প্রেমতৃষা
ইশরাতজাহানজেরিন
পর্ব_৪৯
পুরান ঢাকায় আসার পর আজকে একসপ্তাহ কেটে গেল। এতদিন শুয়ে-বসে কাটিয়েছে তৃষা। তবে কাল রাতেই ভার্সিটি থেকে কল এসেছে। সামনে পরীক্ষা, সেই পরীক্ষার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তৃষার সেই থেকে মাথা কাজ করছে না। একসময় মনে হতো পড়ালেখা ছাড়া জীবন চলবে না, এখন মনে হচ্ছে প্রেমের সঙ্গে প্রেম না করে ভার্সিটি গিয়ে পড়ালেখা করলেই বোধ-হয় জীবনটা তেজপাতা হয়ে যাবে। তৃষার ভোরে দুইবার বমি হয়েছে। রাতে খাবার বেশি খেয়েছে বলে, হয়তো এমন লাগছে। প্রেম ভোরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু ওই ডাক্তারের কাছে গিয়ে পয়সা নষ্ট করে কে? মাথা ব্যাথা হলে একেবারে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঔষধের লিস্ট বানিয়ে বিল ধরিয়ে আম জনতার টাকা চুষে খায়। একদিন তৃষা প্রেম নেওয়াজের মতোই ভুয়া ইন্জিনিয়ার হয়ে ওই ব্যাটাদের ওপর এমন এক্সপেরিমেন্ট করবে না। বলেই মুখটা ভেংচি কাটল।
আজ ভার্সিটিতে পৌঁছাতে তৃষার একটু দেরি হয়ে গেল। প্রেম কেবল গেট পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল। “ছুটি হলে নিয়ে যাব,” এই বলে। তৃষা মাথা নেড়ে কিছু বলল না। ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথেই তার বুকের ভেতর বিরক্তির হাহাকার উঠল। বায়োলজি! ডিএনএ রিপ্লিকেশন নিয়ে ব্যাখ্যা চলছে। স্লাইডে রঙিন গ্রাফ, শিক্ষকের একটানা গম্ভীর ব্যাখ্যা… সব মিলিয়ে তৃষার মাথা ঝিমঝিম। প্রেম নেই। ক্লাসে কোনো মজা নেই।
বাইরে রোদে চত্বর, ক্যাফেটেরিয়ার গন্ধ সবকিছু যেন তাকে ডাকছে। সে চেয়ারে বসে থেকে থেকে আর না পেরে সাইলেন্টে ফোন বের করে সময় দেখে। মাত্র দশ মিনিট গেছে! “উফ, আর কত?” তৃষা মনে মনে বলেই আবার সামনে তাকিয়ে থাকার ভান করে। শেষমেশ বিরক্তি চরমে পৌঁছালে সে চুপচাপ বই গুছিয়ে নিল।
পেছনের সারি দিয়ে কেউ বুঝবার আগেই বের হয়ে গেল বায়োলজির সেই নীরস লেকচার থিয়েটার থেকে।
চত্বরের বাতাসে এসে যেন তৃষার মাথা হালকা হলো।
এই জায়গাটা তার কাছে বিশেষ—এখানেই একদিন ঘৃণাভরা চোখে প্রেমের দিকে তাকিয়েছিল। আর এখানেই প্রথম প্রেমের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিল। সে গভীর শ্বাস নিয়ে বেঞ্চে বসলো। ফেসবুক খুলতেই চোখ ছানাবড়া! প্রিমরোজ ব্যান্ডের আঁধারের লাইভ কনসার্ট!
মাত্র দুই দিনের মাথায়! তৃষার হাত কাঁপতে লাগল।
এতদিন ধরে অপেক্ষা করা কনসার্ট… অবশেষে!
কিন্তু! টিকেট কোথায় পাবে? ঠিক তখনই একটা ছেলে এসে তার পাশে বসল। তৃষা গুরুত্ব দিল না, ফোনেই ডুবে রইল। হঠাৎ ছেলেটা বলল,
“শুনছেন… মানে… হ্যালো?”
তৃষা তাকিয়ে মাপঝোক করল। জুনিয়র মনে হচ্ছে।
“তোমাকে তো আগে দেখিনি। কোন ব্যাচ?”
“ফাস্ট সেমিস্টার। আপনিও আমার ব্যাচের তাই না?”
তৃষা ভেতরে ভেতরে হাসি চেপে রাখল।ছেলেটা যে তাকে পটানোর চেষ্টা করছে, তা তার চোখ এড়ায়নি।সে দুষ্টুমি করে বলল, “হ্যাঁ কোনো সাহায্য চাই নাকি?”
“না মানে… আপনাকে সকাল দেখেছিলাম। আবারও দেখলাম। আচ্ছা একটা সাহায্য চাই। আমার ফোনটা না পাচ্ছি না। যদি আপনার ফোনটা দিয়ে একটু কল দিতেন।”
তৃষা বুঝতে পারল এই ছেলের যে নাম্বার চাই। আজ কালকের ছেলেগুলোও না। সরাসরি কিছু বলতে পারে না। তৃষা একটু ঢং করে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ সাহায্য করতে সমস্যা নেই।” সে ছেলের নাম্বারটা ফোনে ডায়াল করল। তবে কল করল না। কেবল বলল, “প্রেমিকা নেই?”
“না, তবে কেউ একজন চাইলেই হতে পারে।” সে আরেকটু এগিয়ে বসতেই তৃষা চেপে দূরে সরে বসে। প্রেম নেওয়াজের চোখ তো নয় যেন বাজপাখি! কোথা থেকে দেখে ফেলে।
“কই কলটা দেন। ফোনটা তো খুঁজে পাচ্ছি না।” তৃষা ফোনে হাত দেওয়ার আগেই পেছন থেকে প্রেম এসে তার কাঁধে হাত রেখে পিঠে চাপড় মেরে বলে, “ওমা ভাইয়া আপুরা আপনারা কি কাপ্পল নাকি? সিনিয়র লাগছে। সালাম ভাই, সালাম আপুজান। চা এনে দিব?”
ছেলেটি গর্বে ভুলে ওঠে। প্রেমের পাশেই অংকুর দাঁড়িয়ে। সেও মজা নিচ্ছে। তৃষার ভয়ে বুক ধুকপুক বাড়ছে। নিজের জন্য নয় বরং এই ছেলের জন্য। প্রেম ভান করে ছেলেটিকে ধাক্কা দিতেই সে গুটা খেয়ে উঠে দাঁড়ায় একমুহূর্তে। পরক্ষণেই প্রেম হেসে বলল, “আরে ভাই দেখেন আপনার পাছার নিচে কি এটা? আমি প্রাণ বাঁচালাম।”
“কি? কার প্রাণ বাঁচালে? “
“আপনার পাছার নিচে বেঞ্চ, আমি আপনার কাঠির মতো শক্তপাছাটা বেঞ্চের ওপর থেকে সরিয়ে বেঞ্চের প্রাণ বাঁচালাম।” বলেই সে অংকুরের দিকে তাকাতেই অংকুর ছেলেটির কাঁধ শক্ত করে চেপে তাকে নিজের সঙ্গে দিয়ে যায়। যেতে যেতে বলে, “চলো ভাই তোমাকে আজকে পাছার গল্পকাহিনী শুনাবো। একটু চিপায় তো আসো।” ছেলেটিকে অংকুর নিয়ে যেতেই তৃষা একবার প্রেমের দিকে তাকালে। জিন্সের পকেটে হাত গুজে আছে সে। চোখ দুটো অদ্ভুত ঠান্ডা… আর ঈর্ষায় হালকা জ্বলে উঠা।
তৃষা ঠোঁট কামড়ে হাসি থামাল।
প্রেমের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, “আরও এক সেকেন্ড কথা বললে ওই ছেলেটা বাঁচত না। যদিও জানা আছে চিপায় নিয়ে থেরাপি একটা দিবেই। যাতে পরবর্তীতে সিনিয়র না চিনেই টাংকি মারতে চলে না আসে, আর প্রেম নেওয়াজের বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার কথা তো মাথায় ভুলেও না আসে।”
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ভয় পাই নাকি?” বলেই নাক কুঁচকালো তৃষা।
প্রেম শব্দ না করে তার হাতটা শক্ত করে টেনে তাকে দাঁড় করাতেই সে চেঁচিয়ে বলল, “একটা মারাত্মক খবর আছে। শিমলাকে বলতে হবে। সে আগে আসুক তারপর যাব।”
“ইঁদুরমুখী মুখটা অফ করো দয়াকরে। পাপের লেভেল তোমার একধাপ বাড়ছে শালী। বাসায় চলো আগে, ফোনটা যদি না ভেঙেছি আজ। ইশ শখ কত নিজের নাম্বার দিয়ে আরেক ছেলেকে কল দিতে যাওয়া!”
“দেই তো নি।”
“আমি না আসলে তো দিতেই।”
তৃষা কি বলবে না, না বলবে ভাবতেই হঠাৎ প্রেমকে বলে উঠল, “আই লাভ ইউ।”
“বাট আই ওয়ান্ট টু ফাক ইউ মাই ফাকিং উইচ।” বলেই প্রেম তৃষাকে টেনে বাইকের কাছে নিয়ে গিয়ে হ্যালমেটটা পড়িয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় বাইকে বসতে বলল। সেই শীতল চাহনিতে তৃষার বুক কেঁপে উঠল। মাইরি আজ বোধ-হয় ডাইরেক্ট দয়ালের দর্শন করিয়ে ছাড়বে এইলোক।
তখন সন্ধ্যা রাত। তৃষা প্রেমের সেই বদ্ধ রুমটায় আজকে আবারও পাসওয়ার্ড দিয়ে তা খোলার চেষ্টা করেছে। তবে পারেনি। এখন যেন ওই রুমের পেছনে লুকিয়ে থাকা গল্পটা জানতে তৃষা আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। আজকে ভার্সিটি থেকে বাসায় আসার পর গোসল করে বাইরে আসতেই একটা শব্দ কানে আসে তৃষার। এক পা দুই পা দরজা খুলে বাইরে আসতেই কোণের শেষ রুমটার দিকে চোখ যায়। প্রেম দরজা লক করে ভেতর থেকে বের হয়েছিল। তবে প্রেম তৃষাকে দেখার আগেই সে রুমের ভেতর চলে যায়। প্রেম বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারলে তো অবশ্যই ভেতরে এসে জিজ্ঞেস করত। দুপুরে না খেয়েই লোকটা বের হয়। এখনো ফেরার নাম নেই। তৃষার ইচ্ছে করছে না, বাসার সামনের কৃত্রিম বনটা পার করে নেওয়াজ কুটিরে যেতে। সে বই হাতে নিয়ে বারান্দায় বসল। হাতে একটা ইংরেজি বই। বইয়ের ১৮ নাম্বার চ্যাপ্টারে গিয়ে থমকে যায় সে। কেমন যেন শিহরণ কাজ করে তার। হঠাৎ বাইরে থেকে লুফির চিৎকারের শব্দ শুনতে পায়। ঘেউ ঘেউ করছে সে। তৃষা বইটা রেখে উঠে দাঁড়ানোর আগেই বিদ্যুৎ চলে যায় তার। একটা ভয়ে গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে তার। ফোনটা কোথায় পাচ্ছে না। অন্ধকার হাতড়ে কোনোমতে খাটের কাছে যেতেই শুনতে পায় হাটার শব্দ। সিঁড়ি বেয়ে কেউ উপরে আসছে। শব্দ বাড়ে, সঙ্গে তার ভেতরের আতঙ্ক। আচ্ছা সে কি হাতের বইয়ের গল্পের ভেতরে প্রবেশ করেছে নাকি সবটা কেবল স্বপ্ন? ভাবতে না ভাবতেই সেই শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এটাও তো ভয়ের আরেকটা কারন। তৃষার দরজায় তখনো পাসওয়ার্ড মারা। যেই হোক না কেন ভেতরে আসতে পারবে না। তবে সবটা তৃষার ভুল ধারণা । দরজা খুলে গেল। তৃষা ভয়ে খাটের কোণে গিয়ে চুপসে বসে থাকে। এমনিতেও প্রত্যুষের সেইসব বিভীষিকা ময় অত্যাচারের কথা এখনো ভুলতে পারিনি সে। কখনো পারবেও না। ওইসব তাকে তাড়া করে বেড়াবে। লোকটা লম্বাচওড়া। ছায়া দেখা যাচ্ছে কেবল অন্ধকারে। লোকটি পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করল। তা অন্ধকার ধরাতেই এক ঝলক তাকে দেখা গেল। তবে সবটা এত জলদি হলো তৃষা দেখার সুযোগ পেল না। লোকটা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে এক পা দুই পা করে এগিয়ে এসে তৃষার সামনে বসতেই সে বলে কেঁপে উঠল, “ইয়োর ফিয়ার গিভ্স মি প্লেজার।”
চলবে?
( আর মাত্র একটা পর্ব। অনুভূতি কী? সবাই বেশি বেশি রেসপন্স করবেন। একটু সমস্যা ছিল তাই এডিট করছি। সবাই একটু নতুন করে পেইজে প্রবেশ করলে পড়েন।)
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা ৪২ (প্রথম অর্ধেক)
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৪৭
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৪৬(১ম অর্ধেক)
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৬+৭
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৭+১৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩৫+৩৬
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২+৩
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৯+২০