হেইসুইটহার্ট__(০৩)
নুসরাতসুলতানাসেঁজুতি!
কাউকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচানোর বিনিময় কী হতে পারে? কী করতে পারে সেই মানুষটা? একটা ধন্যবাদ জানানো? কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়ে পালটা উপকার করতে চাওয়া? কিংবা মন ভরে সম্মান করা সেই উপকারি দূতকে। অন্তত এই আঠেরো বছর পার করে দেয়া জীবনে এতটুকুই দেখেছে কুহু। আর ঠিক সেজন্যেই সম্রাটের থেকেও ওর এমনই আশা ছিল। অথচ সে কী বলল এক্ষুনি? কী শুনল ও? কুহুর চোখে অবিশ্বাস, চাউনিতে বিস্ময়। পুরন্ত ঠোঁটে দুই ইঞ্চি ফাঁকা। তক্ষুনি সম্রাট স্থুল পুরু ভ্রু-টা নাঁচিয়ে ফের একই জায়গায় দেখাল। কুহু নড়ে উঠল অমনি। ত্রস্ত তাকাল কাঁধের দিকে। ওয়াইড নেক টি শার্টের ফাঁক গলে কালো অন্তর্বাস বেরিয়ে আছে। মেয়েটা লজ্জায়-অস্বস্তিতে মাটিতে মিশে গেল। ঝড়ের বেগে ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়াল সবেগে। ভীষণ রেগে বলল,
“ অসভ্য,ইতর,নির্লজ্জ লোক! কোথায় কোথায় চোখ যায় আপনার?”
গালিগুলো ইংলিশে দেয়ায় বুঝল সম্রাট । সবুজ চোখ ছোট হলো আরেকটু,
“ আমি অসভ্য?”
“ নয় তো কী?
একটা মেয়েকে চেনেন না,জানেন না,এর আগে কখনও কথা অবধি হয়নি,তাকে এরকম কথা বলার সাহস হয় কী করে আপনার? এই জন্যেই কি লোক দিয়ে ডেকে আনিয়েছিলেন?”
সম্রাট দ্বিতীয় দফায় অবাক হলো। ভ্রু উঠল উঁচুতে,
“ সাহস? টিপিক্যাল এনোয়িং লেডি, স্যামকে তুমি সাহস নিয়ে প্রশ্ন করছো?”
কুহুর রাগে মাথা ধরে গেল। সম্রাট স্পষ্ট দেখল মেয়েটার হাত কাঁপছে,নাক ফুঁসছে। রেগে গেলে মেয়েরাও কাঁপে? ও জানতো মেয়েরা শুধু ছুঁতে গেলে কাঁপে। তাও সবাই না,ওই প্রথম প্রথম!
কুহু চাইল না তর্ক করতে। আর না চাইল এখানে এক মূহুর্তও দাঁড়াতে। উল্টোঘুরে ধুপধাপ পায়ে হাঁটা দিলো তাই। দরজার হাতল টানল,তুহিনও ঢুকল তক্ষুনি। মুখোমুখি পড়ায় থামল কুহু। মেয়েটার লালচে চেহারা দেখে ও অতকিছু বুঝল না। জিজ্ঞেস করল নম্র স্বরে,
“ কোনো সমস্যা ম্যাম? কিছু দরকার?
বস, ম্যাম কি চলে যাচ্ছেন?”
সম্রাট তখনো একই জায়গায় ওই একই রকম বসে। কুহু যে তিন তিনটে গালাগাল দিলো ভ্রুক্ষেপ বোধ হয় নেই। কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
“ কী জানি!
তুহিন,তুমি এক কাজ করো আমার জন্যে একটা জ্যাক ড্যানিয়েলস নিয়ে এসো। আই নিড ওয়ান সিপ রাইট নাউ।”
তুহিন ঘাড় নাড়ে,
“ ওকে বস।”
কুহু তাজ্জব না হয়ে পারল না। বিস্ময়,তব্দায় মুখ কুঁচকে চাইল তুহিনের পানে। কর্কশ গলায় বলল,
“ আপনার নাম তুহিন?”
হঠাৎ প্রশ্নে ছেলেটা ভড়কায় একটু,
“ জি।”
“ বাঙালি! কোন দেশ?”
তুহিন চশমা ঠেলে বলল,
“ বাংলাদেশ ম্যাম।”
কুহু খুব রেগে গেল। একেবারে খাঁটি বাংলায় বলল,
“ বাংলাদেশের লোক হয়ে এরকম একটা অসভ্য ছেলের আন্ডারে চাকরি করছেন কেন? লজ্জা করে না আপনার! ছিহ,আবার মদ এনে দিচ্ছে। শুনুন, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ এটা সব সময় মনে রাখবেন!”
তারপর কুহু ক্ষিপ্ত চোখে আরেকবার সম্রাটের দিকে তাকাল।
দাঁত মুখ খিচে বলল,
“ দুশ্চরিত্র লোক একটা ! এর থেকে যত দূরে থাকবেন তত ভালো।”
তুহিন জিভ কাটল। এই রে,সোজা চরিত্রে হাত? বস আবার কী করল এর সাথে? কুহু আর কথা না বলে তেজি পায়ে ওর পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। এদিকে সম্রাটের কপালে ভাঁজ পড়লো। কুহুর শেষ কথা ও বোঝেনি,
বাংলা তো আর জানে না। তার আয়ত্ব ভাষার মধ্যে সুইডিশ,ইংলিশ আর উর্দু আছে। খুব কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ কী বলেছে এই মেয়ে? গালি দিয়েছে?”
তুহিন আমতাআমতা করে বলল,
“ না বস,গালি কেন দেবে? বলেছে আপনার অনেক বড়ো ফ্যান।”
“ নোপ। একদম নতুন একটা শব্দ ছিল। দ্যাশরিট্রো রাইট? কী মানে এটার?”
তুহিন কেশে উঠল,মাথা চুলকাল। তুরন্ত উঠে এলো সম্রাট। একদম ওর সামনে দাঁড়িয়ে ভীষণ সিরিয়াস হয়ে বলল,
“ তুহিন,মানে কী এই কথার?”
তুহিন ঘাবড়ে যায়। মাথা নুইয়ে মিনমিন করে বলে,
“ ক্যারেক্টরলেস!”
সম্রাটের সাদা মুখ থম মেরে গেল। গোছানো ভ্রু ছড়িয়ে দু সেকেন্ড ঝিম মেরে রইল সে। তাজ্জব হয়ে বলল,
“ টিপিক্যালি ব্রিলিয়ান্ট। এক দেখাতেই বুঝে ফেলল? তুমি ওকে আমার সম্পর্কে কিছু বলেছ?”
তুহিন উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,
“ না না বস,আমি কী বলব? যেখানে আপনার নামে কেউ একটা বাজে কথা বললে আমার সহ্য হয় না,সেখানে আমি বলব! কিন্তু বস,উনি এত রেগে গেলেন কেন?এক্স
“ কী জানি! উপকারই তো করলাম। ইনারের স্ট্র্যাপ দেখা যাচ্ছিল, আর বললেই দোষ? দ্যাটস হোয়াই,দে আর টিপিক্যাল বেঙ্গলি পিপল-স।”
বিদ্রুপ শুনে তুহিনের মুখটা ছোটো হয়ে গেল। সেও তো বাঙালি। খেয়াল করতেই হাসল সম্রাট। গাল চাপড়ে বলল,
“ তুমি আমার কাছে আলাদা, তুহিন। আই লাইক ইউ। নাহলে তো সেদিনই তোমার শেষ দিন হতো! আজ তুমি এখানে থাকার বদলে,আকাশের তারা হয়ে জ্বলতে। কিন্তু এখন তুমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ ।”
তুহিনের চেহারা আলোয় ভরে গেল,প্রফুল্ল হয়ে বলল,
“ সত্যি বস?”
“ ইয়েস,নাও মাই ড্রিংক্স?”
“ আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি,বস।”
তুহিন ছটফটে পায়ে রুমের কোণার দিকে এগোলো। একটা ডাবল ডোরের ফ্রিজ রাখা সেখানে। ভেতরের সব থেকে চকচকে বোতলের ছিপি খুলে গ্লাসে ঢালতে গেলে বাধ সাধল সম্রাট,বলল,
“ গ্লাস লাগবে না,এমনি নিয়ে এসো।”
তুহিন বোতল সুদ্ধ এনে সামনে রাখল।
“ তুমি খাবে?”
“ না বস।”
“ আরে লজ্জার কী আছে? প্রফেশনালি আমি তোমার বস, বাট পার্সনালি তুমি আমার ছোটো ভাইয়ের মতো। বোসো।”
তুহিনের প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সম্রাটের প্রতি আনুগত্য ভালোবাসা বেড়ে প্রকাণ্ড হয় আরো। বসে চটপট। সম্রাট নিজেই বোতল থেকে ওয়াইন গ্লাসে ঢেলে দিলো।
তুহিন জিজ্ঞেস করল,
“ আমরা তাহলে আজ প্রথমে কোথায় যাব,বস?”
“ আগে ভেন্যু,দেন ড্যাড নাভেদ শেখের কাছে।”
“ ওকে বস। আর বস ওই পেশেন্টের তো অ্যাপোয়েন্টমেন্ট কালকে নেয়া ছিল। যাবেন?”
“ হোয়াই নট? স্যাম কথার খেলাপ করে না। যাব।”
তুহিন প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলল,
“ বসকে দেখে অবাক হই,সব কিছু এমন করে কীভাবে সামলান বলুন তো!”
সম্রাট উত্তর না দিয়ে, গ্লাসে চুমুক দিলো। তুহিন যেই চুমুক দিতে যাবে,হুট করে বলল,
“ তুমি ওর ডিটেইলস যোগাড় করো তুহিন। কোথায় থাকে,কবে এসেছে,কেন এসেছে? কী করে? কোথায় পড়ে? সব কিছু।”
তুহিন বুঝল না,
“ কীসের বস? পেশেন্টের? উনি তো…”
“ টিপিক্যাল ফুলিশ ইউ আর! আমি
এই মেয়ের কথা বলছি।”
“ ওওও… ওকে, ওকে বস।”
“ কী নাম এর?”
“ উম, কুহু। ”
সম্রাট নাক সিটকাল,
“ খিয়ু? এটা আবার কেমন নাম? নামের অভাব নাকি,অ্যালফাবেটস রেখেছে কেন?”
তুহিন উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ না না, বস কিয়ু না,কুহু। সুন্দর নাম তো!”
“ বাট আই ডোন্ট লাইক ইট। অন্য নাম নেই?”
তুহিন বুঝল না,মেয়েটার নাম দিয়ে সম্রাটের কাজ কী? কে না কে তার নামই বা পছন্দ হতে হবে কেন? তাও ঝটপট বলল,
“ জি বস, পুরো নামটা যেন কী দেখলাম আইডি কার্ডে? ওহ হ্যাঁ, প্রিয়তমা জাফরিন কুহু।”
সম্রাট বোকার মতো চাইল। আগেরটা যাও কিয়ু বলেছিল,এটা আর উচ্চারণই করতে পারল না। ইংলিশ,সুইডিশ দুই ভাষাতেই জড়িয়ে গেল সব। পরপর নাক ফুলিয়ে বলল,
“ তুহিন ইউ নো না,আমি আমার নিজের নামই সেভাবে বলতে পারি না? সহজ করে বলো।”
তুহিন ভাবছে,খুব ভাবছে। কীভাবে বললে বুঝবে বস? শেষে উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ বস, আমরা বলি না? মাই বিলাভড, সুইটহার্ট। বাংলায় সেটাকেই প্রিয়তমা বলে।”
সম্রাট চোখ গুটিয়ে ফেলল।
বিড়বিড় করে বলল,
“ সুইটহার্ট!”
কুহু বাইরে আসতেই ঠান্ডায় জমে গেল। এক ফালি তুষারের ধ্বস এসে খোঁচা দিল শরীরে। উফ,তুহিনের কথায় এভাবে আসা খুব বড়ো ভুল হয়ে গেছে। এখন তো শীতে যায় যায় অবস্থা। বলেছিল,ম্যাম আমি নিজে পৌঁছে দেবো। অথচ এখন চামচামি করেই কূল পাচ্ছে না। চামচা কোথাকার!
তক্ষুনি ওপাশ থেকে কালো পোশাক পরা একজন দীর্ঘদেহী পুরুষ এগিয়ে এলেন। একটা সাদা গাড়ি দেখিয়ে বললেন,
“ ম্যাম,দিস কার।”
কুহু চটে বলল,
“ আপনার গাড়ি তো আপনি মরুন না। আমি দেখে কী করব?”
ভদ্রলোক বুঝলেন না। প্রশ্ন নিয়ে চোখটা ঝাপটালেন শুধু।
কুহু ফোস করে শ্বাস ফেলে শান্ত করল নিজেকে। এবার ইংরেজিতে বলল,
“ লিফট দেবার দরকার নেই। আমি চলে যাব। থ্যাংক ইউ।”
লোকটি কিছু বলতে পারলেন না,এর আগেই সবেগে হাঁটা ধরল সে। এখান থেকে বাসে যেতে হবে। কার ভাড়া নেয়ার মতো টাকা কুহুর নেই। কিন্তু মেয়েটা হাঁটতে হাঁটতে দাঁত পিষল। বিড়বিড় করল প্রচণ্ড রেগে,
“ এই লোক এলিনের ক্রাশ?
এটা? এত অসভ্য,এত!
প্রথম দেখায় একটা মানুষ মেয়েদের ইনার নিয়ে কথা বলে? ছি ছি ছি! আমার সামনে কোনো ছেলে আন্ডারওয়্যার পরে নাচলেও তো আমি ফিরেও তাকাব না। ইস, কী নোংরা লোক! ছি!”
সম্রাট সিসি টিভিতে চেয়েছিল। অফিসের লেন ধরে হেঁটে যাচ্ছে কুহু। মেয়েটার ক্ষুব্ধ চোখমুখ আর বিড়বিড় করা দেখে বাঁকা হাসল সে।
“ আমাকে গালি দিচ্ছে।
এই প্রথম একটা মেয়ে দেখলাম যে আমার গায়ে হামলে না পড়ে গালাগাল দিয়ে গেল। ইন্টরেস্টিং না?”
তুহিন ঘাড় নাড়ল,
“ জি বস।”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল সম্রাট,
“ সব সময় জি বস, না বস করো কেন? এর বাইরে তোমার কথা নেই?”
“ না বস,আপনি যা বলবেন তাই ঠিক। মাই বস ইজ অলওয়েস রাইট!”
হেসে ফেলল সম্রাট। পরপরই ভাঁজ পড়ল ভ্রুতে।
“ ইজ শী বাংলাদেশি?”
“ জি বস।”
“ তাহলে তো তোমার পরিচিত হওয়ার কথা।”
“ বস, বাংলাদেশ ছোট্ট দেশ হলেও সবাই সবাইকে চেনে না।”
“ কিন্তু আমাকে তো সবাই চেনে।”
তুহিনের হাসি পেলো, কিন্তু হাসল না। হাসলে সম্রাটের এই কথাটাকে অপমান করা হবে। খুব বিনয় নিয়ে বলল,
“ বস, আমরা তো আপনার মতো সেলিব্রিটি নই।”
সম্রাট উঠে দাঁড়াল। তুহিনও উঠল সাথে সাথে।
একটু রয়েসয়ে শুধাল,
“ একটা কথা জিজ্ঞেস করব, বস?”
“ হু!”
“ না থাক।”
“ আমি জানি কী বলবে,মেয়েটার খোঁজ নিতে কেন বলছি,এইত?”
আন্দাজ মিলে যাওয়ায় তুহিন চোখ নামিয়ে ফেলল। সম্রাট একপেশে হেসে বলল,
“ কারণ আছে,তবে এক্ষুনি বলব না।”
“ ওকে বস।”
“ তুহিন, কল মাই কস্টিউম ডিজাইনার। কনসার্টে কী কী পরব সব আমার সামনে রেডি চাই।”
“ ওকে বস।”
“ তাহলে যাও এখন। আমি দু ঘন্টা ঘুমোবো। এর মধ্যে সুইডেনে মিসাইল পড়লেও আমাকে কেউ ডাকবে না।”
তুহিন এবারেও মাথা দোলায়,
“ জি বস।”
সম্রাট পাওয়ার বাটন একপাশে সরিয়ে ফোন অফ করে দিলো। তুহিন বেরিয়ে গেল নিশ্চুপ। সম্রাটের অফিস রুমের চার দেওয়ালে চারকোল রঙে মোড়ানো। ঐ কালো দেয়ালের ভাঁজে লুকোনো একটা স্লাইডিং ডোর হাত দিয়ে সরাল সে। বেরিয়ে এলো তার আরামদায়ক প্রাইভেট সুইটের রাস্তা। বিশাল রূমের অদূরের ডেস্কে কেবল একটা আলো জ্বলছে। অথচ ম্যাট কংক্রিটের মেঝেটা সহাস্যে গিলে নিচ্ছে সেটুকু। কক্ষের মতো ক্লান্ত চিত্তে বলিষ্ঠ শরীরটা সাবধানে বিছানায় রাখল সম্রাট। এখনো তো হাত ভালো হয়নি। তবে ডার্ক রেড বিছানার চাদরের মাঝে তার ফরসা উন্মুক্ত দেহটা লাগল দাগ তুলে চেয়ে থাকার মতো। সম্রাট চোখ বুজল,অথচ বাঁকা হাসল হঠাৎ। তারপর স্থির নয়ন জোড়া মেলে এক ধ্যানে সিলিং-এর দিকে চেয়ে রইল সে। পুরোনো বাঁকা হাসিটা তিক্ততায় ভিজিয়ে দিয়ে বলল,
“ আমি ক্যারেক্টরলেস টাই-নি লেডি?
নেহাৎ ছোট মানুষ, নাহলে ক্যারেক্টরলেসের সংজ্ঞা তোমাকে হাড়েহাড়ে বুঝিয়ে দিতাম!”
কুহু আজ আর ক্যাফেতে গেল না। ছুটি দিয়েছে না? এখন তাহলে ছুটিই কাটাবে। কে না কে, কোন ব্যাঙের রকস্টার এসে বলল,আর ওনারাও সুরসুর করে ছেড়ে দিলো ওকে। কই, এমনিতে তো গত এক বছরে হলিডে ছাড়া ছুটিই দিতে চায়নি। কুহু বাসে করে
সোজা ডর্মেটরিতে ফিরল। পড়ল সারাবেলা। তারপর রাতের জন্যে রান্নাঘরে গিয়ে সবজি,চিকেন মিশিয়ে খিচুড়ি বসাল। লাউঞ্জে আসতেই ওপাশের রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো মেহেক।
“ এই কিয়ু, কী রান্না করছো?”
কুহু মুচকি হেসে বলল,
“ খিচুড়ি। তোমার জন্যেও বসিয়েছি।”
মেহেক উচ্ছ্বসিত হয়ে ওর দুগাল টেনে দেয়।
“ সত্যি? ইউ আর সো সুইট কিয়ু,আই লাভ ইউ। আমি আর তাহলে রাতের জন্য স্যুপ ট্যুপ করব না। তুমি শুধু একটু ঝাল কম দেবে,কেমন!”
“ আচ্ছা।”
মেহেক খুশিমনে রুমে চলে গেল। সেদিক চেয়ে গাল ভরে হাসল কুহু। মেহেক সুইডিশ। তবে এখানকার মেয়েদের সাধারণত এত সুন্দর নাম হয় না। ওর নাম এরকম কেন,কে জানে! আবার সুইডিশরা তো এত ঝাল-মশলার রান্নাও খেতে পারে না, তাও কুহুর রান্না খুব পছন্দ করে মেয়েটা। খিচুড়ি রাঁধলে তো কথাই নেই। তবে মেহেকের জায়গা কুহুর জীবনে অন্যরকম। এই যে কুহুর ক্যাফের চাকরিটা?
এটা ওর দৌলতেই পাওয়া। কী সুক্ষণে যে মেয়েটার সাথে ওর আলাপ হয়েছিল!
কুহু নিজের রুমে এলো,স্টাডি টেবিলে বসল, এর মাঝেই টোন বাজল ফোনে। স্ক্রিন মেলে দেখল আলভিনের নাম। দুটো আলাদা আলাদা ঘড়ির ছবি পাঠিয়ে লিখেছে,
“ হুইচ ওয়ান?”
কুহু ঠোঁটে টিপে লিখল,
“ গোল্ডেনটা ভালো লাগছে।”
আলভিন নিজে থেকেই সাফাই দিলো ,
“ আসলে দেশে পাঠাব তো। তাই আরকি!”
“ ওহ আচ্ছা।”
“ খেয়েছ?”
“ না। মাত্র রান্না বসিয়েছি। আপনি?”
“ খাইনি। কী রান্না হচ্ছে আজ?”
“ খিচুড়ি।”
“ কুহুর খিচুড়ি নিশ্চয়ই ভীষণ ডিলিসাস?”
কুহু হাসল,
“ খাবেন?”
“ অধমের কি সেই ভাগ্য হবে?”
কুহু দুটো সেকেন্ড চোখ ঘুরিয়ে ভাবল।
তারপর লিখল,
“ ওকে, নেক্সট মিটে নিয়ে যাব।”
“ কিন্তু সেটা কবে হচ্ছে?”
“ কাল?”
“ সত্যি?”
“ হ্যাঁ।”
“ ওক্কে…”
কুহু লিখল – “ আচ্ছা তাহলে শুভ রাত্রি!”
জবাবে একটা মন খারাপ করা ইমুজি দিলো আলভিন। কিছু লিখতে লিখতেও সময় নিয়ে পাঠাল- ওকে।
মেহেক হাত চেটেপুটে খাচ্ছে। প্লেট প্রায় পাতলা হওয়ার যোগাড়। পুরোটা সময় পাশে বসে ওকে মন ভরে দেখল কুহু। মেয়েটা দেখতে ভীষণ সুন্দর! বলতে গেলে এই ডর্মের সবচেয়ে সুন্দরী সে। তবে বাংলা জানে না। হিন্দি,ইংলিশ আর সুইডিশ ভাষায় অভ্যস্ত! কারণ ওর মা নাকি গুজরাটি। কুহুকেও সেজন্যে ওর সাথে ইংলিশ আর ইন্দি বলতে হয়। মেহেক প্রশংসার ঝুড়ি মেলে বলল,
“ তোমার রান্না বেস্ট কিয়ু, এত ছোটো বাবু এত ভালো রান্না করে ও মাই গড!”
উত্তরে হেসে ফেলল কুহু। মেহেক ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সেজন্যে ওকে ছোটো ভাবে, যদিও সেই হিসেবে ও ছোটোই। কিন্তু এইটুকু জীবনে কুহু যা যা দেখে ফেলেছে,তা অনেকেই দেখেনি।
মেহেক বলল,
“ কিয়ু স্যামের কনসার্টে কী পরবে,ঠিক করলে?”
কুহুর মুখটা অমনি শক্ত হয়ে গেল।
“ আমি তো কনসার্টে যাচ্ছি না।”
“ সে কী, আমি যে তোমার টিকিট কেটে ফেলেছি। আচ্ছা যাবে না কেন? তোমার তো এক্সামে গ্যাপ আছে। প্লিজ চলো আমার সাথে। তুমি ছাড়া আমার ভালো লাগবে না।”
“ আমি যাব না, মেহেক।”
“ ডর্মে কিন্তু কেউ থাকবে না কিয়ু, একা থাকবে তুমি? তাও এমন ফাঁকা জায়গায়! আমরা কখন আসব কেউ জানি না। তুমি একা কী করে থাকবে?”
কুহু এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেল। সত্যিই তো,
এত বড়ো ডর্মেটরিতে ও একদম একা থাকবে? মেয়েটার মুখায়বে ভেসে ওঠা ভয় স্পষ্ট বুঝে ফেলল মেহেক। কণ্ঠ চেপে হুলস্থূল করে বলল,
“ তুমি জানো কিয়ু, এই ডর্মের একটা ইতিহাস আছে। শুনেছিলাম ১৮৮৯ তে এখানে একজন মেয়ে সুইসাইড করেছিল। তারপর থেকে নাকি ডর্ম আগের মতো নেই। মাঝেমধ্যে ছাঁয়া দেখা য্যা।”
কুহু আঁতকে উঠল,
“ কী বলছো?”
“ তোমাকে কেউ বলেনি?”
“ না তো।”
“ হয়ত কথা ওঠেনি, তাই বলেনি। তাছাড়া এখানে এলেই তো এক বছর হলো না। যাক গে,একা থাকতে হবে না কিয়ু,তোমাকে আমি একা রেখে যাবই না। তুমি তৈরি হও,আমার সাথে যাবে।”
কুহু কী করবে বুঝল না। ঠোঁট টিপে বসে থাকতে দেখে ও বলল,
“ আজকে তোমার বোধ হয় মন ভালো নেই। তাহলে কিন্তু তোমার আরো বেশি করে যাওয়া উচিত। স্যামের গান শুনলে, ওকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যাবে দেখো। আমি তো ওকে আজ প্রথম বার দেখব,তাও এত কাছ থেকে। ছবিতে ও এত হট,সেক্সি… সামনে থেকে না জানি আরো কতটা হ্যান্ডসাম হবে। ওকে যে কেন হিরো বানাচ্ছে না!”
কুহু পারল না বালিশ গুঁজে মেহেকের মুখটা বন্ধ করে দিতে। শুধু দাঁত পিষে চুপ করে মাথা নুইয়ে রইল। হুহ,হিরো বানাবে! কাজবাজ,কথাবার্তা শয়তান ভিলেনদের মতো। আর যেভাবে তাকায়…
ততক্ষণে মেহেকের খাওয়া শেষ। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
“ কিয়ু আমি রেডি হচ্ছি। তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি করো।”
কুহু তখনো দ্বিধায় ভুগছে। ওই অসভ্যটার কনসার্টে যাওয়ার একটুও ইচ্ছে ওর নেই। কিন্তু ডর্মে একা থাকবেও বা কী করে? এর আগে কখনো একা থাকেনি। ছুটি-টুটি পড়লে মেহেক ওকে ওদের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে শুধু মেহেকের মা-বাবাই থাকেন। কুহু
বিরস মুখে শ্বাস ফেলল। এখন কী ঝামেলা এসব!
রাত তখন অনেক! পিচের সমান রাস্তায় বরফ পড়ছে বোধ হয়। সেই শীতে দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে কুহুর। কানে টুপি,হাঁটু অবধি টপের ওপর একটা উলের সোয়েটার,হাতে থার্মাল, পায়ে কেডস পরার পরেও ওর শীত এক ফোঁটা কমেনি। অথচ এলিন, থেমি, মেহেক ওরা প্রত্যেকেই কেমন ছোটো ছোটো জামা পরে বেরিয়েছে। সোয়েটার পড়েছে,তবে না পড়ার মতো। সবার ফরসা-নগ্ন হাঁটু দেখে কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কনসার্ট হচ্ছে স্টকহোমে। বিশাল বড়ো ভেন্যু! খুব জনপ্রিয় কেউ নাহলে এই ভেন্যুর কনসার্টে গেস্ট বানিয়ে আনা হয় না।
কানে ছুটে আসা তীব্র হৈচৈ এর শব্দে মুখ কুঁচকাল কুহু। ভেন্যুর বাইরে থেকেই ভিড় জমেছে।
সুইডেনের সব ছেলেমেয়েই কি এখানে নাকি!
কালো কোর্ট, স্কার্ফে মোড়া মানুষজন, আর ওয়েস্টার্ণের মেয়েগুলো দেখে কুহুর খুব আক্ষেপ হলো। এরা এত পাগল,যদি ওর মতো ওই লোকের আসল রূপ জানতো! ততক্ষণে এলিনরা ভেতরে ছুটে গিয়েছে।
মেহেক, ওর হাতটা ধরে বলল,
“ চলো চলো ফাস্ট!”
কুহু রোবটিক পুতুলের মতো সাথে সাথে ছুটল।
ভেন্যুর ভেতরে এসেই মাথা জমে গেল আলো আর শব্দে। মেহেক পাশেই দাঁড়িয়ে, অথচ শব্দের জন্যে জোরে জোরে বলল,
“ আমার সাথে সাথে থেকো কিয়ু, হারিয়ে যেও না।”
ওরা স্টেজের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। সামনে তখন একজন গান গাইছিলেন ,কিন্তু কুহু আশ্চর্য হয়ে গেল ওই শিল্পীর সামনেই ছেলেপেলে চিৎকার করছে,
“ হোয়ার ইজ স্যাম,হোয়ার ইজ স্যাম…” বলে বলে। শুধু ওরা? পাশ থেকে সেই চিৎকারের সঙ্গে যখন থেমি, এলিন এমনকি মেহেকও গলা মেলাল কুহু পারল না সবাইকে বোম মেরে উড়িয়ে দিতে। কিন্তু কী করার! এসেছে যখন সহ্য তো করতেই হবে।
গানে গানে সময় কাটল। এলিন অধৈর্য হয়ে বলল,
“ হোয়ার ইজ মাই বয়? আমার আর ভালো লাগছে না। কখন আসবে ও?”
মেহেক বলল,
“ আসবে আসবে, ও হচ্ছে স্যাম। ও আমাদের মতো এত আগে এলে হয়? ও আসবে ওর মতো করে।”
ভেন্যুর এই এরিয়া সত্যিই বিরাট বড়ো। যেন মস্ত বড়ো ফুটবল মাঠ। চারপাশের চোখ ধাঁধানো আলোয় কুহু স্পষ্ট দেখছে এখানে লোকজন গিজগিজ করছিল। ঘড়িতে প্রায় একটা ছুঁইছুঁই সেসময়, নীরস মুখে প্রত্যেকে গান উপভোগ করছে। সেরকম উত্তেজনা নেই। তবে একটু আগেই হোস্ট স্টেজে উঠে বলে গেছেন,
“ স্যাম আসছে। আর কিছুক্ষণ।”
সেই কিছুক্ষণ এবার কাটল বোধ হয়। হুট করে আকাশ পথে বাতাসের একটা সাইসাই শব্দ শোনা গেল। একদম স্টেজের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সেটা। সবার সাথে সাথে মাথা তুলে চাইল কুহু। এক বিশাল কালো দানবাকৃতির হেলিকপ্টার উড়ছে। ধীর গতি,বোঝাই যাচ্ছে এক্ষুনি নামবে কোথাও। তবে
কুহুর কান ফেটে গেল মানুষের চিৎকারে,
“ স্যাম,স্যাম….স্যাম ইজ হিয়্যার….” এর মানে হেলিকপ্টারে ওই লোকটা আছে? অমনি চোখ নামিয়ে নিলো সে। এলিন গলা ফাটিয়ে বলল,
“ স্যাম আই লাভ ইউ। স্যাম…”
কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতে কপাল নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল,
“ ও গড আমি কেন এলাম? কেন?”
হেলিকপ্টার চলে গেল ব্যাকস্টেজের হেলিপ্যাডের দিকে। কেউ কেউ পাগলের মতো ছুটতে চাইল সেখানে, গার্ডরা স্বদ্যোগে আটকে দিলেন।
কুহু বুঝে পায় না,এত পাগলামি কীসের? উফ! অতিরিক্ত। গান শুনবি শোন,এরা সব মরে যাচ্ছে।
সম্রাট হেলিকপ্টারের দরজা টেনে সরাল,অমনি এক ঝটকা রঙিন আলোয় জ্বলে উঠল স্বীয় সবুজ চোখ। অদূরের ওই ভিড়ের উত্তেজনা দেখে ঠোঁটের কোণ বেঁকিয়ে হাসল সে। সেফটির জন্যে পরা হেলমেটটা খুলে রাখল পাশে৷ পরপর পা জোড়া নামিয়ে দাঁড়াল মাটিতে। কপালের ব্যাণ্ডেজ নেই,তবে ছড়ানো এলোমেলো চুল বাম হাতের চার আঙুল চালিয়ে একপাশে ঠেলল সে। পরনে লেদারের ফিটেড জ্যাকেট থেকেও মাংসপেশী বিশেষ ভাবে চোখে পড়ছে তার। দর্শকের অর্ধেকই ছিড়েখুঁড়ে আসতে চাইছে হেলিপ্যাডের এখানে। সম্রাট হাত তুলে নাড়তেই একটা চিকণ চিৎকারে মেতে উঠল বাতাস। কারো কারো চোখ আটকাল তার প্লাস্টার মোড়ানো হাতে। উৎকণ্ঠার সুর স্লোগানে স্লোগানে ভেসে গেল,
“ স্যাম,স্যাম স্যাম! হোয়াই আর ইউ ইনজিইউরড।”
সম্রাট হাসল। একেকটি ক্যামেরার ফ্ল্যাশে বাড়ল সেই হাসি। এক পল ঠান্ডা চোখ ঘুরিয়ে চাইল পাশে দাঁড়ানো তুহিনের দিকে। ছেলেটা মুচকি হেসে চোখ নামাল।
তক্ষুনি কনসার্টের কর্তৃপক্ষ ছুটে এলেন,
“ স্যার আসুন,suv রেডি।”
এখান থেকে সম্রাট আগে পার্ফমার লাউঞ্জে যাবে। তার জন্যে একদম আলাদা লাউঞ্জ বরাদ্দ। SUV – এ তুহিনও সম্রাটের সাথে সাথে উঠল,উঠল তার দেহরক্ষীরাও। সম্রাট স্পষ্ট শুনতে পেলো এখনো তার ফ্যানরা গলা ফাটিয়ে স্যাম স্যাম করছে। তুহিন চশমা ঠেলে গর্বের হাসি হাসল। এরকম একটা মানুষের পি এ- সে, ভাবতেই বুকের ভেতর প্রজাপতি উড়ে যায়।
প্রায় আধঘন্টা পর ভেন্যুর সবুজ-হলুদ আলোয় সম্রাটের ছায়া দেখা গেল। স্টেজে উঠছে সে। আজ পিঠে গিটার নেই। তবে লেদারের জ্যাকেট কোমরের পেছন থেকে এনে সামনের দিকে বাঁধা। এত শীত,অথচ গায়ে শুধু ব্রাউন ফিটেড মাসল-টি শার্ট। সেখান থেকে দিব্যি ফরসা নগ্ন বাহু বেরিয়ে আছে। চোখেমুখে সেই নির্লিপ্ত আত্মবিশ্বাস, আর অদ্ভুত গরিমা নিয়ে এক হাত তুলে নাড়ল সবার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকারে ভেসে গেল গোটা স্থান। স্যাম স্যাম বলে যেন গলার শিরা খুলে ফেলছে। কুহুর মনে হলো কানের সাথে সাথে ও নিজেও ফেটে যাচ্ছে এবার। সাথে একে অন্যের ঠেলাঠেলি ঠাসাঠাসিতে তলিয়ে যাচ্ছে ভিড়ে। এদিকে এলিনদের হুশ নেই। সম্রাটকে দেখে হাঁ করে চেয়ে আছে সবাই।
সম্রাট সোজা এসে ঠাড়, লম্বা স্ট্যান্ডে বসানো মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াল। তার পেছনে আরো গোটা দশেক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে একেকজন। ড্রাম বিট,সিন্থেসাইজার,ইলেক্সট্রিক গিটার সহ আরো অনেক কিছু সেখানে।
সম্রাট স্ট্যান্ড থেকে মাইক খুলে হাতে নিলো। উঁচু স্বরে প্রথম বাক্য ছুড়ল,
“ হ্যাল্লো স্টকহোম!”
উত্তর এলো বাতাসের গতিতে,
“ হ্যালো স্যাম, হ্যালো।”
“ সরি,আমার একটা এক্সিডেন্ট হওয়ায় আজ গিটার বাজাতে পারব না। কিন্তু আমি জানি আমার গান আর তোমাদের উচ্ছ্বাস এইসবই আমার গিটারের সুর। এই অসুস্থ শরীরে সেজন্যেই তো এখানে আসা।”
সবাই ইয়েস ইয়েস বলে চ্যাঁচাল।
সম্রাট বলল,
“ থ্যাংক্স ফর কামিং গাইস,অল অফ ইউ আর আমেইজিং। আই লাভ ইউ অল…”
উত্তেজনা বাড়ল,বাড়ল চ্যঁাচামেচি।
মানুষ জন পারছে না স্টেজে উঠে যেতে। সম্রাট পেছন ফিরে বাকিদের কিছু একটা বলল। হয়ত কোন গান গাইবে সেই ব্যাপারে!
মুহূর্তে ড্রাম বিটে ঝন করে শব্দ হলো একটা। গিটারের তাল ধরে একেক করে একেকটি বাদ্য বাজল। সম্রাট বুট পরা পায়ের পাতা তালে তালে নাড়ল, চিৎকার করে বলল
“ আর ইউ রেডি ফর নয়েজ?”
“ ইয়েস ইয়েস।”
কুহু দুহাত বুকে গুজে নাক কুঁচকে তাকিয়ে রইল। সম্রাট চোখ বন্ধ করে থম মেরে যায়। দশ সেকেন্ড ওভাবেই চুপ করে থাকে। একটা ছোট্ট নিশ্চুপতার রাশ টেনে সুর ধরে আচমকা,
“ Oh, I cannot explain,
every time, it’s the same.
Oh, I feel that it’s real, take my heart.
I’ve been lonely too long,
oh, I can’t be so strong,
Take the chance for romance,
take my heart.
I need you so There’s no time,
I’ll ever go… “
এ অবধি এসে দর্শকের দিকে মাইক ঘুরিয়ে ধরল সে,সাথে সাথে ভাসল কতগুলো মিশ্র গলার সুরে, “Cheri, cheri lady
Goin’ through a motion,
Love is where you find it,
Listen to your heart…”
সম্রাট গাইতে গাইতে কোমর থেকে প্যাঁচ খুলে জ্যাকেটটা ছুড়ে মারল হঠাৎ। সঙ্গে সঙ্গে সেটা উড়ে গিয়ে শ্রোতাদের ভিড়ে পড়ল। এক দফা কাড়াকাড়ি চলল সেখানে। কেমন ষাড়ের মতো ছুটল একেকজন। এলিনও গেল,কিন্তু পায়নি। তার আগেই অন্য এক ছেলে ধরে ফেলেছে। সাথে সাথে হাত তালি পড়ল। বিজয়ের আহ্লাদে,উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে ভেসে গেল সে। হুট করে ভিড় ছাপিয়ে একটা মেয়ে উঠে এলো স্টেজে। গার্ড আটকাতে চাইলেন,সম্রাট হাত দিয়ে ইশারা করল। বোঝাল -আসতে দিতে। মেয়েটার পরনে শর্ট স্কার্ট,হাঁটু সমান বুট জুতো। স্যাম বলে এক চিৎকার দিয়ে সম্রাটের দিকে ছুটে এলো সে। দুহাত মেলে জাপটে ধরল ওর পেটানো শরীরটা।
তবে,সম্রাট মেয়ের গায়ে হাত ছোঁয়ায় না। একদম অল্প একটু আলিঙ্গন, না করার মতো ভাবে মেয়েটার মাথায় হাত রাখল সে। দুটো চাপড় কেটেই সরিয়ে দিলো আবার। আর অমনি কুহুর চোখ কপালে উঠে গেল। ওরে পল্টিবাজ! ওই বন্ধ ঘরে ওর ইনার নিয়ে কথা বলে এখন দর্শকের সামনে সাধু পুরুষ সাজা হচ্ছে!
ভিড় থেকে একেকজন স্টেজের দিকে হাত বাড়িয়ে রাখল। চাইল,একটুখানি সম্রাট যেন হাতটা ধরে ওদের। সম্রাট অবশ্য ভক্তদের কখনো নিরাশ করে না। ঝুঁকে ঝুঁকে যার হাত সামনে পড়ছে,হ্যান্ড শেক করছে সে। কুহু এবার খেয়াল করল,সম্রাটের গলায় একটা সিলভারের চেইন আছে। নিচু হওয়ায় ঝুলছে সেটা। চেইনের লকেটে একটা ছোট্ট চাবি। এ আবার কী অদ্ভুত স্টাইল রে বাবা!
হাতে নামের অক্ষর লেখা আংটি,আবার গলায় চাবি। তক্ষুনি এলিন রকেটের বেগে দুহাতে ভিড় ঠেলে স্টেজের একদম সামনে চলে গেল। আজ সে স্যামকে ছোঁবেই,ছোঁবে। দেখাদেখি মেহেকও কুহুর হাতটা ধরে বলল,
“ এসো এসো কিয়ু,আমরাও যাই। এখানে দাঁড়ালে স্যামকে ছুঁতে পারব না।”
কুহু বলতে চাইল ; আমি ছুঁতে চাচ্ছিও না। কিন্তু মেহেকের টানাটানিতে পারেনি সেসব। এদিকে এলিন লাফাচ্ছে,হাত বাড়িয়ে চ্যাঁচাচ্ছে,“ স্যাম হিয়্যার প্লিজ, প্লিজ স্যাম.. শেক মাই হ্যান্ড প্লিজ!
মেহেক ওরাও হাত বাড়াল। কুহুর মেজাজ ভীষণ খারাপ হলো তাতে। কটমট করে আরেকদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল ও। এলিন তক্ষুনি গলা ফাটিয়ে বলল, “ স্যাম ও মাই গড,ইউ টাচ মি।” কৌতূহলে তড়িৎ ফিরে চাইল কুহু। দেখল, সম্রাট এলিনের হাত ধরেছে। পরপরই ঝট করে ঘাড়টা বাঁকিয়ে ওর দিকে ফিরল সে। সবুজ মনি জোড়া অমন তড়াক করে তাক হতেই কুহুর শরীর শিউরে উঠল। পরিষ্কার চোখাচোখিতে একটা ভ্রু ওপরে তুলল সম্রাট। খুব আস্তে ফিসফিসিয়ে বলল,
“ হেই সুইটহার্ট…”
চলবে…
Share On:
TAGS: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি, হেই সুইটহার্ট
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৮
-
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৬
-
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৭
-
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২
-
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৫
-
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১
-
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৩
-
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১২
-
হেই সুইটহার্ট পর্ব ১
-
হেই সুইটহার্ট পর্ব ২