মেঘেরওপারেআলো
পর্ব_৩২
Tahmina_Akhter
আলোর শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। পা দুটো অসাড় হয়ে আসছে। বিকট শব্দে আলোর কানের কাছ থেকে মোবাইলটা আঁছড়ে পরল মেঝেতে। সিতারা বেগম একপাশে জড়িয়ে ধরল আলোকে। আলোর শরীর ভয়ানকভাবে কাঁপছে। আলোর অবস্থা দেখে সিতারা ভয় পেয়ে যায়। আলোকে কোনোমতে টেনে নিয়ে যায় বিছানার কাছে। বিছানায় আলোকে বসিয়ে সিতারা বেগম ঘর থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ায়, কাউকে খবর দেয়ার জন্য। কিন্তু আলো হাত টেনে ধরাতে থমকে দাঁড়াতে হলো সিতারাকে। ঘাড় ফিরিয়ে আলোর দিকে তাকাতেই আলো কোনোমতে বলল,
— মা, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো। মনে হচ্ছে শরীর থেকে আমার রুহ বেরিয়ে যাচ্ছে!
সিতারা বেগম এবার নিজেই আতংকিত হয়ে পরলেন। আলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আলো খাটের ওপরে বসে থাকা অবস্থায় সিতারা বেগমের কোমড় জড়িয়ে ধরে রইল শক্ত করে। সিতারা বেগম আলোর মাথায় একহাত রেখে অন্যহাত দিয়ে উনার বাটন ফোন বের করে মেঘালয়ের নাম্বারে কল করলেন। মেঘালয় ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই সিতারা বেগম জানালেন,
“আলোকে হসপিটালে নিতে হবে। আলো কেমন যেন করছে, বাবা। আমার মেয়েটা যদি মরে যায়, আমি কি নিয়ে বাঁচব? “
মেঘালয় স্তব্ধ হয়ে গেছে। চারপাশ থেকে এত এত বিপদের খবর শুনে কেইবা সুস্থ থাকতে পারে! হসপিটালের ফরম্যালিটি পূরণ করে তানিয়ার লাশ নিয়ে বাড়িতে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করবে ঠিক তখনি আলোর খবর এলো।
— দশমিনিট আমার আলোকে দেখে রাখুন, মা। আমি আসছি। আমি আসার আগপর্যন্ত আপনি কোথাও যাবেন না। আ…মি আসছি।
সিতারা বেগম কল কেটে দিয়েছে। মেঘালয় পাগলের মত ছটফট করছে।
মাহরীন তাকিয়ে রইল স্ট্রেচারের ওপর সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা তানিয়ার মরদেহের দিকে। সকালে যেই মেয়েটা তার হাতের আলু পরোটা খাওয়ার বায়না করল, সেই মেয়েটা এখন নেই! মাহরীন ডুকরে কেঁদে উঠে।
তানিয়ার মৃত্যুর খবর শোনার পর মাশফি সেই যে তানিয়ার হাত ধরেছিল। এখনও সেই একই ভাবে হাত ধরে রেখেছে। একটু পরপর হাতের তালুতে চুমু দিচ্ছে। আর বলছে,
“তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, আমি। এই তানিয়া, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তোমাকে বলার সুযোগ কেন দিলে না? অভিমান করে চলে গেলে আমার ওপর? স্বার্থপরের মত নিজের দিকটা ভেবে আমাদের বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলে! এই তানিয়া, কিছু তো বলো? আমার ওপর রাগ করো, চেঁচামেচি করো আমি কিছু বলব না। বিশ্বাস করো। আমার কোনো অভিযোগ নেই তোমার প্রতি। শুধু তুমি ফিরে এসো।”
ইনায়া শুধু কান্না করছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো? এমন সময় হুট করে তানিয়ার পেটের ভিতর কি যেন নড়ে উঠল! ইনায়া প্রথমে বিশ্বাস করল না। কিন্তু, পরেরবার যখন নড়ে উঠল ঠিক তখনি ইনায়া স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা তানিয়ার নিথর দেহের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তানিয়ার পেটের ওপর কাঁপা হাতটা রাখল। এমন সময় ভেতর থেকে নড়চড়ে উঠল তানিয়ার অনাগত সন্তান। ইনায়া মাশফির হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
— ভাইয়া, বাবু নড়ছে। আপুর পেটে বাবু নড়ছে। ডাক্তাররা বুঝতে পারেনি হয়ত। এই নার্স? ডাক্তার? আমার আপুর বাবুটা বেঁচে আছে!
ইনায়ার চিৎকারে ভারি হয়ে উঠল হসপিটালের করিডর। আশেপাশের উৎসুক জনতা যেন ভারী আশ্চর্য হলে এহেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে।
মাশফি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। ইনায়া দৌঁড়ে যায় ডাক্তারের কাছে। মেঘালয় দৌঁড়ে যায় ইনায়ার পেছনে। ডাক্তার ইনায়ার কাছ থেকে এমন ঘটনা শুনে খুব বেশী সময় অপচয় করল না। বিশেষ করে মেঘালয়ের জন্য। তানিয়ার মরদেহে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন থিয়েটারে। মেঘালয় ডাক্তারদের পারমিশন নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে ঢুকল। এতকিছুর মাঝে মেঘালয় বেমালুম ভুলে আলোর কথা।
মাশফির চোখের জল থেমে গেছে। অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইনায়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ইনায়া মাশফিকে দেখে বলল,
— আপু তো চলেই গেছে ভাইয়া। সৃষ্টিকর্তার কাছে, দোয়া করুন যাতে আপুর শেষ চিহ্ন সুস্থ থাকে।
ইনায়া একমনে আল্লাহকে স্মরণ করছে। মাহরীন করিডরে পেতে রাখা সারিবাঁধা চেয়ার একটাতে বসে ইস্তেগফার পাঠ করছেন৷
মাশফি ইনায়ার কথা মত সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করার জন্য মসজিদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ঠিক তখনি ভেসে এলো, নবজাতক শিশুর প্রথম কান্না। মাশফির পা থেমে যায়। মাহরীন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ইনায়া চোখভর্তি জল নিয়ে হেসে ফেলল।
মাশফি দৌঁড়ে লাগাল সামনের দিকে পেছনে ফিরে তাকালো না। সোজা পা চালালো মসজিদের দিকে। মাহরীন মাশফিকে কয়েকবার ডাক দিলো। কিন্তু, মাশফি ফিরে তাকালো না।
মেঘালয় ঠিক পাঁচমিনিট পর অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হলো। কোলে মাশফির নবজাতক মেয়ে। ইনায়া মেঘালয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ইনায়া হাত বাড়াতেই মেঘালয় ইনায়ার কোলে তুলে দিলো তানিয়ার বাচ্চাকে। ইনায়া বাবুকে কোলে তুলে বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরল। মন থেকে একটা কথা প্রতিধ্বনি হচ্ছে ” আপু তোমার মেয়ে এসেছে। কোলে নেবে না তুমি? একটুখানি স্পর্শ করবে না?
ইনায়ার চোখের জল গড়িয়ে পরে বাবুর হাতের ওপর। মাহরীন উঠে এসেছে ততক্ষণে। ইনায়ার কোলে পদ্মফুলের ন্যায় ফুটে আছে মাশফি এবং তানিয়ার মেয়ে।
এমন সময় মেঘালয়ের মোবাইলে কল এলো। মেঘালয়ের টনক নড়ে। আলোর কথা মনে পরল তার এতক্ষণে। মেঘালয় কারো দিকে না তাকিয়ে দিকবিদিকশুন্য মানুষের মত দৌড়ে করিডর পেরিয়ে চলে গেল মুহূর্তের মধ্যে। মাহরীনের চারপাশে কি হচ্ছে এসব নিয়ে খেয়াল নেই। নয়ত, মেঘালয়ের এভাবে ছুটে যাওয়ার কারণ অবশ্যই জানতে চাইত।
মেঘালয় চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে একজন সিনিয়র ডাক্তার এসে ইনায়াকে জানালো, এনআইসিইউতে বাবুকে এডমিট করতে হবে। প্রিম্যাচুয়ার প্লাস তার মায়ের মৃত্যুর কারণে বাচ্চার মস্তিষ্কে অক্সিজেন ঘাটতির কারণে কিছু সমস্যার আশংকা করছেন তারা।
এসব শুনে মাহরীন ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— হায়াত-মউত সবই আল্লাহর হাতে ডাক্তার। তবুও, আমি চাইব আমার নাতনির চিকিৎসায় আপনারা কোনো কমতি রাখবেন না। আপনার কাছে আমার নাতনির সুস্থতা কামনা করছি আমরা।
তানিয়ার মেয়েকে এডমিট করা হলো। ইনায়া এবং মাহরীনের শুরু হলো এক অনিশ্চিত অপেক্ষার প্রহর৷
মেঘালয় কোনোমতে বাড়িতে পৌঁছালো। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো দুজন কাজের মহিলাকে। মেঘালয়কে দেখে একজন কান্না করতে করতে বলল,
— ভাই, আপনার বউটাকে আপনার শ্বাশুড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেছে একটু আগে। অবস্থা ভালো না। অজ্ঞান হয়ে গেছে তানিয়া ভাবির খবর শোনার পর। কি শুরু হইল এই বাড়িতে? কার নজর পরল? ভালো সুস্থ মানুষ একজন মইরা গেল। আরেকজনরে নিয়া এখন যমে টানাটানি করতাছে।
মেঘালয় স্তব্ধ হয়ে গেছে। পায়ের নীচে মাটি সরে গেছে যেন। আলো এবং তাদের অনাগত সন্তানের যদি কিছু হয় তাহলে মেঘালয় নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। চুলগুলো দুইহাত শক্ত করে চেপে ধরল। তৎক্ষনাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো। সিতারার মোবাইল নাম্বারে কল করল। প্রথমবার কল রিসিভ করল না। দ্বিতীয়বার কল রিসিভ করল। মেঘালয়ের কন্ঠস্বর পেয়ে সিতারা মিইয়ে যায়। কোনোমতে জানালো যে, আলোকে নিয়ে রয়েল হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। ব্যস, মেঘালয়ের এতটুকু তথ্য জানার প্রয়োজন ছিল। পরনের ওফ হোয়াইট পাঞ্জাবি অব্দি বদল করার সময় পেলো না। মেঘালয় কাব্যর বাইক নিয়ে যখন ছুটল হাসপাতালের দিকে ছুটে গেল তখন রাত এগারোটা। সারাদিনের অভুক্ত শরীরটার কথা বেমালুম ভুলে গেল সে।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর মেঘালয় ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারল
“আলোর কন্ডিশন ভালো নেই। ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেছে। প্যানিক এ্যাটাক হয়েছে। এই সময় এই ধরণের প্যানিক এ্যাটাক গর্ভের বাচ্চা এবং মায়ের জন্য ক্ষতিকর। সারারাত অবজারভেশনে রাখার পর রোগীর কন্ডিশন দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে “
মেঘালয় এবং সিতারা বেগম যেন মাঝ সমুদ্রে পরলেন। দূরদূরান্তে কোনো কূলকিনারা নেই।
মাশফি মসজিদে নামাজ আদায় করল। মোনাজাত করার সময় কান্নায় ভেঙে পরল সে। মসজিদের ইমাম অসময়ে কাউকে নামাজ পরার সময় কান্না করতে দেখে এগিয়ে এলেন। মাশফির পাশে বসলেন। মাশফি মোনাজাত শেষ করে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখতে পায়, মসজিদের ইমামকে।
— আপনি এভাবে কান্না করছেন কেন? আপনি কি জানেন? আল্লাহ আমাদের মনের গোপন সব কিছুই জানেন। তাকে মুখ ফুটে কিছুই বলতে হয় না!
— আমার আল্লাহ তো জানেন, আমি আমার তানিয়াকে কত ভালোবাসি! কিন্তু, তানিয়া যে আমাকে ভুল বুঝে চলে গেল! নিজের অবস্থান সম্পর্কে একবারও আমি সাফাই গাইতে পারলাম না ওর সামনে। আমাকে ভুল বুঝল। এক বুক অভিমান নিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে!
মাশফি কথাগুলো বলার সময় আবারও ডুকরে কেঁদে উঠে। ইমাম সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এমন স্বামী কি এখনও আছে? যে কিনা স্ত্রীর প্রস্থানে এভাবে কান্না করতে পারে! শোক প্রকাশ করতে পারে! ইমাম সাহেব মাশফির কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বলেন,
— আপনার স্ত্রী সৌভাগ্যবান। কারণ, “যে নারী এমন অবস্থায় মারা যায় যে তার স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” — তিরমিজি: ১১৬১।
ইমাম সাহেবের মুখে এই কথা শুনে মাশফি কান্নায় ভেঙে পরল। তানিয়া তার কাছে, একটা ভালোবাসা ভর্তি সংসার চেয়েছিল। একটু মাফ চেয়েছিল। ব্যস, এতটুকু চাওয়া পূরণ করতে পারল না সে। মাশফি তো দিতে চেয়েছিল। শুধু সময়ের অপেক্ষা করছিল। কিন্তু, কি থেকে কি হয়ে গেল? তানিয়া তাকে ভুল বুঝল।
–আচ্ছা ইমাম সাহেব এমন কি কোনো দোয়া আছে, যেই দোয়া করলে আমার আল্লাহ তানিয়াকে বলবে, তোমার মাশফি কেবল তোমাকে ভালোবাসে। দুনিয়ায় তোমাকে চেয়েছে এবং রোজ হাশরেও তোমাকে চাইবে। বলুন না ইমাম সাহেব, এমন কোনো দোয়া আছে? যেই দোয়া করলে আমার তানিয়ার হৃদয় ভর্তি কষ্ট কমে যাবে। অভিমান কমে যাবে। আমাকে যে ভুল বুঝল। তার ভুল ধারণা মিটে যাবে। এমন কোনো দোয়া আছে?
মাশফি মাথার চুলগুলো পাগলের মত টানতে টানতে কথাগুলো বলছে। ইমাম সাহেব স্তব্ধ হয়ে গেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না। আসলে কি বলে সামনে বসে থাকা এই মানুষটাকে তিনি স্বান্তনা দেবেন?
চলবে….
Share On:
TAGS: তাহমিনা আক্তার, মেঘের ওপারে আলো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩৯
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৩
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১৩
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৪০
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব (৮+৯+১০)
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১৯
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ২৭
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ৫
-
মেঘের ওপারে আলো পর্ব ১৮