#আড়ালে_তুমি
#সামিয়া_সারা
#কাজিন_রিলেটেড_গল্প
পর্ব -৪১
শিমু জাহানের ভেতরে আজ চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে। তার নিজের সন্তান নীলের ভেতরটা যে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না একজন মা হয়ে। নীলের বাহু ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে বললেন,
-আমার উপর তোমার তীব্র অভিমান আমি উপলব্ধি করতে পারছি ইনান।
নীল মুখ ঘুরিয়ে বলল,
-এই নামে না প্লিজ…
-ইহানের বিষয়ে কথা তুললে আমরা কেউই ঠিক থাকি না নীল। হ্যাঁ,ইনায়ার কষ্ট বেশি হয়। খুব স্বাভাবিক। তুমি জানো তা।
-জানলে আনানকে শিখিয়ে পাঠাতেন না এসব ঝামেলা করতে!
-বিশ্বাস কর বাবা,আমি এমন কিছু বলিনি। তুই একটা ম্যাচিউর ছেলে নীল। কিন্তু আনান? ও বয়স অভিজ্ঞতায় তোর থেকে অনেক ছোট। তোর ছোট ভাই….
-কীসের ম্যাচুরিটি? ম্যাচুরিটি কী? ছোট ভাইকে নিজের ভালোবাসা দান ভিক্ষা করে দেওয়া? তাহলে শুনো! দেওয়ান নীল ম্যাচিউর না। নীলের নীলাকে হারাতে হবে যে ম্যাচুরিটি দিয়ে,নীল সে ম্যাচিউর হতে চায় না।
-আমার কথা শোনো নীল।
-ঘৃণা করছে আমার। সব বুঝেও আমার মা অন্য একটা ছেলেকে কীভাবে সাপোর্ট করলো।
-ও তোমার ভাই তো নীল।
-আরে রাখো তো তোমার ভাই! আমি ইনুকে ছাড়া কিছু বুঝি না। কাউকে চিনি না। আমার দুনিয়াতে আর কেউ নাই,ও ছাড়া।
উচ্চস্বরে নীলের বলা কথাগুলোর পরে ঘরে পিনপতন নীরবতা। শিমু জাহান কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থমকে গিয়ে উঠে গিয়ে দরজা লক করলেন। নীলের কাছে এসে বলল,
-আনান আত্মহ*ত্যা করতে গিয়েছিল।
নীল তার লালাভ চোখ নিয়ে মায়ের দিকে ঘুরে তাকায়। সে চোখে ক্লান্ততা। তৃষ্ণা,কাউকে পাবার তীব্র তৃষ্ণা। শিমু জাহান নীলের মুখে হাত রেখে বলল,
-আমি গিয়ে ওকে আটকিয়েছি। তুই বল বাবা,আমি কীভাবে চোখের সামনে ওকে ম*রতে দেখতাম? তোদের কে তো একই ভাবে বড় করেছি।
শিমু জাহান আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তবে নীল কোনো জবাব দেয় না। একই ভাবে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। কোমল গভীর দৃষ্টি, যে কেউ তাকালে মায়ায় পড়ে যাবে। শিমু জাহান চোখ সরিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ পর নীল উঠে দাঁড়ালো।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমার আর ইনুর মাঝে আমি একটা ফুলের পাঁপড়িও মেনে নিতে পারি না মা। সেখানে কোনো জলজ্যান্ত মানুষকে অবশ্যই মানব না।
নীল শিমু জাহানের দিকে আর না ফিরে তাকিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। নিজের রুমে ঢুকতে ইনায়ার ঘরে একটু উকি দেয়। ইনায়া দরজা আটকে রেখেছে। নীল খুব হালকা ভাবে দুবার দরজা ধাক্কা দেয়। ইনায়া ওরনার একেবারে শেষ প্রান্ত মুখের সামনে ধরে দরজা খোলে। নিচের দিকে তাকাতে পা দেখতেই বুঝে যায় নীল ছাড়া আর কেউ না। নীলের উপস্থিতির জন্য চোখ তুলে তার দিকে তাকানোর আর সাহস হয় না। ইনায়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়াতে নীল কাঁপা গলায় বলল,
-ইনু…সরি…
ইনায়া কোনো জবাব দেয় না। নীল পুনরায় বলে,
-জীবনে প্রথমবার তোর সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আড়ালে তো আর কিছু রাখতে চাই না আমি। এমন কি….
বলতে বলতে নাক টেনে বলল,
-নাহ কিছু না। শোন,তুই কীভাবে কী করলে বুঝবি যে আমার কোনো দোষ নেই?
-আপনি কি আমার বড় ভাই এর দায়িত্ব পালন করছিলেন নীল ভাই?
-তোর বড় ভাই হওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম কখনো?
-তাহলে আপনি কেন জানতে চাইতেন আমি কার সাথে সম্পর্ক করব না করব। আমি কাউকে ভালোবাসলে,বিয়ে করলে আপনার কিছু যায় আসে? ফেক আইডি খুলে আমার উপর নজরদারি তো ভাই এর দায়িত্ব পূরণ করতে করেননি। তাহলে কেন নীল ভাই?
নীল এবার নিশ্চুপ। ইনায়া কিছুক্ষন জবাবের অপেক্ষা করে বলল,
-চলে যান…
নীল ইনায়ার চোখাচোখি হয়। নীল ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
–মন চাইলে একটু বোঝার চেষ্টা করিস। না খেয়ে আমিও আছি। তাই নিজে না খেয়ে থেকে আমাকে কষ্ট দিস না।
-খেয়ে নেন আপনি নীল ভাই। মানা কেউ করেনি।
নীল কোনো জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
.
.
.
বহুদিন পর আনান চিঠি লিখতে বসেছে। একটা চকচকে পেজ বের করে,
দুমিনিট ভেবে লিখতে শুরু করল,
“নীল ইনায়াকে ভালোবাসে না। ইনায়াকে কেউ ভালোবাসলে সেটা আনান।”
পুরো একটা পেজ জুড়ে শুধু এই দুটো বাক্য লেখা। সাথে কলমের অসংখ্য ফোটা দেওয়া। মনে করলো সেদিনের কথা,
বেলী ফুলের মালাতে ইনায়া ঠোঁট ছোঁয়ানোর পরে নীল তা কীভাবে মুচড়ে ফেলেছিল। অথচ আনান ইনায়া ছোঁয়া লেগে থাকার কারণে সেই মোচড়ানো ফুল নিজের কাছে সযত্নে রেখে দেয়।
আনান আরো একটা পরিষ্কার পৃষ্ঠা নিল।
তাতে লিখলো,
“ভালোবাসলে আগলে রাখতে হয়। ভালোবাসার মানুষের সব ভালোবাসার জিনিস যত্নে রাখতে হয়,যা আমি রেখেছি।”
.
.
.
তিন দিন হয়ে গিয়েছে নীল ইনায়ার কোনো রকম কথা হয় না। দুজন দুজনের মুখোমুখি হলেও চোখ নামিয়ে ইনায়া চলে যায়। নীলও ইনায়াকে আর কিছু বলেনি সেদিন রাতের পর থেকে। আজ সকাল সকাল রিসানের কল আসে। ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হতে রিসানের কল ধরে নীল।
–মন মেজাজ ভালো?
-কী দরকার বল।
-তোকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না দোস্ত
-সকাল সকাল এই কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না। রাখলাম।
-শোন মামা। সকাল সকাল বললাম,কারণ আজ ভার্সিটিতে যাবি,গত দুই দিন না হয় বন্ধ ছিল। আজ ভালো করে বুঝিয়ে কথা বল?
-রিসান, কিছু জিনিস মানুষকে নিজে থেকে উপলব্ধি করে নেওয়ার জন্য সময় দিতে হয়।
-ভালোবাসিস যে তা বলবি না? নাহলে উপলব্ধি করবে কী?
-তোর মাথা ঠিক আছে? সব জেনে বুঝে কী বলিস?
-ধুর্ ! যা ভালো বুঝিস কর! হাত দিয়ে চাঁদের আলো ধরতে যাবি,তখন দেখবি ধরতে গেলে নাই।
নীল ফোন কেটে দেয়। সাদা শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। ইনায়া টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে। সামনের চেয়ার টেনে নিয়ে ইনায়াকে বলল,
-খাচ্ছিস না কেন?
ইনায়া কোনো জবাব না দিয়ে খাবার মুখে দেয়। আনান এখনো নিচে নামেনি। গত তিনদিন ধরে ইনায়া তার সাথেও কথা বলছে না। আনান অনেক চেষ্টার পরে হাল ছেড়ে ঘরবন্দী করেছে নিজেকে। রুবিনা ইয়াসমিন অনেক ডেকে ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে এনে খেতে বসান। আনান ঘুম ঘুম চোখে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
ইনায়া খেতে খেতে আকবর দেওয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-বড় বাবা আমি আজ থেকে একাই যাব।
-সে কি আম্মু! কেন?
-বনানীর মধ্যেই তো সব,এখান থেকে এতোটুকুই। রিকশা নিয়েই যাওয়া যায়।
-বাড়িতে তোমার দু দুটো শক্তিশালী ফিট বডিগার্ড থাকতে একা কেন?
-আমি পারব বড় বাবা…
নীল খাবার খেয়ে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
-দ্রুত রেডি হবি। ওয়েট করছি।
-চলে যান।
-আজকে রোডে কোনো রিকশা চলবে না।
-কেন?
-আমি বলেছি তাই।
-রিকশা গুলো সব আপনার কিনে দেওয়া না। যে আপনার কথা মতো চালানো বন্ধ হবে।
-তুই চাইলে খুঁজে দেখতে পারিস।
বলেই নীল ডান হাতের মোটা নীল চেইনের ঘরির দিকে তাকায়। বলল,
-ঠিক পনেরো মিনিট। নাহলে একা হেঁটে হেঁটে যেতে হবে।
ইনায়া কিছুক্ষন ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় সে নীলের সাথে যাবে। ব্যাগ নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
-রিকশা নেই বলেছে যখন তার মানে নেই। আচ্ছা যাই,কথা না বললেই হলো
.
.
.
বাইক স্টার্ট দিয়ে একটা মোড় পার হতে না হতেই অসংখ্য রিকশা ইনায়ার নজরে পড়ে। কপাল কুঁচকে নীলের দিকে তাকিয়ে বলল,
-নীল ভাই!
-রাগ কমে গেছে ইনু? মনে হচ্ছে কত বছর পর আমাকে ডাকলি নিজে থেকে।
ইনায়া মুখ বন্ধ করে ফেলে। অসম্ভব রাগ হচ্ছে নিজের উপর তার। এতো এতো রিকশা! আর সে কি না এমন বোকার মতো একটা কাজ করে বসলো।
ভার্সিটির সামনে বাইক থামতেই ইনায়া নেমে কোনো কথা ছাড়াই সোজা ক্লাসের দিকে হাঁটা দেয়। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত আসনে বসে বই খুলে সূচনা কে বলল,
-পড় হচ্ছে কেমন?
-কোনো রকম। কোথায় ভাবলাম ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে আর কোনো পেইন ই থাকবে না! সবই কপাল…
ক্লাসের কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ হঠাৎ করে পাল্টে নীরব হয়ে যায় নীলের আগমনে। সকলে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেও ইনায়া সেদিকে নজরই দেয় না । সূচনা দুতিনবার ঠেলাঠেলি করলেও ইনায়া বই এর দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে ।নীল আড় চোখে বিষয়টা লক্ষ্য করে আজকের টপিকে আলোচনা শুরু করে। আলোচনার এক পর্যায়ে নীল কণ্ঠস্বর নিচু করে শরীরটা হালকা ঝুঁকিয়ে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আপনার মন খারাপ মিস??
ইনায়া ভ্রু ভাঁজ করে বই এর দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে সূচনা জবাব দেয়,
-জ্বী স্যার হালকা হালকা…
ইনায়া দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে সূচনা কে দেখে। সাথে সাথে তাকায় নীলের দিকেও। নীলও সূচনাকে দেখছে। ইনায়া কিছুটা অযাচিত ভাবে অপমানিত বোধ করল। দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলে। নীল পুনরায় ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
-পড়াতে মন দিন। আর অবশ্যই কোনো হেল্প লাগলে আমি তো আছি।
এবার ইনায়া একটুও দেরি না করে নীলের দিকে তাকায়। তবে নীল সূচনার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলেছে দেখে ইনায়া মুখ ভার করে ফেলে। নীল ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে ইনায়া সূচনাকে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-প্রশ্ন তোমাকে করেছিল? যে তুমি উত্তর নিচ্ছিলে…আমাকেও তো করতে পারে।
-তেমাকে করলে আমার দিকে তাকাতো না। ওহ্ ভালো কথা! স্যার এর নাম্বারটা তো নেওয়া হলো না। তুমি থাকো আমি নিয়ে আসছি।
ইনায়ার নিজের উপর রাগ হচ্ছে এখন। না চাইতেও সব সহ্য করতে হচ্ছে । রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে কলম নিয়ে জোড়ে খাতার উপর রেখে ইচ্ছে মতো দাগাদাগি করতে শুরু
করে।
সূচনা হাসি মুখে রুমে ফিরে এসেছে। ইনায়া কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-নাম্বার দিয়েছে?
-ইয়েসস!
বিড়বিড় করে ইনায়া বলল,
-নীল ভাই নাম্বার দিবেন? অসম্ভব। দিলেও ভুলভাল।
সূচনা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-কই দেখি?
সূচনা ফোন থেকে নাম্বার টা বের করে দেখাতেই ইনায়ার চোখ ছানাবড়া। হাত মুঠো করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায় ক্লাসরুম থেকে। শরতের মেঘলা আকাশ,সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি মাথার উপর নিয়েই রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে।
(চলবে……)
#Running
#episode:41
Written by #Samia_Sara
Story name: #আড়ালে_তুমি
আমার প্রিয় পাঠক পাঠিকারা, গল্পটি নিয়ে আপনাদের মন্তব্য শুনতে চাই। একদম সব্বাই কমেন্ট করে জানিয়ে দিন,কেমন লেগেছে আপনাদের কাছে। আর আগের পর্বে এতো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা। ভালোবাসা নিবেন
Share On:
TAGS: আড়ালে তুমি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৩৮
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৩২
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৩৯
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৫১
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৫৩