মেঘেরওপারেআলো
পর্ব_৪০
Tahmina_Akhter
মাশফি ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে কবরস্থানে চলে গিয়েছিল। তানিয়ার কবর জিয়ারত শেষ করার পর মেঘালয়ের ছেলের কবরের সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর সেখান থেকে বাড়ির পথে রওনা হয়। বাড়িতে পৌঁছানোর পর দেখল ড্রইংরুমে মাহরীন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সিতারা বেগম মাহরীনের পাশেই সোফায় বসে আছে। ইনায়া বেলীফুলকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
— আলোর এখন কি অবস্থা? জ্ঞান ফিরেছে?
মাশফির কন্ঠস্বর পেয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো মাহরীন। মাহরীনের রক্তাভ ভেজা চোখজোড়া দেখে আঁতকে উঠল মাশফি।
মাহরীন উঠে এসে মাশফির সামনে দাঁড়িয়ে মাশফির গালে ঠাসস করে চড় লাগিয়ে দিলো। মাশফি গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল তার মায়ের দিকে। সিতারা বেগম লজ্জা এইটুকুন হয়ে গেলেন। কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে যাচ্ছে, কে জানে? ইনায়া আতংকিত হয়ে বেলীফুলকে শক্ত করে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে ।
— কি এমন করেছিস তুই? তানিয়া কেন বাচ্চা পেটে নিয়ে বিষ খেলো? সবার মায়া কাটিয়ে কেন মৃত্যুকে সাদরে সজ্ঞানে গ্রহণ করলো? আমার সঙ্গে তুই ভারতে বসে থেকে বাংলাদেশে কি এমন কলকাঠি নাড়লি যে তোদের মধ্যে দূরত্ব এতটা হলো?
মাশফি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার মায়ের দিকে। তার মায়ের কথার মানে বুঝতে পারছে না। ইনায়ার দিকে তাকালো কিন্তু ইনায়া মাথা নীচু করে ফেলেছে।
— কি বলছো তুমি এসব! তানিয়া বিষ খেতে যাবে কেন? ও তো সিঁড়ি থেকে….
— মিথ্যা বলেছে তোর শালি সাহেবা। মৃত্যু যেই কারণেই হোক না সত্যিটা একবারও জানাতে পারল না আমাদের? আমার বাড়ি না এটা। এই বাড়ি এখন নাট্যমঞ্চ হয়ে গেছে। তোর বাপ মরে গিয়ে শান্তিতে আছে। আমাকে রেখে গেছে তার সুপুত্রদের ঝামেলা ঘাড়ে নিয়ে দিন কাটিয়ে দেয়ার জন্য।
মাশফি ইনায়ার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাহরীন গিয়ে ইনায়ার কোল থেকে বেলীফুলকে কোলে তুলে নিলো। এমন সময় বাড়ির বাইরে গাড়ি থেমে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল। ইতিমধ্যে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে তানিয়ার বাবা-মা।
ইনায়া বাবা-মাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। দৌঁড়ে গিয়ে তার মাকে একপাশে জড়িয়ে ধরল। মেয়ের গালে একহাত রেখে তানিয়ার মা বলল,
— চোখ লাল হয়ে আছে কেন? আরে পাগলি মেয়ে কান্না করছিস কেন?
— আপনার মেয়ের কূটনীতির সঙ্গে আপনিও কি সংযুক্ত আছেন, বেয়াইন?
মাহরীনের কথা শুনে তানিয়ার মা সুফিয়া বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। ইনায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— বেয়াইন কি বলছে?
ইনায়া চুপ করে রইল৷ মাশফি সোফায় বসে পরলো। মাথা ঘুরছে তার। সিতারা বেগমের দিকে মাশফি তাকালো।
— আন্টি আপনি তো কিছু বলুন! কি হচ্ছে এখানে? আলো কোথায় আছে?
সিতারা বেগম ধীরেসুস্থে সবটা খুলে বলল মাশফিকে। সবটা জানার পর মাশফি ইনায়ার দিকে তাকালো। মাশফির এখন কেমন বোধ করা উচিত? যেই স্ত্রী বেঁচে থাকতে সজ্ঞানে কখনো স্বামীকে সম্মান দেয়নি, ভালোবাসাকে বারবার অগ্রাহ করেছে আবার সেই স্ত্রী মৃত্যুর দিন অস্বাভাবিকভাবে তাকে চোখে হারালো। নিজ থেকে ভালোবাসা দিতে চাইলো। ঠিক সেদিনই বলা নেই কওয়া নেই তার স্ত্রী মরে গেল। মৃত্যুর কারণ ছিল সিঁড়ি থেকে পরে যাওয়া, তারপর হার্ট অ্যাটাক। এতটুকু তো সে জানে। কিন্তু, আজ জানতে পারল তার স্ত্রী সুইসাইড করেছে! এখন তার কি করা উচিত? স্ত্রী বিয়োগের আসল কারণ জানার পর দুঃখ-শোক নিয়ে মাতামাতি করা উচিত? নাকি একজন অবলা নিরিহ মেয়ের কপালে লাগা কলঙ্কের দাগ মুছে দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত? তানিয়ার মৃত্যুর কারণ নিয়ে কারচুপির করার পেছনে ইনায়ার মোটিভ কি? আলোর সঙ্গে তাকে জড়িয়ে এমন কুরুচিপূর্ণ বিতর্কিত ব্যাপার নিয়ে এতগুলো মানুষের সামনে আলোকে হেনস্থা করার কারন কি? ইনায়ার দিকে কটমট করে তাকালো মাশফি।
সুফিয়া ইনায়ার ডান বাহু শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— তুই আর তোর বোনটা হচ্ছিস হাড়বজ্জাত। কি হয়েছিল বল? নয়তো থাপড়িয়ে গাল লাল করে ফেলব। ভুলেও মিথ্যা বলবি না। যা সত্য তাই বলবি। কাউকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই।
সুফিয়ার বলা শেষের বাক্যে সত্য-মিথ্যার মাঝে অবিশ্বাসের সুর মিশে ছিল।
“আপা যখন পোল্যান্ডে ছিল তখন আপার সঙ্গে ফোনকলে কথা হয় আমার। আপা কথার ছলে একদিন মাশফি ভাইয়ার সঙ্গে তার বনিবনা না হওয়ার ব্যাপারটা আমাকে জানালো। সমাধানও চায় আমার কাছে। আমি অবিবাহিত মানুষ তাকে কি সমাধান দেব? এরইমাঝে একদিন খবর শুনলাম, আপা প্রেগন্যান্ট। খবরটা জানার পর সেকি খুশী হলাম আমি! ভাবলাম এবার বুঝি আপা এবং মাশফি ভাইয়ার সংসারটা জমবে। আপাকে আমি বারবার জোর দিয়ে বলতে থাকি, আপা তুমি বাংলাদেশে ফিরে এসো। ভাইয়ার আশেপাশে থাকলে তোমরা দু’জনে খুব বেশীক্ষণ রেগে থাকতে পারবে না একে অপরের প্রতি। আপা রাজি হলো। বাংলাদেশে ফিরে এলো। আপা দেশে আসার ক’দিন পর ভাইয়া মাহরীন আন্টিকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেল। আপা ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিল! জানতে চাইলে বলতে চাইতো না। আপার মলিন মুখখানা দেখলে আমি টের পেতাম আমার আপা ভালো নেই।”
এতটুকু বলে ইনায়া দম নিলো। মাশফির দিকে তাকিয়ে বলল,
— আপার মন খারাপের কারণ আপনি খুব ভালো করেই জানতেন, ভাইয়া।
মাশফি ইনায়ার কথা শুনে বুকটা কেঁপে উঠল। ” হ্যা ” কিংবা “না” শব্দের মাঝামাঝি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে মাশফি। ইনায়ার কাছ থেকে সবটা জানা জরুরি এখন। তারপর নাহয় দুই দুইয়ে চার মিলিয়ে যাবে।
— মাহরীন আন্টি এবং মাশফি ভাইয়া দেশে ফেরার খবর শুনে সবচেয়ে খুশী আপা হয়েছিল। গত পাঁচবছরের নড়বড়ে সংসারটাকে এবার গুছিয়ে রাখার অদম্য আগ্রহ আপাকে ক্ষণে ক্ষণে আনন্দিত করে তুলেছিল। কিন্তু, মাশফি ভাইয়া আমার আপার সেই আনন্দ গলা টিপে মেরে ফেলেছিল অজান্তেই।
ইনায়া কথাগুলো শেষ করল। মাহরীনের সামনে তানিয়ার মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— মেসেঞ্জার চেক করুন আন্টি, সব উত্তর এখানে আছে।
মাহরীন মোবাইল হাতে নিয়ে চেক করল। আগাগোড়া সব মেসেজ পড়ার পর মাহরীনের হাত কাঁপছে। মাশফি খুব স্বাভাবিকভাবে বসে আছে। যেন এই ব্যাপারটা সে আগে থেকেই জানত। মাহরীন এবার মোবাইল বাড়িয়ে দিলো সুফিয়ার সামনে। সুফিয়া মেসেজগুলো পড়লেন। তারপর বিস্ময়ভরা সুরে মাশফিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— এসব কি মাশফি! শেষমেশ পরকিয়া!
মাশফি যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল। থুতনির ওপর এক হাত রেখে বলল,
— আপনার মেয়ে ফেইক আইডি খুলে আমার সঙ্গে অপরিচিত সেজে প্রেম করতে চেয়েছিল। আমি যখন ভারতে ছিলাম ঠিক তখন এই ঘটনার সুত্রপাত হয়েছিল। তানিয়া ভেবেছিল আমি ওকে চিনতে পারব না। কিন্তু, তানিয়া হয়তো ভুলে গিয়েছিল, ওর সেই ফেইক আইডি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আগে থেকেই ছিল। এবং নামটাও আমি জানতাম। কারণ, বিয়ের আগে আমাদের প্রেমের সময় এই আইডি দিয়ে সে আমাকে পরীক্ষা করতো, আমি তার প্রতি কতটা লয়াল তা জানার জন্য? বিয়ের পর আমি তানিয়ার কাজিন অহির কাছ থেকে ব্যাপারটা জানতে পারি। তানিয়া আইডির নাম বদলে ফেলেছিল ঠিকই, কিন্তু ইউজার নেইম বদলাতে পারেনি হয়তো। তাই তানিয়া যেদিন আমাকে প্রথমবার মেসেজে করলো ওই আইডি থেকে আমি সেদিনই প্রোফাইল চেক করে বুঝতে পারলাম, ওটা আর কেউ নয় আমার সন্দেহবাতিক বউ তানিয়া। সে আমাকে মেসেজে নানানভাবে ইঙ্গিত করে তার সঙ্গে প্রেম করার জন্য। জবাবে আমি বলতাম, আমার স্ত্রী আছে। কয়েকদিন পর আমার সন্তান দুনিয়ার মুখ দেখবে। এসব জানার পরও মেসেজ করতো,”তাও আমি আপনার সঙ্গে প্রেমে জড়াতে রাজি” আমি হাসতাম ওর মেসেজে দেখলে। আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্য তার কি উদ্ভট আয়োজন! আজকালকার যুগে একটা অচেনা মেয়ে শুধু ছেলের প্রো-পিক প্রেমে পরবে কেন? যেখানে ফ্যামিলি স্ট্যাটাস, টাকা-পয়সা অনেকখানি ম্যাটার করে। সেখানে আমি নিজেকে বিবাহিত মানুষ বলে পরিচয় দিয়েছি। তাও মেনে নিয়েছে। কারন আমাকে ফাঁদে ফেলতে যে হবে। দিনদিন ওর পাগলামি বাড়তে থাকল। আমি যদি তানিয়ার সাথে রাতে কল করে কথা বলতে চাইতাম, তখন তানিয়া কল কেটে দিতো। ঘুমিয়ে যাওয়ার মিথ্যা বাহানা দেখিয়ে। পরক্ষণেই ওর ফেইক আইডি দিয়ে আমাকে মেসেজ করতো। দিনদিন ওর পাগলামি বাড়তে থাকল। আমি আর মা ফিরে এলাম বাংলাদেশ । বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তানিয়ার ভাবসাব দেখে বুঝতে পারলাম, ওর মানসিক পরিবর্তন হয়েছে অনেক। আগের তানিয়া এবং এখনকার তানিয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তানিয়ার অপ্রকাশ্য ভালোবাসা প্রকাশ্যে আনার জন্য আমি মুখের ওপর নকল দুঃখ ঝুলিয়ে রাখলাম। তানিয়া তার শেষ চালটা চালল সেদিন। মিলাদের দিন দুপুরে আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়ার মিনিট পনেরো পর ওর ফেইক আইডি থেকে আমাকে মেসেজ করে বলল,
“আমাকে বিয়ে করবেন?”
আমি ভীষণ মজা পেলাম। ভাবলাম নিজের বিয়ে করা বউয়ের কাছ থেকে সেকেন্ড টাইম প্রপোজাল পেলাম মন্দ নয়। আমি তানিয়াকে জ্বালানোর জন্য বললাম,
” এতদিন আপনার সাথে কথা বললাম, আপনার সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব চলার মাঝে কখন যে আপনার মায়ায় জড়িয়ে গেলাম! আমি আপনাকে বিয়ে করব। আপনার সঙ্গে আমি আজই দেখা করব। আপনি আজ সন্ধ্যায় কুটুম্ব বাড়ি রেস্টুরেন্টে চলে আসবেন। আসবেন তো আপনি? আমি অপেক্ষায় থাকব। “
এই একটা মেসেজ যে আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে আমি যদি একবার টের পেতাম! তাহলে আমি মজা করার দুঃসাহস দেখাতাম না। আমি তো শুধুই চেয়েছিলাম, তানিয়াকে সারপ্রাইজ দিতে। যেই সারপ্রাইজটা হতো তানিয়ার জীবনে অবিস্মরণীয় স্মৃতি। কিন্তু, যাকে ঘিরে ছিল আমার সব আয়োজন সে যে আমার জীবনে শেষ স্মৃতি হয়ে যাবে, আমি কি জানতাম?
পাগলিটা আমার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল। নিজের ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল।
কথাগুলো বলতে বলতে মাশফির চোখের জল গড়িয়ে পরল। উপস্থিত সবার চোখে জল। একটা মশকরা তাদের ওপর যে কতটুকু ভারি পরল ? সুফিয়া বুক চাপড়ে কাঁদতে শুরু করলেন। ইনায়া চোখের জল মুছে মাশফির উদ্দেশ্য বলল,
— দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আমি আর আলো আপার সামনে বসা ছিলাম৷ আপা আপনাকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে গল্প করছিল। এমনসময় আপার মোবাইলে মেসেজ এলো। মেসেজ আসার পর আপাকে অস্থির দেখাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করতেই আপা মলিন হেসে জবাব দিয়েছিল ” পুরুষ মানুষ এক নারীতে আসক্ত হয় না রে৷ পুরুষকে বাবা হবার অনুভূতি অনুভব করানোর জন্য নারীরা মা হয়। মা হবার সে কি মিষ্টি যন্ত্রণা উপভোগ করে! পুরুষ কি সেই মিষ্টি যন্ত্রণা উপভোগ করতে পারে? একজন মা যতটা দেহ ক্ষয় করে সন্তানকে দুনিয়ার মুখ দেখায়, সেক্রিফাইস করে৷ পুরুষরা কি তা পারে? “
আমি আর আলো আপার কথার মানে বুঝতে পারিনি। একটু পরই আপা
শুধু বলল “আমি দোতলা থেকে আসছি”। আপা চলে গেল। আপা ঘর থেকে চলে যাওয়ার পর আলো বেরিয়ে গেল। অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন দেখলাম আপা এবং আলো ফিরে আসছে না। তখন আমি রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখলাম, মাশফি ভাইয়া আলোর সামনে গোলাপ ফুল বাড়িয়ে রেখেছে। আলো হাসিমুখে ফুলটা হাতে নিলো। এতটুকু দৃশ্য আমার যে কেন সহ্য হলো না কে জানে? আমি দ্রুত চলে গেলাম দোতলায়। সেখানে গিয়ে দেখলাম, আপা নেই। আমি আবারও নীচে গেলাম। মাহরীন আন্টির ঘরে চেক করে দেখলাম, সেখানেও আপা নেই। দোতলায় গিয়ে দেখলাম আলো আপাকে কি যেন বলছে? আলো আমাকে দেখে বলল,”ভাবি কি যেন খেয়েছে? ” আমি আপার সামনে গিয়ে কিছু প্রশ্ন করার আগেই আমাকে দেখে আপা বলল যে, “সে এতদিন ভুল মানুষকে ভালোবেসেছে।” আমি আর আলো মিলে আপাকে বোঝাতে লাগলাম। মাশফি ভাইয়া ভীষণ ভালো মানুষ। তখন আপা আমাকে বলল, “সে আমাকে কোনোদিনও ভালোবাসেনি। সে আমাকে ভুলে অন্য নারীর ওপর আসক্ত হয়েছে”
আপার কথাগুলো আমি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নীচে দৌঁড়ে গেলাম মাহরীন আন্টিকে ডাকার জন্য। আন্টিকে ডেকে সিঁড়ির কাছে আসতে না আসতেই অঘটন ঘটে গেল। আপা পা পিছলে পরে গেল। চোখের সামনে এতকিছু হুট করে হয়ে গেল যে আমি শুধু দেখেই গেলাম। আপা আমার হাতটা ধরে যখন বলল,
“খবরদার, মাশফি যেন আমাকে স্পর্শ না করে, ইনায়া। “
আমি তখনই বুঝতে পারলাম মাশফি ভাইয়ার ওপর আমার আপার এত অভিমান, অভিযোগ কেন? হয়তো, আলোর সঙ্গে মাশফি…
ইনায়া কথা বন্ধ করে চোখের পানি মুছলো। তারপর, মাহরীনের দিকে তাকিয়ে আবারও বলতে শুরু করল,
–তারপর, তো আপা চলে গেল। শুধুমাত্র, আপার দেহটা যেন কাটাছেঁড়া করা না হয় সেজন্য আমি ডাক্তারের সঙ্গে চুক্তি করে আপার লাশ অক্ষত রাখি। কারণ, আপা বেঁচে থাকতে তার দেহে কোনোর আঁচড়ের দাগ পছন্দ করতো না। যদিও বেলিফুলের জন্য শেষমেশ আপার লাশটাকে কাটাছেঁড়ার মধ্যে যেতে হয়েছে। আমি সত্যি হয়তো অনেক খারাপ একটা মেয়ে। কিন্তু, খারাপ বোন নই। আমার আপার জানাযা যেন হয় আমি সেজন্য মৃত্যুর আসল কারণ লুকিয়ে রেখেছি।
ইনায়া চুপ হয়ে গেল। বুকের মধ্যে চেপে রাখা কথাগুলো বলে যেন আজ তার হালকা লাগছে ভীষণ। মাশফি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর, ইনায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— আমার সঙ্গে আলোকে জড়িয়ে নোংরা কথা বলতে তোমার মুখে বাঁধলো না?
— অস্বীকার করতে পারবেন আপনি আলোকে সেদিন ফুল দেননি ?
— দিয়েছি আলোকে। তবে তানিয়ার খোঁপায় গুঁজে দেয়ার জন্য। তুমি সাধারণ একটা দৃশ্য দেখে তুমি কত বড় একটা নোংরা দৃশ্যপট তোমার মস্তিষ্কে সাজিয়ে ফেলেছো, ভেবে দেখেছো?
ইনায়া মাথা নীচু করে ফেলেছে। সেই সঙ্গে মাহরীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেলীফুলকে বুকে জড়িয়ে চুপ করে বসে রইল। ইনায়ার কথা শুনে ঘটনার যাচাই-বাছাই না করে আলোকে আদালতের ন্যায় কাঠগড়ায় কোনো প্রমাণ ছাড়াই দোষী সাব্যস্ত করা উচিত হয়নি।
সুফিয়া বেগম সব জানার পর থম মেরে বসে আছেন৷ মেয়ের মৃত্যুশোক ভুলে যাওয়ার মত নয়। কিন্তু গত একমাস দশদিনে নিজেকে কিছুটা সামলে উঠেছিলেন। কিন্তু, আজ মূল ঘটনা জানার পর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মেয়েটা এত জেদি, একরোখা, নিজের প্রতি অবজেসড ছিল । যেই মেয়ে ছোটবেলায় রেগে গেলে নিজের হাতে কামড় দিতো। সেই মেয়ে যে বড় হয়ে এমন আত্মঘাতী হবে এমন ভাবনা কেন তাদের মাথায় এলো না? এমন সাজানো-গোছানো সংসার, ফুটফুটে একটা বাচ্চা, স্বামীকে রেখে কে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? আরে পাগল মেয়ে, তোর স্বামী যদি পরকীয়া করে থাকে, তাহলে কার সঙ্গে করেছে? তোর সঙ্গেই তো করেছে। সুফিয়া আর ভাবতে পারছে না। মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পরলেন।
মাশফির বুকটা কাঁপছে। সবার সামনে থেকে ধীরে ধীরে সে সরে গেল। নিজের ঘরটায় গিয়ে ঢুকল। বিছানায় টান হয়ে শুয়ে পরলো। তারপর, চোখ বন্ধ করে রইে। চোখের কার্নিশ বেয়ে অঝোর ধারায় চোখের জল গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছিল। প্রেম চলাকালীন সময়ে তানিয়া একবার মজারে ছলে বলেছিল, “যেদিন শুনব তুমি আমার না। আমি সেদিন সজ্ঞানে মৃত্যুকে গ্রহন করব”।
মাশফি তানিয়ার ডানহাতটা ধরে বুকের বা পাশের ওপর তানিয়ার হাত রেখে সেদিন বলেছিল,”এই হৃদয়ে যতদিন রক্ত সঞ্চালন থাকবে ঠিক ততদিন তুমি এই হৃদয়ে থাকবে। এখানে অন্যকারো হস্তক্ষেপের অবকাশ নেই”
মাশফি তো কালের পরিক্রমায় ভুলে গিয়েছিল সেই ওয়াদা, সেই স্মৃতি, সেই মূহুর্ত। কিন্তু, তানিয়া তো মনে রেখেছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তাকে যদি এতই ভালোবাসত তবে প্রকাশ করতো না কেন?কেন সে মিছে খেলায় জড়িয়ে গেল? তানিয়া কি একটিবার নিজেকে বোঝাতে পারেনি। মাশফি যাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সে আর কেউ নয় সে নিজেই। অভিমান করে বাপের বাড়ি চলে যেত। নয়তো মাশফিকে অন্য উপায়ে শাস্তি দিতো। কিন্তু, নিজেকে শেষ করে ফেলার মত নিকৃষ্ট অপরাধ কেন সে করতে গেল? বেঁচে থাকতে ভালোবাসা প্রমাণ যে করেনি! সে কেন মরে গিয়ে ভালোবাসা প্রমাণ করতে চাইলো? বেঁচে থেকে প্রমাণ করতো সে কতটা মাশফিকে ভালোবাসত!
— না, আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারিনি। আপনাকে বিয়ে করাটা কি কম অপরাধ মনে করেছেন? সেখানে আপনাকে ভালোবাসব আমি! এখন আমার অপরাধবোধ অনুভব যেন আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে।
আলো মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে পারল না৷ মেঘালয়ের পায়ের পাতার ওপর দৃষ্টি রেখে সে প্রশ্নের জবাব দিলো। মেঘালয়ের হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। বুকের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা এক অচেনা অনুভব! ওই যে পাখি যখন খাঁচা ছেড়ে চলে যায়। খাঁচা তখন শূন্যতায়, অনাদরে পরে থাকে। ঠিক তেমনি অনুভব হচ্ছে তার হৃদয়ে।
আলোর কাছ থেকে দুকদম পিছিয়ে গেল সে। পেছনে ফিরে দুই হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো শক্ত করে চেপে ধরল। আঙুলের চাপে মনে হচ্ছিল যেন চুলগুলো ছিঁড়ে হাতের মুঠোয় চলে আসবে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের তীব্র ওঠানামা তাকে অস্থির করে তুলছে। পেছনে ফিরল। আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমাকে ভালোবাসার কোনো কারণ খুঁজে পেলে না, তুমি মিথ্যাবতী?
মেঘালয়ের কথায় আলোর মাঝে হেলদোল হলো না৷ মেঘালয়ের মুখের দিকে ভুল করেও তাকালো না৷ চোর যখন চুরি করে অথবা মিথ্যাবাদী মানুষ যখন মিথ্যা বলে তখন কিন্তু সে নজর মেলাতে পারে না। আলোর বেলায় হয়তো সেই একই কারন ঘটেছে।
মেঘালয় ধপ করে বিছানায় বসে পরল। দুই হাতের কনুই ভাজ করে দুই উরুর ওপরে রাখল। তারপর হাতদুটোর ওপর থুতনি ঠেকিয়ে চুপ করে বসে রইল। ভালো লাগছে না কিছু! এতকিছু যে হলো সেখানে তার কি দোষ? মা’কে সে বরাবরই ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে সকল আবদার করেছে। বড়বেলায় এসে মনে হয়েছে আলোর ব্যাপারটা যদি কখনো জানতে পারে তাহলে তার মা মেনে নেবে। কিন্তু…
আলোকে শুরু থেকে ভালোবেসে ভালোভাবে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু, হঠাৎ কোন এক কালবৈশাখীর ঝড় এসে তাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল?
আলো মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকালো না। তাকে দেয়া মেঘালয়ের “মিথ্যাবতী” নামটা আজ যথার্থ সম্মান পেয়েছে। আলমারি খুলে তার বাবার বাড়ি থেকে দেয়া গহনা, শাড়ি-থ্রিপিস এবং তার সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে একটা লাগেজে গুছিয়ে রাখল। লাগেজের চেইন টানার শব্দ শুনে মেঘালয় অসহায়ের মতো তাকালো আলোর দিকে।
আলো তার পরনের কানের দুলজোড়া, গলার চেইন, হাতের চুড়ি খুলে এনে মেঘালয়ের হাতের সামনে বাড়িয়ে ধরল। মেঘালয় আলোর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল,
— পাগলামি বাদ দাও আলো। মন খারাপ থাকলে বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। আর এগুলো খুলে এনে আমার সামনে রাখার মানে কি?
মেঘালয়ের সামনে আর থাকা যাবে না৷ আলোর ভেতরটা কেমন দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে! মানুষটাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারছে না। অথচ, তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা এখন বাস্তবায়নের পথে। এত এত কথা বলতে পারে মানুষটা! অথচ, আলোকে একবার মুখ ফুটে বলে, “ভালোবাসি” বলতে পারে না। এবার নিজের প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্ণা জাগে। ডাক্তার সাহেব তাকে কখনো ভালোবাসেনি। এত মায়া, এত যত্ন হয়তো করুণার বহিঃপ্রকাশ ছিল।
তার মত একজন নারীকে একঘরে, একই বিছানায় জায়গা দেয়া যায়। কিন্তু, মনের অলিন্দে জায়গা দেয়া যায় না। আলো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বিছানার ওপর মেঘালয়ের পাশে গয়না গুলো রেখে বলল,
— কারণ, এগুলো আপনার দেয়া।
— আমার দেয়া বলেই কি রেখে যেতে হবে? আমার দেয়া অনেক কিছুই তো তুমি সঙ্গে করে বয়ে বেড়াচ্ছো। সেগুলো ফেরত দিয়ে যাও তাহলে।
মেঘালয় উঠে দাঁড়ালো। আলোর ডানহাতটা ধরে কাছে টেনে কথাগুলো বলল। আলো মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হাত ছোটাতে গিয়ে বলল,
— আপনার দেয়া কোনোকিছু আমি নিচ্ছি না। যা দিয়েছেন সব রেখে যাচ্ছি। আলমারীতে রাখা আছে সব।
— আমার তোমাকে দেয়া আদরগুলো ফেরত দিয়ে যাও তবে।
চলমান….
[আগামী পর্বে সমাপ্তি হবে। একটা পর্ব কিভাবে যেন বেড়ে গেল😔।]
Share On:
TAGS: তাহমিনা আক্তার, মেঘের ওপারে আলো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৪
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১২
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩৭
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২৮
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩৩
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩২
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২৫
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩১
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৬