিতে হাত বোলায়, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরতেই গালের মাঝ বরাবর ছোট্ট একটা গর্তের সৃষ্টি হলো। পুরুষালি পুরু কন্ঠে উত্তর করে,”হোটেলে।
ছোট্ট করে উত্তর করল, যাতে হেলাল সাহেব আর কোনো প্রকার প্রশ্নের তীর তার দিকে ছুঁড়ে দিতে না পারেন। কিন্তু হেলাল সাহেব তো থেমে যাওয়ার লোক নয়, পরপর আবার জিজ্ঞেস করলেন,” তাহলে এতদিন কী করছিলে?
“ঘুরেছি,ফিরেছি,খেয়েছি, ঘুমিয়েছি।
ঝটপট উত্তর দিয়ে মুখ বন্ধ করে নিল।
হেলাল সাহেব বিরশ কন্ঠে বললেন,
” ওখানে গিয়ে ওদের সাথে কন্ট্যাক্ট করেছ?
“প্রয়োজন বোধ মনে করিনি।
হেলাল সাহেব ফুস করে শ্বাস ফেললেন। মুখ বারবার সংকুচিত প্রসারিত করলেন। আরশ তীক্ষ্ণ চোখে দেখল বাবার মুখ সংযত রাখার ক্ষীণ চেষ্টা। হাত তোলে ডায়নিং এর দিকে ইশারা করে অতিষ্ঠ হওয়া গলায় বললেন,”আমার সামনে থেকে যাও, এক্ষুণি তুমি। মাথা গরম করো না, তোমার মুখ দেখেই রাগ উঠছে।
আরশ অবিলম্বে উঠে দাঁড়াল। জিহ্বা দিয়ে গাল ঠেলে নিয়ে ব্যগ্রতার সাথে বলল,”তো আমি কী মরে যাচ্ছি, আপনার সামনে থাকার জন্য? আজব তো!
হেলাল সাহেব আরশের কথা শুনে ভেংচি কাটলেন। বাচ্চাদের মতো আরশকে ভেঙ্গিয়ে বললেন,”আমি জানতাম তোমরা দু-জন দেশে আসতেই নিজেদের রঙ পাল্টে ফেলবে, আর তাই হলো। একজন তো এসেই দেখানো শুরু করেছে, আর এখন তুমি দেখাচ্ছ।
আরশ হেলাল সাহেবের কোনো কথা না শোনার ভঙ্গিতে করে, চলে গেল ডায়নিং এর দিকে। ক্লিন সেভ করা ধারালো থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে কিছু একটা ভেবে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। যার ক্ষীণ রেখা হিসেবে ঠোঁটের একটু উপরে সুতো পরিমাণ গর্তের সৃষ্টি হলো।
___________________________________________
ঝর্ণা বেগম নিজের রুমের জিনিস-পত্র গুছিয়ে রাখছিলেন। বাহিরে থেকে ঠুকঠুক করে শব্দ আসতেই হাত থেমে গেল উনার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে নিলেন সুন্দরভাবে। মাথা নিচু করে গিয়ে দরজার নব ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল। একটু ফাঁক করতেই ঝর্ণা বেগমের অক্ষিকোটরে ভাসল সুফি খাতুনের মুখ, আর তা দেখেই মাথায় চলে আসলো হাজারো চিন্তার বাহার। সুফি খাতুন সচরাচর আসেন না এদিকে, সারাদিন পড়ে থাকেন নাছির মঞ্জিলে। আজ হঠাৎ উনার উদ্ভব নিজের রুমের সামনে দেখে উদ্ভট লাগল তার কাছে। তাই জিজ্ঞেস করলেন ঝর্ণা বেগম,”হঠাৎ এখানে ফুপি, কোনো প্রয়োজন আপনার?
ঝর্ণা বেগম কথা শেষ করার আগেই ঠেলে ভিতরে ঢোকে গেলেন সুফি খাতুন। ঝর্ণা বেগম কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেন নিজ জায়গায়। এটা কোন ধরনের ব্যবহার। তারপর আবার নিজেকে শুধরে নিয়ে বললেন, এই ব্যবহারই সুফি খাতুনের কাছ থেকে আশা করা যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে গিয়ে বসলেন বিছানায় সুফি খাতুনের পাশে। মৃদু কন্ঠে আবারো জিজ্ঞেস করলেন,”কোনো সমস্যা ফুপি?
সুফি খাতুন হা-হুতাশ করে বললেন,
“সমস্যা বলে সমস্যা, বিরাট সমস্যা।
ঝর্ণা বেগম অজানা কোনো খারাপ জিনিসের পূর্বাবাস পেলেন। তাই এক নিমেষে মুখ কাঁদো কাঁদো করে ফেললেন। ধড়ফড় করা বুক নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,” কী হয়েছে ফুপি? ইরহাম কোনো খারাপ কাজ করছে?
সুফি খাতুন মায়া নিয়ে তাকালেন ঝর্ণা বেগমের দিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, অত্যন্ত দুঃখি কন্ঠে বললেন,
“খারাপ বলে খারাপ, একবারে জঘন্য খারাপ কাজ করেছে।
ঝর্ণা বেগমের শ্বাস আটকে আসলো গলার কাছে। শুধু বাকি ডুকরে কেঁদে ওঠার। সুফি খাতুন তখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ঝর্ণার। মায়াময় চোখে তাকিয়ে ভাবছেন, আহারে বেচারি! কী নির্মল হৃদয়! আর ছেলেটা কী করল একটা বেয়াদব মেয়েকে নিজের জন্য পছন্দ করল।
ঝর্ণা বেগম তখনো নির্বাক। কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। চোখ থেকে পানি মুছে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”মেয়ে সংঘটিত বিষয়?
সুফি খাতুন উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। ঝর্ণা বেগম বিষাদ নিজের ভিতর চেপে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“মেয়েটা কে? আমি কি জানি?
সুফি খাতুনের মুখ বিরশ হয়ে গেল। উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে জানালেন ঝর্ণা বেগম মেয়েটাকে চেনেন। ঝর্ণা বেগম সচকিত চোখে তাকিয়ে থাকলেন। নিজ মনে ভাবতে লাগলেন কে! সুফি খাতুন তখনই উজ্জ্বল বদনে আঁধার নামিয়ে উত্তর দিলেন,”নুসরাত!
ঝর্ণা বেগমের চোখ-মুখ কুঁচকে গেল। কপালের মধ্যে পড়ল অস্বাভাবিক রকমের ভাঁজ। এতক্ষণের করা হা-হুতাশ, কান্না থেমে গিয়ে মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো,”নুসরাত!
__________________________________________
রাস্তার মধ্যে চিৎপটাং হয়ে বসে আছে নুসরাত। ইরহাম কী একটা কাজে গিয়েছে। কিৎকাল কাটার পর আশেপাশে কারোর সাক্ষাৎ না পেয়ে উঠে দাঁড়াল শ্যাম বর্ণের মেয়েটা। ভাবনায় চলছে বাড়িতে ঢোকেই কীভাবে ইসরাতকে বিরুক্ত করা যায়? তাই অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল। এক-হাতে পায়ের স্লিপার জোড়া। হঠাৎ পায়ের নিচে তুলতুলে কিছুর অস্তিত্ব পেতেই ছিটকে সরে গেল নুসরাত। চোখ-মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। ভয় পাওয়ার কারণ মনে করেছিল, সাপে পা দিয়ে দিয়েছে, যখন দেখল না সাপ নয়, একটা বিড়াল তখন তার ইচ্ছে করল বিড়ালের বাচ্চাকে ধরে একটা মাথায় তুলে আছাড় মেরে দিতে। রাগী চোখে বিড়ালের ছোট্ট বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে নুসরাত তেড়ে গেল, হাতে তুলে নিল তাবা মেরে। হঠাৎ মনে হলো এই মাছুম বাচ্চাটাকে আছাড় মেরে লাভ কী তার? উঁহু আছাড়-টাছাড় মারা যাবে না, এটাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আম্মাকে জ্বালানো যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ তার, বিড়ালটকে হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরল। বিড়ালটা মিউ মিউ করে ডাকছে সেদিকে নুসরাত পাত্তা দিল না। বিড়ালের সাথে কথা বলল,”আরে শালা, মিউ মিউ করো কেন? তোমাকে আমি বাড়িতে নিয়ে বিস্কুট খাওয়াব, চুংগাম খাওয়াব, চকলেট খাওয়াব, কেট ফুড খাওয়াব, আমার আম্মার পুরো ফ্রিজ তুলে তোমাকে খাওয়াব, তবু্ও মিউ মিউ করে আমার মাথা নষ্ট করোনা তো! চুপ করে থাকো! বেশি কথা বলা আমি একদম পছন্দ করিনা।
বিড়ালটা নুসরাতের দিকে তাকিয়ে থেকে মিউ মিউ করতে লাগল। শরীর পর্যন্ত বেচারা নাড়াতে পারছে না, নুসরাতের এমন চেপে ধরায়। তাই করুন চোখে তাকিয়ে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে।
বিড়ালটা একটু সুযোগ পেলে লাফ ঝাপ মারার চেষ্টা করছে, তাই নুসরাত অতিষ্ঠ হয়ে আঙুল তুলে বিড়ালের বাচ্চাটাকে শাসাচ্ছে,”একদম বেয়াদবি করবা না। আমি যদি আরেকবার দেখি বিলাইয়ের বাচ্চা তুমি নাচুনি-কুদনি করছ তাহলে এইখান থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিব। মনে রেখো আমি যা বলি তাই করি।
বিড়াল মিউ মিউ করে উঠল। নুসরাত ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ থাকতে দেখাল। বেচারা বিড়াল বুঝল না, নুসরাত তাকে চুপ থাকতে বলছে, তাই মৃদু শব্দে মেয়াউ মেয়াউ করে উঠল বারংবার।
অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটায় নিজের পাশের ব্যক্তিকে নুসরাত তখনো খেয়াল করেনি। আবির গত দু-মিনিট যাবত নুসরাতের সাথে সাথে হাঁটছে। রাস্তার দিকে তাকাতেই নিজের ছায়ার সাথে আরেকটা ছায়া দেখতেই তড়াক করে নিজের পাশে তাকাল। আর তখনই চোখাচোখি হলো আবিরের সাথে। আবির নুসরাতকে ব্যঙ্গাত্মক গলায় জিজ্ঞেস করল,”কী, এখানে কাজ করো?
নুসরাত নিজের মুখ ওড়না দিয়ে ঘষে মুছে নিল। আবিরের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকল। এই মুহুর্তে এই বেটা আবিরকে মোটেও পেটানোর ইচ্ছে নেই। তাই নিজের মুখ বন্ধ রাখা ভালো মনে করল। কথা বললেই খচ্ছরটা হেসে মাথা গরম করে ফেলবে। নুসরাতের অতর্কিত ভাবনা ভেদ করে আবিরের গা জ্বালানো কথা কানে আসলো তার,”কতটাকা বেতন দেয়?
নুসরাত কথার উত্তর দিল না। পা চালিয়ে চলে যেতে নিবে আবির শুধালো,”আমাকে পাত্তা দিচ্ছো না, তুমি জানো আমি কে? তুমি চাইলে তোমার কাজের ব্যবস্থা ভালো একটা বাড়িতে করে দিতে পারি?
নুসরাত মুখ ঝামটা মারল আবিরকে। দুই চোখ উল্টে নিয়ে উত্তর দিল,”আমি জানতে ও চাই না তুই কে! আর তুই কী আমার কাজের ব্যবস্থা করে দিবি! নিজেই তো মানুষের পেছন পেছন ঘুরে চাকরি বাঁচিয়ে রেখেছিস।
নুসরাত তাচ্ছিল্যে ভরা কন্ঠে কথা শেষ করল। যা খুব শক্তভাবে আবিরের গায়ে লাগল।
আবির আঙুল তুলল নুসরাতের মুখের সামনে। নুসরাত আঙুলটা আলগোছে নিজের হাত দ্বারা নিজের মুখের সামনে থেকে নামিয়ে দিয়ে, ধমকি দিয়ে বলে ওঠল,”স্পর্ধা করবি না আমার সামনে আঙুল তোলার। মনে নেই কী বলেছিলাম? হয়তো মনে নেই, তাহলে তোকে আবার মনে করিয়ে দেই। বলেছিলাম, আমার সামনে আঙুল তুললে সেটা ভেঙে আমি লকেট বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দিব। শেষ বারের মতো বলছি, এবার করেছিস করেছিস, আরেকবার যদি আমার মুখের সামনে আঙুল তোলার চেষ্টা করিস, তাহলে তুই নিজে আস্তো থাকবি কী-না তার গ্যারান্টি আমি দিতে পারছি না। চাল ফোট…!
নুসরাত আবিরকে চলে যাওয়ার কথা বলে নিজেই পাশ কাটিয়ে চলে যায়।যেতে যেতে আওড়ায়,”মেজাজ খারাপ করার জন্য আমার ঘাড়ে এসে পরে সবগুলো।
______________________________________
ঝর্ণা বেগম থম মেরে বসে আছেন। কোনো প্রকার শব্দ ব্যয় করছেন না। সুফি খাতুন দ্বিধাদ্বন্ধে ভোগলেন। মনে করলেন বেয়াদব মেয়েটার নাম শুনে হয়তো বেচারি এত বড় শোক নিতে পারেনি তাই মনে হয়, বড় আঘাত পেয়ে হার্ট অ্যাটাক করেছে। হাত তোলে ঝর্ণা বেগমের নাকের সামনে নিলেন সুফি খাতুন, বুঝতে চাইলেন শ্বাস প্রশ্বাস চলছে কী-না তখনি বাকশূন্য কন্ঠে ঝর্ণা বেগম বললেন,”বেঁচে আছি ফুপি।
সুফি খাতুন স্বস্থির শ্বাস ফেললেন। ঝর্ণা বেগমের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কথা তুলতেই ঝর্ণা বেগম থামিয়ে দিলেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলেন,”আপনি বলছেন নুসরাতের সাথে ইরহামের কোনো সম্পর্ক আছে, রাইট?
সুফি খাতুন মাথা দোলালেন। ততক্ষণে ঝর্ণা বেগমের বুক থেকে মোটা একটা পাথর সরে গিয়েছে। তীব্র বিরক্তি নিয়ে একটা শ্বাস ফেললেন। বিরশ কন্ঠে বললেন,”নুসরাতের সাথে ইরহামের সম্পর্ক সম্ভব না।
ঝর্ণা বেগমের কথায় মুখ বাঁকান সুফি খাতুন। তৎপর গলায় তাচ্ছিল্য করে জানতে চাইলেন,”কেন সম্ভব না? ওরা দু-জন একজন আরেকজনকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরেছিল পার্কে আমার এই দুই গুণাগার চোখের সামনে আমি দেখেছি। তারপর নুসরাতের সাথে ঢলাঢলি তো করতেই আছে তো করতেই আছে। নাজমিনকে পর্যন্ত বাদ রাখেনি, ওর সাথে কী রকম মাখন লাগিয়ে কথা বলে। বাবারে বাবা..! ওদের বাড়িতে গিয়ে কিচেনে বাসন-কোসন পর্যন্ত পরিস্কার করে রাখে। এই বাড়িতে জীবনে এসব করেছিল? কিচেনের আশেপাশে পর্যন্ত যেতে দেখিনা তোমার ওই অলস ছেলেকে। শুধু গান্ডে-পিন্ডে গিলে, আর নাক ডাকিয়ে ঘুমায়।
ঝর্ণা বেগম নিজের নিচের দিকে রাখা মুখ উপরে তুললেন। নিজের বিরক্তি চেপে গিয়ে, কন্ঠে শক্ততা এনে আওড়ালেন,”ফুপি বলছি না সম্ভব না। তারপর ও আপনি কীসের সাথে কীসের জোড় মিলাচ্ছেন। আমার কথা তো আগে শুনে নিবেন।
সুফি খাতুন কথা কেটে দিয়ে বললেন,
“আরে ঝর্ণা তুমি বুঝতে পারছ না, ওরা মা-মেয়ে সবগুলো মিলে তোমার ছেলেকে আত্মসাদ করার…
ঝর্ণা বেগম ক্ষুব্ধ চোখে তাকালেন। হাত দিয়ে বিছানার চাদর চেপে ধরে বলে উঠলেন,”ইরহাম নুসরাতের দুধ ভাই।
ঝর্ণা বেগমের কথা শেষ হতেই সুফি খাতুনের কথা গলায় আটকে গেল। চোখের পলক ফেলে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,” কী বললে আবার বলো?
ঝর্ণা বেগম ভারী স্বরে আবার রিপিট করে বললেন, “নুসরাতের দুধ-ভাই ইরহাম।
ফুস করে উড়ে গেল সুফি খাতুনের হম্বিতম্বি। হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে হা করে চেয়ে রইলেন ঝর্ণার দিকে। মুখে স্পষ্ট অপ্রস্তুতভাবে ফুটে উঠেছে। মিনমিন করে সুফি খাতুন বলেন,”আগে বলবে তো।
ঝর্ণা বেগম কটমট কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,
“আপনি বলার সুযোগ দিয়েছিলেন?
_________________________________________
সৈয়দ বাড়ির মধ্যে ইসরাত আর ইরহামের গানের গলা সবথেকে ভালো। নুসরাত আর মমো এই বিষয়ে ডাব্বা। মমো তবুও পড়ায় ভালো,কিন্তু নুসরাত সে কোনো কিছুতেই ভালো না। নুসরাতের মতামতে এটাই নাকি তার বিশেষত্ব। তারপর ও নুসরাত মনে করে সবদিক দিয়ে সে পারফেক্ট।
নাছির মঞ্জিলের ছাদের মাঝখানে সুইমিং পুল। সুইমিং পুলের একপাশে কিছু ফুলের গাছ, আর একপাশে বসার জায়গা। পুলে পা ডুবিয়ে বসে আছে, সৈয়দ বাড়ির দুষ্টু তিন সদস্য। নিজাম শিকদারের মতে সৈয়দ বাড়ির তিন নমুনা,নুসরাত, ইরহাম, আহান। ইসরাত পা ভেজায়নি, সে মাদুরে পা গুটিয়েই বসে।
ইরহাম নিজের পা তুলে ফেলল পানি থেকে। মাদুরে আসন পেতে বসতে বসতে গিটারে আঙুল চালাল। ঠোঁটে লেগে আছে মৃদু হাসি। অনান্য মেয়েদের ব্যাপারে যতই ভন্ড হোক ইরহাম, গানের গলা বরাবরই ভালো তার। গিটারে আঙুল চালাতেই সুর ভেসে উঠল। তার সাথে ইরহামের পুরুষালি গলার আওয়াজ,
মেঘের খামে আজ তোমার নামে
উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম,
পড়ে নিও তুমি মিলিয়ে নিও
খুব যতনে তা লিখে ছিলাম।।
নুসরাত আহান ও পা তুলে মাদুরে বসল। দু-জন গানের তালে তালে নিজেদের মাথা দোলাচ্ছে। আহান শরীর ছেড়ে দিয়ে নুসরাতের কাঁধে মাথা রাখল। ইসরাত মৃদু স্বরে ইরহামের সাথে গানের লাইন গুলো আওড়াচ্ছিল। ইরহাম গিটারে হাত চালাতে চালাতে বলল,”আপি,,
ইসরাত ইরহামের পানে চোখ ফিরাতেই ইরহাম তার সাথে গলা মিলাতে বলল,
বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয়না হৃদয়,
কতটা তোমায় ভালবাসি।
ইসরাত ইরহামের তালে গলা মিলাচ্ছে। ঠোঁটে দু-জনের হাসি। ইরহাম আবারো বলে উঠল,”সত্যি বলনা কেউ কী প্রেমহীনা কখনো বাঁচে।
নুসরাত আর আহান দু-জন দু-জনের দিকে নিষ্পাপ ভঙ্গিতে চেয়ে ফিসফিস করে আওড়াল,”আমরা দু-জন তো প্রেমহীনাই বেঁচে আছি।
কথা শেষ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। আবারো মনোযোগী হলো ইরহাম আর ইসরাতের গানের দিকে। ইরহাম গিটারের সুর আরো একটু জোরে তোলে নিল। তারপর সবাই একসাথে গেয়ে ওঠল,
“বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয়না হৃদয়,
কতটা তোমায় ভালবাসি।
পিছন থেকে মমোর গলা ভেসে আসলো। গান গেয়ে গেয়ে সবাই পিছু ফিরতেই দেখল ব্যাগ হাতে মমো দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলার আগেই দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরল ইসরাতকে। তখনো ইরহাম গান গাইছে। মমো গানের সাথে তাল মিলাচ্ছে। ইসরাত অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মমোর পিঠে হাত বুলিয়ে এলোমেলো কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”এই হঠাৎ তুই এলি কীভাবে? জানাসনি কেন আসছিস?
মমো অভিমানী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আমি এসেছি বলে তোমার খারাপ লাগছে?
ইসরাত অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
“আরে খারাপ লাগবে কেন! আমাদের তো আরো বেশি ভালো লাগছে তুই এখানে এসেছিস বলে।
মমো ইসরাতের গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী ভঙ্গিতে কেঁদে উঠল। আহান আর নুসরাত নাক উপরে তুলে মমোকে ভেঙ্গিয়ে একসাথে বলল,” এ্যা এ্যা এ্যা…! কোথা থেকে আসছে ন্যাকাচন্দ্র দাস?
ইসরাতকে শক্ত চোখে তাকাতে দেখে নুসরাত আরো কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। মুখ বাঁকিয়ে বসে রইল নিজের জায়গায়।
____________________________________________
আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা চাঁদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশ। চোখ-মুখ গম্ভীর। রেলিঙে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে সে। তার পাশে সমান উচ্চতার আরেকজন পুরুষ অবয়ব দাঁড়িয়ে। রঙ আরশের থেকে আরো বেশি উজ্জ্বল। ঠোঁটে লেগে আছে সব সময়ের মতো হাসি। ঠোঁটে হাসির অস্তিত্ব রেখেই জিজ্ঞেস করল,”কী ভাবছিস?
আরশ রেলিঙ শক্ত করে হাতের তালুতে চেপে ধরে বলে ওঠে,”ভাবছি একটা মানুষ কতটুক নির্লজ্জ হলে একদিন আগে যার শহর থেকে ফিরে এসেছি, সেই মানুষটা আবার আমার বাড়িতে চলে আসে।
মাহাদি ঠোঁট বাঁকায় আরশের কথায়। বেতের সোফায় আরাম করে বসে বলে ওঠে,”তা আমি ও ভাবছি! এখন বল সত্যি সত্যি কী ভাবছিস?
আরশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কথার উত্তর দেয় না। চোখ তার পাশের ডু-প্লেক্স বাড়িটার দিকে। আলো অনেক আগে নিভানো হয়েছে। বাড়িটির আলো অনেক আগে নিভানো হলো উপরের তলা থেকে এখনো ঠুকঠুক শব্দ আসছে। যা এত জোরে হচ্ছে যে, এখানে দাঁড়ানো আরশের কানে স্পষ্ট লাগছে। সন্দেহের নজরে সেদিকে তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে ফোন বের করল সে। মোবাইলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতেই খুলে যায় লক।অতঃপর কল লিস্টে ঢুকে মনোযোগ দিয়ে অনেক খোঁজাখোঁজির পর একটা নাম্বার খুঁজে পায় সবার শেষে। একদম তলানিতে নাম্বারটা পড়ে আছে। চোখের সামনে ঝাপসা দেখতেই, চশমা হাত দ্বারা পরিস্কার করার চেষ্টা করে। হাতের সংস্পর্শে চশমার গ্লাস পরিস্কার হওয়ার বদলে আরো বেশি গোলাটে বর্ণ ধারণ করে। আরশ চোখ থেকে বিরক্ত ভঙ্গিতে চশমা খুলে টেবিলে রাখে। কল লাগায় বের করে নিয়ে আসা নাম্বারটিতে। প্রথমবার রিং হতে হতে কেটে যায়, দ্বিতীয়বার ও তাই, তৃতীয় বার গিয়ে কল পিক হয়।
আরশ ধমক দিতে গিয়ে থমকে যায় কিছু সেকেন্ডের জন্য। ফোনের ওপাশ থেকে ঘুম ঘুম মেয়ে কন্ঠে জিজ্ঞেস করছে,”হ্যালো! কে?
আরশ এক মুহুর্তের জন্য মেয়েটার ভয়েজ শুনে থামে, নিজের পৃথিবী নিজের কাছে ঘোলাটে লাগে, তারপর চোখ ঝাপটে, নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”বেয়াদব, হ্যালো কী! সালাম দে আগে! ফোন ধরে আগে সালাম দিতে হয় জানিস না তুই?
নুসরাত বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলে। এক চোখ খুলে নাম্বার দেখে। না নাম্বার চেনে না। তাই ফোন কাটার পয়তারা করে বলে ওঠে,”ওমা, আপনি কে? আপনাকে আমি সালাম করতে যাব কোন দুঃখে? আর আরো একটা কথা, অসভ্যের মতো রাত-বিরেতে ফোন দিয়ে তুই-তোকারি করছেন কেন?
আরশ ক্ষেপে গিয়ে, চোখ ছোট ছোট করে নিল। এক হাত দিয়ে নিজের কপালের উপরে পড়ে থাকা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,”তুই জানিস না, আমি কে? আমার বিষয়ে কেউ বলেনি তোকে?
আরশের কন্ঠে স্পষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ পায়। নুসরাতের সোজা-সাপ্টা উত্তর,”আমাকে কেউ বলেনি আপনি কে! এখন আপনি নিজেই দয়া করে জানান, কোন দেশের রাষ্ট্রপতি আপনি, যাকে আমার সালাম দিতে হবে।
আরশ ফুসফুস করে শ্বাস ফেলল। রাগী গলায় বলল,
” বেয়াদব মেয়ে! আমি তোর জামাই বলছি।
“বেয়াদব তো আপনি রাতের বেলা মানুষকে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করছেন, আর সাথে বলছেন আমার জামাই। একটা কথা কান খুলে রাখুন মিস্টার, আমি বিবাহিত না, পিউর সিঙ্গেল। আমার কোনো জামাই টামাই নাই। যেইগুলা ছিল, সবগুলা ছোটবেলা মইরা গেছে..!
নুসরাত কথাটা শেষ করেই আরশের মুখের উপর ফোন কেটে দিল। আরশ দ্বিতীয়বার ফোন দিতেই এক মহিলা কন্ঠ বলে ওঠে, এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না, দ্যা নাম্বার ইজ বিজি নাও। আরশের রাগে কড়মড় করতে করতে আওড়ায়,”হাউ ফাকিং ডেয়ার সি কাট মাই কল?
আরশের এরুপ হিসহিসিয়ে চিৎকার করা দেখে মাহাদি হাসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে ঠাট্টা করে আরশকে বলল,” ওর প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই, ও শুধু আমার দায়িত্ব।
মাহাদি সূক্ষ্ম খোঁচাটা আরশকে ছুঁড়ে দিয়ে নিষ্পাপ মুখ বানিয়ে বসে রইল। আরশকে তার দিকে হিংস্রত্মক বাঘের মতো চেয়ে থাকতে দেখে পকেট থেকে ফোন বের করে নিল। ভাব করল সে কিছুই বলেনি। ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি ঝুলিয়ে মোবাইল স্ক্রল করতে লাগল। আর বারবার আরশকে জ্বালানোর জন্য একটাই কথা ফিসফিস করে আরশের শোনার মতো করে আওড়াল,”ও আমার দায়িত্ব..! এর বেশি কিছু না। ও আমার দায়িত্ব..! হা হা হা
হাসির তোড়ে মাহাদির সারা শরীর দোলে উঠল। আরশ গর্জে ওঠে, তেড়ে এসে মাহাদির কলার চেপে ধরে বলল,”চুপ একদম চুপ।
মাহাদি নিজের হাসি থামাতে ব্যর্থ হলো। সারা গা দুলিয়ে হাসতে হাসতে আবারো আরশের কথাটার কপি করে বলল,”ও আমার দায়িত্ব, এর বেশি কিছু না। হা হা..!
চলবে…
Share On:
TAGS: জান্নাত নুসরাত, প্রিয় প্রণয়িনী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ১
-
প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ১০
-
প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ৪
-
প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ৯
-
প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ৩
-
প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ২০
-
প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ৫
-
প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ১৪
-
প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ১৫
-
প্রিয় প্রণয়িনী সিজন ২ পর্ব ১৩