সোনাডিঙি_নৌকো (২)
মৃধা_মৌনি
ঢাকা শহরে একেবারে কোলাহলপূর্ণ রাস্তাঘাট সচরাচর পাওয়া যায় না। সবসময় যানবাহনের টুংটাং আওয়াজ লেগেই থাকে। মধ্য রাতে থাকে নেড়ি কুকুরের আর্তনাদ। তবে দীক্ষা-শিশির যে পথে হাঁটছে, সেই পথটি এই মুহূর্তে একেবারেই কোলাহল মুক্ত। রাস্তার দু’ধারেই বড় বড় দালান-কোঠা। তাদের সামনে আম-জাম-কাঠালসহ নাম না জানা আরও গাছ লাগানো রয়েছে। তারা বড় হয়েছে। ছায়া দিচ্ছে। যতবারই দেখে ততবারই মুগ্ধ হয় দীক্ষা। তবে আজ তার সেসব কিছুতেই খেয়াল নেই। বরং মন পড়ে রয়েছে শিশিরের দিকে। হাঁটতে হাঁটতেই আঁড়চোখে বারবার শিশিরকে দেখছে সে। অপরদিকে শিশির নাক বরাবর হেঁটে চলছে তো চলছেই। কিছুক্ষণ পর পর হাতঘড়িতে নজর বুলাচ্ছে। মানুষটার পাশে দাঁড়ানো দীক্ষার চেয়েও বাড়িতে ফেলে আসা দু’দিনের মেয়েটির জন্য এত টান অনুভূত হচ্ছে? বাহঃ
দীক্ষার চোখ ভিজে এলো। এতো ভোঁতা মন তার ছিল না কখনোই। আর এখন…ক্ষণে ক্ষণে ভেঙে আসে হৃদয়ের পাড়! সময় শিশিরের পাশাপাশি তাকেও কেমন বদলে দিয়েছে। দুর্বল করে দিয়েছে চিত্ত। ইশ…
দীক্ষা নিচু হয়ে চোখের কোণ মুছতে লাগল। আর ঠিক সেই সময়েই শিশির জিজ্ঞেস করে উঠল,
—“কাঁদছিস কেন?”
দীক্ষা চমকে তাকাল। বিস্মিত গলায় বলল,
—“কই?”
শিশিরের নিস্তরঙ্গ কণ্ঠস্বর, দায়সারাভাবে বলল,
—“দেখলাম তো, চোখে পানি।”
দীক্ষা মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলল ঠোঁটের কোণে। অভিমানী কণ্ঠস্বরে জানালো,
—“যাক…খেয়াল করিস তাহলে! আমি তো ভেবেছিলাম, আমার কোনো কিছুই তোর চোখে পড়ে না।”
এ কথার পিঠে কিছুই বলল না শিশির। হাত ঘড়িতে আবারও দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রাণহীন কণ্ঠে জানালো,
—“দশ মিনিট শেষ। এবার ফিরতে হবে।”
দীক্ষা জবাবে কিচ্ছুটি না বলে চুপচাপ ফিরতি পথ ধরল। শিশিরের হাতটা ছেড়ে দিলো। সামান্য দূরত্ব রেখে চুপ করে হাঁটতে লাগল। বুকের ভেতর অনেক গুলি প্রশ্ন হুড়মুড় করে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দীক্ষা বহু কষ্টে চেপে রেখে দিয়েছে তা। শিশিরকে কেন যেন প্রশ্ন গুলি শোনাতে বড্ড ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, যেটুকু সুঁতো আছে, তাও ছিঁড়ে যাবে তবে। কিন্তু এভাবেই বা আর কতক্ষণ? হৃদয়কে হাতের মুঠে চেপে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় বেশিক্ষণ?
বাসার পথেই এক সিরিয়ালে তিন-চারটি দোকান রয়েছে। সেই দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়াল শিশির।
—“কি হলো?”
জানতে চাইলো দীক্ষা।
—“আমার তো কিছু কেনা লাগবে না।”
বলল সে। শিশিরের চোখ-মুখ কেমন র ক্তি ম হয়ে উঠল। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায়ও ঘেমে উঠল অকস্মাৎ। গলা ঝেড়ে টানা স্বরে বলল,
—“বাড়ির সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে যাই।”
দীক্ষা কিছু বলল না। নীরবে চেয়ে চেয়ে দেখল শিশিরের কান্ড-কাহিনি। খুঁজে খুঁজে স্ট্রবেরি ফ্লেভারের আইসক্রিম নিলো দুই বক্স। দীক্ষার মনে পড়ে গেল একটা ঘটনা। তখন তার বিয়ে হয়নি। তৃণা ছোট। সম্ভব সিক্স বা সেভেনে পড়ে। বড় মামা শহর থেকে সবার জন্য ভালো মানের বক্স আইসক্রিম নিয়ে গিয়েছিলেন। যেতে যেতে আইসক্রিম গলে পানি। মা সেই বক্স গুলো ফ্রিজে রেখে কড়া গলায় বলেছিল, “চার ঘন্টা পর পাবি। তার আগে কেউ যদি ফ্রিজে হাত দেয়…তার খবর আছে!”
দীক্ষা হাত দেয়নি। আইসক্রিম খাওয়া নিয়ে কোনোকালেই তার চূড়ান্ত রকমের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা ছিল না। কিন্তু তৃণা বরাবরই চঞ্চল। সেই চার ঘন্টা অপেক্ষা করতে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। কত শত বার ফ্রিজের চারপাশে চক্কর কে টে ছিল। অবশেষে যখন সবাইকে বাটিতে করে আইসক্রিম দেওয়া হলো, তৃণা কেঁদে কেটে একশা। তার পছন্দের ফ্লেভার স্ট্রবেরি। সেই কোন কালে বড় মামাই খাইয়েছিলেন একদিন, সেই থেকে মুখে লেগে আছে। অথচ মামা এনেছিলেন চকলেট। সবাই খেলেও তৃণা খায়নি। শেষ পর্যন্ত মামা ওর জন্যই অনেক কষ্ট করে স্ট্রবেরি ফ্লেভারের ললি জোগাড় করেছিলেন।
ঘটনা এই মুহূর্তে কেন মনে পড়ল- দীক্ষা জানে না। কেবল জানে, তার হৃদয়ের ভেতর একটা কিছু নাড়া দিয়ে গেছে। ঝড়ের আগে আকাশ যেমন থম ধরে যায়- ঠিক তেমনই থম ধরে আছে মনবাড়ির প্রকৃতি। ঝড় উঠবে- দীক্ষা বুঝতে পারছে। সেই ঝড়ে সংসার নামক সম্পর্কটির খুঁটি মজবুত থাকে নাকি ভেঙে গুড়িয়ে ভেসে চলে যায় তাই এখন দেখবার বিষয়।
কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো তৃণা। যেন সে দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল তাদের ফিরে আসার। শিশিরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই দু’জনের চোখজোড়া সামান্য জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল। দীক্ষার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল না। নীরবে ভেতরে প্রবেশ করল সে।
ঝুমাও পড়া রেখে উঠে এসেছে। শিশিরের হাত থেকে প্যাকেটটি নিতে নিতে বলল,
—“কি এনেছিস ভাইয়া?”
শিশির সোফায় বসেছে ততক্ষণে। ওখান থেকেই বলল,
—“সবার জন্য আইসক্রিম। সবাইকে ডাক।”
এসবের ভেতরে দীক্ষা ধীরপায়ে নিজের রুমের দিকে এগোতেই তৃণা চাপা স্বরে বলল,
—“কই যাচ্ছিস আপা? আইসক্রিম খাবি না?”
দীক্ষা তাকাল। সেই তাকানোতে কি ছিল, তৃণা জানে না। কেবল তার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল।
তৃণা একবারও শিশিরের দিকে তাকাল না। কেবল শীতল গলায় ভরাট কণ্ঠে উত্তর দিলো,
—“স্ট্রবেরি ফ্লেভার আমার পছন্দ না। আর এই অবস্থায় আমি আইসক্রিম খেতেও পারব না। তোর জন্য এনেছে, তুই-ই খা।”
দীক্ষা ভেতরে চলে গেল।
তৃণা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একবার চাইলো শিশিরের দিকে। শিশির চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে নিজের দিকে ডাকল। যাবে না যাবে না করেও তৃণা এগিয়ে গেল।
জড়সড় হয়ে শিশিরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। শিশির পূর্ণ দৃষ্টিতে তৃণাকে লক্ষ্য করল। এই মেয়েটা কেমন যেন। মাত্র কদিনেই খুব কাছের হয়ে উঠেছে। এমনটাই লাগে শিশিরের কাছে। যেমনটা দীক্ষা ছিল একসময়, চঞ্চল, মেজাজী, খানিকটা খেয়ালীও বটে। সেই দীক্ষা আর আজকের দীক্ষার মধ্যে খুব একটা মিল খুঁজে পায় না শিশির…
দীক্ষা ছিল স্বাস্থ্য সচেতন, নিজের প্রতি সবসময় যত্নশীল একজন। নিজের জন্য যা ভালো হয় তাই করত। সবসময় নিজেকে গুছিয়ে সাজিয়ে রাখত। শিশিরের কাছে লজ্জাবতী গাছের মতো নুয়ে থাকত। দিনগুলো রঙিন লাগতো। আর আজকাল দীক্ষার নিজেকে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই, স্বপ্ন নেই, জীবনের প্রতি কোনো চাওয়া পাওয়াও নেই। নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার তাড়াও নেই। কেমন স্বাদহীন পানির মতো হয়ে গেছে জীবনটা। সেই জীবনে তৃণা এসে হঠাৎ করেই আবার রঙ ঢালতে শুরু করল। সকাল বেলায় পাখির কিচিরমিচিরের মতোই তৃণার খলখলে হাসিতে ঘুম ভাঙে তার। যখন আশেপাশে থাকে, সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখে চারপাশে থাকা সবাইকে। তাকে দেখলেই শত মন খারাপেও হাসি পেয়ে যায় শিশিরের। এমনকি যখন অফিসে প্রচন্ড কাজের ভীড়ে ব্যস্ত সময় পার করতে থাকে সে, তখনো তৃণার করা কিছু কিছু পাগলামি মনে পড়ায় হো হো শব্দে হেসে ফেলে শিশির… এ কি শুধুই ভালো লাগা নাকি তারচাইতেও বেশি কিছু? শিশির ইদানীং খুন চিন্তায় ভোগে। নিজেকে নিয়ে, দীক্ষাকে নিয়ে, যে আসতে চলেছে তাকে নিয়েও…
—“আপনি কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
ঠোঁট ভেঙে জিজ্ঞেস করে তৃণা।
শিশির চিন্তার গতিপথে লাগাম টেনে ধরে উত্তর দিলো,
—“উম না…একটু কাজের টেনশন আর কি।”
—“অফিস থেকে যখন বের হন, তখন কাজটাকে যেমন অফিসেই ফেলে আসেন সেভাবেই টেনশন টাকেও ফেলে আসার চেষ্টা করুন। বাড়ি আসবেন রিল্যাক্স মাথা নিয়ে, বুঝেছেন?”
হঠাৎ করেই দুষ্টু বুদ্ধির উদয় হলো শিশিরের মগজে। সে ঠোঁট চেপে ধরে দুষ্টুমির গলায় বলল,
—“না বুঝলে কি আবারও বুঝিয়ে দিবা নাকি?”
তৃণাও অল্পবিস্তর হাসি ফুটিয়ে তুলল,
—“কেউ যদি বুঝতে চায় কিছু, তবে তাকে বোঝাতে রাজি আছি।”
শিশির অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো। সেই চাহনিতে কেঁপে ওঠে তৃণার কিশোরী হৃদয়।
বাড়ির সবাই-ই চলে এসেছে ততক্ষণে। শর্মিলার আসতে একটু দেড়ি হলো। বাবুটা ছোট, ঘুমাবে করে কাঁদছিল এতক্ষণ, তাকে শান্ত করে তবেই আসতে হলো। সে এসে বসতে বসতে আশেপাশে দীক্ষাকে খুঁজল। শিশিরের একপাশে তৃণা, আরেকপাশে ঝুমা। তিনজন মিলে গুটুর গুটুর করে কি যেন গল্প করছে আর চাপা হাসি হাসছে। তাই দেখে শর্মিলার একটু খারাপই লাগল। কোথায় এই সময়টায় বউটাকে দুটো মিনিট আলাদা দেবে, তা না…
শর্মিলার ইচ্ছে করল এক্ষুনি এই মুহূর্তে তৃণা নামক বেয়াদব মেয়েটাকে চাবকে ধরে বাসা থেকে বের করে দেয়। কিন্তু যেখানে দীক্ষাই চুপ, সেখানে তার কিছু করার আছে? শর্মিলা বড় অসন্তুষ্ট মনেই এক চামচ আইসক্রিম মুখে দিলো।
ঘর অন্ধকার করে কপালের উপর হাত চাপা রেখে শুয়ে রয়েছে দীক্ষা। দু’চোখের কার্নিশ ঘেঁষে পানি গড়িয়ে বালিশের অনেকখানি ভিজে গেছে এতক্ষণে। ডাইনিংরুম থেকে সবার হাসি ঠাট্টার আওয়াজ আসছে কম-বেশি। সবচেয়ে বেশি আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে তৃণার। একটু পর পরই সে হা হা করে হেসে উঠছে। সেই হাসি বিষের মতো কানে বাজছে। দীক্ষার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে অবিরাম ধারায় পানি গড়িয়ে চলছে। একটা সময় ছিল, এক ফোঁটা পানি তার চোখ দিয়ে ঝরে পড়ার আগে শিশির তা আঙুলের ডগায় তুলে নিতো। তারপর কপট রাগী কণ্ঠে বলতো,
—“কাঁদছিস কেন? ম রে গেছি?”
তাই শুনে ঠোঁট উলটে আহ্লাদী হয়ে আরও কেঁদে ফেলত দীক্ষা। তখন সব ভুলে শিশির বুকে টেনে নিতো। সরি বলতো। মাফ চাইতো। কক্ষনো কষ্ট দেবে না- সেই প্রমিস করত। আর বলত, “সেদিন তুই কাঁদবি, যেদিন আমি থাকব না। তার আগ অবধি নো কান্নাকাটি, নো চোখের পানি ফেলাফেলি, আন্ডারস্ট্যান্ড?”
সত্যি তো, আজ দীক্ষার কান্নায় বাঁধা নেই।
শিশির তো নেই আজ। ওর শরীরটা বেঁচে রইলেও মন তো ম রে গেছে। এখন দীক্ষা কাঁদতেই পারে।
কেউ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। লাইট জ্বালালো। দীক্ষা চোখের উপর থেকে হাত সরালো না। এমনকি চোখ মেলে তাকালোও না। সে জানে, শিশির ঢুকেছে। এই বুনো গন্ধ একমাত্র শিশিরের শরীরের।
—“তোর কি শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলল সে।
দীক্ষা কোনো প্রকার জবাব দিলো না।
বাইরে কি সুন্দর বাতাস বইছে। অথচ জানালা গুলো আঁটকে ভারী পর্দা টেনে রেখেছে দীক্ষা। শিশির ব্যস্ত হাতে পর্দা সরালো। জানালা খুলে দিলো। বেলকনির দরজা খুলে আবারও দীক্ষার কাছে এলো।
—“কিরে কি হয়েছে? জবাব দিচ্ছিস না কেন? রাতে ভাত খাবি না? ওষুধ আছে তো। দীক্ষা, এই দীক্ষা।”
শিশির ধাক্কা দিতেই দীক্ষা হাত সরিয়ে তাকাল। শিশির চমকে উঠল। চোখজোড়া টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ঈষৎ ফোলাফোলা চোখ-মুখ। দেখে মনে হচ্ছে বড় কোনো ঝড় বয়ে গেছে ওর উপর দিয়ে।
শিশির চাপাস্বরে অস্ফুটে বিড়বিড় করল,
—“কি হয়েছে?”
দীক্ষা উঠে বসল। বসতে বসতেই ফেটে পড়ল প্রচন্ড ক্ষোভে এবং মানসিক যাতনায়। একটা কিছু যখন হৃদয়ের উপর পাহাড় সমান চাপ নিয়ে বসে, সেটিকে বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। খুব দ্রুতই হৃদয়ের আগ্নেয়গিরি ফেটে আ গু নের গলিত লাভা বেরিয়ে ধূলিসাৎ করে দেয় সবকিছু।
তেমনটাই হলো এখন। দীক্ষা চিৎকার করে বলল,
—“কি হয়েছে- জানিস না তুই? কিচ্ছু জানিস না, না?”
হতভম্ব হলো শিশির।
—“চিৎকার করছিস কেন দীক্ষা? হয়েছে টা কি? আমায় বল!”
—“হ্যাঁ বলব। সব বলব আমি। সবাইকে বলব। এই যন্ত্রণা একা আমি কেন ভোগ করব। তোকেও করতে হবে। আর সবাইকেও করতে হবে। যা গিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়। যা।”
—“দীক্ষা! বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু। কি হয়েছে ঠান্ডা মাথায় আগে বল। আর শান্ত হ প্লিজ। সিনক্রিয়েট করিস না।”
—“সিনক্রিয়েটের তুই কি দেখলি শিশির? আমি তোকে ভালোবেসেছি। আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছি। ঘৃণা করলেও সবটুকু দিয়েই করব।”
দীক্ষা নিজেই বিছানা থেকে নেমে এলো। দরজা খুলে সবাইকে ডেকে আবারও ভেতরে প্রবেশ করল। তৃণা সবার পেছনে, ভয়ে বুকটা ধুকপুক করছে তার।
শিশির চুপচাপ দীক্ষার আচরণ দেখছে। এবং কিছুটা বুঝেও গেছে, দীক্ষা কি করতে চায়। যাক, একদিক থেকে ভালোই হয় তবে। নিজের ভেতরেও যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব জন্মেছে, তা সবার সামনে এই সুযোগে নিয়ে আসা গেলেই ভালো। নতুন করে কাউকে কিছু বলতে হবে না। বোঝাতেও হবে না। তবে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে। সে দেওয়া যাবে। শিশির মনে মনে শক্ত রইলো। চোখ দিয়ে একবার তৃণাকে দেখে নিলো। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে! শিশির মনে মনে বলল, “তোমার কোনো ভয় নেই, আমি আছি।”
তারপর তাকাল দীক্ষার দিকে।
দীক্ষা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—“আপনাদের সবার সামনে আমি ওকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। ও যা বলবে সবাইকে সাক্ষী রেখে বলবে।”
শিশিরের মা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে অবাক গলায় বললেন,
—“কি হয়েছে ছোট বউমা! তুমি এমন করছ কেন?”
ঢুকল শর্মিলাও,
—“করার যথেষ্ট কারণ আছে আম্মা। তাই করছে। এটা আরও আগেই করা উচিত ছিল।”
—“আমি তোমার কথা বুঝতেছি না বড় বউমা। ও তো কাঁপতেছে। ওকে ধরো।”
শর্মিলা দীক্ষাকে এক হাত দিয়ে চেপে ধরল।
দীক্ষা টালমাটাল অবস্থায় থেকেই অশ্রুসিক্ত নয়নে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
—“তুই তো আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলি তাই না? কথা দিয়েছিল, সারাজীবন আমাকে এই ভালোবাসা দিয়ে মুড়িয়ে রাখবি। অনেক ঝৈ-ঝামেলা, ঝড়-ঝঞ্ঝা শেষে তোকে আমি বিয়ে করেছি তাই না? তাহলে সেইসব কিছু আজ মূল্যহীন হয়ে গেল কেন? ভালোবাসা হারিয়ে গেল কেন? আমার চেয়ে আমার বোন তোর কাছে দামী হয়ে গেল কেন? তোর মানিব্যাগে আমার ছবির বদলে তৃণার ছবি কেন? কেন শিশির, কেন? সবগুলো কেন’র উত্তর দিবি আজ তুই। সবার সামনে দিবি।”
উপস্থিত সকলের মাথাতে বাঁজ পড়ল যেন।
সবার চোখজোড়া ঘুরে গিয়ে পড়ল তৃণার উপর। আর তারপর শিশিরের উপর। একমাত্র শর্মিলাই চমকালো না। সে তো আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল এমন কিছু হবে। যাক…অবশেষে দীক্ষা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে বিষয়টাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
তৃণা এমনিতেই জড়সড় হয়ে ছিল এবার প্রায় গুটিয়ে গেল। পারছে না ফ্ল্যাট থেকে এক দৌড়ে বাইরে কোথাও বেরিয়ে যেতে। কারো দিকেই চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই তার। বিশেষ করে শিশিরের মায়ের দিকে। এই মানুষটি দীক্ষাকে বড় পছন্দ করেন।
—“জবাব দে শিশির, একদম চুপ করে থাকবি না। আজকে তোর উত্তর দিতেই হবে। আমি একা একা এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবো, কেন? ভালো তো একা আমি বাসিনি। বিয়ে তো একা আমি করিনি। সংসার তো একা আমার না। তাহলে সবকিছুর ভোগ আমার একা পোহাতে হবে কেন? বল…বল তুই।”
দীক্ষা কাঁদছে। পাগলের মতোই কাঁদছে।
তাকে দেখে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না এই মুহূর্তে। শর্মিলা কোনো ভাবে ধরে রেখেছে। পাঁচ মাস চলছে ওর। এই অবস্থায় সামান্য এদিক ওদিক পড়ে ব্যথা পেলে সেটা মোটেই ফল ভালো হবে না।
দীক্ষার কান্না দেখে তারও কান্না পেয়ে যাচ্ছে।
দীক্ষার অসহায়ত্ব আজ তার হৃদয় ও নাড়িয়ে দিচ্ছে।
সেও শিশিরের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,
—“কি হলো, জবাব দাও না কেন। এসব কি বলছে দীক্ষা? উত্তর দাও।”
শিশিরের মা নিশ্চুপে কেবল হতভম্ব মুখে ছেলের দিকে চেয়ে রয়েছেন এই মুহূর্তে। কি বলবেন, বুঝতে পারছেন না। অপরদিকে যাকে নিয়ে এত কান্ড, সেই শিশির একেবারেই শান্ত, স্বাভাবিক। বিন্দুমাত্র বিচলতা নেই তার মধ্যে। হঠাৎ শিশির এগিয়ে গেল। দরজার ওপাশে থরথরিয়ে কাঁপতে থাকা তৃণার একটা হাত ধরে তাকেও ঘরের ভেতর নিয়ে এলো। দীক্ষা, শর্মিলা, শিশিরের মা, ঝুমা, প্রত্যেকে তার দিকে তাকিয়ে- শিশির কেবলমাত্র দীক্ষার চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
—“ওকে আমি পছন্দ করি দীক্ষা। যদি সুযোগ হয়, ওকে নিয়ে নতুন করে জীবনটাকে সাজাতে চাই। আর কিছু শুনতে চাস?”
—“শিশির!”
—“প্রেসার বাড়িয়ো না মা। আমি শুধু আমার মনের কথাটাই বলছি। দীক্ষাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি ঠিকই, কিন্তু ও কি আমার প্রেমিকা থেকে স্ত্রী হতে পেরেছে? একজন স্বামী তার স্ত্রীর কাছ থেকে কীরকম আচরণ প্রত্যাশা করে- ও কি তা জানে? ও সবসময় আমাদের সম্পর্কটাকে সেই আগের বন্ধুত্ব ভেবেই এগিয়ে গেছে। অথচ আমার অফিসের কলিগদের দেখেছি, আমার বন্ধুদের দেখেছি, তাদের ওয়াইফ কতটা সম্মান করে তাদেরকে। শ্রদ্ধা দেখায়, ভয় পায়। এসবই তো চায় একজন পুরুষ তাই না? অথচ দীক্ষা কেবল তুই তুই তুই… তাছাড়া ও বিয়ের পর একদম চেঞ্জ। নিজের প্রতি যত্নটা নিতেও ভুলে গেছে যেন! সবসময় এলোমেলো ভাবে যেমন তেমন হয়ে থাকে। নিজের লাইফের প্রতি নো ডেডিকেশন, নো ইম্পরট্যান্স! আমি এই দীক্ষাকে তো চাইনি। তবু মানিয়ে গেছি। দিনের পর দিন নিজেকে বুঝিয়ে গেছি। বাট আই এম সরি। একটা মাত্র জীবন আম্মু। সেটাকে এভাবে নষ্ট করে ফেলতে পারব না।”
হা হয়ে গেল দীক্ষা। কাঁদতেও ভুলে গেল যেন।
এসব শিশির বলছে টা কি! এই তুচ্ছ কারণে সে পরিবর্তন হয়ে যাবে? ভালোবাসা বদলে যাবে? অন্য কারো প্রতি মন আসবে? ভালোবাসা তবে এতই ঠুনকো? এতই সহজ!
শিশির ফের বলে উঠল,
—“আমি একজন বউ চাই আম্মু, বন্ধু না! প্রেমিকা না! এসব বিয়ের আগ পর্যন্তই ভালো লাগে। এরপর আর লাগে না। এখন এমন একজন কে চাই যার ভেতর আমার জন্য সম্মান থাকবে, শ্রদ্ধা থাকবে। আমি যা বলব তাই হবে। আমার উপর দিয়ে মাতব্বরি করবে না। আমি ক্লান্ত আম্মু, প্রচুর ক্লান্ত।”
শিশিরের মুখে কথাগুলো শেষ হতেই দীক্ষা নিশ্চুপে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখদুটো টলটল করছে, কিন্তু সে কান্না চেপে রাখল এবারে। গলায় স্বর কাঁপলেও প্রতিটা শব্দ যেন ধারালো কাঁচের মতো কে টে যাচ্ছিল সকলের ভেতর।
—“আমি তোকে কোনোদিন সম্মান করিনি, শ্রদ্ধা করিনি- এই কথাগুলো তুই কীভাবে বলতে পারলি, নিজেই ভেবে কূল পাচ্ছি না। এর উত্তরে আমি তোকে যে কি বলব, তাও বুঝতে পারছি না। তবে একটা জিনিস আজ বুঝতে পারলাম হাড়ে হাড়ে, সবাই পার্টনারের মধ্যে বন্ধু খোঁজে, এ কথাটা ভুল। কেউ কেউ তোর মতো শুধু একজন পার্টনারই খোঁজে…বন্ধু না।”
সে থেমে একটু নিঃশ্বাস নিলো, তারপর ধীরে ধীরে পুনরায় বলতে লাগল,
—“তুই জানিস? আমি তোর পর থেকে আর কাউকে মুগ্ধ করতে চাইনি। তোকে পেয়ে মনে হয়েছিল, আমার জীবনের সব পাওয়া এখানেই শেষ। তোর হাসিতে, তোর চোখে, তোর একটু যত্নে আমি এমন তৃপ্তি পেয়েছিলাম, যে নিজের রঙ হারিয়ে ফেলেছি তোর ভেতরেই। আমি ভেবেছিলাম- এইতো, এটাই জীবন। এই ভালোবাসাটাই চিরকাল থাকবে। আর আজ, সেই ভালোবাসাই নাকি তোর কাছে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কারণ! বাহ, ভালো বললি শিশির… সত্যিই বাহ! আমার ভালোবাসা তোকে এমন জায়গায় এনে ফেলেছে, যেখানে আমি তোর জন্য বোঝা হয়ে গেছি। আমি জানতাম না, এত কম দামি ছিলাম আমি।”
দীক্ষার গলা কেঁপে উঠল। দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল অবাধ্য হয়ে। সে হাতের উলটো পিঠে তা মুছে নিয়ে স্থির কণ্ঠে বলল,
—“তুই যা ঠিক ভাবছিস, কর। কিন্তু আজ থেকে মনে রাখবি একটা কথা- আমি কোনোদিন তোকে হারাতে চাইনি, বরং তুই-ই নিজেকে আমার থেকে সরিয়ে নিয়েছিস।”
কেউ কিচ্ছু বলল না।
সবাই চুপ। এমনকি শিশির ও মৌনতাকে গ্রহণ করেছে।
দীক্ষা বেরিয়ে যেতে চাইলো। এই ঘরে ওর দমবন্ধ হয়ে আসছে। তবে বেরোনোর মুখে তৃণার মুখোমুখি হতে হলো তাকে। তৃণা চোখ তুলে তাকাচ্ছেই না। কি সুন্দর অভিনয়- বাহ! দীক্ষার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। মা সবসময় বলত, তার ছোট মেয়েটা চঞ্চল হলেও মনের দিক দিয়ে সাদা। প্যাঁচ বোঝে না। অভিনয় কি জানে না। অথচ আজ যদি মা এখানে থাকত, তবে দেখত, তার ছোট মেয়েটার অভিনয় আজ বড় বড় অভিনেত্রীদেরকেও হারিয়ে দিয়েছে।
দীক্ষা হঠাৎ করেই একটা কাজ করে বসল। তৃণার জুবুথুবু মুখপানে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে একটা চ ড় মা র ল। এতই জোরে আর এতই অকস্মাৎ যে, তৃণা প্রায় টলে উঠল সেই চ ড় খেয়ে। উপস্থিত সকলেই চমকালো তবে কেউ কোনো কথা বলল না। কেবলমাত্র এগিয়ে এলো শিশির, হুড়মুড় করে।
—“কি করলি এটা!”
দীক্ষা জবাবে বিষদৃষ্টিতে তাকাল শিশিরের দিকে। তারপর একটিও কথা না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো মুহূর্তে। তৃণা নিঃশব্দে কাঁদছে।তার ফর্সা গালে দীক্ষার চার আঙুলের দাগ লালচে হয়ে ফুটে উঠেছে। সেই দৃশ্যটা দেখে শিশিরের বুকের ভেতরটা যেন ছিঁড়ে গেল। অথচ আশ্চর্য, তার জন্য যে মানুষটা নিজের স্বপ্ন, আশা, এমনকি পুরো জীবনটাই ভস্ম করে দিয়েছে- সেই মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়েও তার মনুষ্যত্বটুকু জেগে উঠল না। বিন্দুমাত্র করুণাবোধ ও তৈরি হলো না হৃদয়ের আদালতে!
(চলবে)
Share On:
TAGS: মৃধা মৌনি, সোনাডিঙি নৌকো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
সোনাডিঙি নৌকো গল্পের লিংক
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৮
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৬
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৫
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১২
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৪
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১০+ খন্ড অংশ
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১১
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৭