সোনাডিঙি_নৌকো (৫)
মৃধা_মৌনি
দীক্ষা পা রাখল বাড়ির ভেতর। গেটের বাঁশের দরজাটা ঠেলে যখন ঢুকল, ঠান্ডা একটা বাতাস এসে তার গাল ছুঁয়ে গেল। টিনের চালের নিচে হালকা কুয়াশা জমেছে, বারান্দার ছায়ায় জমে থাকা শিশিরে তার পায়ের আওয়াজ পর্যন্ত মোলায়েম হয়ে গেল।
বাড়িটা পুরোনো, কিন্তু সুন্দর। একতলা, টিনের ছাউনি নেমে এসেছে নিচু করে, সামনের উঠোনে ছড়িয়ে আছে শুকনো পাতার খসখস শব্দ, মাঝখানে একটা ছোট কুয়ো, যার পাশে রাখা আছে পিতলের একটা কলস।
ডানদিকে তিন রুমের সারি-
প্রথম ঘরটা বসার ঘর, দেয়ালে ফিকে হয়ে যাওয়া সবুজ রঙ। কাঠের বেঞ্চ, একটা পুরনো টেবিল আর একপাশে ছোট আলমারি। আলমারির উপর ঘড়ি টিকটিক করে চলেছে।
তার পাশের ঘরটা দীক্ষার মার, দরজাটা আধখোলা, ভেতর থেকে কেরোসিনের হালকা গন্ধ ভেসে আসছে। একটা স্টিলের খাট, তার উপর চাদর ভাঁজ করে রাখা, পাশে ছোট আয়নার টেবিল, তার উপর চিরুনি, আতর আর একটা ফাটা চায়ের কাপ।
সবচেয়ে ভেতরের ঘরটা বড় মামার। বাড়ির সবচেয়ে বড় ঘর। দেয়ালে খোদাই করা কাঠের ফ্রেমে টানানো মামার তরুণ বয়সের ছবি। খাটের পাশে আলমারিতে কয়েকটা পুরনো বই, আর একটা তসবিহ ঝুলছে। বাতাসে ধূপের গন্ধ এখনো বিদ্যমান।
বাড়ির বাম দিকে রান্নাঘর। ওটা আলাদা ঘর, টিনের ছাউনি নিচু করে দেওয়া। ভেতরে মাটির চুলা, একটা সিলিন্ডার গ্যাসের চুলাও উঠিয়েছে মামা ইদানীংকাল। তাড়াহুড়োর কাজে লাগে। পাশেই চাপকল, যেখান থেকে পানি টেনে কলস ভরা হয়। চাপকলের চারপাশে সবুজ ঘাস আর কচুপাতার ঝোপ। দিনের বেলায় প্রচুর পাখি এসে বসে এখানটায়।
পেছনের দিকে ও একটুকরো উঠোন- সেখানেই পুকুর। ঘাটের ধারে শেওলা জমে আছে, পাড়ে একটা কলাগাছ হেলে পড়েছে জলের দিকে। সেদিক থেকেই ভেসে আসছে ব্যাঙের একঘেয়ে স্বরের ডাক।
দীক্ষা একবার চারপাশে তাকাল। এই বাড়িটা যেন সময়ের ভেতর আটকে থাকা কোনো ফ্রেম। প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি দাগ, প্রতিটি টিনের আওয়াজ যেন চেনে তাকে। শিশিরের সঙ্গে বিয়ের পর সেভাবে আর আসা হয়নি। তবু এতদিন পর এসেও মনে হচ্ছে, এইতো সেদিনই ওই পুকুর ঘাটে বসে আম ভর্তা বানিয়ে খেয়েছিল ওরা তিন বোন। বড় মামার একটি মেয়েও আছে। বকুল নাম।
দীক্ষা পা মুছে বারান্দায় উঠতেই ভেতর থেকে একটা দরজার কড়ার শব্দ এল। মুহূর্তেই দেখা দিলো খালেদা বেগম- দীক্ষার মা। পরনে হালকা নীল ছাপা শাড়ি, চোখে ঘুম জড়ানো ক্লান্তি, মুখে একটু অনিচ্ছার রেখা।
তিনি কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার চৌকাঠে।
দীক্ষার দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখে প্রথমে বিস্ময় খেলল। তারপর হালকা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
—“ঠিকঠাক মতো আসতে পারছিস?”
খালেদা বেগম দীক্ষার দিকে এগিয়ে বললেন,
—“আসার পথে কোনো সমস্যা হয় নাই তো?”
—“ঠিকঠাক ভাবেই আসছি। কোনো সমস্যা হয়নি। তুমি কেমন আছ মা?”
খালেদা বেগম বললেন,
—“ভালো আছি। আয়, ভেতরে উঠে আয়। এই ঠান্ডায় সোয়েটার পরিসনি কেন?”
—“তোমাদের এদিকে এত ঠান্ডা পড়ে গেছে, সে কি আমি জানি নাকি! শহরে তো ফুল স্পিডে ফ্যান চলে।”
—“আয়, হাত – মুখ পড়ে ধুবি, আগে ভেতরে এসে বস।”
ভেতরে ঢুকে দীক্ষা চারপাশে তাকাল। ঘরের বাতাসে আছে ধূপ আর মাটির মিশ্র গন্ধ। দেয়ালের কোণে ছোট একটা টেবিলে কেরোসিন বাতি জ্বলছে। তার হলুদ আলোয় খালেদার মুখটা আরো ক্লান্ত, আরো বয়স্ক লাগছে।
বড় মামা পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন হাসিমুখে।
—“আসলি রে মা। এত রোগা হয়ে গেছিস যে? খাওয়া দাওয়া করিস না রে ঠিক মতো?”
তিনি এসে দীক্ষার মাথায় হাত রাখলেন। দীক্ষা কিছু বলতে পারল না। ঠোঁট কাঁপল তার, চোখে পানি চিকচিক করে উঠল। বাবার পর এই একটা মানুষ তাদের মাথায় বটগাছের মতোন ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
—“আসতে অসুবিধা হয়নি তো না? গরম পানি আনছে বকুল। ওই দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে তারপর খেতে বস। রাত অনেক হলো।”
দীক্ষা ক্লান্ত গলায় জানাল,
—“আমার জন্য ব্যস্ত হতে হবে না মামা। আমি ঠিক আছি। আর কিছু খাবোও না। এতদূর জার্নি করে এসে গা গুলোচ্ছে।”
—“একদম খালি পেটে শুবি নাকি!”
—-“সত্যি বলছি মামা। আমার কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি একটু ঘুমোতে চাই মামা। মনে হয় কতদিন আমি ঠিকঠাক ঘুমাই না!”
বড় মামা কি যেন দেখলেন ওই চোখে, আর কথা বাড়ালেন না তিনি।
অল্পতে বললেন,
—“হাত মুখ ধুয়ে একটা সিদ্ধ ডিম খেয়ে নে অন্তত। তারপর শুয়ে পড়।”
তিনি বেরিয়ে যেতেই দীক্ষা মায়ের দিকে তাকাল। মা কেমন যেন চিমসে গেছেন ইতিমধ্যেই। তার আসাতে মায়ের এতই অসুবিধা হলো? দীক্ষার হঠাৎ করেই বাবার কথা খুব মনে পড়তে লাগল।
বকুল এসে দরজায় দাঁড়াল। ওখান থেকেই ক্ষীণ স্বরে ডাকল,
—“আপা তোমার পানি…”
দীক্ষা চোখে – মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
—-“ভেতরে আয়। দরজায় দাঁড়ালি কেন? এদিকে আয়।”
বকুল পায়ে পায়ে এলো। কী ভীষণ জড়তা কাজ করছে তার মনের মধ্যে। দীক্ষা অবাক হলো। এইটুকুনি দেখে গেছিল মেয়েটাকে। মামার চটপট মা র ত আর চিৎকার করে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলত মেয়েটা। অথচ এখন এ যেন মেয়ে নয় এক পরিপূর্ণ নারী। মাথায় ওড়নার আঁচল তুলে দেওয়া, চোখেমুখে রাজ্যের লজ্জা এসে ভর করেছে, কথাও বলছে গলা নামিয়ে।
দীক্ষা মুগ্ধ গলায় বলল,
—“তুই দেখি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছিস হ্যাঁ রে বকুল! মামা কি এখনো মা রে তোকে? মা র লে নিশ্চয়ই কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলিস? নাকি সেটাও চেঞ্জ হুম?”
বকুল জবাবে কিছু বলল না। অল্প একটু হেসে বলল,
—“পানি ঠান্ডা হয়ে যাবে। বাইরে নিশি পড়তেছে। আপনি আসেন। হাত-মুখ টা ধুইয়া নেন। আমি ডিম সেদ্ধ বসাইছি। বেশিক্ষণ লাগব না। আসেন আপা।”
উঠোনে নেমে এলো দীক্ষা। এক কোণে কাজলকে দেখা যাচ্ছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে নিশ্চয়ই শান্ত৷ অন্ধকারে তাকে দেখা যায় না তবে হাতে কিছু একটা জ্বলছে তা স্পষ্ট। নিশ্চয়ই সিগারেট। সেদিকে এক নজর তাকিয়ে হাত-মুখ ধুতে লাগল সে। বকুল কে জিজ্ঞেস করল,
—“মামী কই রে? কেমন আছে?”
—“ভালো আছে।”
—“ঘুমিয়ে পড়ছে?”
—“মা রে তালা বন্ধ করে রাখতে হয় আপা।”
দীক্ষা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল বকুলের দিকে। বকুল হালকা হাসল।
—“পাগলামি আরও বাড়ছে আপা। কাউরে সহ্য করতে পারে না। আমারে তো পারেই না।”
—“তাই বলে তালা দিয়ে রাখতে হবে?”
—“একদিন খুব আদর আদর করে কথা বলল আপা। তারপর বলল খুলে দিতে। আমিও সরল মনে খুলে দিলাম। এরপর রান্নাঘর থেকে বটি নিয়ে আমাকে কো পা তে আসছিল। ভাগ্যিস আব্বা বাড়িতেই ছিল। সে না ঠেকালে আমি তো… এরপর থেকেই তালা দিয়ে রাখছে আব্বা।”
দীক্ষা আর কিছুই বলতে পারল। বকুল স্বাভাবিক ভাবেই দীক্ষার পায়ের পাতায় উষ্ণ গরম পানি ঢালতে লাগল। একটা জিনিস তার বুকের ভেতর কাঁকড়ার ন্যায় কামড়ে ধরল হঠাৎই। বড় মামারা ভালো নেই। তাদের এই অবস্থায় সে নিজেও এমন ভাবে এসেছে! বুক চিঁড়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। ভাগ্য যে কি লিখে রেখেছে, কে জানে!
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিলো শান্ত। পায়ের নিচে পিষ্ট করতে করতে বলল,
—“শালা, একটু ধন্যবাদ ও দিলো না! সব নষ্টের গোড়া তুই। শুরুতেই ভেজাল কথা বইলা আমার ইজ্জতের ফালুদা বানাই দিছোস।”
কাজল মিনমিন স্বরে শুধালো,
—“আপার মন টন একটু খারাপ তো। আমি ধন্যবাদ দিলাম আপনারে শান্ত ভাই। থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ।”
—“আরে রাখ তো থ্যাংকু। তোরটা দিয়ে করব টা কি? শুকনা জিনিস.. আচ্ছা তোর আপার মন খারাপ কেন? চাচীও দেখলাম তারে দেইখা খুব একটা খুশি হইলো না। সব কেমন ঠান্ডা মাইরা রইছে। ঘটনা কি? উনি তো বোধহয় পোয়াতি। এই অবস্থায় একলা এতদূর আইছে.. কি রে কাজল, কাহিনি কি?”
মৃদু শ্বাস ফেলল কাজল।
—“ঘটনা কি আমিও ঠিক জানি না। তবে শুনছি আপায় আসতেছে। একা একা। আমারে বইলা রাখছে গিয়া আগাইয়া নিয়া আসতে। এইটুকুই। তবে ভাবভঙ্গিতে বুঝছি, আপার সাথে বড় কোনো গোলমাল হইছে তার শ্বশুর বাড়িতে। আপা তাই চইলা আসতেছে।”
—“একবারের জন্যে?”
—“জানি না শান্ত ভাই। ফুপুর মনটাও ভালো না। আব্বায় তো জানোই কেমন রাগী মানুষ। কারে জিজ্ঞাস করমু কও?”
শান্ত কিছু বলল না। রাত বাড়ছে। শীত জেঁকে ধরছে। দু হাত কাঁচুমাচু করে ভাঁজ করে রেখেছে সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে এক তলা বাড়িটির দিকে। হয়তো কাউকে আর একবার দেখতে চাইছে অবচেতন মন.. কিন্তু, সেই কেউটা কে? শান্ত শত খুঁজেও এর উত্তর পেল না। কেবল একটা অস্বস্তিকর অশান্তি নিয়ে উশখুশ করতে করতে সে বেরিয়ে গেল এ বাড়ি ছেড়ে।
বড় মামা দরজাটা খুলে দিলেন।
ঘরটা ছোট, কিন্তু পরিপাটি। দেয়ালের একপাশে কাঠের খাট, তাতে পুরনো নকশিকাঁথা বিছানো। জানালার পাশে টেবিলের উপর একটা তেলবাতি জ্বলছে মৃদু আলোয়। বাতাসে ঘুমের আগের নরম নিস্তব্ধতা।
দীক্ষা ধীরে ধীরে ব্যাগটা নামিয়ে রাখল খাটের পাশে। জানালার কাঁচ আধখোলা, বাইরে কুয়াশায় মোড়ানো পুকুরের জলে চাঁদের ফিকে প্রতিচ্ছবি কাঁপছে। পুকুরের ধারে হয়তো বাতাসে কলাগাছের পাতার শব্দ হচ্ছে। একটা ফসফস ফসফস আওয়াজ দীক্ষার কানে ভেসে এলো।
তার চোখ এক মুহূর্তে চলে গেল দেয়ালের দিকে। ওখানেই ঝুলছে পুরনো ক্যালেন্ডারটা, ঠিক সেই বছরটার যখন সে শেষবার এই বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিল। সময় যেন থেমে গেছে এখানেই, কেউ আর কিছু ছোঁয়নি।
দীক্ষা খাটে বসে পড়ল। হাতটা রাখল নকশিকাঁথার উপর। স্পর্শে মনে হলো এতদিন আগের কেউ হয়তো এখনও এই কাঁথায় ঘুমায়, কিংবা তারই কোনো গন্ধ এতে রয়ে গেছে।
চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ল- কত শত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই ঘরে। মৃদু স্বরে কেউ যেন বাতাসের মধ্যে সেই দিনগুলির প্রতিচ্ছবি কল্পকাহিনির মতো করে বলে বলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দীক্ষা হঠাৎ জানালার দিকে তাকাল। বাইরে পুকুরের ঘাটে কুয়াশা ঘন হচ্ছে, জলের উপর ধোঁয়ার মতো কুয়াশার আস্তর। টিনের ছাউনি থেকে শিশির পড়ছে ধীরে ধীরে। একটা পেঁচা ডেকে উঠল গাছের ডালে-
হু-হু শব্দে…
তার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল।
মনে হলো, এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি টিনের আওয়াজ, প্রতিটি গাছ যেন তাকে চিনে- তবু কেউ আজ তাকে আপন করে নেয় না।
সে একটুখানি হেলান দিল দেয়ালে, চোখ বন্ধ করল।
মন কাঁপছে, শরীর ক্লান্ত, কিন্তু ঘুম আসছে না।
মায়ের মুখটা বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে- সেই শীতল, নিঃস্পন্দ মুখ।
বাইরে কুকুরের ডাকে নিস্তব্ধতা খানিকটা ভাঙল।
দীক্ষা ধীরে ধীরে নকশিকাঁথাটা গায়ে টেনে নিলো। তারপর ফিসফিস করে বলল,
—“বাড়িতে ফিরেও যেন কোথাও ফিরতে পারিনি আমি…”
বকুল চট করে তাকাল,
—“কিছু বললে আপা?”
—“উঁ? না, কিছু না। এই ঘরটায় তোরা কেউ থাকিসনি এতদিন?”
—“থেকেছি তো। তুমি চলে যাওয়ার পরেও আমি আর তৃণা এখানেই ঘুমিয়েছি। এরপর তৃণাও চলে গেল। তখন একা একা শুতে কেমন অস্বস্তিবোধ হতো। তাই রাত হলেই ফুপুর কাছে চলে যেতাম।”
দীক্ষা হঠাৎ একটা অন্যরকম প্রশ্ন করে বসল,
—“আমি আসায় তোরা খুব অখুশি হয়েছিস, তাই না বকুল?”
বকুল শীতল চোখে দীক্ষার দিকে চাইলো।
পরমুহূর্তেই খিলখিল করে হেসে উঠল। কিশোরী তরুণীর ন্যায়- সে হাসি গিয়ে ধাক্কা দিলো ঘরের চার দেয়ালে। বকুল চুপ করে গেল। তবে তার শরীর থেকে হাসির দমক সরল না মোটেই।
—“কিসব অদ্ভুত কথা বলো না আপা! অখুশি হতে যাব কেন? বাড়িতে মেহমান আসলেও কেউ অখুশি হয় না আর সেখানে তুমি তো এ বাড়িরই মেয়ে।”
দীক্ষা অবাক হলো। সেই সঙ্গে মুগ্ধও হলো আরও একবার। বকুল কত সরল সোজা ছিল। আর এখন…বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া সবসময় চিকচিক করতে থাকে। রাতারাতি পরিবর্তন ঘটে নারীর- এ কথা বুঝি সত্যই!
বকুল এগিয়ে এসে দীক্ষার পিঠের পেছনে একটা বালিশ টেনে দিলো। নকশিকাঁথার উপর কম্বলটাও টেনে দিলো কোল পর্যন্ত। তারপর বসে ধীরস্থির কণ্ঠে বলল,
—“কাল থেকে হাড়িতে এক মুঠ চাল বাড়তি দিতে হবে। তাছাড়া আর কোনো আহামরি পরিবর্তন দেখছি না আমি। তুমি অযথাই এত চিন্তা করছ আপা। উদ্বিগ্ন হচ্ছো। এসব নিয়ে না ভেবে যে আসছে তাকে নিয়ে ভাবো। মনে রেখো, তোমার পাশে আমরা সবাই-ই আছি। ফুপু মন ম রা থাকলেও সে তোমাকে ঠেলে ফেলে দেবে না আপা। আর আব্বাও তা হতে দেবে না। তুমি তো জানোই, আব্বা বাহির থেকে শক্ত হলেও মনটা অনেক নরম। তুমি থাকলেও আমাদের পারিবারিক ঝামেলা থাকবে। তুমি না থাকলেও থাকবে। অযথাই নিজেকে ছোট না ভেবে চুপচাপ শুয়ে ঘুমাও তো। ফুপু শুয়ে পড়েছে। দেখবে সকাল হলেই সব কিছু ঠিক লাগছে।”
দীক্ষা সত্যি সত্যি শুয়ে পড়ল।
বকুল ওর পাশেই বসে রইল। একটা হাত চুলের ভেতর দিয়ে আঙুল নেড়েচেড়ে বিলি কাটতে লাগল। আরামে ঘুম চলে এলো দীক্ষার। মনেই রইল না কোনো দুঃখ, ব্যথাবোধ। গভীর ঘুম রাজ্যে পাড়ি জমালো সে- নিজের অজান্তেই….
এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, ঘূনাক্ষরেও ভাবেনি শিশির। জামা-কাপড় প্রয়োজনীয় জিনিস, সবকিছু ছাড়াই তাকে আর তৃণাকে এভাবে বের করে দিতে পারল সায়েমা বেগম! শিশিরের মগজেই ঢুকছে না, আপন মানুষ গুলো তার সাথে এমন করতে পারল কি করে!
সকাল থেকে খাওয়া হয়নি। দুপুরের দিকে এক বন্ধুর বাড়িতে কোনো রকমে দু’জন খাওয়া দাওয়া করেছিল, তারপর আর পেটে কিছু পড়েনি। মানিব্যাগটাও আনতে পারেনি। সঙ্গে একটা টাকাপয়সা নেই। দুপুরের ওই বন্ধুর থেকেই দু’হাজার টাকা চেয়ে নিয়ে এসেছে। কাল একবার অফিস যেতে হবে। গত মাসের স্যালারিটা আরও কয়েকদিন পরে দেওয়ার কথা। কিন্তু কালকেই ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে চেয়ে দেখবে। এই মুহূর্তে পকেট ফাঁকা মানে ব্রেইন ও ফাঁকা। তার উপর তৃণাদ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কান্না- অসহ্য লাগছে শিশিরের। সেই সঙ্গে অসহায় ও লাগছে।
শিশির নিজের মনেই বলে উঠল,
—“একটা ভুলই করে ফেললাম তাই না বলো? আরও ভেবেচিন্তে আগানো উচিত ছিল। আমি তো ভেবেছিলাম এই ঝগড়া ঝামেলায় তোমার বোন চলে যাবে। সেখানে আমাকেই যে আমার মা…”
তৃণা কটমট করে তাকাল। তার দুটি চোখ বেয়ে উপচে পড়ছে অশ্রুজল।
—“আপনার মা আমার সঙ্গে এটা কেন করল? দোষ কি আমার একার?”
শিশির ভ্রু কুঁচকে বলল,
—“না আমারও আছে, তাই তো তোমার সঙ্গে আমাকেও বের করে দিলো।”
—“আমার সঙ্গে আপনাকে না বরং আপনার সঙ্গে আমাকে…এখন এই রাস্তায় কীভাবে দিন যাবে! আচ্ছা আপনার ব্যাংকে টাকাপয়সা কিছুই কি নেই? একটা ব্যবস্থা করুন না…”
টাকাপয়সা আছে, তবে তার পরিমাণ আহামরি না। এই মুহূর্তে সেটা বের করে খরচ করা মানে শেষ সম্বল টুকুও নষ্ট করা। তাই এই ব্যাপারে তৃণাকে কিছুই বলল না শিশির। ওরা বসে আছে একটা হাইওয়ে রাস্তার পাশে। সিমেন্ট দিয়ে বেঞ্চ তৈরি করা। তার উপরই দু’জন বসে আছে। তাদের সামনে দিয়েই শাঁই শাঁই করে ছুটে যাচ্ছে শত শত গাড়ি।
শিশির এগিয়ে বসল। সাহস করে এক হাত তৃণার পিঠের পেছনে নিয়ে আগলে ধরল। কেঁপে উঠল তৃণা। অদ্ভুত চোখে চাইলো শিশিরের দিকে।
সাহস পেয়ে শিশির তার দিকে আরও এগিয়ে এসে নরম গলায় বলল,
—“তুমি দুশ্চিন্তা করো না। তোমার সব দায়িত্ব এখন থেকে আমার। আমরা একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া করব। শুরুতে হয়তো খুব কষ্ট হবে কিন্তু স্ট্রাগল না করলে কোনো কিছুই এচিভ করা যায় না, তাই না? পারবে না তৃণা, আমার সঙ্গে এই স্ট্রাগল পিরিয়ডটা লড়াই করতে?”
তৃণা জবাব দিলো না। অসহ্য লাগছে তার। মাথা ধরেছে। একটা টাফনিল দরকার। এই মুহূর্তে সেটা চাইতে গেলে আবার নিজেরই কয় মাইল হেঁটে যাওয়া লাগবে, কে জানে। তারচেয়ে চুপ করে মাথাব্যথাটাকে কমানোর চেষ্টা করাই ভালো।
শিশির তৃণার বাহুতে শক্ত করে চাপ দিলো।
মুখ কানের সঙ্গে প্রায় মিশিয়ে বলল,
—“কি হলো, জবাব দিচ্ছো না যে? পারবে না হুম? আমরা সবাইকে ভুল প্রমাণিত করব। সবাইকে বুঝাবো আমরা আমাদের জন্যে বেস্ট ডিসিশনটাই নিছি। পারবে না তুমি? বলো…”
শিশিরকে ঠেলে সরিয়ে দিলো তৃণা।
দু আঙুল কপালে ঠেকিয়ে বলল,
—“জানি না। ভাল্লাগছে না। এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। এখন এই রাতটা কোথায় থাকব আমরা- সেটা ভাবুন। সারারাত নিশ্চয়ই এই রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে থাকা যাবে না, তাই না?”
শিশির জবাব দিলো না। তৃণার সরিয়ে দেওয়াটা কেন যেন তার ভালো লাগল না। হঠাৎ করেই মনে হলো, দীক্ষা কোনোদিন তাকে সরিয়ে দেয়নি। এই কথাটা কেন মনে হলো? শিশির মাথা ঝাড়া দিলো। যে চ্যাপ্টার বাদ তা নিয়ে আর ভাবতে চায় না সে। অস্থির ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে ধরাতে লাগল। বাতাসের কারণে বারবার নিভে যাচ্ছে গ্যাসলাইটের আ গু ন। শিশিরের চড়া মেজাজ আরও চড়ছে।
এর ভেতর তৃণা বলে উঠল পুনরায়,
—“কি হলো? আপনি জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন কেন? কোথায় যাব আমরা? এইভাবে এখানে আমি সারারাত বসে থাকতে পারব না। আপনি জলদি একটা ব্যবস্থা করুন। এই…শুনছেন…”
শিশির বিরক্তি স্বরে ঝাড়ি দিয়ে উঠল,
—“শুনছি তো। এক কথা কয়বার বলবা? চুপ করে বসে থাকো। পারলে ব্যবস্থা করব, না পারলে নাই। আমি যদি রাস্তায় থাকতে পারি, তাহলে তুমি ও পারবা। মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নাই।”
তৃণা জবাব দিতে পারল না। অবাক চোখে শিশিরের এই নতুন রূপ হতভম্ব হয়ে দেখতে লাগল।
দীক্ষার ঘুম ভাঙলো একটু বেলা করেই। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে তার। গত রাতেও একটা চাপা ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল তলপেটে, আজ তা নেই। সে চোখ খুলেও অনেকক্ষণ শুয়ে রইল। জানালার শিঁক গলে সোনালি রোদের আলো এসে পড়ছে ঘরের মেঝেতে। চারকোণা আকৃতির চিত্র আঁকছে তারা। সেদিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ভিজে উঠল ওর। অকারণেই, অজান্তেই!
বিয়ের পর এই প্রথম- শিশিরের মুখটা দেখা ছাড়া সকাল হয়েছে তার! যা ছাড়া মানুষের বাঁচতে বা বেঁচে থাকার কথা কল্পনা করতেও রাজ্যের কষ্ট হয়, তাই ছাড়া একদিন বেঁচে থাকতে হয় যুগের পর যুগ।
কি অদ্ভুত প্রকৃতির নিয়ম!
দীক্ষা উঠে পড়ল। জ্বালা ধরা চোখ নিয়ে বাইরে বেরোতেই দেখল চমৎকার সকাল। মিঠা মিঠা রোদে ভেসে যাচ্ছে আশপাশ। উঠোনের এক কোণে বড় মামা বসে রয়েছেন। এক হাতে দা- অন্য হাতে বাঁশের একটা টুকরো। গভীর মনোযোগে তাতে শান দিচ্ছেন তিনি।
দীক্ষা উঠোনে নেমে দাঁড়িয়ে বলল,
—“কী বানাচ্ছো মামা?”
বড় মামা তাকালেন,
—“বর্শা বানাই রে মা। আজকে মাছ ধরতে যাবো।”
—“তোমার বর্শায় মাছ মা রা পড়ে না মামা। কতবার ধরতে গেলে…”
—“আজকে দেখিস, মাছের চৌদ্দগুষ্টি ধরব। এমন বর্শা বানাচ্ছি না…”
মামার আগ্রহ চাপা ঝলমলে মুখ দেখে দীক্ষার মন ভালো হয়ে গেল। মামা এমন ভাব করছে যেন মাছ না ডাকাত ধরতে যাচ্ছেন…
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে ভাজা পেয়াজের গন্ধ।
দীক্ষা বলল,
—“বাকি সবাই কই?”
—“পুকুর ঘাটে গিয়ে দেখ। সবাই আছে। মাছ মা রা র প্রস্তুতি চলছে।”
একটা নীমের ডাল ভেঙে ওদিকে হাঁটতে লাগল দীক্ষা। কতদিন পর সকালটা শুরু হয়েছে মাটির কাছাকাছি। ভালো লাগছে দীক্ষার। খুব ভালো লাগছে। মনের ভেতর পাহাড় সমান ওজনের যে চাপটা ব্যথা দিচ্ছিলো তাকে, সেটা কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে। দীক্ষার একটা গান ধরতে ইচ্ছে করছে…
প্রজাপতি, প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা…
দূর থেকে একটা ছোট্ট হট্টগোল দেখতে পেল দীক্ষা। কাজল, বকুল, সেই সঙ্গে গত রাতের দেখা হওয়া ওই ছেলেটা- শান্ত দাঁড়িয়ে আছে। শান্তর লুঙ্গি কোঁজা করে বাঁধা। গায়ে একটা পাতলা টি-শার্ট। চুল গুলো আজকেও খাড়া করানো। গায়ের রঙ অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর। রাতের আঁধারে বোঝা যায়নি। এখন বুঝতে পেরে খানিকটা চমকালোই দীক্ষা। কাছে এগিয়ে গেল।
শান্ত ভাব গলায় বলছে,
—“দে বালতি দে। ছোট্ট ছোট্ট পোলাপান নামবে নাকি মাছ ধরতে। তোরা মাছ চিনোস ঠিক কইরা? তাই তো মনে হয় না। এই আমারে দেখিস, নাইমা সাড়তে পারব না, মাছ হুমড়ি খাইয়া পড়বে। বলবে, আমারে আগে নেন শান্ত ভাই, আমারে আগে নেন।”
বকুল সলজ্জিত চোখে তাকিয়ে মুখ ভেংচে বলল,
—“আপনার খালি চাপা শান্ত ভাই!”
শান্ত খেঁকিয়ে উঠল,
—“কিসের চাপা? আমি শান্ত এক কথার মানুষ। কোনো চাপা চুপাতে নাই। বিশ্বাস না হইলে দুই মিনিট দাঁড়াইয়া দেখ। নামা মাত্র মাছ কেমনে পায়ের কাছে হুড়মুড়াইয়া পড়ে। দে কাজল, বালতি দে।”
কাজল বালতি এগিয়ে দিলো।
পুকুরের এক পাশ সেঁচে পানি কমানো হয়েছে। সেখানেই মাছ ধরা হবে। শান্ত বালতি হাতে নামবার আগে দীক্ষার দিকে তাকাল। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখ, চুলগুলো খোলা, এলোমেলো, চোখেমুখে উৎকণ্ঠা, আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সেও- শান্ত মনে মনে আল্লাহরে ডাকল। ইয়া মাবুদ, ইজ্জত আর ফালুদা বানাইয়ো না গো মাবুদ। রক্ষা কইরো তোমার নাদান বান্দারে.. রক্ষা কইরো মাবুদ।
মাবুদ রক্ষা করলেন না।
অতিরিক্ত চাপা ওয়ালাদের মাবুদ রক্ষা করেনও না।
শান্ত নেমে দু’পা ফেলতেই কাঁদার ভেতর ব্যালেন্স হারালো আচানক। এক পা বেশি দেবে গেল, আরেক পা দাবলো না। মাছ হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল কি না কে জানে, তবে শান্ত পড়ল। হুড়মুড়িয়ে উলটে পড়ল। হাতের বালতি
ছুটে প্রথমে আসমানে উঠল, সেখান থেকে প্লেনের মতো সোজা নিচে… শান্তর জেল দিয়ে দাঁড়া করানো চুলের উপর। শান্তর মনে হলো, এই কাঁদা মাটির ভেতরই ডুবে যাক সে। তলিয়ে যাক আজ পুকুরের তলানিতে। পেছন থেকে ভেসে আসা তীক্ষ্ণ শব্দের খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি শান্তর চোখে পানি এনে দিলো। সেই সঙ্গে সামান্য অভিমান ও হলো মাবুদের উপর।
সে তবু কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল। মাথা থেকে বালতি সরাতেই কাজল আরও জোরে হাসতে লাগল। বকুল হাসছে না তবে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। আর দীক্ষা…সে হেসে কুটিকুটি। তলপেটে একটা হাত চেপে রেখেছে। আরেক হাতে গাছের গায়ে ধরেছে। তার হাসতে কষ্ট হচ্ছে তবু হাসি থামাতে পারছে না। শান্তর এত মন খারাপ হলো। তবু তা লুকিয়ে সে বলতে চেষ্টা করল,
—“আরে আমি তো এইটা ইচ্ছা করে করছি রে ভাই। মাছ গুলারে সারপ্রাইজ দিলাম। ওরা বুঝুক, কে নামছে পুকুরে।”
—“নামতে না নামতেই পুকুর লাড়াই ফেলছে।”
ঠোঁট টিপে বলল কাজল।
—“না শান্ত ভাই, সেই হইছে। আপনার সারপ্রাইজ ডাইভ টা সেই হইছে। আরেকটা দেন শান্ত ভাই। সারপ্রাইজ যত দিবেন ততই ভালো। প্লিজ রিকোয়েস্ট, আরেকটা দেন প্লিজ।”
শান্তর মেজাজ খারাপ হলো। একশোতে একশো চড়ল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আজকে তোরে যদি না চুবাইছি নাতির পোলা… আমার নাম ও শান্ত না!
(চলবে)
Share On:
TAGS: মৃধা মৌনি, সোনাডিঙি নৌকো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৭
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৯
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১২
-
সোনাডিঙি নৌকো গল্পের লিংক
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৬
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১০+ খন্ড অংশ
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৮
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ২
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৪