সোনাডিঙি_নৌকো (১১)
মৃধা_মৌনি
হাটি হাটি পা পা করে শীত যেন জেঁকে বসেছে এবার। এই পৌষের সকালে আকাশ থাকে ঘন কুয়াশার আবরণে ঢাকা, প্রকৃতি যেন গভীর অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। চারপাশের পরিবেশ জুড়েই থমথমে নীরবতা। গাছের পাতাগুলো ভিজে জবজবে, শীতার্ত কাকেরা অলসভাবে ডালপালায় বসে থেকে শুধু মাঝে মাঝে করুণস্বরে ডেকে উঠছে। এত ঠান্ডা! বেলা বারোটা পেরোলে তবেই একটুখানি সূর্যদেবের নরম আলোর দেখা মেলে, তাও যেন নিতান্তই দায়সারা উপস্থিতি।
এই হিমেল প্রকৃতিতে দীক্ষার বুকের ভেতরটাও আজ প্রকৃতির মতোই শূন্য, রিক্ত আর নিঃস্ব লাগে। চারদিকে কেবল শূন্যতা, আর সেই শূন্যতায় নিজেকেও শূন্য শূন্য লাগে। শীতকাল এলেই তার হুট করে মনে পড়ে যায় শিশিরের কথা।
শিশিরের শীতকাল বড্ড প্রিয় ছিল। কারণ, এই ঋতুতেই এক কম্বলের উষ্ণ আশ্রয়ে দু’জন গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা যেত অনেকক্ষণ। বাইরের হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ভেদ করে উষ্ণতার খোঁজে শিশির পুরো রাতটা দীক্ষার শরীরের ওঁমে ঢুকে তবেই ঘুমাতো, আর ফিসফিস করে করতো রাজ্যের দুষ্টুমি কথাবার্তা।
স্মৃতিগুলো আজ কাঁচের গুঁড়োর মতো বিঁধে রয়েছে হৃদয়ের দর্পণে। মনে পড়ে তাদের সেই ভোরবেলার আয়োজন- একসাথে গাছ থেকে নামানো টাটকা খেজুরের রস খেতে যাওয়া, শহরের কোলাহল ফেলে গোলাপ গ্রামের সুবিশাল বাগানে গোলাপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া, আর সকাল সকাল কনকনে জলে গোসল সেরে দু’জনে ছাদে গিয়ে মিষ্টি রোদে গা পোহাতে পোহাতে দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি করা। আহা! কত্ত কত্ত স্মৃতি!
দীক্ষার গর্ভকালীন জীবনের ছয় মাস পেরিয়ে সবে সাত মাসে পড়েছে। অথচ এই সময়ের ভেতর একবারের জন্যও শিশির তাকে ফোন করেনি, টেক্সট করেনি। দীক্ষা জানে, আর কোনোদিন হয়তো করবেও না। বরং তার চলে আসায় শিশিরের কাঁধ থেকে একটা বড়সড় ঝামেলা মুক্ত হয়েছে।
তবুও, অভ্যাসের বশে দীক্ষা শিশিরের আইডিটা সবসময় দেখে। তার গতিবিধি অনুসরণ করে। মাঝে মাঝেই অনলাইনে দেখা যায় তাকে, অল্প কিছু সময়ের জন্য। দিন পনেরো আগে শিশির একটি পোস্ট ও করেছিল,
“শূন্যতাই পরম পূর্ণতা।”
দীক্ষা বুঝতে পারে না, এই গভীর, রহস্যময় কথা দিয়ে শিশির আসলে কি বুঝাতে চেয়েছে! তার জীবনে কিসের শূন্যতা, যা এখন পূর্ণতায় রূপ নিয়েছে? নাকি দীক্ষার এই রিক্ততাই তার কাছে মুক্তি?
এদিকে, ও বাড়ি থেকে শিশিরের মা এবং তার ভাবী প্রায়শই কল করে। দীক্ষার আজকাল কিছুই ভালো লাগে না, তাই কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। তবু খালেদা বেগম বেয়াইনের সাথে দীর্ঘক্ষণ গল্প করেন, যেন তিনি তাদের দুই মাতৃ কষ্টের ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে চান। দীক্ষার তাদের প্রতি রাগ নেই, তার রাগ শুধু নিজের শূন্য ভাগ্যের ওপর। বুকের ভেতরটা কেবলই শূন্যতায় খা খা করে।
দীক্ষা আর ঘরের ভেতর থাকতে পারে না। তার মনে হয়, এই পূর্ণ ঘরটিও আজ তার শূন্যতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সে এসে উঠোনের দোড়ে দাঁড়াল। শীতল বাতাস এসে তার মনের অব্যক্ত বেদনাকে ছুঁয়ে দিয়ে যায়।
প্রকৃতির এই অলস দুপুরে উঠোনটা একদম ফাঁকা। দূরে নিমগাছের পাতাগুলো মাঝে মাঝে শনশন করে শব্দ করছে। শুনলে মনে হবে কারো ফিসফিসানি কথোপকথন! আর ঠিক তখনই, সেই নীরবতা ভেঙে দীক্ষা চাপা গলায় রমিলার ডাক শুনতে পেল। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে তিনি দীক্ষাকে তার কাছে ডাকছেন। দীক্ষার বুকটা কেন যেন ধক করে উঠল। ব্যস্ত পায়ে ছুটল সেদিকে।
জানালা ধরে দাঁড়াতেই রমিলা হাসি হাসি মুখে বললেন,
—“কেমন আছ গো মা?”
দীক্ষা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
—“ভালো আছি মামী। তুমি কেমন আছ?”
—“পাগল মাইনষের আর ভালো থাকা থাকি। তোমার মুখটা দেইখা তো মনে হইতেছে না তুমি ভালো আছ! মিথ্যা বললা?”
দীক্ষা মলিন ঠোঁটে হাসল। রমিলা চোখ সরু করে বললেন,
—“তোমার জন্মের পর তোমারে পরথম কে কোলে নিছিলো জানো? আমি নিছিলাম। আমার এই দুই হাতে তোমার ছোট্ট শরীলডা আমি যখন পরথম ধরলাম, আমার মনেই হয় নাই একটা মানুষের বাচ্চা ধরছি। এত ছোট আর এত নরম… আমার তো তখন পোলাপান হয় নাই। পোলাপানের মহব্বত কি বুঝিও না। কিন্তু তোমারে কোলে নিতেই আমার মনে হইলো তুমি আমারই সন্তান। আমার পেটের মাইয়া! তোমার নাড়িনক্ষত্র সব আমি জানি। আমারে মিথ্যা বইলো না। মনের কথা চাইপা রাইখো না। খুইলা দাও মায়ার বাঁধন। যে বাঁধনে খালি কষ্টের পাল্লায় ভারী হয়, সে বাঁধন আর কতকাল গিট দিয়া রাখবা?”
দীক্ষা মাথা নিচু করে ফেলল। দু’হাতে জানালার শিঁক চেপে ধরল শক্ত করে। তার সেই মুঠের উপর রমিলাও নিজের হাত দুটো রাখলেন। দীক্ষা আঁতকে উঠল। এত ঠান্ডা, শীতল স্পর্শ- যেন কোনো জীবন্ত মানুষের নয়। দীক্ষা এই প্রথম খেয়াল করল, রমিলার গায়ে কোনো গরম কাপড় নেই। বাইরে এত কনকনে ঠান্ডা!
দীক্ষা চিন্তিত স্বরে বলল,
—“সুয়েটার পড়ো নাই কেন? ঠান্ডা লাগবে তো।”
রমিলা মৃদু হাসলেন, সেই হাসিটা যেন এই শীতের সকালের নরম রোদের মতোই নরম এবং স্নিগ্ধ।
—“পাগল মাইনষের ঠান্ডা গরম বোধ থাকে না রে মা। তুমি কথা ঘুরাইয়ো না। আমার দিকে চাও।”
দীক্ষা তাকাল। রমিলার সেই স্থির, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দীক্ষার মনের গভীরে প্রবেশ করল।
—“বাইর কইরা দাও।”
—“কি?”
—“তারে বাইর কইরা দাও। মনের মইধ্যে তারে যে আসন দিছো, সেই আসনখান শূন্য কইরা দাও।”
দীক্ষা কিছু বলল না। নিঃশব্দে কেবল শুনতে লাগল।
রমিলা বলেই চললেন,
—“গিট খোলো। বাঁধন মুক্ত করো। বোকা নারী সাইজো না। প্রতারণার কোনো ক্ষমা হয় না, সেটা প্রেমেরই হোক বা বিশ্বাসের। মনে রাইখো, যে পুরুষ একবার নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়, সে আসলে যাওয়ার পথটাই নিজের জন্য স্থায়ী করে নিতে চাইছে।”
দীক্ষার দুই চোখ ভিজে ওঠে সহসা। সে মাথা নিচু করে হালকা কেঁপে উঠতেই রমিলা তার হাতের বাঁধনে ভরসা দিলেন। শক্ত কণ্ঠে বললেন,
—“আমি তোমারে দোয়া দিছি না, তুমি অনেক ভালো থাকবা? অনেক সুখে সুখী হইবা? তাইলে কিসের ভয় করো? খোদায় তোমার কপাল দিয়া এমন একজনকে দূরে সরাইছে, যে তোমার জীবনখান নষ্ট করে দিতে পারত। এখন তুমি মুক্ত। তোমার জীবন এখন তোমার হাতে।”
দীক্ষা মিনমিন স্বরে শুধালো,
—“জানি না মামী। মাঝে মাঝে নিজেরেই দোষ দিতে ইচ্ছে করে। মনে হয় যে, আমারই বোধহয় কমতি ছিল কোথাও না কোথাও। নাহয় কেন ও এভাবে… আমাকে একটা কল দেয় না মামী। আমার কথা ছাড়ো, ওর সন্তানটার কথাও ও…একটু কি মনেও পড়ে না মামী? মায়া কেবল আমার একারই? বিয়েটা তো সেও করেছিল। একদিনের জন্য হলেও তো ভালোবেসেছিল। একদিনের জন্য হলেও আমি তার স্ত্রী ছিলাম! তাই না বলো? অথচ এই ভার… এই ভার শুধু আমার একার! কি ভাগ্য মামী!”
দীক্ষা নিঃশব্দে কপাল ঠেকায় জানালার শিঁকগুলায়। রমিলা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সেই শীতল স্পর্শে এক সমুদ্র স্নেহ মাখা যেন।
—“আহা রে মা! এইটাই তো নারী জনম। শোনো, এই জগতে মায়া কেবল নারীরই ভূষণ, পুরুষের নয়। পুরুষের মায়া হলো সকালের শিশির- সূর্যের আলো পড়তেই শুকিয়ে যায়। আর নারীর মায়া হলো গভীর নদী- পথ হারানো মানুষ তার স্রোতে ভেসে চলে, কিন্তু নদীর গভীরতা কেউ দেখতে পায় না। তারা মায়ার বাঁধন বোঝে না। তারা শুধু সেই নদীর তীরের ফসল দেখে, কিন্তু নদী যে নীরবে তার নিজের সবটুকু দিয়ে যায়, সেই হিসেব কেউ রাখে না।”
রমিলার কণ্ঠস্বর এবার এক প্রাচীন বেদনার ভারে ভারী হয়ে এলো।
—“তুমি কেন নিজেকে দোষ দেও? তোমার তো কোনো কমতি ছিল না। কমতি ছিল তার ভালোবাসার গভীরতায়, তার দায়িত্বের ভারে। যে পুরুষ সন্তানসম্ভবা স্ত্রী কে ফেলে দিনের পর দিন নীরব,নিশ্চিন্ত থাকতে পারে, সে তোমার ভালোবাসার যোগ্যই ছিল না। সে নিজেই তো পূর্ণতা খুঁজেছে শূন্যতায়, তাকে তার পথেই থাকতে দেও।”
রমিলা থামলেন। দীক্ষার কাঁধের ভার যেন কিছুটা হালকা হলো।
—“এই যে তুমি ঘরে বসে আছ, চার দেয়ালের ভেতর কষ্ট চাপা দিচ্ছ… এইটা ভালো না। তোমার ভেতরে যে শিল্পীটা লুকিয়ে আছে, তাকে বের হতে দেও। তুমি যে হাতের কাজের কথা বলছিলা, সেইটা করো। দেখবা, তোমার সুই-সুতো যখন কাপড়ের উপর দিয়ে চলবে, তখন তোমার মনের কষ্টগুলোও সুতো হয়ে বেরিয়ে যাবে। হাতে কাজ থাকলে মাথাটা শান্ত থাকে, আর নিজের রোজগারের টাকায় যে স্বাধীনতা আসে, তার চেয়ে বড় সুখ আর নেই রে মা। সেটাই হবে তোমার আসল প্রতিশোধ।”
দীক্ষা তার মামীকে জড়িয়ে ধরতে চাইল, কিন্তু মাঝখানে জানালা থাকার কারণে পারল না৷ দীক্ষা অপ্রস্তুত হলেও রমিলা সামান্য হাসলেন।
দীক্ষা বলল,
—“আমি করব মামী। তুমি যেমন বললে, তেমনই করব। এইবার আমি সত্যি সত্যি স্বাধীন হব।”
রমিলা ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ করলেন। তার ঝলমলে হাসিটা দীক্ষার কানে যেন এক গভীর আশ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে এলো।
—“তাই করো মা। তোমার জন্য আমার দোয়া আছে। আর মনে রাইখো, এই বন্দী ঘর থেকে আমি তোমাকে সব সময় দেখতে পাই। আমি তোমার সাথে আছি।”
দীক্ষা একটু অবাক হয়ে বলল,
—“তুমি এত কিছু খেয়াল রাখো! তোমার নাকি মাথাটা আগের চাইতেও বেশি খারাপ হয়েছে। কিন্তু আমার তো মনে হয়, তুমি সুস্থ। তুমি বাইরে আসবা মামী? আমি তালাটা খুলে দেই?”
রমিলা মাথা ঝাঁকালেন,
—“দুনিয়ার আলো বাতাস সবের জন্যে না। কারো কারো জন্যে মাবুদ অন্ধকার তৈরি করছেন। আমি সেই একজন। আমার অন্ধকারই ভালো লাগে মা। আমি অন্ধকারেই বাঁচতেছি, অন্ধকারেই ম র ব। আলোতে তোমরা থাকো। আমি তোমাগো দেইখাই খুশি।”
রমিলা তার কথা শেষ করলেন। জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে ভেতরে খাটের উপর বসলেন। পিঠ জানালার দিকে দিয়ে, দীক্ষা তার মুখটা আর দেখতে পারছে না তাই।
—“কী হলো? আর কথা বলবেন না? আমার ভালো লাগছিল মামী।”
রমিলা প্রত্যুত্তর করলেন না। কেবল হাত উঁচু করে ইশারায় দীক্ষাকে চলে যাওয়ার জন্য বললেন। দীক্ষা সরে এলো। তবে তার মাথায় ঘুরতে লাগল মামীর বলা কথাগুলি। মনের গিঁট খুলতে হবে। মায়ার বাঁধন মুক্ত করতে হবে। কিছু একটা শুরু করতে হবে। সুই সুতোর কাজ- কথাটা ভালোই লাগল দীক্ষার। আঁকতে পারে সে। রঙ নিয়ে খেলেছে স্কুল-কলেজ জীবনে। কিন্তু সুতোয় ফোঁড় তোলা হয়নি খুব একটা। কিন্তু একবার চেষ্টা করা যেতেই পারে… যা রঙে ফোটানো যায়, তা সুতায় ফুটিয়ে তোলা যাবে না কেন?
—“এই দীক্ষা, এই।”
দীক্ষা থমকে দাঁড়াল, খালেদা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওকেই ডাকছেন। দীক্ষা যাচ্ছিল একটু পুকুর ঘাটের দিকে। ওখানে বসতে ভালো লাগে। অনেকক্ষণ ঘাটলার উপরে রোদের ছায়া লুকোচুরি খেলে। মায়ের ডাকে অগত্যা তাকে ফিরতে হলো।
—“কিছু বলবে?”
খালেদা বেগম ফোন বাড়িয়ে দিলেন,
—“বেয়াইন কথা বলতে চায়।”
কথাটা শুনতেই চোখ-মুখ শক্ত হয়ে উঠল ওর,
—“মা তুমি তো জানো…”
খালেদা মোবাইলে হাত চেপে ধরে চাপা কণ্ঠে বললেন,
—“একটু কথা বল। উনি তোর কথা সবসময় জিজ্ঞাসা করে। যা করছে শিশির করছে, ওর মা তো কিছু করে নাই।”
দীক্ষা ফোন ধরল।
সায়েমা বেগমের কণ্ঠ ভীষণ দুর্বল, আগের মতো শক্ত সবল নেই। দীক্ষার বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই ধক করে উঠল।
—“আম্মা, সব ঠিক আছে তো?”
সায়েমা বেগম দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন,
—“আমার উপরে এত রাগ করছিস মা! আমার সাথে এক মিনিট কথাও বলতে চাস না। অবশ্য আমি তো খারাপই। আমার পেট থেকেই তো একটা জা নো য়া র পয়দা করছি। তুই তো রাগ হবিই আমার উপরে…”
দীক্ষা তরল গলায় শুধালো,
—“আপনার উপর আমি রাগ হবো কেন? আপনি আমার মা। মায়ের উপর সন্তান কি রাগ হতে পারে? তাছাড়া আপনি আমারে যে স্নেহ করছেন, যে ভালোবাসা দিছেন, আমার জন্য নিজের পেটের সন্তানকে ছাড় দেননি- সমাজে আপনার মতো একজন শ্বাশুড়ি পেলে মেয়েদের আর কোনো চাওয়া পাওয়া থাকত না। শ্বশুর বাড়িটা ফুলের বাগান হয়ে যেতো। আমার সাত কপালের ভাগ্য ছিল, আমি আপনার মতো চমৎকার একজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, ভালোবাসা পেয়েছি। আপনার উপর আমার কোনো রাগ অভিমান নাই মা। আমার এমনিতেই কোনো কথাবার্তা বলতে ইচ্ছে করে না। কেন করে না, জানি না।”
সায়েমা বেগম একটু শান্ত হলেন। কান্না থামিয়ে গলা স্বাভাবিক করে বললেন,
—“তুমি কি আর আসবে না ছোট বউমা? আমার এই ঘরটা এমনই শূন্য হয়ে থাকবে? একসাথে হেসে খেলে কত বিকেল আমরা পার করতাম…সেগুলি কি আর ফিরবে না দীক্ষা?”
দীক্ষার অন্তর হু হু করে উঠল। চোখে জল চাপলো। না চাইতেও….অবাধ্য মনটা মুচড়ে উঠল এমন হাহাকারে। কি জবাব দেবে? মনটাকে এত পাথর করতে চায়, পারে না তো! ওকে সামলানো যে দিনকে দিন বড় দায় হয়ে যাচ্ছে।
সায়েমা বেগম উত্তর না পেয়ে ফের বলে চললেন,
—“যতদিন তুমি না আসবে ততদিন আমি শিশিরকেও এই বাড়িতে উঠতে দিবো না। এই পণ করেছি। আর বিশ্বাস করো, আমি আমার পণ রেখেছিও। ওর কোনো খোঁজ ও আমি করিনি। একদিন এসেছিল, বড় বউমাকে দিয়ে ওর সব জিনিস দিয়ে বিদায় করে দিয়েছি। ও আমার সুন্দর সুখের সংসারটা ভাঙলো, ওকে কি আমি এমনিতেই ছেড়ে দিবো? যতই আমার সন্তান হোক.. একজন নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় তো তার অস্তিত্বে… আজ তোমার দুঃখ আমি না বুঝলে আমার সেই অস্তিত্বকেই ছোট করা হবে। আমার একটা কথা রাখবে ছোট বউমা? তুমি ঢাকায় আসো। আমি শিশিরকেও ডাকাই। একটা সমাধানে তো আসাই উচিত আমাদের।”
দীক্ষা কোনোরকমে বলল,
—“আমি ওর মুখটা দেখতে চাই না।”
গলা ভেঙে যাচ্ছে ওর। এইটুকু বলতেও অনেক কষ্ট হচ্ছে। হবে নাই বা কেন, এই কথা তো ওর মনের না, ওর রুহের না। অন্তর তো আজও সেই অতীতের স্বপ্ন দেখে। সেই মুহূর্তগুলিতে হারিয়ে যায়। কিন্তু বিবেক যে তাকে ঝাঁকায়, বোঝায়- বাস্তবতা কত কঠিন!
সায়েমা বেগম বললেন,
—“কেন দেখবে না? তুমি কি এত কমজোর ছোট বউমা? ও যা করছে তার শাস্তি আমরা ওকে দেবো কেন? তুমি দিবে না? আর তোমাদের সন্তান.. আচ্ছা তোমার সন্তান- ওর কথাও তো ভাববে একবার। যদি বড় হয়ে ও আফসোস করে বলে, কেন তুমি আরেকটু চেষ্টা করলে না মা, কেন এত সহজেই হাল ছেড়ে চলে এলে, আমি তো বাবার আদরটাও পেতে পারতাম যদি তুমি আরও শক্ত হাতে সব আঁকড়ে ধরতে…তখন। তখন কি হবে দীক্ষা? একবার ভাবো…”
দীক্ষা চুপ হয়ে গেল। সায়েমা বেগম বলে চললেন,
—“এত কষ্ট করে যে সংসারটা গড়েছো তুমি, তা কি এত সহজেই ছেড়ে দেওয়া যায়?”
দীক্ষার বুক চিঁড়ে বেরিয়ে এলো,
“সারাটা জীবন ভালোবাসাকে একটা শত্রু দূর্গ ভেবে আক্রমণ করলাম, আর যখন দেয়াল ভাঙল, তখন দেখলাম দূর্গের ভেতরে তুমিই বসে আছো, অপেক্ষারত রাজা হয়ে…”
মুখ ফুটে এই শব্দগুলি উচ্চারণ করতে পারল না সে।
যুদ্ধটা করবে কার বিরুদ্ধে? শিশিরকে পাওয়ার জন্য শিশিরের সঙ্গেই যুদ্ধের ঘোষণা দেবে? হাস্যকর না!
দীক্ষার নীরবতা যেন সায়েমা বেগমকে অনেক গুলি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে এনে দিলেন।
তিনি এবার নরম গলায় স্নেহের সঙ্গে বললেন,
—“ঠিক আছে। আমি আর জোর করব না। তোমার সিদ্ধান্তই সব৷ যদি মনে হয়, একবার এসে তুমি শেষ চেষ্টা চালাবে, তবে আমি তোমার সঙ্গে আছি। আর যদি মনে হয়, সব শেষ, কোনোদিনই তোমার সঙ্গে এক কাপ চা খাওয়া বিকেল আর আসবে না, তবেও আমি তোমার সঙ্গে থাকব ছোট বউমা। মেয়ে মেনেছি, মুখে নয় অন্তরেও!”
দীক্ষার চোখ ভিজে এলো। টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল দুয়েক ফোঁটা। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখতেই খালেদা একটা হাত দীক্ষার কাঁধে রাখলেন।
—“কি করবি রে মা?”
দীক্ষা মায়ের দিকে তাকাল, কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল,
—“জানি না মা। কিচ্ছু জানি না। আমার বড্ড অসহায় লাগে জানো মা। কিচ্ছু ভালো লাগে না। এই সময়ে ওকে পাশে পাব, ওর সাপোর্ট পাব, ভালোবাসা পাব- এইটুকুই তো চেয়েছিলাম, না? খুব বেশি কিছু চাইনি তো। তবু ভাগ্যের এত কার্পণ্য আমায় দিতে!”
খালেদার বুকের ভেতর ঢুকে পড়ল দীক্ষা। কাঁধে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে চলল পরের অনেকটা সময়। খালেদা কিছুই বলতে পারলেন না। স্বান্তনা দেবার ও ভাষা নেই তার। তবে মনে মনে ভাবলেন, একবার তৃণার নাম্বারে ফোন করবেন তিনি। ওর মতো মেয়েকে কে টে গাঙে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, এই কথাটা ওকে শোনাবেন।
ভেতরের দেয়ালে জমে থাকা শ্যাওলা রঙের মতোই বিবর্ণ হয়ে এসেছে শিশির আর তৃণার সম্পর্কটা। এই এক মাসের পুরোনো ‘খুঁপরি’ বাড়িতে উঠে আসার পর থেকেই একটা শীতল কুয়াশা গ্রাস করেছে তাদের নিত্যদিন। কিন্তু সেদিনের সেই ঝড়ের পর এতই শীতলতা বিরাজমান চারপাশে যে, শিশির নিজেও জমে যাচ্ছে। চারপাশে তাকিয়ে আলো খুঁজলেও অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। শিশিরের চোখে তৃণা আজকাল এক অচেনা দ্বীপ, যেখানে পৌঁছানোর কোনো সেতু তার জানা নেই।
তৃণা এখন আর কথা বলে না। মুখ খুললেই দু’একটা আলগা শব্দ, কারও সঙ্গে মেশা তো দূর, ঘরের কোণে সে নিজেই নিজেকে নির্বাসিত করেছে যেন। রান্নাঘরের কাজগুলো এখন আর দায়িত্ব নয়, কেবলই এক খেয়ালিপনা হয়ে দাঁড়িয়েছে- করলে করল, না করলে নেই। তার এই উদাসীনতার আস্তরণ শিশিরের ভেতরেও এক জমাট নীরবতা সৃষ্টি করে। তার চাহনিতে মনে হয়, সে যেন বহুদূরের কোনো হারিয়ে যাওয়া ঠিকানায় নিজেকে খুঁজে বেড়ায়।
শিশিরের আর ভালো লাগে না এই প্রাত্যহিক যন্ত্রণা। নিজের ভেতরের গভীর ডিপ্রেশন তাকে গ্রাস করেছে, তার ওপর তৃণার এই অসহযোগিতা যেন কাঁটায় নুনের ছিটা। চোখের সামনে একটা মাস পেরিয়ে গেল, অথচ একটা কাজও সে জোগাড় করতে পারল না। বেকারত্বের চাপ আর সম্পর্কের এই বিষাদ-মাখা স্তব্ধতা তাকে আরও ক্লান্ত করে তোলে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিশির জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। বাইরের আবছা আলোয় ভেসে আসে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিরা। মনে পড়ে সেই উষ্ণ দিনের কথা, যখন দীক্ষা ছিল তার জীবনে। দীক্ষা… এক-দু’দিন করে আজ কতগুলো দিন পার হলো, তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। সত্যিই কি দীক্ষার সঙ্গে ভুল করেছিল সে? এই প্রশ্নটা আজকাল তাকে আরও বেশি করে দ্বিধায় ভোগায়। তৃণার কাছে সাপোর্ট না পেয়ে তার মন বারবার সেই পুরোনো নির্ভরতার দিকে ফিরে যেতে চায়।
এইভাবে কি জীবন চলে? শিশিরের মনে হয়, তারা দু’জনই যেন এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে হেঁটে চলেছে, যার শেষে কোনো আলোর রেখা নেই। তবে কি আর কোনোদিন গোছাতে পারবে না এই এলোমেলো জঞ্জাল হওয়া জীবনটাকে?
ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে তৃণা। চোখ দুটি আকাশের গায়ে বিদ্ধ। অমন হা করে কি দেখছে কে জানে। শিশির নিঃশব্দ পায়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল। নিজেও ক্ষণকাল আকাশের গায়ে উড়ে বেড়ানো মেঘপুঞ্জির দিকে নীরবে তাকিয়ে থেকে একসময় ডেকে উঠল মৃদু স্বরে,
—“তৃণা!”
তৃণা চমকে উঠল। খেয়ালই করেনি, কখন, কোন সময়ে তার পাশটা দখল করে নিয়েছে শিশির।
হকচকানো গলায় বলল,
—“আপনি?”
—“খেয়াল করোনি, না?”
তৃণা জবাব দিলো না। সন্তর্পণে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে আকাশের বুকে তাকাল পূর্বের ন্যায়।
শিশির তাই দেখে ক্লান্ত গলায় বলে উঠল,
—“আর কতদিন?”
তৃণা বুঝতে না পেরে চাইলো,
—“কি বললেন?”
—“আর কতদিন এভাবে? আমার সঙ্গে কথা বলো না। ঘর সংসার সামলাও না। একদিন রাঁধলে তিনদিন আর ধারে কাছেও যাও না। দিন ভরে ঘুমাও। রাত হলে জেগে বসে থাকো। কি হয়েছে তাও বলছ না। আমি তো একটা মানুষ, তাই না?”
তৃণা চুপ করে রইল। শিশিরের ইচ্ছে করল এই ছাদ থেকেই ধাক্কা দেয় ফেলে দেয় ওকে আর নইলে নিজে পড়ে যেতে। কি বিচ্ছিরি লাগছে এই জীবনটাকে!
—“আমার ধৈর্যের সীমা আছে তৃণা। আমিও র ক্ত মাংসে গড়া একজন মানুষ, ভুলে যেয়ো না। তুমি কি চাও? আমি তোমাকে বিয়ে করি, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে? তাহলে চলো, আজকে এক্ষন চলো, বিয়ে করব৷ পাঁচ লাখ কাবিন তো? ওকে, তাই হবে। কিন্তু আমি একটা সুন্দর পূর্ণাঙ্গ সংসার চাই। ব্যস!”
তৃণা অস্ফুটে বিড়বিড় করে উঠল,
—“আমি বাড়ি যাবো।”
শিশির শুনতে না পেয়ে কান পাতলো,
—“কি, কি বললে?”
—“আমি বাড়ি যাবো।”
এবার বেশ স্পষ্ট করেই উচ্চারণ করল সে।
শিশির অবাক হলো।
—“বাড়ি যাবে মানে! কেন?”
—“আমি আর এখানে থাকব না। আমার ভালো লাগছে না।”
—“তৃণা…”
—“আপনি আমায় গাড়ির টিকিট কে টে দিন, আমি একাই চলে যাব।”
—“পাগল হয়ে গেছ? তোমার মা তোমাকে উঠতে দেবে? তাছাড়া….”
শিশিরের কণ্ঠস্বর হঠাৎ ভার হয়ে উঠল,
—“দীক্ষা ওখানে আছে। ভুলে গেছ?”
—“ভুলিনি। কিন্তু ওটা আমারও বাড়ি তো! আপার ভাগ থাকলে আমারও আছে। দরকার হলে আমি গিয়ে আমার ভাগ চাইবো। সেটা বিক্রি করে আপনি একটা ব্যবসা বানিজ্য করবেন। আমাকে পড়াবেন।”
শিশিরের ভ্রু জোড়া কুঁচকালো এবারে। এই মেয়ে বলছে কি। পাগল হয়ে যায়নি তো?
তৃণা বলল,
—“আমার আর এখানে ভালো লাগে না। আমি অনেক দূরে কোথাও যেতে চাই। নতুন ভাবে শুরু করতে চাই সবকিছু। আপনার হাত ধরে যখন এসেছি, আপনার হাত ধরেই থাকব৷ কিন্তু ভালো ভাবে। এই ধুকে ধুকে যাওয়া… আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”
শিশির তৃণার দু’কাঁধে হাত রাখল,
—“তুমি কি বলছ? একবার ভাবছ? তোমার ভাগ চাইবে?”
—“চাইবো। বাবা আমাদের দু বোনের জন্য ব্যাংকে কিছু এমাউন্ট রেখে গেছেন। তাছাড়া আমার দাদা বাড়িতেও জায়গা আছে। সেটা এই মুহূর্তে না পেলেও ব্যাংকের টাকার ভাগ চাইবো। মা আমার বিয়ের জন্য আলাদা করে রেখেছেন। ওটাই নিবো আমি। ওটাতে তো আমারই হক, তাই না?”
কি বলবে শিশির, বুঝতে না পেরে চুপ করে চেয়ে রইল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে। তৃণা শক্ত কণ্ঠে বলল,
—“আমায় টি কি ট কে টে দিন। আমি আগামীকালকেই যেতে চাই।”
—“আমি আসব সাথে?”
—“না। আমার জন্য অনেক কিছু সহ্য করছেন, আর প্রয়োজন নেই।”
শিশির কিছুই বলল না এ কথার পিঠে। তৃণা ও কথা বাড়ালো না। আবারও চোখ ফেলল আকাশের বুকে। কি সুন্দর মেঘেরা উড়ে যাচ্ছে। যেন জীবনের প্রতিচ্ছবি। কোথাও রোদ তো কোথাও বৃষ্টি!
বাড়ির বারান্দার বাতিটা টিমটিম করে জ্বলছে। ঘরের ভেতর ছোটখাটো একটা পারিবারিক বৈঠক বসেছে।দীক্ষার মা, বড় মামা, দীক্ষা। কাজল এক কোণে নিঃশব্দে বসে আছে, আর বকুল দাঁড়িয়ে আছে দরজার ঠেকনায়, মুখে গম্ভীরতা জমে আছে তার।
দীক্ষা চুপচাপ বসে। তার চোখ দুটো যেন খালি। সামনে তাকিয়ে আছে, অথচ অন্য কোথাও ডুবে গেছে। মা আর মামার কথায় সে শুধু মন দিচ্ছে, কিন্তু নিজের ভেতরের ঝড় কারও সাথে ভাগ করতে পারছে না।
বড় মামা প্রথমেই গম্ভীর গলায় বললেন,
—“খালেদা, মাইয়া যদিও তোমার, কিন্তু দীক্ষা আর বকুল দুইজনেই আমার মাইয়া। আমি কোনোদিন তাদের আলাদা চোখে দেখি নাই।”
খালেদা বেগম শান্তস্বরে উত্তর দিলেন,
—“জানি ভাইজান। আপনি না থাকলে আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে এভাবে টিকতে পারতাম না। ওরা আমার মেয়ে দুটোকে গুরুত্ব দিত না, মানুষ করার মতো পরিবেশ ছিল না। তাই তো আমি আপনার কাছে উঠে এসেছি। আপনার স্নেহটাই আমার ভরসা।”
বড় মামা হালকা মাথা নেড়ে বললেন,
—“হুম… তাইলে একটা কথা কই। তৃণা যা করছে, সেইটা নিয়ে আমার বেশি বলার কিছু নাই। কিন্তু মেয়েটারে এইভাবে রাস্তায় নামায় দেওয়া ঠিক না। তুমি তারে ফোন দিও, বুঝাইয়া-সুঝাইয়া বলো—ঘরে আসুক। আর আসলে, বাকি দায়িত্ব আমার। আমি তারে ভালো জায়গায় বিয়া দিয়া দিমু। নাইলে ওর জীবনটাই নষ্ট হইয়া যাবে। শিশির বাবাজি ওরে কখনোই ঘরে তুলবে না, এইটা সেই মাইয়া বুঝতেছে না।”
খালেদা বিস্ময়ে বললেন,
—“তাহলে দীক্ষার ব্যাপারে আপনি…”
বড় মামা থামিয়ে দিয়ে বললেন,
—“দীক্ষা মায়ের ব্যাপারে আমি কিছু কমু না। শিশির যেটা করছে এইটার ক্ষমা নাই। কিন্তু আমার কথা হলো… ও যদি চান্স দেয়, অন্তত সামনে যে আসতেছে তার কথা একটু ভেবে নাহয়। জীবনে বাচ্চা আসলে পুরুষ মানুষ একটু একটু করে বদলায়। সংসারটারে ধরে রাখতে চেষ্টা করে। আর এইসব বদমাইশি তো ছেলে ছোকরাতে করেই। আজকালকার যে যুগ জামানা… এর ভেতর দিয়াই সংসার গুছাইয়া নিতে হয়।”
খালেদার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।
—“ভাইজান, যে একবার বিশ্বাস ভাঙে সে আবারও বিশ্বাস ভাঙতে পারে। আমি আমার মেয়েরে কোনো চাপ দেব না। ও যেটা ঠিক মনে করবে ওটাই করুক। আমি ওর পাশে আছি।”
মামার কণ্ঠ নরম হয়ে গেল।
—“আমিও আছি। কিন্তু বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ ভাবলে মাথা কাজ করে না। বাপ ছাড়া একটা বাচ্চারে বড় করা অনেক কষ্ট…”
সবাই একসাথে তাকাল দীক্ষার দিকে।
দীক্ষা তখনো নীরব। চোখে কোনো আলো নেই। যেন সে উপস্থিত থেকেও এখানে নেই।
ঠিক সেই মুহূর্তে বকুল কথা বলে উঠল, তার গলায় তীব্র ক্ষোভ আর বোনের প্রতি মমতা মিশে রয়েছে।
—“তোমরা কেউই আপারে এত চাপ দিও না। ওর ভেতরে কী চলছে আমরা কেউই বুঝব না। ও যা ঠিক মনে করবে ওইটাই হোক।”
বকুল থেমে যেতেই দীক্ষা গাঢ় শ্বাসে নিঃশ্বাস ফেলল। বড় মামার দিকে তাকিয়ে বলল,
—“আমি ঢাকায় যাব। শিশিরের সাথে মুখোমুখি কথা বলব। একটা প্রশ্ন আছে আমার। তার উত্তর শোনার পরই আমি সিদ্ধান্ত নেব… এই ভেঙে যাওয়া সম্পর্কটায় আর টানার মতো কিছু অবশিষ্ট আছে নাকি নেই।”
তার কথা শেষ হতেই ঘরটা যেন আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কিছু বলল না। শুধু অনুভূত হলো- একজন মেয়ের বুকের ভেতরে দীর্ঘদিনের স্তব্ধ যন্ত্রণা আজ প্রথমবার স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হলো। বাইরে তখন নিশি নামা রাত। দু একটা ব্যাঙ হঠাৎ করেই ডেকে ওঠে থেমে যাচ্ছে।
(চলবে)
Share On:
TAGS: মৃধা মৌনি, সোনাডিঙি নৌকো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১০+ খন্ড অংশ
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ২
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৯
-
সোনাডিঙি নৌকো গল্পের লিংক
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১২
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৫
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৭
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৬
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৩