#ডেনিম_জ্যাকেট —- পর্ব ৩২ (বিয়ে পর্ব – ||)
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
কুহু শ্বাস আটকে বসে থাকল, সেই ‘বাড়ির ছেলের’ নামটা শোনার জন্যে। ঠিক তখুনি শামিমা আসল বোমাটা ছুড়লেন, কুহুর কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে হাসিহাসি মুখে বললেন———‘ছোটবেলা থেকে বলে এসেছি— আমার কাব্যের জন্যে একটা পুতুল আনব বউ করে। অথচ ঘরের সামনে একটা জলজ্যান্ত পুতুল থাকতেও আমি কিনা বাইরে খোঁজ নিচ্ছিলাম? কি রে কুহু? বানাবি আমাকে শাশুড়ি? হবি আমার কাব্যের বউ?’
কুহু আহাম্মক, চূড়ান্ত হতবিহ্বল হয়ে ফিরে তাকালো শামিমার দিকে। শামিমা অম্লান হেসে কুহুর কপালে আলতো করে চুমু বসয়ে দিতে দিতে ওকে আগলে নিলেন।
কুহু পুরোপুরি হুশ খুইয়েছে ততক্ষণে, চকিতে তাকাল অদূরে বসে থাকা কাব্যের দিকে। কাব্যও ঠিক তখুনি মাথা তুলে সবে কুহুর দিকেই তাকিয়েছে। কুহুর অবাক, বড় বড় চোখদুটো দেখে কাব্য স্রেফ মৃদু হাসল, ও হাসি কেমন যেন কুহুকে নিয়ে মজা করছে বলে মনে হলো।
কুহু ভ্রু কুচকাতেই সাথেসাথে কাব্য কুহুর দিকে চেয়ে বাম চোখটা টিপলো! কুহু ভীষণ রাগে কটমট চোখে তাকাতেই, কাব্য বড় একটা শ্বাস টেনে শার্টের কলার ঠিক করলো। তারপর কুহুকে দেখিয়ে দেখিয়ে বেশ রয়েসয়ে সোফায় হেলান দিয়ে ভ্রু তুলে তাকালো কুহুর দিকে।
কাব্যের এসব মজা, কৌতুক, গা ছাড়া এক্সপ্রেশন দেখে কুহুর এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে— ডাইরেক্ট কাব্যকে কাচা খেয়ে ফেলতে। এ লোকের সাহস কত বড়? কুহুকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে? সিয়ামের কথা— সিয়াম কুহুর কাছে কে, সেটা একমাত্র কাব্য ভাই খুব ভালোভাবেই জানতেন। উনি জানতেন— কুহু একমাত্র তার জন্যেই সিয়ামের সাথে জড়িয়েছে। আর আজ? কাব্য চাই সেটাকেই নিজের হাতিয়ার বানিয়ে কুহুর ফ্যামিলির সামনে ওকে ছোট করলেন? রাগে দুঃখে কুহুর চোখে জল চলে এলো কেমন। ও ঢোক গিলে সোজা তাকাল সাদাদের দিকে। সাদাদ মেয়ের দিকে গম্ভীর চোখে চেয়ে আছেন তখন।
সাদাদ কুহুর দিকে চেয়ে বললেন——‘তোমার কিছু বলার আছে আমাদের এই সিদ্ধান্তে?’
কুহু কি বলবে? যতবার সাদাদের ভঙ্গুর, থমথমে মুখটা দেখছে— দুনিয়া রীতিমত অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে কুহুর।
কুহুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হচ্ছে— ওর বাবা-মা। দুনিয়া চাই উলোট-পালোট হয়ে যাক, তবুও কুহু কখনোই ওর জন্যে ওদের চোখে ঘেন্না, বা অপমান দেখতে পারবে না; সহ্যই করতে পারবে না কুহু কোনদিন।
ওরা কাদুক, কিন্তু সেই কান্নার কারণ যেন কখনোই স্বয়ং কুহু না হোক।
এসব মনে করলে কুহুর ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে, ও থামলো, থেমে থেমে বহু কষ্টে উচ্চারণ করল———‘আ. . আব্বু? তুমি আমাকে এমনটা. . মনে করো? যার জন্যে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে?’
সাদাদ মাথাটা নিচু করে ছোট শ্বাস ফেলে আবার কুহুর দিকে তাকালেন। কুহুর চোখের জল দেখে মিইয়ে যেতে লাগলেন কেমন যেন। তখন সাদাদের ভঙ্গুর আচরণ দেখে পাশ থেকে কবিতা আলগোছে সাদাদের হাতে হাত রাখলেন, সবার অগোচরে। সাদাদ দমলেন ওই এক স্পর্শে! পরপর থমথমে কণ্ঠে কুহুর দিকে চেয়ে জবাব দিলেন———‘বিয়েটা করে আমাদের সন্দেহ মুছে ফেলো, ব্যাস! এটুকু চাই আমি।’
কুহু কান্নামাখা মুখে এবার হাসল, ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল——-‘হু, বুঝলাম। আমি আব্বু আজ. . খুব হা. .হার্ট হয়েছি। তুমি আমাকে এমনি এসব অপবাদ না দিয়েই একেবারে বিয়ে দিতে, আমি মেনে নিতাম। কিন্তু এসব জেনে আমাকে ভুল বোঝার আগে অন্তত একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতে আব্বু। কেন করলে না?’
কুহু সাদাদের দিকে তাকাল, সাদাদ কুহুর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেললেন। কুহু হেসে ফেলল, জবাব পেয়ে গেছে ও। কুহু এবার কাব্যের দিকে সোজা তাকিয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে বলল———‘আমার বিয়ের আগে কাব্য ভাইয়ের সাথে কথা আছে। এটুকু কি আমি করতে পারি? অন্তত?’
সাদাদ মানা করতে যাবেন, তার আগে কাব্য কুহুর ভঙ্গুর, কান্না মাখা কণ্ঠ শুনে সাদাদকে থামিয়ে দিল। চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলে নরম গলায় অনুরোধ করলো—-‘চাচ্চু, প্লিজ!’
সাদাদ থেমে গেলেন কাব্যের ওই এক অনুরোধে। মাথা নেড়ে আলগোছে সায় দিলেন। কুহু মেকি হাসল। কাব্য ভাই সবকিছু ঘেটে দিয়ে এখন ভালো সাজতে এসেছেন? হায়রে অভিনয়! কাব্য কুহুর দিকে চেয়ে ইশারা করে বলল———‘ছাদে যা, আসছি আমি।’
কুহু উঠে গেল। মাথার ওড়না সামলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ছাদের দিকে, পেছনে পেছনে কাব্যও এগুলো।
ছাদে আসামাত্রই কুহু মুহূর্তেই রণচণ্ডী রূপ নিয়ে নিল। ঠাস করে মাথার দোপাট্টা টেনেটুনে ফেলে দিল। কাব্য ভ্রু কুচকে কিছু বোঝার আগেই ও কাব্যের হাত ঝাঁড়ি দিয়ে টেনে ছাদের রেলিংয়ের ওদিকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিল। কাব্য তো বেচারা অবাক হয়ে কোনরকমে রেলিং ধরে পড়তে পড়তে বাঁচলো। পরপর কুহুর এমন হাইপার রূপ দেখে ভ্রু তুলে মজা নিয়ে বলল——-‘আরে মেরে ফেলবি নাকি? আস্তে,কুল ওকে?’
কুহু কটমট চোখে ওড়না সামলে, কাব্যের দিকে এগোল——-‘একদম চালাকি করবেন না, একদম না।’
কাব্যও হাসতে হাসতে স্যারেন্ডার করার ভঙ্গি করে বলল——-‘ওকে!’
কুহু এবার কাব্যের মুখোমুখি হলো, কাব্যের চোখে চোখ রাখতে কাব্য সুন্দর করে হাসলো। কুহু আজ ওই হাসির ধার ধারলো না একটুও। ও রাগী অথচ তেজি গলায় বলে গেল——-‘কেন করেছেন এমন? কি শান্তি মিলল আমাকে অপদস্ত করে? উত্তর দিন!’
কাব্য কিছু না বোঝার ভান করে ভ্রু বাকালো তাৎক্ষণিক——‘অপদস্ত? কাউকে বিয়ে করা তাকে অপদস্তের পর্যায়ে পড়ে নাকি?’
কুহু দুহাতে কাব্যের বুকের দুপাশে কঠোরভাবে জোরে দুটো ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে চাইলো——‘একদম ইনোসেন্ট সাজবেন না আমার সামনে, কাব্য ভাই। আপনি কেমন- এটা আমাকে নতুন করে চেনানো লাগবে না আর, ওকে? বলুন— সিয়ামের কথা কেন বলেছেন আব্বুকে?’
কাব্য এবার মজা করা থামিয়ে দিল। কুহুর দিকে চেয়ে থমথমে কণ্ঠে বলল——-‘সিয়ামের কথা আমি বলিনি চাচ্চুকে।’
কুহু আবারও রাগল যেমন। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল——-‘বলেছেন আপনি। মিথ্যা বলবেন না, খবরদার। আপনি ছাড়া এ বাড়ির কেউই জানত না সিয়ামের কথা। বদলা নিয়েছেন, তাই না? আপনাকে রিজেক্ট করার বদলা?’
শেষের কথাটা বলে কুহু পুনরায় কাব্যের বুকে জোরে ধাক্কা দেওয়ার জন্যে হাত বাড়াতেই সাথেসাথে কাব্য কুহুর হাত দুটো চেপে ধরে ওকে থামিয়ে দিল। কুহু বিমূর হয়ে তাকাল, কাব্য ওর হাতদুটো নিজের দুহাতের মুঠোয় চেপে শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল———‘বদলা নেয়ার হলে না কুহু— আমি কাব্য অনেক ভাবেই নিতে পারি,এমন এমন উপায় দ্যাট ইউ কান্ট ইভেন ইমাজিন। এরকম ঘাটিয়া উপায়ে বদলা নেওয়ার দরকার পড়বে না আমার।আর বাকি রইল বিয়ের কথা, সেটা তোকে চাচ্চুর সামনে সিয়ামের কথা বলে অপদস্ত করে আমার বিয়ে করতে হবে না। আমার দরকার হলে আমি এমনিই তোর হাত চাইতে পারি চাচ্চুর কাছে: এটুকু গাটস আছে আমার।’
কথাগুলো শোনাল অনেকটা ধমকের ন্যায়: যেন শাসাচ্ছে। কুহু ভ্রু কুচকে, খিচে চেয়ে আছে কাব্যের দিকে। কাব্য ওর চোখে চোখ রেখে আবারও শান্ত কণ্ঠে বলল—‘আমাকে নিয়ে পজিটিভ ভাবতে পারছিস না, ওকে ফাইন। কিন্তু আমাকে নিয়ে নেগেটিভ থটস নিজের মাথায় ঢুকিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যকার বন্ডিং নষ্ট করলে তোর খবর আছে।’
কাব্য এভাবে শাসাতেই কুহু এবার যেন আরো রাগলো, ছটফট করে উঠল কাব্যের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াবার জন্যে। কাব্য ছাড়লোই না, আরও শক্ত করে হাতদুটো চেপে হিসহিস করে বললো———‘তুই আমাকে চিনিস কুহু। অনেক ভালো করে আমি কাব্য কি সেটাও বুঝিস। তারপরও, লিট্রেলি তারপরেও তুই একটার পর একটা নেগেটিভ থটস মাথায় ঢুকিয়ে আমাকেও ভোগাচ্ছিস, নিজেও ভুগছিস।’
কাব্য থামলো,একবার শ্বাস টেনে আবার বলে গেল——‘আর এইজন্যেই আমি বিয়েটা করছি। আমার সাথে, আমার পাশে থাকলে মেইবি,তোর ব্রেইনে যদি আমি কিছুটা বুঝ ঢুকাতে পারি।’
কুহু এবার সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলো——‘আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি এখনো। আব্বু সিয়ামের কথা কিভাবে জানলেন? যদি আপনি ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে থাকেন? আব্বুর তো জানার কথা না।’
কাব্য ভ্রু কুচকে, অতিষ্ট হয়ে বলল——-‘তোর ব্রেইন আসলেই হাঁটুতে তাইনা?’
কুহু রেগেমেগে তাকাতেই কাব্য এবার অতিষ্ঠ হয়ে চোখ উল্টালো, কুহুর হাত ছেড়ে দিয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললো——‘ওকে ফাইন। প্রুফ দিচ্ছি তোমার কাণ্ড-কারখানার। দিন-দুনিয়ার হুশ তো আপনি অনেক আগেই খুইয়েছেন, আর সেটার খেসারতও আমাকেই দিতে হচ্ছে।’
কাব্য নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে কিছু একটা খুলে ভিডিও অন করে কুহুর সামনে ধরল——-‘লুক।’
কুহু কাব্যের থেকে চোখ সরিয়ে ফোনের দিকে তাকাল। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে— সিয়াম বাস্কেটবল ফিল্ডে কুহুকে প্রপোজ করছে; আর কুহু সেটা একসেপ্ট করেছে। তারপর সিয়াম কুহুকে জড়িয়েও ধরেছে। ঢাকার একটা কাপল পেজ থেকে ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে, ক্যাপশনে আবেগপূর্ণ কথা লেখা ——
~এরকম একটা বাস্কেটবল প্লেয়ার সবার জীবনে আসুক~
কুহু হতবিহ্বল হয়ে গেল যেমন। ও মুখে হাত চেপে পিছিয়ে গেল দু কদম, চোখে বিস্ময়,স্পষ্ট অপমানের ছাপ! কাব্য কুহুকে এমন ভেঙ্গে পড়তে দেখে ফোন দ্রুত পকেটে ঢুকিয়ে সাথে সাথে এগিয়ে এসে কুহুকে আগলে নিতে গেল। কুহু তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে উঠল——-‘ছোঁবেন না আমায়। আমি… এই ভিডিও—!’
বলতে বলতে কুহু পিছিয়েছে। কুহুর সারাটা শরীর স্পষ্ট কাঁপছে, ও কাপতে কাপতে বলল——-‘এটা আপনি করেছেন? তাই না? আপনি এটা ওদের সাপ্লাই করেছেন?’
কাব্য চুড়ান্ত হতাশ——‘খোদা, আমি এই ভিডিও কেন করব? তুইতো সিয়ামের প্রপোজ টাইমে পুরোটা সময় আমাকে দেখছিলি? ভিডিও করেছি আমি? আর সবচেয়ে বড় কথা— আমাদের বাড়ির মেয়ের এইসব ভিডিও আমি অনলাইনে কেন আপলোড করব? তুই আমাকে চিনিস এ ব্যাপারে।’
কুহু অস্থির হয়ে যাচ্ছে ধীরেধীরে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে——‘কত. . লোক দেখেছে এসব। আব্বু, বড়আব্বু, বড়মা— সবাই সবাই দেখেছে। আল্লাহ। ওরা আমাকে. . আমাকে কি . . মনে করছে? ছি!’
কুহুকে এভাবে অস্থির হতে দেখে কাব্য বোঝাতে গেল সুন্দর করে—-‘এটা মেইবি এটা ভার্সিটির একটা জুনিয়র বা ফ্রেশার কেউ করেছে। আমি ভিডিওটা সরানোর জন্যে আইটি সেকশনের সাথে যোগাযোগ করেছি, আমার এক বন্ধু কাজ করে ওখানে। ও এই ভিডিওর আসল হোল্ডারকে ট্রেস করছে। সাথে ভিডিও ডিলিট করার জন্যে কাজ করছে। কালকের মধ্যেও আশা করি ভিডিওটা ডিলিট হয়ে যাবে পুরো সোশ্যাল সাইট থেকে।’
কুহু হতবম্ভ তখনো। ও কাব্যের দিকে এইবার অসহায় চোখে তাকাল। কাব্য হয়তো সেটা বুঝল। ও নরম হলো এইবার: আলগোছে কুহুকে নিজের সাথে আগলে নিল। কুহু বিড়াল ছানার ন্যায় এবার কেমন যেন হুশ খুইয়ে মিশে গেল কাব্যের বুকে, স্রেফ মাথাটা ঠেসে রেখেছে ও কাব্যের পুরুষালি বুকটায়।
কাব্য কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে বলে গেল——-‘ইটস ওকে, ইটস ওকে। সব ঠিক হয়ে যাবে। সম্মান যা যাওয়ার আমার বউয়ের গেছে। এন্ড আই’ম কমপ্লিটলি ফাইন উইথ ইট। হু? কান্না না, স্টপ ক্রাইং!’
কুহু এখনো অবাক। ওর এই ভিডিও সবাই দেখেছে। কি ভেবেছে সবাই? আব্বু, চাচ্চু, বড়মা সবাই দেখেছে। এসব দেখার পরেও কেন কুহুকে নিজের বাড়ির বউ করতে চাইছে? কাব্য ভাইকে নিয়ে ওদের কত আশা! এসব দেখার পরেও বড়মা কেন রাজি হলেন এই বিয়েতে?
কুহু এ কথা মাথায় আসতেই ও ছিটকে সরে গেল কাব্যের গা থেকে। কাব্য হাতদুটো সেভাবেই পরে থাকলো, ও ভ্রু কুঁচকে তাকাল কুহুর দিকে।
কুহু কেমন গা ছাড়া কণ্ঠে এইবার এদিক ওদিক তাকিয়ে অস্থির, পাগলাটে কণ্ঠে একের পর এক বলতে চাইল———‘তবুও— আমি আপনার বিয়ে করব না। নেভার এভার। নিচে গিয়ে আপনি আমারই বিয়েতে বড়মা, বড় চাচ্চুকে মানা করে দেবেন। ভুলে যাবেন না— আপনি আর আমি কি কি পরিস্থিতি ফেস করে এসেছি, বা করছি।’
কাব্য ভ্রু তুলল, অবুঝের মতো বলল—‘কি পরিস্থিতি ফেস করেছি আমরা?’
কুহু বিরক্ত হয়ে তাকালো মাথা তুলে কাব্যের দিকে। অতিষ্ট কণ্ঠে বলল——-‘ওহ; জানেন না আপনি? দেখুন— বড়মা এসব ভিডিও দেখে আই ডোন্ট নো উনি কেন এই বিয়েতে এত খুশি। কিন্তু আমি উনাকে, উনার ফিলিংসকে অপদস্ত হতে দিতে পারিনা। আপনি আমার সাথে যাই করুন না কেন; বড়মা আমার কাছে অনেক বেশি ম্যাটার করেন। আপনার-আমার এই রেষারেষির সম্পর্কে বড়মা হার্ট হবেন- আর সেটা আমি চাই না।’
কাব্য এবার হালকা হাসল, রেলিংয়ে আরাম করে হেলান পুয়ান্টের পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে জবাবে বলল——-‘তোর আর আমার বিয়েতে তোর বড়মাই সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। আর বাকি রইল— এই রেষারেষির সম্পর্ক। ওটা বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে,ডোন্ট ওরি!’
কাব্যের এসব দায়ছাড়া কথায় কুহুর মেজাজ তুঙ্গে উঠলো এইবার। কুহু এবার সোজাসাপটা প্রশ্ন করল——-‘আচ্ছা? তাই বুঝি? তা আপনার গার্লফ্রেন্ড জানে যে আপনি আমাকে বিয়ে করছেন? হু? না তাকেও ডিচ করে দিয়েছেন?’
কাব্য এবার রেলিং ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেল। তারপর কুহুর এই তীক্ষ প্রশ্নের উত্তরে থমথমে কণ্ঠে জবাব দিল——-‘কুহু, ঊর্মি আমার গার্লফ্রেন্ড না।’
কুহু হেসে ফেলল, যেন কাব্য কৌতুক করছে। কাব্য ঠান্ডা চোখে কুহুর হাসি দেখলো। কুহু হাসতে হাসতে বলল——-‘ওমা? এক্ষুনি যেই বিয়ের কথা উঠল, ও আপনার গার্লফ্রেন্ড নাই হয়ে গেল? বাহ!
কুহু হাসছে, উপহাস করছে যেমন কাব্যকে। ওসব উপহাস কাব্য পাত্তাও দিল না দু-আনার। কাব্য জবাবে ঠান্ডা স্বরে বলল———‘আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছিল চার বছর আগে। আমি তোকে মিথ্যে বলেছিলাম।’
কুহু ভ্রু কুচকে ফেলল সাথেসাথেই, ওর হাসিহাসি মুখ কালো হয়ে গেল। ও অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল এইবার। এবার কাব্যই বলা শুরু করল———‘আমি সরি। কিন্তু সেসময় তোকে রিজেক্ট করার জন্যে স্ট্রং কোনো অজুহাত ছিল না আমার হাতে। আর তুইও জেদ দেখাচ্ছিলি। তাই আমি উপায় না পেয়ে ওর কথা বলে দিয়েছি। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে— আমরা আলাদা এখন, ওর সাথে আমার কোনো রকম যোগাযোগই নেই এখন, ইনফ্যাক্ট চার বছর ধরেই নেই।’
কুহু সন্দেহ নিয়ে তাকাল কাব্যের দিকে। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না কাব্যের একটা কথাও। যদি সম্পর্ক নাই থেকে থাকে, তাহলে ঊর্মির সাথে ছবিগুলো, মেসেজ, ওর আর কাব্যের সমস্ত কথা— এগুলো ঊর্মি জানবে কেমন করে? নাকি কাব্য ভাই স্বয়ং এটা লুকাচ্ছেন? কুহুর মাথার ভেতর চিন্তাগুলো ভনভন করতে শুরু করল।
কাব্যের মুখভঙ্গি চুড়ান্ত গম্ভীর! যেন ও মজা করছে না। এটাতে কুহু সন্দেহ নিয়ে তাকাল। বলতে গেল———‘তাহলে আমার-আপনার…কথা—!’
বাকি কথা বলার আগেই ছাদের দরজায় মহুয়া দৌড়া দৌড়াতে এসে দাড়ালো। পরপর কাব্য-কুহুর কাছে এসে হাপাতে হাপাতে ফরফর করে বলতে লাগলো———‘কুহু আপু, কাব্য ভাই! বড় চাচ্চু ডাকছেন তোমাদের। যেতে বলেছে আমার সাথে।’
কুহু এরপর বাকি কথা গুলিয়ে ফেলল। কিন্তু কাব্য ভুললো না। ও ডেসপারেট ভীষণ কুহুর কথাগুলো শোনার জন্যে। মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল———‘আসছি, তুই যা।’
বলে কাব্য মহুয়াকে পাশ কাটিয়ে কুহুর দিকে চেয়ে থমথমে কণ্ঠে বলল———‘বাকি কথা ফিনিশ কর।’
কুহু বলতে যাবে, তার আগেই মহুয়া আবার অধৈর্য হয়ে বলল———‘এক্ষুনি যেতে বলেছে বড় চাচ্চু। সবাই ডাকছে। তোমরা আসবে না? বকা খাবো তো আমি?’
অতিষ্ট হয়ে কাব্য চোখ উল্টে হতাশ শ্বাস ফেলল। তারপর কুহুর দিকে চেয়ে দু’কদম এগিয়ে বলল———‘রাতে কল দেব। সব, ইচ অ্যান্ড এভরি ডিটেলস আমি শুনব তোর কাছে; কল না ধরলে ওয়ার্নিং দিচ্ছি কুহু— তোর রুমে এসে তোকে…!’
কুহু ভ্রু কুচকাল———‘রুমে এসে কি?’
কাব্য এবার হালকা হাসল, কুহুর কানের কাছে ঠোঁট এনে হালকা করে কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়েই সেকেন্ডের মধ্যে সরে গিয়ে কানেকানে বলল———‘তোর হবু বর না আমি? লাইসেন্স কিন্তু আছে— যা ইচ্ছা তাই করার।’
কুহু শরীর এই সামান্য স্পর্শেই কাপলো কেমন: ও কানে হাত ছুটে ছুটে থেমে গেল, বুকে ধুকপুক অনুভূতি নিয়ে ভ্রু বাঁকাল———‘মানে?’
কাব্য এই কথার উত্তরে স্রেফ হাসল, অশ্লীল একটা হাসি। কুহুর রূহ অব্দি কেঁপে উঠল সেই হাসি দেখামাত্রই। মনেমনে শিউরে উঠলেও, ও কটমট চোখে কাব্যের দিকে তাকালো। কাব্য সেই রাগী দৃষ্টির এক আনার দাম না দিয়ে আরাম করে মহুয়ার হাত ধরে যেতে যেতে বাকা চোখে কুহুর দিকে চেয়ে কৌতুক করে বলল———‘চল, আমরা যাই। তোর ভাবি শকে আছে।’
কাব্য-মহুয়া এগোচ্ছে। যেতে যেতে মহুয়াকে বলতে শোনা গেল———‘কুহু আপু কি সত্যি আমার ভাবি হবে কাব্য ভাইয়া? তাহলে এখন থেকে আমি তাকে কি বলে ডাকব?’
কাব্য জবাবে বলল———‘গুগল করে জেনে নে।’
তারপর. . . ?
তারপরের কাহিনি খুবই সরল, অনেকটা রূপকথার ন্যায়!
বড়দের মধ্যে কথা হচ্ছে— আগামীকাল ছোট একটা অনুষ্ঠান করে মেহমান ডেকে আংটি পরিয়ে দেবেন কুহুকে। আর দুদিন পর শুক্রবার, সেদিন বাদ দুপুরে নিকাহ পড়িয়ে ফেলবেন। ছেলের পক্ষ থেকে রিসেপশন হবে কুহুর এক্সাম শেষের পর। তার আগে মেয়েকে উঠিয়ে দেওয়া হবে কাব্যের ঘরে। তাছাড়া কাব্যের মাস্টার্স এক্সাম সামনে, ওর নিজেরও পড়াশোনা আছে। তাই আপাতত কাউকেই বিয়ের জন্যে প্রেসারাইজ করা ঠিক হবে না। ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে মেয়েকে তুলে দেবেন। সবার মতে, ঘরের ছেলে-মেয়ে বিয়ে করছে— এতে এত তারাহুড়োর তো কিছু নেই, আস্তে-ধীরেই হোক সব!
কুহুকে নিয়ে এত কথা যখন হচ্ছিল— ও পুরোটাসময় মূর্তির মতো বসেছিল নিজের জায়গায়। ওর মাথাটা ভনভন করছে। বারবার না চাইতেও বড়মার দিকে চোখ যাচ্ছে। বড়মা কুহুকে কি সত্যি মন থেকে মেনে নিয়েছেন? আর সবাই কি করে এই বিয়েতে রাজি হলো? কাব্য ভাই ওদের কি বলে রাজি করিয়েছেন? এভাবে হঠাৎ করেই সবাই রাজি হয়ে গেল তাদের বিয়েতে? এর পেছনে কারণটা কি? অথচ কদিন আগেও কাব্য ভাই ভেবেছিলেন ওদের বিয়ে সম্ভব না। তাহলে?
কাব্য ভাই রাতে কল দিলে— কুহু জানতে চাইবে এসব। যদি সে না বলে এই বিয়ের পেছনে রহস্য কি, তাহলে কুহুও কিছু বলবে না- যা কাব্য শুনতে চায়।
আর ভিডিওটা কে করেছে সেটাও জানা দরকার। আর সিয়াম? গত একমাস ধরে সিয়ামকে ভার্সিটি দেখা যাচ্ছে না। কেন দেখা যাচ্ছে না? শার্লিন সেদিন সিয়ামের ডিপার্টমেন্টে ওকে খুঁজে এসেছে। মূলত সিয়ামের খবর কেউই জানে না, আর নাইবা জানে কেউ ঊর্মি আপুর খবর!
কোথায় তারা?
#চলবে
Share On:
TAGS: অবন্তিকা তৃপ্তি, ডেনিম জ্যাকেট
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৪
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১৬
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৯
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৮
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩০
-
ডেনিম জ্যাকেট স্পয়লার (বিবাহ পরবর্তী)
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৭
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩
-
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ২৬