#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৩৭
প্রেম রুমে এসে দেখল তৃষা কোথাও নেই ওদিক তৃষাকে ডেকে শেষে ড্রয়ার খুলল। কাপড়ের ভাঁজ সরিয়ে পুতুলটা হাতে নিয়ে বলল, ‘তৃষা আমার ওপর গেইম খেলো না। তুমি যেই গেইম খেলছো ওটা আমার তৈরি করা।’ বলেই দরজার দিকে তাকাতেই দেখল তৃষা সেখানে দাড়িয়ে। প্রেম তাকে দেখে বাঁকা হাসল। তৃষা ক্ষেপে গিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তৃষাকে কাছে টেনে প্রেম কথা বন্ধ করতে ঠোঁটে চুমু খেলো। তৃষা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,’আমি অংকুর ভাইকে নিয়ে পুতুলটা আপনার জন্য আনিয়েছি আপনি কিনা দেখে নিলেন?’
‘ইয়ে মানে যখন ড্রয়ারে ঢুকাচ্ছিলে তখনই দেখে ফেলেছিলাম। আমার সঙ্গে গেইম খেলো সোনা আর ভাবো আমি কিছু বুঝব না? কিন্তু এই পুতুলের চুল সোনালী কেন? কালো হলে ভালো হতো না?’
‘সেটা আমিও ভাবছিলাম। এক কাজ করি চলুন।’কুটিল ভঙ্গিতে বলল।
প্রেম সন্দেহভরা স্বরে বলল, ‘কি কাজ?’
তৃষা ঠাট্টা করে জবাব দিলো, ‘একটা খুন করে চুল কেটে পুতুলের মাথায় লাগিয়ে দেই।’
‘ তোমারটাই কাটি?’
তৃষা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, ‘আমারটা কেন?’
‘মনে আছে প্রত্যুষকে ধোঁকা দিয়ে আমার কাছে এসেছো। ভাইয়ের হয়ে শাস্তি দেব নাকি?’
‘তো চলে যাই আপনার ভাইয়ের কাছে? দেওয়ান বাড়ির বংশ বাড়িয়ে দিয়ে আসি।’
প্রেম মুহূর্তেই রেগে যায়। রেগে তৃষার গলা চেপে ধরে ঠোঁটে শক্ত চুমু খেয়ে বলল, ‘শালীর ঘরের বউ আরেকবার মুখ থেকে এই কথা বের কর, জানে মেরে ফেলব।’ তৃষাকে ছেড়ে দিতেই সে প্রেমের থুতনি আলতো করে কাছে এনে গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। অতঃপর হেসে বলল, ‘চিন্তা নেই আমার মেট লিপস্টিক। আপনার গালে লাগবে না সিনিয়র ভাইয়া।’
প্রেম মুখ ভেংচি কেটে বলল,’ আজকে বীজ বপন করলে কালকে বাম্পার ফসল হবে সে এখনো ভাইয়া ডাকে। তৃষা জবাব দিলো না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে পারফিউম লাগাতেই প্রেম পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল। জিজ্ঞেস করল, ‘আরে বাপরে এই সোনা! পারফিউমে কি ড্রাগস মিশিয়েছো? আমার তো চোখ ঝাপসা হচ্ছে। নেশা নেশা লাগছে।’
‘তো যান গিয়ে লেবু পানি খান।’
‘তুমি আছো না? তোমার মতো একটাকে রেখে অন্য কিছু খেলে খাবারও রাগ করবে। তবে পারফিউমটা ভালো। আগেরটা তো এয়ারফ্রেশনারের মতো লেগেছে।’
‘তবুও তো কাছে এসেছেন।’
‘ ধরতে হবে বলে ধরি, এ-ই ছাড়া ধরার মতো কোনো কারন নেই। আর বউ গিফট দিলে একটা ভালো কিছু দেও। এই যুগে পুতুল কে দেয়?’
‘আমি। আপনি জানেন ওটা অংকুর ভাইকে দিয়ে আনিয়েছিলাম কষ্ট করে। একটা সুইচ আছে। ওটা চাপলে আ…’
‘ওটা চাপলে তোমার জামা-কাপড় খুলে যাবে নাকি? যদি এমন কিছু হয় তাহলে নেওয়া যায়।’
‘ছিঃ আমি বলতে চেয়েছি ওই সুইচ চাপলে আপনার জন্য একটা গিফট কিনেছিলাম ওটা ওপেন হবে।’
‘ওহ সেটা খুলে বললেই তো পারো?’
‘খুলেই তে বললে চাইতাম কিন্তু আপনার জন্য পারলাম কই?’
‘তাহলে শাস্তি হিসেবে এবার সব খোলার দায়িত্ব আমায় দাও।’
‘খুলবেন মানে?’
মানে তোমার হৃদয়টা একটু খুলে দেখতে চাই তাতে আমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি।’
‘ইশ পরে হৃদয় বেচে আইফোন কেনার ধান্দা।’ প্রেম সেই কথা শুনে পকেট থেকে লেটেস্ট আইফোন বের করে তৃষার সামনে ধরে চোখ মেরে বাঁকা হাসল। ইশ এই লোক কিভাবে খোঁচা মারল। আইফোন আছে বলে দুনিয়া কিনে নিবে নাকি?
–
রিসোর্টটায় আজকে আলাদা করে অনুষ্ঠান আছে। তৃষা প্রেমের হাত ধরে রিসোর্টের ক্লাবে আসে। সেখানে অনেক দম্পতি আগ থেকেই ডান্স করায় মশগোল। তৃষা প্রেমের হাত ধরে সেখানে প্রবেশ করে। প্রেম তৃষার চোখে চোখ রেখে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘চলো ডান্স করি।’ তৃষা হাতে হাত রাখতেই প্রেম তাকে নিয়ে ওপরের দিকে চলে যায়।
ধীরে ধীরে মৃদু আলোয় ঝরে পড়া নরম সুরের সঙ্গে প্রেম আর তৃষা দুলছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল মৃদু সঙ্গীত আর দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দ মিলেমিশে এক আবেশ তৈরি করছে। প্রেম তৃষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে কাছে টেনে নেয়। তৃষার লম্বা চুল প্রেমের গায়ে ছুঁয়ে যায়। প্রেম ফিসফিস করে তৃষার কানের কাছে মুখ এনে বলল, তুমি জানো, আমি তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবতে পারি না।?”
তৃষা চোখ নামিয়ে তাল মিলিয়ে বলল, “আপনি শুধু কথায় বলেন… বিশ্বাস করব কীভাবে?”
প্রেম হেসে তৃষার চিবুকে হাত রাখে, আলতো করে মুখটা ওপরে তোলে। “বিশ্বাসের দরকার নেই… অনুভব করো।”
প্রেম হঠাৎ ঝুঁকে তৃষার ঠোঁটে চুমু খায়। তৃষা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নেয়, তবে হাত দিয়ে প্রেমের গলা জড়িয়ে ধরে। নাচ থেমে যায় না, তারা দুলতে থাকে একই ছন্দে। তৃষা মৃদু কণ্ঠে বলল “আপনি তো নাচের ফাঁকে ফাঁকেই আমায় চুরি করে নিচ্ছেন…”
প্রেম মুচকি হেসে, আবার কপালে চুমু দিয়ে বলল, “না তৃষা, এটা চুরি নয়… এটা আমার অধিকার।”
তৃষা মৃদু হেসে চোখ মেলে, তবে তার ভেতরে রক্তিম আবেশ ছড়িয়ে যায়। প্রেম আবার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নেয়, ঘূর্ণির মতো দুলিয়ে দেয়, আর মাঝেমাঝেই তার ঠোঁট ছুঁয়ে নেয় তৃষার ঠোঁট।
তৃষা শ্বাসভরা কণ্ঠে বলল, “থামুন প্রেম… আমি হারিয়ে যাচ্ছি।”
প্রেম তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, “হারিয়ে যেও না… থেকো যাও আমার ভেতরেই, চিরকাল।”
‘ ওগো শুনছেন?’
‘শুনছি পাখি, বলো।’
‘সবচেয়ে ছোট্ট আনন্দ?’
‘তোমার ডাকনাম উচ্চারণ করা।’
‘সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন?’
“তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো?” কারণ হিসেব মেলে না।’
‘সবচেয়ে প্রিয় রং?’
‘তোমার চোখের গভীর কালো।’
‘সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গীত?’
‘তোমার হাসির শব্দ।’
‘ প্রিয় ঠিকানা?’
‘যেখানে তুমি থাকো।’
‘সবচেয়ে সুন্দর মিথ্যে?’
‘বলি আমি ঠিক আছি, অথচ তোমায় ছাড়া কিছুই ঠিক নেই।’
‘সবচেয়ে মধুর যন্ত্রণা?’
‘তোমার অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা।’
‘সবচেয়ে দীর্ঘ যাত্রা?’
‘তোমার থেকে এক মুহূর্ত দূরে থাকা।’ প্রেম থমকে তৃষাকে চোখ দু’টো বন্ধ করতে বলল। বাম হাতটা শক্ত করে ধরে আঙ্গুলে হাত বুলালো। অতঃপর তৃষাকে চোখ খুলতে বলল সে। তৃষা আঙুলের দিকে চেয়ে দেখল তাতে ডায়মন্ডের একটা আংটি। তৃষা খুশিতে আত্মহারা হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রেম তাকে বলল, ‘অভিনন্দন।’
‘অভিনন্দন কেন? ‘
“এই যে মিসেস, তুমি এখন আমার, কাগজে কলমে নও কেবল সবটা জুড়েই কেবল আমার আমিটার একমাত্র তুমিটা, শুধুই তুমি। ভালোবাসো আমায়? তবে জড়িয়ে ধরো তেমন করে, যেমন করে বিষমাখা শিকড় জড়িয়ে ধরে মৃতগাছের ধ্বংসাবশেষ। মিশে যাও আমার বুকের ভেতরকার অন্ধকারে যেমন করে গোপনে মাটি টেনে নেয় মৃতদেহের সমস্ত গন্ধ আর স্মৃতি। তুমি জানো কি? তোমাকে আমি কেবল আলিঙ্গনের মতো করে কাছে চাই না, চাই তোমাকে এমনভাবে, যেমন করে গাঢ় ছায়া মিশে যায় অন্ধকারের বুক চিরে। যেমন করে কবরের মাটি জড়িয়ে ধরে মৃতদেহকে। যেমন করে কাফনের কাপড় ধীরে ধীরে মাংসের গন্ধ শুষে নেয়।
যেমন করে নীরবতা গ্রাস করে আকাশের শেষ সুর্যাস্তটাকে। আমি চাই তুমি আমার ভিতরের সমস্ত পচা-বিষাদে মিশে যাও, তোমার সাদা রঙটা আমার কালোয় মিশে পবিত্র হয়ে যাক। রক্তের সঙ্গে হয়ে যাও আমার বেদনার লাল নদী। চাই তুমি আমাকে এতটাই জড়িয়ে ধরো, যেন তোমার নিঃশ্বাস আর আমার নিঃশ্বাসের সীমায় মুছে যায়। যেন তোমার বুকের শব্দ আর আমার হৃদয়ের ধাক্কা একাকার হয়ে যায়। আমার ভালোবাসা কোনো গোলাপ নয় প্রেয়শী, এটা রাতের বেলায় শ্মশানের আগুনের মতো টগবগে। নীরব, উষ্ণ, ধোঁয়ায় চোখ ভরা, তবু সত্যি এই প্রেমের প্রেমময় তৃষা।
যদি আমাতে জড়াও, জানাই তোমাকে অভিশাপের মতোই ভয়ানক অভিনন্দন। ভালোবাসা মোবারক আমার ঘরের মালকিন।
এই হৃদয়ের কাফন পরে নাও তুমি,
এই শরীরের মাটি হয়ে যাও তুমি।
কবুল করে নাও আমায়, তোমার উন্মাদ জনাবের ইস্ক।”
তৃষার চোখে তখন জল। প্রেম সেই অশ্রুসিক্ত নয়নে তৃষাকে জড়িয়ে ঠোঁটে চুমু দিতেই প্রেমের উন্মাদনার গতি বেড়েই চলল। সে ক্লাবে সকলের সামনেই তৃষার কালো গাউনের সরু ফিতা টেনে খুলতেই তৃষা একমুহূর্তের জন্য ছিটকে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘কি করছেন প্রেম? আমরা পাবলিক প্লেসে।’
‘তাহলে রুমে চলো প্লিজ।’ হঠাৎ পেছন থেকে অংকুর এসে ডাকতেই প্রেম ক্ষিপ্ত গলায় তাকে বলল, ‘আরে বাল তোমার আসার সময় নেই? কি হয়েছে?’
‘আব্বে প্রেম, তুমি একটু পরে প্রেম করো। আগে একটু সাইডে আয় ভাই। কথা আছে।’
প্রেম তৃষার চোখের দিকে তাকাতেই তৃষা যাওয়ার জন্য ইশারা করল। যাওয়ার আগে প্রেম তৃষার কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘জাস্ট দুই মিনিট সোনা। আসছি আমি।’
তৃষা সোফায় গিয়ে বসল। একটা মকটেল হাতে নিয়ে চুমুক দিতেই পাশে একটা পুরুষ বসল। মুখে মাস্ক পড়া। কালো রঙের একটা হুডি। তৃষার গাউনের পিঠ খোলা। পুরোটা জুড়ে চিকন কালো ফিতা। লোকটা তার পেছনের সিটে গিয়ে বসল। একেবারে তার চোখ হাতড়ে বেড়াচ্ছে তৃষার উন্মুক্ত পিঠের ওপর। হঠাৎ সামনের আয়নার দিকে তৃষার চোখ গেল। দেখতে পেল লোকটির দৃষ্টি কোথায় থমকে আছে। পরক্ষণেই আয়নায় আরেকটি ছায়ামূর্তি দেখে বুকের ভেতর ছলাৎ করে উঠল। তৃষা পেছনে ঘুরতেই দেখল হুডি পড়া লোকটি উঠে বিল দিয়ে চলে যাচ্ছে। তার সামনেই প্রেম দাঁড়িয়ে আছে। চোখ এখনো তার তৃষার পিঠের দিকে। তার জিনিসে অন্য কারো নজর? উফ বুকে লাগছে খুব। সঙ্গে ভেতর ফালাফালা করার মতো বিশ্রী এক ধরণের রাগ হচ্ছে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলে চাইল। পারল না। তৃষার হাত শক্ত করে ধরতেই সে কেঁপে উঠল। সেই প্রেম নেওয়াজের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে যে তার পেটে ছুড়িঘাত করেছিল। যে উন্মাদের মতো আঘাত করত এই শরীরে। শিউরে ওঠে তৃষার গা। প্রেম তার হাতটা শক্ত করে ঘরে টেনে নিয়ে যেতেই তৃষা বলল, ‘আমি বুঝতে পারিনি লোকটার নজর যে আমার পিঠের দিকে ছিল। বিশ্বাস করুন।’ প্রেম শুনল না। রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে গা থেকে ব্লেজার খুলে মেঝেতে ফেলে দিয়ে তৃষার ঠোঁটের বুলি বন্ধ করে দিয়ে তাকে চুমু খেলে। যেই পিঠে অন্যের দৃষ্টি গেছে ঝরনার দিকে নিচে জল দিয়ে বারংবার ধৌত করল সেই স্থান। যতক্ষণ না মনের ক্ষোভ মিটল ঠিক ততক্ষণ। ভেজা শরীরে তৃষাকে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে নিজের ভারী শরীরটা ঝুকিয়ে দিলো তৃষার বুকের ওপর। ধীরে ধীরে তার শিকারি হাত দু’টো তৃষার শরীরের প্রতিটি জাল উন্মুক্ত করে তাতে হারিয়ে গেল। স্পর্শের আকুলতা গভীর থেকে গভীরতর হলো। তৃষার নিশ্বাসও সেই সঙ্গে হয়ে উঠল ভারী। তৃষার চোখের কোণে জল। প্রেম হাত টানা দিয়ে রুমের বাতি বন্ধ করে দিয়ে তৃষার চোখের জল নিজের মধ্যে শুষে নিয়ে বলল, ‘আমি তোমায় না মেরেও কাঁদাবো সোনা। তোমার পিঠের দিকে অন্য পুরুষ তাকাবে কেন? শাস্তি তো সবে শুরু দেখি কতক্ষণ নিতে পারো।’
‘শাস্তি যদি এমন হয় তবে আমি বার বার অপরাধ করতে প্রস্তুত।’
‘ডোন্ট মেইক অ্যা নয়েজ শালীর ঘরের বউ।’বলেই বাতি বন্ধ করে প্রেমতৃষার প্রেম মহিয়া হয়ে উঠল।
–
ঘড়ির কাঁটা বলছে তখন মাঝ রাত। প্রেমের বুকের ওপর তৃষা শুয়ে আছে। প্রেম গভীর ঘুমে মগ্ন। তৃষার পড়নে কালো একটা নাইটি। সে প্রেমের দিকে একবার তাকায়। ড্রয়ার থেকে কাপড়ের ভাঁজে রাখা ইনজেকশনটা বের করে। ছোট্ট একটা শিশি থেকে একধরনের লিকিউড প্রোডাক্ট বের করে ইনজেকশনে ঢুকিয়ে প্রেমের দিকে তাকায়। তার হাতের পুশ করে বলে, ‘সরি আমার হাতে আর কোনো উপায় নেই।’ কাজ শেষ করে তৃষা ড্রেসিং যায়। খোলামেলা নাইটির ওপর একটা কালো হুডি পড়ে রুমের দরজা খুলে বাইরে চলে যায়। যেতে নিয়ে একবার ফিরে আসে। তখন ড্রয়ারের ওপর পুতুলটি রেখেছিল। ওটার দিকে দৃষ্টি যায় তার। কি একটা ভেবে পুতুলটা সঙ্গে করে নিয়ে নেয়। যাওয়ার সময় একবার পেছন ফিরে প্রেমের দিকে তাকায়। তারপর চোখ ফিরিয়ে চলে যায়।
শিমলার গরম লাগছে। ঘুমিয়েছিল তবে হঠাৎ করেই মনে হলো স্বামীর উষ্ণতা থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে। তাকাতে ইচ্ছে করছে না। তাকালেই ঘুম হাল্কা হয়ে যায়। তবুও সে পাশ ফিরল। বিছানার বা পাশ হাতড়ে কিছুটা অবাক হয়ে পাশের টেবিল থেকে চশমা নিয়ে বাতি জালিয়ে দেখল অংকুর পাশে নেই। শিমলা উঠে বাথরুমে গেল। বারান্দায় খুঁজল। অংকুর কোথাও নেই। এই রাতের বেলা কোথায় যেতে পারে? তার চোখে জল চলে এলো। ফোন করল অংকুরকে সে। ধরল না। শেষে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ল শিমলা। বিরবির করে কাঁপা গলায় আওরালো, ‘আর কত অংকুর? আজকে রাতে আবারও?’
–
অন্ধকার রুম। রুমের চারপাশ ফুল দিয়ে সাজানো। অদ্ভুত সুন্দর একটা সুগন্ধ বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ি রিসোর্টের জানালা দিয়ে কি সুন্দর বাতাস আসছে। বাইরে বাতাস আর বৃষ্টি একসঙ্গে। কালো হুডি পড়া লোকটি বাথটবের জলে বড় বড় বরফের টুকরো ছেড়ে দিলো। এই তীব্র ঠাণ্ডায় নগ্ন হলো। তারপর নেমে পড়ল বরফ জলে। রক্ত চাই তার। রক্ত জলে স্নান না করলে ঘুম আসে না তার। সে পাশে রাখা ছুড়িটা হাতে নিতেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীর কণ্ঠ তাকে থমকে দেয়। লোকটি সেই নারীকে দেখে এক মুহূর্তে খুশী হয়ে যায়। নারীটির পরনে কালো নাইটি। লোকটি তাকে দেখে বলল, ‘ অবশেষে এলে তুমি? তুমি জানো না আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকি?’
‘সব সময় কি আমার এভাবে তোমার কাছে আসা সম্ভব?’
‘তুমি না ফিরলে কিন্তু আমি একের পর এক খুন করেই যাব। কাউকে বেঁচে থাকতে দিব না। কারণ আমি খুন না করলে তুমি আসো না। আসো না আমার কাছে।’ মেয়েটি শরীর থেকে কালো রঙা নাইটি খুলে ফেলল। নগ্ন শরীরে পুরুষের সামনে দাঁড়াতেই তার চোখ থমকে গেল। লোকটি আর কথা বাড়ালো না। হাত বাড়িয়ে দিতেই মেয়েটি জলে নেমে গেল। অতঃপর লোকটিকে বলল, ‘তোমার রক্ত চাই?’
‘চাই তো।’
মেয়েটি লোকটির হাত থেকে ছুড়ি হাতে নিয়ে চোখ চোখ রেখে নিজের হাতর ওপর ধরে টান দিতেই ফ্যারফ্যার করে রক্ত গড়িয়ে পড়ে জলে। লোকটি সেই রক্তের দিকে তাকাতেই তার চোখ চকচক করে ওঠে। সে জিহ্বা দিয়ে লেহন করে সেই রক্ত। মনে হচ্ছে অমৃত মুখে দিয়েছে। মেয়েটি মুচকি হেসে লোকটির দিকে তাকায়। তারপর আবদার করে, ‘আজকে যেই মেয়েটিকে মেরেছো তার চুলগুলো দিও তো। আমার নতুন পুতুলটির চুলগুলো একটুও ভালো লাগেনি। আর শুনো আজকে বিরিয়ানি রান্না করবে? ‘
‘কিসের বিরিয়ানি?’
‘মানুষের মাংসের। যাকে আজ মেরেছো তার মাংসের। পিস গুলো বড় বড় করবে কিন্তু। বিরিয়ানি না খেয়ে আজ ফিরছি না। তবে অবশ্যই ফজরের আজানের আগেই সব শেষ করবে। আমায় তো আবার ফিরতে হবে?
‘ইশ তুমি যেও না। তোমার স্বামীর থেকেও তো বেশি ভালোবাসি আমি।’
‘আমিও তো তবে যেতে যে আমায় হবে। আজকে কিন্তু তুমি রান্না করবে বুঝলে?’
‘যা মর্জি আপনার। ‘ বলেই লোকটি মেয়েটির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। রাত আরো গভীর হলো, সঙ্গে গভীর হলো দু’টো উন্মাদ শিকারির উতলা উন্মাদনা।
–
ফজরের আযান পড়ছে তখন চারিদিকে। অংকুর বাইকটা রেখে রুম নাম্বার ২২২ এ প্রবেশ করে। পরনের কালো হুডিটা ভিজে একাকার। শেষে রিসোর্টের লন্ড্রিতে ওটা দিয়ে রুমে চলে আসে। এসে দেখতে পায় তার স্ত্রী ঘুমিয়ে আছে। অংকুর শিমলার পাশেই শুয়ে পড়ল। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ল। অনেক ঘুম পাচ্ছে তার। এবার ঘুমাতে হবেই। কাজ তো অনেক করল আজকে।
সকাল হয়েছে সেই কখন। প্রেম ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া খুব কম করে। হাত নাড়াতে গিয়ে গেল ঘুমটা ভেঙে। ইশ চোখে এত ঘুম কোথা থেকে আসছে? তবুও চোখ মেলার চেষ্টা করল। হাতের দিকে তাকালো একবার। উফ চাকা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে তার বুকে জড়িয়ে থাকা তৃষার দিকে চোখ গেল তার। ইশ আস্ত মায়া এই মেয়ে। দেখলেই আদর করতে মন চায়। প্রেম তৃষার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। দেখল চুল ভেজা। কিন্তু চুল ভিজল কি করে? হয়তো রাতে যে গোসল করিয়ে দিয়েছিল সেই জন্য হয়তো। তবে সারারাতে তো শুঁকিয়ে যাওয়ার কথা। সে তৃষার কপালে চুমু দিতেই তৃষা নড়ে-চড়ে উঠল। চোখ ফেলতেই প্রেম তাকে জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি তৃষা। অনেক বেশি।’
তৃষাও শক্ত করে জড়িয়ে নিলো প্রেমকে। তবে তার চোখ প্রেমের পেছনে রাখা ড্রয়ারের ওপরে রাখা পুতুলটির দিকে। ওটার চুল এখন কালো। সে ওদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বাঁকা হেসে মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলো, ‘আমিও আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি প্রেম।’
চলবে?
#প্রেমতৃষা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৩৮
হেতিজা দুপুরে ভাতের থালা ছুঁয়েও দেখেনি। বুকের ভেতরটা যেন কাঁটার বন। প্রেমা পাশে বসতেই তার চোখের জল আর্তনাদের মতো ফেটে বেরিয়ে এল।একটা শুকনো নদীর বুকে হঠাৎ জলোচ্ছ্বাস। প্রেমা মাকে বুকে টেনে নিল, হয়তো এই বুকেই মা আশ্রয় পাবে। তৃষা চলে যাওয়ার পর থেকে প্রত্যুষ রাতে বাসায় ফিরে না। দিনেও কোথায় খায়, কী করে—খোদা ছাড়া কেউ জানেন না। যে ছেলেটা একসময় সবার গর্ব ছিল, সেই ছেলেটির জীবন এখন হেতিজার চোখের সামনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। মায়ের বুকটা হাহাকার করে ওঠে। কেবল কান্নাই আসে। কেন যে ওই মেয়েটিকে ভালোবেসেছিল! এ ভালোবাসা তো জীবনটাকেই গিলে খাচ্ছে, ধ্বংস করে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
‘প্রেমা, একবার কল কর তো তোর ভাইকে,’
হেতিজার গলা শুকনো, কাঁপা।
প্রেমা তাই করল। কিন্তু কল যেতেই স্ক্রিনে সেই একই দৃশ্য—ফোন বন্ধ। আজকাল যেন রিং হওয়ার থেকেও বন্ধ থাকার দৃশ্যটাই পরিচিত হয়ে গেছে। হেতিজার চোখে নিদারুণ ক্লান্তি। এই বাড়ির প্রতিটি জীবনের আলো কি এভাবেই নিভে যাবে? আল্লাহ, এই অভিশপ্ত পরিণতি থেকে কবে মুক্তি মিলবে?
–
রিসোর্ট থেকে ফিরে আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমেছে ঘরেজুড়ে। দুপুরের রোদে বাড়িটা যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন, জানালার পর্দায় আলো-ছায়ার খেলা থেমে গেছে। প্রেম আর তৃষা—দু’জনেই ক্লান্ত, কিন্তু ক্লান্তিরও এক রোমাঞ্চ আছে, যা শরীরের প্রতিটি শিরা টেনে রাখে কোনো এক অজানা টানের ভেতর। তৃষা বই পড়তে পড়তেই ড্রয়িং রুমের সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে। নিস্তব্ধ ঘরে শুধু ঘড়ির কাঁটার শব্দ, আর দূরে কিচেন থেকে ভেসে আসে ছুরির সঙ্গে কাঠের টেবিলের ঘষাটানা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তৃষার। চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে কিচেনের দিকে তাকাতেই সে মুহূর্তটা থমকে যায়। ওপেন কিচেনের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে এক পুরুষ—কালো রঙের ট্রাউজার, আর শরীরের উপরে অন্ধকারের মতো দৃঢ় ছায়া। তার পিঠটা এতটাই চওড়া যে আলোর রেখাটাও সেখানে ভেঙে গেছে। তৃষা স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্য যেন কোনো মানুষের নয়—বরং এক অনিবার্য মায়ার মতো, যা তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে। ঘুম ভাঙার পর এমন দৃশ্য ক’জন নারীর কপালে জোটে? তার বুকের ভেতরটা হঠাৎ ভারী হয়ে আসে। পুরুষটি এখনো পেছন ফিরে তাকায়নি তবুও তার উপস্থিতি ঘরের প্রতিটি কোণে গায়ে গায়ে লেগে আছে, এক ধরনের অজানা উষ্ণতা হয়ে। তৃষার মনে হয়, এই মানুষটা যদি এখন ঘুরে তাকায়, তাহলে সে হয়তো নিজের সমস্ত ঘুম, সমস্ত নিঃশ্বাস হারিয়ে ফেলবে সেই চোখের ভেতর। সে ওঠে যায়। এক পা দুই পা করে কিচেনে গিয়ে পেছন থেকে ওঠে জড়িয়ে ধরে প্রেমকে। পিঠে চুমু খেয়ে বলে, ‘আপনাকে অসীম ভালোবাসায় আমি ভালোবাসি।’
প্রেম পেছনে ঘুরে তৃষার নাকে নাক ঘষে ঠোঁট ঠোঁট বুলিয়ে বলল, ‘আমিও মিসেস নেওয়াজ আপনাকে অসীম ভালোবাসি।’
‘কি রান্না করেছেন?’ তৃষা জিজ্ঞেস করল।
প্রেম তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সব আপনার পছন্দের খাবার। আপনি এগুলো খাবেন আর আমি আপ…..’ পুরোটা বলার আগেই তৃষা প্রেমের ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে তাকে থামিয়ে বলল, ‘ইশশশশয়।’
প্রেম আঙুল সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘এমন ভাবে থামতে বললে কেন জানি আমার আরো বেশি করে শব্দ করতে ইচ্ছে করে।’
তৃষা হাসল। তারপর বলল, ‘পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। জলদি খাবার দেন। খাই আগে।’
‘ইদুর দৌড়াচ্ছে? তাহলে তো ইঁদুর মারার বিষ খেতে হবে আপনাকে মিসেস নেওয়াজ। ‘
‘আপনার মুখের যেই কথা। আর বিষ খাওয়ার দরকার নেই।’
‘শালী মিঠা কথা তোমার দরবারে সয়ে না? তোমায় ডিম থেরাপিই দেওয়া উচিত, নট প্রেম থেরাপি।’
–
পাহাড়ি পথটা বিকেলের আলোয় ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ছিটকে আসা রোদ ঝিকমিক করছে মাটিতে। যেন কেউ সোনার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছে। আজকে সারাদিন আধিবাসী গ্রামে ঘুরবে তারা। রাতে ক্যাম্পফায়ার করবে। প্রেম আর তৃষা পাথরের সরু পথ ধরে এগোচ্ছে। বাতাসে নরম একটা ঠান্ডা ছোঁয়া। মাটির সোঁদা ঘ্রাণে মন ভরে যাচ্ছে। কোথাও কাছেই হয়তো কারও উঠোনে চাল শুকোচ্ছে, আর তার পাশেই পাথর ঘেঁষে বসে আদিবাসী কিছু লোক গান গাইছে। বাঁশি বাজাচ্ছে। সেই সুর নেমে এসেছে পাহাড়ের বুক থেকে, মাটির ভেতর দিয়ে সোজা হৃদয়ে গিয়ে লাগে। তৃষা হাঁটা থামিয়ে চারপাশে তাকায়। তার চোখে অনির্বচনীয় বিস্ময়। পাহাড়ের পেছনে লুকোচুরি খেলছে সূর্য। আকাশে কমলা আর গোলাপি রঙের মিশেল। দূরে ধোঁয়া উঠছে রান্নাগুলো থেকে, তার সঙ্গে মিশে আছে পোড়া কাঠ আর পুড়তে থাকা পাটপাতার গন্ধ। তৃষা নরম স্বরে প্রেমকে বলল,
“সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছে, প্রেম… এরা কত সরল, অথচ কত রঙিন! জানেন, এদের মুখে কোনো ক্লান্তি নেই। মনে হয় প্রকৃতি নিজেই হাসছে ওদের সঙ্গে।”
প্রেম থেমে গিয়ে একটু তাকাল তার দিকে। তৃষার চুলের পাশে সূর্যের আলো লেগে ঝলমল করছে। তার চোখে পাহাড়ের প্রতিফলন।
প্রেম মৃদু হেসে বলল, “এদের চোখে শহরের মতো ধোঁয়া নেই, আছে কেবল আলো। আর সেই আলোয় তুমিও আলাদা করে ঝলমল করছো আজ।”
তৃষা কিছু বলতে পারল না। শুধু চুপ করে তাকিয়ে রইল দূরের পাহাড়ের দিকে। বাতাসে দুলছে তার চুল, আর কানে বাজছে ঢোলের সুর। ঠিক তখনই একদল বাচ্চা ছুটে এলো। তাদের হাতে ছোট ছোট ফুলের তোড়া, আর রঙিন পাথর দিয়ে বানানো ব্রেসলেট। তারা হাসতে হাসতে তৃষার সামনে থামল। একটা মেয়ে এগিয়ে এসে তৃষার কব্জিতে পরিয়ে দিল লালচে পাথরের বালা। আরেকটা ছেলে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিল প্রেমের। তৃষা প্রেমের দিকে তাকাতেই সে বলল, ‘তুমি আমার জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই তোমার জন্য সামান্য একটু আয়োজন তো করতেই পারি?’
হঠাৎ গ্রামের কিছু পাহাড়ি মুরুব্বিরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। তাদের গলায় পাটের চাদর। একজন বলে উঠলেন,
“আজ তোমরা অতিথি, আর অতিথি হচ্ছে ইশ্বরের অন্য রূপ। আমাদের গ্রাম আমাদের কাছে সব কিছু। এই গ্রামে সূর্য ডোবে, কিন্তু ভালোবাসা কখনো ডোবে না।”
তৃষা মৃদু গলায় বলল, “প্রেম, মনে হচ্ছে আমি যেন আমার নিজের ঘরেই ফিরে এসেছি।”
প্রেম তার হাতটা ধরল, “হয়তো ভালোবাসা মানেই এমন এক জায়গা— যেখানে অপরিচিতরাও আপন হয়ে যায়, যেখানে প্রতিটা বাতাসে তোমার নামের মিষ্টি প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তাই না?
তৃষা কিছুক্ষণ নীরব থাকল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখো, সূর্যটা কেমন থেমে গেছে আমাদের জন্য।”
প্রেম হেসে বলল, “হয়তো সে-ও দেখছে, আজ শহরের দুই মানুষ মিশে যাচ্ছে পাহাড়ের মাটির সঙ্গে।”
দুজনেই এগিয়ে চলল গ্রামের ভেতর। যাওয়ার সময় তৃষা বলল, ‘আপনি যেই মানুষ এখানে অসভ্যতামি করবেন না কিন্তু। ‘
প্রেম মুখ বাঁকিয়ে বলল,’ দেখা যাক শালীর ঘরের বউ।’
গ্রামের ভেতর ঢুকতেই কিছু মেয়েরা এসে তৃষা আর প্রেমকে আধিবাসীদের পোশাক দিলো। তৃষা তো সেই পোশাক পড়ার জন্য মহা আগ্রহী। তবে প্রেম নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখল একবার। তারপর তৃষার কানের সামনে ফিসফিস করে বলল, ‘এই সোনা তুমি চাইলে আমি পোশাক ছাড়াই থাকতে পারব। দেখবে এই পাহাড়ের থেকেও সুন্দরী প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখিয়ে ওদের মুগ্ধ করে দেব।’
‘ প্রেমের বাচ্চা চুপ থাক।’
‘শালীর ঘরের বউ তুই চুপ থাক।’ বলেই চুল ঠিক করে প্রেম সামনের মেয়ে গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই গার্লস আমি এসব চাংচুং ড্রেস পড়তে পারি না। সাহায্য করলে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখাবো। ‘ মেয়ে গুলো সেই কথা বুঝলো কিনা কে জানে। তার আগেই তৃষা তার পায়ের ওপর পাড়া দিয়ে বলল, ‘দেন আমি সাহায্য করছি।’
প্রেমের পোশাকটি হচ্ছে লালচে রঙের লুঙ্গি, সঙ্গে কাপড়ের শার্ট। আর তৃষারটি হচ্ছে অপূর্ব বেগুনি, হলুদ আর সবুজ রঙে বোনা হ্যান্ডলুম জামা, যার কাঁধে ঝুলছে নরম, শাড়ির মতো এক টুকরো কাপড়। সেই কাপড়ে সূক্ষ্ম নকশা— ফুল, পাখি, আর জলের ঢেউয়ের মতো নকশা, যেন প্রকৃতিরই অনুবাদ। তৃষা পোশাকটি পরে বের হতেই বাতাস যেন কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল। জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া আলো তার গায়ে পড়তেই সে যেন গ্রামীণ রঙে মিশে গেল একেবারে। চুলের পাশে ছোট্ট ফুল গুঁজে সে হাসল, “এরা কত সুন্দর করে বুনে, প্রতিটা সুতোয় যেন একটা গল্প লুকিয়ে আছে।”
প্রেম তাকিয়ে রইল নিরবতায়, তারপর মৃদু হেসে বলল,
“ এই বউ বলবো না তোমাকে মহা সুন্দরী লাগছে। বাট গড প্রমিস হেব্বি বাসর পাচ্ছে আমার। একটু চিপায় আসো প্লিজ।”
তৃষা চারপাশে তাকিয়ে প্রেমকে চোখ রাঙায়। উফ এই লোকটাও না!
সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের কেন্দ্রস্থলে জ্বলতে শুরু করল অগ্নিকুণ্ড। একটা বড় হারিয়ে যাওয়া আঁচরীর মতো। যা ধুলোকে উড়িয়ে দিয়ে উষ্ণ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে।বাঁশের ভেতর ভরা ভাত ফুঁপে ফুঁপে ধোঁয়া ছুঁড়ছে আকাশ। মাটির হাঁড়িতে সাজানো খাবারগুলো। বাঁশের মধ্যে রান্না করা মাংস, ঝকঝকে সবজি, ধোঁয়া ওঠা বুনো মুগরির ঝোল, ঝিঁঝির কাঁকড়া সবই আছে। সঙ্গে সিদ্ধ সবজি, সিদোল দিয়ে মরিচ ভর্তা কি নেই তাতে?
আর বাঁশপাতায় মোড়া মিষ্টি পিঠা তার কোনো তুলনা নেই। খাবার শেষে সবাই আগুনের চারপাশে গোল করে বসল। আগুনের ফটকার শব্দ কানে গম্ভীর তাল বেঁধে দিচ্ছে। বৃদ্ধ একটা লোক মাঝে বসা। সেই লোকটি স্বরে-স্বরে বলতে শুরু করল, পাহাড়ের আত্মা, নদীর রাণী, আর হারিয়ে যাওয়া প্রেমের কাহিনি। তৃষা প্রেমের কাঁধে মাথা রেখে সেই গল্প শুনতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে সে চুপচাপ হেসে উঠছে গল্পের কাতারে মুখ চেপে ধরত। গল্পগুলো ভীতিকর ছিল না বরং তারা ছিল বিশ্বাসোদযাপন, সেই বিশ্বাস যে মানুষকে জোড়া লাগায় প্রকৃতির সঙ্গে। গল্পের এক মুহূর্তে প্রেম বলল, “এদের গল্পে কোনো ভয় নেই, শুধু বিশ্বাস।” তৃষা ধীর করে বলল, “হয়তো এই বিশ্বাসটাই ভালোবাসার প্রথম পাঠ।”
‘তাহলে বাসায় চলো জলদি তোমায় ভালোবাসার দ্বিতীয় পাঠের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।’ তৃষা প্রেমের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। অতঃপর বলল, ‘আমার না প্রেম বিরিয়ানি খেতে মন চাইছে।’
‘মাত্র না তুই মেয়ে নাদানের মতো গিলল? এত খাবার যায় কই?’
‘তোমার নানির পু…’
‘চুপ। কোথায় সই করতে হয় আজকে যাই একবার বাসায় তখন বুঝাবো।’
‘এই যে…’
‘হুম।’
‘বিরিয়ানি খাবো।’
‘তেহারি নাকি কাচ্ছি?’
‘মানুষের মাংসের।’
চলবে?
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষ্ণা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩৯ ( প্রথম অর্ধেক+শেষ অর্ধেক)
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৩+১৪
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৫+২৬
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৫+১৬
-
প্রেমতৃষা গল্পের লিংক
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৪+৫
-
প্রেমতৃষা সারপ্রাইজ পর্ব
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৮
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৪১