Golpo romantic golpo অবাধ্য হৃৎস্পন্দন

অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৫


অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (০৫)

সোফিয়া_সাফা

উদ্যান ফোনটা রেখে মাহবুবা সুলতানার দিকে তাকায়। ঠিক তখনই স্যুট ব্যুট পড়া দুজন ভদ্রলোক বাড়ির ভেতর ঢুকল। তারা সোজা উদ্যানের সামনে এসে দাঁড়াতেই মাহবুবা সুলতানা হতভম্ব হয়ে গেলেন। দুজন লোকের মধ্যে একজন হচ্ছে তাদের পারিবারিক লয়ার আরেকজন হচ্ছে তাদের ম্যানেজার। খানজাদা ফ্যাশন হাউস সহ পুরো দেশে মোট পাঁচটি ব্রান্ডেড শোরুম আছে। এগুলো মূলত তাদের পারিবারিক বিজনেসের অংশ। এতোদিন যাবত এগুলোর দায়িত্ব ম্যানেজারের উপর ছিল। এই ম্যানেজার ছিলেন উদ্যানের বাবা তাশরিফ খানজাদার বিশ্বস্ত বন্ধু। তাশরিফ খানজাদার অবর্তমানে ম্যানেজার হিসেবে তিনিই ব্যাবসা দেখাশোনা করেছেন। তাদের দুজনকে একসাথে আসতে দেখে মাহবুবা সুলতানা ঘামতে লাগলেন। উদ্যান ঠিক কি করতে চাইছে বুঝতে না পারলেও সে খানিকটা আঁচ করতে পারছেন।

“তেহজিব খানজাদা কেমন আছো? বহুবছর পর দেখা হলো।”

ম্যানেজারের কথার উত্তরে উদ্যান সোজা হয়ে বসল,
“আমি তো ভালো আছি আংকেল। সমস্ত রেকর্ড গুছিয়ে এনেছেন তো?”
“জি,”

ম্যানেজার হাতে থাকা ফাইলগুলো খুলে দেখাতে চাইলে উদ্যান বাধা দিয়ে বলল,
“লাগবেনা, আমি কিছুই দেখতে চাইনা। আপনারা বসুন।”

ম্যানেজার আর লয়ার সামনে থাকা সোফায় বসলেন।
“লয়ার আংকেল আপনাকে যেসব পেপার রেডি করে আনতে বলেছিলাম এনেছেন?”

লয়ার হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে কিছু পেপার্স উদ্যানের সামনে থাকা টেবিলের উপর রাখলেন। উদ্যান পেপার্সগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। মাহবুবা সুলতানা এবার লয়ারকে প্রশ্ন করলেন,
“এগুলো কিসের পেপার ভাই?”

লয়ার অবাক চোখে মাহবুবা সুলতানার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ভাবী আপনি কিছুই জানেন না?”

মাহবুবা সুলতানা জোরপূর্বক হেসে বললেন,
“না তো। কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নাকি?”

লয়ার গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“তেহজিব নিজের স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি দান করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

কথাটা শুনে মাহবুবা সুলতানার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল যেন।
“কিহ! উদ্যান তুমি এসব করতে পারোনা।”

উদ্যান গম্ভীর গলায় বলল,
“আমি কি কি করতে পারি সেই সম্পর্কে ধারণা খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবেন।”

মাহবুবা সুলতানার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল,
“তুমি কি চাও আমাকে বলো, আমি সব করবো। শুধু আমাদেরকে নিঃস্ব করে দিওনা বাবা।”

উদ্যান কিছুক্ষণ স্থির থেকে মাহবুবা সুলতানার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল,
“মেলো আমাকে বিয়ে করবেনা বলে পালিয়ে গেছে। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই। আমার ওয়াইফ প্রয়োজন। আজকেই বিয়ে করতে হবে।”

মাহবুবা সুলতানা হাপ ছেড়ে বললেন,
“এ আর এমন কি আমি আজকেই তোমার জন্য মেয়ের ব্যবস্থা করব।”

উদ্যান কোনো প্রকার ভণিতা না করেই বলল,
“আমি অন্য কাউকে না ফারহান আমহৃতের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সর্বস্ব হারাতে না চাইলে আপনি নিজেই ওকে আমার হাতে তুলে দেবেন।”

মাহবুবা সুলতানা অবিশ্বাস্য চোখে উদ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল।
“তুমি এসব কি বলছো? তুমি তো ওকে দেখতেই পারোনা, তাহলে হঠাৎ করে কেন ওকে বিয়ে করতে চাইছো?”
“আমি কৈফিয়ত দেবোনা। যা বলেছি তা করবেন কিনা বলুন।”

মাহবুবা সুলতানা শাড়ির আঁচলে চোখজোড়া মুছে মিনতির সুরে বললেন,
“তুমি বলেছিলে ফুলকে আবেশের থেকে কেড়ে নেবেনা। তাহলে এখন কেনো করছো এসব?”
“আমি কেড়ে নেবোনা। আপনারা নিজে থেকেই ভালো ভাবে ওকে ছেড়ে দিন। যদি না ছাড়েন তাহলে নিঃস্ব হওয়ার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করুন। আজকে কোনো ভাবে যদি বিয়েটা না হয় তাহলে আগামী কালকে এই বাড়িটাও নিলামে উঠবে।”

কথাটা বলেই উদ্যান পেপার গুলো টেবিলের উপর রেখে সাইন করতে উদ্যত হতেই মাহবুবা সুলতানা তাকে থামায়,
“তুমি যা বলবে তাই হবে। এখানে সাইন কোরোনা।”

উদ্যান থেমে গিয়ে দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে লয়ার আর ম্যানেজারের উদ্দেশ্যে বলল,
“বিয়েটা হলে আপনারা খাওয়া দাওয়া করে যাবেন। আর নাহলে বাড়ির জঞ্জাল সরাতে আমাকে হেল্প করবেন।”

লয়ার আর ম্যানেজার মাথা নেড়ে উঠে দাড়াল। তারপর ধীরেসুস্থে ডেকোরেশনের জায়গায় চলে গেল।

“অল্রেডি দুটো বেজে গেছে। আড়াইটার মধ্যে ম্যারিজ রেজিস্ট্রার এসে পড়বে। আপনি গিয়ে সবকিছু রেডি করুন।”

মাহবুবা সুলতানা ধীরগতিতে উঠে দাড়ালেন।
এদিকে রেহানা বেগম ফুলের চুল মুছে দিচ্ছেন। মেয়েটা কিছুক্ষণ আগেই গোসল করে এসেছে। এরইমাঝে সুনেরা আর মেহেক রুমে ঢুকল,
“জানো ফুল কি হয়েছে?”

মেহেকের কথা শুনে ফুল ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কি হয়েছে? আর তোমরা এই সময় এখানে কেন? তোমাদের দুজনকে না আমি মুলো… না মানে মেলো আপুকে সাজিয়ে দিতে বলেছিলাম। একটু সাজিয়ে দেওনা গিয়ে, আমার পায়ে ব্যাথা তো তাই শাওয়ার নিতে গিয়ে লেইট হয়ে গেছি।”
“আরে ফুল সাজিয়ে দেবো কাকে? মেলো আপু তো পালিয়ে গেছে।”

সুনেরার কথা শুনে ফুলের মুখ হা হয়ে গেল,
“কি? কি বলছো? পালিয়ে গেছে মানে? কখন, কিভাবে আর কেনো পালিয়ে গেছে?”

তাদের কথার মাঝেই মাহবুবা সুলতানা ধীরপায়ে রুমে প্রবেশ করলেন,
“সুনেরা আর মেহেক তোমরা রেডি হয়ে নেও।”
“কিন্তু খালামনি…
“সময় নেই মেহেক, যা বললাম তাই করো।”

সুনেরা আর মেহেক মাথা নেড়ে চলে যেতেই রেহানা বেগম বললেন,
“ওরা রেডি হয়ে কি করবে? মেলো নাকি পালিয়ে গেছে? তা মেয়েটা পালিয়ে গেল কেন?”

মাহবুবা সুলতানা তড়িৎ গতিতে এগিয়ে এসে রেহানা বেগমের হাত ধরে কান্নাজরিত কন্ঠে বললেন,
“আমাদেরকে নিঃস্ব হওয়া থেকে বাচাও বোন।”

তার এহেন কথা শুনে রেহানা বেগমের সাথে সাথে ফুলও অবাক হয়ে গেল,
“তুমি এসব কি বলছো ভাবী?”
“হ্যাঁ আমি ঠিকই বলেছি বোন। উদ্যান ফুলকে বিয়ে করতে চাইছে। একমাত্র ফুলই পারবে আমাদেরকে নিঃস্ব হওয়া থেকে বাচাতে।”

“কিহ?”

একসাথে তিনজন উক্ত বাক্যটি উচ্চারণ করল। মাকে একপ্রকার ছুটে আসতে দেখে আবেশও তার পিছু পিছু এসেছিল। এদিকে ফুল তো তাজ্জব বনে গেছে। এটা কিরকম মজা করছে মামী? ভাবতেই শরীর কাটা দিচ্ছে। আবেশ এসে মাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“মম তোমার মাথা ঠিক আছে? তুমি জানো তুমি কি বলছো?”

মাহবুবা সুলতানা ঝাড়া মেরে আবেশের হাত সরিয়ে দিলেন,
“তুই এসবের মধ্যে আসবিনা আবেশ।”
“আসবোনা মানে? তোমার বড় ছেলে যখন যা চাইবে তখন তাই দিতে হবে? মগের মুল্লুক নাকি?”

রেহানা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,
“আবেশ দাঁড়াও, আগে ভাবীকে বলতে তো দেও।”

আবেশ বিছানায় বসে পড়ল। বাইরে থেকে শান্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে তার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছে। মাহবুবা সুলতানা নিজেকে সামলে নিয়ে আবেশের উদ্দেশ্যে বললেন,
“আবেশ তুই যা এখান থেকে ফুল আর রেহানার সাথে আমার আলাদা কিছু কথা আছে।”
“কি এমন কথা যা আমার সামনে বলতে পারবেনা?”

মাহবুবা সুলতানা তেতে উঠলেন। তার হাতে সময় নেই। তাছাড়া এসব ব্যাপারে আবেশকে কিছুই বলতে পারবেনা।
“তুই যদি এখনই এই রুম থেকে বেরিয়ে না যাস তাহলে আমি যেদিকে চোখ যাবে সেদিকে চলে যাবো।”

আবেশের শরীর অসাড় হয়ে এলো। উঠে দাড়িয়ে দরজা অবধি এসে ঘুরে তাকাল ফুলের দিকে। অসহায় ভঙ্গিমায় না বোধক মাথা নেড়ে কিছু বোঝাতে চাইলো। ফুল সেটা বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে নিল। আবেশ চলে যেতেই মাহবুবা সুলতানা দরজা লাগিয়ে দিয়ে এলেন। তারপর তাদের দুজনের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন,
“উদ্যান সহায় সম্পত্তি সহ ব্যাবসা বানিজ্য সবকিছু দান করে দিতে চাইছে। শুধু এটুকুই নয় এই বাড়িটাও সে নিলামে তুলবে।”

ফুল বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল,
“মানে? সবকিছু তার একার নাকি যে যা ইচ্ছা তাই করবে?”

মাহবুবা সুলতানা আর রেহানা বেগম একে অপরের দিকে তাকালেন। ফুল বুঝতে পারলো তারা কিছু লুকাচ্ছেন,
“কি হলো? বলো, তুমি এতো ভয় কেন পাচ্ছো মামী? তুমি মামার বউ। আবেশ ভাই মামার ছোট ছেলে। তোমাদেরও তো অধিকার আছে তাইনা?”

মাহবুবা সুলতানা কিছু বলতে চাইলে রেহেনা বেগম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
“তোর মামা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পূর্বে নিজের সহায় সম্পত্তি সব নিজের বড় ছেলের নামে দিয়ে গেছেন। তাই সে যা চাইবে তাই করতে পারবে।”

ফুলের চোখ বড়বড় হয়ে গেল। এটা কেমন কথা? তার মামা এটা কিভাবে করতে পারেন? তার ভাবনার মাঝেই রেহানা বেগম বলে উঠলেন,
“ছেলেটা যা ইচ্ছা করুক গিয়ে। অনেক সহ্য করেছি কিন্তু এটা আমি মেনে নিতে পারবোনা ভাবী। ক্ষমা করো আমাকে। নিজের মেয়েকে কোরবানি করার মতো হৃদয়হীন হতে পারবোনা।”

মাহবুবা সুলতানা কি বলবেন ভেবে পেলেন না। আর যাই হোক এইক্ষেত্রে সে জোর করতে পারবেন না। এরইমাঝে রেহানা বেগমের ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। সে ফোনটা হাতে নিয়ে মেইল টা চেক করতেই চমকে উঠলেন। মেইলে স্পষ্ট ভাষায় লেখা,
আপনার সো কল্ড মেয়েকে আমার হাতে তুলে না দিলে আমি আপনার প্রাণপ্রিয় মানুষটাকে উপরে পাঠিয়ে দেবো। আশা করি আমি কার কথা বলেছি সেটা আপনি বুঝতে পেরেছেন।

মেইল টা পড়ে রেহানা বেগম ধপ করে খাটের উপর বসে পড়লেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন,
“ফুল উদ্যানকে বিয়ে করবে ভাবী। আপনি সব ব্যবস্থা করুন।”

আচমকা রেহানা বেগমের সম্মতিতে বেশ অবাক হলেন মাহবুবা সুলতানা। ফুল নিজেও বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় মায়ের দিকে,
“মা তুমি এসব কি বলছো? এসব বলোনা মা। দরকার হলে আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে বানের জলে ভাসিয়ে দিও তবুও ওই মনস্টারের হাতে তুলে দিওনা।”

ফুলের কান্না দেখা মাহবুবা সুলতানাও কেঁদে উঠলেন। সেও তো চায়না ফুলকে উদ্যানের হাতে তুলে দিতে। আবেশের মনোভাবও যে তার অজানা নয়। ছেলেটা যে ফুলকে ভালোবাসে। আর সেও তো ফুলকে বউমা বানাবে বলে ঠিক করে রেখেছিল।

“তুই এই বিয়েটা করবি ফুল। আর এটা তোর মায়ের আদেশ।”

ফুল ঠোঁট চেপে কেঁদে উঠল, এরই মাঝে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ ভেসে আসে। কেউ একজন অনবরত দরজা ধাক্কাচ্ছে। মাহবুবা সুলতানা দরজা খুলে আবেশকে দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। আবেশ বিদ্যুৎ বেগে ফুলের সামনে এসে দাঁড়াল। ফুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে ফুলের হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগে।
“আমি এখনই তোকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”

ফুলকে একপ্রকার টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে লাগল আবেশ কিন্তু পথিমধ্যে রেহানা বেগম আর মাহবুবা সুলতানা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
“ফুলের হাত ছেড়ে দেও আবেশ।”
“না ফুপি, তুমি সরে যাও সামনে থেকে। ফুল আমার সাথে যাবে।”

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ফুল আকুতি করে বলল,
“আমি তোমার সাথে যাবোনা আবেশ ভাই। ছেড়ে দেও আমাকে।”

ফুলের মুখ থেকে উক্ত কথাটি শুনে আবেশ ফুলের হাত ছেড়ে দিয়ে তার গালে হাত রাখল,
“তুই ভুল করছিস ফুল। এনারা শুধু মাত্র নিজেদের স্বার্থে তোকে বিসর্জন দিয়ে দেবে। তুই এনাদের ফাঁদে পা দিসনা।”

আবেশের হাত খুব সন্তর্পণে সরিয়ে দিল ফুল।
“এনারা আমাকে বিসর্জন দিয়ে শান্তি পেলে আমি বিসর্জন হতেও প্রস্তুত।”

আবেশ আর কি বলবে? মায়ের বিরুদ্ধে গিয়েও সে ফুলের হাত ধরতে চেয়েছিল কিন্তু ফুল যেখানে নিজেই আত্মাহুতি দিতে চায় সেখানে সে কি করে ফুলকে বাচাবে? সব কথার উর্ধ্বে সে নিজে কিভাবে বাচবে? সে যে ফুলকে ভালোবাসে।
“তুই মম আর ফুপির কথাই ভাববি? আমার কথা ভাববি না?”

ফুল ছলছল নয়নে আবেশের দিকে তাকায়। সে আবেশের কথা ভাবেনি কে বলেছে? সবচেয়ে বেশি আবেশের কথা ভেবেই সে এই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবেশ পুনরায় ফুলের গালে হাত রাখল,
“এই ফুল। দ্যাখ আমার দিকে। তুই আমার কথাটা একবার ভাব…

আবেশ আর কিছু বলার আগেই মাহবুবা সুলতানা ছেলেকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন,
“আমাদের হাতে সময় নেই আবেশ। তুই যা এখান থেকে।”

আবেশ কোনো কিছু না ভেবে মায়ের পা জড়িয়ে ধরল,
“মম এমনটা কোরোনা। আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো। আমি মেনে নিতে পারবোনা এসব। এতো বড় অন্যায় কোরোনা আমার সাথে।”

ফুল অবাক চোখে আবেশের কান্না দেখল। আবেশ তার জন্য কাদছে? তাহলে কি আবেশ তাকে ভালোবাসে? ভাবনাটা যেন মন গহীনে উথাল পাথাল ঝড় তুলল। ফুল কিছু বলতেই যাবে তার আগেই রেহানা বেগম তার হাত ধরে অন্যদিকে নিয়ে গেল,
“আমরা যা করছি আবেশের ভালোর জন্যই করছি। এতে সবচেয়ে বেশি আবেশের ভালো হবে।”

তাদের কথার মাঝেই মাহবুবা সুলতানা আবেশকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তারা চলে যাওয়ার পর ফুল মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“আবেশ ভাইয়ের আকুতি দেখেও বুঝতে পারছোনা যে সে আমাকে ভালোবাসে? আমাকে ছাড়া এই সম্পত্তি পেয়ে তার কি এমন ভালো হবে?”

রেহানা বেগম কিছু বলার আগেই মাহবুবা সুলতানা ফিরে এলেন। সে আবেশকে রুমে লক করে রেখে এসেছেন।
“আবেশ ভাই কোথায়? তাকে কোথায় রেখে এলে?”

মাহবুবা সুলতানা কাঠকাঠ গলায় বললেন,
“তুই ওর কথা ভাবলে বিয়েটা করে নে ফুল। ভালোবাসার থেকেও সম্মান বড়। তুই এই বিয়েটা না করলে আমাদেরকে মান সম্মান খুইয়ে পথে বসতে হবে। আবেশের পড়াশোনাও শেষ হয়নি। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলে অন্তত একটা চাকরি বাকরি করে সংসার চালাতে পারতো। ওর তো সেই বয়সটাও হয়নি। ছেলেটার সবেমাত্র ২২ বছর শেষ হলো। আবেশকে আমি অনেক আদর যত্নে বড় করেছি মা। বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে ওর কোনো ধারণাই নেই। এমতাবস্থায় সহায় সম্বল হারিয়ে কিভাবে বাচবো আমরা? তার উপর উদ্যান তো আছেই। তুই এই বিয়েটা না করলে ও আমাদের জীবন দূর্বিষহ করে তুলবে।”

মাহবুবা সুলতানার কথাগুলো বিষের ন্যায় ফুলের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল। আচ্ছা, তিনি তো শুধু নিজেদের কথাই ভাবলেন? কই ফুলের কথা তো একবারও ভাবলেন না। অবশ্য যেখানে স্বয়ং জন্মদাত্রী ফুলের কথা ভাবছে না। সেখানে মাহবুবা সুলতানা আর কতটুকই বা ভাববেন? ফুল নিজের চোখজোড়া মুছে শান্ত গলায় বলল, “চিন্তা কোরোনা মামী, আমি ওই মনস্টারকে বিয়ে করে নেবো কিন্তু তার আগে আমি তার সাথে একবার কথা বলবো।”

ফুল রুম থেকে বের হয়ে দেয়ালে ভর দিয়ে দিয়ে হাটতে লাগল। ডান পায়ের পাতায় ভীষণ ব্যাথা। পা ফেলা মুশকিল। কিছুটা হাটার পর আবেশের চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এলো। ফুল সেদিকে যেতে নিয়েও মাহবুবা সুলতানার ডাকে থেমে যায়।
“দরজা খুলিস না। কিছুক্ষণ চিল্লাচিল্লি করার পর ও নিজে থেকেই শান্ত হয়ে যাবে।”

ফুল ঠোঁট চেপে কান্না নিয়ন্ত্রণ করে উদ্যানের রুমের দরজায় নক করল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলনা। দরজায় হাল্কা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়। খোলা অংশটুকু দিয়ে উঁকি দিতেই ফুল দেখল উদ্যান খাটের শেষপ্রান্তে বসে আছে। হাতে একটা গ্লাস, গ্লাসের মধ্যে একধরনের সবুজ রঙা তরল। আরও অদ্ভুত ব্যপার হলো উদ্যানের দৃষ্টি তার দিকেই স্থির। ফুল সাহস জুগিয়ে এতদূর পর্যন্ত চলে তো এসেছে কিন্তু উদ্যানের এরূপ চাহনি দেখে তার সব সাহস যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
“কিছু বলবি?”

ছুরির ন্যায় ধারালো উদ্যানের কথার পিঠে ফুল শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল।
“তারাতাড়ি বল। আমার হাতে বেশি সময় নেই। তুই বিয়ে করতে রাজি না হলে সবকিছু নিলামে তুলবো। এগুলো অনেক সময়ের ব্যাপার।”

ফুল ছুটে এসে উদ্যানের সামনে দাঁড়াল।
“কেন করছেন এমন? আমার সাথে আপনার কিসের শত্রুতা?”

উদ্যান হাতে থাকা গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল,
“শত্রুতা তো অবশ্যই আছে। সেটা আস্তে আস্তে খোলাসা হোক।”

ফুল ঠোঁট চেপে ভাঙা গলায় বলল,
“ধরে নিলাম আমার সাথে আপনার শত্রুতা আছে তাই বলে আপনি নিজের ভাইয়ের সাথেও অবিচার করবেন?”

ভাই শব্দটা শুনে উদ্যান জ্বলন্ত চোখ ফুলের দিকে তাকায়। তার সেই চাহনি দেখে ফুল একটা শুষ্ক ঢোক গিলল,
“তুই কার কথা বলছিস? আমার তো কোনো ভাই নেই। শুধু ভাই কেন এই পুরো দুনিয়ায় আমার কেউ নেই।”

ফুল এবার না পেরে চেচিয়ে উঠল,
“উদ্ভট কথা বলবেন না। এসব খেতে খেতে মাথার তাঁর ছিড়ে…

ফুল নিজের কথা শেষ করার আগেই উদ্যান উঠে এসে তার গলা চেপে ধরল,
“ইউ ব্লাডি মিস্টেক আমার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলার সাহস কোথায় পেলি? বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি বলে নিজের অওকাত ভুলে যাসনা। আমি তোকে বিয়ে করবো শুধু মাত্র নিজের প্রয়োজনে। শুধুমাত্র তোকে কষ্ট দিতে। ১৮ বছর আমার টাকায় অনেক মৌজ-মস্তি করেছিস। সেসবের হিসাব সুদে আসলে আদায় করে নেবো।”

গলা চেপে ধরার কারণে ফুলের শ্বাসকষ্ট শুরু হল। উপায়ন্তর না পেয়ে উদ্যানের হাতে নিজের নখ দাবিয়ে দিল। কিন্তু তাতেও উদ্যানের মাঝে ভাবান্তর হলোনা। কিছুক্ষণ পর উদ্যান নিজে থেকেই তাকে ছেড়ে দেয়। ফুল টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পড়ে। উদ্যান উল্টো ঘুরে বেডের দিকে এগিয়ে যেতেই ফুল ভাঙা গলায় বলে ওঠে,
“আবেশ ভাইকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিলে তবেই আমি আপনাকে বিয়ে করবো। নয়তো করবো না।”

কথাটা শুনে উদ্যান তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“ওর পাওনা ওর বাপের কাছ থেকে বুঝে নিতে বল গিয়ে। আমাকে বলছিস কেন?”
“মামাকে কোথায় পাবো? সে তো নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। তাছাড়া সব সম্পত্তি আপনার একার নামে লিখে দিয়ে সে নিজেই তো অবিচার করেছেন।”

উদ্যান প্রতিউত্তরে কিছু না বলে বিছানায় বসে পড়ল। রাত থেকে অনবরত ড্রিংকস করার কারণে তার মতো হাই টলারেন্স করতে পারা ব্যাক্তিও নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। উদ্যান বেশ কয়েকবার মাথা ঝাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“আমি তোকে বেশি সময় দিতে পারবো না। ম্যারিজ রেজিস্ট্রার নিচে অপেক্ষা করছে।”
“আপনি যদি বিয়ের পরেও আবেশ ভাইকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেন তখন?”

উদ্যান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি সবকিছুর ৫০% আবেশের নামে লিখে দিতে রাজি আছি। বিনিময়ে তুই আমার সাথে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি?”

কথাটা শুনে ফুল চমকিত নয়নে উদ্যানের দিকে তাকায়।
“বল রাজি আছিস?”

ফুল চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। মাথা নেড়ে বলে,
“আগে আবেশ ভাইয়ের প্রাপ্য তাকে বুঝিয়ে দেবেন তারপরই আমি বিয়ের পেপারে সাইন করবো।”
“ওকে ডিল কনফার্মড।”

মাহবুবা সুলতানা আর রেহানা বেগম দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। উদ্যানের কথায় তারা হতবাক হয়ে গেছেন। উদ্যান তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তারাতাড়ি ওকে নিয়ে গিয়ে রেডি করুন। আমি ওয়েট করছি ওর জন্য।”

উদ্যানের এরূপ মন্তব্যে বাকি তিনজনের শরীর ঘৃনায় বিষিয়ে উঠল। উদ্যান অবশ্য বুঝতে পারল সে ভুলভাল কিছু বলে ফেলেছে। সে আসলে বলতে চেয়েছিল ম্যারিজ রেজিস্ট্রার বিয়ে পড়ানোর জন্য ওয়েট করছে। মাহবুবা সুলতানা কিছু বলার আগে ফুল নিজেই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার পিছু পিছু মাহবুবা সুলতানা আর রেহানা বেগমও চলে গেলেন। তারা চলে যেতেই উদ্যান এলোমেলো পায়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। এইমুহূর্তে শাওয়ার নেওয়াটা বাঞ্ছনীয়।

বিকেল ৩ টা,
ফুলের গায়ে বিয়ের বেনারসি জড়ানো। আর কোনো সাজসজ্জা নেই। পাশেই উদ্যান দায়সারা ভাবে বসে আছে। গায়ে অ্যাশ রঙা ডেনিম শার্ট-প্যান্ট। লিভিং রুমে বসে তাদের বিয়ে পড়ানো হচ্ছে। বিয়ে পড়ানোর ঠিক আগ মূহুর্তে উদ্যান দুটো শোরুম সহ বাড়ির অর্ধেকটা আবেশের নামে উইল করে দিয়েছে। তার এই কাজে মাহবুবা সুলতানা অবাক বনে যান। সে ভাবতেও পারেনি যে সত্যি সত্যিই উদ্যান এরকম কিছু করবে। আবেশ আর উদ্যানের মাঝে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। আবেশ হচ্ছে মাহবুবা সুলতানার আগের ঘরের ছেলে। সেই হিসেবে উদ্যানের বাপ-দাদার সম্পত্তির উপরে আবেশের কোনো অধিকার নেই। আবেশকে যে খানজাদা সারনেম টি দেওয়া হয়েছিল সেটাই তো অনেক ছিল।
ফুল কবুল বলতে যাবে ঠিক আগ মুহূর্তে আবেশের চিৎকার ভেসে আসে। ছেলেটা পাগলের মতো চিৎকার করছে। তার সেই চিৎকার শুনে মাহবুবা সুলতানার সাথে সাথে ফুলও কেঁদে ওঠে।

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ২৬০০+

(সবেমাত্র গল্প শুরু হয়েছে সামনে আরও অনেক কিছু হওয়া বাকি। নেক্সট পর্ব থেকেই গল্পের আসল কাহিনী শুরু হবে। পরবর্তী পর্ব পেতে লাইক কমেন্ট করুন।)

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply