মেঘেরওপারেআলো
পর্ব_৩৫
Tahmina_Akhter
— তুমি বেঁচে আছো। আমার তাতেই চলবে। ডাক্তাররা তোমাকে নিয়ে বেশী চিন্তিত ছিল।
মেঘালয়ের কথা শুনে আলোর অশান্ত হৃদয় শান্ত হয় না। আলোর নীরবতা দেখে মেঘালয় আলোর হাতটা ধরে বলল,
— আল্লাহ চাইলে আমরা আবারও বাবা-মা হতে পারব। মন খারাপ করলে কি লাভ হবে বলো? সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাদের কতটুকু ধারণা আছে বলো?
— তানিয়া ভাবির বাচ্চাটা?
আলোর প্রশ্নটি শুনে মেঘালয় বুঝতে পারল, তার কথাগুলো কতটা সুক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে আলো। মেঘালয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
— ভালো আছে। তানিয়া ভাবির ডেলিভারি ডেট তো খুব বেশি দূরে ছিল না। তিন সপ্তাহ পর ছিল। ভাবিকে ডেথ ডিক্লেয়ার করার পর বাচ্চার নড়াচড়ার টের পায় ইনায়া। তারপর, ডাক্তার সি-সেকশন করল। সাময়িক অক্সিজেন ঘাটতির কারণে বাবুর কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে গুরুতর সমস্যা নয়। ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে।
আলো চোখ বন্ধ করে রইল। তানিয়ার সঙ্গে কাটানো মূহুর্তগুলো ভাবছে। কখনো মনে হতো তানিয়া একজন বড় বোন। কখনো মনে হতো তানিয়ার কাছে আলোর কোনো ভ্যালু নেই। কিন্তু, শেষদিনগুলোতে আলোকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে আলোর সঙ্গে গুটুর গুটুর আলাপ করতো। আলো মনোযোগ দিয়ে শুনতো। কারণ, তানিয়ার তিক্ত বাক্যের মাঝে আলো প্রেরণা খুঁজে পেত। শক্ত কথার পেছনে কতটা অনুপ্রেরণা দিতো আলোকে তা একমাত্র সেই জানত।
আরও চারঘন্টা পর একজন নার্স এসে মেঘালয়কে অনুরোধ করে বলল, আলোকে উঠিয়ে যেন হাটাহাটি করাতে সাহায্য করে। এবং হালকা পাতলা খাবারও যেন খেতে দেয়া হয়। নার্স চলে যাওয়ার পর মেঘালয় আলোর মুখের সামনে ঝুঁকে মৃদু স্বরে বলল,
— আমার গলা জড়িয়ে ধরো। তুমি কোনো চাপ দেবে না শরীরে। আমি সামলে নেব।
আলো মেঘালয়ের গলা জড়িয়ে ধরল। মেঘালয় ধীরে ধীরে আলোকে উঠিয়ে বসালো। তারপর, অনুরোধ করল যেন সামান্য হাঁটাহাঁটি করে।
— ব্যাথা হচ্ছে অনেক। আমি পারব না।
আলো দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি বলল।
— দশ কদম হেঁটে এসো। আমি তোমার হাত ধরে রাখব।
মেঘালয়ের বাড়িয়ে দেয়া হাতের ওপর হাতটা রেখে আলো প্রথম কদম ফেলল। ব্যাথা সে কাতর হয়ে উঠল। মেঘালয় আলোর মুখের দিকে তাকালো না আর। আলোর কষ্ট ইদানিং সে সহ্য করতে পারে না। আলো দশ কদমের জায়গায় পনেরো কদম হেঁটে এসে বেডের ওপর বসল। এরমাঝে মাশফি এক গাদা খাবারের বক্স নিয়ে কেবিনে ঢুকল। মেঘালয় এগিয়ে গিয়ে মাশফির হাত থেকে বক্স নিয়ে রেখে দিলো বেডসাইড টেবিলের ওপর।
— কেমন আছো, আলো?
মাশফির আলোর দিকে না তাকিয়ে প্রশ্ন করল। আলো মাথা নীচু করে ফেলল। চোখের পানি টলমল করছে তার। কারণ, বড় ভাইয়ের মত মাশফির অবস্থা এখন তার চেয়েও বেশ শোচনীয়! মানুষটার স্ত্রী চলে গেছে না ফেরার দেশে। যেদিন রাতে স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দেয়ার প্ল্যান করলেন ঠিক সেদিন বিকেলে স্ত্রী চলে গেল। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে একটা মানুষের মৃত্যু কি মেনে নেয়া যায়?
আলোর নীরবতা দেখে মাশফি দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল না। কারণ, আলোর মনের অবস্থা এখন কেমন সবাই জানে? মাশফি উঠে দাঁড়ালো। মেঘালয়কে উদ্দেশ্য করে বলল,
— আলোকে খাইয়ে দিয়ে তুইও কিছু খেয়ে নে। ইনায়া খুব হসপিটালে গিয়েছে। ওকে দেখেই আমি বাড়িতে ফিরে গোসল করে, তোদের জন্য হোটেল থেকে খাবার নিয়ে ফিরলাম।
মা এবং সিতারা আন্টি কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসবে৷
— তুমি খেয়েছো?
মেঘালয়ের প্রশ্ন শুনে মাশফি মেকি হাসি দিয়ে বলল,
— দুদিন হতে চলল কিন্তু পেটের মধ্যে খুদা লাগছে না রে! মিলাদের দিন দুপুরে শেষবার যে তানিয়ার হাতে খাবার খেলাম। সেই খাবারের স্বাদ যেন এখনও পেটের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্যকিছু খাওয়ার কথা ভাবলেই মনে হয় আমার ঠোঁটের চারপাশে লেগে থাকা তানিয়ার হাতের শেষ স্পর্শ মুছে যাবে।
মাশফি দাঁড়ালো না আর চলে গেল। আলো নীরবে দু’ফোটা চোখের জল ফেলল। মেঘালয়ের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।
আলোকে কোনোমতে স্যুপ খাইয়ে দিলো মেঘালয়। আলো মেঘালয়কে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে, মেঘালয় আলোকে জানালো। সে এখন খেতে পারবে না। এরইমধ্যে নার্স এসে আলোকে ঔষধ খাইয়ে দিলো দুটো। নার্সের সাহায্য নিয়ে ধীরে ধীরে শুয়ে পরল আলো। মেঘালয় টুলের ওপর বসে রইল। আলো তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই মেঘালয় চোখের ইশারায় দেখালো ঘুমিয়ে পরতে। আলো চোখ বন্ধ করে ফেলল। মেঘালয় আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
— ঘুমিয়ে থাকলে যন্ত্রণা কম অনুভব করবে। শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে এখন মানসিক সমস্যা কাবু করে ফেলছে। আমি যদি পারতাম আমি ঘুমের ঔষধ খেয়ে দিনদুনিয়া ভুলে ঘুমিয়ে থাকতাম। আমার রাজপুত্রের কথা ভুলে থাকতে পারতাম। তোমার অসহায় দৃষ্টি ভুলতে পারতাম। আমার ভাইয়ের কষ্টকে ভুলে থাকতে পারতাম। কিন্তু, আফসোস পারছি না। এত কষ্ট, বেদনা, বিয়োগের অনুভব সবটাই অনুভব করছি।
সিতারা বেগম এবং মাহরীন এলো দুপুরের দিকে। তাদের দেখে মেঘালয় জানালো সে এখন বাড়িতে ফিরবে। মাহরীন ছোট ছেলের মুখের দিকে তাকালেন না৷ বড় ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন না গত দুদিন ধরে। বুড়ো মা বেঁচে আছে কঠিন অসুখ নিয়ে। অথচ, বড় ছেলে সুস্থ সবল স্ত্রীকে হারালো তাও কিনা সামান্য হার্ট এ্যাটাকের কারণে! আর ছোট ছেলেটা বাপ হতে গিয়ে পারল না। চলে গেল বাচ্চাটা। কি সুন্দর দেখতে হয়েছিল! মাহরীনের কলিজায় মোচড় দিয়ে ওঠে নাতির হিমশীতল শরীরটার কথা মনে পরলে।
মাহরীন আলোর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, “অসময়ের কালবৈশাখির ঝড় এসে তার সাজানো সংসারটাকে তছনছ করে দিয়ে গেল। কিসের অপরাধ? কোনের পাপের সাজা ভোগ করলে দুই দুইটা নিষ্পাপ প্রাণ?” জবাব খুঁজে পায় না।
মাশফির মেয়েটা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছে ঠিক দুদিন পর৷ পরদিন আলো হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ পায়। মাশফি মেয়েকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে বসে ছিল। ঠিক ও-ই সময় মাহরীন এবং মেঘালয় তার আলোকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। সিতারা এবং ইনায়া মাশফির সাথে ড্রইংরুমে বসে ছিল। তিনজনকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে তারা এগিয়ে যায়। মাশফির কোল থেকে বাবুকে কোলে তুলে নিলো মাহরীন। নাতনিকে বুকের মাঝে চেপে ধরল। হুট করে মাহরীনের বুকটায় কেমন ফাঁকাফাকা লাগছে।! তানিয়ার জন্য মনটা পুড়ছে বেশ।
সিতারা বেগম আলোর হাতটা ধরে বলল,
— কষ্ট হয়নি তো?
আলো মাথা নাড়িয়ে বোঝালো কষ্ট হয়নি।
মাহরীনের কোলে থাকা বাবুটার দিকে তাকিয়ে আলোর বুকটা হাহাকার করে উঠলো। ফাঁকা ফাকা লাগছে বুকের মধ্যে। বাবু হারানোর ব্যাথাটা আজ যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মেঘালয় আলোর মনের অবস্থা বুঝতে পারল।
সকলের চোখ আড়ালে আলোর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। আলো মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকালো। টুপ করে আলোর দুচোখের জল গড়িয়ে পরল। মেঘালয় আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাহরীনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— মা, আমি আলোকে নিয়ে ঘরে যাচ্ছি।
— সিঁড়ি বেয়ে উঠতে কষ্ট হবে না আলোর? তারচেয়ে বরং নীচতলার গেস্টরুমে কয়েকদিন থাকুক।
ইনায়ার কথায় সিতারা বেগম এবং মাহরীন সায় দিলেন। মেঘালয় আলোর হাত টেনে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মাহরীন, সিতারা এবং ইনায়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। সিঁড়ির সামনে গিয়ে মেঘালয় আলোর হাত ছেড়ে দেয়। আলো মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকায়।
মেঘালয় চট করে আলোকে কোলে তুলে নিলো। মাহরীন এবং সিতারা বেগম খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। ইনায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাশফি বাড়ির বাইরে উদ্দেশ্য যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরল।
মেঘালয়ের গলা দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল আলো। বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে রইল। মেঘালয় আলোর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে পা রাখার সময় মনোযোগী হলো।
মেঘালয় তাদের ঘরে প্রবেশ করল। আলোকে বিছানায় শুয়ে দিলো আস্তে করে। আলোর পাশে সেও টানটান হয়ে শুয়ে পরল। মাথার নীচে দুইহাত রেখে পাশ ফিরে তাকালো। আলো মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। দুই জোড়া চোখের দৃষ্টি বিনিময় হলো। মেঘালয় আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পলক ফেলতে ইচ্ছে করছে না৷ এত মায়া কেন এই মুখটায়? আলো মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ গত পাঁচদিনে মানুষটার চেহারার জৌলুশ হারিয়ে গেছে। দাঁড়ি ঘন হয়ে গেছে। বিয়ের সাতমাসের মধ্যে আজ একটা অভাবনীয় কান্ড ঘটিয়ে ফেলল আলো। হাত বাড়িয়ে মেঘালয়ের গালভর্তি দাঁড়িতে হাত রাখল। অস্থির ভঙ্গিতে তার চোখ দুটো কি যেন খুঁজছে মেঘালয়ের চেহারা মধ্যে। আলোর নরম হাতের স্পর্শে মেঘালয়ের হৃদয় নড়বড়ে হয়ে পরে। আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে জিজ্ঞেস করে,
— কি খুঁজছো?
— আমাকে খুঁজছি, ডাক্তার সাহেব।
আলোর জবাব শুনে ভীষণ অবাক হয় মেঘালয়৷ মেঘালয় আলোর কাছে সামান্য এগিয়ে যায়। আলোর বালিশে মাথা রাখল। দু’জনের মাঝে আজ সরিষা দানা পরিমান দূরত্ব নেই। মেঘালয় আলোর শরীরে ওপর এক হাত রাখল। তারপর, আলোর গলার মধ্যে মুখ গুঁজে রইল। আলোর শরীরে শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে। মেঘালয়ের তপ্ত প্রশ্বাস আঁছড়ে পরছে তার গ্রীবাদেশে। মেঘালয় ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করল আলোকে,
— আমার মাঝে তোমার অস্তিত্ব কতখানি খুঁজে পেলে?
আলো জবাব দিতে পারল না। কি জবাব দেবে? নাকি বলবে “আপনি আমার আত্মার সঙ্গে মিশে গেছেন, ডাক্তার সাহেব” আলোর চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পরল বালিশে।
চলমান……
Share On:
TAGS: তাহমিনা আক্তার, মেঘের ওপারে আলো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩২
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩৭
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১৪
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২৭
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১৭
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১৮
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৫
-
মেঘের ওপারে আলো গল্পের সবগুলো পর্বের লিংক
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২৯
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২১